Friday, March 29, 2024
Homeরম্য গল্পনীল চোখ ফিরিশতা - আশাপূর্ণা দেবী

নীল চোখ ফিরিশতা – আশাপূর্ণা দেবী

'নীল চোখ ফিরিশতা' - আশাপূর্ণা দেবী

এদের কাকুতি মিনতি আর হাত ধরে ঝুলোঝুলির জ্বালায় সুন্দর বনের সেই ভয়ঙ্কর কাহিনীটাই শুরু করতে হলো আমায়! সেই আমার মাছ ধরতে গিয়ে নৌকা ওলোট-পালোট হয়ে সুন্দরবনের ধারে ছিটকে গিয়ে পড়া, আর পথ হারিয়ে গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়ে নরখাদক মানুষদের হাতে প্রাণ যাওয়ার কাহিনীটা। এতোটুকু বাচ্চাদের কাছে এ গল্প আমি কখনো করি না। দরকার কী বাবা, এসব শুনেটুনে যদি রাত্রে স্বপ্ন দেখে আতকে ওঠে? উঠতেই পারে, খুবই স্বাভাবিক। কারণ যতোই হোক- মানে, যতোই গল্পখোর হোক, তারা শিশু বৈ তো নয়! আর শিশুদের স্বপ্নের বিভীষিকায় আঁতকে ওঠা থেকে কতো কী-ই না ঘটতে পারে!

তেমন কিছু ঘটলে ওই বাচ্চাদের মা-বাবা যে আমাকে আস্ত রাখবে, এ ভরসা রাখি না। কী দরকার বাবা তবে আমার অতো ঝুকি নেবার? নইলে গল্পের কিছু অভাব আছে জগতে? ছেলেবেলায় শুনিনি আমরা? বেলা আন্টি আর ছোটোকাকু জগতের সমস্ত জীন ভূতেদের গল্প কি বলেননি আমাদের ?

কিন্তু সেসব গল্পও আমি ছোটোদের বলি না। বলবো কী করে, ওর প্রতিক্রিয়া তো জানি। শোনবার সময় আমরা, মানে বাড়িতে যে গোটা পাঁচ – ছয়জন ছেলে ছিলাম, দিব্যি বেলুআন্টির কি ছোটোকাকুর গা ঘেসে বসে চোখ গুলি-গুলি করে গল্পগুলো গিলতাম, গায়ে কাটা দিলে বা বুক ধড়ফড় করলে কি মাথা ঘুরলেও ছাড়তাম না।

ডালমুট বা ঝালমুড়ির মরিচ যেমন চোখে পানি নিয়েও চেটে চেটে খেতে ইচ্ছে করে, তেমনি গায়ে কাটা নিয়েও শুনতে ইচ্ছে করতো।
কিন্তু তারপর? মানে, সেই রোমহর্ষক ভূতুড়ে গল্প শোনবার পর?
তারপর যা হতো । ও বাবা !

সন্ধ্যে হতে না-হতেই আমাদের ক’জনের অবস্থা হতো ঠিক পিণ্ডিখেজুরের মতো। পাঁচ-ছয় জনে মিলে এমন তালগোল পাকিয়ে ডেলা বেঁধে থাকতাম যে আলাদা করে চিনে বার করা যেতো না। দালান পার হয়ে সিড়িতে যাচ্ছি তো ওই ছজনে হাত ধরাধরি করে, সিড়িতে উঠছি তো সবাই কাধ ধরাধরি করে, আর পিড়ি পেতে ভাত খেতে বসেছি তো প্রত্যেকে প্রত্যেকের হাটুতে হাটুতে ঠেকিয়ে।

আর রাত্রে শুতে যাওয়া ?
সে তো কেটে ফেললেও মা কি ফুপুআম্মার শোবার আগে নয়!
এসব তো জানি আমি।
সবই জানি।

জেনেশুনে কি আমার আদরের বাচ্চাটাচ্চাগুলোকে সেই বিষ খেতে দিতে পারি?
তাই গল্পের বইয়ের গল্প থেকে শুরু করেছিলাম। কিন্তু সে গল্প এদের ভালো লাগছে না, গল্প বলো, ভালো গল্প বলো, তোমার নিজের গল্প বলো, বলে হাত ধরে ঝুলোঝুলি করছে!

তা যে-সে তো নয় এরা, যে এদের কথা অবহেলা করি! এরা হচ্ছে আমার ছোট বোনের মামাতো খালাশাশুড়ীর ছেলের মেয়েরা আর মেয়ের ছেলেরা।

অগত্যাই আমার নিজের গল্প শুরু করতে হলো। একেবারে সাল তারিখ দিয়েই শুরু করি। এরা ছোটো বলে তাদের কাছে বলা গল্প যেমন তেমন করে সেরে দেওয়া আমার ভালো লাগে না। এই ধরো যেমন বিয়ে বাড়িতে! ছোটোদের খেতে বসিয়ে ভালো ভালো জিনিস গুলো দিতে চায় না! বাড়ির কর্তারা এসে হাঁ-হাঁ করে মেছিয়ারদের হুকুম দেবেন, কাটলেট ছোটোদের পাতে নয়, ছোটোদের পাতে নয়; ফ্রাই একখানা, শ্রেফ একখানা! ছোটো খালা কোথায় গেলো। বাচ্চাদের দই দিতে! মিষ্টি জিগ্যেস করে দেবে, ফেলাছড়া না যায়। কেন বাবা ? ছোটোদের বুঝি মান সম্মান নেই? চাইতে পারে তারা? একমাত্র পান ছাড়া আর কক্ষণো কিছু তো চেয়ে খাইনি আমি।

অবশ্য এখন কী হয়েছে, তা জানি না। এখন বোধহয় ছোটোদের শুধু ছোটো না ভেবে মানুষই ভাবা হয়। কিন্তু আমাদের ছেলেবেলায় তা ভাবা হতো না, এই সত্যি কথা বলছি।

আমি কিন্তু মানুষই ভাবি। তাই ওদের কাছে গল্প বললে গুছিয়েই বলি। শুরু করলাম-উনিশশো উনচল্লিশ সালের আগস্ট মাসের এক রাত্রে ছোট্ট একখানা নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মাছ ধরতে। খালাশাশুড়ীর মেয়ের বড়ো ছেলে বলে ওঠে, ধ্যেৎ, রাত্রে আবার কেউ মাছ ধরে নাকি? আমার বড়চাচা তো দিনের বেলা–
মাঝপথে আমি বাধা দিয়ে বলি, আহ! সে তো ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে। জাল ফেলে মাছ রাত্রেই ধরে।

ও! বলে কাছে ঘেঁষে এলো মেয়ের ছোটো ছেলে। ফিরিশতার মত মুখখানা আর নীল কাচের মার্বেলের মতন ঝকঝকে চোখ তুলে মহোৎসাহে বললো, তারপর ?

ছেলেটার এই কাচের মতন চোখ আর ফিরিশতার মতন মুখ দেখতে এতে ভালো লাগে আমার! ওকেই সবচেয়ে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। তাই গল্প বলার সময় ওর মাথাই হাত-রাখি।

তারপর- আমি বলি, রাত যখন বেশ গভীর হয়ে উঠেছে আর গভীর জলের ইয়া বড়ো বড়ো মাছগুলো জলের ওপর উঠে এসেছে চাঁদের আলো খেতে-

বোনের খালাশাশুড়ীর ছেলের বড়ো মেয়ে বলে ওঠে, আহ, কী কথার ছিরি! চাঁদের আলো আবার খায় মানুষে?

গম্ভীর হয়ে বলি, মানুষের কথা বলিনি, বলছি মাছের কথা।
আহাসে একই কথা হলো, মাছ বলে তারা কি আর মানুষ নয়,
নীল কাচের মার্বেলচোখের ছেলেটা বলে ওঠে, আহ, কথা বলছিস কেন? শুনবি তো মন দিয়ে?
বেশ বাবা বেশ, শুনছি বাবাঁ শুনছি — সবাই গুছিয়ে বসে।

আবার শুরু করি—সেই গভীর রাত, চারিদিকে নিঝুম অন্ধকার, একলা আমি সেই কালো ঢেউ তোলা পানিতে জাল ফেলেছি, এমন সময়–

নতুন মামা—আবার ব্যাঘাত পড়ে —জাল বুঝি একলা ফেলে ?
আমরা তো দাদাবাড়ি গিয়ে দেখেছি দু’জন তিন জনে জাল ফেলে। খালাশাশুড়ির ছেলের বড়ো মেয়েই বলে এ কথাটি ।
আমি স্নিগ্ধ হাসি হেসে বলি, ওরে, গভীর জলের মাছ তুলতে হলে একলাই জাল ফেলতে হয়। দুজন চারজন থাকলেই তো কথা আর কথা কানে গেলেই ওরা ফের গভীর জলে পালায়।

নীল মার্বেলচোখা আবার ওদের তাড়া দেয়, ফের কথা বলছিস? না, নতুন মামা, শুনো না ওদের কথা, তাড়াতাড়ি বলো।
ওর উৎসাহ-চকচকে চোখ দুটোই আমাকে বিগলিত করে ফেলে। তাই আবার ওকে কাছে টানি; টেনে বলি, কী বলছিলাম, এমন সময় ইয়া প্রকাণ্ড একটা কী যেন জলজন্তু হঠাৎ ডিঙির তলায় মারলো এক ধাক্কা! মনে হলো, কোনো পাহাড় এসে ধাক্কা মারলো।

নতুন মামা, নীল কাচের মার্বেল চোখা ছেলেটা আগ্রহে আর উত্তেজনায় ঠিকরে উঠে বলে, জলহস্তী বুঝি?
ওর আগ্রহ দেখে মনে হলো, জলহস্তী হলেই ভালো হতো কিন্তু হবার উপায় নেই। ওটা তিমি মাছ, কারণ তার পরের বারই যে লেজের ঝাপ্টা দেয় ও আমায়। জলহস্তীর কি লেজ থাকে? থাকে না, তাই কাচের মার্বেলকে একটু মনঃক্ষুন্ন করেই বলতে হয়, না জলহস্তী নয়, তিমি মাছ!

তিমি মাছ! ও মা! হাততালি দিয়ে ওঠে আর একজন, তিমি মাছ আমার খুব ভালো লাগে। তারপর কী হলো?

তারপর? তারপর হলো সেই কাণ্ড! যার জন্যে আমাকে একেবারে ছিটকে গিয়ে পড়তে হলে সেই সুন্দরবনের গহন অরণ্যের ধারে!
কী করে? বললো একজন।

আরে বাবা, এটা জানিস না, তিমি কখনো শুধু মাথার ঘা মেরেই থেমে যায় না! তিমিরা ঠিক যা যা করে ও-ও হাত দিয়ে অনুকরন করে দেখালো। মাথায় ধাক্কা দিয়েই ঘুরে গিয়ে মারলো লেজের ঝাপ্টা!

মারলো? নীল মার্বেলচোখা ফেরেশতা উৎসাহে নীল বাল্ব এর মত হয়ে ওঠে।
আমি ওকে কাছে টেনে বলি, মারবে না? যার যা স্বধর্ম সেও তা করবে তো? ডিঙি নৌকোর যা স্বধর্ম সেও তাই করলো, ওই ধাক্কায় স্রেফ রবারের বলের মতো লাফিয়ে, উল্টেপাল্টে ডিগবাজি খেয়ে আমাকে ছুড়ে দিলো ডাঙায় মানে সুন্দরবনে।

বাঃ, সুন্দরবনের দিকেই বা তুমি মাছ ধরতে গেলে কেন? বললো সেই পাকা মেয়েটা খালাশাশুড়ীর ছেলের বড়ো মেয়ে।
গেলাম কেন সে কথা বুঝিয়ে বলার আগেই নীল কাচের মার্বেল চোখা ছেলেটা ভীষণ রেগে ওঠে, খালি খালি বুঝি দেরি করিয়ে দিবি তোরা? শুনতেই দিবি না? সুন্দরবনের কাছেই কি আর গিয়েছিলেন নতুন মামা? এমনি বাড়ির কাছের যমুনাতেই হয়তো জাল ফেলেছিলেন, তিমি মাছটাই তো এই কাণ্ড করলো। বাড়ির কাছ থেকে সুন্দরবনে নিয়ে গিয়ে ফেললো? পাকা মেয়েটা অবিশ্বাস করে।

কাচের মার্বেল চেচিয়ে ওঠে, ফেলবে না? ওদের জোর কতো, তা জানিস? বিলেতে নিয়ে গিয়েও ফেলতে পারে ওরা।
আমি মুখ গম্ভীর করে ওদের দিকে তাকিয়ে বলি, বিলেতের কথা অবশ্য ঠিক জানি না আমি। আমাকে অন্তত ফেলেনি কখনো কিন্তু সুন্দরবন আমার হাড়ে হাড়ে প্রত্যক্ষ। যদি তোমাদের শুনতে ভালো না লাগে—-

না না, খুব ভালো লাগছে, বলো বলো। ঐকতান বাদন শুরু হয়ে যায়। বলো বলো আর থামতে চায় না।

হেসে ফেলে থামিয়ে দিয়ে বলি—এই যে বলছিলাম হাড়ে হাড়ে, ওইটাই আসল কথা। যখন পড়েছিলাম তখন তো আর জ্ঞানবুদ্ধি তত ছিলো না। তারপর যখন সকাল হয়ে চলে গিয়ে দুপুর হয়েছে, মুখে চোখে আগুনের মতো রোদ এসে পড়েছে, তখন জ্ঞান ফিরলো। ফিরলো তো, কিন্তু আমি যে পাশ ফিরতেও পারছি না। হাড়গোড় যেন সব চূর্ণ।

চূর্ণ! ওদের সকলের কণ্ঠ থেকে একযোগে হতাশা আর বেদনা ঝরে পড়ে।

আমি আশ্বাস দিয়ে বলি, আহ, সত্যিই কি আর গুড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে? তা নয়, ভেতরে ভেতরে ছাতু হয়ে গেছে আর কি। যেমন বরফ চূর্ণ! ও, তোমরা বুঝি চূর্ণ বরফ খাওনি কখনো? তবে আর কী বুঝবে। যাক, ভীষণ ব্যথা গায়ে, সেই নিয়েই গড়াতে গড়াতে একটা গাছের তলায় পৌছে ছায়ায় পড়ে রইলাম। তখনও তো জানি না, কী ঘটেছে কপালে, কোথায় এসে পড়েছি। তখন ভাবছি একটু উঠে যেতে পারলেই এই জঙ্গলটা থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে চলে যাবে। আর একটা দোকানে উঠে যতো পারবো পেট ভরে খেয়ে নেবো। পয়সা? সে তো কখন পকেট থেকে হাওয়া, পানিতে কি জঙ্গলে। কিন্তু এই যে রুপার সীল আংটিটা, যেটা গত ঈদের সময় খালাম্মা দিয়েছিলেন, এইটা বুকের বল। দোকানীকে দিলে কি আর যতো পারবো খেতে দেবে না? পেটের মধ্যে বুঝলে কিনা -তখন একেবারে আগুন! বকরাক্ষস আর কুম্ভকর্ণের খাওয়া দাওয়ার গল্পগুলো মোটেই বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে না তখন। এমনকি মনে হচ্ছে তিমি মাছটা যখন আমাকে আছড়ে দিলো তখন যদি এক-আধটা জলের তলার ছোটো খাটো মাছও আছড়ে দিতো, ওই কড়া রোদেই ঝলসে খেয়ে নিতাম। কিন্তু হাঁ, মাছ তো দূরের কথা একটা মাছিও নেই সেখানে। শুয়ে শুয়ে মনে পড়তে থাকে এযাবৎ জীবনে কবে কোথায় কখন কী কী খাবার না খেয়ে নষ্ট করেছি। উঃ, ইস! !! সে কি কম! কম খাওয়ার জন্যেই খালাম্মার বকুনি খেয়েছি চিরদিন।

আশৈশবের সেই ফেলেদেওয়া মাছ, মিষ্টি, দই, পায়েস, লুচি, ভাত, খিচুড়ি-মাংস এমনকি ছোট মাছের চচ্চড়ি, বেগুনভাজা পর্যন্ত যেন অদৃশ্যলোক থেকে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দাত বার করে হাসতে থাকে। ভেবে গায়ে কাটা দিয়ে উঠতে থাকে।

হে আল্লাহ, কাতর প্রার্থনায় তো তুমি গলে যাও শুনেছি, মুসাকে(আঃ পাহাড়ের উপর দেখা দিয়েছিলে, আমি অতো কিছু চাইছি না, তোমার দেখা পেয়ে আর কী হবে, শুধু যদি তোমার ওই ভাণ্ডার থেকে যেন এক ঠোঙা খাবার ফেলে দিতে!

বুঝলি কিনা, অনেকক্ষণ আশা করলাম, কিন্তু কোথায় কী? প্রভু হয়তো আমার কপালে সেসময় খাবার লিখে রাখেন নি। অবশেষে গায়ের ব্যথা নিয়েই গা ঝেড়ে উঠে পড়ে লোকালয়ের উদ্দেশে হাটতে শুরু করলাম। তখনও জানি না, কপালে কী ঘটবে! ওরা আমার কাছে ঘেষে আসে।

হাটছি হাটছি, কোথায় লোকালয়, কোথায় বা রাস্তা আরও বন, নিবিড় বন, ভয়ঙ্কর বন! তারপর হঠাৎ দেখি, ফুটফুটে অন্ধকার হয়ে গেলো। কী রে বাবা, সন্ধ্যা হয়ে গেলো নাকি! তা নয়, জমাট পাহাড়ের মতন, কয়লার খনির মতন, তাড়কা রাক্ষসীর চুলের মতন, গহন গভীর অরণ্যে এসে পড়েছি! সে যে কী অন্ধকার তোমরা ধারণা করতেও পারতে না। নিজের হাত-পা দেখতে পাচ্ছি না, মাথাটা ঘাড়ের ওপর আছে কিনা টের পাচ্ছি না, গায়ে-হাতে চিমটি কেটে চুল ছিড়ে ছিড়ে দেখছি, আছি তো—

ঈ-ঈস! কাচের মার্বেলচোখা ছেলেটি শিউরে উঠে একেবারে আমার হাঁটু চেপে ধরে,তারপর? ওর ছোট্ট হাঁ-টা বড়ো হয়ে যায়, বড়ো হয়েই থাকে। আর চোখ দু’টি দু’আনার মার্বেলের সাইজ হয়ে ঠিকরে ওঠে। আরো কাছে টেনে নেই পিচ্চিটাকে।
তারপর–? তারপরের কথা বলবো? ভেবে দেখি বাপু, তোমরা রাত্রে ভয় পাবে না তো?
–না না, আমরা তো মায়ের কাছে শুই।

তারপর পাগলের মতো ছুটোছুটি করতে থাকি, আর যেদিকে যাই সেদিকেই মোটা গাছের গুড়িতে মাথা ঠোকে। আয়না নেই, চোখে দেখবার নয়। হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখি, টুকে ঝুকে কপালটা আগে আলুর মতো, তারপর কাচা পেঁপের মতো, তারপর ডাবের মতো, আর শেষ অবধি প্রকাণ্ড এক বিলিতি কুমড়ার মতো হয়ে উঠল।

–বিলিতি কুমড়ার মতো! ওরে বাবা! সকলের মুখ হাঁ হয়ে যায়।
সেই নিয়েই পাগলের মতো ছুটোছুটি করছি। হঠাৎ দেখি, সেই অন্ধকারের গায়ে কোন এক ফাকা থেকে দপদপে আগুনের শিখা!
দাবানল বুঝি? পাকা মেয়েটা বলে উঠে।

আরে বাবা, সে হলে বরং ভালো ছিলো। এ আগুন- কিসের আগুন, বলবো? বলবো কিনা ভেবে দেখো?
হা হা হা। সবাই চেচায়, শুধু কাচের মার্বেল একটু যেন নিভে আসে, আর প্রায় আমার কোলের ভেতর ঢুকে আসে সে।
বলছি কিন্তু আমার দোষ নেই। এ আগুন মানুষের হাতের মশালের। সেই মশালের আগুনেই তাদের চেহারা দেখতে পেলাম!

আবলুশ কাঠ দেখেছো তোমরা? দেখোনি! যাক, কয়লার চাই দেখেছ তো? ঠিক যেন সেই কয়লার চাই দিয়ে গড়া একদল দাঁত খিচোনো দৈত্য! বললে বিশ্বাস কররে না, প্রত্যেকের মুখে হাতির দাতের মতো দু’পাশে দুটো খোচা খোচা ধারালো দাত, কপালে সাদা সাদা কিসের যেন মোটা মোটা দাগ আঁকা। গলায় জন্তু-জানোয়ারের হাড়-গাথা মালা, পরনে গাছের ছাল, আর নেড়া মাথার ওপর—

পাকা মেয়েটা হঠাৎ বলে ওঠে, নাপিত আছে ওদের?
নাপিত! আমি তো হতভম্ব-নাপিত মানে?
বাহ, মাথা নেড়া করতে নাপিত লাগে না?

হাঁ হাঁ করে হেসে উঠি আমি, আরে এতো বুদ্ধি নিয়ে এই কথা বললে তুমি? কেন, সুন্দরবনের ‘কুন্তলোৎপাটিনী লতিকা’র নাম শোনোনি কখনো? তা হয়তো শোনোনি, কী জানি তোমার মা-বাবাও শুনেছেন কিনা আজকাল তো আর এইসব বৃক্ষলতা নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউ, সবাই ডাক্তারি ওষুধ ব্যবহার করে। ওই লতার রস একবার মাথায় মাখলে তিন দিনের মধ্যে মাথার সমস্ত চুল উধাও। জীবনেও আর সে মাথায় চুল গজাবে না।

ওরা এবার একটু বিচলিত হলো, জীবনেও চুল গজাবে না?
নাহ!

কী নাম বললে, নতুন মামা? কুন্তলোটিকা পাতিনী না কী?
কী সর্বনাশ! আরে না না, কুন্তলোৎপাটিনী লতিকা।
ওরা বিজবিজ করে মুখস্থ করতে থাকে।

তুমি বাবু বড় বাধা দিচ্ছো, আমি প্রায় ভুলেই যাচ্ছি সব।
না না নতুন মামা, বলো, ভেবে ভেবে সব বলো তুমি, ফেরেশতার মতো ছেলেটি অধীর আগ্রহে আমার আঙ্গুল টানাটানি করে বলে, নেড়া মাথার ওপর কী?

নেড় মাথার ওপর? আমি বলি, সে যা ব্যাপার, তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না।
মাথায় গাছের পাতা বুঝি? ওরা বলে ওঠে।

উঁহু, না।
তবে, পাখির পালক?
দূর, নেড়া মাথায় পালক গুজবে কোথা?
তবে? হরিণের শিং?
তবে নিশ্চয়- তবে নিশ্চয়-

বলতে পারলে না তো? প্রত্যেকের মাথার মাঝখানে ইয়া বড়ো এক-একটি পা-বাঁধা বনমোরগ! অনবরত তারা তাদের হাত দুই করে লম্বা ডানাগুলো ঝটাপট ঝটাপট ঝটপটাচ্ছে।
জ্যান্ত? কাচের গুলি বিস্ময়ে বিষ্ফারিত হয়ে ওঠে!
জ্যান্ত বলে জ্যান্ত–একেবারে জলজ্যান্ত।

উড়ে পালিয়ে যাচ্ছে না?
আমি বললাম— বাঃ, বললাম না—পা-বাধা? সেই বাধন দড়িগুলো যে আবার ওদের কানের সঙ্গে আটকানো।
ইস, কী বুদ্ধি! নীল কাচের মার্বেলই সত্যিকার অভিভূত হচ্ছে।

সেই জলন্ত মশালগুলো আমার মুখের সামনে তুলে ধরে বললো, বাঃ, চেহারা বেশ সুন্দর তো! কাচা খেতেই ভালো লাগবে।
তুমি ওদের ভাষা বুঝালে? পাকা মেয়েটা আবার ফোড়ন কাটে।

আমি অবশ্য পাকাকে বোকা বানিয়ে ছাড়ি। সত্যি, এতো পাকা অথচ এটুকু আর জানে না, সুন্দরবন বাংলাদেশেরই অন্তর্গত। বললামও তাই– সুন্দরবন তো বাংলাদেশে, তাও জানো না? বাংলা দেশের লোকের ভাষা বুঝতে পারবো না ?

বাঃ, ওরা তো বুনো। বনে জঙ্গলে থাকে। মানুষের মাংস খায়।
চমৎকার! তোমার যা বুদ্ধি। আমি বলি, মানুষের মাংস খায় বলে মাতৃভাষায় কথা বলবে না?
বলবে?
নিশ্চয় বলবে!
বাঙালির মাংস খাবে?

নিশ্চয় খাবে। বাঙালির মাংসের স্বাদ কতো ভালো।
সেই আমার ফেরেশতাটি, সত্যি বড়ো সরল ছেলেটা—শুনে একেবারে কাদো-কাদো গলায় বললো, কেন নতুন মামা, বাঙ্গালির স্বাদ কেন ভালো?

বাঃ, বাঙালিরা কতো ভালো ভালো জিনিস খায়। পৃথিবীর আর কোথাও এতো অদ্ভূত সুন্দর আর এতো রকম বেরকম রান্না-খাওয়া আছে? ভাপা পিঠা, দুধচিতই, চন্দরপুলি, রসমাধুরী ছানার পায়েস, সাড়ে ছাপান্ন রকম সন্দেশ চোখে দেখেছে আর কোন জাতি? তবে? এসব খেলে গায়ের মাংস তুলতুলে আর সুস্বাদু হবে না? নরখেকো গুলো ওই কথাই বলাবলি করছিল, দেখেছিস, বেটার গা দিয়ে যেন খোসবু বেরোচ্ছে।

আমার অসহ্য লাগতে লাগলো। চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, যা করবার তাড়াতাড়ি করো, আর ভালো লাগছে না।
আমার চেচানিতে নরখেকোর দলনেতাটার কী ফুর্তি।

লাফিয়ে নেচে বিশ্রী একটা চিৎকার করেই প্রচও এক শিস দিলো আর সঙ্গে সঙ্গে– উঃ সে দৃশ্য ভাবলে এখনও আমার কালঘাম ছুটে যায়। সঙ্গে সঙ্গে যেন বনে আগুন ধরে গেলো। কোথা না কোথা থেকে পিলপিল করে দলে দলে ঠিক ওই এক সাজের লোক মশাল হাতে ছুটে এসে আমাকে ঘিরে দাত খিচিয়ে খিচিয়ে নাচতে লাগলো। তার সঙ্গে মাথার ওপর সেই ঝট-পটন্ত বনমোরগ, আর মুখে কিম্ভূতকিমাকার গান!

তখন আমার যা অবস্থা, কী গাইছিলো তা মনে নেই, শুধু মনে আছে, খালি খালি বলছিলোঃ
হেচাং হেচাং হেচা হে—
নাছস নুতুস খাউস রে
তাধিং তাধিং ধিং তা রে

তারপর ? নীল কাচ প্রায় আমার হাতটা খামচে ধরে, তারপর নতুন মামা?
ওর মুখ-চোখ ভয়ে আভাশ, মাথার চুলগুলো শজারুর কাটার মতো খাড়া, আর গলার স্বর বুজে আসা।
দেখো, আর বলবো না, তুমি বড়ো ভয় পাচ্ছো।

না না, বলো বলো। তারপর কী হলো বলো—সেই বোজা গলাতেই বলে ও, কিন্তু আমার সঙ্গে একেবারে লেপ্টে বসে।
অগত্যাই বলি, তারপর তারা নাচতে নাচতে তাদের মশালগুলো একবার করে আমার গায়ের চামড়ায় বুলিয়ে দিয়ে, নাচতে নাচতেই আবার সেই বনের মধ্যে মিলিয়ে গেলো। রইলো খালি আগের লোকেরা। একজন আমাকে টিপে টিপে বললো, চামড়া ঝলসেছে মনে হচ্ছে।

অর্থাৎ বুঝতে পারছো কেন ওই মশাল বুলোনো। জ্যান্ত রোষ্ট করে নিলো আমায়।
আমি হাত জোড় করে চেচিয়ে বললাম, আমাকে তোমরা তাড়তাড়ি শেষ করো, আর কষ্টে মেরো না!

ওরা আবার খ্যা খ্যা করে হেসে উঠলো, তারপর না- ওরে বাবা, কী করে বলি! এদিকে তোমরাও না শুনে ছাড়বে না। তারপর না, দু’তিনজনে মিলে আমাকে জোর করে মাটিতে শুইয়ে ফেললো, আর দলপতি কোথা থেকে একটা চিমটে এনে—ওরে বাবা রে ভয়ে চোখ বুজি আমি সেই দৃশ্য মনে পড়ায়।

চিমটে এনে কী? ও নতুন মামা? নীল চোখা ছেলেটা ভয় পেয়ে খালি আমায় খামচে ধরছে।

চিমটে এনে! চিমটে এনে আমার গা থেকে সমস্ত ছাল চড়চড় করে টেনে ছাড়িয়ে নিলো!
সত্যি নিলো, এবার দেখলাম যতোগুলো চোখ ছিলো সবগুলোই গুলি গুলি হয়ে উঠেছে, এমনকি সেই পাকা মেয়েটারও।
লাগলো না তোমার ?

লাগলো? হু । আমি কি তখন আমার মাঝে ছিলাম। অসাড় হয়ে ঠিক যেন সিনেমার ছবি দেখছি-ছালগুলো সব ছাড়িয়ে একটা তাল বানিয়ে মাটিতে রেখে তাতে কী যেন গুড়ো, মসলা কি নুন তা জানি না, ছড়িয়ে ছড়িয়ে চেখে চেখে খেতে লাগলে সবাই।

তুমি নিজের চক্ষে দেখলে, হঠাৎ নীলচোখা ডুকরে কেঁদে উঠলো, তোমার ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে নুন মসলা দিয়ে খাচ্ছে তুমি দেখলে? ও নতুন মামা?

আরে আরে-ব্যস্ত হয়ে উঠি আমি, কান্নার কী আছে? আবার তো ছাল গজিয়েছে আমার!

কী করে আবার গজালো? পাকা মেয়েটা রুদ্ধশ্বাসে বলে।
গজালো ওদেরই গুণে, আমি বলি, ওরা নিজেরা বলাবলি করলো
ছালটাই ভারি মজাদার খেতে। ছোড়াকে এক্ষুনি শেষ করার দরকার নেই। ভুরাং, তুই এটাকে মসলা মাখিয়ে রোদে শুকোতে দিয়ে রাখবি, ফের ছাল গজিয়ে যাবে। আহাকী মজা রে!

তারপর?
তারপর আর জানি না, মরে গেলাম কি বেঁচে থাকলাম, তাই বা কে হিসেব রেখেছে? কবে কতোদিন পরে জানি না, জ্ঞান হতে দেখি, সেই জলের ধারে কাটাগাছের ঝোপের ওপর রোদে পড়ে আছি, সর্বাঙ্গে কিসের যেন প্রলেপ। ঠিক যেমন খাল্লামা নুন মসলা মাখানো আমসি রান্নাঘরের চালে তুলে রোদে দিতেন।
আমার যে জ্ঞান ফিরেছে সে খবর ওরা পায়নি। তাই নিশ্চিন্ত আছে। আমি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা দিলাম পানিতে ঝাঁপ।
সাতারটা শেখা ছিলো তাই ডুবলাম না। সাত দিন সতেরো রাত সাতরে উঠলাম এসে এই মাঝেরচরের ঘাটে!

আঁ!
তবে না তো কী!
তারপর?
তারপর জীবনে আর কখনো মাছ ধরতে যাইনি, বাড়িতে কোনো চিমটে রাখতে দিইনি, আর খালাম্মাকে আচার রোদে দিতে দিইনি।
চিমটে আর আমসি দেখলেই– উঃ! কপালের ঘাম মুছতে থাকি আমি।

কান্না থামিয়ে ছেলেটা আমার গায়ের চামড়া টিপে টিপে বলে, এসব নতুন ছাল?
বিলকুল। যাক, এবার নাইতে যাওয়া যাক। বেলা হয়ে গেছে। তোমরা তো দিব্যি পেট ভরিয়ে বসে আছো।

নাইতে গেলাম, কিন্তু চিরকালের জন্যে কেন গেলাম না! কেন আবার ফিরে এলাম! ফিরে এলাম শুধু এ ঘরে তোয়ালেটা ছিলো বলে। কিন্তু না, ঘরে আমি আসিনি, শুধু দরজার বাইরে পর্যন্ত এসেছিলাম। তারপরই সেই প্রচও ধাক্কা। না না, কপালে নয় যাতে কপালটা আলু থেকে বিলিতি কুমড়া হয়ে উঠতে পারে। ধাক্কা খেলাম প্রাণে।

শুনতে পেলাম পাকা মেয়েটা বলছে, উঃ! যাই হোক, ভাগ্যিস সাতার জানতো নতুন মামা! তাই না–
তার কথা থামিয়ে ফেরেশতার মত নীলচোখা ছেলেটার হি হি হাসি ঝলকিয়ে উঠলো, তুই বুঝি ওই সব বিশ্বাস করেছিস? ও তো নতুন মামা স্রেফ গুল মেরেছে!
গুল!

না তো কী? এতোক্ষণ ধরে স্রেফ গুল মারলো নতুন মামা! চোখে অন্ধকার দেখেও তখনও পর্যন্ত দাড়িয়ে ছিলাম, পরের দু’লাইন শুনে আর পারলাম না, টেনে দৌড় দিয়ে সোজা চলে এলাম রেল স্টেশনে, গোসল বাদ। ছোট আপুর বাড়ি থেকে সোজা নিজেদের বাড়ি।

শেষ দু’লাইন? উফ, ভাবলে সারা গায়ের ছাল ছাড়ানোর চাইতেও যন্ত্রণা হয়। পাকা মেয়েটা বললো, আহা! বডড যে চাল মারছিস এখন? তখন তো ভয়ে কেঁদেই ফেললি!

নীল মার্বেল চোখা ছেলেটা বললে, দূর ও তো বানিয়ে! নতুন মামা এতো কষ্ট করে এতো সব গল্প বানালো। আমরা একটু বানিয়ে বানিয়ে বিশ্বাসও করবো না? একটু ভয়ও পাবো না? তাই কি হয়।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments