তুমভি কাঁঠাল খায়া – জসীম উদ্দীন

তুমভি কাঁঠাল খায়া' জসীম উদ্দীন

এক কাবুলিওয়ালা বাংলাদেশে নতুন এসেছে! বাজারে গিয়ে দেখে বড় বড় কাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে। পাকা কাঁঠালের কেমন সুবাস! না জানি খেতে কত মিষ্টি! তার দেশে তো এত বড় ফল পাওয়া যায় না। মাত্র আট আনা দিয়া মস্ত বড় একটা কাঁঠাল সে কিনে ফেলল। কাঁঠালটি নিয়ে সে একবার ঘ্রাণ শুঁকে দেখে, আবার কাঁধে নিয়ে দেখে। তারপর খুশিতে নাচতে নাচতে কাঁঠালটি বাসায় নিয়ে গেল।

আমরা জানি, কাঁঠাল খাইতে হইলে হাতে তেল মাখাইয়া নিতে হয়, ঠোটে তেল লাগিয়ে নিতে হয়। তাহা না করিলে কাঁঠালের আঠা হাতে মুখে লেগে যায়। সাবান পানি দিয়া কিছুতেই তোলা যায় না।

কাবুলিওয়ালা নতুন লোক। এসব কিছুই জানে না। সে দুই হাতে কাঁঠালটি ধরে কামড়াইতে লাগিল। কাঁঠালের আঠা তার হাতে লাগিল, মুখে লাগিল, দাড়িতে লেগে দাড়ি জট পাকিয়ে গেল; কিন্তু সেদিকে কে খেয়াল করে! এমন মিষ্টি কাঠাল আর এমন তার সুবাস! সে ছোবড়াসমেত সমস্ত কাঁঠালটি খাইয়া ফেলল। তারপর হাতমুখ ধুইতে গিয়ে বড়ই বিপদে পড়ল। সাবান ঘষিয়া, সোডার পানি গোলাইয়া সে হাত আর দাড়ি যতই পরিষ্কার করতে যায়, ততই হাতে-মুখে, দাড়িতে কাঁঠালের আঠা আরও চটচট করে।

রাত্রে শুতে গিয়ে আরও মুশকিল। এপাশ হতে ওপাশ ফিরিতে বিছানা বালিশে দাড়ি আটকে চটচট করে তাহাতে কিছু দাড়ি ঘেঁড়া যায়। দাড়িতে হাত বুলাইতে হাত দাড়ির সঙ্গে আটকে যায়। তাহাতে কিছু দাড়ি ছিড়ে যায়! সারারাত সে ঘুমাতে পারল না।

পরদিন হাটের বার। এটা ওটা কিনতে সে হাটে গিয়েছে। তরকারির দোকানে তরকারি দর করতে, ঝিঙ্গা-পটল দাড়ির সঙ্গে আটকে আসে, মাছের দোকানে মাছ তার দাড়িতে আটকে আসে। দোকানিরা দাড়ি হতে সেগুলি ছাড়িয়ে নিতে দাড়ি চটচট করে ছেড়ে। বেচারি কি আর করে! মনের দুঃখে কিছু না কিনেই বাসায় ফিরে আসতে চায়।

তাও কি ফিরে আসতে পারে? দাড়ির সঙ্গে ওর ছাতা আটকে যায় তার গামছা আটকে যায়। সকলে তাহাকে ধরে মারতে আসে।

মনের দুঃখে বেচারা এক যুবকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “হাঁ বাবুজি! হামি ত কাঠাল খাইছে। কাঁঠালের আঠা হামার দাড়িমে আর গোঁফমে লাগ গিয়া। কিছিছে ছেড়তা নেহি। আব ক্যা করেংগা সাব?”

যুবকটি দেখিল বেশ মজা হয়েছে! সে আরও মজা দেখার জন্য বলল, “আপনি দাড়িতে কিছু ছাই নিয়ে মাখান, আঠা ছেড়ে যাবে।”

কাবুলিওয়ালা বাসায় গিয়ে তাই করল। ছাই মাখানের ফলে তার দাড়িতে কাঁঠালের আঠা আরও জট পাকিয়ে গেল। মুখের চেহারা বদ হয়ে গেল। কাবুলিওয়ালা কি আর করে— খাইতে গেলে হাত দাড়িতে লেগে আটকে যায়, শুতে গেলে বিছানা-বালিশের সঙ্গে দাড়ি জড়িয়ে যায়। এপাশ ওপাশ হতে দাড়ি চট চট করে ছেড়ে। অবশেষে সে একজন বৃদ্ধ লোকের কাছে গিয়ে সকল কথা খুলে বলল।।

“য়্যা বাবুজি। হামি ত কাঁঠাল খাইছে। আওর কাঁঠাল কা আঠা হামার দাড়িমে গোফমে লাগ গিয়া! এক যোয়ান কা পরামর্শমে উছকা পর হাম ছাই লাগায়ে দিয়া। এসিসে এ দাড়িমে জট পাকায়া, আভি হাম ক্যা করেংগা?”

সমস্ত শুনিয়া বৃদ্ধ লোকটি বলিলেন, “সাহেব! একে ত কাঁঠালের আঠা তোমার দাড়িতে লাগিয়েছ, তার উপরে মাখাইয়াছ ঘুটের ছাই। এর উপরে আর কোনো কেরামতিই খাটিবে না। তুমি এক কাজ কর, নাপিতের কাছে গিয়ে গোঁফদাড়ি কামিয়ে ফেল।”

কতকাল ধরে কাবুলিওয়ালা তার মুখের এই দাড়ি জন্মিয়েছে। গাড়িতে, ইষ্টিমারে এই দাড়ি দেখে লোকে তাহাকে কত খাতির করে। নিমন্ত্রণ বাড়িতে এই দাড়ি দেখে লোকে তার পাতে আরও দুইটা বেশি করে রসগোল্লা-সন্দেশ এনে দেয়। আজ সেই দাড়ি কেটে ফেলতে হবে। মনের দুঃখে কাবুলিওয়ালা অনেকক্ষণ কাঁদল। কিন্তু কেঁদে কি হবে? নিরুপায় হয়ে সে এক নাপিতের কাছে গিয়ে দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে ফেলল।

তার দুঃখের ভাগী আর কে হবে। হাটে-পথে, মাঠে-ঘাটে সে যখন যাহাকে দাড়ি কামানো দেখে, তারই গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “ভায়া হে! তুমভি কাঁঠাল খায়া?”

সে মনে করে, যাদের দাড়ি নাই, তারাও বুঝি কাঁঠাল খাইতে কাঁঠালের আঠা দাড়িতে লাগিয়ে তারই মতো দাড়ি কামিয়ে ফেলেছে।।

Facebook Comment

You May Also Like

About the Author: eBooks

Read your favourite literature free forever on our blogging platform.