Friday, November 14, 2025
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পভূত মন্ত্র - হুমায়ূন আহমেদ

ভূত মন্ত্র – হুমায়ূন আহমেদ

ভূত মন্ত্র – হুমায়ূন আহমেদ

বাবলুকে একা বাসায় রেখে তার বাবা-মা ভৈরবে বেড়াতে গেছেন। সকালের ট্রেনে গেছেন, ফিরবেন রাত নটায়। এই এত সময় বাবলু একা থাকবে। না, ঠিক একা না, বাসায় কাজের বুয়া আছে।

বাবলুর খুব ইচ্ছা ছিল সেও ভৈরব যাবে। অনেক দিন সে ট্রেনে চড়ে না। তার খুব ট্রেনে চড়তে ইচ্ছা করছিল। তা ছাড়া ভৈরবে ছোট খালার বাড়িতেও অনেক মজা হবে। ছোটখালার বাড়িটা নদীর ওপরে। নিশ্চয়ই নৌকায় চড়া হবে। বাবলু অনেক দিন নৌকাতেও চড়ে না। তাকে ইচ্ছে করলেই নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু বাবলুর বাবা মনসুর সাহেব তাকে নেবেন না। তিনি চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন, নো নো নো। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেড়ানো আমি পছন্দ করি না। তুমি বাসায় থাক। হোম ওয়ার্ক শেষ কর।

বাবলু ক্ষীণ গলায় বলল, হোম ওয়ার্ক শেষ করে রেখেছি।

শেষ করলে অন্য কাজ কর। দেখি অঙ্ক বই নিয়ে আস, দাগিয়ে দেই। অঙ্ক করে রাখ–ভৈরব থেকে ফিরে এসে দেখব।

বাবলু অঙ্ক বই নিয়ে এলো। মনসুর সাহেব বিশটা অঙ্ক দাগিয়ে দিলেন।

সব করবে। একটা বাদ থাকলে কানে ধরে চড়কিপাক খাওয়াব। সারা দিন আছেই শুধু খেলার ধান্ধায়।

বাবলুর চোখে পানি এসে গেল। সারা দিন সে তো খেলার ধান্ধায় থাকে। খেলাধুলা যা করার স্কুলেই করে। বাসায় ফিরে বাবার ভয়ে চুপচাপ বই নিয়ে বসে থাকে। বাবলু তার বাবাকে অসম্ভব ভয় পায়। বাবাদের কোনো ছেলেই এত ভয় পায় না–বাবলু পায়, কারণ মনসুর সাহেব বাবলুর আসল বাবা না, নকল বাবা।

বাবলুর আসল বাবার মৃত্যুর পর তার মা এঁকে বিয়ে করেন। তবে লোকটা যে খুব খারাপ তাও বলা যাবে না। বাবলুকে তিনি প্রায়ই খেলনা, গল্পের বই এইসব কিনে দেন। কিছুদিন আগে দামি একটা লেগোর সেট কিনে দিয়েছেন।

তবে বাবলুর সব সময় মনে হয় তার আসল বাবা বেঁচে থাকলে লক্ষ গুণ বেশি মজা হতো। বাবা নিশ্চয়ই তাকে ফেলে ভৈরব যেতেন না। বাবলু কোথাও যেতে পারে না। বেশির ভাগ সময় সোবহানবাগ ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলাতেই তাকে বন্দী থাকতে হয়। মাঝে মাঝে তার এমন কান্না পায়। তার কান্না দেখলে মা কষ্ট পাবেন বলে সে কাঁদে না। তার খুব যখন কাঁদতে ইচ্ছা করে তখন সে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে কাঁদে। বের হয়ে আসার সময় চোখ মুছে এমনভাবে বের হয় যে, কেউ কিছু বুঝতে পারে না।

বাবলু বসার ঘরে অঙ্ক বই নিয়ে বসেছে। মনসুর সাহেব বিশটা অঙ্ক দাগিয়ে দিয়ে গেছেন। এর মধ্যে সে মাত্র একটা অঙ্ক করেছে। অঙ্কগুলি এমন কঠিন। বুয়া গ্লাস ভর্তি দুধ রেখে গেছে। দুধ খেতে হবে না খেলে সে নালিশ করবে। গ্লাসটার দিকে তাকালেই বাবলুর বমি আসছে। সে অঙ্ক করছে গ্লাসটার দিকে না তাকিয়ে। এই সময় দরজায় খট খট শব্দ হলো। বাবলু দরজা খুলে দিল। সাতআট বছর বয়েসি দুষ্টু দুষ্ট চেহারার একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। খালি পা। পরনে সাইজে বড় একটা প্যান্ট। প্যান্ট খুলে পড়ার মতো হচ্ছে আর সে টেনে টেনে তুলছে। তার গায়ে রঙিন শার্ট। শার্টের একটা বোতাম নেই। বোতামের জায়গাটা সেফটি পিন দিয়ে আটকানো। ছেলেটা বাবলুর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে বলল, এই, তুই আমার সঙ্গে খেলবি?

বাবলু কথা বলল না। ছেলেটাকে সে চিনতে পারছে না। ফ্ল্যাটেরই কারো ছেলে হবে। তবে বাবলু আগে দেখেনি। অপরিচিত একটা ছেলে তাকে তুই তুই করছে, এটাও বাবলুর ভালো লাগছে না।

কথা বলছিস না কেন? খেলবি?

না।

আমি অনেক মজার মজার খেলা জানি।

আমি খেলব না। অঙ্ক করছি।

সকালবেলা কেউ অঙ্ক করে? আয় কিছুক্ষণ খেলি— তারপর অঙ্ক করিস।

আমাকে তুই তুই করে বলছ কেন?

বন্ধুকে তুই তুই করে বলব না? বন্ধুকে বুঝি আপনি আপনি করে বলব?

আমি তোমার বন্ধু না।

বন্ধু না! এখন হবি। ঐ গ্লাসটায় কি দুধ নাকি?

হুঁ।

তোকে খেতে দিয়েছে?

হুঁ। খেতে ইচ্ছা করছে না?

না।

দুধটাকে পেপসি বানিয়ে তারপর খা।

পেপসি কীভাবে বানাব?

মন্ত্র পড়লেই হয়। এর মন্ত্র আছে। মন্ত্র জানিস না?

রাগে বাবলুর গা জ্বলে যাচ্ছে। কী রকম চালবাজের মতো কথা! মন্ত্র পড়লেই দুধ নাকি পেপসি হয়ে যাবে। মন্ত্র এতই সস্তা?

আমি মন্ত্র জানি। মন্ত্র পড়ে পেপসি বানিয়ে দেব?

দাও।

যদি দেই তাহলে কি তুই খেলবি আমার সঙ্গে?

হুঁ।

ছেলেটা ঘরে ঢুকল। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কী যেন বলে গ্লাসে ফুঁ দিল— বাবলু দেখল, দুধ দুধের মতোই আছে। আগের মতোই কুৎসিত। সর ভাসছে।

ছেলেটা বলল, দেখলি দুধ কেমন পেপসি বানিয়ে দিলাম, কঠিন মন্ত্র— তোকে শিখিয়ে দেব। এই মন্ত্র দিয়ে খাবার জিনিস বদলে ফেলা যায়। মনে কর তোকে ছোট মাছ দিয়ে ভাত দিয়েছে। ছোট মাছ খেতে ইচ্ছা করছে না। মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিবি ছোট মাছ হয়ে যাবে মুরগির রান। তুই মুরগির রান খাস, না বুকের মাংস?

বাবলু বলল, দুধ তো আগের মতোই আছে। একটুও বদলায়নি।

দেখাচ্ছে দুধের মতো কিন্তু এর স্বাদ এম পেপসির মতো। খুব ঝাঁঝ। এক চুমুক খেলেই টের পাবি। একটা চুমুক দিয়ে দেখ।

ছেলেটা কি তাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে? বাবলুর রাগ লাগছে। কেউ তাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করলে তার রাগ লাগে। ছেলেটা বলল, আমার দিকে এমন রাগী চোখে তাকিয়ে আছিস কেন? একটা চুমুক দিয়ে দেখ।

বাবলু দুধের গ্লাস হাতে নিল। এক চুমুক খেয়ে দেখা যাক। ক্ষতি তো কিছু নেই। ছেলেটা যেভাবে বলছে তাতে দুধ বদলে গিয়ে পেপসি হয়েও তো যেতে পারে!

বাবলু চুমুক দিল। চুমুক দিয়েই থু করে ফেলে দিল। দুধ দুধের মতোই আছে তার মুখের ভেতর দুধের সঙ্গে এক গাদা সরও ঢুকে গেছে। এই ছেলে দেখি মহাত্যাদড়। তাকে খুব বোকা বানাল।

ছেলেটা বলল, পেপসি হয়নি?

না।

সময় লাগবে। দিনের বেলা মন্ত্র চট করে লাগে না। দুধের গ্লাসটা এক কোণােয় রেখে দে কিছুক্ষণ পর দেখবি দুধ বদলে পেপসি হবে। এখন আয় আমরা খেলি। বেশিক্ষণ খেলব না। অল্প কিছুক্ষণ খেলে আমি চলে যাব।

আমি খেলব না। আমাকে অঙ্ক করতে হবে। তা ছাড়া তুমি মিথ্যাবাদী, মিথ্যাবাদীর সঙ্গে আমি খেলি না।

আমি মিথ্যাবাদী তোকে কে বলল? দুধটা বদলাতে সময় লাগছে— বললাম না, গরমের সময় মন্ত্র সহজে ধরে না।

তুমি চলে যাও। আমার অঙ্ক শেষ করতে হবে।

কঠিন অঙ্ক?

হুঁ কঠিন।

খুব কঠিন?

হুঁ। খুব কঠিন।

কঠিন অঙ্ক সহজ করার একটা মন্ত্র আছে। সেটা শিখিয়ে দিব? যে-কোনো কঠিন অঙ্কের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রটা পড়ে দুবার ফুঁ দিলেই অঙ্ক সহজ হয়ে যাবে, চট করে করতে পারবি। দেব শিখিয়ে?

তুমি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছ কেন? তুমি কি ভেবেছ আমি বোকা? আমি মোটেই বোকা নই।

মন্ত্র শিখবি না?

না শিখব না। আর শোনো আমাকে তুই তুই করবে না।

ছেলেটা ফিসফিস করে বলল–তুই এমন রেগে আছিস কেন? রাগ করা তো ভালো না। আচ্ছা শোন, রাগ কমাবার মন্ত্র আমার কাছ থেকে শিখবি? এই মন্ত্রটা খুব সহজ। হাত মুঠো করে এই মন্ত্র একবার পড়লেই রাগ কমে যায়। নিজের রাগ তো কমেই আশপাশে যারা আছে তাদের রাগও কমে। মনে কর তোর বাবা খুব রাগ করেছেন—তুই হাত মুঠো করে একবার মন্ত্রটা পড়বি–দেখবি মজা। তোর বাবার সব রাগ পানি হয়ে যাবে। তাকে হাসি মুখে কোলে তুলে নিবে।

বাবলু বলল, তুমি যাও তো।

চলে যাব?

হ্যাঁ চলে যাবে এবং আর কোনো দিন আসবে না।

আচ্ছা চলে যাচ্ছি। একটা খাতা আর কলম আন—চট চট করে মন্ত্রগুলি লিখে ফেল। আমি একবার চলে গেলে আর আমাকে পাবি না।

তোমাকে আমার দরকারও নেই।

সত্যি চলে যাব?

হ্যাঁ চলে যাবে।

আচ্ছা চলে যাচ্ছি। তুই মন খারাপ করে বসেছিলি দেখে এসেছিলাম— আমি কে জানিস?

জানতে চাই না।

আমি হচ্ছি ভূত রাজার ছেলে। ভূতদের সব মন্ত্র আমি জানি। খাতাটা দে–অদৃশ হবার মন্ত্রটা লিখে রেখে যাই। চোখ বন্ধ করে তিনবার এই মন্ত্রটা পড়লেই অদৃশ্য হয়ে যাবি। আর কেউ তোকে দেখতে পাবে না।

তুমি যাও তো।

ছেলেটা মন খারাপ করে চলে গেল। বাবলু দরজা বন্ধ করে আবার অঙ্ক নিয়ে বসল। কী যে কঠিন সব অঙ্ক! বাবলু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। অঙ্ক সহজ করার কোনো মন্ত্র থাকলে ভালোই হতো।

রান্নাঘর থেকে বুয়া চেঁচিয়ে বলল, দুধ খাইছ?

বাবলু বলল, না।

তাড়াতাড়ি খাও। না খাইলে তোমার আব্বার কাছে নালিশ দিমু।

নালিশ দিতে হবে না, খাচ্ছি।

বাবলু দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। দুধ কোথায়? গ্লাস ভর্তি পেপসি। বরফের দুটা টুকরাও ভাসছে। বাবলু ভয়ে ভয়ে একটা চুমুক দিল।

হ্যাঁ সত্যি সত্যি পেপসি। কী ঝাঁঝ! মন্ত্র তাহলে সত্যি আছে?

বাবলু ছুটে ঘর থেকে বের হলো। ছেলেটাকে কোথাও পাওয়া গেল না। ফ্ল্যাটের দারোয়ান বলল, লাল শার্ট পরা একটা ছেলেকে সে শিস দিতে দিতে রাস্তার ফুটপাত ধরে এগিয়ে যেতে দেখেছে। এর বেশি সে আর কিছু জানে না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments