Friday, March 29, 2024
Homeরম্য গল্পঅলক্ষুণে জুতো - মোহাম্মদ নাসির আলী

অলক্ষুণে জুতো – মোহাম্মদ নাসির আলী

'অলক্ষুণে জুতো' মোহাম্মদ নাসির আলী

অনেক কাল আগের কথা। আলী আবু আম্মুরী নামে একজন ধনীলোক বাস করত বাগদাদ শহরে। শহরের ওপরে তার যেমন ছিল একখানা চমৎকার বাড়ি, তেমনি ছিল যথেষ্ট টাকা-পয়সা। শহরে সবাই তাকে ধনী বলে জানত। কিন্তু বিদেশী কেউ হঠাৎ এসে তার জামাকাপড় দেখে মোটেই ধারণা করতে পারত না যে, লোকটা সত্যি ধনী।

তার পাড়া পড়শিরা প্রায়ই বলাবলি করতো : আলী আবু ধনী হবে না কেন? লোকটা নিজের জন্য একটি দিনারও ব্যয় করে না। চেয়ে দ্যাখো একবার ওর জুতোজোড়ার দিকে, তাহলেই বুঝতে পারবে ও ধনী হয়েছে কী করে। বলেই তারা হাসতে থাকত।

আলী আবুর পায়ের নাগরাই জুতো নিয়ে বাগদাদ শহরের শিশুরা অবধি হাসাহাসি করে। হাসবে না-ই-বা কেন? এমন একজোড়া পুরোনো জুতো সারা বাগদাদ শহরে কেউ খুঁজে পাবে না। কেউ কেউ বলে, ও একজোড়া জুতো পরে আলী আবু জিন্দেগি কাবার করে দিয়েছে।

কিন্তু একজোড়া জুতো কী করে এতদিন টিকতে পারে? হ্যাঁ, আলী আবুর জুতোর কোনো জায়গায় একটি ফুটো হলেই সে বেরোয় মুচির সন্ধানে।

বাগদাদের মুচিরাও তাকে চিনে ফেলেছে। তাকে দেখলেই তারা বলে ওঠে, ওতে আর তালি লাগানো চলবে না সাহেব, ওটা বাদ দিয়ে একজোড়া নতুন জুতো কিনুন।

আলী আবু কিন্তু সে কথায় কান দেয় না। সে আর এক মুচির কাছে যায়। এমনি করে ঘুরতে ঘুরতে কেউ হয়তো একটা তালি লাগিয়ে দেয়। এমনি করে আলী আবুর নাগরাই জুতো সকলের পরিচিত হয়ে উঠল। এমনকি বন্ধুরা একে অপরকে বলতে লাগলো, আলী আবুর নাগরাই জুতোর মতো তোমার পরমায়ু হোক।

কিন্তু অবশেষে সেই বিখ্যাত জুতোই আলী আবুর দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে উঠলো। শহরের রাস্তায় বেরিয়ে একদিন সে যাচ্ছিল এক কাচের শিশি-বোতলের দোকানের পাশ দিয়ে। দোকানি তাকে দেখে বলে উঠল, এই যে আবু ভাই, আপনার জন্য একটা খোশ-খবর আছে। বিদেশি এক সওদাগর এসেছে, অনেকগুলো আতরের শিশি বেচতে। চমৎকার রঙিন ফুলকাটা শিশি। মোটে ৫০ দিনার দাম। কিনে একমাস ঘরে রাখলে তার দাম কম-সে-কম একশো দিনার দিয়েই আমি নেব। আমার বদনসিব যে এখন একটি দিনারও হাতে নেই।

অমন লাভের লোভ কে সামলাতে পারে, সামলানো সহজ বিষয় নয়। আলী আবুর রাতদিন চিন্তাই হচ্ছে, কী করে টাকা বাড়ানো যায়। কাজেই সে তৎক্ষণাৎ রঙিন শিশিগুলো কিনে বাড়ি নিয়ে গেল।

দিনকয়েক পরে আরেক বন্ধু এসে খবর দিল, একটা লোক এসেছে বসরাই গোলাপজল বেচতে। চমৎকার জিনিস কিন্তু দাম একেবারে সস্তা। কিছুদিন পরেই এর দাম দুইগুণ-তিনগুণ হতে বাধ্য। আর তোমার সেই রঙিন শিশি ভর্তি করে বেচলে, চাই কি চারগুণও পেতে পারো। আহা কী গোলাপ!

টাকা বাড়াবার কী অমূল্য সুযোগ। যোগাযোগটা চমৎকার-রঙিন শিশি, তাতে গোলাপজল। আলী আবু ৫০ দিনার দিয়ে গোলাপজল কিনে নিয়ে এলো।

শিশিগুলো গোলাপজলে ভর্তি করে সে যত্ন করে রেখে দিল জানালা বরাবর একটা তাকের উপর। শিশি- বোতল রাখার পক্ষে এই জায়গাটাই তার বাড়িতে সবচেয়ে নিরাপদ।

অল্প কয়েকদিনের ভিতর দু-দুটো লাভের কারবার করতে পেরে আলী আবুর মন খুশিতে আটখানা।

সেদিন দুপুরবেলা সে শহরের হাম্মামে গিয়ে ঢুকল গোসল করতে। ঠিক সে সময়ে হাম্মাম থেকে গোসল সেরে বেরিয়ে আসছিল ওমর বিন আদি নামে তার এক বন্ধু। আলী আবুকে দেখেই সে বলে উঠলো, আস্‌সালামো আলাইকুম, আবু ভাই।

আলী আবু সাথে সাথে জবাব দিল। এমন সময় ওমরের নজর পড়ল আবুর জুতোর ওপর। ধনী বন্ধুর জুতোর এ দুর্দশা দেখে সে মাথা নেড়ে বলল, ভাই আলী আবু, তোমার তো মা-শাল্লাহ টাকা-পয়সার কমতি নেই। একজোড়া নতুন জুতো কেন তুমি কিনছো না ভাই? সারাটা বাগদাদ শহর খুঁজেও তোমার নাগরাই জুতোর শামিল আর একজোড়া জুতো কেউ বের করতে পারবে না। সত্যি বলছি, তোমার এ জুতোকে এবার পেনশন দিয়ে একজোড়া নতুনের ব্যবস্থা করা উচিত।

এই বলে ওমর বিন আদি মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে গেল। আবু কোনো জবাব না দিয়ে শুধু মুচকি হাসলো।

গোসল সেরে কাপড়-জামা পরে আবু বাইরে এসে দেখল, তার জুতোজোড়া জায়গামতো রাখা নেই। আসলে লোকের পায়ের ধাক্কায় দূরে এক বেঞ্চির তলায় দুখানা জুতো দুপাশে পড়ে আছে। আবুর পুরোনো জুতো যেখানে ছিল, সেখানে পড়ে আছে একজোড়া দামি চকচকে নতুন জুতো। চমৎকার জুতো, তাও ঠিক আবুর পায়ের মাপের।

আবু তখন মনে মনে ভাবল, আমার বন্ধু ওমরেরই এ কাজ। সে-ই নতুন জুতোজোড়া কিনে আমাকে উপহার দিয়ে গেছে। এজন্যই মাথা নাড়ছিল ওমর। প্রাণ খুলে বন্ধুকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবু নতুন জুতো পায়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেলো।

আসলে আবুর অনুমান কিন্তু মোটেই সত্য নয়। জুতোজোড়া ছিল শহরের কাজির। আবুর মতো তিনিও জুতো ছেড়ে হাম্মামে ঢুকেছিলেন গোসল করবার জন্য। বাইরে এসে কাপড় পালটাতে গিয়ে তিনি দেখলেন, জুতো নেই সেখানে। দেখেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, আমার জুতো কী হলো?

কাজির জুতো নিখোঁজ? খোঁজ খোঁজ সাড়া পড়ে গেল তক্ষুনি। চারদিকে খুঁজে পেতে অবশেষে পাওয়া গেল আলী আবুর রঙবেরঙের তালিওয়ালা সেই নাগরাই জোড়া।

সেই জুতো চিনতে কারও বাকি রইল না। তালিওয়ালা সেই জুতো বাগদাদ শহরের কে না চেনে?

এ জুতো সেই কমবখত আলী আবুর না হয়ে যায় না। আমার নতুন জুতো নিয়ে সে-ই পালিয়েছে। হাতে-নাতে এভাবে না ধরলে কে ভাবতে পারে যে, ব্যাটা জুতোচোর? ব্যাটাকে ধরে এনে আচ্ছা সাজা দিতে হবে আজ।

– বলে কাজি চিৎকার করতে লাগলেন।

তারপর লোকজনদের ডেকে পুরোনো জুতো পাঠিয়ে দিলেন আলী আবুর বাড়িতে। তারা গিয়ে দেখতে পেল, সত্যি সত্যি আলী আবুর পায়ে কাজির সেই নতুন জুতো।

আর যায় কোথায়? টানতে টানতে তারা বেচারা আলী আবুকে হাজির করলো কাজির দরবারে। কাজি রেগে বললেন, এক্ষুনি ওর পিঠে দশ দোররা মারো। মেরে নিয়ে যাও কয়েদখানায়। হাজার দিনার জরিমানা দিলে তবে ওর মুক্তি।

ব্যাপারটা যে ভুলবশত: হয়ে গেছে আবু তা বোঝাতে বারবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কে শুনবে তখন তার কথা। অবশেষে কেবল এক হাজার দিনার জরিমানা দিয়ে আলী আবু সে যাত্রা রক্ষা পেল।

বাড়ি ফিরে আসতে আসতে সে ভাবল, যে অপয়া জুতোর জন্য এতটা হয়রানি আর বেইজ্জতি, তার মুখ আর জীবনে দেখতে চাইনে। আজ বাড়ি গিয়ে ও-দুটোকে শেষ করতে হবে।

এই ভেবে আবু বাড়ি ফিরে তার নাগরাই জোড়া নিয়ে এলো নদীর তীরে। তারপর বাড়ি থেকে বেশ খানিক দূরে একটা পুলের ওপর দাঁড়িয়ে এক এক করে দু-পাটি জুতোই ছুঁড়ে ফেলল নদীতে।

কিন্তু সেদিন বিকালে ঘটল এক কান্ড। এক জেলে এসে নদীতে জাল ফেলতেই মাছের পরিবর্তে সশরীরে উঠে এল আবুর সেই বিখ্যাত নাগরাই জোড়া। হরেক রকমের চামড়ার তালি লাগানো জুতো চিনতে জেলের দেরি হলো না। সেবারের খ্যাপে জালে মাছ না উঠলেও সে কিন্তু মনে মনে খুশিই হলো। বাড়ি ফিরে বউকে বললো, আলী আবু ধনী মানুষ- এতদিনের জুতোজোড়া ফেরত পেলে কম করেও দু-দিনার বকশিশ নিশ্চয় দেবে।

দুঃখের বিষয়, জেলে যখন আলী আবুর বাড়ি জুতো নিয়ে হাজির হলো, তখন বাড়িতে কেউ ছিল না। ঘরের দরজাগুলো সব বন্ধ। শুধু একটা জানালা খোলা ছিল। তাও ছিল অনেক উঁচুতে। জেলে মনে মনে বললো, এই নিয়ে আর তকলিফ করে ফিরে যাওয়া যাবে না। তার চেয়ে জানালা দিয়ে ছুড়ে দিলেই আবু এসে তার জুতো পেয়ে খুশি হবে। পরে যখন দেখা হবে, তখন বললেই হবে যে, আমি পেয়েছিলাম ওটা। বকশিশটাও তখন চেয়ে নেয়া যাবে।

এই বলে জানালা দিয়ে জুতো দু-খানা ছুড়ে মারতেই সেগুলো গিয়ে পড়ল গোলাপজলের শিশির ওপর। তার ফলে তাকের সবগুলো শিশি মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল।

রাতে বাড়ি ফিরে আবুর তো চক্ষু চড়কগাছ। মাথা চাপড়ে সে কেঁদে উঠলো। আবার সেই অপয়া জুতোর কীর্তি। কী বদনসিবই হয়েছে আমার। আজই, এক্ষুনিই, এ অলক্ষুণে জুতোর হাত থেকে যে করেই হোক রেহাই পেতে হবে।

এই বলে বাগানের একপাশে দেয়ালের ধারে গিয়ে সে মাটি খুঁড়তে লাগলো। আঁধারে তখন কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু কাল ভোর অবধি অপেক্ষা করবার মতন মনের অবস্থা আবুর মোটেই নেই। চোর যেমন আঁধারে সিঁধ কাটে আবুও তেমনি আঁধারেই মাটি খুঁড়তে লাগল।

দেয়ালের পাশে শব্দ শুনে পাশের বাড়ির লোকেরা এলো আলো নিয়ে। এসে দেখল আবুর কান্ড। তারা বলল, এই তোমার কীর্তি! আঁধারে বসে দেয়ালের তলায় সুড়ঙ্গ কেটে আমাদের সর্বস্ব চুরি করার মতলব? চলো এক্ষুনি কাজির কাছে।

এবার কাজি তাকে দেখেই বলে উঠলেন, আবার চুরি ! কদিন আগে আমার জুতো চুরি করে জরিমানা দিয়েছ। এবার বুঝি বড় রকমের দাঁও মারবার মতলবে ছিলে?

এই বলে আবুকে কথা বলবার সুযোগ না দিয়েই কাজি তাকে কয়েদখানায় পাঠিয়ে দিলেন।

বাড়ি এসে সে ভাবল-দু-বার দু-হাজার দিনার জরিমানা দিয়ে জেল খাটার হাত থেকে রেহাই পেলাম। কিন্তু জুতোর হাত থেকে রেহাই না পেলে চলবে না। এই অলক্ষুণে জুতো বাড়ির বার করতেই হবে।

অনেক ভেবেচিন্তে এবার সে জুতোজোড়া ফেলে এলো নর্দমায়। বাড়ি ফিরে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো, এতদিনে সত্যিই রেহাই পেলাম। নর্দমায় কেউ জাল ফেলতে আসবে না।

পরের দিন ভোরে ঝাড়ুদার এলো নর্দমা পরিষ্কার করতে। এসে দেখলো একজোড়া ছেঁড়া জুতো আটকে নর্দমা বন্ধ হয়ে আছে। বলা বাহুল্য, জুতোর মালিককে চিনতে বেগ পেতে হলো না। ময়লা জুতোজোড়া সে আবুর বাড়ির দরজায় রেখে চলে গেল।

আবুর ঘুম ভাঙতে বাইরে এসে দেখলো, আবার সেই জুতো। আবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। এবার কী করবে তাই বসে সে ভাবতে লাগলো।

রাস্তা দিয়ে এক কুকুর যাচ্ছিল ছুটে। হঠাৎ আবুর বাড়ির কাছে এসেই থেমে পড়ল। তারপর মাটি শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে এলো জুতোর কাছে। এসেই একপাটি জুতো মুখে নিয়ে দে-ছুট।

অগত্যা আবুও ছুটল কুকুরকে তাড়া করে। ছুটতে ছুটতে সামনে পড়ল একটা দেয়াল। কুকুর দেয়াল টপকে যেতেই জুতোটা ফস্কে গিয়ে পড়ল দেয়ালের ওপাশে একটা ছোট ছেলের মাথায়। আবুর ভারী জুতোর ঘায়ে ছেলে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। বাড়িতে হইচই পড়ে গেল। সবাই এলো ছুটে।

তারপর আবার সেই কাজির দরবার। আবুকে দেখে কাজি রেগে উঠে বললেন, ছেলেটার চিকিৎসার সব টাকা তো দিতেই হবে, তাছাড়া সমপরিমাণ টাকা খেসারতও দিতে হবে।

বেচারা এবার কেঁদেই ফেলল। দুবার জরিমানা আর শিশির কারবারে লোকসান দিয়ে আবুর হাতে নগদ টাকা-পয়সা কিছুই ছিল না। তাই এবার তাকে ধাক্কা সামলাতে হলো বন্ধুবান্ধবের কাছে ধার করে।

এ ঘটনার দিন-দুই পরে আবু এসে হাজির হলো কাজির দরবারে। কাজি তো তাকে দেখেই অবাক। সেদিকে লক্ষ না করে তালি দেয়া জুতোজোড়া কাজির সামনে রেখে আবু বলল, এবার আমার ফরিয়াদ রাখতে হবে হুজুর। আমার এই জুতোজোড়ার বিরুদ্ধে ফরিয়াদ। এ অলক্ষুণে জুতোর কারণে আমার যা-কিছু দুর্ভোগ ঘটেছে, তা শুনে হক ইনসাফ কর, করে দোষীর সাজা দিন।

কাজি অবাক হয়ে চেয়ে রইল। লোকটা তামাশা করছে না কি! আবু আবার বলতে লাগলো, আমি সত্যি বলছি হুজুর। আমার বুড়োবয়সে সবকিছু দুর্ভোগের মূল ওই ছেঁড়া জুতোজোড়া। এ দুটোকে এমনভাবে কয়েদ করে রাখুন যাতে আমার নজরে আর না পড়ে।

এই বলে সে একে একে কাজিকে সব কথা খুলে বলল।

আবুর দুর্ভোগের কথা শুনে কাজির ভীষণ হাসি পেল। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, সত্যিই তুমি জুতোর বদৌলতে কষ্ট ভোগ করছ দেখতে পাচ্ছি। যাও তোমার জরিমানার টাকা সব ফেরত দেবার হুকুম দিলাম। তাছাড়া এ জুতো আর তোমাকে দেখতে হবে না।

কাজি সত্যিই দয়ালু ছিলেন। তিনি আবুর দু-হাজার দিনার সাথে সাথে ফেরত দিয়ে দিলেন। জুতোজোড়ার ভাগ্যে কী ঘটেছিল কেউ বলতে পারে না। কিন্তু আবুর পায়ে সেগুলোকে আর দেখা যায়নি।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments