Friday, April 26, 2024
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পঅন্য ভুবন - ডিউক জন

অন্য ভুবন – ডিউক জন

অন্য ভুবন - ডিউক জন

খুট করে একটা শব্দ হতেই ঘুমটা ভেঙে গেল ইশতিয়াক সাহেবের। ভদ্রলোকের ঘুম খুব পাতলা। তার ওপর একবার ঘুম ভাঙলে চোখ আর লাগতেই চায় না। একেবারে অন্ধকারে ঘুমাতে পারেন না তিনি। সে জন্য জ্বেলে রাখেন ডিম লাইটটা। লাল আলোতে ডুবে থাকে কামরা।

হরর ছবিতে দেখানো কফিনে শায়িত জিন্দা লাশের মতো চোখ মেলে তাকালেন। রক্তিম ঘোলাটে আলোয় পরিচিত কামরাটা কেমন রহস্যময় দেখাচ্ছে। কাঁপ ধরিয়ে দেয় বুকে।

শুয়ে থেকেই উৎকর্ণ হলেন।

আবার শোনা গেল আওয়াজটা। এবারে যেন ছেঁচড়ানোর শব্দ। খাটের তলা থেকে আসছে!

ভয়ে বুকটা আঁকড়ে এল তাঁর।

ভয় পাওয়াটা ইদানীং যেন রোগে পরিণত হয়েছে ইশতিয়াক সাহেবের। অল্পতেই চমকে ওঠেন।

এটার ব্যাখ্যাও অবশ্য রয়েছে। বেশি দিন হয়নি, হরর কাহিনির নেশায় মজেছেন। বই পড়েন, ভৌতিক সিনেমা দেখেন। মনের ওপর প্রভাব তো পড়বেই।

খুব একটা অফিসে যান না আজকাল। নিজের ব্যবসা। মাস চারেক আগে অকালে হারিয়েছেন স্ত্রীকে। তারপর থেকেই মনটন উঠে গেছে দুনিয়াদারির ব্যাপারে। তা-ও যদি নিজের ছেলেমেয়ে থাকত!

তবে বিশ্বস্ত ম্যানেজার আছে একজন। কাজী তৌকীর নাম। নামের মতোই কাজের কাজি লোকটা। সে-ই সামলায় ব্যবসা-বাণিজ্য।

কিন্তু কাজকর্ম না থাকার সমস্যা হলো সময় কাটতে চায় না। বই আর সিনেমা দিয়ে যতটুকু পারা যায়।

হররের পোকাটা মাথায় ঢুকিয়েছে ছোট ভাই ইফতেখার। ভূতপ্রেত বিষয়ে রীতিমতো বিশেষজ্ঞ বলা যায় ইফতিকে।

আচ্ছা, খেয়াল হলো ইশতিয়াক সাহেবের—একটা গল্প পড়েছিলেন খাটের নিচের পিশাচ নিয়ে, তাঁর খাটের তলায় ওরকম কিছু নেই তো?

আওয়াজটা হয়েই চলেছে। নিশুতি রাতে আক্ষরিক অর্থেই পীড়া দিচ্ছে কানের পর্দায়।

শুকনো, খসখসে গলায় ডাকলেন তিনি, ‘রাকিব…রাকিইইব…’

জবাব নেই।

রাকিব এই বাড়ির কাজের ছেলে। এমনিতে ভালোই, কিন্তু ঘুমালে স্রেফ মরে যায়।

ডাক দিলেন ইফতিকে। না, তারও সাড়া নেই কোনো।

ইশতিয়াক সাহেবের খেয়ালই নেই যে ঘরের দরজা এঁটে শুয়েছেন তিনি। ডাকাডাকির আওয়াজটা সেভাবে বেরোতে পারছে না বাইরে।

আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেলেন তিনি। ঠান্ডা ঘাম টের পেলেন কপালে। মনে পড়ল গেল হপ্তার ঘটনাটা।

একাকী বসে ছিলেন বারান্দায়। রাত তখন কত হবে? আটটা কি সাড়ে আটটা। ফুরফুরে একটা হাওয়া দিচ্ছিল দক্ষিণ দিক থেকে।

‘মাধবীলতা’ নামের এই বাড়ির কম্পাউন্ডটা গাছপালায় ঘেরা। বারান্দার আলোটা কম্পাউন্ডের অনেকখানি জায়গা আলোকিত করে।

একটা চালতাগাছ আছে মেইন গেটের বাঁ দিকে। সাদা সাদা ফুল যখন ধরে, অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুল হচ্ছে চালতা ফুল—এমনটাই মনে করেন ইশতিয়াক সাহেব।

গাছটার দিকে চোখ গেল তাঁর। আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে বারান্দা থেকে। নিচু এক ডালে সাদামতো কিছু একটা ঝুলে রয়েছে মনে হলো।

মোবাইলের টর্চটা জ্বাললেন তিনি। আলো গিয়ে সরাসরি পড়ল ঝুলে থাকা জিনিসটার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ধড়াস করে লাফ মারল হূিপণ্ড।

সাদা কাপড় পরা এক মেয়েমানুষ ঝুলছে গাছ থেকে! ফাঁস নিয়েছে গলায়! এমন বিশ্রীভাবে কাত হয়ে আছে ঘাড়টা যে বোঝাই যাচ্ছে ভাঙা। চোখ জোড়া বস্ফািরিত। জিবটা বেরিয়ে আছে মুখের এক পাশ দিয়ে।

মোবাইলটা পড়ে গেল হাত থেকে। বিকট এক চিৎকার দিয়ে ঘরের দিকে দৌড় দিলেন ভদ্রলোক। হাঁকডাক, চিৎকারে মাথায় তুললেন নিশ্চুপ ‘মাধবীলতা’।

রাকিব, ইফতেখার ও আশপাশের আরও দু-পাঁচজন পড়িমরি করে ছুটে এল কী গজব নাজিল হয়েছে চাক্ষুষ করার জন্য। গাছটার কাছে গিয়ে আলোটালো নিয়ে তদন্ত করল সবাই। নিজেও ভালো করে পরীক্ষা করলেন ইশতিয়াক সাহেব। কিচ্ছু নেই! অথচ স্পষ্ট দেখেছেন তিনি, ঝুলন্ত মেয়েটা তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছে!

রহস্যটা অমীমাংসিতই রয়ে গেল তাঁর কাছে। অন্যদের ধারণা অবশ্য পরিষ্কার, ভুল দেখেছেন ইশতিয়াক সাহেব।

তা-ও না হয় মানা যেত, তাই বলে পরপর দুবার ভুল দেখবেন?

হ্যাঁ, আরও একবার দেখেছেন তিনি মেয়েটিকে। এবার কিন্তু মৃত নয়, জ্যান্ত ছিল ‘লাশ’টা, গলায় দড়ির ফাঁস ঝুলিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিল কম্পাউন্ডে! পাগল ভাববে মনে করে কাউকে কিছু বলেননি ইশতিয়াক সাহেব।

আরেক রাতে কথা নেই, বার্তা নেই, কালো এক বেওয়ারিশ বিড়াল কোত্থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল গায়ের ওপর। ভয়ে তো তাঁর জ্ঞান হারানোর দশা।

সাহসে ভর করে মাথাটা খাটের কিনারে নিয়ে এলেন ইশতিয়াক হোসেন। উঁকি দিলেন নিচে। মুহূর্ত পরেই বরফ হয়ে গেলেন জমে।

কালো একটা হাত বেরিয়ে এসেছে খাটের তলা থেকে! তারপর আরেকটা। দীর্ঘ, সরু সরু আঙুলগুলোয় তীক্ষ নখ। মোজাইকের মেঝেতে কর্কশ শব্দ তুলে এবার দৃশ্যমান হলো মাথাটা। ঝাঁকড়া, কালো, লম্বা চুল মাথায়।

চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল ইশতিয়াক সাহেবের। আফ্রিকান ঢাক বাজতে লাগল বুকের ভেতরে।

ছেঁচড়ে প্রমাণ সাইজের খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে এল দেহটা। গাঢ় রঙের আঠালো কী যেন লেপ্টে আছে সারা গায়ে। নিশ্চয়ই রক্ত! লালচে আলোয় কালো দেখাচ্ছে।

মেঝেতে রক্তের দাগ রেখে দরজার দিকে এগোতে লাগল ওটা বুকে ভর দিয়ে। সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে আছেন, আচমকা ঘাড় ঘোরাল অনাহূত অতিথি। তীব্র, জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইশতিয়াক সাহেবের দিকে। নীরব অথচ ভয়ংকর হাসিতে বেরিয়ে পড়ল এবড়োখেবড়ো, চোখা দাঁতগুলো।

বুক চেপে ধরলেন ভদ্রলোক।

দুই.

সকালে চা দিতে এসে দরজা ধাক্কিয়ে যখন কোনো সাড়া পাওয়া গেল না, ইফতেখার ভাইকে ব্যাপারটা জানাল রাকিব।

পাড়াপড়শি কজনের উপস্থিতিতে ভাঙা হলো দরজা।

ঘরের মধ্যে মরে পড়ে আছেন ইশতিয়াক সাহেব। মুখ হাঁ। বুকের বাঁ দিকটা খামচে ধরা। নিথর, ঠিকরে বেরোনো চোখ দুটোয় অজানা আতঙ্ক।

পরীক্ষা করে রায় দিলেন ডাক্তার—হার্ট অ্যাটাক।

শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ল ইফতেখার। সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছে ইশতিয়াক সাহেবের ছোট ভাইটিকে। কিন্তু আপনজন হারানোর ক্ষতি কি সান্ত্বনায় উপশম হয়? যার গেছে, সে-ই কেবল বোঝে কী হারিয়েছে!

তিন.

নিঝুম হয়ে আছে বাড়িটা। মৃত্যুপুরী যেন। বসার ঘরের সোফায় গুম হয়ে বসে আছে ইফতেখার।

মেঝেতে বসা রাকিব খান প্রবল প্রতিবাদ জানাল মাথা নেড়ে। ‘না, ইফতি বাই, পনেরো আজারে অইব না। কম কইরা অইলেও তিরিশ আজার দেওন লাগব। আর জরিনা ম্যাডামও দশ আজারের নিচে মানব না।’

‘টাকা কি গাছে ধরে, যে ঝাঁকি দিলেই ঝরঝর করে ঝরে পড়বে?’ ঝাঁজিয়ে ওঠে ইফতেখার।

‘এত কতা বুজি না, বাই,’ রাকিবের এক গোঁ। ‘যেমুন কাম, তেমুন ট্যাকা।’

চুপ করে গেল ইফতি। ভাবছে, লক্ষ-কোটি টাকার সম্পত্তি আর বিশাল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার কিছুই না। কাজ হাসিল হয়েছে। এখন কিপ্টেমি না করাই ভালো। সাক্ষী যদি বিগড়ে যায়…

ভীমরতিতে পেয়েছিল ভাইজানকে। সহায়-সম্পত্তি সব বিক্রি করে হাসপাতাল বানাবে ভাবির নামে, স্কুল-মাদ্রাসা-বৃদ্ধাশ্রম করবে…

এসব যখন ওর সঙ্গে আলোচনা করছে, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ইফতেখার।

সদ্য বউহারা সরল-সোজা ভাইটাকে ভয়াল কাহিনিতে আসক্ত করা ছিল পরিকল্পনার প্রথম অংশ। দ্বিতীয় অংশে সাহায্য প্রয়োজন হয় রাকিব ছোড়াটার। ও-ই কোনো এক সার্কাস পার্টি থেকে ভাড়া করে এনেছে জরিনা নামের মেয়েটাকে। ঝুলন্ত লাশের দারুণ অভিনয় করেছে মেয়েটা। একবার শুধু হেসে ফেলেছিল। তবে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে এতে। রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছে।

এদিকে কোত্থেকে এক কালো বিড়ালও জোগাড় করেছে করিতকর্মা রাকিব খান। সবশেষে নিজেই ভূত সেজে বসে গেছে খাটের তলায়। ইফতেখারের জোগান দেওয়া নকল দাঁত, নকল নখ, পরচুলা পরা, ‘রক্তাক্ত প্রেত’টাকে দেখে আত্মা চমকে গেছে ইশতিয়াক সাহেবের।

মিশন শেষ হলে ফ্লোর থেকে ‘রক্ত’ মুছে ফেলে রাকিব। তারপর বেরিয়ে যায় অ্যাটাচড বাথরুমের খোলা ভেন্টিলেটর দিয়ে। হ্যাংলা-পাতলা বলে সমস্যা হয়নি তেমন।

ভাইয়ের উকিলকে পেট ভরে টাকা খাইয়েছে ইফতেখার। শিগগিরই নিজের নামে হয়ে যাবে দলিলগুলো।

চার.

ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে রেললাইন ধরে হেঁটে চলেছে রাকিব। এ পথ দিয়ে দুই কিলোমিটার এগোলেই ওর গ্রামের বাড়ি।

অনেক টাকা এসে গেছে পকেটে। এই টাকা দিয়ে গাঁয়ে একটা দোকান দেবে ও। বিয়েশাদি করে সংসারী হবে।

ট্রেন আসার শব্দ পেয়ে লাইনের পাশে নেমে গেল রাকিব। হাঁটতে লাগল আপন মনে।

একচক্ষু দানবের মতো ছুটে এল ট্রেনটা। ওটার চোখ ধাঁধানো আলো ফুঁড়ে দিয়েছে রাতের অন্ধকার।

ট্রেনটা যখন আর তিন হাত দূরেও নেই, কোনো এক অদৃশ্য হাত যেন ধাক্কা দিয়ে লাইনের ওপর ফেলে দিল ছেলেটাকে। চিৎকারটা পর্যন্ত দিতে পারল না হতভাগ্য রাকিব। তার আগেই…

পাঁচ.

আজকাল অনিদ্রায় পেয়েছে ইফতেখারকে। ঘুমের বদলে মৃত ভাইয়ের চেহারাটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে।

অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে থাকে ও। বাতাসে চালতাগাছের পাতা নড়ে ভূতের মতো।

সে রাতেও বসে ছিল বারান্দায়। কোথায় একটা বিড়াল ডেকে উঠল আচমকা।

কলজেটা কেঁপে উঠল ইফতেখারের। আওয়াজটা অবিকল মানবশিশুর কান্নার মতো।

তড়াক করে উঠে দাঁড়াল ও। তেষ্টা টের পেতে নিজের ঘরে গিয়ে পানি খেল এক গেলাস। আর দেরি না করে সোজা উঠে পড়ল বিছানায়।

অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করল। চোখটা কেবল লেগে এসেছে, তখনই শুনল খুট করে একটা শব্দ। মুহূর্তে তন্দ্রাটন্দ্রা টুটে গিয়ে সজাগ হয়ে উঠল পুরোপুরি। তীক্ষ হয়ে উঠেছে শ্রবণেন্দ্রিয়। আওয়াজটা মনে হয় খাটের নিচ থেকে এসেছে।

আরেকটা শব্দ হলো এবার। শুনলে মনে হয়, মেঝের ওপর দিয়ে কিসে যেন টানাহেঁচড়া করছে নিজের শরীরটা।

ভিতু নয় ইফতেখার। খাটের কিনারা দিয়ে নিচে ঝুঁকল ও। তক্ষুনি ওর হার্টবিট থামিয়ে দিয়ে একটা হাত বেরিয়ে এল খাটের তলা থেকে! পরক্ষণে আরেকটা।

ঝট করে উঠে বসতে চাইল ইফতেখার। কিন্তু শরীর বিশ্বাসঘাতকতা করছে তার সঙ্গে। অবশ হয়ে গেছে সমস্ত স্নায়ু।

হাতের সঙ্গে বেরিয়ে এল এবার মাথাটা। তারপর ধড়।

সাহস হারাল ইফতেখার। চিৎকারর করতে চাইল গলা ফাটিয়ে। কিন্তু না। জবানও আটকে গেছে ওর।

ঘাড় ঘুরিয়ে ভয়ার্ত যুবকের দিকে চাইল আতঙ্কটা। ডিম লাইটের নীলচে আলোয় চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে ওটার।

বাইরে বিদ্যুৎ চমকাল এমন সময়। ঝড়ের পূর্বাভাস। এক সেকেন্ডের জন্য দেখতে পেল ইফতেখার, ওর দিকে যে তাকিয়ে আছে, সে আর কেউ নয়—ওরই মৃত ভাই!

কিন্তু ইশতিয়াক সাহেবের চোখে কোনো জিঘাংসা নেই, আছে বোবা অভিমান।

ছলছলে সে দৃষ্টি সহ্য করতে পারল না ইফতেখার। তীব্র ব্যথা ঝিলিক দিয়ে উঠল বুকের বাঁ পাশটায়…

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments