Wednesday, April 24, 2024
Homeবাণী-কথাএকজন শৌখিনদার মানুষ - হুমায়ূন আহমেদ

একজন শৌখিনদার মানুষ – হুমায়ূন আহমেদ

সুলায়মানকে আজ বড় সুন্দর লাগছে।

আসমানী যতবার ছেলের দিকে তাকাচ্ছে ততবারই মমতায় তার চোখ ছলছল করে উঠছে। গলার কাছে শক্ত কি একটা দলা পাকিয়ে উঠছে। অথচ এ রকম হবার কোন কারণ নেই, সুলায়মান এমন কোন দূরে যাচ্ছে না। চার পাঁচ মাইল পথ। ইচ্ছা করলেই সে ছেলেকে দেখে আসতে পারে। আর ধরা যাক সে যদি যেতে না পারে সুলায়মানতো চলেই আসবে। তিনমাসের চুক্তি। তিনমাস কোন ব্যাপারই না।

সুলায়মান উঠানে একটা জলচৌকির উপর বসে ছিল। তার মুখ বিষণ্ণ। দেখলেই মায়া লাগে। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে ইচ্ছা করে। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলে ছেলে রাগ করে তারপরেও সকাল থেকে আসমানী বেশ কয়েকবার ছেলেকে আদর করেছে। শেষবারে সুলায়মান ঝটকা মেরে মায়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বলেছে–দিক করবা না। খবর্দার দিক করবা না।

আসমানী দুঃখিত গলায় বলেছে, রাগ করস ক্যান?

শইল্যে হাত দিলে ভাল লাগে না।

সুলায়মানের বয়স বারো। রোগা বলে তার বয়স আরো কম মনে হয়। বড় বড় চোখ, খাড়া নাক। গলার স্বরও চিকন। বাইরে থেকে দেখলে তাকে খুব নরম স্বভাবের। ছেলে বলে মনে হয়। মনে হয় সে চোখ মেলে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। কিন্তু মা’র সঙ্গে সে বড় খারাপ ব্যবহার করে। আসমানীর মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ হয়। তিন। মাসের জন্যে যে ছেলে চলে যাচ্ছে তাকে আদর করতে গেলে সে কঠিন হয়ে যাবে ধাক্কা দিয়ে মা’র হাত সরিয়ে দেবে এটা মনে হলেই চোখে পানি এসে যায়। আসমানীর চোখে পানি এসে গেলেও সে চোখের পানি সামলেছে। মা’র চোখে পানি দেখলেও ছেলে রাগ করে। কর্কশ গলায় বলে, ক্যান কান্দ? তার কর্কশ গলাটাও ঠিক কর্কশ শোনায় না। মিষ্টি গলার মানুষ কর্কশ কথা বললেও মিষ্টি শোনায়।

আসমানী আদুরে গলায় ডাকল, ও সুলায়মান।

সুলায়মান ঘাড় ঘুরিয়ে মা’র দিকে তাকাল। তার ভুরু কুঁচকে আছে–মনে হচ্ছে মা’র ডাকেও সে বিরক্ত।

রইদে বইয়া আছস। ছেমা’র মইদ্যে আয়।

দিক করবা না মা।

কার্তিক মাসের রইদ ভালা না। জ্বর হয়।

হউক জ্বর।

কিছু খাইবি বাপধন?

না।

নাইরকেল দিয়া মুড়ি মাইখ্যা দেই?

সুলায়মান হ্যাঁ না কিছু না বলে মুখ ফিরিয়ে নিল। সে খাবে কি খাবে না বোঝ যাচ্ছে না। আসমানী নারকেল কুরানি নিয়ে বসল। নারিকেল মুড়ি সুলায়মানের খুব প্রিয়। খেজুর গুড় থাকলে ভাল হত। ঘরে গুড় নেই। সুলায়মানের বাবা হাটে গেছে। তাকে খেজুর গুড়ের কথা বলা হয়েছে। আনবে কি আনবে না কে জানে। হয়ত আনবে। সুলায়মানের কথা বলে সে গুড় আনতে বলেছে। ছেলের কথা মনে করে সে হয়ত আনবে। তাছাড়া তার কাছে টাকা আছে। তিনমাসের চুক্তিতে সুলেমান কাজ করতে যাচ্ছে। অগ্রিম দুহাজার টাকা তাকে দেয়া হয়েছে। তিন মাসের চুক্তি শেষ হলে বাকি তিন হাজার টাকা পাওয়া যাবে। অনেকগুলি টাকা। মাত্র বার বছর বয়সে এতগুলি টাকা রোজগার সহজ কথা না। টাকা ছাড়াও ব্যাপার আছে। এই তিনমাস সুলেমান সুখে থাকবে। হাশেম মিয়া সুলেমানকে নিচ্ছেন। তিনি বড় শৌখিনদার মানুষ। তার কাছে সুলেমানের আদর যত্ন এবং খাওয়া-খাদ্যের অভাব হবে না। কাপড় চোপড়েরও অভাব হবে না। শৌখিনদার মানুষ সব ব্যাপারেই শৌখিন। সুলেমান থাকবে সুখে।

হাশেম মিয়ার গান বাজনা খুব পছন্দ। যৌবনকালে যাত্রার দলও করেছিলেন—নিউ সালেহা বানু অপেরা পার্টি। সালেহা বানু তার প্রথম স্ত্রীর নাম। যাত্রা দল বেশী দিন টেকে নি। তবে তার উৎসাহে কোন ভাটা পড়ে নি। যাত্রাদল না থাকলেও স্থানীয় গান বাজনার যে কোন দলকেই তিনি টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেন। গানের আসরে প্রয়োজনে তবলার ঠেকা দেন। ব্যাঞ্জো নামের একটা যন্ত্র তিনি একসময় বেশ ভালই। বাজাতেন।

শৌখিনদার মানুষ এইসব করবেই। এটা দোষের কিছু না। শৌখিনদার মানুষ না থাকলে সাধারণ মানুষরা বিনোদন পাবে কোথায়? সাধারণ মানুষের শখ আছে–শখের পেছনের অর্থ কোথায়? আসর সাজিয়ে হ্যাজাক বাতি জ্বালাবে শৌখিনদার, তারা শুধু গভীর বিস্ময় ও গভীর আনন্দ নিয়ে গোল হয়ে বসবে চারদিকে। বার বার রোমাঞ্চিত হবে।

হাশেম মিয়া তিন মাস সুলেমানকে নিজের বাড়িতে রাখবেন। এক ধরনের সাহায্য। গান বাজনায় সাহায্য। সাধারণ মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে এই জাতীয় সাহায্য তিনি প্রতি বছরই করেন। এবারো করছেন। গ্রামে ঘেঁটু গানের দল হয়েছে। ছয় জন বালক নিয়ে দল। ছয়জনের ভেতর তিনজন মেয়ে সাজবে। তিন কিশোরী ও তিন বালকের দল। এরা নাচবে, গান গাইবে। আসরের ভেতর জড়াজড়ি করবে, নানান অঙ্গ ভঙ্গি করবে।

অঙ্গ ভঙ্গিগুলি ভাল না। গানের কথাগুলিও ভাল না। তাতে কি? ঘেঁটু নাচের বিষয়টাই এ রকম। গভীর রাতে দেখতে ভাল লাগে। যারা দেখে তাদের বুকের মধ্যে এক ধরনের চাঞ্চল্য হয়। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। এইটাইতো মজা। ভাল ভাল মজার মধ্যে কিছু নোংরামী থাকবেই।

শৌখিনদার মানুষরা সাহায্য না করলে দরিদ্র গ্রামের পক্ষে এইসব দল করা সম্ভব না। হাশেম মিয়া ভালই সাহায্য করছেন। দু’টা ছেলেকে নিজের বাড়িতে খরচ দিয়ে রাখছেন। ড্যান্স মাষ্টারকেও রাখছেন। দশ হাজার টাকা তার গেছে শুধু ছেলে দু’টার জন্যে। ড্যান্স মাষ্টারের জন্যে তিন হাজার–সিগারেটের খরচ আলাদা। ড্যান্স মাষ্টার মকবুল খাঁ মাসে সিগারেটই খাচ্ছে হাজার টাকার।

.

নারকেল কোরা শেষ করে আসমানী উঠে দাঁড়াল। গুড় আসুক তখন ভালমত মেখে ছেলেকে খেতে দেবে। এখন সংসারের অন্য কাজকর্ম দেখতে হবে। সুলেমান ছাড়াও তার চারটা সন্তান আছে। বড়টা নেত্রকোনায় এক চায়ের দোকানে কাজ করে। মাসের শেষে সত্তর টাকা হাত খরচ পায়। আর দু’টা যমজ। বাড়িতে থাকে না। সারাদিন ঘুরে বেড়ায়, শুধু ভাত খাবার সময় উঁকি দেয়। ভাত সব সময় থাকে না। তারা তাতে বিচলিত হয় না, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে যায়। আসমানীর সর্ব কনিষ্ঠ সন্তানটিই মেয়ে। সে সারা বৎসর রোগে ভুগে। এখনও জ্বর উঠেছে। শুয়ে আছে বিছানায়। সুলেমানের ব্যাপারে সে অস্থির বলে মেয়ের খোঁজ সারাদিনে একবারও নেয়া হয়নি। জ্বর বেড়েছে কিনা সে জানে না। হয়ত বেড়েছে। বাড়লেও মেয়ে কিছু বলবে না। তার ছেলেমেয়েরা বড়ই লক্ষ্মী। শুধু সুলেমানের মেজাজ ভাল না। সে অল্পতেই রেগে যায়। চিৎকার চেঁচামেচি করে। তার স্বভাব চরিত্র অদ্ভুত।

আসমানী ছেলের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে ডাকল, ও সুলেমান।

সুলেমান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। আহারে কি সুন্দর চেহারা। কি সুন্দর চোখ। চোখের দিকে তাকালেই মায়ায় মনটা উদাস হয়। আসমানী বলল, কার্তিক মাসের রইদ বালা না রে বাপধন।

সুলেমান কিছু বলল না, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। আসমানী স্বস্তি বোধ। করল। সে ভেবেছিল ছেলে আবারো রেগে যাবে।

মুড়ি খাবি?

দেও।

গুড় নাই, খালি নাইরকেল আর মুড়ি।

আইচ্ছা।

আসমানী এক বাটি মুড়ি সামনে রাখল। সুলেমান মুড়ি চিবুচ্ছে। কুট কুট করে খাচ্ছে। আহারে কি সুন্দর লাগছে।

মা।

কি রে ময়না।

আমি বাড়িত থাকমু। গানের দলে যামু না।

আসমানী মনে মনে বলল, আইচ্ছা।

লোকে আমারে নিয়া কুকথা কয়, হাসে।

আমি বলব তোর বাপরে।

বলেই মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। উপায় নেই। সুলেমানকে যেতেই হবে। বায়নার দুহাজার টাকা নেয়া হয়ে গেছে। আরো টাকা আসবে। সংসার টাকাগুলির জন্যে হা করে আছে।

আসমানী ছেলের মাথায় হাত রাখল। ছেলে ঝটকা মেরে মা’র হাত সরিয়ে দিল। আসমানী সাহস পেয়ে ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। সুলেমান তখনো কিছু বলল। তার বড় বড় চোখ শুধু ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করল। আসমানীর মনে হল ছেলে তার কথা বিশ্বাস করে ফেলছে। সে হয়ত ভাবছে মা তাকে পাঠাবে না।

.

হাশেম মিয়া সুলেমানকে দেখে অত্যন্ত খুশী হয়েছেন। ঘেটু দলের জন্যে এরকম সুন্দর ছেলেই দরকার। ড্যান্স মাষ্টার সুলেমানকে মেয়েদের পোষাক পরিয়ে দিয়েছেন। ঠোঁট লিপস্টিক দিয়ে লাল টুকটুক করা হয়েছে। নারকেল মালা দিয়ে বুক উঁচু করা। সুলেমানের লম্বা চুল বেণী করা। বুক দু’টা কেমন উঁচু হয়েছে। আরেকটু কম হলে মানানসই হত। তবু সুন্দর লাগছে। খুব সুন্দর। এমন সুন্দর লাগছে যে চোখ ফেরানো যায় না। হাশেম মিয়া ড্যান্স মাষ্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন, গলা কেমুন?

গলা খুবই চমৎকার। সুলেমান, দেখি একটা গান শুনা।

সুলেমান রিনরিনে গলায় গান ধরল,

কোথায় তোমার ঘর বান্ধই
কোথায় তুমি থাক?
তোমার শাড়ির অঞ্চলে বান্ধই
কারে গোপন রাখ?

বলব না বলব না বান্ধই
আমার গোপন কথা।
শাড়ি খুইল্যা দেখামু বান্ধই
……. (মুদ্রণ যোগ্য নয়)

গান গাইতে গাইতে সুলেমান শাড়ি খোলার ভঙ্গি করল। হাশেম মিয়া বললেন, মধু মধু। কাছে আয়।

সুলেমান কাছে এগিয়ে গেল। হাশেম মিয়া তার গাল টিপে আদর করলেন।

. হাশেম মিয়ার স্ত্রী সন্ধ্যা থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছে। ঘেঁটু নাচের ছেলে বাড়িতে থাকতে এলে বাড়ির মেয়েরা চোখের জল ফেলে। এই নিয়ম ঘেটু নাচের মতই প্রাচীন নিয়ম। হাশেম মিয়ার সুন্দরী স্ত্রী কেঁদে নিয়ম রক্ষা করে। কারণ শৌখিনদার মানুষরা ঘেঁটু নাচের বালকদের বড়ই পছন্দ করে। শৌখিনদার মানুষ যখন রাতে স্ত্রীর সঙ্গে ঘুমুতে আসে তখন ঘেঁটু বালককেও সঙ্গে নিয়ে আসে। সেই বালক রাতে স্বামী স্ত্রীর মাঝখানে ঘুমায়।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments