Wednesday, April 24, 2024
Homeকিশোর গল্পসোনালি বাঘ - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

সোনালি বাঘ – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

অথ নিমন্ত্রণ ভোজন - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

আগে ছিল শুধু কালো পাহাড় আর সবুজ জঙ্গল। বাঘের ডাকে নিস্তব্ধ রাত্রির আকাশ গমগম করে উঠত। ঝরনার পাশে হরিণের পায়ের দাগ, ভালুকের থাবা আর এখানে-ওখানে মরকত মণির ছিটের মতো টকটকে তাজা রক্তের বিন্দু। চেরাপুঞ্জির পাহাড়ে যখন ঘন নীল মেঘে বর্ষণ নামত, তখন এখানকার অরণ্যও তৃষ্ণার্ত ঊর্ধ্বমুখে আকাশের দিকে অঞ্জলি বাড়িয়ে দিত। ঝরনার জল ঘোলা হয়ে যেত, পাথরের চাঙড় নামত, বন্যার প্রচন্ড তোড়ে উপড়ে পড়া শালের গাছ আছড়ে পড়ত নীচের উপত্যকায়।

মানুষ থাকত অনেক দূরে। এ তো মৃত্যুর রাজত্ব। শুধু বাঘই নয়। সকালে-সন্ধ্যায়-লক্ষ কোটি আরণ্য মশার বিকট গুঞ্জনে বাঘের ডাক চাপা পড়ে যায়। কাচমণির মতো মনোরম আর সুন্দর ঝরনার জল, কিন্তু এক আঁজলা খেলেই হাড়ের মধ্যে ম্যালেরিয়ার কাঁপুনি ধরে। তারপরে ব্ল্যাক-ওয়াটার ফিভার।

কিন্তু অরণ্যের ধ্যান একদিন ভাঙল। এল দুঃসাহসিক অভিযাত্রীর দল। চায়ের বাগান হিসেবে জায়গাটা আদর্শ। এল শাবল-গাঁইতি আর কুড়ল। পাহাড়ের নীচে বিরাট কলোনি বসে গেল। কাঁটাতারের বেড়া, লোহালক্কড়, টিনের শেড, যন্ত্রপাতি, বাংলো, তিরিশ মাইল দূরে রেল স্টেশন পর্যন্ত কালো পিচের পথ। ম্যালেরিয়া, সাপ আর বন্য জন্তুর মুখে বহু প্রাণ বলি দিয়ে শেষপর্যন্ত মানুষের জয় হল। বুভুক্ষু বাঘেরা বন্দুকের ভয়ে আজ আর নীচে নামতে সাহস করে না। ম্যালেরিয়ার মৃত্যু নিয়ন্ত্রিত হয়েছে কুইনিনে আর ইঞ্জেকশনে।

এ প্রায় চল্লিশ বৎসরের ইতিহাস। আজ এখানে সোনাঝুরি চা-বাগান। যুদ্ধের বাজারে এ বাগান এবার শতকরা তিনশো টাকা ডিভিডেণ্ড দিয়েছে। মোহিনী সরকার এ বাগানের প্রবলপ্রতাপান্বিত ম্যানেজার। এ পর্যন্ত ভূমিকা।

কিন্তু মাঝখানে এমন দিনও গেছে যখন দেনায় দেনায় একেবারে ডুবে যেতে বসেছিল বাগানটা। তখন যুদ্ধ দেখা দেয়নি, তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, তিন আনা পাইকারি দরে বিক্রি হত চায়ের পাউণ্ড। তারপরে আগুন জ্বলে উঠল ইউরোপে। তারও পরে রেঙ্গুনে বোমা পড়ল। যাদুকরের হাতে ভেলকি লাগল বনমানুষের হাড়ে। সরকারি প্রচারপত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝকঝকে নোট ছাপা হওয়া শুরু করল, সোনাঝুরি চা-বাগানে রাতারাতি দেখা দিল সোনার খনি।

সুযোগটা নিলে গুজরাতি ব্যবসায়ী কানহাইয়ালাল। রেঙ্গুনের বিরাট কারবারের মোহ কাটিয়ে তাকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল কোহিমার দুর্গম পথ দিয়ে। কিন্তু একেবারে নিঃস্ব হয়ে আসেনি। পেট কাপড়ে বেঁধে যে পরিমাণ কাঁচা সোনা আর ব্যাঙ্কনোট সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল, তারই একটা বড়োরকম অংশ জুয়া খেলার মতো ছড়িয়ে দিয়ে কানহাইয়ালাল কিনলে সোনাঝুরি বাগানের বারো আনি শেয়ার।

অনুমানে ভুল হয়নি কানহাইয়ালালের। স্পেকুলেশনে শেয়ার মার্কেটে সে কোনোদিন ঠকেনি, আজও ঠকল না। তিন বছরে সোনাঝুরির চা-বাগান বিপুল গৌরবে ঠেলে উঠেছে। সমস্ত দেনা শোধ করে দিয়ে ঘরে এসেছে প্রচুর ডিভিডেণ্ড। তার বারো আনা গেছে কানহাইয়ালালের পকেটে; আর বাকি চার আনা মিলেছে অন্যান্য ছোটোখাটো শেয়ার হোল্ডারের ভাগে।

টাকা—টাকা—টাকা। যুদ্ধের পরে ভারতবর্ষের শিল্পবাণিজ্য নাকি উৎসারিত হয়ে উঠবে সহস্র ধারায়। দেশের কোটিপতিদের বিস্তৃত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বেরোয় খবরের কাগজে। তাই নিয়ে আন্দোলন আর আলোড়নের অবধি নেই। ভবিষ্যতের ভারতবর্ষ কবে একদা ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা হয়ে উঠবে, তারই সোনালি স্বপ্ন শিল্পনায়কদের চোখে।

খবরের কাগজ পড়ে হাসি পায় মোহিনী সরকারের। তিনশো টাকা ডিভিডেণ্ডের ব্যাপারে সেও নিতান্ত উপবাসী থাকেনি, চুরির বিরাট সমারোহের মাঝখানে তার অংশটাই বরং সিংহভাগ। তবু খবরের কাগজে এই সুবর্ণ প্রতিশ্রুতিগুলো তারও বিবেককে যেন আঘাত করে। কত ধানে কত চাল, তার চাইতে সেটা বেশি আর কে জানে।

ডিরেক্টরদের আবির্ভাব প্রায়ই ঘটে বাগানে। উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই সাধু। কিন্তু ইনস্পেকশন ফি র আকর্ষণ না থাকলে এসব মহৎ উদ্দেশ্য শুকিয়ে গিয়ে বহুকাল আগেই খটখটে বালি বেরিয়ে যেত।

কত দৃষ্টান্ত চোখের সামনে। বাংলায় দুর্ভিক্ষ-কাপড় নেই, চাল নেই, সব নাকি যুদ্ধের দাবি মেটাবার জন্যে রাতারাতি ফ্রন্টে চালান হয়ে গেছে। তা যাক, কিন্তু বাগানের জন্যে চাল ডাল-কাপড়-জামার কমতি নেই কিছু। ওয়াগন বোঝাই কয়লা যায়, চিনি যায়, কাপড় যায়। কুলিদের অভাব দূর করো, তাদের গায়ে বস্ত্র এতটুকু কমতি না হয় সেদিকে কড়া নজর দাও–এই হচ্ছে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের আদেশ।

অতএব বাগানে কোনো অভাব নেই। কাগজপত্রে সমস্ত হিসেব ঠিক আছে। ডিরেক্টরেরা কাগজ দেখেই খুশি, বেশি না ঘাঁটানোই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেন তাঁরা। তবু তাঁদের একজন কী ভেবে বলে বসলেন, চলুন বাগান দেখা যাক। একটা ঢোঁক গিলে মোহিনী বললে, চলুন।

বাগানের ভেতর কালো কালো কুলি মেয়েরা কাজ করছে। অদ্ভুত ক্ষিপ্রগতিতে হাত চলছে তাদের, পিঠের ঝুড়িটা ভরে উঠছে সবুজ সরস চায়ের পাতায়। কিন্তু ওরা সামনে এগিয়ে আসতেই তারা টুপ টুপ করে চা-গাছের আড়ালে বসে পড়ল। যেন কী মন্ত্রবলে এতগুলো মাথা একসঙ্গে অদৃশ্য।

ডিরেক্টর বললেন, ওরা ওভাবে লুকাল কেন বলুন তো? মোহিনী ঠোঁট দুটো চেটে বললে, ওদের পরনে যে কাপড় আছে তাতে শরীরের সবটা ঢাকে না বলেই…

বিস্মিত ডিরেক্টর বললেন, কেন? এত কাপড় এল বাগানে…!

মানে, ইয়ে, বুঝলেন না? যা ডিম্যাণ্ড তার অর্ধেকও…

ডিরেক্টর এক বার তীক্ষ্ণচোখে মোহিনীর দিকে তাকালেন। চোখাচোখি হল ক্ষণিকের জন্যে এবং তারই মধ্যে প্রচুর ভাববিনিময় হয়ে গেল।

তাই কী? হবে।

খানিকটা এগোতেই কুলি বস্তি। খুব খানিকটা হাউমাউ কান্না শোনা গেল সেখান থেকে। মড়াকান্নার একটানা দীর্ঘস্বর।

কেউ মরেছে নাকি?

হ্যাঁ, একটা কুলি।

কী হয়েছিল জানেন?

মোহিনী নিরুত্তর। উত্তরটা তার সর্বাঙ্গ ঘিরে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অথচ রাশি রাশি চাল এসেছে বাগানে, এসেছে খাদ্য।

ডাক্তার বলেছে ম্যালনিউট্রিশন।

ডিরেক্টর ঠোঁট কামড়ালেন। বললেন, ওর বউটাকে এক বার ডাকতে পারেন?

ডাকলেও আসবে না।

কেন?

আবার দৃষ্টি বিনিময়। অনাহারে মরবে, তবু লজ্জা ছাড়তে পারবে না। স্বামীর মৃতদেহ আঁকড়ে ধরে কান্না জুড়েছে ভাঙা গলায়, কিন্তু নগ্ন দেহে বেরিয়ে আসবে কেমন করে?

ডিরেক্টর খানিক্ষণ গুম হয়ে রইলেন। তারপর ফেরবার পথে বললেন, কাপড়চোপড় কিছুই নেই একেবারে?

না। গুদামে গিয়ে এক বার দেখুন-না স্যার। গাঁট বাঁধবার কতগুলো ছেঁড়া টুকরো ছাড়া…

বেশ, বেশ। ওই টুকরোগুলোই যা পারেন বিলিয়ে দেবেন ওদের। তবু তো হবে কিছুটা। একটা মহৎ কাজ করতে পারায় ডিরেক্টরের মুখ প্রসন্ন হয়ে উঠল। বিবেককে নিরঙ্কুশ করে ফেলেছেন তিনি।

এইতো সত্যিকারের অবস্থা। মৃদু হেসে মোহিনী খবরের কাগজটা নামিয়ে রাখল। শিল্পপতিদের বোম্বাই পরিকল্পনা! দেশটা সত্যি সত্যিই আমেরিকা হয়ে যাবে!

সামনে প্যাকিং বাক্সের একটা হিসাব। দশ হাজার বাক্স এসেছে বাগানে। সত্যিই কি দশ হাজার! কাগজের অঙ্ক বাদ নিলে গোনাগুনতি দাঁড়াবে সাত হাজারে। বাকি তিন হাজার যে কোথায় যায়, কলকাতায় নানা কাজ কারবারে ব্যস্ত ম্যানেজিং ডিরেক্টর কানহাইয়ালালের সেটা জানবার কথা নয়।

রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করল মোহিনী সরকারের স্ত্রী অমলা। অজ পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, কিছুদিন আগেও নাকে নোলক পরত। হালে তার পদোন্নতি হয়েছে। অমলা আজকাল সারাদিন চা খায়, তেলেভাজা জিলিপির চাইতে পাম কেকে তার রুচি বেশি। কোকো ভালোবাসে, তবে কফির কেমন একটা পোড়াগন্ধ তেমন পছন্দ করতে পারে না। পুরু পাউডারের প্রলেপে নাকের ছিদ্রটা প্রায় অদৃশ্য হতে বসেছে।

খট খট শব্দ করতে করতে এল অমলা। একটা উদ্ধত ভঙ্গিকে আবিৰ্তত করে তোলবার চেষ্টা করলে সর্বাঙ্গে।

সারাদিন কী একরাশ রাবিশ নিয়ে বসে আছ। একটু বেড়াতে বেরোবে না? চোখ তুলে মোহিনী এক বার তাকাল অমলার দিকে। বেশ তৈরি হয়ে উঠেছে, আর দু বছরের মধ্যে কোথাও একটু ফাঁক খুঁজে পাওয়া যাবে না। রঙিন কাপড় দিয়ে পুতুল সাজিয়ে ছেলে-মেয়েরা যেমন সৃষ্টির আনন্দ অনুভব করে, অমলা সম্বন্ধে মোহিনীর মনোভাবটাও সেই-জাতীয়।

নাঃ, আজ আর বেরোনো চলবে না। এরোড্রোমের ওরা সন্ধ্যায় চা খেতে আসবে, সব ঠিক করে রাখতে বলো গে।

মাই গড! অমলা বললে, এতক্ষণ বলনি! দ্রুত পদক্ষেপে হিলের জুতো প্রস্থান করলে।

আরও খানিকক্ষণ কাজকর্ম করবার পরে মোহিনী কাগজপত্রগুলোকে রাখল সরিয়ে। বেলা পড়ে আসছে। সোনাঝুরি চা-বাগানের দেবদারু গাছগুলোর মাথা রাঙিয়ে দিয়ে সোনার রং পিছলে পড়ছে সবুজ পাতার সমুদ্রে। সেই রঙের দীপ্তি দেখা যাচ্ছে কালো কালো কুলি মেয়েদের মুখে। চায়ের পাতাগুলো যেখানে পেষা হচ্ছে ওখান থেকে আসছে নিরবচ্ছিন্ন লোহার কলরব। পাহাড় আর অরণ্য দিনান্তের সোনা মেখে রাত্রির জন্য প্রতীক্ষা করছে, অন্ধকার নেমে এলেই জেগে উঠবে ওখানকার হিংস্র জীবন। ঝরনার জলে সোনা, সোনাঝুরি চা-বাগানে সোনা ফলছে।

মাথার ওপরে এরোপ্লেনের পাখার শব্দ। মাইল তিনেক দূরে মাঝারি গোছের একটা এরোডস্লাম বসেছে, পূর্ব সীমান্তে প্রতিরোধ ব্যবস্থা। শাল গাছের উদ্ধত মাথাগুলোর ওপরে যেন পাখার ঝাপটা দিয়ে গেল।

মন দিয়ে মোহিনী অপস্রিয়মাণ যন্ত্র ইগলটাকে লক্ষ করতে লাগল। পাখার গায়ে তিনটে নানা রঙের সমুজ্জ্বল বৃত্ত। উদীয়মান সূর্যকে ডুবিয়ে দেবার জন্যে অভিযান করেছে। চলুক, চলুক, যুদ্ধ চলুক। শুধু বোমারই বুম নয়, ব্যবসায় বুম, চায়ের বাজারে বুম। যুদ্ধ-দেবতার কুঠার মানুষকে হত্যা করে, কিন্তু তার ফলাটা সোনায় তৈরি।

ঝাড়নের একটা শব্দ অত্যন্ত প্রকট হয়ে কানে এল। যতটুকু প্রয়োজন তার চাইতে অনেক বেশি, যেন মোহিনীর মনোযোগটা আকর্ষণ করতে চায়। বারান্দা ঝাঁট দিতে ঝি এসে উপস্থিত হয়েছে। অমলা সংশোধন করে বলে, আয়া।

চোখ-কান তীক্ষ্ণকরে আয়া অনুভব করে নিলে অমলা কোথায় এবং কতদূরে। তারপর মোহিনীর টেবিলের সামনে এসে স্থির হয়ে দাঁড়াল।

আরার চুল থেকে সৌখীন তেলের গন্ধ মুহূর্তে জাগিয়ে দিলে মোহিনীকে। মোহিনী সোজা ওর দিকে তাকাল, চোখের দৃষ্টি উঠল ঘন আর গভীর হয়ে। কে বলে সাঁওতাল মেয়েরা কালো এবং কুশ্রী? প্রসাধনের মায়াস্পর্শে আয়াকে এখন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বলে মনে হয়।

স্বপ্নাবিষ্টের মতো মোহিনী হাসল, কী চাই?

কিছু না। একটা আকস্মিক ঝাপটা দিয়ে সরে গেল মেয়েটা। এ শুধু খেলা—তপস্বীর ধ্যান ভঙ্গ করবার জন্যে একটুখানি লঘু কৌতুক।

নিরাপদ সীমানায় দাঁড়িয়ে আয়া মারাত্মক একটা ভঙ্গি করলে। চমক লাগল মোহিনীর চেতনায়। কিন্তু এখন সময় নয়। বাইরে দিনের আলো, সোনাঝুরি চা-বাগানের ওপর অস্ত যাচ্ছে সোনার সূর্য। যখন-তখন এসে পড়তে পারে অমলা।

আমাকে একটা গাউন কিনে দিতে হবে বাবু।

গাউন?

হুঁ। ওই যে মেম সায়েবেরা পরে।

বটে! মোহিনী বিস্ময় বোধ করলে, মেমসায়েব হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে নাকি?

হুঁ। আয়া সশব্দ হাসি হাসল। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা তির্ষক দৃষ্টি। এটা অধিকন্তু অনুরোধটা জোরালো হবে এতে।

আচ্ছা যা, দেখা যাবে।

আশ্চর্য লাগছে মোহিনীর। মানভূমের কোনো এক শালবনের ছায়া আর লালমাটির টিলা থেকে আমদানি হয়েছিল এই কালোকোলো হাবা মেয়েটা। ওর স্বাস্থ্য সুঠাম শরীর মোহিনীকে আকর্ষণ করেছিল, তাই বাগান থেকে তুলে এনে সোজা নিজের কাজে লাগিয়েছিল। এই ক বছরেই কী দ্রুত প্রগতি হয়েছে। আর শুধু ওরই-বা দোষ কী। অমলাও তো ঠিক তালে তালেই এগিয়ে চলেছে।

ক্রিং করে লাল সাইকেলের ঘণ্টির শব্দ। টেলিগ্রাম।

ক্ষিপ্রহাতে লেফাপা ছিঁড়ে টেলিগ্রাম পড়ল মোহিনী। কাল সন্ধ্যার ট্রেনে কলকাতা থেকে আসছে শঙ্করলাল, কানহাইয়ালালের ভাইপো।

ধড়মড় করে করে উঠে পড়ল সে। সকলকে এখনই ডাকা দরকার। কাগজপত্র, গুদাম সমস্তই রাতারাতি ঠিক করতে হবে। আর যে তিনশো বস্তা অতিরিক্ত চা গুদামে মজুত আছে, তাদেরও নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেলতে হবে এক্ষুনি। খাতাপত্রে ওই তিনশো বস্তার হিসেব নেই কিছু।

সন্ধ্যায় বাংলোতে ফিরে মোহিনী দেখলে অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই কোথাও। আতিথেয়তার ব্যাপারে অমলা তাকে অনেক পেছনে ফেলে গেছে আজকাল। বেতের চেয়ারে, টেবিলে আর ফুলদানিতে সুন্দর করে সাজিয়েছে বারান্দাকে। আর এমনভাবেই প্রসাধন করেছে যে দেড় মাইল দূর থেকেই তার কসমেটিকের গন্ধ যেন মাথা ঘুরিয়ে দেয়। গলার খাঁজে পুরু পাউডারের আস্তর দিয়ে সেটাকে একেবারে সাদা করে ফেলবার একটা মর্মান্তিক দুশ্চেষ্টা করেছে অমলা।

অমলা বললে, ননসেন্স। এত দেরি করলে। ওদের যে আসবার সময় হয়ে গেল।

ক্লান্ত গলায় মোহিনী বললে, তুমি একাই তো যথেষ্ট।

ভ্রূ কুঁচকে অমলা বললে, মানে?

মানে কিছু নেই মোহিনী মন্থর অবসন্ন গতিতে ভেতরে চলে গেল। কেন কে জানে, আজকে অমলার এই অতি প্রসাধনটা তার ভালো লাগল না। মোহিনীর হাতের তৈরি পুতুলটা কার মায়াবলে জীবন্ত হয়ে উঠল? তার সৃষ্টি যেন তাকেই ছাড়িয়ে যেতে চায়। বড়ো বেশি এগিয়ে গেছে অমলা, এখন এক বার রাশ টানা দরকার।

বাথরুমের সামনে অনুজ্জ্বল নীল আলোতে দেখা গেল আয়াকে। মুখে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। মোহিনীকে দেখে মুহূর্তে সিগারেটসুদ্ধ হাতটাকে পেছনে লুকিয়ে ফেললে।

কী রে, গাউন পরবার আগেই সিগারেট ধরেছিস? আয়া অপ্রতিভ হয়ে গেল অনেকটা। বললে, না, ওরা দিলে তাই…।

কারা দিলে?

ওই… উত্তরটা অসমাপ্ত রেখেই আয়া দ্রুত প্রস্থান করলে।

মোহিনী চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল খানিক্ষণ।

সমস্ত চিন্তা চকিত আর সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। আজ সন্ধ্যায় সব কিছু বিরক্ত আর বিস্বাদ করে দিচ্ছে মনকে। অমলা আর আয়া দুজনেই বড়ো বেশি এগিয়ে গেছে, এত বেশি এগিয়েছে যে মোহিনী যেন আর তাদের নাগাল পাচ্ছে না। হয়তো এমন দিনও আসবে যখন দূর থেকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করবার থাকবে না মোহিনীর। নিজের তৈরি অস্ত্র আজ কি তার নিজের বুক লক্ষ করেই উদ্যত হয়ে উঠল?

হঠাৎ নিস্তব্ধ রাত্রির আকাশে গমগম করে বাঘ ডেকে উঠল। পাহাড়ে বাঘ ডাকছে। ক্ষুধিত বাঘ আজ আর স্বচ্ছন্দে নীচে নেমে আসতে পারে না মানুষের ভয়ে—তার অস্ত্রের ভয়ে। তাই দুর্গম পাহাড়ের জটিল লতাগুল্মের আড়ালে গর্জন করে অসহায় আক্রোশে। কচিৎ কখনো দু-এক বার নেমেও এসেছে, প্রাণ নিয়েছে মানুষের, তারপরে নিজের প্রাণ দিয়েছে। সোনাঝুরি চা-বাগানে সোনার শস্য দেখা দিয়েছে, প্রাচুর্যের সঞ্চয় মানুষের বিশ্বব্যাপী মুষ্টির ভেতর থেকে উপছে পড়ে যাচ্ছে, শুধু বাঘই বঞ্চিত। ওই গর্জনের ভেতর দিয়ে সে কি নিজের দাবিকেই জানাতে চায়?

বাইরে জিপ গাড়ি থামবার শব্দ। অমলার কলকণ্ঠ, পুরুষের মোটা গলা। এরোড্রোমের আমন্ত্রিতেরা এসে পড়েছে।

প্রায় পনেরো মিনিট পরে অনিচ্ছুক দেহ আর আড়ষ্ট মন নিয়ে মোহিনী বেরিয়ে এল বাইরের বারান্দাতে। আসর ভালো করেই জমে উঠেছে, তার অভাবে কোনোখানে এতটুকু ত্রুটি নেই কিছুর। এরোড্রোমের দুজন ভারতীয় কর্মচারী এসে আসর জাঁকিয়ে বসেছেন, একজন সিন্ধি আর একজন পাঞ্জাবি। সিগারের কড়া গন্ধ বাতাসকে ঘনীভূত করে তুলেছে। শুধু সিগারের গন্ধই নয়, মোহিনীর অভ্যস্ত নাক তার ভেতর মদের অস্তিত্বও অনুভব করল।

মোহিনীকে দেখবামাত্র খানিকটা অট্টহাসি বিদীর্ণ হয়ে পড়ল।

দ্য ম্যানেজার ইজ অলওয়েজ লেট।

ও, হি ইজ এ লেট লতিফ।

নট লতিফ বাট সিরকার।

আবার খানিকটা উচ্ছ্বসিত হাসি। পাঞ্জাবি আর সিন্ধির চোখের দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায় প্রকৃতিস্থ নেই ওরা। হাসির ধমকে পাঞ্জাবির প্রকান্ড শরীরটা দুলে উঠছে ঢেউয়ের মতো। সিন্ধির বাহুমূলে অভিজাত ইউনিফর্মের ওপরে জ্বলজ্বল করছে সোনালি ইগল। তাদের অত্যন্ত কাছ ঘেঁষে বসেছে অমলা। কী বুঝেছে কে জানে, তারও সমস্ত মুখ নির্বোধ হাসিতে উদ্ভাসিত। পাঞ্জাবির অনামিকায় জ্বলছে একটা হিরের আংটি। ওদের নেশার ছোঁয়াচ যেন রং ধরিয়েছে অমলার গালে, অমলার মনেও। পাঞ্জাবির চেয়ারের হাতল ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে আয়া, সেও হাসছে। পলকের জন্যে এক বার অমলা আর এক বার আয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল মোহিনী। কী-একটা জিনিস মুহূর্তের মধ্যে ওর মনের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল, এরা দুজনে যেন আজ পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী।

কুঞ্চিত করে মোহিনী চেয়ারে এসে বসল। চায়ের সঙ্গে চলতে লাগল উদ্দাম হাসি, অকারণ কৌতুক, সুলভ রসিকতা। অমলা যেন রাতারাতি বিলাতি ছবির নায়িকা হয়ে উঠেছে। আয়ার চোখেও যেন তারই প্রতিবিম্ব।

মোহিনীর অস্বস্তি লাগতে লাগল, অতি তীব্র অস্বস্তিতে জ্বালা করতে লাগল সমস্ত শরীরটা। এখানে সে অনধিকারী, তার উপস্থিতিতে যেন এখানকার উচ্ছ্বসিত আনন্দের মধ্যে ছন্দপতন ঘটে যাচ্ছে। এখান থেকে এখন তার সরে যাওয়াই উচিত। মোহিনী হাতঘড়িটার দিকে। তাকাল। রাত নটা বাজে। অফিসের কাগজপত্র এলোমেলো, গুদামের বাড়তি তিনশো বস্তা রিমুভ করবার কোনো বন্দোবস্ত এখনও হয়নি। ওদিকে কাল সন্ধ্যার ট্রেনেই শঙ্করলাল এসে পড়বে। বোম্বাইয়ের পাকা ব্যাবসাদার লোক, আর যা-ই চলুক, ফাঁকি চলবে না।

মোহিনী উঠে দাঁড়াল। এক্সকিউজ মি, অফিসে জরুরি কাজ পড়ে আছে, আমাকে এখুনি উঠতে হবে।

দ্য স্কাউন্ট্রেল সিরকার ইজ অলওয়েজ বিজি।

লেট হিম গো।

উই হ্যাভ গট আওয়ার বিউটি। পাঞ্জাবি জিভ কাটলে, আওয়ার সুইট হোস্টেস।

মুখ লাল করে মোহিনী উঠে পড়ল। চা-বাগানের ম্যানেজার, ছোটোখাটো জিনিসকে গায়ে মাখলে বহুদিন আগেই এসব ছেড়েছুড়ে দিয়ে বানপ্রস্থ নিতে হত তাকে। কিন্তু এখানকার এই আবহাওয়া মোহিনীর পক্ষেও অসহ্য হয়ে উঠছে, নিজেকে বড়ো বেশি অপমানিত বলে বোধ হচ্ছে। আয়া আর অমলার চোখে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বহ্নিছটা, ছলনাতে কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে তারই প্রতিযোগিতা চলছে যেন। মোহিনীর সৃষ্টি আজ মোহিনীকে অতিক্রম করে যাওয়ার দাবি রাখে।

জোর করেই ওখান থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলে সে, দ্রুতপায়ে বাংলোর লন পেরিয়ে চলল এগিয়ে। যা করে করুক ওরা। এখনই অফিসে গিয়ে বসতে হবে স্তুপাকার কাগজপত্র নিয়ে। কাল সন্ধ্যায় শঙ্করলাল আসবার আগেই সমস্ত ছিদ্রগুলোকে বেমালুম জুড়ে দিতে হবে।

বাংলোর বারান্দা থেকে আসছে উচ্ছসিত হাসি আর দূরে পাহাড়ের কোলে বাঘের ডাক। হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনল মোহিনী। ওই দুটো শব্দ একসঙ্গে মিলে গিয়ে যেন একটা ঐকতানের সৃষ্টির হয়েছে। ওদের মধ্যে কোথাও একটা সাদৃশ্য আছে কি?

চিন্তাটাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সে অফিসে এসে ঢুকল। কাজ চলছে পুরোদমে। ঠেলাগাড়িতে করে বস্তাগুলো সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটা ফাইল টেনে নিয়ে মোহিনী কাজের মধ্যে ডুবে গেল। ঘড়ির কাঁটায় ঘুরতে লাগল সময়।

নিস্তব্ধ রাত, প্রায় বারোটা! শুধু টেবিল-ফ্যানটা ঘুরছে কট কট করে। মোহিনী খস খস করে উলটে চলেছে ফ্ল্যাট ফাইলের শিটগুলো। হঠাৎ একটা উচ্চন্ড আর উদ্দাম চিৎকারে রাতের পৃথিবী উঠল জেগে। কুলি বস্তিতে দারুণ কোলাহল, মর্মান্তিক আর্তনাদ।

মোহিনী চমকে দাঁড়িয়ে উঠল।

কী হয়েছে? আগুন লাগল নাকি?

প্রবল চিৎকার। ভয়ার্ত কলরব। ঢন ঢন করে ঘা পড়ছে ক্যানেস্তারায়। পাঁচ-সাতটা গলার উতরোল কান্না।

একজন কেরানি বললে, আগুন নয়, নিশ্চয় কোনো জানোয়ার নেমেছে পাহাড় থেকে!

সঙ্গে সঙ্গেই দশ-বারো জন লোক খোলা দরজার পথে এসে আছড়ে পড়ল মোহিনীর পায়ে। হাউমাউ করতে করতে বললে, হুজুর বাঘ এসেছিল বস্তিতে।

বাঘ?

হ্যাঁ হুজুর। মংরুকে খাঁটিয়া থেকে তুলে নিয়ে গেল।

মোহিনীর শিরা-স্নায়ুর মধ্যে উত্তেজিত হয়ে উঠল শক্তি আর তেজের তরঙ্গ। গায়ের কোটটা ছুড়ে ফেলে দিলে চেয়ারের ওপর। বললে, যতগুলো পারিস মশাল জ্বালিয়ে দে চারদিকে। আমি বন্দুক নিয়ে আসি।

ক্ষিপ্রগতিতে মোহিনী এগিয়ে গেল বাংলোর দিকে। লোহার গেটটা এক ধাক্কায় খুলে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল বারান্দাতে। দুটো ঘরের দরজাই বন্ধ। অমলার ঘরে আলো জ্বলছে। এত রাতেও কি ঘুমোয়নি অমলা!

দরজায় ঘা দিতে গিয়েই খড়খড়ির ফাঁকে যা চোখে পড়ল তা মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ করে দিলে মোহিনীকে। অসম্ভব বা অস্বাভাবিক হয়তো নয়, কিন্তু এতখানির জন্যে সে তৈরি ছিল না। এ ঘরের মালিক এখন সে নয়, তার জায়গা দখল করেছে সিন্ধি!

রাগ নয়, দুঃখ নয়, স্ত্রীর এই রূপ দেখে উগ্র হিংস্রতার চিরন্তন প্রেরণাতেও শরীর জ্বালা করে উঠল না। মোহিনী শুধু অভিভূতের মতো তাকিয়ে রইল। কেন সে এসেছিল, কোথায় এসে সে দাঁড়িয়েছে, কয়েক মুহূর্ত কিছুই আর মনে পড়ল না। সব যেন শূন্য আর মিথ্যে হয়ে গেছে।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো মোহিনী পাশের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। এ ঘরও বন্ধ, ভেতর থেকে পাঞ্জাবির গলার আওয়াজ। তবে এ ঘরে আলো জ্বলছে না, অমলার চাইতে আয়ার লজ্জাটা কিছু বেশি—গৃহিণীর মতো অতটা সে এগিয়ে যেতে পারেনি। তবে তারও দিন আসছে।

নিজের ঘরেই ঢোকবার অধিকার আজ আর নেই মোহিনীর। নিঃশব্দে পা টিপে সরে এল সে, একটু জুতোর শব্দ না হয়, এতটুকু রসভঙ্গ না হয় কোনোখানে। বারান্দার রেলিং মুঠোর মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরে ঝুঁকে দাঁড়াল সে। শনশন করে হাওয়া দিচ্ছে, শরীরটা মৃদু শীতের স্পর্শে উঠছে শিউরে। বাংলোর টালি-দেওয়া ছাতের ওপর টুপ টুপ করে পড়ছে রাত্রির শিশির। পাহাড়ের গায়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কালো অরণ্য। নীল-লাল আলোর দুটো সরু রেখা অন্ধকার আকাশের গায়ে বুলিয়ে বিমান উড়ে যাচ্ছে।

ওদিকে কুলি বস্তিতে কোলাহলের বিরাম নেই। অনেকগুলো মশালের আলো, ক্যানেস্তারার শব্দ, নারীকন্ঠের কান্না—মংরুর স্ত্রীই নিশ্চয়। পাহাড়ের রাজত্ব থেকে ক্ষুধার্ত বাঘ হানা দিয়েছে ওখানে। বাঘ—সোনাঝুরি বাগানের সোনালি বাঘ। যুদ্ধদেবতার কুঠার সোনায় তৈরি। কিন্তু কুঠার তো চিরদিনই কুঠার, সে শুধু হত্যাই করে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments