Friday, March 29, 2024
Homeকিশোর গল্পভীমগড়ের কালো দৈত্য - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ভীমগড়ের কালো দৈত্য – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ভীমগড়ের কালো দৈত্য - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সরকারি ডাকবাংলো থেকে বিকেলে বেরুনোর সময় চৌকিদার সুখলাল হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে যা বলেছিল, তার সারমর্ম ছিল এরকম :

পশ্চিমের সবচেয়ে উঁচু আর ন্যাড়া পাহাড়ের ওধারে বাস করে এক ‘কালা দেও’, অর্থাৎ কিনা কালো দৈত্য। তার চেহারা ঘনকালো মেঘের মতো। পেল্লায় তার গড়ন। তার হিংস্র দাঁত ঝকঝক করে উঠলেই কানে তালা ধরানো হুঙ্কার শোনা যাবে। দৈবাৎ যদি তাকে পাহাড়ের ওপর দেখতে পাই, আমরা যেন তক্ষুণি পালিয়ে এসে কোনও ফাঁকা জায়গায় উপুড় হয়ে পড়ি। তা না হলে সে আমাদের তুলে নিয়ে দুরে পাথরের ওপর ছুঁড়ে ফেলবে।…রামজিকা কিরিয়া সাব, কালা দেও হামারা ভাতিজা রঘুয়াকো মার ডালা।….।

আর কার-কার কালো দৈত্যের পাল্লায় পড়ে একেকটি আছাড়ে হাড়গোড় দলা পাকিয়ে কয়েক মাইল দূরে লাশ পাওয়া গিয়েছিল, সেই রোমহর্ষক বর্ণনাও দিয়েছিল সুখলাল।

ভীমগড়ের পাহাড়ি জঙ্গলে শেষ মার্চের বিকেলে কর্নেলের সঙ্গী হয়ে বেরুনোর সময় চৌকিদারের ওইসব কথা শুনে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলুম। কিন্তু কর্নেলের মুখ দেখে বুঝতে পেরেছিলুম, তিনি কেমন যেন নির্বিকার। বারকয়েক কালো দৈত্যের ব্যাপারটা কী হতে পারে, জিগ্যেস করেও কোনও উত্তর পাইনি। তিনি ভীমগড়ের শেষদিকটায় খানা-খন্দে ভরা পিচরাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ থেমে বাইনোকুলারে কিছু দেখছিলেন। হয়তো পাখি। বসন্তকালে গাছপালায় পাখিদের ডাকাডাকি স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্যের কথা অবশ্য জানি। কলকাতার একটি ইংরেজি কাগজে এক দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির অর্কিডের খবর পড়েই তাঁর রাতারাতি ভীমগড় আগমন।

এদিকে অর্কিডের প্রতি আমার আগ্রহ না থাকলেও আমাকে তিনি এখানে টেনে এনেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,জয়ন্ত। ভীমগড় নাম শুনেই তোমার বোঝা উচিত, সেখানে মহাভারতের ভীম

হোন, অন্য কোনও ভীম বাস করতেন। আর গড় মানে দুর্গ। কাজেই রাজাগজার ব্যাপারটা এসে যাচ্ছে। কোনও সময়ে ভীম নামে কোনও রাজা সেখানে অবশ্যই ছিলেন। এমন তো হতেই পারে সেই রাজা ভীমের গুপ্তধন তার দুর্গের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে লুকোনো আছে। আর গুপ্তধনের এমন নেশা, ধরো দৈবাৎ গুপ্তধনসন্ধানী কোনও দলের হদিশ সেখানে তুমি পেয়ে গেলে এবং সেই সূত্র ধরে একখানা সাংঘাতিক রোমাঞ্চকর স্টোরি লিখে তোমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় ছেপে দিলে। ব্যস! হিড়িক পড়ে যাবে। তাই না?

একটু চটে গিয়ে বলেছিলুম,–আমাকে কি আপনি অবোধ বালক ভেবেছেন? কর্নেল অমনই গম্ভীরমুখে তাঁর সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,–জয়ন্ত! এই পৃথিবীকে অবোধ বালকের চোখে তাকিয়ে দেখলে কত অদ্ভুত ঘটনা আবিষ্কার করা যায়। যাই হোক, চলো তো! আশা করি, ভীমগড় তোমাকে কোনও-না-কোনও একটা চমক দেবে।…

সেই বিকেলে ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে হাঁটবার সময় কর্নেলের সেই কথাগুলো মনে পড়ে গেল। এবার বলে উঠলুম,–কর্নেল! আপনি ভীমগড়ে চমকের কথা বলেছিলেন। দেখছি, সত্যিই এখানে একটা চমকের আভাস পাচ্ছি। চৌকিদার সুখরামকথিত কালো দৈত্য!

কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে কিছু দেখছিলেন। বাইনোকুলার নামিয়ে একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ। কালো দৈত্য।

–কিন্তু তখন থেকে কতবার আপনাকে জিগ্যেস করছি, ব্যাপারটা আসলে কী? আপনি কোনও জবাবই দিচ্ছেন না।

আমরা চলেছি দক্ষিণে। আমাদের বাঁদিকে মাঝে-মাঝে এক-একটা জরাজীর্ণ বাড়ি এবং কোথাও বা বাড়ির ধ্বংসস্তূপ। আগাপাছত ঝোঁপঝাড়, গাছপালায় সব ঢাকা। কর্নেল হাঁটতে-হাঁটতে আঙুল তুলে বাঁদিকে উঁচু মাটির ওপর সেই বাড়িগুলো দেখিয়ে বললেন,–জয়ন্ত! কালো দৈত্যদর্শন সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের কথা। কিন্তু এই এলাকায় বসতির অবস্থা দেখছ? জনহীন এই এলাকাটা নিশ্চয়ই কালো দৈত্য রাগ করে ভেঙেচুরে দেয়নি। তুমি তো সাংবাদিক। একটুখানি দেখে নিয়ে বলো তো, এগুলোর এমন দশা কেন হয়েছে?

দেখে নিয়ে হাসতে-হাসতে বললুম,–কালো দৈত্যের ভয়ে লোকেরা এখান থেকে পালিয়ে গেছে।

–ওই দ্যাখো। একটা ভাঙা ফটকের গায়ে এখনও মার্বেল ফলক আটকে আছে। ফলকে পশ্চিমের পাহাড়ের ওপর থেকে সূর্য এখনও প্রচুর আলো ফেলেছে।

উঁচু মাটিতে উঠে গিয়ে ফলকটা দেখে এলুম। বললুম,–কী আশ্চর্য! বাংলায় লেখা আছে ‘সন্ধ্যানীড়। তলায় কী নাম লেখা আছে, পড়া গেল না। শ্যাওলা পড়েছে।

কর্নেল এবার হাঁটার গতি দ্রুত করে বললেন, এটা একসময় ছিল ভীমগড়ের বাঙালিটোলা।

-কিন্তু বাঙালিরা সব ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে কেন?

–সম্ভবত তাদের সন্তান-সন্ততি ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। নয়তো কলকাতায় সুখে বসবাস করছে। আসলে বাঙালি এখন এসব মুলুকের প্রকৃতির চেয়ে আরও সুন্দর সেজেগুজে থাকা প্রকৃতির খোঁজ পেয়ে গেছে। লক্ষ্য করছ না? কী এলোমেলো জঙ্গল, বেখাপ্পা টিলা আর একঘেয়ে দৃশ্য!

কিছুক্ষণ পরে কর্নেল রাস্তাটা ছেড়ে ডানদিকে পশ্চিমে এবড়োখেবড়ো গেরুয়ামাটির পায়ে-চলা রাস্তায় পা বাড়ালেন। রাস্তাটা অস্বাভাবিক নির্জন। ক্রমশ উঁচুতে উঠে গেছে এবং সামনে-দুরে কালো একটা পাহাড়ের মাথা সূর্য ততক্ষণে ছুঁয়ে ফেলেছে। দুধারে নানান গাছের জঙ্গল আর ঝোঁপঝাড়। কোথাও ফাঁকা ঢালু মাঠে ছোটবড় নানা গড়নের পাথর আর ঝোঁপ।

কর্নেল সামনে বাঁদিকে জঙ্গলে ঢাকা একটা টিলার দিকে ঘুরে বললেন,–ইংরেজি কাগজের সেই প্রকৃতিবিদ যে নির্দেশ দিয়েছেন, তাতে এই টিলার গায়েই অর্কিডের খোঁজ পাওয়ার কথা। তুমি এখানে অপেক্ষা করো। আমি দেখি, তার খোঁজ পাই নাকি।

বলে তিনি টিলায় চড়তে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন। মুচকি হেসে বললেন,–সাবধান জয়ন্ত! ওই পশ্চিমের উঁচু পাহাড়ের দিকে লক্ষ্য রাখবে। কালো দৈত্যটা দেখতে পেলেই আমাকে ডাকবে।

হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। কর্নেল টিলার জঙ্গলে উধাও হয়ে গেলেন। এইসব জঙ্গলে হিংস্র জন্তু থাকা সম্ভব। কালো দৈত্যের চেয়ে তারাই আপাতত আমার কাছে সাংঘাতিক। মহুয়ার ফল পাকতে এখনও দেরি আছে। কিন্তু বুনো ভালুক কী অত বোঝে? পাশের ওই মহুয়াগাছের দিকে হানা দিতে এসে আমাকে দেখতে পেলেই দাঁত-নখ বের করে ঝাঁপ দেবে।

এইসব ভেবে প্যান্টের পকেট থেকে রিভলবার বের করে তৈরি হয়ে থাকলুম। অবশ্য মাঝে-মাঝে পশ্চিমের পাহাড়ের দিকটা দেখে নিচ্ছিলুম। সূর্য এখন পাহাড়ের আড়ালে নেমে গেছে। চারদিকে ধূসরতা ক্রমে গাঢ় হয়ে আসছে।

কতুক্ষণ পরে কর্নেলকে দেখতে পেলুম। তিনি অমন পড়িমরি করে টিলার জঙ্গল ভেঙে নেমে আসছেন কেন?

অবাক হয়ে চেঁচিয়ে বললুম,–কী হয়েছে?

কর্নেল আমার কাছাকাছি এসে বললেন,–জয়ন্ত! দৌড়তে হবে। কুইক!

–ব্যাপার কী? বাঘ-ভালুক নাকি?

–কালো দৈত্য!

–তার মানে?

–তোমাকে পশ্চিমের পাহাড়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে বলেছিলুম। তুমি এত বোকা–তা ভাগ্যিস টিলার ওপর থেকে আমার চোখে পড়েছিল।

কর্নেল প্রায় দৌড়নোর ভঙ্গিতে উতরাই পথে নামতে-নামতে কথাগুলো বলছিলেন। ঘুরে একবার পশ্চিমের পাহাড়ের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল, কালো মেঘ দ্রুত ছড়িয়ে আসছে। তারপরই বিদ্যুতের ঝিলিক এবং কানে তালা ধরানো গর্জন শোনা গেল।

দৌড়তে-দৌড়তে বললুম,–ওটা তো মেঘ!

কর্নেল ততক্ষণে ডানদিকে ফাঁকা মাঠে নেমে গেছেন। তারপরই কানে এল, অস্বাভাবিক একটা শনশন-গরগর গর্জন। সেই সঙ্গে পিছনে কোথাও বাজ পড়ল।

কর্নেল একটা ঝোঁপের গোড়া দু-হাতে আঁকড়ে ধরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন। এ অবস্থায় তাঁর মতো আমিও পাশে একটা ঝোঁপের গোড়া দু-হাতে চেপে ধরে উপুড় হলুম। এরপর যা ঘটতে থাকল, তা যেন মহাপ্রলয়। ঝড়, বৃষ্টি আর বজ্রপাত। তার চেয়ে সাংঘাতিক ঘটনা, যে ঝোঁপ আঁকড়ে ধরেছি, সেটা যেন আমাকে সুষ্ঠু উড়িয়ে নিয়ে যাবে এবং শিকড় উপড়ে যাবে, ঝড়ের এমন প্রচণ্ড গতিবেগ।

কর্নেলের দিকে তাকাব কী, চোখ খোলা যাচ্ছিল না। বৃষ্টির ধারালো ফোঁটার সঙ্গে ঝড়ে ওড়া বেলেপাথরের টুকরো আর ঝাঁকে-ঝাঁকে কাঁকর আমার ওপর মুঠো-মুঠো ছুঁড়ে মারছিল সেই ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক শক্তি। ততক্ষণে হাড়ে-হাড়ে বুঝতে পেরেছি, চৌকিদার সুখরামের কাছে শোনা সেই ‘কালা দেও’ প্রকৃতপক্ষে কী।

কতক্ষণ কালো দৈত্যের এই তাণ্ডব চলেছিল জানি না, একসময় কর্নেলের ডাকে অতিকষ্টে চোখ খুলে তাকালুম। কর্নেল ভিজে একেবারে জবুথবু। আর ঝড়টা নেই। কিন্তু বৃষ্টি ঝরছে। কর্নেল বললেন,–উঠে পড়ো জয়ন্ত! দৈত্যটা কেটে পড়েছে। কিন্তু বৃষ্টিতে বেশিক্ষণ ভেজা ঠিক নয়।

উঠে দাঁড়িয়ে টের পেলুম সারা শরীর ব্যথায় আড়ষ্ট। কর্নেলকে অতিকষ্টে অনুসরণ করলুম। গেরুয়া মাটির রাস্তা কাদা হয়ে গেছে। কর্নেল এবার পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বেলে বললেন,–কাদায় হাঁটতে অসুবিধে হবে। এসো, পাশের শালবনের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাই। তোমার টর্চ আনননি?

আমার বৃষ্টিভেজা শরীর ঠান্ডায় কাঁপছিল। বললুম,ভুলে গেছি। তখন কি জানতুম….

কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,–ঠিক আছে। আমার পিছনে এসো। ডাইনে বাঁয়ে লক্ষ্য রাখবে। এ সময় খুদে জন্তু-জানোয়ারের লোভে পাইথন সাপ বেরিয়ে পড়ে।

সাহস দেখিয়ে বললুম,–ফায়ার আর্মসের গুলিতে পাইথনের মাথা গুঁড়িয়ে দেব কর্নেল! আমি এখন মরিয়া হয়ে উঠেছি।

কর্নেল বললেন,–বাঃ! এই তো চাই। ভীমগড়ের প্রথম চমক এটা।

এরই মধ্যে অন্ধকার ঘনিয়েছে। আকাশ মেঘে ঢাকা। বৃষ্টি সমানে ঝরছে। মাঝে-মাঝে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে। তবে কালো দৈত্যের হাঁকডাকে আর তত জোর নেই।

কিছুক্ষণ পরে সেই ভাঙাচোরা পিচরাস্তায় পৌঁছলুম। আবার বৃষ্টিতে বাগে পেল। বুললুম,–কর্নেল! বরং সেই বাঙালিটোলার কোনও ঘরে আশ্রয় নিয়ে মাথা বাঁচানো যাক। বৃষ্টি ছাড়লে বেরিয়ে পড়ব।

কর্নেল সায় দিলেন,–কথাটা আমিও ভেবেছিলুম। শেষ দিকটায় একটা বাড়ি চোখে পড়ল। জরাজীর্ণ বাড়িটা দোতলা। কাছাকাছি যেতেই দোতলার ডানদিকের জানলার ফাঁকে আলো দেখতে পেলুম। বললুম, বাড়িটাতে লোক আছে। দোতলায় আলো জ্বলছে।

দেখেছি।-বলে কর্নেল বারান্দায় উঠলেন।

আমিও উঠলুম। কিন্তু বারান্দার ছাদ ফাটাফুটো। ফোঁটা-ফোঁটা নোংরা জলের উপদ্রবে অতিষ্ট হয়ে বললুম,–কর্নেল! বাড়ির লোকেদের ডাকা উচিত। অন্তত ভিতরে কিছুক্ষণ আশ্রয়ের সুযোগ পাব।

কর্নেল এই অবস্থাতেও হাসলেন,–ঠিক বলেছ। এক কাপ গরম চা-ও মিলতে পারে। নাঃ, কফির আশা না করাই ভালো।

তিনি দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকাডাকি শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পরে ভিতরে আলোর ছটা চোখে পড়ল। তারপর দরজা খুলে গেল। একজন বেঁটে মোটাসোটা লোক হাতের হেরিকেন একটু তুলে বাংলায় বলল,–বলুন আজ্ঞে।

কর্নেল বললেন, আমরা কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছি। পথে ঝড়বৃষ্টিতে কী অবস্থা হয়েছে, তা দেখতেই পাচ্ছ! বারান্দায় দাঁড়াতে পারছি না। এ বাড়ির মালিক কে?

-মালিক আজ্ঞে কলকাতায় থাকেন। আমি এই বাড়ি পাহারা দিই।

-তুমি তো বাঙালি মনে হচ্ছে। এই বিপদে আমাদের একটু সাহায্য করো। আমাদের ভিতরে বসতে দাও। বৃষ্টি ছাড়লেই আমরা চলে যাব।

লোকটার গোঁফে যেন পোকা আটকেছে, এমন ভঙ্গিতে গোঁফ ঝেড়ে একটু দ্বিধা দেখিয়ে বলল, –তা-তা বসতে পারেন আজ্ঞে। কিন্তু আর লণ্ঠন তো নেই। এটা নিয়ে আমাকে দোতলায় যেতে হবে।

-লণ্ঠনের দরকার নেই। তুমি তোমার কাজে যাও। আমাদের এই টর্চই যথেষ্ট।

বলে কর্নেল তার পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমি তাকে অনুসরণ করে গিয়ে দেখলুম, ঘরে কয়েকটা নড়বড়ে চেয়ার আর টেবিল ছাড়া কোনও আসবাব নেই। দুজনে মুখোমুখি বসলুম। কর্নেলের তাগড়াই শরীরের ওজন চেয়ারটা সামলে নিল। তিনি বললেন,–তোমার নাম কী?

লোকটা তখনও কেমন অবাক-চোখে তাকিয়ে ছিল। বলল,–আজ্ঞে আমি কালীপদ।

–আচ্ছা কালীপদ, দুকাপ চায়ের ব্যবস্থা করা যায় না? ভালো বকশিস পাবে।

কালীপদ তার গোঁফ থেকে আবার পোকা বের করার ভঙ্গি করল। তারপর বিরসমুখে মাথা নেড়ে বলল, আজ্ঞে! চা-ফা আমার চলে না। ওই যাঃ! তরকারিটা পুড়ে গেল হয়তো!–বলে সে হন্তদন্ত ভিতরে চলে গেল। তারপর ভিতরের কপাট ওদিক থেকে বন্ধ করার শব্দ হল।

একটু পরে কানে এল টেবিলে টুপটুপ করে যেন জল ঝরছে। বললুম,–কর্নেল! ছাদ ভেঙে পড়বে না তো? একতলার ছাদের ওপর দোতলার ছাদ আছে। মনে হচ্ছে দুটো তলাই মেরামতের অভাবে ফেটে গেছে।

কর্নেল সবে চুরুট ধরিয়েছিলেন। আমার কথা শুনে টর্চ জ্বেলে টেবিলটা দেখলেন। বললেন, –ঠিক বলেছ!

কর্নেল টর্চের আলো নেভাননি। আমি টেবিলের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয়ে বললুম, জলের ফোঁটা লালরঙের কেন?

–আগের দিনে চুনসুরকির মশলা দিয়ে বাড়ি তৈরি হতো। সুরকিগুঁড়ো হতে পারে।

কর্নেলের হাত থেকে টর্চ নিয়ে সিলিঙে আলো ফেলে দেখলুম, কড়ি-বরগার ওপর সাজানো টালির একটা ফাটল দিয়ে লালরঙের তরল পদার্থটা পড়ছে।

কর্নেল বললেন,–ব্যাটারি শেষ হয়ে যাবে। টর্চ নেভাও।

টর্চের আলো টেবিলে ফেলে আঙুল দিয়ে লাল রঙটা পরীক্ষা করে বললুম,–কর্নেল! সুরকির গুঁড়ো কি এমন আঠালো হয়?

মাই গুডনেস!–বলে কর্নেল আমার হাত থেকে টর্চ নিয়ে সিলিং এবং টেবিলের ওপরটা পরীক্ষা করলেন। তারপর চাপাস্বরে বলেন,–তুমি হয়তো ঠিক বলেছ জয়ন্ত! বৃষ্টিটা একটু কমেছে মনে হচ্ছে। কালীপদকে ডাকা যাক!

তিনি উঠে গিয়ে ভিতরের দরজা খোলার চেষ্টা করলেন। খুলল না। তখন হাঁক দিলেন, কালীপদ! কালীপদ!

কোনও সাড়া এল না! আরও কয়েকবার ডাকাডাকির পর কর্নেল কপাটে সজোরে তার মিলিটারি লাথি মারলেন। তিনটে লাথির পর কপাট ভেঙে পড়ল। কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, –জয়ন্ত! তোমার ফায়ার আর্মস রেডি রাখো। আমার পিছনে এসো। সাবধান! চারদিকে লক্ষ্য রাখবে।

কর্নেল এক হাতে তার রিভলভার অন্যহাতে টর্চের আলোয় ভিতরটা দেখে নিলেন। ঘরে একটা খাঁটিয়া পড়ে আছে। সেটা কেউ বহুদিন যাবৎ ব্যবহার করেছে বলে মনে হল না।

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যে ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে আলো দেখেছিলুম, সেই ঘরটাও ফঁকা। কোনও আসবাব নেই। তাহলে কালীপদ লণ্ঠন নিয়ে এ ঘরে কী করছিল?

কথাটা জিগ্যেস করার সুযোগ পেলুম না। কর্নেল পরের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে বললেন,–এই ঘরের নিচেই আমরা ছিলুম। এ ঘরে দেখছি তালা আঁটা আছে। এক মিনিট! তুমি টর্চটা ধরো। জ্বেলে রাখো।

কর্নেল তার পিঠে আঁটা কিটব্যাগ থেকে একটা অদ্ভুত গড়নের প্লাস বের করলেন। তারপর সেটা দিয়ে কী কৌশলে তালা খুললেন কে জানে? কপাটদুটো ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন তিনি। আমার হাতে টর্চ। আলো ফেলে যা দেখলুম, তা কর্নেলের পাল্লায় পড়ে অনেকবার আমাকে দেখতে হয়েছে।

মেঝেয় একটা রক্তাক্ত মৃতদেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। পরনে প্যান্ট আর স্পোর্টিং গেঞ্জি।

কর্নেল আমার হাত থেকে টর্চ নিয়ে মৃতদেহটা দেখে বললেন, আমার এই এক দুর্ভাগ্য জয়ন্ত! যেখানে যাই, এক অদৃশ্য আততায়ী আমার সামনে একটা মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলে আমাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। যাই হোক। মৃতদেহটার কয়েকটা ফোটো তুলে নিয়ে কেটে পড়া যাক।

তার ক্যামেরায় ফ্ল্যাশবালব কয়েকবার ঝিলিক দিল।….

.

চৌকিদার সুখলাল সঙ্গে একজন লোক নিয়ে আমাদের খোঁজে আসছিল। বাংলোর কাছাকাছি তাদের সঙ্গে দেখা হল। সুখলালকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। ‘কালা দেও’-এর পাল্লায় পড়ে আমাদের কোনও ক্ষতি হয়নি জেনে সে আশ্বস্ত হল।

বাংলোয় ফেরার পর আমরা ভেজা পোশাক বদলে নিলাম। সুখলাল কফি নিয়ে এল। কর্নেল তাকে জিগ্যেস করলেন,–বাঙালিটোলার শেষের দোতলা বাড়িটাতে কি কেউ থাকে?

সুখলাল অবাক হয়ে বলল,–না কর্নিলসাব!

-তুমি কালীপদ নামে বেঁটে মোটাসোটা কোনও বাঙালিকে চেনো?

সুখলাল একটু ভেবে নিয়ে বলল,–পাঁচবরস আগে কালীপদ ওই বাড়ির জিম্মাদার ছিল। লেকিন সে কলকাত্তা চলিয়ে গেছে। কালীপদ দুবলা আদমি ছিল। বুঢ়া ভি ছিল। লেকিন…

সে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন,–বাংলোর কেয়ারটেকার মোহনবাবু কী বাড়ি চলে গেছেন?

–হাঁ কর্নিলসাব।

–ওঁর অফিসের চাবি তাহলে উনি নিয়ে গেছেন?

–‘ডুপলিকাটু’ হামার কাছে আছে। কুছু দরকার হলে বলিয়ে সাব!

–টেলিফোন করতে চাই।

–কুছ অসুবিধা নাই।….

কর্নেল দ্রুত কফি শেষ করে তার সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। তিনি কাকে ফোন করতে যাচ্ছেন, তা জানতুম। একটা বেঁটে হোঁতকা-মোটা-ফো লোক কাউকে কোনও ছলে ওই পোডড়াবাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে, এটা আমার কাছে স্পষ্ট। হঠাৎ আমরা গিয়ে পড়ায় যে লাশ ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে, তা-ও বোঝা যাচ্ছে।

একটু পরে কর্নেল ফিরে এসে বললেন,–আশ্চর্য ব্যাপার জয়ন্ত। ভীমগড়ের পুলিশ ভূতপ্রেত বিশ্বাস করে কল্পনাও করিনি। ও. সি. ভদ্রলোক আমার কথায় হেসে অস্থির। বললেন, এর আগে বারদুয়েক কারা ওই পোড়োবাড়িতে আমাদের মতোই রক্তাক্ত লাশ দেখে থানায় খবর দিয়েছিল। পুলিশ গিয়ে তন্নতন্ন খুঁজে লাশ তো দূরের কথা, ছিটেফোঁটা রক্তও খুঁজে পায়নি।

অবাক হয়ে বললুম,–ভারি অদ্ভুত তো!

–হ্যাঁ। এদিকে সুখলাল ব্যাপারটা জেনে নিয়ে একই কথা বলল।

–কিন্তু আমরা তো রক্তাক্ত লাশ দেখেছি। আপনি ক্যামেরায় লাশটার ছবিও তুলেছেন।

কর্নেল গুম হয়ে একটু বসে থাকার পর বললেন,–আমি ও. সি. জয়রাম সিংহকে আমার ক্যামেরায় লাশের ছবি তোলার কথাও বলেছি। আমি খাপ্পা হয়ে মিঃ সিংহকে পুলিশসুপার মিঃ প্রশান্ত ত্রিবেদীর নাম করে বলেছি, মিঃ ত্রিবেদী আমার পরিচিত। তাকে খবরটা জানাতে বাধ্য হব। তা শুনে ও. সি. একটু ভড়কে গিয়ে অবশ্য নিছক দুজন আর্মড কনস্টেবল পাঠাতে রাজি হলেন।

-কর্নেল! আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–কনস্টেবলরা পৌঁছনোর আগেই খুনি পোড়োবাড়ি থেকে লাশটা সরিয়ে গুম করে ফেলবে। এই তো?

-ঠিক ধরেছেন।

–কথাটা আমিও ভেবেছি। কাজেই আমাদের চুপচাপ বসে থাকা ঠিক হবে না। উঠে পড়ো। বেরুনো যাক। সঙ্গে এবার টর্চ নিতে ভুলো না!

–সেই পোড়োবাড়িতে যাবেন?

কর্নেল রহস্যময় ভঙ্গিতে হেসে বললেন, চলো তো! সুখলালকে সঙ্গে নেব। কারণ সুখলাল এবার আমাদের গাইড হবে।

দেখলুম, সুখলাল তখনই বল্লম আর টর্চ নিয়ে এল। তার সেই সঙ্গীকে বাংলোয় থাকতে বলে আমাদের সঙ্গে সে বেরিয়ে পড়ল।

.

ততক্ষণে আকাশ থেকে মেঘ সরে নক্ষত্র দেখা দিয়েছে। আমাকে অবাক করে সুখলাল আর কর্নেল উত্তরে ভীমগড় বসতির দিকে হাঁটছিলেন। লাশ আছে দক্ষিণে পরিত্যক্ত বাঙালিটোলার একটা জরাজীর্ণ বাড়িতে। আর আমরা তার উলটোদিকে কোথায় যাচ্ছি কে জানে! প্রশ্ন করতে গিয়ে থামতে হল। অদূরে স্ট্রিটল্যাম্পের ম্লান আলোয় দুজন সশস্ত্র কনস্টেবল আস্তে-আস্তে এগিয়ে আসছিল।

আমাদের দেখে তারা থমকে দাঁড়াল। সুখলাল বলল,–রাম-রাম পাঁড়েজি!

পাঁড়েজি হিন্দিতে বলল,–রাম-রাম সুখলাল ভাইয়া! তোমরা কোথায় যাচ্ছ? এঁরা কে?

–ইনিই কর্নির্লসাব। থানায় বড়বাবুকে লাশের খবর দিয়েছেন।

দুজন কনস্টেবলই খ্যাখ্যা করে হেসে উঠল। কর্নেল বললেন,–পাঁড়েজি! লাশ দেখবেন তো আমাদের সঙ্গে চলুন! দেরি করবেন না। সুখলাল। তুমি রাস্তা দেখিয়ে দেবে।

সম্ভবত বাঙালিটোলার পোড়াবাড়িতে যাওয়ার কষ্ট স্বীকার করতে হবে না ভেবেই সশস্ত্র কনস্টেবলদ্বয় খুশি হয়েছিল। এর পর কিছুটা এগিয়ে বসতি এলাকার সংলগ্ন ডান দিকের রাস্তায় সুখলাল আমাদের নিয়ে চলল। আমবাগান এবং ঘন গাছপালার মধ্য দিয়ে রাস্তাটা এগিয়ে গেছে। কিছুদূর চলার পর যেখানে পৌঁছলুম, সেখানে একটা ঝিল দেখা দিল। তারপরই পিছনের দিকে কোথাও ‘রামনাম সৎ হ্যায়’ চিৎকার শোনা গেল।

তখনই কর্নেল বললেন, আমাদের লুকিয়ে পড়তে হবে। শিগগির।

ঝোঁপের আড়ালে আমরা লুকিয়ে পড়লুম। ক্রমশ ‘রামনাম সৎ হ্যায়’ চিৎকার কাছেই শোনা গেল। কর্নেল পাণ্ডেজিদের চাপাস্বরে হিন্দিতে কিছু বললেন। তারপর খাঁটিয়ায় একটা মড়া চাপিয়ে লণ্ঠন হাতে কয়েকজন লোক এসে পড়তেই কর্নেল এবং কনস্টেবলদ্বয় ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এলেন। কর্নেল টর্চের আলো জ্বেলে উদ্যত রিভলভার হাতে গর্জন করে উঠলেন,–থামো! নইলে গুলি করব।

টর্চের আলোয় সেই জাল কালীপদকে’ দেখতে পেয়েছিলুম। সবার আগে লণ্ঠন ফেলে দিয়ে সে পালাতে যাচ্ছিল। পাঁড়েজি তাকে ধরে ফেলল। কিন্তু বাকি লোকেরা খাঁটিয়া ফেলে ঝোঁপের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। কর্নেল খাঁটিয়ার কাছে গিয়ে বললেন,–এই সেই ভূতুড়ে লাশ। সুখলাল! দেখো তো চিনতে পারো কি না!

সুখলাল লাশের মুখ দেখে আঁতকে উঠে বলল,–আরে! এ তো পরসাজি আছেন।

পাঁড়েজি গুফো লোকটার পিঠে রাইফেলের বাঁটের এক খোঁচা মেরে বললেন,–কর্নিলসাব! এই লোকটার নাম মগনলাল। দাগি খুনি। এলাকার ডাকুদের সর্দার!

অপর কনস্টেবল বলল,–হায় রাম! পরসাদজি তো খুব ভালো লোক ছিলেন। এই শয়তানটা ওঁকে খুন করল কেন?

কর্নেল বললেন, আমার ধারণা, এই প্রসাদজিকে ফাঁদে ফেলে মগনলাল খুন করেছে। ফঁদটা কীসের তা যথাসময়ে জানা যাবে। পাঁড়েজি, আপনি আসামিকে নিয়ে থানায় চলে যান। ও. সি. মিঃ সিংহকে খবর দিন।

পাঁড়েজি আঁতকে উঠে বলল,–না কর্নিলসাব! এই ডাকু বহত খতরনাক আছে। তার চেয়ে চৌবেজি থানায় গিয়ে খবর দিক। আমরা এখানে অপেক্ষা করি।

অপর কনস্টেবল চৌবেজি টর্চের আলো জ্বালতে-জ্বালতে কাঁধে বন্দুক রেখে যেভাবে হেঁটে গেল, মনে হল মগনলালের অনুচরদের আচমকা হামলার ভয়ে সে বেজায় আড়ষ্ট।….

কর্নেল বলেছিলেন, ফাঁদ পেতে প্রসাদজি নামে ওই ভদ্রলোককে মগনলাল খুন করেছে। আর বাংলোর চৌকিদার সুখলাল বলেছিল, পরসাদজি খুব ভালো লোক ছিলেন। কিন্তু পরদিন সকালেই আসল ঘটনা জানা গিয়েছিল। কীভাবে জানা গিয়েছিল, সেটাই শেষ চমক বলা যায়।

ভোর পাঁচটায় আমাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে কর্নেল বলেছিলেন,–চলো জয়ন্ত! আমার রথ দেখা কলা বেচা দুই-ই হয়ে যাবে। সেই পোড়োবাড়িতে সারা রাত পুলিশের পাহারার ব্যবস্থা করতে বলেছিলুম। সেখানে গিয়ে দেখি কী অবস্থা। তারপর অর্কিডের খোঁজে একচক্কর ঘুরব। চিন্তা কোরো না। ফ্লাস্কভর্তি কফি আর প্রচুর বিস্কুট সঙ্গে আছে।

কী আর করা যাবে, কর্নেলের পাল্লায় পড়ে অনেকবার জেরবার হয়েছি। এবারও হতে হবে। হাঁটতে অবশ্য ভালো লাগছিল। বসন্তকালের ভোরবেলায় পাখিদের ডাকে কী এক মায়া আছে! সেই পোড়োবাড়িতে গিয়ে দেখছিলুম, ভিতরের বারান্দায় সেই জীর্ণ খাঁটিয়ায় একজন কনস্টেবল শুয়ে তখনও নাক ডাকাচ্ছে। বাকি তিনজন বারান্দায় মেঝের থামে হেলান দিয়ে বসে আছে। আমাদের সাড়া পেয়ে তারা উঠে দাঁড়াল। কর্নেলের প্রশ্নের জবাবে তারা একবাক্যে বলল, রাত্রে একটা চুহা অর্থাৎ ইঁদুরের শব্দও তারা শোনেনি।

কর্নেল এবার উঠোনের ঝোঁপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেলেন। তাকে অনুসরণ করব কি না ভাবছিলুম। কিন্তু তিনি উঠোনের কোণে সেই ইঁদারায় উঁকি মেরে কিছু দেখার পর সহাস্যে ডাকলেন,–জয়ন্ত! দেখে যাও!

গিয়ে দেখি ইঁদারার ওপাশে একটা ঝোঁপের গোড়ায় মোটা দড়ি বাঁধা আছে এবং দড়িটা ইঁদারার পাড়ে একটা ফাটলের মধ্যে দিয়ে তলায় নেমে গেছে। কর্নেলের টর্চের আলোয় দেখলুম, দড়ির শেষপ্রান্তে বাঁধা একটা কালো ব্যাগ ঝুলছে।

কর্নেল ব্যাগটা দড়ি ধরে টেনে তুললেন। ততক্ষণে দুজন কৌতূহলী কনস্টেবল এসে গেছে। তারা দুজনে হতবাক হয়ে ব্যাপারটা দেখছিল।

ব্যাগে তালা আঁটা ছিল। কর্নেল একটু হেসে বললেন,–ও. সি. মিঃ সিংহ এখনই এসে পড়বেন।

বললুম-ব্যাগে কী থাকতে পারে?

কর্নেল হাসলেন।–সম্ভবত মগনলাল ডাকুর ডাকাতি করা দামি কিছু জিনিস। ব্যবসায়ী রমেশ প্রসাদ এই চোরাই মাল কিনতে এসে খুন হয়েছে।

-খুনের কারণ কী?

-হ্যাঁ। তোমাকে ইচ্ছে করেই বলিনি। কারণ ভীমগড়ে কিছু-কিছু চমকের কথা দিয়েছিলুম তোমাকে। কাল রাতে মগনলালের কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকার নোটের বান্ডিল পাওয়া গেছে। বান্ডিলগুলো তার জামার তলায় একটা কাপড়ে সারবন্দি অবস্থায় লুকানো ছিল। বুক থেকে পিঠ অবধি বেড় দিয়ে বাঁধা ছিল। টাকাটা সে প্রসাদজিকে খুন করে হাতিয়েছিল।

সেই সময় বাইরে জিপের শব্দ পাওয়া গেল। একটু পরে ও. সি. মিঃ সিংহ দুজন পুলিশ অফিসার এবং কনস্টেবলসহ বাড়িতে ঢুকে ব্যস্তভাবে বললেন,–মর্নিং কর্নেলসায়েব! ওখানে কী করছেন?

কর্নেল থামলেন।-মর্নিং মিঃ সিংহ! যা অনুমান করেছিলুম, তা সত্য হয়েছে। এখানে এসে ব্যাপারটা দেখে যান।

হ্যাঁ, কর্নেল ঠিকই বলেছিলেন। ব্যাগের তালা ভাঙতেই বেরিয়ে পড়ল কাপড়ের থলে ভর্তি একরাশ সোনার গয়না। হিরে বসানো একটা জড়োয়া নেকলেসও।

ও. সি. উত্তেজিতভাবে বললেন,–গত মাসে আহিরগঞ্জের একটা বাড়িতে ডাকাতি হয়েছিল। এগুলো সেই ডাকাতি করা মাল মনে হচ্ছে। আহিরগঞ্জের ধনী ব্যবসায়ী পাটোয়ারিজি ডাকাতি হওয়া জিনিসের যে লিস্ট দিয়েছিলেন, তা আমার মনে আছে। এই জড়োয়া নেকলেসটা দেখেই সব মনে পড়ে গেল!

এর পর আর কী! ভীমগড়ের চূড়ান্ত চমক আমাকে সত্যিই দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য রোমহর্ষক একটা স্টোরির মশলা উপহার দিয়েছিল। তখন কর্নেলের সঙ্গে পাহাড়ি জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে আর আমার এতটুকু দ্বিধা ছিল না। তাছাড়া ভীমগড়ের কালো দৈত্যের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ।…

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments