Tuesday, April 16, 2024
Homeগোয়েন্দা গল্পসোনার ডমরু - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সোনার ডমরু – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সোনার ডমরু - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ডমরুনাথ নেপাল সীমান্তে একটি প্রাচীন তীর্থক্ষেত্র। কিন্তু জনসমাগম বছরে সেই একবার-বৈশাখ মাসে বাবা ডমরুনাথের পুজো উপলক্ষে। বাকি এগারো মাস খাঁ খাঁ নিঃঝুম অবস্থা। আড়াইহাজার ফুট পাহাড়ের মাথায় বাবার মন্দির। ঘোরালো একফালি রাস্তা পাহাড় ঘুরে ঘুরে এগিয়ে গেছে ওপরে। মোটরগাড়ি নিয়েও অনায়াসে ওঠা যায়।

ছোট্ট একটা বাজার এবং বস্তী রয়েছে ডমরু পাহাড়ের পাদদেশে। সেখান দিয়েই গেছে নেপালগামী একটা পিচের সড়ক।

অক্টোবরের এক বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যায় আমি আমার বৃদ্ধ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ভাড়া করা জিপ থেকে নামলুম। যে বাংলোয় আমরা উঠব, সেটা খুব কাছেই একটা টিলার ওপর। জিপের ড্রাইভার বুষ্টু সিং এবং তার ছোকরা অ্যাসিস্টান্ট হরিয়া তাদের প্রতিশ্রুতি মতো আমাদের অল্পস্বল্প মালপত্তর সেখানে পৌঁছে দিল। ওরা যত ভিজল, আমরা তত ভিজলুম না। কারণ আমাদের গায়ে বর্ষাতি চাপানো। কিন্তু বাংলোর বারান্দায় উঠেই আমার বন্ধুটি ভীষণ কাশতে শুরু করলেন।

চৌকিদার বদ্রীনাথ বয়সে প্রৌঢ়। পেটাই শরীর। বেঁটে, এবং মুখের গড়ন কিঞ্চিৎ বর্তুলাকার। তাকে অমায়িক ও আমুদে লোক বলে মনে হলো। সে আমার সঙ্গী ভদ্রলোকের কাশি দেখে কেন কে জানে হাসি চাপছিল। একটু পরে অনুমান করলুম সম্ভবত কাশির শব্দটাই তার হাসির কারণ।

হাসি আমারও পাচ্ছিল। কারণ, এযাবৎকাল এই খ্যাতনামা গোয়েন্দা এবং প্রকৃতিবিদ বৃদ্ধলোকটির এমন দুরবস্থা কখনও প্রত্যক্ষ করিনি। কাশতে কাশতে উনি যেভাবে ঝুঁকে পড়ছিলেন ভয় হচ্ছিল, দম আটকে বেঘোরে মারা না পড়েন। কিন্তু কাশি থামার সঙ্গে সঙ্গে ওঁর দুচোখে সেই সুপরিচিত উজ্জ্বল হাসি ছলছল করে উঠছিল। এ হাসি প্রতিফলনের দরুণ দ্বিগুণ উজ্জ্বল-জলে আলোর ছটা পড়লে যা হয়। ওঁর চোখে কাশি জনিত জল ছিল।

অক্টোবরেই উচ্চতার দরুন এ তল্লাটে আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। তার ওপর এই বৃষ্টি। শূন্য ফায়ারপ্লেসের দিকে চেয়ে আমি একটা মতলব ভঁজছি টের পেয়ে উনি বললেন, দরকার হবে না ডার্লিং! বরং তুমি বদ্রীকে বলল, ঝটপট কফিটা নিয়ে আসুক। আর শোনো, আমার কিটব্যাগ খুলে ডানদিকে খোপ থেকে ক্ষুদে শিশিটা বের করো।

বদ্রীর উদ্দেশ্যে হাঁক মেরে জলদি কফি করতে বলার পর কিটব্যাগ খুলে। শিশিটা এনে দিলুম। টেবিলের পাশে পা ছড়িয়ে আরাম কেদারায় বসে উনি শিশি থেকে লালরঙের কয়েকটা গুলি বের করলেন। মুখে ফেলে চুষতে থাকলেন।

জিজ্ঞেস করলুম, হাই ওল্ড ম্যান! বস্তুটি কি তানসেন গুলি?

টাকওলা প্রকাণ্ড মাথাটি দোলালেন মাত্র। তারপর অভ্যাসমতো সাদা দাড়িগুলোতে আঙুল বোলাতে থাকলেন। আমি বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকলুম।

বৃষ্টিঝরা অন্ধকার রাতে ডমরুনাথকে রহস্যময় দেখাচ্ছিল। একটু নীচে ওই বস্তী ও বাজারে সামান্য কয়েকটা আলো আবছা ঝিকমিক করছে। শুনেছি, তিনমাইল দূরের হাইড্রো-ইলেকট্রিক সেন্টার থেকে এখানে বিদ্যুৎ আসে। আসার কারণ বাবা ডমরু ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। সেই সুবাদে এই বাংলোও বিদ্যুৎ লাভে বঞ্চিত হয়নি।

এই সময় হঠাৎ কানে এল পাশের বদ্ধ ঘর থেকে কাদের কথাবার্তা চলেছে। আড়িপাতা স্বভাব আমার নয়। কিন্তু ওই কথাবার্তা স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। তার চেয়ে বড় কথা, একটি কণ্ঠ মহিলার।

অনেক সময় অনিচ্ছাসত্ত্বেও অন্যদের আলোচ্য কানে এসে ঢোকে এবং কিছু করার থাকে না–নেহাত শুনে যাওয়া ছাড়া। বদ্রীর কফি করতে মিনিট সাতেক লাগল। তার মধ্যে আমি অনেকগুলো কথা শুনে ফেললুম।

কিছুক্ষণ পরে কফি খাচ্ছি, গোয়েন্দাপ্রবর মাঝেমাঝে অদ্ভুত শব্দে কেশে উঠছেন–বদ্রী এসে জিজ্ঞেস করল, সায়েবরা সঙ্গে রাতের খাবারদাবার এনেছেন, নাকি তাকে খানার বন্দোবস্ত করতে হবে?

আমরা কিছু আনিনি এবং তাকেই সব ব্যবস্থা করতে হবে, শুনে সে চলে যাচ্ছিল। আমি ডাকলুম, বদ্রী, শোনো।

বদ্রী জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

বললুম– পাশের ঘরে কারা এসেছেন মনে হলো?

হ্যাঁ স্যার। ওনারাভি বাঙালী আছেন। কলকাতা থেকে আজ সকালে এসেছেন।

স্বামী স্ত্রী?

বদ্রী কেমন হাসল শুধু।

স্বামী-স্ত্রী নয়?

বদ্রী ফের হেসে বলল, নয়–তা তো বলিনি স্যার!

বেড়াতে এসেছেন বুঝি?

তাছাড়া আর কেন এখন ডমরুনাথে লোকে আসবে? আপনারাও তো এসেছেন। বলে বদ্রী রহস্যময় হেসে চলে গেল।

বৃদ্ধ গোয়েন্দা এবার আরেক দফা কেসে আস্তে বললেন, তোমায় রীতিমতো উত্তেজিত মনে হচ্ছে ডার্লিং। তবে একটা কথা বলি শোনো। নরনারীর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো অভদ্রতা। সুতরাং আশা করি আজ রাতে যদি তেমন কিছু ঘটেও–তুমি যেন ব্যস্ত হয়ো না!

আমি একটু অবাক হয়ে বললুম– এর অর্থ?

অতি সরল। বলে উনি কফির সঙ্গে সেই লাল গুলিও ফের মুখে চালান করলেন।

সিগারেট ধরিয়ে হাসতে হাসতে বললুম– আপনি কি গণক, না অন্তর্যামী? কারা ও-ঘরে এসেছে, আমরা এখনও তাদের চাক্ষুষ পর্যন্ত করিনি। অথচ আপনি দৈববাণী করছেন যে, আজ রাতে কিছু ঘটতে পারে।

বৃদ্ধ চোখ বুজে গুলি চুষতে থাকলেন। হাঁটুর ওপর কফির পেয়ালা। পেয়ালার ভাপ নিচ্ছেন হাতে এবং সেই হাত মাঝে মাঝে গালে ও কম্ফোর্টার সরিয়ে গলায় বুলোচ্ছেন।

ডাকলুম, কর্নেল!

 বলো জয়ন্ত! ঐ দৈববাণীর কারণ কী?

কর্নেল চোখ খুলে একটু হাসলেন। বললেন, তোমার উত্তেজিত চেহারা দেখে যা মনে এল, বলেছি ডার্লিং!

ভ্যাট! আমার চেহারায় কিছু নেই।

গোয়েন্দাপ্রবর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, যখন তুমি বারান্দায় গেলে, তখন তোমার চেহারায় প্রশান্তি ছিল। যখন তুমি ঘরে ঢুকলে, তখন তোমার চেহারায় রীতিমতো উত্তেজনা ছিল। তারপর তুমি বদ্রীকে জেরা করতে শুরু করলে। সব মিলিয়ে আমার মনে হলো, বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুমি ও-ঘরে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আড়ি পেতেছিলে! নিশ্চয় তেমন কিছু কানে এসেছিল তোমার–যাতে…

বাধা দিয়ে হাসতে হাসতে বললুম– হার মানছি। কিন্তু হে বৃদ্ধ ঘুঘুমশাই। ব্যাপারটা কিন্তু সত্যি বড্ড গোলমেলে। আমি অকারণে উত্তেজিত হইনি!

কর্নেল চোখ বুজে বললনে, বলে যাও ডার্লিং! আমি সবকিছুতেই আগ্রহী।

চাপা গলায় বললুম– ওঁরা ভীষণ ঝগড়াঝাটি করছিলেন। কারণটা বোঝা গেল না। ভদ্রলোক বলছিলেন, তুমি নিজেই এ জন্যে দায়ী, এ সব কথা আগে জানলে কিছুতেই আমি আসতুম না এখানে। ভদ্রমহিলা বলছিলেন, ন্যাকামি কোরো না! তুমি জেনেশুনেই এসেছ। তুমি কী তা এতদিনে হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছি। তারপর শুনি, ভদ্রলোক ক্ষেপে গেছেন যেন। বললেন এখনই আমি চলে যাচ্ছি। থাকো তুমি একা! বিশ্বাসঘাতিনী মেয়ে কোথাকার! তারপর ভদ্রমহিলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

হুঁ। ইন্টারেস্টিং। তারপর?

 তারপর আর কোনও সাড়াশব্দ ছিল না। চলে এলুম।

কর্নেল কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, বদ্রীও কী যেন আঁচ করেছে মনে হলো। কেমন হাসছিল।

এই সময় কড় কড় কড়াৎ করে মেঘ ডাকল। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে বাতাসের শোঁ শোঁ শোনা গেল। জানলাগুলো বন্ধই ছিল। দরজার পর্দা দুলে উঠল। তখন দরজা বন্ধ করে দিলুম।

কর্নেল বললেন, সন্ধ্যা থেকে টিপটিপ করে ঝরছিল। তখনই বুঝেছিলুম, রাতের দিকে অবস্থা যোরালো হবে। জয়ন্ত তরাই অঞ্চলের পাহাড়ে ঝড়বৃষ্টির রাত বড় রোমাঞ্চকর। ওই শোনন, বাবা ডমরুনাথ ডমরু বাজিয়ে এবার বেজায় রকমের একটা নাচ জুড়বেন। খাসা!

বাইরে বাতাসটা বাড়তে থাকল। তার সঙ্গে মুহুর্মুহু বজ্রপাত এবং মেঘের গর্জন শুরু হলে বাংলো কাঁপতে থাকল। বললুম– সর্বনাশ! সেবার এ তল্লাটে এসে সাতদিন আটকে গিয়েছিলুম মনে পড়ছে কর্নেল? ধস ছেড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এবারও তাই হবে নাকি?

হলেও অবাক হব না। কর্নেল নিরাসক্তভাবে বললেন।

তবে স্বস্তির কারণ, ওঁর কাশিটা কমেছে। আমি পা ছড়িয়ে আরাম পাওয়ার চেষ্টায় সিগারেট ধরালুম। কিন্তু মনের ভেতর পাশের ঘরের সেই তর্কাতর্কি সারাক্ষণ প্রতিধ্বনি করে চলেছে। একটা যুক্তিসঙ্গত ঘটনা দাঁড় করার চেষ্টা করছি। কিন্তু দাঁড়াচ্ছে না। ভদ্রলোক ভদ্রমহিলাকে কিসের জন্য দায়ী করেছে? কী জানতে পারলে এখানে আসতেন না? আর ভদ্রমহিলাই বা কেন বলছেন,  জেনেশুনেই এসেছ তুমি! ব্যাপারটা কী হতে পারে?

এতকাল ধরে গোয়েন্দার সঙ্গগুণে সবতাতে কৌতূহলী হওয়ার স্বভাব আমাকে পেয়ে বসেছে। ঝোঁকের মাথায় উঠে দাঁড়ালুম। কর্নেল চোখ বুজে শরীর এলিয়ে বসে আছেন। বর্ষাতিটা গায়ে চড়িয়ে দরজার দিকে এগোলে বললেন, বেরিয়ো না জয়ন্ত। ঝড়ে উড়ে যাবে। তাছাড়া কৌতূহল জিনিসটা অনেক সময় অকারণ বিপদে ফেলে। চুপ করে বসো।

কথা কানে নিলুম না। দরজা খুলতেই ভেজা পর্দা গায়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। কর্নেল বিরক্ত হয়ে ফের বললেন, তুমি দেখছি কেলেংকারি না বাধিয়ে ছাড়বে না জয়ন্ত! লক্ষ্য করেছ কি, আমার স্বরভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ? যে ঠাণ্ডা বাতাসটা এইমাত্র ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে, আজ রাতে সে আমার গলার বারোটা বাজাবে। দরজা বন্ধ করো শীগগির!

দরজা বন্ধ করার মুখে আবছা একটা চিৎকার কানে এল যেন। ভুল হতেও পারে। কিন্তু গা শিউরে উঠেছিল। দরজা বন্ধ করে বললুম– কে চেঁচাল, শুনতে পেলেন?

কর্নেল ওভারকোটের কলার আরও তুলে মাথার দুপাশটা ঢেকে বললেন, না।

 আমার ধারণা পাশের ঘরে একটা কিছু..।

কথা কেড়ে বৃদ্ধ গোয়েন্দা বললেন, শুনেছি ডমরু পাহাড়ে ঝড়ের রাতে অনেক বিদঘুটে চিৎকার শোনা যায়। ভূতপ্রেত থাকা অস্বাভাবিক নয়। বাবা। ডমরুনাথ স্বয়ং মহাদেব কি না!

ক্ষুব্ধমুখে চুপচাপ বসে রইলুম। বাইরে ঝড়বৃষ্টি তুমুল চলতে থাকল। বজ্রপাত এবং মেঘের গর্জনে পৃথিবী কাঁপতে থাকল।

কতক্ষণ পরে বদ্রীর সাড়া এল দরজার বাইরে। দরজা খুললে সে ট্রে ভর্তি চাপাটি আর আলুর দম নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঝড়টা কমেছে। কিন্তু ছিটেফোঁটা বৃষ্টি সমানে ঝরছে। বদ্রী বলল, তাহলে আপনারা খেয়ে নিন স্যার। দরকার হলে ঘণ্টার বোতাম টিপবেন।

বললুম– পাশের ঘরের ওঁদের খাওয়া-দাওয়ার কী হচ্ছে বদ্রী?

বদ্রী চোখ নাচিয়ে বলল, ক্যা মালুম! ওনারা রাতে কিছু খাবেন না বলেছেন।

দরজা বন্ধ আছে দেখলে?

জী হাঁ।

বদ্রী চলে যাচ্ছিল, ডাকলুম–শোনো।

 বলুন স্যার!

কিছুক্ষণ আগে কে চেঁচিয়ে উঠল মনে হলো। শুনছ?

বদ্রী হাসল।…..ও কিছু না স্যার। ঝড়ের রাতে এমন আজব শব্দ হয়। শুনতে নেই।

সে চলে গেলে কর্নেল উঠলেন। বললেন, জয়ন্ত! তুমি কি ভাবছ, ডমরুনাথে এসে তোমার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য কিছু লোভনীয় রসদ সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে?

হাসতে হাসতে বললুম– আপনার গলা বেশ ভেঙে গেছে কর্নেল!

আরও ভাঙবে। সকালে হয়তো আর কথাও বলতে পারব না। কর্নেল টেবিলে ট্রের দিকে ক্ষুধার্ত চোখে তাকিয়ে বললেন। হুম! তাই আগে থেকে বলে রাখি, অকারণ পাশের ঘরে নাক গলিও না। বিপদে পড়বে। এবং সে বিপদে বৃদ্ধের সাহায্য পাবার আশা বৃথা। কারণ তার প্রচণ্ড কাশিজনিত স্বরভঙ্গ আসন্ন। গলার স্বর না। থাকলে গোয়েন্দাগিরিতে কোনও সুফল ফলে না।

কোনও কথা বললুম– না। কিন্তু বিপদে পড়ার কথা কেন বলছে কর্নেল, একথা ভেবেই কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। তাছাড়া স্বরভঙ্গের সঙ্গে গোয়েন্দাগিরির বৈরীভাবের কারণ কী, তাও বুঝলুম না।

.

০২.

 রাতে উল্লেখযোগ্য আর কিছু ঘটল না, কর্নেলের কাশিও বিশেষ শুনলুম না। তবে একবার মনে হয়েছিল, বাইরে বারান্দায় কার বা কাদের চলাফেরার শব্দ শুনছি। ভাল করে শোনার আগেই সেটা থেমে গেল।

আমার ঘুম ভাঙে দেরিতে। অভ্যাস মতো লক্ষ্য করলুম, প্রকৃতিবিদ নিত্য নৈমিত্তিক প্রাতঃভ্রমণে গেছেন। দরজা ভেজানো রয়েছে।

থাক গে, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। ভেবেছিলুম, কাশিটা রাতারাতি বেড়ে যাবে। বাড়েনি এবং জ্বরজ্বালা এসে কাহিল করেনি বুড়োকে। করলে এ বিদেশ বিভুয়ে কেলেংকারি হতো। ভ্রমণের আনন্দ মাঠে মারা যেত।

প্রকৃতি আজ হাসিখুশি ও পরিচ্ছন্ন। আকাশ পরিষ্কার নীল। রোদে ভেসে যাচ্ছে পাহাড় ও সবুজ বনস্থলী। হিমালয় জঙ্গলের তাবৎ পক্ষিকুল যেন এক সঙ্গে গলা ছেড়ে গান ধরেছে।

একটু পরে বদ্রী দিনের প্রথম সেলামসহ চা দিতে এলে বললুম– খবর বলল বদ্রী!

বদ্রী হাসল। সে টের পেয়েছে, আমি কী জানতে চাইছি। বলল, খবর ভাল স্যার! পাশের ঘরের বাবুসাবকে দেখতে পাচ্ছি না। মেমসাব একা আছেন। উনিও ভি চলে যাবেন বললেন। বেলা সওয়া ন’টায় বাস আসবে। বাসে তুলে দিতে হবে ওনাকে।

বদ্রী চলে গেলে একটু নিরাশই হলুম। নাটকটা জমল না।

চা খেয়ে সিগারেট টানতে টানতে বেরোলুম। বারান্দা থেকে লনে নামতেই পেছনে আস্তে কেউ ডাকল-শুনুন!

ঘুরেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। প্রায় চেঁচিয়ে উঠলুম–প্রণতি! তুমি এখানে!

প্রণতিও ভীষণ অবাক হয়ে গেল। দরজা থেকে পর্দা তুলে আমাকে ডেকেছিল– এখন ছিটকে বারান্দায় বেরিয়ে এল। বলল, জয়ন্ত! তুমি এখানে?

প্রণতির গলার স্বর কাল রাতে কেন চিনতে পারিনি, তার কারণ নিয়ে মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ বাহুল্য। আসলে এমন একটা দুর্গম জায়গায় তার অস্তিত্ব স্বপ্নেও ভাবা যায় না।

কো-এডুকেশনের কলেজে প্রণতি আমার সহপাঠিনী ছিল। তার সঙ্গে প্রেম করার কথা ভুলেও ভাবিনি কোনওদিন। তবে তার প্রতি মোহ ছিল না এমন নয়। সে-মোহ ওর সৌন্দর্য এবং ব্যক্তিত্বের প্রতি। তাছাড়া আমাকে সে পাত্তা দেবেই বা কেন? এম. এ. পড়তে গিয়ে লক্ষ্য করেছিলুম, প্রণতি পিছিয়ে পড়েছে। আমার মতো সেও ইংরেজি নিয়ে পড়ত। তার পিছিয়ে পড়ার কারণ শুনেছিলুম বিয়ে। যতদুর জানতুম, সে ছিল একটা সওদাগরী আপিসের সাধারণ কেরানীর মেয়ে। এক্ষেত্রে মেয়ের সৌন্দর্য থাকলে নিম্নবিত্ত অভিভাবকরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেন না।

প্রণতির বিয়ের নেমন্তন্ন আমি পাইনি। তার সঙ্গে বেশ কয়েকটা বছর দেখা হয়নি। গত বছর রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। কিন্তু তার সেই উজ্জ্বল লাবণ্য আর তত ছিল না। গায়ে মেদও জমেনি। বরং আরও রোগা হয়ে গেছে। কারণ হিসেবে সে অসুখ বিসুখের কথাই বলেছিল। স্বামী সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলেনি। তখনই আমার মনে হয়েছিল, দাম্পত্য জীবনে প্রণতি সুখী নয় হয়তো।

ডমরুনাথে এসে তার সঙ্গে এ-ভাবে দেখা হওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রণতির চেহারা গতবছর যেমন দেখেছিলুম, প্রায় তেমনি রয়েছে। প্রথম বিস্ময় কেটে যাবার পর আমরা বারান্দার চেয়ারে বসলুম। তারপর প্রণতি ডমরুনাথে আসার কারণ যা বলল, তা এই: তার স্বামী নীতিশ ইঞ্জিনিয়ার। এখান থেকে তিন মাইল দূরে সারাঙ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে সে সম্প্রতি বদলি হয়ে এসেছে। সারাঙে যেতে হলে ডমরুনাথে নামতে হয়। এখান থেকে দুর্গম পাহাড়ি পথ। তাই বিকেলে পৌঁছে এই বাংলোয় আশ্রয় নিয়েছে। খবর না দিয়ে আসার জন্য এই গণ্ডগোল। ভোরে খবর পাঠিয়েছে। নীতিশ জিপ নিয়ে এসে যাবে–সেই প্রতীক্ষা এখন।

হ্যাঁ, এক আত্মীয়ের সঙ্গেই এসেছে প্রণতি। তিনি ভোরে সারাঙ চলে গেছেন খবর দিতে।…

প্রণতির এই বিবরণ শোনার পর বলা বাহুল্য মনে মনে আমি হাসলুম। প্রণতি কতটা সত্য বলছে, তা জানি না। কিন্তু কতটা মিথ্যা বলছে, তা ধরতে পারছি, প্রথমত, ‘আত্মীয়’ ভদ্রলোকের সঙ্গে রাতে সেইসব রহস্যময় ঝগড়াঝাটি ও কান্নাকাটি–দ্বিতীয়ত, বদ্রীকে বলেছে, সওয়া ন’টার বাসে তুলে দিতে।

আমি ধূর্ত প্রশ্ন ছাড়লুম-খবর না দিয়ে এভাবে আসা কি ঠিক হয়েছে? ধরো, যদি নীতিশবাবু দৈবাৎ কোথাও গিয়ে থাকেন, তোমার আত্মীয় ভদ্রলোক কী করবেন? খামোক হয়রান হয়ে ফিরে আসবেন।

প্রণতি জবাব দিতে দেরি করল না। ভুরু কুঁচকে বলল, আমি ফিরে যাব।

 সে কী?

প্রণতি জবাব দিল না। একটু চুপ করে থাকার পর বললুম– তোমার এখানে অপেক্ষা করার অসুবিধে নেই অবশ্য। নীতিশবাবু যদি সারাঙে নাই থাকেন এবেলা, তুমি অপেক্ষা করবে। আর যদি বলল, আমি এখানেই জিপের ব্যবস্থা করে তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসব’খন।

প্রণতি গুম হয়ে শুধু মাথাটা দোলাল।

বললুম– ব্যাপারটা কী বলো তো প্রণতি?

কী ব্যাপার?

হাসলুম। …অনেক খটকা লাগছে। মানে হঠাৎ তোমার এভাবে আসা…

প্রণতি কথা কেড়ে বলল, কী করব? একটা চরমহেস্তনেস্ত করা তো দরকার। কলকাতা থেকে সেজন্যে ছুটে এসেছি।

আপত্তি না থাকলে ব্যাকগ্রাউণ্ডটা জানাতে পারো। আস্তে এবং সহানুভূতি মিশিয়ে কথাটা বললুম–।

প্রণতি একটু চুপ থাকার পর বলল, তুমি তো আগে ভীষণ ইনটেলিজেন্ট ছিলে। টের পাচ্ছ না?

অতি সামান্য।

সেই যথেষ্ট। বলে প্রণতি উঠে দাঁড়াল।

তাকে হঠাৎ ব্যস্ত মনে হলো। ঘড়ি দেখল সে। তারপর মুখটা ঘুরিয়ে ওপাশে নিচে রাস্তার দিকে তাকাল। হাসতে হাসতে বললুম– কিছু যদি মনে না করো, আমার কথা শোনো। তুমি এখানে অপেক্ষা করো। আমি তোমার দূত হয়ে বরং বেরিয়ে পড়ি। আমার হাতে অঢেল সময়। তাছাড়া করার মতো একটা কাজও জুটে গেল বরাতে।

প্রণতি গম্ভীরমুখে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, শমীক তো গেছে।

শমীক কে?

আমার পিসতুতো দাদা–যার সঙ্গে এসেছি।

 উনি সারাঙের রাস্তা চেনেন তো? বড্ড গোলমেলে এ এলাকার রাস্তাঘাট।

চেনে।

প্রণতির হাবভাব আমার বরদাস্ত হচ্ছিল না। উঠে দাঁড়িয়ে বললুম– ঠিক আছে। আমি একটু ঘুরতে বেরুব। যদি অসুবিধে হয় জানিও।

প্রণতি কোনও কথা বলল না। আমি হনহন করে গেট পেরিয়ে টিলা থেকে নামতে থাকলুম। নিচের রাস্তায় গিয়ে এদিক ওদিক তাকালুম। এমন উজ্জ্বল সকালে প্রণতির ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামানোর মানে হয় না। মোড়ে এগিয়ে বাঁদিকে একটা সঙ্কীর্ণ পিচের পথ দেখতে পেলুম। সেখানে একটা ফলকে লেখা আছে সারাঙ চার কি. মি.। একটা তীরচিহ্নও আছে। সেই পথ ধরে আনমনে হাঁটতে থাকলুম। পথটা আঁকাবাঁকা। একপাশে পাহাড়ের দেয়াল, অন্যপাশে অতল খাদ। তাকালে মাথা ঘুরে ওঠে। কিছুদূর চলার পর আবছা জলের শব্দ কানে এল। খুঁজতে খুঁজেত আবিষ্কার করলুম, বাঁকের ওধারে একটা ঝর্ণা রয়েছে।

ঢালু ধাপবন্দী পাথর বেয়ে নেমে ঝর্ণার নিচে গেলুম। হাত পঁচিশেক চওড়া একটা নদীর ধারা সৃষ্টি করেছে ঝর্ণাটা। তার ওধারে বালি ও পাথরে ভর্তি অনেকটা চওড়া জায়গায় ছোট ছোট ঝোপ গজিয়েছে। ঝোপে অজস্র নীল ফুল ফুটেছে। পাথরে পা রেখে ডিঙিয়ে সেই ঝোপগুলোর কাছে গেলুম। জলের শব্দে কান ঝালাপালা হচ্ছিল।

একটা উঁচু পাথরে পা ঝুলিয়ে বসে হাত বাড়িয়ে একটা নীল ফুল ছিঁড়তে গিয়েই চমকে উঠলুম।

ওপাশে বালির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে কেউ। পরনে প্যান্ট, শার্ট, পায়ে জুতো রক্তে মাখামাখি অবস্থা। রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে এবং রঙটা কালচে হয়ে। গেছে।

তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে যে আতঙ্ক ও বিস্ময় চেপে ধরেছিল, তার মধ্যেই দুটো জিনিস মাথায় এল। এটা একটা হত্যাকাণ্ড এবং হত্যাকাণ্ডটা ঘটেছে বৃষ্টি ছেড়ে যাবার অনেক পরে। সম্ভবত ভোরের দিকে।

অনেক বছর ধরে প্রখ্যাত এক গোয়েন্দার সহবাসে এসব জিনিস দেখার সাধারণ আতঙ্ক আমি অনেকটা এড়াতে শিখে গেছি। সেই সঙ্গে গোয়েন্দাসুলভ তদন্তবৃত্তিও অবলম্বন করতে শিখেছি।

আতঙ্ক ও বিস্ময় জোর করে তাড়িয়ে প্রথমে আশেপাশে বালির দিকে তাকালুম। জুতোর ছাপ আছে অনেকগুলো। ধস্তাধস্তির চিহ্ন প্রকট।

সেই ছাপের মধ্যে নিজের জুতোর ছাপ জুড়ে দেওয়া সঙ্গত মনে করলুম না। পাথরের ওপর পা রেখে হামাগুড়ি দিয়ে ঝুঁকে লোকটার মুখ দেখার চেষ্টা করলুম। মুখটা কাত হয়ে আছে। চোখ দুটো একটু ফাঁক। মনে হলো, আক্রমণ ঘটেছিল আচম্বিতে। লোকটা এখানে বসে কারুর জন্য অপেক্ষা করছিল কি?

আশেপাশে খুঁজতে খুঁজতে আরেকটা জিনিস চোখে পড়ল। পাথরে লাফ দিয়ে দিয়ে এগিয়ে ঝুঁকে দেখি, এইখানে অনেকটা বালি সরানো। গর্ত হয়ে রয়েছে। কেউ বা কারা বালির তলা থেকে কিছু উদ্ধার করে নিয়ে গেছে।

 আবার লোকটার দিকে তাকালুম। আমারই বয়সী। প্রণতির পিসতুতো দাদা শমীক নয় তো? শিউরে উঠলুম। তারপর পাথর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে ফের তার কাছে চলে এলুম। ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে তার বুকপকেটে ঢোকানোর চেষ্টা করলুম। যদি কোনো কাগজপত্র পেয়ে যাই!

কিন্তু সেই সময় আচমকা আমার পাশেই ঠকাস করে একটা ঢিল পড়ল। লাফিয়ে উঠলুম। মুখ তুলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, ঠকাস করে আরেকটা ঢিল পড়ল পাথরে।

এবার দেখতে পেলুম, ঝর্ণার ওপর বাঁদিকের প্রকাণ্ড পাথরে দাঁড়িয়ে আছেন আমার বৃদ্ধ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। টাক ঢাকা সাদা টুপি রোদে ঝলমল করছে। গলায় কম্ফোর্টার জড়ানো। এক হাতে প্রজাপতি ধরা জাল, অন্যহাতে একগুচ্ছের ঢিল।

বুঝলুম, স্বরভঙ্গ যথার্থ ঘটেছে। তাই এই ঢিল। কিন্তু হাসবার মতো মনের অবস্থা নয়। ওঁকে দেখামাত্র সাহস ও উৎসাহ বেড়ে গেল। কীভাবে হাঁচড়-পাঁচড় করে ওই তিরিশ-পঁয়ত্রিশ ফুট উঁচু জায়গায় উঠে গেলুম বলতে পারব না।

পৌঁছেই হাঁফাতে হাঁফাতে বললুম– ওখানে একটা ডেডবডি পড়ে আছে কর্নেল। রীতিমত মার্ডার। রক্তে ভেসে গেছে।

কর্নেলের মুখটা গম্ভীর। হাতের ঢিল ফেলে নিজের মুখ হাঁ করে আঙুল দিয়ে বোঝালেন, স্বরভঙ্গ ঘটেছে। তারপর বোবার ভঙ্গিতে ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, কিছুক্ষণ আগে তিনিও লাশটা আবিষ্কার করেছেন এবং একজন পথিককে দিয়ে ডমরুনাথ পুলিশ ফাঁড়িতে খবরও পাঠিয়েছেন। তারপর এখানে বসে শকুনের মতো অপেক্ষা করছিলেন, এমন সময় আমি হাজির হয়েছি। আমি কতটা কী করি, আমুদে বুড়ো তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছে। শেষে আমি বাড়াবাড়ি করছি দেখে ঢিল ছুঁড়ে আমাকে সতর্ক করে দিয়েছেন।

আমি প্রণতির ব্যাপারটা বলার পর প্রশ্ন করলুম, এ দুইয়ে কি কোনও সম্পর্ক আছে?

কর্নেল পকেট থেকে একটুকরো সাদা চকপাথর বের করলেন। বুঝলুম, কোথাও কুড়িয়েছেন স্বরভঙ্গের দরুন ও পাহাড় পর্বতে জিনিসটা কাজে লাগবে বলে।

খড়ি দিয়ে পাথরের ওপর লিখলেন : যদি নিহত ব্যক্তিটি সেই শমীক হয়, তাহলে তো সম্পর্ক থাকছেই। যদি না হয়, তাহলে কিসের সম্পর্ক?

বললুম– যাই বলুন। প্রণতির ব্যাপার-স্যাপার বড় গোলমেলে। খুব রহস্যময়।

কর্নেল লিখলেন : রহস্যময় কি না, সেটা বোঝা যাবে সারাঙ বিদ্যুৎকেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে। যদি সত্যি ওখানে নীতিশবাবু নামে কোনও ইঞ্জিনীয়ার থাকেন, তাহলে গোলমাল কিসের?

বললুম– রাতে ওই যে সব কথাবার্তা শুনলুম শমীক ও প্রণতির–তার মানেটা কী?

কর্নেল লিখলেন : মানেটার সঙ্গে কোনও ক্রাইম জড়িত না থাকতেও পারে। যাই হোক, আর কথা নয়। চুপচাপ বসে পুলিশের অপেক্ষা করা যাক। এ আমাদের নাগরিক কর্তব্য।

বললুম– ফাঁড়িতে তো শুধু সেপাইরা থাকবে। দেখবেন, গণ্ডগোলে না যেন পড়তে হয়। বিহারের পুলিশ সম্পর্কে আমার আতঙ্ক আছে।

কর্নেল চুপচাপ চুরুট ধরিয়ে টানতে থাকলেন। আমার কথাও গ্রাহ্য করলেন না।

কিছুক্ষণ পরে ওপাশে রাস্তায় জনা দুই সেপাইকে আস্তে-সুস্থে আসতে দেখলুম। তাদের পেছনে একজন দেহাতি মজুর গোছর লোক। বুঝলুম, ওকে দিয়েই কর্নেল খবর পাঠিয়েছিলেন।

 দেহাতি লোকটা ক্রমে আঙুল দিয়ে নিচে লাশটার দিকে সেপাই দুটোর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তারপর আমাদের দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে কিছু বলল।

আমরা নেমে গেলুম লাশের কাছে। সেপাই দুজন হোমরা-চোমরা ভঙ্গিতে জেরা শুরু করল। সব জবাব আমিই দিলুম। সেইসঙ্গে কর্নেলের স্বরভঙ্গের কথাও জানালুম। তখন দেহাতি লোকটা ফিক করে হেসে হিন্দিতে বলল, আমি ভেবেছিলুম বুড়োসায়েব বোবা-কালা!

সেপাইরা থানায় খবর পাঠিয়ে দিয়েছে। পাঁচমাইল দূরের থানা থেকে অফিসাররা এসে পড়বেন। ততক্ষণ আমাদেরও থাকতে হবে।..

.

০৩.

 প্রণতি এতে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে পড়ল। কারণ লাশটা তার স্বামী নীতিশের। পকেটে আইডেন্টটি কার্ড ছিল। জনান্তিকে আমি কর্নেলকে বললুম– যা বলেছিলুম, হলো তো? রাত থেকেই আঁচ করেছিলুম, একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটতে চলেছে।

কর্নেলের স্বরভঙ্গ। মুখে অসহায় মানুষের ভঙ্গি। করুণ হাসলেন মাত্র।

আমরা এখন বাংলোয় ফিরেছি। লাশ মর্গে চলে গেছে পুলিশের জিপে। সারা থেকে খবর পেয়ে একদল বিদ্যুৎকর্মী ও অফিসার এসেছিলেন। পুলিশের জেরায় নাস্তানাবুদ হয়ে গেছেন সবাই। বিহারের পুলিশ গা করে না তো করে না করলে বেজায় রকমের করে।

প্রণতি জেরার চোটে জেরবার। কোণঠাসা হয়ে নীরবে কান্নাকাটি করে যাচ্ছে সারাক্ষণ। আমার কষ্ট হচ্ছিল ওর অবস্থা দেখে। চক্রান্ত করে স্বামী হত্যার দায়ে গ্রেফতার করা হবে বলে শাসাচ্ছিলেন পুলিশের দারোগা ভদ্রলোক।

রাতের সেইসব ঘটনার কথা পুলিশকে আমি বলিনি। কর্নেল চোখ টিপে নিষেধ করেছিলেন।

কিন্তু বালির গর্তটা সম্পর্কে তীব্র কৌতূহল ছিল আমার। দারোগাবাবুকে জিগ্যেস করলে দ্রুত জবাব দিলেন, গর্ত করে লাশটা পুঁততে চেষ্টা করছিল খুনী। সম্ভবত কেউ এখানে গিয়ে পড়ায় সেটা পারেনি।

দুপুর বারোটার মধ্যে প্রণতিকে সত্যি সত্যি গ্রেফতার করে নিয়ে দারোগাবাবু সদলবলে প্রস্থান করলেন।

কিন্তু আশ্চর্য, প্রণতি আমাকে একবারও বলল না তাকে সাহায্য করতে। সে চুপচাপ চলে গেল।

বাংলো আবার নির্জন ও শান্ত হয়ে গেল। কর্নেল স্নান করলেন না আরও ঠাণ্ডা লাগবার ভয়ে। আমি স্নান করবার পর খাবার টেবিলে বসে বললুম– দারোগা ভদ্রলোক যেভাবে কেস দাঁড় করালেন, আমার খটকা থেকে গেল কর্নেল।

কর্নেল তাকালেন।

বললুম– প্রণয়ী শমীককে নিয়ে এসে স্বামীকে ডেকে এনে খুন করাল প্রণতি এই হলো দারোগাবাবুর বক্তব্য। কিন্তু রাতে শমীকের সঙ্গে ঝগড়াঝাটির অর্থ কী? তাছাড়া শমীক বলছিল, এ জন্যে তুমিই দায়ি…

কর্নেল পকেট থেকে সেই চক পাথরটা বের করেছেন দেখে থেমে গেলুম। কর্নেল টেবিলে লিখলেন, খাওয়ার সময় মুখ বুজে থাকা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। তৃপ্তির সঙ্গে খেতে হলে কথা বলা উচিত নয়। বদ্রীর রান্নাও অতি উপাদেয়।

ক্ষুব্ধভাবে খাওয়াটা সেরে নিলুম। ঠিক করলুম, বুড়ো গোল্লায় যাক–আমি একা ব্যাপারটাতে নাক গলাব এবং রহস্যের ফদাই করে ফেলব ওঁর নাকের ডগায়!

খাওয়ার পর আমার একটু দিবানিদ্রার অভ্যাস আছে। সেই ঘুম ভাঙল বিকেল চারটেয়। উঠে দেখি কর্নেল নেই। বদ্রী চা দিতে এসে বলল, কর্নেল সাহাব একঘণ্টা আগে বেরিয়ে গেছেন।

আনমনে বললুম– আচ্ছা বদ্রী, তোমার কী মনে হয় বলো তো?

বদ্রী বলল, কী কথা বলছেন স্যার, বুঝতে পারছি না।

মানে–ওই খুনের ব্যাপারটার?

বদ্রী একটু হাসল। আমি ছোটা আদমি স্যার। আমার কী মনে হবে?

আমি তাকে জেরার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম, কাল রাতে চিৎকার শুনেছিলুম, তুমি বললে এখানে নাকি এমন চিৎকার রাতবিরেতে শোনা যায়। এটা বিশ্বাস হচ্ছে না বদ্রী।

বদ্রী চোখ বড় করে বলল, হ্যাঁ স্যার। আমি প্রায়ই শুনতে পাই। বাবা ডমরুনাথের চেলারা অমন করে চেঁচায়। তাই রাতবিরেতে আমি দায়ে না ঠেকলে। বেরুই নে।

আচ্ছা বদ্রী, শমীকবাবু ভোরে কখন বেরিয়েছিলেন, তুমি দেখেছ?

বদ্রী ঘাড় নাড়ল।

 এইসময় বাইরে কেউ ভারি গলায় ডাকল-বদ্রী দাস! বদ্রী দাস।

বদ্রী যেন চমকে উঠল। ঝটপট বেরিয়ে গেল। দরজার পর্দা তুলে উঁকি মেরে দেখলুম একজন লম্বা-চওড়া গড়নের ভদ্রলোক লনে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে একটা স্যুটকেস! বদ্রী তাকে সেলাম দিয়ে স্যুটকেসটা নিল।

তারপর আমাকে অবাক করে প্রণতিরা যে ঘরে ছিল, সেই ঘরের দরজা খুলে দিল। চাপা গলায় বলল, খুব সাংঘাতিক কাণ্ড হয়েছে রাণাসাহেব!

ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে চোখ টিপে বললেন, শুনেছি। চেপে যাও এখন।

ওই ঘরে প্রণতির কিছু জিনিসপত্র তখনও রয়ে গেছে। বদ্রীর জিম্মায় আছে। পুলিশের অনুমতি না নিয়ে ওঘরে বদ্রী এই রাণাসাহেবকে ঢোকাল, এটাই অবাক লেগেছে। পর্দার ফাঁকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইলুম। বদ্রী বেরিয়ে যাওয়ার পর বারান্দায় গেলুম। রাণাসাহেবের ঘরের দরজা বন্ধ। বদ্রী হনহন করে নেমে যাচ্ছে টিলা থেকে। একটু পরে সে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমার মনে রীতিমতো উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছে। রহস্য আরও ঘনীভূত হয়ে গেল যে!

আমি পা টিপেটিপে ওই দরজার কাছে গেলুম এবং কান পেতে রইলুম। ভেতরে চাপা কী একটা শব্দ হচ্ছে। বাক্স গোছানোর মতো। শব্দটা থামলে মনে হলো রাণাসাহেব দরজা খুলতে আসছেন। সঙ্গে সঙ্গে সরে এলুম। লনে গিয়ে সিগারেট ধরালুম।

কিছুক্ষণ পরে রাণাসাহেব বেরিয়ে গটগট করে আমার পাশ দিয়ে চলে গেলেন। আমাকে গ্রাহ্যও করলেন না। টিলা থেকে নেমে রাস্তায় উঠলেন ভদ্রলোক। তারপর ডমরু পাহাড়ের দিকে যেতে দেখলুম তাঁকে। পাহাড়ের চূড়ায় মন্দির। নিচে থেকে স্বাস্থ্যবান তীর্থযাত্রীদের জন্য নাক বরাবর সোজা একটা সিঁড়িও উঠে গেছে মন্দিরের দিকে। রাণাসাহেব সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। পুজো দিতে যাচ্ছেন নাকি?

বিকেলের আলো দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। পশ্চিমের পাহাড়ের পেছনে সূর্য নেমে গেছে। কুয়াশা ঘনিয়েছে। রাণাসাহেবের মূর্তি অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এদিকে বদ্রীও ফিরছে না! গেল কোথায় সে?

এইসময় আচমকা আমার কাঁধে টুপ করে একটা ঢিল পড়ল। পেছন ফিরে দেখি ওপাশে বদ্রীর ঘরের পেছনে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন গোয়েন্দা প্রবর কর্নেল সায়েব। হাসতে গিয়ে সংযত হলুম। কর্নেল ইশারায় ডাকছেন। মুখে ব্যস্ততা, ধূর্ততা ও ভীষণ গাম্ভীর্যের ছাপ।

কাছে যেতেই ইশারায় বদ্রীর ঘরের জানালার দিকে কিছু দেখালেন। চাপা গলায় বললুম– কী ব্যাপার? আপনি এখানে কী করছেন?

কর্নেল আমাকে হিড়হিড় করে টেনে জানালার কাছে নিয়ে গেলেন। টালির চাল চাপানো এই লম্বাটে ঘরের একদিকে কিচেন, অন্যদিকে বদ্রীর থাকার ব্যবস্থা। পেছনের জানালাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে। সম্ভবত এ বুড়োরই কারচুপি খড়খড়ির ফাঁকে লাঠি ঢুকিয়ে ছিটকিনি তুলে জানালাটা খুলে কিছু দেখছিলেন।

উঁকি মেরে কিছু নজরে পড়ল না। ভেতরে আবছা অন্ধকার। জিজ্ঞেস করলুম, কী?

কর্নেল অসহায়তার ভঙ্গিতে মাথাটা দোলালেন। তারপর জানালাটা বাইরে থেকে টেনে আটকে দিয়ে আমার হাত ধরে টানলেন।

ভীষণ টান। পরক্ষণে আমাকে দৌড় করিয়ে ছাড়লেন। নিজেদের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে টের পেলুম, বদ্রী ফিরে আসছে। তখন এভাবে পালিয়ে আসার কারণ বুঝতে পারলুম। বুড়োর কি সারা শরীরে অজস্র চোখ আছে?

ভেতরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন কর্নেল। তারপর পকেটের সেই চকপাথর বের করে টেবিলে খস খস করে যা লিখলেন, পড়ে দেখে আমি শিউরে উঠলুম। শরীর হিম হয়ে গেল।

কর্নেল লিখেছেন : বদ্রীর ঘরে একটা লাশ আছে।

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম ওঁর মুখের দিকে। এ কি সাংঘাতিক ব্যাপার! তাহলে কি আমরা এখানে এসে এক রক্তপাগল খুনীর পাল্লায় পড়ে গেছি? আর এ লাশটাই বা কার হতে পারে? কর্নেল গুম হয়ে বসে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন।

একটু পরে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলুম, কার লাস? শমীকবাবুর নাকি?

কর্নেল মাথাটা দোলালেন।

আরও ঘাবড়ে গিয়ে বললুম– সর্বনাশ! কিন্তু আপনি টের পেলেন কীভাবে?

কর্নেল লিখলেন : প্রশ্ন নয়। চুপচাপ থাকো। বদ্রীকে কফি দিতে বলল।

আমার আর সাহস হচ্ছিল না বেরুতে এবং বদ্রীর মুখোমুখি দাঁড়াতে। ভোজালির কোপ ঝাড়লেই হলো। ব্যাটা যে এমন সাংঘাতিক খুনী কে জানত! অমন অমায়িক হাসিখুশি চেহারা। আর পেটে এই সাংঘাতিক হননেচ্ছা!

ইতস্তত করছি দেখে কর্নেল থামলেন। স্বরভঙ্গ না হলে দারুণরকমের রসিকতা করতেন, সেটা ওর চোখ দেখেই বোঝা গেল।

দরজায় উঁকি মেরে ডাকলুম, বদ্রী! বদ্রী!

ওপাশ থেকে সাড়া এল, যাই স্যার!

কফি চাই বদ্রী! জলদি।

আচ্ছা! বদ্রী জবাব দিল।

বাইরে আলো জ্বলে উঠল একটু পরে। ইতিমধ্যে আমি চাপা গলায় জনৈক রাণাসাহেবের আগমন ও বদ্রীর সঙ্গে তার কথোপকথন জানিয়ে দিলুম কর্নেলকে। কর্ণেল নিরুত্তর এবং নির্বিকার।

আবার লাশটার কথা ভাবতে থাকলুম। আশ্চর্য, দুপুরঅব্দি এ বাংলোয় পুলিশের সমাগম ছিল। কত জেরা, কত খোঁজখবর হলো। অথচ কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, ওপাশে বদ্রীর ঘরের ভেতর আরেকটা লাশ লুকোনো রয়েছে!

বদ্রী কফি নিয়ে এল। কিন্তু মুখটা ভারি গম্ভীর। জিজ্ঞেস করল, রাতে কি খানার বন্দোবস্ত করতে হবে?

ওর হাতে খেতে আমার বাধছিল। ভাগ্যিস কর্নেল ইশারায় জানিয়ে দিলেন, তবিয়ত ঠিক নেই। কিছু খাবেন না। আমিও বলে দিলুম, শরীর খারাপ। খাব না।

বদ্রী দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে হয়তো কিছু আঁচ করতে চাইল। তারপর চুপচাপ বেরিয়ে গেল।

ফিসফিস করে বললুম– কর্নেল! পুলিশে খবর দেওয়া উচিত ছিল না কি?

 কর্নেল ঘড়ি দেখে মাথাটা রহস্যজনক ভঙ্গিতে দোলালেন শুধু।…

.

০৪.

তারপর ঘণ্টা তিনেক কেটে গেছে। রাতের অন্ধকার পরিবেশকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। কর্নেল চুপচাপ শুয়ে একটা বই পড়ছে। আমি চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে আকাশপাতাল হাতড়ে এই যুগল হত্যাকাণ্ডের জট ছাড়ানোর চেষ্টা করছি। দরজা বন্ধ করা আছে। হঠাৎ বাইরে পরপর দুবার গুলির শব্দ এবং চিৎকার ও তর্জনগর্জন শোনা গেল।

কর্নেল বই ফেলে উঠে পড়লেন এবং ঝটপট দরজা খুলে বেরুলেন। আমিও বেরুলুম।

রেরুতেই চোখে টর্চের আলো পড়ল।

আলো সরে যাওয়ার পর পুলিশের মূর্তি দেখে আচ্ছন্নতাটা মুহূর্তে কেটে গেল। একদঙ্গল সশস্ত্র পুলিশ বাংলোকে হুলস্থূল করে ফেলেছে। বদ্রীর ঘরের দিকে দৌড়ে গেলেন কর্নেল। পেছন-পেছন আমিও গেলুম। গিয়ে দেখি, তেরপলে জড়ানো একটা লাশের সামনে পুলিশ অফিসাররা দাঁড়িয়ে আছেন এবং বদ্রী হাঁটু চেপে ধরে বসে আছে। মুখটা বিকৃত। তার পায়ে রক্ত এবং আঙুলেও সেই রক্তের ছোপ। গুলি লেগেছে পায়ে, সেটা বোঝা গেল।

তার কাঁধ ধরে, একজন পুলিশ অফিসার তাকে ওঠাল। তারপর ওই আহত অবস্থায় হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল গেটের দিকে। বুঝলুম, খুনে শয়তানটাকে শ্রীঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

তেরপল সরিয়ে লাশটা বের করা হলো। নীতিশবাবুর বয়সী এক যুবকের লাষ। তেমনি রক্তাক্ত। একেবারে জবাই করা অবস্থা।

তাহলে কাল রাতে যে চিৎকার শুনেছিলুম, তা কিসের এতক্ষণে বোঝা যাচ্ছে।

কিন্তু কেন বদ্রী এভাবে পরপর দুটো খুন করেছে? মাথা মুণ্ডু কিছু বোঝা যাচ্ছে না। যিনি বোঝেন, অর্থাৎ বুড়ো ঘুঘুমশাই স্বরভঙ্গ ধরিয়ে বসে আছেন। এককথায় যে আভাস দেবেন, আপাতত সে আশা নেই। কাগজকলম করে তাকে সবটা জানাতে হবে। কিন্তু সে তো সবকিছু চুকেবুকে গেলে, তবে।

এই হট্টগোলের মধ্যে রাণাসাহেবের কথা মনে পড়ে গেল।

ঘুরে প্রণতিদের ঘরের দিকে তাকালুম। আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, সদ্য পুলিশের ঝাঁক তাকে ঘিরে ফেলল। রাণাসাহেব বেজায় হম্বিতম্বি জুড়ে দিলেন ইংরেজি ভাষায়। কোনও কাজ হলো না। পুলিশ তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল গেটের দিকে। ওধারে পুলিশভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে।

লাশটা তেরপল জড়ানো অবস্থায় নিয়ে গেল ভ্যানের দিকে। তারপর জনাতিনেক অফিসার এবং কর্নেল বারান্দায় উঠলেন। অনুসরণ করলুম তাদের।

আমাদের ঘরে রীতিমতো বৈঠক বসল। এক্ষেত্রে কর্নেলের একটা লম্বাচওড়া ভাষণ দেওয়ার কথা। কিন্তু তার স্বরভঙ্গ।

পকেট থেকে একটা মোড়ক বের করে টেবিলে রাখলেন কর্নেল। একজন অফিসার মোড়কটা খুলে সবিস্ময়ে বললেন, এই সেই সোনার ডমরু! এরই জন্যে এত খুনোখুনি!

হা, প্রায় ছ’ইঞ্চি লম্বা এবং আন্দাজ ইঞ্চি তিনেক চওড়া অর্থাৎ ব্যাসের একটা ডমরু। ডমরুটা সোনার। একটু ময়লা দেখাচ্ছে। আনাড়ি চোখে ওটা পেতলের বলে ভুল হওয়া স্বাভাবিক।

কিন্তু এর সঙ্গে প্রণতির যোগাযোগ হলো কীভাবে?

অগত্যা জিজ্ঞেস করলুম পুলিশ অফিসারটিকে, ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন মশাই?

অফিসার তাঁর সঙ্গীদের দিকে এবং পরে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নিয়ে বললেন, আপনি তো সাংবাদিক?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

জব্বর স্টোরি পেয়ে গেলেন মশাই! খাইয়ে দেবেন কিন্তু।

দেব। কিন্তু স্টোরিটা কী?

এতদিনে এই প্রথম কর্নেলের বদলে রহস্য ফাঁসের ব্যাপারটা পুলিশের কাছ থেকে নোট করতে হলো আমাকে। কিন্তু পুলিশ যে স্টোরি দেয়, তা আইন বাঁচিয়েই দেয় এবং তাতে সব জট খোলা থাকে না, অভিজ্ঞতা থেকে এটা জানা আছে। কিন্তু আপাতত এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আমার বন্ধুর স্বরভঙ্গ থেকে আরোগ্য লাভ পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

সম্প্রতি কিছুদিন আগে বাবা ডমরুনাথের মন্দির থেকে এই সোনার ডমরু চুরি যায়। ডমরুটা খুব প্রাচীন। নেপালের রাজাদের অর্ঘ্য বাবা ডমরুনাথের শ্রীচরণে।

রাণাসাহেবের একটা চোরাচালানী গ্যাং আছে এ তল্লাটে। প্রবাবশালী লোক বলে তার গায়ে হাত দেওয়া যায়নি। অথচ পুলিশের সন্দেহ ছিল একাজ ওঁর গ্যাঙেরই।

বদ্রী ওঁর গ্যাঙের লোক। বদ্রীই চুরি করেছিল ডমরু। প্রণতির স্বামী নীতিশ আসলে সারাঙড্যামের ইরিগেশন ইঞ্জিনিয়ার। ওই ঝর্ণাটা নিয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকারের একটা প্রকল্প আছে। তার সার্ভে করতে গিয়ে ঝর্ণার ওখানে বালির তলায় সে সোনার ডমরুটা আবিষ্কার করে। স্ত্রীকে ব্যাপারটা লিখে জানায়। প্রণতি এসে গেলে দুজনে মিলে ওটা বাবা ডমরুনাথকে প্রত্যর্পণ করার কথাও লেখে।

শমীক প্রণতির পিসতুতো দাদা-টাদা নয়, পুরনো প্রেমিক। নীতিশ ব্যাপারটা একটু আধটু আঁচ করেছিল। কিন্তু বিশেষ গা করত না। ডমরুনাথে পৌঁছে দিতে এসেছিল শমীক, প্রণতির অনুরোধেই। প্রণতি তাকে কথায় কথায় সোনার ডমরুর। কথাও বলেছিল।

এখানে পৌঁছনোর পর প্রেমিক শমীক তার পুরনো প্রেমিকাকে স্বামীর কাছে যাবার আগে এই একটা রাত প্রচণ্ডভাবে কাছে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রণতি বেঁকে বসে। শমীকের সঙ্গে একঘরে রাত কাটাতে রাজি নয়। অথচ উপায় ছিল না। বৃষ্টি পড়ছিল। অমন দুর্যোগে সারাঙ যাবে কীভাবে? তাই এই বাংলোয় আশ্রয় নিতেই হয়েছিল শেষপর্যন্ত। তারপর শমীক প্রেমনিবেদন শুরু করে। প্রণতি বাধা দেয়। ঝগড়াঝাটি শুরু হয়। তখন শমীক ক্ষেপে গিয়ে বলে, তোমার স্বামী চোর। বাবা ডমরুনাথের সোনার ডমরু চুরি করেছে। ওকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেব।

সম্ভবত বদ্রী আড়ি পেতে ব্যাপারটা শুনেছিল। এই হলো প্রণতির জবানবন্দী।

ঝগড়াঝাঁটি চরমে উঠলে শমীক রাগ করে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে যায়। তারপর একটা কিছু ঘটেছিল। ওই সময় বদ্রী তাকে নিজের ঘরে স্বচ্ছন্দে খুন করে। কেনই বা খুন করল, কেন শমীক তার ঘরে গেল–এখনও বোঝা যাচ্ছে না। বদ্রীর জবানবন্দী আদায় করলে বোঝা যাবে।

ওদিকে নীতিশই বা ঝর্ণার ধারে খুন হলো কেন, তাও বোঝা যাচ্ছে না।

কর্নেল প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে তার লাশ দেখতে পান। লাশটা খুনী পুঁতে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, তার প্রমাণ ওই অসমাপ্ত গর্ত। কর্নেল গিয়ে পড়ায় সে পালিয়ে যায়। কর্নেল ঘুরতে ঘুরতে একটু তফাতে স্বচ্ছ জলের মধ্যে সোনার ডমরুটা আবিষ্কার করেন। বোঝা যায়, নীতিশের হাতে ওটা ছিল এবং খুনী তার ওপর হামলা করার সময় ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। খুনী আর ওটা খুঁজে পায়নি–অথবা খোঁজার সময়ও পায়নি।

কেন নীতিশ ডমরুটা নিয়ে এত ভোরে ওখানে এসেছিল?

আমার প্রশ্ন শুনে পুলিশ অফিসার বললেন, বদ্রীর জবানবন্দী না আদায় করলে অনুমান করা যাচ্ছে না কিছু। তাছাড়া সারাঙে এখনও তদন্ত করছেন আমাদের অফিসার।

বললুম– আমি প্রণতি ও শমীকের ঝগড়া শুনেছিলুম। শমীক বলছিল, তুমি নিজেই এজন্যে দায়ী…

কর্নেল পকেট থেকে চকপাথর বের করছেন দেখে থেমে গেলুম। কর্নেল লিখলেন টেবিলে : ওটা পুরনো কথা তুলে প্রেমিক-প্রেমিকার কলহ। অর্থাৎ প্রণতি নিজেই নীতিশের সঙ্গে বিয়ের জন্যে দায়ি। ওসব কথার সঙ্গে এ ঘটনার সম্পর্ক নেই।

পুলিশ অফিসাররা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর কর্নেল ও আমাকে বিদায় সম্ভাষণ করে চলে গেলেন।

বললুম– আপনার স্বরভঙ্গের আর সময় ছিল না? কেলেংকারি বটে!

কর্নেল করুণমুখে হাসলেন শুধু।…

.

০৫.

 ঘুম ভেঙে গেল অতি পরিচিত কণ্ঠস্বরে-সুপ্রভাত ডার্লিং। আশা করি, সুনিদ্রা হয়েছে? শুনে লাফিয়ে উঠে বসলুম। বাইরে সোনালী রোদ ঝলমল করছে। আমার বৃদ্ধ বন্ধু খাটের পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন।

চেঁচিয়ে উঠলুম, স্বরভঙ্গ সেরে গেছে আপনার?

কর্নেল মধুর হেসে বললে, প্রাচীন আয়ুর্বেদকে অবহেলা কোরো না বস? যষ্ঠীমধু এবং নানাপ্রকার শেকড়বাকড় সহযোগে প্রস্তুত ওই রক্তবর্ণ বটিকাগুলি আমাকে এক কবিরাজ উপহার দিয়েছিলেন। এতকাল ব্যবহারের সুযোগ পাইনি। পেয়ে ব্যবহার করে দেখলুম, অতি অব্যর্থ। কাশি তো তখনই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে স্বরভঙ্গও সেরে গেল। যাই হোক, ওঠো। চলো, আমরা নিচে রাস্তার ধারে খাবারের দোকানে গিয়ে গরম গরম কচুরি এবং চা সেবন করি গে! বদ্রী নেই–অতএব একটু কষ্ট করতেই হবে।

ঝটপট বাথরুম সেরে এসে দেখি, ঘুঘুমশাই তাঁর প্রজাপতি ধরা জাল, অত্যদ্ভুত ক্যামেরা, বাইনোকুলার ইত্যাদি কাঁধে ঝুলিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

দরজায় তালা এঁটে বেরিয়ে গেলুম দুজনে। টিলা থেকে ঢালু পিচের রাস্তায় নামতে নামতে বললুম– থানায় যাবেন না?

না ডার্লিং। আমার খাওয়াটা সেরে নিয়ে জঙ্গলের দিকে যাব।

বদ্রীর জবানবন্দীটা শোনার ইচ্ছে ছিল যে!

কর্নেল আমার একটা হাত ধরে বললেন, কী দরকার? সেটা তুমি আমার মুখেই শুনতে পারো।

আপনি জানেন সব?

আঁচ করেছিলুম কী ঘটতে পারে। কিন্তু স্বরভঙ্গ হয়ে গিয়ে অনিবার্য বিপদকে ঠেকাতে পারিনি।

আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলুম। বলেন কী!

কর্নেল আমাকে টানতে টানতে বললেন, আভাস পেয়েছিলুম। এ আমার এক সহজাত বোধ বলতে পারো। বদ্রীর হাবভাবে খুনীর আদর্শ ক্রমশ ফুটে উঠছিল। সেটাই প্রথমে আমার চোখে পড়ে। তাছাড়া সোনার ডমরু চুরির ঘটনা আগেই কলকাতায় থাকতে কাগজে পড়েছিলুম। খবরের কাগজের লোক হয়েও তুমি ব্যাপারটা জানো না, এতে আমার বিস্ময় নেই। কারণ ময়রার সন্দেশে রুচি থাকে না।

হাসতে হাসতে বললুম– ঠিক বলেছেন। তারপর?

কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন, বদ্রীর মধ্যে আমার চির পরিচিত খুনীর আদর্শ আবিষ্কার করার পর তার দিকে নজর রাখা উচিত মনে হয়েছিল। তবে রাতে বদ্রী যখন খানা আনল, তখন তুমি একটা চিৎকার শুনেছিলে। ওটা শমীকের আর্তনাদ হতে পারে না। হিমালয়ের ভালুকের চিৎকার। বৃষ্টির রাতে বিরক্ত হয়ে ওরা চেঁচামেচি করে। যাই হোক, শমীক প্রণতির সঙ্গে ঝগড়া করে বেরিয়ে গিয়ে বদ্রীর ঘরে গিয়েছিল রাত কাটাতে। বৃষ্টির মধ্যে যাবে কোথায় বেচারা? বদ্রী তাকে নিজের বিছানায় শুতে দেয়। খুব ভোরে আমি যখন বেরুচ্ছি, তখন বদ্রীর ওপর নজর রাখতে গিয়ে উঁকি মেরে তার ঘরে শমীককে দেখি। গেটের কাছে গিয়ে বদ্রীকে খুঁজছি, চোখ পড়ল সে হনহন করে সারাঙয়ের রাস্তায় চলেছে। তখন কিছু বুঝিনি। আমার ইচ্ছে ছিল ঝর্ণার ধারে জঙ্গলে গিয়ে প্রজাপতি ধরব গোটাকতক।

কর্নেল দম ছেড়ে ফের বললেন, তখন সূর্য উঠেছে। কিন্তু কুয়াশা রয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় এই এক জ্বালা। সূর্য নেপালের পাহাড়ের আড়ালে থাকায় রোদ পৌঁছতে পারছে না। আমি অপেক্ষা করছি। রোদ না ফুটলে প্রজাপতির দেখা মিলবে না। ঘণ্টাখানেক পরে দেখি, এক ভদ্রলোক আর বদ্রী হনহন করে আসছে সারাঙ থেকে। ঝর্ণার কাছে এসে দুজনে দাঁড়াল। তারপর বদ্রী নিচে জলের দিকে আঙুল তুলে তার খোট্টাই বুলিতে বলল, বাবা ডমরুনাথ আমাকে স্বপ্নে ওই জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছেন স্যার। ওখানেই চোর ওনার ডমরু পুঁতে রেখেছিল। সেই ডমরু আপনার কাছে আছে বাবুসাব। স্বপ্নে বাবা আমাকে বলেছেন।

বললুম– আপনি ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন?

হ্যাঁ। আমি তো মাত্র হাত বিশেক তফাতে একটা পাথরে বসে আছি। সামনে, ঝোপ থাকায় ওরা আমাকে দেখতে পাচ্ছিল না। …

 তারপর?

ভদ্রলোক অর্থাৎ নীতিশবাবু কেমন যেন ভয় পেয়ে গেছে মনে হল। : বললেন, তোমার স্বপ্নটা হয়তো ঠিক আছে। বাবা তার ডমরু ফিরে পাবেন। ওটা আমার কাছেই রয়েছে। চলো, আমার স্ত্রীকে সঙ্গে করে বাবার মন্দিরে উঠব। তার জিনিস তাকেই ফিরিয়ে দেব। তুমি ঠিকই বলেছ, ওটা আমার লুকিয়ে রাখা ঠিক হয়নি।

 কর্নেল চুপ করলেন। আমরা নিচের রাস্তায় একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি। ওঁকে চুপ করতে দেখে বললুম– তারপর কী হলো?

হঠাৎ দেখলুম, বদ্রী কোমরের কাছ থেকে একটা ভোজালি বের করে ওঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার স্বরভঙ্গ। চেঁচিয়ে উঠতে পারলুম না। সঙ্গে রিভলভারটাও আনিনি। তাছাড়া আমাকে ওদের কাছে পৌঁছতে হলে অন্তত আড়াইশো গজ দূরত্ব ঘুরে যেতে হয়। ঝর্ণার অন্য পারে মাথার দিকটায় আছি। আমি যেতে যেতে খুন হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। বদ্রী ওঁর জামাপ্যান্ট হাতড়াচ্ছে পাগল হয়ে। পেল না ডমরুটা। তখন বালি সরিয়ে লাশ পোঁতার চেষ্টা করল। আমার পক্ষে ওই দুর্গম আড়াইশো গজ পেরুতে যতটা সময় লাগে, তার আগেই এ পর্যন্ত ঘটে গেল। তখন মরিয়া হয়ে একটা পাথর ছুঁড়লুম। অমনি বদ্রী আমাকে দেখতে পেয়ে পালিয়ে গেল। যাই হোক, ডমরুটা আমি কুড়িয়ে পেলুম জলের ধারে।…কর্নেল পা বাড়ালেন।

বললুম– তারপরও বদ্রীকে কিছু বলেনি? পুলিশকেও কিছু জানাননি।

 কর্নেল হাসলেন।…আমার যা স্বভাব। খুনীর সঙ্গে কিঞ্চিৎ খেলা করা। তবে বদ্রীর মতো লোকের সঙ্গে খেলতে গিয়ে ভুল করেছি। শমীককেও বাঁচাতে পারিনি। এদিকটা ভাবিইনি।

শমীককে কেন খুন করল বদ্রী?

শুধু শমীককে নয়। প্রণতিকেও খুন করত। প্রণতি দরজা আটকে ঘুমোচ্ছিল বলে।

কিন্তু কেন?

রাগ এবং আতঙ্ক ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে? সম্ভবত খুন করে বাংলোয় ফিরে তার ঘরে শমীককে দেখামাত্র তার হননবৃত্তি ফের চাগিয়ে উঠেছিল। তবে একটা কারণ অনুমান করা যায়। সোনার ডমরুর ব্যাপারটা ওই তিনজনেই জানত। নীতিশ খুন হওয়ার পেছনে সোনার ডমরু চুরির ব্যাপার থাকতে পারে, প্রণতি ও শমীকের এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তারা পুলিশকে বলত। ওদিকে আমি বদ্রীকে খুন করতে দেখেছি। বদ্রীর মাথার ঠিক ছিল না তাই। পারলে আমাকেও শেষ করে ফেলত। ….

বলে কর্নেল মুখ তুলে চারদিকটা দেখে নিলেন। ফের বললেন, আমি এমন ভাব দেখাচ্ছিলুম, যেন বদ্রীকে ভোরের কুয়াশার মধ্যে চিনতেই পারিনি! বদ্রীর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, সে এটাই অনুমান করেছে। নইলে আমার এবং তারপর  তোমার ওপরও ভোজালি চালাতে দ্বিধা করত না। বাংলোয় এ কাজ নির্বিঘ্নে সেরে ফেলতে পারত।

আঁতকে উঠে বললুম– ছেড়ে দিন। চলুন চা-ফা-খাওয়া যাক।

কর্নেলের অনুমান যাই হোক, শমীককে খুন করার ব্যাপারটা রহস্যময় থেকে গেল আমার কাছে। কিন্তু আপাতত ও নিয়ে আর মাথা ঘামালুম না। ডমরুনাথের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি জাদুকর। ক্রমশ আমাকে সে আবিষ্ট করেছিল।…

.

বিকেলে রহস্যটা ফাঁস হলো শেষ পর্যন্ত। পুলিশ অফিসার মদনলাল এলেন বাংলোয়। তার কাছেই শুনলুম, বদ্রী কবুল করেছে সব। শমীককে সে খুন করত না। কিন্তু ঝর্ণাতলায় খুন করে এসে সে শমীকের মুখোমুখি পড়ে যায়। তখনও তার হাতে ভোজালি, কাপড়-চোপড়ে রক্ত। শমীক বিছানা ছেড়ে সবে উঠেছে তখন। জিজ্ঞেস করামাত্র মরীয়া হয়ে বদ্রী ওর গলায় কোপ বসায়। শমীক চিৎকার করে ওঠার সুযোগও পায়নি। তবে সাহস আছে বদ্রীর। এই বাংলোয় পুলিশ ধুন্ধুমার করছে, তার মধ্যে সে দিব্যি আরেকটা লাশ খাটিয়ার তলায় লুকিয়ে ভালমানুষ সেজে ঘুরে বেড়িয়েছে। তারপর রাতে পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে হাতে নাতে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments