Saturday, April 20, 2024
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পরহস্যকুঠীর রানী - মানবেন্দ্র পাল

রহস্যকুঠীর রানী – মানবেন্দ্র পাল

রহস্যকুঠীর রানী - মানবেন্দ্র পাল

বড়দিনের ছুটিতে ভাইপোকে নিয়ে মধুপুরে বেড়াতে যাব ঠিক করেছি। মধুপুরে কিছুদিন থেকে দেওঘর আর গিরিডি’ও নিয়ে যাব, প্ল্যান করেছি। দেওঘরের ত্রিকূট পাহাড়, গিরিডির উশ্রী প্রপাত – ডাকু আজ পর্যন্ত দেখেনি। এবার ওকে না দেখালেই নয়। ডাকুর তো আনন্দে রাতে ঘুমই হয় না। খালি জিজ্ঞেস করে, ” কাকু, কবে মধুপুর যাব?”

দিন যেই স্থির হল, তারপর থেকে ডাকু ব্যস্ত হয়ে পড়ল, কি কি জিনিস সঙ্গে নেবে, তার লিস্ট তৈরি করতে। হোক দশদিনের জন্য, তবু তো বাইরে যাওয়া।

যাই হোক, শেষপর্যন্ত এক শীতের বিকেলে আমরা মধুপুর স্টেশনে এসে নামলাম। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল হোটেলে জায়গা পাওয়া নিয়ে। কোনও হোটেলে রুম খালি নেই। টাঙ্গাওয়ালা আমাদের একটা নামকরা হোটেলের সামনে নিয়ে এসে ছেড়ে দিল; কিন্তু হায় মন্দভাগ্য! এই হোটেলেও জায়গা নেই। ম্যানেজার আরও সাঙ্ঘাতিক কথা শোনালেন। তিনি জানালেন, এইসময় শুধু হোটেল কেন, একটা খালি বাড়িও নাকি পাবো না। এইসময়টায় নাকি প্রচুর লোক চেঞ্জে আসে, তাই ভীড়ও বেশি। আমি একটা ঘরের জন্য যখন প্রায় নাছোড়বান্দা তখন উনি চোখ ছোট ছোট করে বললেন, ” একটা বাড়ির সন্ধান দিতে পারি; কিন্তু টিকতে পারবেন কি?”
বললাম,” কেন? ভূতের বাড়ি নাকি?”

ম্যানেজার মাথা দুলিয়ে বললেন, ” লোকে তো তাই বলে। এক রাত্তিরের বেশি কেউ থাকতে পারে না, শুনেছি। “
ডাকু ঐসময় আমার হাতে চাপ দিয়ে ফিসফিস করে বললে, ” ঐবাড়িতেই চলো কাকু, ভূত দেখা যাবে। “

আমি তখন ভালমানুষের মতো মুখ করে ম্যানেজারকে বললাম, ” কি আর করা যাবে? ঠিকানাটা দিন তাহলে। ভূতের বাড়িতেই ক’দিন কাটাই।”

ম্যানেজার তখন কোথা দিয়ে কোথায় যেতে হবে বুঝিয়ে দিল।

শহরের বাইরে নদীর ধারে একটা কবরখানা। তারই পাশে বিরাট গম্বুজওয়ালা একটা পুরনো দোতলা বাড়ি। সেই বাড়িতে একজন মহিলা থাকেন। তিনিই বাড়ির মালিক। তিনি যদি রাজি থাকেন, তাহলে হয়তো সেই বাড়িতে একখানি ঘর পেতে পারি।
আমি হতাশার সুরে বললাম ” যা শুনছি, তাতে মনে হয় উনি ভাড়া দেবেন।”

ম্যানেজার বললেন, ” দেখুন, সে আপনার কপাল। তবে উনি অনেককেই ভাড়া দিয়েছেন আর কেউই এক রাত্তিরের বেশী টিকতে পারেনি। তবে হ্যাঁ, পুরো ভাড়াটা অবশ্য উনি আগাম নিয়ে থাকেন।”

শীতের বেলা তখন শেষ হয়ে এসেছে। টাঙাটা আমাদের এক জায়গায় নামিয়ে দিল। বলল,” কবরখানার রাস্তার দিকে আর নাকি গাড়ি চলবে না। রাস্তা খারাপ।”

অগত্যা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে গিয়ে পৌঁছলাম। নদীর পশ্চিম দিকে একরাশ বুনো ফুলের আড়ালে একটা পুরনো কবরখানা দেখতে পেলাম। এবার বাড়িটা খুঁজতে হবে। ভাগ্য ভাল, বাড়িটাও খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। অনেকগুলো সার সার ইউক্যালিপটাস গাছের আড়ালে বাড়িটা যেন লুকিয়ে ছিল।

আমরা যখন ফটক ঠেলে বাড়ির ভেতর ঢুকলাম তখন চারপাশে রীতিমতো অন্ধকার। শহরে ইলেক্ট্রিসিটি থাকলেও এই পল্লীতে বিদ্যুৎ আসেনি। এখানে যে অল্প কয়েক ঘর বসতি আছে তাদের প্রায় সবাই আদিবাসী খ্রীষ্টান; কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় ওদের জীবনে জাঁকজমক বলে কিছু নেই। সারাদিন খাটাখাটুনি করে এসে সন্ধ্যে হবার আগে চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে খিল বন্ধ করে দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কারোর সঙ্গে কারোর কোনও যোগাযোগ নেই। ইলেকট্রিক আলোর জন্য মাথা কোটাকুটিও করে না।
যাই হোক, আমরা সেই বাড়ির বাইরের ঘরে এসে ঢুকলাম প্রথমে। কুপকুপে অন্ধকার ঘর।
আমি ডাকলাম, ” কেউ আছেন?”
সাড়া নেই।
আবার ডাকলাম, ” কেউ কি আছেন?”
এবারও সাড়া নেই।

এবার ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে জ্বালালাম। সেই আলোয় দেখলাম, সামনে আরেকটা দরজা। সেই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সামনে একটা লম্বা দালান। ওপাশে মনে হল ওপরে ওঠার সিঁড়ি। আমরা সেই দালানে পা রাখতেই ওপাশের একটা মস্ত জালে ঢাকা খাঁচা থেকে অনেকগুলো মুরগি যেন ভয়ে পেয়ে একসঙ্গে কোঁকর-কোঁ-কোঁকর-কোঁ করে ডেকে উঠল।
ডাকু ফিসফিস করে বলল, ” এত মুরগি! বাড়িওয়ালী কি মুরগির ব্যবসা করে না নিজে খায়?”

আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। সারাদিন ট্রেনজার্নি করে আসা, এখন যদি একটু থাকার ব্যবস্থা না হয় তাহলে যাব কোথায়?
তাই এবার একটু জোরে ডাকলাম, ” কেউ আছেন?”

হঠাৎ খুব কাছ থেকে একটা অদ্ভুত কন্ঠ শোনা গেল, ” বাইরের ঘরে বসুন।”
গলার স্বরটা না পুরুষের, না মহিলার। কেমন একটা বিশ্রী খ্যানখেনে গলা। এপাশ ওপাশ তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না।

যাই হোক, আমরা আবার বাইরের ঘরে এসে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়েই রইলাম, কেননা বসবার কোন ব্যবস্থাই ছিল না। টর্চের আলোয় দেখলাম, চারদিকে শুধু ভাঙা আলমারি, ভাঙা দেরাজ আর কতগুলো ভাঙা চেয়ার মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। মেঝেতে পুরু ধূলোর আস্তরণ। এই ঘরে যে কেউ কোনওদিন আসে না, সেটা বেশ বুঝতে পারলাম।

একসময় ভেতরের দরজা দিয়ে একচিলতে ঘোলাটে আলো এসে পড়ল। তারপরই দেখলাম, কালো গাউন পরা একজন মহিলা, হাতে পেটমোটা একটা সেকেলে সেজবাতি নিয়ে এসে এ’ঘরে ঢুকলেন। একেবারে আপাদমস্তক কালো গাউনে ঢাকা। গলা থেকে একটা লম্বা ক্রশ গাউনের ওপর এসে ঝুলছে। মুখটা অস্বাভাবিক সাদা। গালের হনুদুটো একটু উঁচু আর সেজন্য গালের বাকি অংশ একটু বসা। মহিলা বেশ লম্বা কিন্তু কত বয়স তা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না।

আমি একটু ইতস্তত করে নমস্কার জানিয়ে বললাম, ” আ…আ….আপনাকে মনে হয় বেশ বিরক্ত করলাম। “
ভদ্রমহিলা সেই অস্বাভাবিক ভাবলেশহীন গম্ভীর স্বরে খ্যানখ্যানে গলায় বললেন, ” কি বলতে চান, বলুন।”
আমি ইতস্তত করে বললাম, ” এই….দিন দশেকের জন্য আমার একটা ঘর লাগবে। থাকব এই…আমরা দুজন। আমি…আর আমার এই ভাইপো…. “।

এতক্ষণে ডাকুর দিকে ওঁর লক্ষ্য পড়ল। উনি সেই পেটমোটা সেজবাতিটা আরেকটু বাড়িয়ে ধরে ডাকুকে ভাল করে দেখতে লাগলেন। আর সেই মূহুর্তে আমিও ওঁকে ভাল করে দেখতে পেলাম। সেইসঙ্গে ওঁর চোখদুটো…. সে যে কি তীক্ষ্ণ আর কি জ্বলন্ত…. তা না দেখলে বোঝা যায় না। আমার মনে হল, উনি সেই চোখের দৃষ্টি দিয়ে ডাকুকে যেন গিলে খেতে চাইছেন। আমি তাড়াতাড়ি ডাকুকে আড়াল করে দাঁড়ালাম।

ভদ্রমহিলা পূর্বের সেই খনখনে গলায় বললেন, ” তা শেষপর্যন্ত আমার বাড়িতে কেন?” তারপর একটু থেমে বললেন, ” ভূত দেখতে বুঝি?”

আমি এবার একটু হেসে ইতস্তত করে বললাম, ” না, না, ভূত দেখতে আসব কেন! কোথাও হোটেলে রুম পাচ্ছিলাম না তাই হোটেলের ম্যানেজার বললেন…..”

আমার কথার মাঝেই ভদ্রমহিলা থেমে থেমে বলতে লাগলেন, ” অনেকেই তো এ বাড়িতে ভূত দেখতে আসে। আপনারাও যদি এ বাড়িতে ভূত দেখতে আসেন তাহলে ঠকবেন। কেননা ভূত এ বাড়িতে টিকতে পারে না।”

এই কথা বলে ভদ্রমহিলা ভাড়ার টাকাটা গুনে নিয়ে ফিরে যাবার সময় তাঁর সেই তীক্ষ্ণ আর জ্বলন্ত চোখদুটো ফের আরেকবার ডাকুর ওপর বুলিয়ে নিলেন।

দোতলার এককোণায় একটা ঘর পাওয়া গেল। ঘরে অনেকগুলো জানলা। কোনও জানলাতেই গরাদ নেই; একটা জানলায় দাঁড়ালে কবরখানাটা পরিষ্কার দেখা যায়। তবে এখানে একটাই অসুবিধে, খাওয়ার কোনও ব্যবস্থাই এখানে নেই। হয় নিজে রাঁধো নয়তো হোটেলে খাও। নিজে আর কি রাঁধব? সন্ধ্যার পর হোটেল থেকে খেয়ে ফিরে খিল লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম। একে প্রচণ্ড শীত তার ওপর শরীরে ক্লান্তি। তাই তাড়াতাড়ি চোখে ঘুম নেমে আসতেও দেরী হল না।
ঠক..ঠক।
দরজায় করাঘাতের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। কে যেন কড়া নাড়ছে দরজায়। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। অন্ধকার ঘর। কান খাড়া করে রইলাম। ভুল শুনেছি কি!
ঠক…ঠক….ঠক।
দরজায় আবার করাঘাত পড়ল। না, ভুল নয়। ঐ তো, কে যেন আবার দরজায় টোকা দিচ্ছে, কড়াও নাড়ছে। এবার টের পেলাম, পাশে ডাকু’ও চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে বসেছে। টর্চ জ্বেলে সাবধানে দরজার খিল খুলতে দেখি, বাইরে ঝোড়ো কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে পর্দাগুলো উড়ছে পাগলের মতো। সেইসঙ্গে অমনি সেই বিশ্রী খনখনে কণ্ঠস্বর কানে এল, ” গুড মর্নিং! “

লম্বা একটা হাই তুলে আমিও বললাম, ” গুড মর্নিং! “
খেয়াল করে দেখি, ভোরের আলো ফুটছে সবে বাইরে। আর বাড়িওয়ালী মিস দফাদার কখন নিজেই দু’কাপ চা আর কিছু নোনতা বিস্কিট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার বাইরে।
আমরা অবাক। মিস দফাদার যে এইভাবে চা-বিস্কিট দিয়ে নিজে আপ্যায়ন করবে, ভাবতেও পারিনি।
মিস দফাদার বললেন, ” চা-টা আপনাদের জন্য। প্লিজ খেয়ে নিন।” চায়ের ট্রে’টা টেবিলে রাখতে রাখতে তিনি বললেন, ” আমি অবশ্য সব ভাড়াটেদের এমন আপ্যায়ন করি না।”
আমি বললাম, ” থ্যাংকইউ। আপনার এই সৌজন্য আমরা ভুলব না।”
ধন্যবাদ জানিয়ে মিস দফাদার চলে যাচ্ছিলেন, আবার ফিরে দাঁড়ালেন। ফের একবার তাকালেন ডাকুর দিকে। ওহ! কি হিংস্র, পৈশাচিক দৃষ্টি! হিসহিসে কন্ঠে মিস দফাদার কেটে কেটে বললেন, ” কাল রাতে আপনাদের নিশ্চয়ই ঘুমের ব্যাঘাত হয়নি? “
আমি হেসে বললাম, ” না, না, এতটুকুও নয়।”
মিস দফাদার বলতে যাচ্ছিলেন, ” মানে, ভূতের ভয়ে……”

তাঁর কথার মাঝেই আমি জোরে হেসে উঠে বললাম, ” আমি ভূত বিশ্বাস করি না।”
মিস দফাদার আর দাঁড়ালেন না। হিলের খটখট শব্দ তুলে টানা বারান্দা ধরে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

তিনটে দিন কি করে যেন কেটে গেল। মধুপুরটা মোটামুটি দেখা হয়ে গেছে। এবার দেওঘর যাবার কথা ভাবছি। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করছি, ডাকু যেন দিনদিন কিরকম অন্যমনস্ক আর খিটখিটে হয়ে উঠছে। দুপুরবেলাটা কিছুতেই আমার সঙ্গে বেরোতে চায় না। বলে, ” ভাল লাগছে না, তুমি যাও। আমি একটু শুয়ে থাকি।”
একা একা বেড়াতে ভাল লাগে না, তবু বেড়াই। মনে মনে ভাবি, ডাকু’টার হঠাৎ হল কি!
সেদিন খাবার টেবিলে বসে হঠাৎ ও বলল, ” মিস দফাদার দিনের বেলা বাড়ি থাকেন না।”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ” কি করে জানলি?”
ডাকু হঠাৎ রেগে গিয়ে বলল, ” সে আমি বলব না।”
ওর এই আচরণে আমি বেশ অবাক হলাম। সামলে নিয়ে বললাম, ” কোথায় যান উনি, তা জানিস?”
ডাকু বলল, ” উঁহু, তা জানি না।”

আমি এবার জিজ্ঞেস করলাম, ” আচ্ছা, তুই কি দুপুরবেলা ঐদিকে যাস? ওদিকে মানে, মিস দফাদারের ঘরের দিকে?”
ডাকু গম্ভীরভাবে বলল, ” হ্যাঁ, যাই।” তারপর একটু থেমে কেমন ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, ” রোজ দুপুরে কে যেন আমায় ঐদিকে যাবার জন্য ডাকে। আমি না গিয়ে পারি না। সেদিন দেখি, ঐদিকের ঘরের জানলার নিচে একগাদা মুরগির পালক পড়ে আছে। ঠিক যেন কেউ গোটা মুরগিগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে।” এই কথাগুলো বলতে বলতে ওর চোখমুখ কেমন যেন হয়ে গেল। তারপরই ও কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আমি এবার বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। গভীরভাবে ভাবতে বসলাম, ‘ কে ওকে ওদিকে যাবার জন্য ডাকছে! কেনই বা ডাকছে! আর সেই ডাকার সঙ্গে মুরগির কি সম্পর্ক! ডাকু কি সজ্ঞানে ভুল বকছে! ওর কি শরীর টরীর খারাপ হল! ‘

নাহ! ভূতুড়ে বাড়িতে ক’দিন থেকেও ভূত দেখার সৌভাগ্য আর হল না! শুধু বাড়িওয়ালী মিস দফাদারের আচরণগুলোই আমায় একটু অবাক করছিল। ওঁকে সেদিন প্রথমদিন সকালে চা দিতে আসার সময় সেই দেখেছিলাম, তারপরে আর এ ক’দিনে চোখেই পড়েনি! তবে এটুকু বুঝতে পেরেছি, উনি ঠিক সাধারণ মহিলার মতো জীবনযাপন করেন না। এমনকি ডাকু একদিন গম্ভীরভাবে একটা খবর শোনাল – ” জানো কাকু, মিস দফাদার বোধহয় কিচ্ছু খান না। তাঁর কোনও হাঁড়ি-পাতিল নেই, রান্নার গ্যাস নেই, উনুন নেই, স্টোভ বা চুল্লি কিচ্ছু নেই।”
আমি ওকে ফের জিজ্ঞেস করলাম, ” তুই জানলি কি করে?”
ডাকু হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ” আরও কত কি জানতে পারব!”
ওর এই ধরনের কথায় আমার কেমন গা ছমছম করে। কিছু কথা বলার সময় ও কিরকম যেন অস্বাভাবিক হয়ে যায়! এমন গম্ভীর চালে কথা বলে যেন মনে হয় কত বয়স্ক লোক কথা বলছে! এবার এখান থেকে পাততাড়ি গোটাবো ভাবছি, ঠিক সেই রাত্তিরেই একটা ঘটনা ঘটল –
রাত তখন কত জানি না। শীতের রাত। পাহাড়ে শীত, ঘরের সমস্ত জানলা বন্ধ। মাথা পর্যন্ত লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিলাম।
মাথার কাছে সবসময় থাকে টর্চ আর দুটো বড় ছুরি । কি জানি কখন দরকার হয়।

হঠাৎ কেন যেন ঘুমটা ভেঙে গেল। জেগেই দেখি, পাশে বিছানায় ডাকু নেই। ঘরের দরজা খোলা। আমি চমকে উঠলাম। আরে! ডাকু কোথায় গেল! ও তো রাত্তিরে বড় একটা ওঠে না! যদি বা ওঠে, তাহলে আমায় ডাকে। তাহলে!

এক লাফে বিছানা থেকে নেমে বাইরে বেরিয়ে এলাম। সেই টানা বারান্দা ধরে মিস দফাদারের ঘরের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম, মিস দফাদারের ঘর থেকে আগুনের আভার মতো কি যেন দাউদাউ করে জ্বলছে, আবার নিভছে, আবার জ্বলে উঠছে। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের রঙও বদলাচ্ছে। কখনও লাল, কখনো নীল আবার কখনো বা সবুজ! মনে হল, এই গভীর রাতে এই বাড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ম্যাজিক দেখছি। আর সেই জাদুকরী আগুনের আলোয় দেখলাম, ডাকু বারান্দার দেওয়াল ধরে ধরে সেই ঘরের দিকে এগোচ্ছে। ডাকু’কে চেঁচিয়ে ডাকতে সাহস হল না; ছুটে গিয়ে ওকে জাপটে ধরে ফেললাম। আমায় দেখে ডাকুর সে কি রাগ! জোর করে হাত ছাড়িয়ে সে ঐ আগুনের দিকে যাবেই। তখন আমিও সর্বশক্তি দিয়ে ডাকু’কে পাঁজাকোলা করে তুলে নিজের ঘরে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ওকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া মাত্রই কেমন যেন নেতিয়ে পড়ল। আমি ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, রাত তখন আড়াইটে।

হঠাৎ ডাকু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলতে লাগল, ” আমায় ছেড়ে দাও…..আমায় ছেড়ে দাও……ওগো, আমায় ছেড়ে দাও…..ও যে আমায় ডাকছে!…..আমায় ডাকছে……আমায় ছেড়ে দাও…..ও আমায় আজ কবরখানায় নিয়ে যাবে বলেছিল……ঐ যে…..ঐ যে…..ও দাঁড়িয়ে আছে…..ও রেগে আছে…..তুমি আমায় যেতে দিচ্ছ না বলে ও রেগে যাচ্ছে…..হ্যাঁ…ও বলছে আমায় ওর খুব দরকার…..ও আমায় এখানে রেখে দেবে বছরের পর বছর…… হ্যাঁ….আমায় ওর দরকার……ও ডাকছে আমায়……আমায় ডাকছে…..আমায় ডাকছে…….”
একটু থেমে ডাকু আবার লাফিয়ে উঠে বলল, ” হ্যাঁ…..ও ডাকছে…..আমায় ছেড়ে দাও…….আমায় ছেড়ে দাও…..আমায় ডাকছে….ঐ যে……ঐ যে…..আমায় কবরখানার দিকে ডাকছে……ঐ তো…..ঐ তো…..ও কবরখানার দিকে চলে যাচ্ছে…..আমায় যেতে দাও……”

বলতে বলতে ডাকু একটানে ঘরের জানলাটা খুলে ফেলে অর্ধেক শরীর বাইরে ঝুলিয়ে দিল। যেন এক্ষুনি আমার হাত ছাড়িয়ে নিতে পারলেই বাইরে ঝাঁপ দেবে। আমিও শীতের কনকনে বাতাসকে উপেক্ষা করে সর্বশক্তি দিয়ে ডাকুকে আঁকড়ে ধরে রইলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে আমার সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠল। স্পষ্ট দেখলাম, কালো গাউন পরা একটা চলমান মূর্তি কবরখানার ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল! পরদিন সকালেই ঠিক করলাম, আজ না হোক, আগামীকাল সকালে মধুপুর ছাড়বই। আর যতটুকু সময় এ বাড়িতে আছি কিছুতেই ডাকুকে কাছছাড়া করব না। কেননা যেকোনো কারণেই হোক, আমার মনে হয়েছে ডাকুর জীবন বিপন্ন; আর ঐ মিস দফাদার মানুষটিও কিছুতেই স্বাভাবিক মানুষ নন।

ওর অন্য কিছু একটা মতলব আছে। তাই সারাদিন ডাকু’কে চোখে চোখে রাখলাম। ওকে আজ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। কিছুতেই বিছানা ছেড়ে উঠছে না। দুপুরের খাওয়া সেরে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিলাম; হঠাৎ দেখলাম হোল্ডলের স্ট্রাপটা ছিঁড়ে গেছে। এখনি মুচিকে দিয়ে না সারালে নয় ; কিন্তু ডাকু’কে একলা ফেলে যাই কি করে! এ বাড়িতে তো এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যাকে দিয়ে হোল্ডলের স্ট্রাপটা সারিয়ে আনতে পাঠাব!

নাহ! ভেবে লাভ নেই। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য আমায় একা বেরোতেই হবে। তাই আর দেরী করলাম না। তাকিয়ে দেখি, ডাকু বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।

দেরী না করে হোল্ডলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর থেকে প্রতি মূহুর্তে বুকের মধ্যে ধুকপুকানি। কেবলই ভয় হতে লাগল, এতক্ষণে বুঝি ডাকু’র কিছু একটা হয়ে গেল। কোনওরকমে স্ট্রাপটা সারিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

বাড়ির ভেতর পা রাখতেই মুরগিগুলো হঠাৎ একসঙ্গে ডেকে উঠল খাঁচার ভেতর থেকে। হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতেই চমকে উঠলাম – ‘ কই! ডাকু কই!’ডাকু তো নেই!’
” ডাকু! ডাকু!” ডাকতে লাগলাম।
না, কোনও সাড়া নেই।
কি হল! কোথায় গেল ডাকু! আমি আবারও চেঁচিয়ে ডাকলাম, ” ডাকু!”
না, এবারও সাড়া নেই।
এই ভয়টাই আমি করেছিলাম। জানি না, এর মধ্যে ডাকু’র কি অবস্থা হয়েছে! আমি তখন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। তারপর ছুটতে লাগলাম মিস দফাদারের ঘরের দিকে। এদিকটায় আমি কখনো আসিনি। সার সার তালাবন্ধ ঘর। কোথাও কোনও জনমানবের সাড়া নেই। আমি কেবলই বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে মোড় বাঁকতে বাঁকতে চলেছি। বারান্দাটা যেন সাপের মতো এঁকেবেঁকে গেছে। হঠাৎ থেমে যেতে হল। সামনে সিঁড়ি দেখছি। নীচের দিকে নেমে গেছে সিঁড়ি।
বাইরে তখন সন্ধের অন্ধকার নেমে আসছে। বাড়ির ভেতরেও কোথাও এতটুকু আলো নেই। আর এই সিঁড়ির মুখটায় যেন চাপ চাপ অন্ধকার!

না, নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। আমি সেই অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। নামছি তো নামছিই….নামছি তো নামছিই…..। যেন কোনও পাতালপুরীর পথে পা বাড়িয়েছি। সিঁড়িগুলো এত সরু আর অন্ধকার যে প্রতি মূহুর্তে ভয় হচ্ছে, এই বুঝি পা পিছলে পড়ে গেলাম! আর পড়ে গেলে যে কোথায় গড়িয়ে যাব, ঠিক নেই। তাছাড়া যতই নামছি ততই যেন ঠান্ডাটা বাড়ছে। মনে হচ্ছে যেন বরফের দেশে চলেছি।

একসময় সিঁড়ি ফুরিয়ে গেল। কিন্তু একি! এ যে পায়ের তলায় নরম মাটি! কাদা কাদা! পিছল পিছল! অবাক হয়ে ভাববার সময়টুকু পর্যন্ত নেই। ডাকু’কে খুঁজে বের করতেই হবে। আমি অন্ধকারের মধ্যেই অন্ধের মতো শ্যাওলা ধরা দেওয়াল ধরে ধরে এগিয়ে চললাম। কিন্তু কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। দরজায় জোর করাঘাতের শব্দ শুনতে পেলাম। খুব কাছেই কে যেন কোথায় বন্ধ দরজায় জোরে জোরে করাঘাত করছে দুম দুম শব্দ করে!

আরেকটু এগোতেই চমকে উঠলাম। কে যেন একটা বন্ধ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় জোরে জোরে শব্দ করছে আর জোরে জোরে চিৎকার করে বলছে, ” এই যে আমি এসেছি…..এই যে আমি এসেছি……এই যে আমি এসেছি……!”
আমি চেঁচিয়ে ডেকে উঠলাম, ” ডাকু!”

ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতেই সঙ্গে সঙ্গে ওর অচৈতন্য দেহ আমার বুকের ওপর লুটিয়ে পড়ল। আর সেইসময় বন্ধ ঘরটার জানলা দিয়ে বাইরে থেকে যে দৃশ্যটা আমার চোখে পড়ল, তা আমি কক্ষনো ভুলতে পারব না।

অন্ধকার পাতালপুরীর সেই ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে পুরনো, পরিত্যক্ত বদ্ধ ঘরটার ভেতর দেখা যাচ্ছে একটা খাটিয়া। আর সেই খাটিয়ার ওপর ধবধবে সাদা চাদর ঢাকা……..হা ঈশ্বর! ঐ তো…..একটা মৃতদেহই তো মনে হচ্ছে! আর……আর……ও কি! মৃতদেহটা হঠাৎ নড়ে উঠল মনে হচ্ছে!…….হ্যাঁ, ঐ তো নড়ছে……..সাদা চাদরটা খসে পড়ল মৃতদেহটার ওপর থেকে……..তারপর….. তারপর দু হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে, শীর্ণ হাড়সর্বস্ব আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে কবর থেকে যেমন প্রেতাত্মার উত্থান হয়, সেইভাবে সোজা উঠে বসল…..আর…আর…..সেইসঙ্গে নারীকন্ঠে কি পৈশাচিক শীতল হাসি!
” মিস দফাদার!”

অজান্তে আমার গলা দিয়ে একটা ভয়ার্ত চিৎকার বেরিয়ে এল। তারপর….. তারপর কি করে যে ডাকু’কে কাঁধের ওপর ফেলে সেই অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এসেছি, তা বলতে পারব না। তারপর ডাকু’কে কাঁধের ওপর ফেলে সেই শীতের হিমশীতল সন্ধ্যায় দিগ্বিদিকভাবে ছুটে বাড়ির বাইরে এসে নির্জন পথের ওপর দিয়ে ছুটতে লাগলাম শহরের দিকে। দৌড়তে দৌড়তে একবার পেছন ফিরে মিস দফাদারের ঘরের জানলার দিকে তাকিয়ে দেখি, জানলার সামনে কালো গাউন পরা একটা মূর্তি আমাদের লক্ষ্য করছে। মূহুর্তমাত্র না থেমে আমি ডাকু’কে কাঁধে নিয়ে প্রাণপণে স্টেশনের দিকে ছুটতে লাগলাম। তখনো কানে আসছে শীতল কন্ঠের সেই রক্তহিম করা পৈশাচিক হাসি।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments