Saturday, April 20, 2024
Homeকিশোর গল্পকালিকাপুরের ভূত রহস্য – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

কালিকাপুরের ভূত রহস্য – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

কালিকাপুরের ভূত রহস্য – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সেবার ডিসেম্বরেও কলকাতায় তত শীত পড়েনি। এক রবিবারে অভ্যাসমতো কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে আড্ডা দিতে এসেছিলুম। দেখলুম কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে যথারীতি চুরুট টানছেন, আর সোফার কোণের দিকে বসে প্রাইভেট ডিটেকটিভ আমাদের প্রিয় হালদারমশাই ডানহাতে খবরের কাগজ আর বাঁ-হাতে এক টিপ নস্যি নিয়ে বসে আছেন। আর কর্নেলের কাছাকাছি যে প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি কাচুমাচু মুখে বসে আছেন, তাকে দেখেই বোঝা গেল তিনি মফস্বলের মানুষ। কলকাতার লোকজনের চেহারা আর হাবভাবে বেশ খানিকটা চেকনাই থাকে। এই ভদ্রলোক মুখ তুলে আমাকে দেখে আর-একটু আড়ষ্টভাবে সরে বসলেন। কর্নেলের জাদুঘর সদৃশ ড্রইংরুমে ঢুকেই আমি সম্ভাষণ করেছিলুম,–মর্নিং কর্নেল।

কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে গলার ভেতরে মর্নিং’ আউড়ে আবার চোখ বুজলেন।

ভদ্রলোকের সামনে দিয়ে এগিয়ে আমি সোফার শেষপ্রান্তে বসলুম। এতক্ষণে হালদারমশাই নস্যি নাকে গুঁজে কাগজ নামিয়ে রেখে মৃদুস্বরে বললেন,–আয়েন জয়ন্তবাবু, বয়েন। আপনাগোর সত্যসেবক পত্রিকায় আইজ তেমন কিসু নাই।

আমি চোখের ইশারায় প্রৌঢ় ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললুম,–আছে। সবকিছু কি কাগজে ছাপা হয়!

আমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে গোয়েন্দাপ্রবর বললেন,–হ, ঠিক কইসেন।

ইতিমধ্যে ষষ্ঠি আমার জন্যে এক পেয়ালা কফি দিয়ে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে বললুম,–এবার ডিসেম্বরেও কলকাতায় শীতের দেখা নেই। ফ্যান চালাতে হচ্ছে।

আমার কথা শুনে সেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন, আপনাদের কলকাতা শহরে এসে আমাকে সোয়েটার খুলতে হয়েছে। সোয়েটারের ওপর ওই দেখছেন একখানা শাল, তাও জড়ানো ছিল। আমাদের কালিকাপুরে গেলে কিন্তু শীতের কামড়ে আপনার হাড় নড়িয়ে দেবে।

কর্নেল তো তুম্বা মুখে চোখ বুজে কী ধ্যান করছেন, কে জানে।

কালিকাপুরের ভদ্রলোক কথা বলায় গুমোট ভাবটা কেটে গেল। জিগ্যেস করলুম,–আপনি কালিকাপুর থেকে আসছেন? সেটা কোথায়?

ভদ্রলোক বললেন, আজ্ঞে বেশি দূরে নয়, মোটে ঘণ্টাচারেকের ট্রেন জার্নি। স্টেশন থেকে নেমে এক্তাগাড়ি, সাইকেলরিকশা, বাস–সবই পাওয়া যায়। গঙ্গার ধারে আমাদের গ্রামটা এখন আর গ্রাম নেই। ইলেকট্রিসিটি এসেছে, টেলিফোন এসেছে, নিউ টাউনশিপ হয়েছে।

ভদ্রলোক আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ কর্নেল চোখ খুলে বললেন, আপনার বাড়িতে আপনার বাবা আর কাকা ছাড়া আর কে-কে থাকেন?

ভদ্রলোক বললেন, আমার এক বিধবা পিসি থাকেন। আমার মা তো অনেক বছর আগে মারা গিয়েছেন। কাকা বিয়ে করেননি। সাধুসন্ন্যাসীর মতো ওঁর চালচলন। আমরা ভাবি কবে হয়তো কাকা সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয়ে চলে যাবেন। অথচ আপনাকে বলেছি আমার বাবা রুগ্ণ মানুষ, বাড়ি থেকে বেরোতেই পারেন না। কিন্তু কাকার শরীর-স্বাস্থ্য খুব ভালো। নিয়মিত যোগব্যায়াম করেন কিনা।

কর্নেল বললেন, বাড়িতে কাজের লোক নিশ্চয়ই আছে?

ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ, তা আছে। মানদা নামে একটি মেয়ে প্রতিদিন ভোরবেলায় আসে, সারাদিন থেকে সন্ধের পর নিজের খাবারটা বেঁধে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। আপনাকে তো বলেছি, ব্যাপারটা প্রথম তারই চোখে পড়ে। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন কর্নেলসাহেব।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। আপনি বলেছিলেন বটে। কিন্তু মানদা তখনই ফিরে এসে কথাটা আপনাদের বলেনি কেন? আপনি বলেছিলেন পরদিন সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফেরার সময়েই সে কথাটা আপনার পিসিমাকে বলেছিল–তাই না?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলুম। আসলে এমন একটা গোলমেলে ব্যাপার যে ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না। আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তাতেই ইলেকট্রিক আলো আছে। গত বছর কালিকাপুরে মিউনিসিপ্যালিটি হয়েছে কিনা! বুঝে দেখুন স্যার, শীতের রাতে এখন ওখানে বড় কুয়াশা হয়। তা হলেও মানদা স্পষ্ট চিনতে পেরেছিল লোকটাকে।

হালদারমশাই গুলি-গুলি চোখে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন। এবার বলে উঠলেন,–তা হইলে ক্যামনে বুসলেন ওই লোকটাই সেই মরে যাওয়া লোক?

ভদ্রলোক ব্যস্তভাবে বললেন, আমাদের মানদা স্যার খুব চালাক-চতুর মেয়ে। অন্ধকারেও দেখতে পায়। তা ছাড়া যে লোকটাকে দেখেছিল, সে সম্পর্কে আমারই এক দাদা। মাসতুতো দাদা। পাঁচ বছর আগে তাকে আমরা শ্মশানে চিতায় দাহ করে এসেছি। বাবা-কাকা সবাই ছিলেন শ্মশানে।

কর্নেল বললেন, আপনার ওই মাসতুতো দাদার নাম বিনোদ মুখুজ্যে তাই না?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। ওরা মুখুজ্যে, আমরা চাটুজ্যে। কথাটা বিশ্বাস করতুম না, কিন্তু আমাদের পাড়ার বামাপদ গোঁসাই হঠাৎ কাল কথায়-কথায় বললেন, হারে শচীন, তোদের বাড়ির কাছে কাল সন্ধেবেলা একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছিলুম। মাত্র হাত দশেক দূরে। দ্যাখা মাত্রই চমকে উঠেছিলাম। এ তো সেই পাগলা বিনোদ!

এবার আমি জিগ্যেস করলুম,–পাগলা বিনোদ মানে?

শচীনবাবু বললেন, কর্নেলসাহেবকে সবই বলেছি। আমার ওই মাসতুতো দাদার কোনও চালচুলো ছিল না। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াত, মাঝে-মাঝে একটু-আধটু পাগলামি করত। তারপর বেশ কিছুদিন খুব শান্ত আর গম্ভীর হয়ে থাকত। তাই লোকে ওকে বলত বিনোদ পাগলা, বা পাগলা বিনোদ।

কথাটা বলে শচীনবাবু সার্জের পাঞ্জাবির হাত সরিয়ে ঘড়ি দেখলেন। তারপর করজোড়ে বললেন,–কর্নেলসাহেব, কালিকাপুরের জমিদারবাড়ির চণ্ডীবাবু আপনার কাছে পাঠিয়েছেন-সেকথা তো আগেই বলেছি। আমাদের রাতের ঘুম একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যখন-তখন ওই উৎপাত।

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে, চণ্ডীবাবুকে গিয়ে বলবেন আমরা যে-কোনও দিন কালিকাপুরে গিয়ে হাজির হব। সেখানে কোথায় উঠব তা আগে থেকে বলতে পারছি না। তবে আপনারা নিশ্চয়ই খবর পাবেন।

কালিকাপুরের শচীনবাবু তার ব্যাগের ভেতর শালটাও যেন খুলে ভরে নিলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–এখনই শিয়ালদায় একটা ট্রেন আছে। ট্যাক্সি করে চলে যাব।

বলে তিনি প্রথমে কর্নেলকে, তারপর আমাদের দুজনকে নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন। সেই সময় লক্ষ করলুম, তিনি যেন একটু লেংচে হাঁটছেন।

তিনি চলে যাওয়ার পর বললুম,–ভদ্রলোকের বাঁ-পায়ে গণ্ডগোল আছে। তা একটা ছড়ি হাতে নিয়ে হাঁটেন না কেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–ছড়িটা উনি দরজার বাইরে ঠেকা দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ছড়ি বলা যায় না, আস্ত বাঁশ বললে ভুল হয় না। কিন্তু বেশ পালিশ করা বাঁশের লাঠি। ভদ্রতা-বশে বা যে-কোনও কারণেই হোক ওটা নিয়ে ঘরে ঢোকেননি।

জিগ্যেস করলুম,–ওঁর সেই মাসতুতো দাদা বিনোদ পাগলার ভূত কি প্রতি রাতে উৎপাত করছে?

কর্নেল কিন্তু হাসলেন না। গম্ভীর মুখে বললেন,–প্রতি রাতে নয়, কিন্তু উৎপাত করছে তা বলা যায়। ওঁদের একতলা বাড়ির ছাদে ধুপ-ধাপ করে শব্দ হয়। আবার কখনও উঠোনে অনেকগুলো ঢিল পড়ে। টিলগুলো–এটাই আশ্চর্য, দেখতে পাহাড়ি নদীতে পড়ে থাকা নুড়ির মতো।

বলে কর্নেল তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে গোটা চারেক নুড়ি বের করলেন। সেগুলো একেবারে নিটোল, কতকটা ডিমের মতো।

হালদারমশাই উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে বললেন,–মাসতুতো দাদারে দাহ করছিল ওগো শ্মশানে। গঙ্গার ধারে শ্মশান, আর তার ভূত পাহাড় অঞ্চলে যাইয়া এগুলান কুড়াইয়া আনসিল ক্যান? কর্নেলস্যার আপনি আমারে যেন সাথে লইবেন।

কর্নেল ঈষৎ কৌতুকে বললেন,–আমার মতো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবেন আপনি? আপনি তো প্রফেশনাল প্রাইভেট ডিটেকটিভ।

হালদারমশাই বললেন,–তাড়াই কর্নেলস্যার। হাতে কোনও ক্যাস নাই। তাই মনটা ভালো নাই। চৌত্রিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করসি। রিটায়ার কইর‍্যা যা পাইসি তাই যথেষ্ট। এদিকে পেনশেনও পাইত্যাসি আপনার মতন।

কর্নেল চুরুটে শেষ টান দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, তাহলে আপনাকে যাওয়ার সময় ডেকে নেব।

ষষ্ঠি আর এক দফা কফি নিয়ে এল। আমি আপত্তি করছিলুম, কিন্তু কর্নেল বললেন,–জয়ন্ত, কেসটা তো শুনলে। পাঁচবছর আগে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া মানুষ একেবারে জলজ্যান্ত দেহে ফিরে এসেছে, এবং যারা তার সৎকার করেছিল, তাদের ওপর উৎপাত চালাচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে হলে নার্ভ আরও চাঙ্গা করা দরকার।

কফির পেয়ালা তুলে নিয়ে বললুম,–আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে ওখানে শচীনবাবুদের কোনও শত্রুপক্ষ কোনও কারণে তাদের পেছনে লেগেছে। ওসব ভূতপ্রেতের গল্প বোগাস।

হালদারমশাই সায় দিয়ে বললেন,–হ! ঠিক কইসেন জয়ন্তবাবু। ওনাদের শত্রুপক্ষই উৎপাত করত্যাসে।

কর্নেল বললেন,–শচীন চাটুজ্যে আমাকে বেশ বড় গলায় বলেছেন, ওঁদের কোনও শত্রু নেই। শচীনবাবু স্কুল-টিচার ছিলেন। এখন রিটায়ার করেছেন। ওঁর বাবা অহীনবাবু রুণ, শয্যাশায়ী। তিনিও শিক্ষকতা করতেন। ওঁদের কাকা মহীনবাবু সংসারের কোনও সাতে-পাঁচে থাকেননি। তা ছা, ওঁদের বিষয় সম্পত্তিও কিছু নেই। শুধু ওই ভিটে আর তার সংলগ্ন একটা ঠাকুরবাড়ি।

কর্নেল আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিয়ে বললেন,–কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।…চণ্ডীপ্রসাদবাবু? কী ব্যাপার? এইমাত্র আপনার চিঠি নিয়ে এসেছিলেন শচীন চাটুজ্যে। তিনি চলে গেছেন। আমি তাকে কথা দিয়েছি, কারণ আপনার সঙ্গে এই সুযোগে আবার দেখা হবে…আঁ? বলেন কী? কখন?…ও মাই গড! ব্যাপারটা তাহলে দেখছি ছেলেখেলা নয়!…ঠিক আছে। আমরা মানে আমি আর আমার তরুণ সাংবাদিক-বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী–যার কথা আপনাকে একবার বলেছিলুম। আর একজন রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার, যিনি এখন পেশাদার প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তিনজনেই সন্ধ্যার ট্রেনে রওনা হব। সম্ভব হলে আপনি..বাঃ! ঠিক আছে।…আচ্ছা, রাখছি।

কর্নেল রিসিভার রেখে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে মাথার প্রশস্ত টাকে একবার হাত বুলিয়ে নিলেন।

লক্ষ করলুম গোয়েন্দাপ্রবরের হাতে কফির পেয়ালা। এবং তিনি গুলিগুলি চোখে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। অভ্যাসমতো দুই চোয়াল তিরতির করে কাঁপছে।

আমি জিগ্যেস করলুম,–কর্নেল, কালিকাপুরে নিশ্চয়ই কোনও অঘটন ঘটেছে-প্লিজ, কথাটা খুলে বলুন।

কর্নেল এবার সোজা হয়ে বসে কফির পেয়ালা তুলে নিয়ে চুমুক দিলেন। তারপর মৃদু স্বরে বললেন,–একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। শচীনবাবুদের ঠাকুরবাড়ির সামনে অনেকটা জায়গায় রক্ত পড়ে আছে। ওখানে একটা হাড়িকাঠ আছে। চৈত্র সংক্রান্তিতে শিবমন্দিরের সামনে পাঁঠা বলি দেওয়া হয়।

জিগ্যেস করলুম,–কিন্তু কাকে বলি দেওয়া হয়েছে?

শচীনবাবু ভোর ছ’টায় স্টেশনে গিয়েছিলেন। তাঁর বিধবা পিসি কাজের মেয়ে মানদাকে নিয়ে পুকুরঘাটে যাচ্ছিলেন। মন্দিরের সামনেই একটা পুকুর। খিড়কির দরজা দিয়ে বেরুনোমাত্র হাড়িকাঠের পাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে চবচবে রক্ত দেখা যায়। মানদা চেঁচামেচি জুড়ে দেয়, পড়শিরা দৌড়ে আসে। কিন্তু কাকে বলি দেওয়া হয়েছে, তার লাশ পাওয়া যায়নি। পরে সবার খেয়াল হয় শচীনবাবুর কাকা মহীনবাবুর কোনও পাত্তা নেই।

হালদারমশাই বলে উঠলেন,–ওনার সন্ন্যাসী হওয়ার ইচ্ছা ছিল, শচীনবাবু কইত্যাসিলেন।

কর্নেল বললেন,–এতে স্বভাবতই লোকের সন্দেহ হয়েছে মহীনবাবুকেই কেউ বা কারা কোনও কারণে বলি দিয়ে তার লাশ গুম করে ফেলেছে। পুলিশ এসে তদন্ত করার পর চলে গেছে। জেলে নৌকাগুলোকে নাকি পুলিশ বলেছে গঙ্গায় কোনও লাশ দেখতে পেলে তার যেন পুলিশকে খবর দেয়।

বললুম,–শচীনবাবুর কাকা মহীনবাবুকেই যে বলি দেওয়া হয়েছে, তা প্রমাণ করার জন্য আজ সারাদিন অপেক্ষা করা যেতে পারে। এমন হতেই পারে, তিনি সাধু-সন্ন্যাসী টাইপের মানুষ, বাড়িতে না বলে কোথাও গঙ্গার ধারে কোনও সন্ন্যাসীকে দেখে তার কাছে বসে আছেন।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন,–মহীনবাবু ঘরের বারান্দায় একটা খাঁটিয়ায় শুয়ে থাকতেন। চণ্ডীপ্রসাদবাবু বললেন, ওটা ওঁর কৃচ্ছ্বসাধনের চেষ্টা। মশারি নিতেন না। একটা হালকা তুলোর কম্বল জোর করে তাকে দেওয়া হত। কিন্তু আজ তার খাঁটিয়ার বিছানা এলোমলো হয়ে পড়েছিল। তুলোর কম্বলটা পড়েছিল বারান্দার নীচে। শচীনবাবু ট্রেন ধরবার জন্য তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যান। তাই ওটা লক্ষ করেননি। এদিকে তার পিসি সেটা লক্ষ করলেও ভেবেছিলেন, মহীনবাবু রাগ করে তুলোর কম্বল ফেলে দিয়েছে। মাঝে-মাঝে তিনি এই শীতেও ঠান্ডা মেঝেয় শুয়ে থাকতেন।

হালদারমশাই বললেন,–হেভি মিস্ত্রি।

কর্নেল চুপচাপ চা খাওয়ার পর চুরুট-কেস থেকে একটা চুরুট বের করে লাইটার দিয়ে ধরালেন, তারপর ধ্যানস্থ হলেন।

এই সময় আবার টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল দ্রুত সোজা হয়ে বসে হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে নিয়ে সাড়া দিলেন।-বলুন চণ্ডীবাবু…পুকুরপাড়ে রক্ত পাওয়া গেছে? আপনি পুলিশকে চাপ দিলে পুলিশ কলকাতার ডগ স্কোয়াড থেকে শিক্ষিত কুকুর নিয়ে যেতে পারে। ওখানে যে স্যান্ডেলটা পাওয়া গেছে, তা যখন মহীনবাবুর না, তখন খুনেদেরই হতে পারে…ঠিক আছে, আপনি বলুন। যদি পুলিশ ইতস্তত করলে আমাকে জানাবেন। আমি লালবাজারে আমার জানা অফিসারদের সাহায্যে একটা ব্যবস্থা করতে পারব।…আমরা রাতের ট্রেনে যাচ্ছি।

.

দুই

কোনও অভিযানে বেরুনোর আগে লক্ষ করেছি কর্নেল কতকগুলো কাজ করেন। যেখানে যাচ্ছেন সেখানকার পুলিশ কর্তাদের জানিয়ে যান। এটা স্বাভাবিক, কারণ খুনি হোক বা অপরাধী হোক, রহস্যের পরদা তুলে তিনি তাকে দেখিয়ে দিতে পারেন। তাই বলে তাকে গ্রেফতারের ক্ষমতা তো তার নেই। তাই পুলিশ ছাড়া তার চলে না। এদিকে আর-একটা সমস্যা, তার নিজের চেহারা এবং বয়স নিয়ে। রহস্যের পেছনে ছোটা মানে গোয়েন্দাগিরি করা। কর্নেল অঙ্ক কষে রহস্য আঁচ করতে পারেন বটে, কিন্তু সব তথ্য জোগাড় করতে একজন চালাক-চতুর অভিজ্ঞ লোক দরকার। সেই জন্যই অনেক সময়ই তিনি প্রাক্তন পুলিশ ইন্সপেক্টর এবং বর্তমানে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কৃতান্তকুমার হালদার অর্থাৎ হালদারমশাইকে সঙ্গে নেন। আর আমি তো নেহাত সাংবাদিক! কর্নেলের কীর্তিকলাপ রোমাঞ্চকর করে লিখি বটে, কিন্তু কোনও রহস্যময় ঘটনার সূত্র খুঁজে বের করা আমার সাধ্য নয়।

আরও একটা কথা বলে রাখা দরকার, এ-ধরনের অভিযানে বেরুতে হয় বলে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে আমার জন্য একটা ঘর বরাদ্দ আছে। সেখানে পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে দাড়ি কাটার ব্লেড, টুথব্রাশ আর পেস্ট সবই থাকে। কাজেই আমার আর সল্টলেকের ফ্ল্যাটে ফেরা হল না। কর্নেল নীচের তলায় আমার গাড়ি রাখার জন্য একটা গ্যারেজও খালি রেখেছেন। একসময় সেখানে তার একটা ল্যান্ড রোভার গাড়ি ছিল। পুরোনো গাড়ির ঝামেলা অনেক, তাই সেটা লোহা-লক্কড়ের দামে বেচে দিয়েছিলেন।

দুপুরে খাওয়ার পর আমার ভাত-ঘুমের অভ্যাস আছে। ড্রইংরুমের একটা ডিভানে যথারীতি শুয়ে পড়েছিলুম! কর্নেল তার অভ্যাসমত ইজিচেয়ারে বসে চুরুট টানছিলেন। তারপর একবার কানে গিয়েছিল টেলিফোনে চাপাস্বরে কার সঙ্গে কথা বলছেন।

আমার ভাত-ঘুম ভেঙে ছিল ষষ্ঠিচরণের ডাকে। তার হাতে চায়ের কাপ-প্লেট! দেখলুম কখন আমার গায়ের ওপর কেউ একটা হালকা কম্বল চাপিয়ে দিয়ে গেছে। তার মানে আমার ঘুমটা যাতে ভালো হয়, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উঠে বসে ষষ্ঠির হাত থেকে চা নিয়ে বললুম,–আমার গায়ে এই মড়ার কম্বল চাপাল কে?

ষষ্ঠি খি-খি করে হেসে উঠল। বলল,–বাবামশাই আড়াইটেতে বেরিয়ে গেছেন। যাওয়ার সময় উনিই কম্বলটা আপনার গায়ে চাপিয়ে দিয়ে গেছেন। আর-একটা কাজ করেছেন।

চায়ে চুমুক দিয়ে বললুম,–তুমি না-বললেও বুঝেছি। আমার প্যান্টের পকেট থেকে গাড়ির চাবি চুরি করে কোথাও উধাও হয়েছেন।

ষষ্ঠি আরও হেসে বলল,–বাবামশাই বলে গেছেন, ঠিক চারটেয় তোর দাদাবাবুকে চা দিবি। আমি তো জানি, আপনি সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে বাসিমুখে চা খান। আবার দুপুরে ঘুমুলেও বিছানায় বসে আপনার চা খাওয়ার অভ্যেস আছে।

কথাটা বলে ষষ্ঠিচরণ হন্তদন্ত চলে গেল। বুঝতে পারলুম সে ছাদের বাগানে কাক তাড়াতে যাচ্ছে। কারণ এই শীতের বিকেলে পাশের বাড়ির একটা নিমগাছে কাকেরা ঝগড়া করে। আবার ঝগড়া করতে-করতে ঝাঁক বেঁধে এসে কর্নেলের সাধের বাগানে হামলা করে। সেখানে বিচিত্র প্রজাতির অর্কিড, ক্যাকটাস আর কিম্ভুতকিমাকার সব বনসাই আছে। ষষ্ঠি হালদারমশাইয়ের পরামর্শে একটা কাকতাড়ুয়া তৈরি করেও কাকের উৎপাত থামাতে পারেননি। এ-হল গিয়ে কলকাতার কাক, কাজেই ষষ্ঠির এখন কাকের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময়।

চা খাওয়ার পর আমি নিজেই কিচেনে গিয়ে চায়ের কাপ-প্লেট রেখে এলুম। তারপর ভাবলুম ছাদের বাগানে ষষ্টির যুদ্ধ দেখতে যাব, কিন্তু সেই সময় ডোরবেল বেজে উঠল। কিচেনের পেছন দিয়ে গিয়ে একটা করিডর দিয়ে হেঁটে সদর দরজায় গেলুম। আইহোল-এ চোখ রেখে দেখলুম, হালদারমশাই এসে গেছেন।

এই দরজায় যে ল্যাচ-কি সিসটেম আছে, তাতে ভেতর থেকে দরজা খোলা যায়, কিন্তু বাইরে থেকে দরজা খুলতে হলে চাবি চাই। আমি দরজা খুলে দিলে হালদারমশাই সহাস্যে বললেন, ষষ্ঠি গেলে কই?

বললুম,–ষষ্ঠি এখন ছাদের বাগানে কাকের সঙ্গে যুদ্ধ করছে।

এই দরজা দিয়ে ঢুকলে ডানদিকে ডাক্তারবাবুদের যেমন রোগিদের জন্য ছোট্ট ওয়েটিংরুম থাকে, তেমনি ছোট্ট একটা ঘর আছে। এই ঘর দিয়ে এগিয়ে গেল ড্রইংরুম।

আমার সঙ্গে ড্রয়িংরুমে ঢুকে হালদারমশাই বললেন,–কর্নেলস্যার গেলেন কই? তিনিও কি কাকের লগে ফাইট করতে গেছেন?

বললুম,–না, আমি যখন ভাত-ঘুম দিচ্ছিলুম তখন উনি আমার গাড়ি চুরি করে নিপাত্তা হয়ে গেছেন।

গোয়েন্দাপ্রবর খিলখিল করে হেসে সোফায় বসলেন। দেখলুম তিনি একেবারে সেজেগুজেই এসেছেন। গায়ে অবশ্য হাতকাটা সোয়েটার, কিন্তু হাতে ভাঁজ করা একটা জ্যাকেটও আছে। আর আছে তার কাঁধে ঝোলানো একটা পুষ্ট পলিব্যাগ।

বললুম,–কর্নেল বলছিলেন ট্রেন ছাড়বে সন্ধ্যা সাড়ে-ছ’টায়। তবে ডিসেম্বরে সাড়ে-ছটা মানে রাত বলাই ভালো।

হালদারমশাই সায় দিয়ে বললেন,–হ! তাই দেরি করলাম না।

বলে তিনি কণ্ঠস্বর চেপে জিগ্যেস করলেন–আচ্ছা জয়ন্তবাবু, আপনার কি মনে হয় কালিকাপুরের চাটুজ্যে বাড়িতে এমন কোনও দামি জিনিস আছে, যেটা হাতানোর জন্য অগো কেউ ভয় দ্যাখাইতাসে!

বললুম,–সেটা আপনি সেখানে গিয়ে গোয়েন্দাগিরি করে জেনে নেবেন।

বলে আমি সুইচ টিপে ঘরের আলো জ্বেলে দিলুম। কারণ, শীত না পড়লেও অন্ধকার নামতে দেরি করেনি। ওদিকে ততক্ষণে ষষ্ঠিচরণও ছাদ থেকে নেমে এসেছে।

হালদারমশাই বললেন,–কর্নেলস্যার আইলে তখন কফি খামু কি কন?

আমি সায় দেওয়ার আগেই ড্রইংরুম-সংলগ্ন সেই ছোট্ট ওয়েটিং রুমে কর্নেলের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলুম,–আমি এসে পড়েছি হালদারমশাই। আর ষষ্ঠিটাও আমাকে করিডরের ওদিক থেকে উঁকি মেরে দেখে ফেলেছে। আমি ভেবেছিলুম চুপিচুপি ঘরে ঢুকে ষষ্ঠিকে চমকে দেব। কিন্তু সে সম্ভবত ছাদের বাগান থেকেই জয়ন্তের গাড়িটা দেখতে পেয়েছিল।

গোয়েন্দাপ্রবর ফিক করে হেসে বললেন,–জয়ন্তবাবু কইসিলেন আপনি ওনার গাড়ি চুরি করসেন।

কর্নেল তার বিখ্যাত অট্টহাসি হেসে ইজিচেয়ারে বসলেন। তারপর আমার গাড়ির চাবিটা বের করে টেবিলে রাখলেন।

জিগ্যেস করলুম,–আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এমন জায়গায় গিয়েছিলেন যেখানে আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলে অসুবিধে হত, কাজেই জিগ্যেস করছি না কোথায় এবং কেন গিয়েছিলেন।

কর্নেল বললেন,–না, তোমাকে নিয়ে গেলে অসুবিধে হত না, কিন্তু তোমার সুনিদ্রা ভাঙাতে চাইনি।

ষষ্ঠিচরণ ট্রেতে কফির পট, দুধ, চিনি, চায়ের পেয়ালা আর এক প্লেট চানাচুর রেখে গেল। কর্নেল বললেন,–হিস-হিস, হুস-হুস–সব নিজের নিজের কফি তৈরি করে নাও। হালদারমশাই তো স্পেশাল কফি খান। কাজেই স্বাবলম্বি হওয়াই ভালো। আমরা নিজের-নিজের কফি তৈরি করে নিলুম, হালদারমশাই একটু বেশি দুধ মেশানো কফি অভ্যাস মতো ফুঁ দিয়ে দিয়ে চুমুক দিতে থাকলেন।

আমি বললুম,–আপনি বলছিলেন সাড়ে-ছটায় ট্রেন। এখন পাঁচটা বেজে গেছে। অন্তত এক ঘন্টা আগে বেরুনো উচিত।

কর্নেল আমার কথার কোনও জবাব দিলেন না। তিনি কফি পান করতে করতে বুক পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করলেন। তারপর সেটা এক হাতেই খুলে টেবিলে রাখলেন। তার ওপর পেপারওয়েটের মতো আমার গাড়ির চাবিগুলো চাপা দিলেন। লক্ষ করলুম হালদারমশাই গুলি-গুলি চোখে কাগজটার দিকে তাকিয়ে আছেন। বললুম,–ওই কাগজটা কোথাও আনতে গিয়েছিলেন?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। ওতে কালিকাপুরের চ্যাটার্জি ফ্যামিলির পূর্ব-পুরুষের লুকিয়ে রাখা গুপ্তধনের খবর আছে।

কথাটা শোনামাত্র হালদারমশাই এত জোরে নড়ে বসলেন, যে তার পেয়ালা থেকে খানিকটা কফি ছিটকে তার প্যান্টের ওপর পড়ল। তিনি উত্তেজিতভাবে বললেন,–কী কইলেন? কী কইলেন?

কর্নেল তেমনই গম্ভীর মুখে বললেন,–গুপ্তধনের সন্ধান।

হালদারমশাই আমার দিকে ঘুরে বসে বললেন,–ঠিক এই কথাটাই আমার মাথায় আইজ সারা দিন মাসির মতন ভনভন করত্যাসিল।

আমি হাসি চেপে বললুম,হালদারমশাই, এ-গুপ্তধনটা কর্নেলকে ফাঁকি দিয়ে আপনি আর আমি দুজনে ভাগাভাগি করে নেব–কি বলেন?

কর্নেল কিন্তু হাসলেন না। তেমনই গম্ভীর মুখে বললেন,–তবে গুপ্তধন সব সময়েই যে ধনরত্ন হবে, এমন কিন্তু নয়। একটু খুব পুরোনো, ধরো পাঁচশো বছরের কোনও সাধারণ জিনিসকেও গুপ্তধন বলা যায়।

বললুম,–আপনার ওই কাগজটা কিন্তু মোটেই পুরোনো নয়। একটা ছোট্ট প্যাডের একটা স্লিপ বলেই মনে হচ্ছে।

কর্নেল আমার কথায় কান না দিয়ে কফি শেষ করলেন, তারপর চুরুট ধরিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে তার আতস কাঁচটা বের করলেন। এরপর তিনি টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে আতস কাঁচের সাহায্যে কাগজের লেখাগুলো খুঁটিয়ে দেখার পর বললেন,–হ্যাঁ, এতে গুপ্তধনের সূত্র লেখা আছে বটে।

হালদারমশাই ব্যস্তভাবে বললেন,–কী লেখা আছে কন তো কর্নেলস্যার।

কর্নেল কাগজটা আমার হাতে দিলেন। দেখলুম এটা একটা ছোট্ট প্যাডের স্লিপই বটে। তাতে লেখা আছে :

হালদারমশাই উঁকি মেরে দেখছিলেন। বললেন,–অন্ন, মানে টক। তারপর হং, মং–এগুলিন কী?

কর্নেল বললেন,–যিনি এটা আমাকে দিয়েছেন, তার কাছেই পাঁচশো বছরের বেশি পুরোনো একটা তুলোট কাগজে এগুলো লেখা আছে।

আমি অবাক হয়ে বললুম,–এটা কে আপনাকে দিল, তা বলতে আপত্তি আছে?

কর্নেল বললেন, তুমি দুপুরে যখন স্নান করছিলে, তখন টেলিফোনে এক ভদ্রলোক তার নাম ঠিকানা দিয়ে আমাকে শিগগির যেতে বলেন। আমি যথেষ্ট সতর্ক হয়েই গিয়েছিলুম, তারপর তার পরিচয় পেয়ে বুঝতে পারলুম ইনি কালিকাপুরের চাটুজ্যে পরিবারেরই এক জ্ঞাতি। কালিকাপুরের চণ্ডীপ্রসাদ সিংহ তার বন্ধু এবং ছাত্রজীবনের সহপাঠী ছিলেন। চণ্ডীবাবুই তাকে ফোন করে সেখানে যা ঘটেছে তা জানিয়েছেন। চণ্ডীবাবু আমার পরিচয় এবং ফোন নম্বর তাকে দিয়ে বলেছেন তার কাছে যে অমূল্য প্রাচীন কাগজটা আছে, তা যেন আমাকে তিনি দেন। কিন্তু তার টেলিফোন পেয়ে আমি তার সঙ্গে যখন দেখা করতে গেলুম তখন তিনি সেই কাগজটা থেকে আমাকে দেবনাগরী লিপিতে লেখা ওই শব্দগুলো টুকে নিলেন। আমি অবশ্য মিলিয়ে দেখে নিয়েছি।

জিগ্যেস করলুম,ভদ্রলোক কে, কোথায় থাকেন?

কর্নেল বললেন,–তার নাম শরদিন্দু চ্যাটার্জি। থাকেন ভবানীপুরে। তার বাবা থাকতেন কালিকাপুরে। তারপর কলকাতায় আসেন। শরদিন্দুবাবুর নেশা পাখি শিকার করা। আজকাল এসব শিকার নিষিদ্ধ। তবু শীতকালে কালিকাপুরের ওদিকে একটা বিশাল বিলে অনেক দেশি-বিদেশি জলচর পাখি আসে। শরদিন্দুবাবু অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। গোপনে বুনো হাঁস শিকার করতে যান। তবে জ্ঞাতিদের বাড়িতে ওঠেন না। তার আশ্রয় চণ্ডীবাবু। হাঁস শিকার করতে পারলে সেদিনই তিনি তার ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। তার যাওয়ার কথা ছিল আজ। কিন্তু একটা কাজে আটকে পড়েছেন। তিনি পেশায় একজন আইনজীবী। তাই কোর্টের ছুটি না থাকলে তার কালিকাপুর যাওয়া হয় না।

বললুম,–তাহলে তিনি সেখানে যাচ্ছেন না?

কর্নেল বললেন,–আর কয়েকদিন পরেই তো বড়দিন–পঁচিশে ডিসেম্বর, কাজেই তার আগের দিন তিনি সন্ধ্যার ট্রেনে যাবেন।

হালদারমশাই টান হয়ে শুয়েছিলেন। বললেন,–এই ভদ্রলোকেরে আমার সন্দেহ হইতাসে। আইনজীবী হইয়াও তিনি আইন ভঙ্গ করেন।

কর্নেল এতক্ষণে একটু হাসলেন। বললেন, আপনি কি তিনটে দিন অপেক্ষা করে শরদিন্দুবাবুর গতিবিধির দিকে লক্ষ রাখবেন? তারপর না হয় ওঁকে ফলো করেই কালিকাপুরে যাবেন।

হালদারমশাই কঁচুমাচু হেসে বললেন,–নাঃ, যখন বারাইয়া পরসি তখন আর কোনও কথা না। তেমন বুসলে আমি কালিকাপুরে থাইক্যা যামু।

এইসব কথাবার্তা হতে-হতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। তারপর কর্নেল কাগজটা নিজের পকেটে ভরে বললেন,–জয়ন্ত এই তোমার গাড়ির চাবি আমি আলমারির লকারে রেখে যাব। যাও তুমি রেডি হয়ে নাও। এই সময়টা রাস্তায় বড্ড জ্যাম হয়। হাতে সময় রেখে বেরুনোই ভালো। তা ছাড়া লোকাল ট্রেন। আমার টিকিট কাটার দরকার হয় না। কিন্তু তোমাদের দুজনের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করতে হবে।

হালদারমশাই আড়মোড়া দিয়ে সোফায় হেলান দিলেন। কর্নেল তার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। আর আমি ঢুকলুম আমার জন্য সংরক্ষিত ঘরে। শীতকাল বলে আমার ঘরে বাড়তি জ্যাকেট সোয়েটার, কান-ঢাকা-টুপি–সবই রাখা ছিল। তবে আমার পয়েন্ট বাইশ ক্যালিবারের সিক্স রাউন্ডার রিভলভারটা ছিল আমার হ্যান্ড ব্যাগে। ওটা সবসময়েই কর্নেলের উপদেশে আমি সঙ্গে রাখি। একটা বাড়তি ব্যাগে দরকারি জিনিসপত্র পোশাক-আশাক ভরে নিয়ে আমি ড্রইংরুমে এলুম। তারপর এলেন কর্নেল। আর কর্নেলের গলায় দেখলুম যথারীতি বাইনোকুলার আর ক্যামেরা ঝুলছে। তার পিঠে আঁটা কিটব্যাগ, আর হাতে একটা পুষ্ট মোটাসোটা ব্যাগ।

বেরুতে যাচ্ছি টেলিফোনটা বাজল। বিরক্ত হয়ে কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। তারপর কাকে কৌতুক করে বললেন,–হা বলি হতেই তো যাচ্ছি দাদা!

হালদারমশাই চমকে উঠে বললেন,–কেডা কী কইল?

কর্নেল বললেন,–ও কিছু না, চলুন।

.

তিন

সে-রাতে কালিকাপুর স্টেশনে যখন ট্রেন পৌঁছেছিল, তখন টের পেয়েছিলুম শীত কাকে বলে! প্রচণ্ড কনকনে শীতের রাতটা সত্যিই একটা অ্যাডভেঞ্চারের পরিবেশ তৈরি করেছিল। কারণ, কর্নেলের বাড়ি থেকে বেরুনোর সময় কেউ হুমকি দিয়েছিল। কাজেই আমি চারদিকে সতর্ক চোখে লক্ষ করছিলুম। কর্নেল অবশ্য নির্বিকার। হালদারমশাই লোকের ভিড় ঠেলে যেতে-যেতে একবার বলেছিলেন,–কী কাণ্ড! কলকাতায় ফ্যান চলত্যাসে, আর এখানেও ফ্যান চলত্যাসে।

এই ধাঁধার জবাব পেলুম একটু ফাঁকায় গিয়ে। নীচের চত্বরে সাইকেলরিকশা, এক্কাগাড়ি, আর বাস-এইসব যানবাহনের ভিড়। হালদারমশাইকে জিগ্যেস করেছিলুম,–কলকাতা আর এখানে ফ্যান চলছে বলছিলেন–ব্যাপারটা কী?

হালদারমশাই হাসবার চেষ্টা করে বললেন,–বুজলেন না, ওখানে চলত্যাসে ইলেকট্রিক ফ্যান আর এখানে চলত্যাসে নেচারের ফ্যান।

এতক্ষণে লক্ষ করেছিলুম কথা বলতে গেলেই মুখ দিয়ে বাচ্চা বেরুচ্ছে। কর্নেল এদিক-ওদিক ঘুরে চণ্ডীবাবুর পাঠানো গাড়ি খুঁজছিলেন। একটু পরেই যাত্রীদের নিয়ে সব যানবাহন চলে গেল, কিন্তু কোনও প্রাইভেট গাড়ি চোখে পড়ল না।

কর্নেল বললেন,–আবার কোনও গণ্ডগোল হয়ান তো? চণ্ডীবাবুর গাড়ি দেখছি না কেন?

হালদারমশাই বললেন,–কর্নেলস্যার, এই শীতে মাটির ভাঁড়ে চা খাইয়া লই। গাড়ি ঠিক আইয়্যা পড়বে।

হালদারমশাই চায়ের দোকানের দিকে পা বাড়িয়েছেন, এমন সময় হর্ন দিতে-দিতে একটা মেরুন রঙের প্রাইভেট গাড়ি এসে আমাদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে গেল। তারপর ড্রাইভার নেমে কর্নেলকে সেলাম ঠুকে বলল,–পথে একটু দেরি হয়ে গেছে স্যার। বেশি ঠান্ডায় গাড়ির ইঞ্জিন ঠিক মতো কাজ করছিল না। এখন ঠিক হয়ে গেছে, আপনারা উঠে পড়ুন।

কর্নেল সামনের সিটে এবং আমরা দুজনে পেছনের সিটে বসলুম। তারপর ড্রাইভার গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে স্পিড বাড়াল। জানলার কাঁচ তোলাই ছিল, তবু কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় জবুথবু হয়ে বসে থাকলুম। রাস্তাটা তত ভালো নয়, তাই ঝাঁকুনির চোটে অস্থির হচ্ছিলুম। দু-ধারে সারবদ্ধ গাছপালা হেডলাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছিল। কর্নেল ড্রাইভারের সঙ্গে চাপা গলায় কথা বলছিলেন, কিন্তু সেদিকে আমার কান ছিল না। কেন যে আমি পুরু জ্যাকেটটা পরে আসিনি! তার বদলে এই হালটা জ্যাকেট আর ভেতরে একটা পাতলা সোয়েটার এখানকার শীতের পক্ষে যথেষ্ট নয়। মিনিট পনেরো পরে লক্ষ করলুম, সামনে গাছপালার ফাঁকে গাঢ় কুয়াশার ভেতরে জোনাকির মতো আলো দেখা যাচ্ছে। জনপদের ভেতর ঢুকে শীতের কামড়টা একটু কমে এল। এটা বাজার এলাকা। এত রাত্রে জনমানবহীন হয়ে আছে। তারপর বাঁক নিয়ে ক্রমাগত এদিক-ওদিক ঘুরতে-ঘুরতে যেখানে পৌঁছুলুম সেদিকটায় রাস্তার আলো নেই। কিন্তু একটা বাড়ির গেটে আলো জ্বলছিল। দারোয়ান গেট খুলে দিল। তারপর লন দিয়ে এগিয়ে গাড়ি পোর্টিকোর তলায় থামল। আমরা নিজের-নিজের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে গাড়ি থেকে নামলুম।

ততক্ষণে কর্নেলও নেমেছেন। দেখলুম সিঁড়ির মাথায় এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। গায়ে সোয়েটার এবং পরনে প্যান্ট। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, প্রায় কর্নেলের বয়সি। এই ভদ্রলোকের মুখে অবশ্য দাড়ি নেই, তবে দেখার মতো গোঁফ আছে। মাথার চুলও সাদা। তিনি কয়েক ধাপ নেমে এসে কর্নেলের সঙ্গে হ্যান্ডসেক করলেন। তারপর বললেন, আমি ভাবছিলুম ট্রেন লেট করেছে।

ড্রাইভার গাড়ির ভেতর থেকে বলে উঠল,–না স্যার, পথে ইঞ্জিন গোলমাল করছিল। কালকে একবার গ্যারেজে দেখিয়ে আনতে হবে।

ভদ্রলোক আমাদের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করে বললেন,–আসুন।

ভেতরে একটা প্রশস্ত ঘর। সেকেলে আসবাবপত্র। এ-ধরনের বনেদি ধনী পরিবারের বাড়ি কর্নেলের সঙ্গগুণে আমার দেখা আছে। তাকে অনুসরণ করে আমরা দরজা দিয়ে করিডরে ঢুকলুম। এতক্ষণে চোখে পড়ল একটা গাঁটগোঁট্টা চেহারার লোক করিডরের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারা প্রচণ্ড কালো। সে দু-হাত জোড় করে সামনের দিকে ঝুঁকে বলল,–কর্নেলসাহেবকে দেখে খুব আনন্দ হচ্ছে। আপনি আসবেন শোনার পর থেকেই আমি শুধু অপেক্ষা করছিলুম। কর্তামশাই আমাকে নন্দ-ড্রাইভারের সঙ্গে স্টেশনে যেতে দিলেন না।

চণ্ডীবাবু কপট ধমক দিয়ে বললেন,–এই কেতো, যাত্রাদলের পার্ট করবি, না সাহেবদের ঘরে নিয়ে যাবি?

সে পাশের একটা ঘরের পরদা সরিয়ে বলল,–সবকিছু রেডি কর্তামশাই। সাহেবরা বসুন, আমি ঠাকুরমশাইকে দেখি।

চণ্ডীবাবু বললেন,–এক মিনিট। কর্নেলসাহেব এত রাতে কি আর কফি খাবেন?

কর্নেল বললেন,–খাব। তবে ডিনারের পরে। কার্তিক, তুমি ঠাকুরমশাইকে কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে।

মোটামুটি প্রশস্ত একটা সাজানো-গোছানো ঘরে আমরা ঢুকেছিলুম। দু-ধারে দুটো খাট। একপাশে সোফা। চণ্ডীবাবু কোণের একটা চওড়া টেবিল দেখিয়ে বললেন,–ব্যাগগুলো ওখানে রেখে কর্নেলসাহেব আরাম করে বসুন। আপনার ইজিচেয়ারটা কিন্তু আমি ওপর থেকে আনিয়ে রেখেছি।

কর্নেল তার পিঠে-আঁটা কিটব্যাগটা খুলে টেবিলে রাখলেন। তারপর ক্যামেরা এবং বাইনোকুলারটা একপাশে রেখে দিলেন। তিনি ইজিচেয়ারে বসে মাথার টুপিটা খুলে দেওয়ালের একটা ব্র্যাকেটে আটকে দিলেন। তারপর ইজিচেয়ারে বসে চওড়া টাকে হাত বুলোতে থাকলেন।

ততক্ষণে আমরা সোফায় বসেছি। ঘরের ভেতরটা বেশ আরামদায়ক।

চণ্ডীবাবু বললেন,–একটা রুম হিটার আছে, জ্বেলে দেব নাকি?

কর্নেল বললেন, না মিস্টার রায়চৌধুরী। আমার সঙ্গীদের একটু শীতের আরাম পাওয়া দরকার। কলকাতায় এখনও ফ্যান চালাতে হচ্ছে।

চণ্ডীবাবু সোফার একপাশে বসে বললেন,–উনি আপনার তরুণ সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী, তা বোঝা যাচ্ছে। আর ইনিই সেই প্রাক্তন পুলিশ অফিসার এবং প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিস্টার কে কে হালদার। কি? আমি ভুল করিনি তো?

হালদারমশাই সহাস্যে বললেন,–নাঃ, আপনি ঠিক ধরসেন। তবে একসময় আমি পুলিশ লাইফে অনেক গ্রামে ঘুরসি, কিন্তু আপনাগো এখানে শীত ক্যান?

চণ্ডীবাবু বললেন, শীত বদলায়নি। আসলে বদলে গেছেন আপনি। কলকাতায় থাকলে মানুষের অনেক অদলবদল ঘটে যায়।

কর্নেল বললেন,–আচ্ছা মিস্টার রায়চৌধুরী, চাটুজ্যে বাড়ির কেস সম্পর্কে পুলিশ কতদূর এগিয়েছে? আপনি নিশ্চয়ই জানেন।

চণ্ডীবাবু বললেন,–লালবাজার থেকে আপনার সুপারিশে পুলিশ একটা কুকুর এনেছিল। সান্ডেলটা শুকিয়ে কুকুরটাকে শুনেছি কাজে লাগানো হয়েছিল। কিন্তু কুকুরটা পুকুরের পাড় দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা গলি রাস্তায় গিয়েছিল। তারপর আর সে কোনওদিকে এগোয়নি। বিশ্বস্ত সূত্রে শুনেছি ওই গলির পাশে একটা নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। ম্যাটাডোরে বোঝাই করে বাড়ির মালমশলা নিয়ে আসা হচ্ছে। তাই পুলিশের সন্দেহ খুনিরা খুনি ওই ম্যাটাডোরে চেপে পালিয়ে গেছে।

হালদারমশাই বলে উঠলেন, পুলিশ ম্যাটাডোরের ড্রাইভার বা যার বাড়ি হইতাসে তাগো জেরা করে নাই?

চণ্ডীবাবু একটু হেসে বললেন,–জেরা করেছে, কিন্তু কোনও সূত্রই বেরিয়ে আসেনি। অবশ্য এমন হতেই পারে প্রাণের ভয়ে ড্রাইভার মুখ খুলতে চায়নি।’

কথাটা বলে তিনি ঘড়ি দেখলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনারা বাথরুমে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। গরম জলের ব্যবস্থা আছে। আমি দেখি, খাওয়ার ব্যবস্থা কতটা হল।

তিনি বেরুবার আগেই কার্তিক এসে গেল। সে বলল,–সব রেডি স্যার। আপনারা এখনই আসুন। যা শীত পড়েছে খাবার গরম থাকছে না।

নীচের তলায় ডাইনিংরুমে খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা গেস্টরুমে ফিরে এলুম। তারপর কার্তিক এসে বলল,–একজনের শোওয়ার ব্যবস্থা পাশের ঘরেই হয়েছে। এই ঘর থেকে যাওয়া যায়। ওই দেখুন দরজা।

হালদারমশাই টেবিল থেকে তার ব্যাগ তুলে নিয়ে একটু হেসে বললেন,–আমি ওই ঘরে যাই।

কর্নেল বললেন,–যান, কিন্তু সাবধান। এ-বাড়িতেও ভূতের উৎপাত আছে। বাইরের দিকে কেউ কড়া নাড়লে যেন দরজা খুলে বেরুবেন না।

কার্তিক হালদারমশাইকে আমাদের ঘরের মাঝের দরজা দিয়ে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। সে হালদারমশাইকে সব দেখিয়ে এবং বুঝিয়ে দিয়ে আমাদের ঘরের ভেতর দিয়ে চলে গেল।

চণ্ডীবাবু পাইপ টানছিলেন। আর কর্নেল অভ্যাসমত কফি পান করছিলেন। আমি পুরু কম্বলের তলায় ঢুকে পড়েছিলুম। দুজনে চাপা গলায় কথা বলছিলেন, কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলুম না। তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছি।

সেই ঘুম ভেঙেছিল কার্তিকের ডাকে। তার হাতে চায়ের কাপ-প্লেট দেখেই বুঝতে পেরেছিলুম কর্নেলের নির্দেশ সে পালন করছে। সে আমার হাতে চায়ের কাপ-প্লেট তুলে দিয়েই বলল,–আমার কর্তামশাইয়ের সঙ্গে কর্নেলসাহেব আর হালদারসাহেব তোরবেলা বেরিয়ে গেছেন। কিছু দরকার হলে আমি আছি। ওই বেলটা টিপবেন, তাহলেই আমি এসে যাব।

ঘড়িতে দেখলুম সাড়ে সাতটা বাজে। উলটোদিকের জানলা খোলা। পরদার ফাঁকে ম্লান রোদের আভা। কার্তিক বেরিয়ে গিয়েছিল। আমি বেড-টি খাওয়ার পর উলটোদিকের দরজা খুলে দেখলুম, এদিকে টানা বারান্দা। আর নীচে রং-বেরঙের ফুলের গাছ। তখনও রোদের সঙ্গে কুয়াশা মিশে আছে। বাউন্ডারি ওয়ালের উঁচু পাঁচিল দেখা যাচ্ছিল। পাঁচিলের ধারে সারবদ্ধ গাছ। কিন্তু ঠান্ডায় বেশিক্ষণ দাঁড়ানো গেল না।

কর্নেলরা যখন ফিরে এলেন, তখন প্রায় ন’টা বাজে। অভ্যাসমতো কর্নেল বললেন,–মর্নিং জয়ন্ত। আশাকরি কোনও অসুবিধে হয়নি?

বললুম,–না। আপনাদের সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। আপনারা কি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন?

হালদারমশাই এসেই নিজের ঘরে ঢুকেছিলেন। কর্নেল কিছু বলার আগে তিনি দ্রুত ফিরে এসে ধপাস করে সোফায় বসে বললেন,–আরে কী কাণ্ড!

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে টুপি, বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা গলা থেকে খুলে পাশের টেবিলে রাখলেন। তারপর বললেন,–হা কাণ্ডই বটে। তবে একটা কথা আপনাকে বলা দরকার হালদারমশাই। অমন করে যেখানে-সেখানে ফায়ার আর্মস বের করবেন না।

গোয়েন্দাপ্রবর কঁচুমাচু হেসে বললেন,–হ! উচিত হয় নাই। আসলে আমাগো ভূতের ভয় দেখাইতে চায়–এত সাহস!

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–হ্যাঁ। আপনি একসময় পুলিশ অফিসার ছিলেন, আপনার রাগ হওয়ারই কথা। তবে ভাগ্যিস টিলগুলো সেইরকম নুড়িপাথর নয়! তাহলে আমাদের চোট লাগত।

জিগ্যেস করলুম,–ব্যাপারটা কী?

কর্নেল বললেন,–গঙ্গার ধারে বাঁধের পথে আমরা যাচ্ছিলুম। হঠাৎ গাছপালার আড়াল থেকে ঢিল এসে পড়তে শুরু করল। তবে মাটির ঢিল। গঙ্গার ধারের মাটি খুব নরম, তাই ঢিলগুলো

ভেঙে যাচ্ছিল। চণ্ডীবাবু ছিলেন আগে। তিনি থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। আর হালদারমশাই রিভলভার বের করে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন।

বলে কর্নেল তার অনুকরণ করে শোনালেন,–কোন হালা রে! দিমু মাথার খুলি ঝাঁঝরা কইর‍্যা। শুধু তাই নয়, তিনি বাঁধ থেকে নেমে ঝোঁপজঙ্গল ভেদ করে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাঁকে চণ্ডীবাবুই পেছন থেকে টেনে ধরেছিলেন। আর জায়গাটা কোথায় জানো? কালিকাপুরের শ্মশান। তাই ওখানে কোনও বসতি নেই। তা ছাড়া, গঙ্গার ভাঙন রোধে বনদপ্তর থেকে বাঁধের নীচে একটা শালবনও গড়ে তোলা হয়েছে।

হালদারমশাই যে মনে-মনে ক্ষুব্ধ তা বুঝতে পারছিলুম। তিনি নস্যির কৌটো বের করলেন। কিন্তু তখনই কার্তিক একটা বিশাল ট্রেতে কফি এবং স্ন্যাক্স এনে রাখল। তার পেছনে এলেন চণ্ডীবাবু।

কার্তিক চলে গেল। আমরা কফি পানে মন দিলুম। একসময় চণ্ডীবাবু হেসে উঠলেন। তারপর বললেন,–মিস্টার হালদারকে আমি যদি না-আটকাতুম, তাহলে উনি নিশ্চয়ই এক রাউন্ড ফায়ার করে অন্তত একটা ভূতকে ধরাশায়ী করতেন।

হালদারমশাই বললেন,–ঠিক কইসেন। একখান গুলি অন্তত একজন ভূতের হাঁটুর নীচে লাগত।

চণ্ডীবাবু বললেন,–ওই ঘন কুয়াশার মধ্যে আপনারাও কিন্তু বিপদের আশঙ্কা ছিল।

কর্নেল বললেন,–একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে মিস্টার রায়চৌধুরী। কলকাতা থেকেই কেউ বা কারা আমাদের অনুসরণ করেছে। রাত্রে আমরা গাড়িতে আসায় তারা সুবিধে করতে পারেনি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমাদের একটু সতর্ক থাকা ভালো।

হালদারমশাই বললেন,–আর শচীনবাবুও যেমন কেমন বদলাইয়া গেসেন। কলকাতায় ওনাকে মনে হইত্যাসিল খুব সরল মনের মানুষ। কিন্তু এখানে মনে হইল য্যানো কিছু গোপন করবার চেষ্টা করত্যাসেন।

চণ্ডীবাবু জিগ্যেস করলেন, আপনি অভিজ্ঞ মানুষ, ঠিকই ধরেছেন। ওই শচীনই আমাকে ওর জ্ঞাতি অ্যাডভোকেট শরদিন্দুবাবুর কাছে রক্ষিত ওদের পূর্বপুরুষের একটা দলিলের কথা বলত। কিন্তু কর্নেলসাহেব যখন জানতে চাইলেন উনি কেন নিজে সেটা শরদিন্দুবাবুর কাছে স্বচক্ষে দেখতে চাননি, তখন শচীন ন্যাকা সেজে বলল ওটা তেমন কিছু নয়। তার বাবা নাকি বলেছে ওটার কোনও মূল্যই নেই।

কর্নেল বলে উঠলেন,–হা, শচীনবাবুর কথাটা আমাকে অবাক করেছে। আমি যখন ওঁকে সেই কাগজটা দেখিয়ে বললুম, এটা তিনি চেনেন কি না, এবং এও বললুম, এটা তাদের সেই পূর্বপুরুষের রক্ষিত কাগজে যা লেখা আছে তার কপি, তখন শচীনবাবু একবার চোখ বুলিয়েই বললেন, এটা বাজে। আসল কাগজটা নাকি শরদিন্দুবাবু আমাকে দেখাননি।

এই সময় কার্তিক পরদার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে বলল,–কর্তামশাই, আপনার টেলিফোন এসেছে।

চণ্ডীবাবু তখনই তার কফির কাপে প্লেট ঢাকা দিয়ে আসছি বলে দ্রুত চলে গেলেন।

হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন, আমার ধারণা, চণ্ডীবাবু আমাগো সঙ্গে থাকায় শচীনবাবু হয়তো মন খুইল্যা কথা কইতে পারেন নাই। কর্নেলস্যার যদি আমারে একটা শচীনবাবুর লগে দেখা করতে কন আমি যামু।

কর্নেল বললেন,–যেতে পারেন, কিন্তু খুব বেগতিক না দেখলে যেন রিভলবার বের করবেন না।

একটু পরে চণ্ডীবাবু ফিরে এসে বললেন,–থানা থেকে ওসি প্রণবেশবাবু ফোন করেছিলেন। উনি কর্নেলসাহেবকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বললেন।

.

চার

ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। চণ্ডীবাবু নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে নিয়ে চললেন। কর্নেল তার অভ্যাসমতো সামনের সিটে বসলেন। আমি এবং হালদারমশাই ব্যাক সিটে বসলুম। এই এলাকাটা নিরিবিলি নির্জন। ঘন বসতি এলাকায় পৌঁছে হালদারমশাই বলে উঠলেন,–মিস্টার রায়চৌধুরী, আমাকে এখানেই নামাইয়া দেন।

কর্নেল কিছু বললেন না। কিন্তু চণ্ডীবাবু বললেন, আপনি কি চাটুজ্যে বাড়ি যেতে চান?

হালদারমশাই বললেন,–হ! আমি একবার নিজের বুদ্ধিতে পা ফালাইয়া দেখতে চাই।

আমি বললুম,–দেখবেন, আড়াল থেকে ভূতের হাতের ইট-পাটকেল যেন না এসে পড়ে।

গোয়েন্দাপ্রবর হাসি মুখে গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। এখন তার মাথায় হনুমান টুপি নেই। গলা-বন্ধ পুরু সোয়েটার আর প্যান্ট পরা ঢ্যাঙা মানুষটি ঠিক পুলিশের ভঙ্গিতেই এগিয়ে গেলেন।

চণ্ডীবাবু গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললেন,–যাই বলুন কর্নেলসাহেব, মিঃ হালদার খুব সাহসী মানুষ। পুলিশ জীবনে উনি সম্ভবত আরও জেদি আর দুঃসাহসী ছিলেন।

কর্নেল বললেন,–ওঁকে নিয়ে একটাই সমস্যা। অনেক সময়েই উনি ভুলে যান যে উনি এখন আর পুলিশ অফিসার নন।

বাজার এলাকা পেরিয়ে বাঁ-দিকের গঙ্গার ধারে এদিকটায় বাঁধের ওপর পিচ রাস্তা করা হয়েছে। সেই রাস্তায় সবরকমের যানবাহন যাতায়াত করছে। আমাদের ডানদিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে গঙ্গার ভাঙন রোধ করার জন্য শাল আর শিশু গাছের ঘন জঙ্গল গড়ে তোলা হয়েছে। এদিকটায় ঘরবাড়িগুলো বেশ সাজানো-গোছানো এবং প্রত্যেকটা বাড়ির সামনে একটা করে ফুলবাগিচা। চণ্ডীবাবু বললেন,–এই দিকটায় নিউ টাউনশিপ গড়ে উঠেছে। এলাকার পয়সাওয়ালা লোকেরা এখানে এসে বাড়ি করেছেন।

কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা চওড়া রাস্তায় পৌঁছলুম। দেখলুম ডান দিকে গঙ্গা পারাপারের ঘাট আর বাঁদিকে সেকাল-একালে মেশানো সব দোতলা পাকা বাড়ি। কর্নেল বললেন,–কালিকাপুরের অনেক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু সরকারি অফিসগুলোর অবস্থা দেখছি একইরকম। ওই বাড়িটা সেই ভূমি-রাজস্ব দপ্তরের অফিস না?

চণ্ডীবাবু বললেন,–ওটার পেছনেই থানা। তবে থানার বাড়িটা দোতলা করা হয়েছে এবং অনেক ভোল ফেরানো হয়েছে।

গাড়ি আবার বাঁ-দিকে ঘুরে যেখানে দাঁড়াল, সেখানে সামনা-সামনি একটা গেট। গেটটা খোলাই ছিল। ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়ে একপাশে পার্ক করলেন চণ্ডীবাবু। পুলিশের জিপ আর বেতার ভ্যান দেখে বুঝতে পারলুম, এটাই থানা। গাড়ি থেকে নেমে কর্নেল এবং চণ্ডীবাবু এগিয়ে গেলেন। আমি নেমে গিয়ে চণ্ডীবাবুকে বললুম,–গাড়ি লক করে এলেন না?

চণ্ডীবাবু একটু হেসে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, লক করে আসা উচিত ছিল। ওসি প্রণবেশবাবু নিজেই বলেন,থানা থেকে চুরির আশঙ্কা বেশি।

একটা ঘরের জানলা দিয়ে দেখলুম, এক ভদ্রলোক সাদা পোশাকে বসে আছেন। চণ্ডীবাবু আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে বললেন,–এই দেখুন, আপনার সেই কিংবদন্তিখ্যাত ব্যক্তি।

তখনই বুঝতে পারলুম ইনিই ওসি মিস্টার প্রণবেশ সেন। তিনি কর্নেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। সকৌতুকে বললেন, আমি স্বপ্ন দেখছি, না বাস্তব কিছু দেখছি সেটা পরীক্ষা করে নিই।

কর্নেল হাত বাড়িয়ে দিলে তিনি দু-হাতে হাত চেপে ধরে বললেন,সত্যি আমার জীবন ধন্য হল। আপনার কথা এতকাল উঁচুতলার অফিসারদের মুখে শুনে আসছি, আপনাকে যে স্বচক্ষে দর্শনের সৌভাগ্য হবে কল্পনাও করিনি।

কর্নেল সামনের খালি চেয়ারে বসলেন। তার একপাশে চণ্ডীবাবু অন্যপাশে আমি বসলুম। প্রণবেশবাবু আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই সেই খ্যাতনামা সাংবাদিক, জয়ন্ত চৌধুরী? এবার আপনাকে ছুঁয়ে দেখি।

অগত্যা আমাকেও উঠে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে করমর্দন করতে হল।

প্রণবেশবাবু বললেন,–দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় জয়ন্তবাবুর যা রেপোটার্জ বেরোয়, আমার গিন্নি তা খুঁটিয়ে পড়েন।

এইসব এলোমেলো কথাবার্তার পর ওসি মিস্টার সেনের কোয়ার্টার থেকে একজন কনস্টেবল ট্রেতে কফি আর স্ন্যাকস নিয়ে এল। সে মৃদুস্বরে বলল,–মাইজি সাহেবদের সঙ্গে একবার আলাপ করতে চান।

মিস্টার সেন বললেন,–তোমার মাইজিকে অপেক্ষা করতে বলো। কর্নেলসাহেবরা এসেছেন বিশেষ একটা কাজে।

কনস্টেবল সেলাম ঠুকে চলে গেল।

আমার আর কফি পানের ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু ভদ্রতা রক্ষা করার জন্য কাপটা তুলে নিতেই হল। কারণ এই কফি যিনি তৈরি করে পাঠিয়েছেন, সেই ভদ্রমহিলা আমার লেখার ভক্ত। ওসি মিস্টার সেন কফিতে চুমুক দিয়ে চাপাস্বরে বললেন,–ব্লাড রিপোর্টের সারমর্ম আজ সকালেই

টেলিফোনে পেয়ে গেছি। ফরেনসিক এক্সপার্টদের মতে রক্তটা মানুষের নয়। চণ্ডীবাবু চমকে উঠে বললেন,–মানুষের রক্ত নয়? তাহলে কীসের রক্ত?

ওসি একটু হেসে বললেন,–কোনও মানবেতর প্রাণীর রক্ত। যে কারণেই হোক, কেউ বা কারা চ্যাটার্জিবাবুদের ভয় দেখাতে চেয়েছে। ভূতের উৎপাতে ওঁরা ভয় পাচ্ছেন না দেখেই সম্ভবত একটা সাংঘাতিক ঘটনা সাজিয়েছে।

কর্নেল চুপচাপ শুনছিলেন। চণ্ডীবাবু জিগ্যেস করলেন, কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, মহীন কোথায় গেল? না কি সে সত্যিই সন্ন্যাস নিয়ে চলে গেছে, এবং তার ঘনিষ্ঠ কোনো লোককে সে সেকথা জানিয়ে গেছে, এবং তার সূত্রেই চাটুজ্যেদের কোনও শত্রু এই সুযোগটাকে কাজে লাগাচ্ছে।

ওসি বললেন,–হ্যাঁ। এ-ধরনের অনেক সিদ্ধান্তে অবশ্য আসা যায়, তবে সবার আগে শচীনবাবু কিংবা তার বাবা যদি আমাদের কাছে কোনও কথা না লুকিয়ে খোলাখুলি বলে দেন, তাহলে আমাদের এগোতে সুবিধে হয়।

এতক্ষণে কর্নেল বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই।

ওসি বললেন,–না কর্নেলসাহেব, আমাদের তদন্তের কাজ যথারীতি চলছে।

এই সময়েই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,–আজ ভোরে গঙ্গার ধারে, বেড়াতে গিয়ে আপনারা কাদের ঢিল খেয়েছেন। তার মানে

কর্নেল হাসতে-হাসতে বললেন, আমরা কারুর ঢিল খাব কেন? আমাদের সঙ্গী হালদারমশাইয়ের হাবভাব দেখে কাচ্চা-বাচ্চারা পাগল বলে ঢিল ছুঁড়তেই পারে।

তখনই বুঝতে পারলুম, কথাটা বলা আমার উচিত হয়নি। কর্নেল খুব দরকার না হলে কোনও কেসে নিজের হাতের তাস পুলিশকে দেখাতে চান না।

এদিকে কর্নেলের কথা শুনে চণ্ডীবাবু হেসে উঠেছিলেন। আর ওসি প্রণবেশ সেনও হাসতে-হাসতে বললেন,–হালদারমশাই মানে সেই প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোক? যাঁর কথা জয়ন্তবাবুর রেপোর্টাজে পড়েছি। তিনি তো রিটায়ার্ড পুলিশ ইন্সপেক্টর। তো তাকে সঙ্গে আনলেন কেন?

কর্নেল বললেন,–হালদারমশাই এখানকার ঠান্ডায় একেবারে নেতিয়ে গেছেন। তাই শরীর গরম করার জন্য তিনি পায়ে হেঁটে সারা কালিকাপুর ঘুরে দেখতে চান। এতে নাকি তার শরীর আবার গরম হয়ে উঠবে।

প্রণবেশবাবু হেসে উঠলেন। বললেন,–পায়ে হেঁটে কালিকাপুর পুরোটা ঘুরে দেখতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। যাই হোক, এবার একটা সিরিয়াস কথায় আসছি। শচীনবাবু কাল সন্ধ্যায় থানায় এসেছিলেন। উনি বলেছিলেন ওঁর বাবা নাকি কিছুদিন থেকে প্রায়ই বলছেন এই বাড়ির ওপর কোনও কুপিত গ্রহের দৃষ্টি পড়েছে। বাড়িটা বেচে দিয়ে নিউ টাউনশিপ এলাকায় যাওয়া উচিত। কিন্তু শচীনবাবুর বক্তব্য ওই এলাকায় জমির দাম অনেক বেশি। তা ছাড়া, ঠাকুরবাড়ি ফেলে রেখে অন্য জায়গায় গেলে গৃহদেবতা রুষ্ট হবেন।

চণ্ডীবাবু বললেন,–কদিন আগে আমি শচীনের বাবাকে দেখতে গিয়েছিলুম। অহীনকাকা আমার হাত চেপে ধরে বললেন,–চণ্ডী, এই বাড়ি থেকে আমাদের চলে যাওয়া দরকার। তুমি অন্তত একটা ভাড়ার বাড়িও দেখে দাও আমাদের। আজকাল তো কালিকাপুরে অনেক সরকারি অফিস হয়েছে, অনেকে বাড়ি ভাড়া দিচ্ছে শুনেছি।

আমি অহীনকাকুকে বলেছিলুম,–আপনারা তো এখানে ভালোই আছেন। এরকম চারিদিকে মোটামুটি ভোলামেলা বাড়ি কোথাও পাবেন না।

তখন অহীনকাকু চাপাস্বরে আমাকে বললেন,–রোজ রাত্রে বিনোদ পাগলার প্রেত এসে হানা দিচ্ছে। ভয় পাবে বলে শচীন বা আমার ভাই মহীনকে কথাটা বলিনি। চণ্ডীবাবু হাসতে-হাসতে আরও বললেন,–অহীনকাকু নাকি ঘরের ভেতরে তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। এমনকি তার বোন বাসন্তীও নাকি রাতদুপুরে স্পষ্ট তাকে দেখেছে। মেয়েদের সাহস বেশি, আর বাসন্তীর তত সাহসের সীমা নেই।

ওসি মিস্টার সেন বললেন, হ্যাঁ, ওই পাড়ায় ভূতের গল্প জোর রটে গেছে। তারপর হঠাৎ এই হাড়িকাঠে রক্তপাত। আফটার অল সব গ্রামের মানুষ তো! সন্ধ্যা হতে-না-হতেই দরজা এঁটে বাড়িতে ঢুকে থাকছে। গত একসপ্তাহ ধরে ওই এলাকায় পুলিশ রাউন্ডে গেছে, কিন্তু রাস্তায় কোনও লোকজন দেখতে পায়নি।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন,–মিস্টার সেন, তাহলে এবার ওঠা যাক।

ওসি মুখে কৌতুক ফুটিয়ে বললেন, আপনি কি সরেজমিনে তদন্ত করতে চাটুজ্যে বাড়ি যাবেন?

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–একবার যেতে ইচ্ছে করছে। কারণ আপনার মুখে যে সূত্রটা পেলুম সেটা গুরুত্বপূর্ণ। রক্তটা মানুষের যে নয়, কোনও জানোনায়ারের, ওটা যখন জানা গিয়েছে। তখন ভূতের উপদ্রব কিংবা মহীনবাবুর অন্তর্ধান রহস্য অন্যদিক থেকে ভেবে দেখার দরকার আছে।

ওসি প্রণবেশ সেন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–কর্নেলসাহেব, পুলিশ সুপার আমাকে না বললেও, আমি আপনাকে সবরকমের সাহায্যের জন্য তৈরি থাকব। শুধু একটা অনুরোধ, একবার আপনি জয়ন্তবাবু এবং মিস্টার হালদারকে আমার গৃহিণীর সামনে উপস্থিত করাবেন। সোজা কথায় বলছি চণ্ডীবাবুসহ আপনাদের তিনজনক একবার আমার গৃহিণীর হাতের রান্না খেতে হবে।

কর্নেল বললেন,–অবশ্যই। তবে আগে চাটুজ্যে বাড়ির রহস্যটা ফাস করতে হবে। আপনার সাহায্যও দরকার হবে। তারপর আপনার নেমন্তন্ন খাওয়া যাবে।

প্রণবেশ সেন আমাদের গাড়ির কাছে এগিয়ে এসে বিদায় দিলেন। রাস্তায় পৌঁছে আমি বললুম,ভদ্রলোককে পুলি। বলে একদমই মনে হল না। অত্যন্ত সরল সাদাসিধে মানুষ।

চণ্ডীবাবু গাড়ির গতি কমিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বাঁকা হেসে বললেন,–জয়ন্তবাবু, আজ অবধি কালিকাপুরে এই ভদ্রলোকের মতো কোনও অফিসার আসেননি। উনি আসার পর একবছরেই এলাকার দাগি অপরাধীরা কেউ জেলে পচছে আবার কেউ এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি এলাকার একজন দাগি অপরাধী কালু মিঞা, সেনসাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে-বলতে একেবারে কাপড়ে-চোপড়ে–

চণ্ডীবাবু মুখ ফিরিয়ে হাসতে থাকলেন। কর্নেল বললেন,–জয়ন্ত এতদিন ধরে আমার সঙ্গে ঘুরে অসংখ্য পুলিশ অফিসার দেখেছে। তবু এখনও ও পুলিশ সম্পর্কে অজ্ঞ।

অনেক অলিগলি ঘুরে আমাদের গাড়ি যেখানে দাঁড়াল, সেখানে কাছাকাছি কোনও বাড়ি নেই। ডানদিকে একটা আমবাগান আর বাঁ-দিকে একটা পুকুর। পুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটা পুরোনো মন্দির। গাড়ি থেকে নেমে বললুম,–আমার ধারণা ওটাই সেই চাটুজ্যে বাড়ির গৃহদেবতার মন্দির।

চণ্ডীবাবু এখানে কিন্তু গাড়ি লক করলেন। ততক্ষণে কর্নেল হনহন করে পুকুরের পাড় দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। আমি তাকে অনুসরণ করলুম। মন্দিরের সামনে একটা চত্বর। চত্বরে একটা পশুবলি দেওয়ার হাড়িকাঠ পোঁতা আছে।

হাড়িকাঠে অবশ্য সিঁদুর মাখানো আছে, কিন্তু কোথাও আর রক্তের কোনও চিহ্ন নেই। চণ্ডীবাবু এগিয়ে এসে বললেন,–রক্ত কালই পুলিশ এসে ধুয়ে ফেলেছে। কিছুটা নমুনা অবশ্য নেওয়া হয়েছিল।

মন্দিরের কোনও দরজা দেখলুম না। তবে একটা শিবলিঙ্গ দেখতে পেলুম। কর্নেল মন্দিরের পেছন দিকে ঘুরে আমার সামনে এলেন। সেই সময়েই এক প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা পাশের বাড়ির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে আমাদের দেখে থমকে দাঁড়ালেন। চণ্ডীবাবু বললেন,–বাসন্তীদি, চিনতে পারছ, এঁরা কে?

ভদ্রমহিলা করজোড়ে নমস্কার করে বললেন,–পেরেছি বইকি! শচীনের মুখে কর্নেলসাহেবের কথা শুনেছি। আপনারা দয়া করে বাড়ির ভেতরে আসুন।

বুঝতে পারলুম এই দরজা দিয়ে মন্দির এবং চত্বরের নীচে পুকুরের ঘাটে যাওয়া যায়। বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখলুম, একতলা একটা পুরোনো বাড়ি। অন্যপাশে একটা টালির চালের তিনদিক ঘেরা ঘর। ওটা রান্নাঘর।

বাসন্তী দেবী বললেন,–এই সময় আবার শচীন কোথায় বেরুল কে জানে! আপনারা আসুন। শচীনের ঘরেই আপনাদের বসাচ্ছি।

কর্নেল বললেন,–থাক, আমরা বসব না। একটুখানি আপনাদের এই বাড়ি আর পেছন দিকটা ঘুরে দেখব।

কথাটা বলেই কর্নেল হঠাৎ আমাদের অবাক করে রান্নাঘরের পাশে পাঁচিলটার দিকে দৌড়ে গেলেন। তারপর পাঁচিলের ওপর দিয়ে দু-হাতের সাহায্যে উঁচু হয়ে কী দেখলেন। তারপর ফিরে এসে সহাস্যে বললেন,–দিন-দুপুরে পাঁচিলের ওপর দিয়ে ভূতের মুণ্ডু!

চণ্ডীবাবু বললেন,–ভূতের মুণ্ডু মানে! কেউ উঁকি দিচ্ছিল?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। কুৎসিত মুখোশ পরা একটা মুখ! আমি তেড়ে যেতেই অদৃশ্য। অগত্যা দৌড়ে গিয়ে দেখতে হল ভূতের চেহারাটা কীরকম। কিন্তু ততক্ষণে ভূতটা পেছনের ওই ভেঙেপড়া বাড়িটার আড়ালে লুকিয়ে গেল।

বাসন্তীদেবী চোখ বড় করে বললেন,–এত সাহস! কর্নেসাহেব দয়া করে একটু বসুন।

.

পাঁচ

বাসন্তী দেবীর অনুরোধে কর্নেল বললেন, ঠিক আছে, যদি আপনার কোনও কথা বলার থাকে, এখানে দাঁড়িয়েই বলতে পারেন।

বাসন্তী দেবী বললেন,–দাদা এখন বাথরুমে আছেন। তা না হলে দাদাই বলতেন। ছোড়দা মহীন প্রায়ই বলত, সে আমাদের পূর্বপুরুষের লুকিয়ে রাখা এক ঘড়া সোনার মোহর কোথায় আছে তা জানে, কিন্তু সেকথা সে জানাতে পারবে না। কারণ, এক রাত্রে স্বপ্নে তাকে তার ঠাকুরদা নাকি দেখা দিয়ে বলেছেন, তুই যা জেনেছিস তা যেন অন্যে জানতে না পারে। অন্যকে তুই মোহরের ঘড়ার খবর দিলে মুখে রক্ত উঠে মরবি। তাই আমাদের ঠাকুরবাড়িতে হাড়িকাঠের পাশে রক্ত দেখার সঙ্গে-সঙ্গেই আমার মনে হয়েছিল তাহলে মহীনই হয়তো শচীনকে কথাটা বলে দিয়েছিল। তাই মুখে রক্ত উঠে সে মরেছে। আর শচীন তার লাশটা তুলে কোথাও পুঁতে ফেলেছে।

চণ্ডীবাবু বলে উঠলেন,–কী সর্বনাশ! উনি ওই গোবেচারা শচীনকেই সন্দেহ করে ফেললেন? শচীনের মতো রোগাটে গড়নের লোক তার কাকার লাশ একা ওঠাতে পারে?

বাসন্তী দেবী বিব্রত মুখে বললেন,–না, মানে আমি ভেবেছিলুম শচীনের সঙ্গে তার বন্ধুরাও হয়তো ছিল।

চণ্ডীবাবু হো-হো করে হেসে উঠলেন। কর্নেল বললেন, আপনি কি আপনার বড়দাকে একথা বলেছিলেন? কিংবা কোনও ছলে শচীনকেও এরকম কোনও আভাস দিয়েছিলেন?

বাসন্তী দেবী বললেন,–না, কথাটা আমি কাকেও বলিনি। এমন কথা কি বলা যায়? কর্নেল বললেন, তখন আপনার এরকম ধারণা হয়েছিল, এখন আপনার কী ধারণা? বাসন্তী দেবীর কান্না এসে গেল। আত্মসম্বরণ করে বললেন, আমার ছোড়দার মতো সন্ন্যাসী সাদাসিধা মানুষকে খুন করার পেছনে আর কী কারণ থাকতে পারে, এবার আপনারাই বলুন। আমার মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই সে দৈবাৎ মুখ ফসকে কোনও দুষ্ট লোককে কথাটা বলে ফেলেছিল। তারপর অভিশাপ লেগে ছোড়দা মুখে রক্ত উঠে মরেছে। তবে আমি কিন্তু আমাদের বাড়ির চারপাশে সব জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, কোথাও কোনও গর্ত খোঁড়া দেখতে পাইনি। তবে এমনও হতে পারে মোহর ভরতি ঘড়া এর বাইরে কোথাও পোঁতা ছিল।

চণ্ডীবাবু বললেন, পুলিশ তো এই এলাকা তন্নতন্ন খুঁজেছে, যদি কোথাও মহীনকে পুঁতে রাখা হয় তার খোঁজ মিলবে। কিন্তু তেমন কোনও চিহ্নই তারা পায়নি।

এই সময়েই বারান্দার ওপাশে বাথরুম থেকে এক রুণ চেহারার ভদ্রলোক বেরিয়ে আসতেই বাসন্তী দেবী হন্তদন্ত গিয়ে তাকে ধরলেন। বললেন,–সাড়া দিলেই তো আমি যেতুম।

ভদ্রলোকের চেহারায় শচীনবাবুর ছাপ স্পষ্ট। উনি তাহলে শচীনবাবুর বাবা অহীনবাবু। বাসন্তী দেবীর কাঁধে ভর দিয়ে একপা-একপা করে এগিয়ে এসে তিনি ঘরের দরজার কাছে দাঁড়ালেন। বললেন, কারা যেন বসে আছে।

বাসন্তী দেবী বললেন,–চণ্ডীদা এসেছেন। আর তার সঙ্গে কলকাতার সেই কর্নেলসাহেবরা এসেছেন। যাঁদের কাছে শচীন গিয়েছিল।

অহীনবাবু ছেলেমানুষের মতো কেঁদে উঠলেন। বললেন,–আমার সাদাসিধে সরল ভাইটাকে কারা মেরে ফেলল।

চণ্ডীবাবু উঠে গিয়ে তাকে ধরে বললেন,–ঘরে চলুন। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আপনার কষ্ট হবে।

চণ্ডীবাবু এবং বাসন্তী দেবী অহীনবাবুকে ঘরে তার বিছানায় শুইয়ে রেখে বাইরে এলেন। সেই সময়েই কর্নেল বাসন্তী দেবীকে বললেন,–একটা কথা আমার জানতে ইচ্ছে করছে। শচীনবাবুর একটা পায়ে গণ্ডগোল আছে। আমি লক্ষ করেছি, উনি মোটা ছড়ির সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারেন না।

বাসন্তী দেবী বললেন,–ওঁর বাঁ-পায়ের পাতা জন্ম থেকেই একটু বাঁকা। তাই ছোটবেলা থেকেই খুঁড়িয়ে হাঁটত শচীন। স্কুল যেত একটা মোটাসোটা বেতের ছড়িতে ভর দিয়ে। ছাত্ররা ওকে খোঁড়ামাস্টার বলে আড়ালে ভেংচি কাটত।

চণ্ডীবাবু তখনই হাসতে-হাসতে বললেন,–বেচারা খোঁড়া মাস্টারের ওপর তুমি সন্দেহ করে ভেবেছিলে, সে নাকি তার কাকার লাশ গুম করেছে!

বাসন্তী দেবী জিভ কেটে বললেন,–না-না, মানে ওর দু-একজন বন্ধু আছে, তারা তো ভালো লোক নয়। তুমি তাদের চেনো চণ্ডীদা। কায়েতপাড়ার গোপেন আর ওই যে একচোখা লোকটা–কী যেন নাম। সদগোপপাড়ায় বাড়ি

চণ্ডীবাবু বললেন,–ভুতুর কথা বলছ?

বাসন্তী দেবী চাপাস্বরে বললেন, কিছুদিন আগে থেকে গোপেন আর ভুতু ঘনঘন এ-বাড়িতে আসত। শচীনের সঙ্গে আড্ডা দিত। এখন আর আসে না।

কর্নেল বললেন,–পুলিশকে কি আপনি একথা জানিয়েছেন?

বাসন্তীদেবী করজোড়ে চাপাস্বরে বললেন,–মিনতি করে বলছি বাবা, একথা যেন কেউ জানতে না পারে। ওরা দুজনেই খুব বজ্জাত লোক। পুলিশের খাতায় ওদের নাম আছে–তাই না চণ্ডীদা?

চণ্ডীবাবু বললেন,–ওরকম অনেকের নামই পুলিশের খাতায় আছে। যাই হোক, তুমি আর যেন কারুকে মুখ ফসকে এসব কথা বলে ফেলো না।

চাটুজ্যেবাড়ি থেকে রাস্তার দিকের সদর দরজা দিয়ে আমরা বেরিয়ে গেলুম। তারপর কর্নেল বাড়ির পেছনের দিকটা বাইনোকুলারে দেখে নিয়ে বললেন,–রাতবিরেতে ভূতেরা অনায়াসে শচীনবাবুদের বাড়ির ছাদে উঠে দাপাদাপি করতে পারে। ঢিলও ছুঁড়তে পারে।

এরপর আমরা রাস্তার উত্তরদিকে এগিয়ে বাঁ-দিকের সেই পুকুরপাড়ে গেলাম। তার নীচেই চণ্ডীবাবুর গাড়ি আছে। কতকগুলো বাচ্চা ছেলে আমাদের দেখামাত্র ডানদিকে আমবাগানের ভেতর পালিয়ে গেল। বোঝা গেল তারা মোটর গাড়িটা নিয়ে ইচ্ছে মতো খেলা করছিল। চণ্ডীবাবু গাড়ির লক খুলছেন, এমন সময় কর্নেল বললেন,–একটা অপেক্ষা করুন। আমি পুকুরের পূর্বদিকটা দেখে আসি।

আমি কর্নেলকে অনুসরণ করলুম। পুকুরপাড়ের নীচে একটা পোড়ো জমি। তার একদিকে বাঁশবন। কর্নেল পোডড়া জমি দিয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে গেলেন। তারপর বললেন,–এদিকটায় বসতি নেই দেখছি!

কোথাও কোথাও ফসলের খেত, কোথাও আখচাষ করা হয়েছে। হঠাৎ দেখলুম কর্নেল আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে চাটুজ্যেবাড়ির পাঁচিলের নীচে থেকে দুটো নুড়ি-পাথর কুড়িয়ে নিলেন। বললুম,–কী আশ্চর্য! ভূতের ঢিলগুলো বাড়ির ভেতরে পড়ার কথা। পড়েওছিল। এখানে এই নুড়িগুলো কে রাখল?

কর্নেল তার পিঠে-আঁটা কিটব্যাগের চেন টেনে তার ফাঁক দিয়ে নুড়ি-পাথর তিনটে ভেতরে ঢোকালেন। তারপর চেন টেনে কিটব্যাগের মুখ বন্ধ করলেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে বাঁশবনের ভেতরটা একবার দেখে নেওয়ার পর বললেন,–চলো, ফেরা যাক।

তাকে অনুসরণ করে বললুম,–ওখানে নুড়ি-পাথর পড়ে থাকাটা খুব রহস্যজনক মনে হচ্ছে।

কর্নেল বললেন,–হ্যাঁ, রহস্য তো এখন আমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।

বললুম,–বাসন্তীদেবীকে বলা উচিত ছিল হাড়িকাঠের রক্তটা মানুষের নয়।

কর্নেল মুখ ঘুরিয়ে চোখ কটমট করে বললেন,–মুখটি বুজে থাকবে।

গাড়ির কাছে গেলে চণ্ডীবাবু বললেন,–আপনাকে খুব ব্যস্ত দেখাচ্ছিল। অমন করে পাঁচিলের ধারে হুমড়ি খেয়ে কী দেখছিলেন। রক্ত? ওখানেই এক পাটি স্যান্ডেল পাওয়া গেছে।

কর্নেল হাসতে-হাসতে বললেন, আমি দ্বিতীয় পাটি স্যান্ডেলটা খুঁজে দেখছিলুম।

চণ্ডীবাবু গাড়িতে উঠে বললেন,–আর-এক পাটি জুতো নিশ্চয়ই গঙ্গাগর্ভে ছুঁড়ে ফেলেছে ওরা।

কর্নেল আগের মতো গাড়ির সামনের সিটে বাঁদিকে বসলেন। আমি বসলুম পেছনে। চণ্ডীবাবু স্টার্ট দিয়ে গাড়ির মুখ সবে ঘুরিয়েছেন, এমন সময় আমবাগানের ভেতর থেকে ছুটে আসতে দেখলুম হালদারমশাইকে। তিনি যে এত জোরে ছুটতে পারেন তা দেখার সৌভাগ্য কোনওদিন আমার হয়নি। কর্নেলের কথায় ততক্ষণে চণ্ডীবাবু গাড়ি দাঁড় করিয়েছিলেন। হালদারমশাইয়ের সোয়েটারে এবং প্যান্টের এখানে-ওখানে কাদার ছোপ। উনি হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন, আমি কর্নেলসাহেবেরে দেইখ্যাই ছুট দিসিলাম। ওঃ কী কাণ্ড!

আমি দরজা খুলে দিলে তিনি ভেতরে ব্যাক সিটে বসলেন। তারপর পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে এক টিপ নস্যি নিলেন।

সামনে থেকে কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কারুর সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করছিলেন হালদারমশাই। আপনার পোশাকে অত কাদার ছোপ কেন?

গোয়েন্দাপ্রবর নোংরা রুমালে নাক মুছে বললেন,–না কর্নেলস্যার, একজনেরে ফলো কইর‍্যা যাইতেছিলাম। আমবাগানের শেষ দিকটার খানিকটা জায়গা ঝোঁপজঙ্গলে ঢাকা। তার ওধারে একটা বসতি।

চণ্ডীবাবু বললেন,–ওটা জেলেপাড়া।

হালদারমশাই বললেন,–যারে ফলো করসিলাম, সে একখানে খাড়াইয়া যেন কারো লাইগ্যা ওয়েট করত্যাসিল। তারপর একজন আইয়া তারে কইল-খবর কও। তারপর দুইজনে চাপাস্বরে কী কথা হইল আমি শুনি নাই। তাই সাপের মতন উপুড় হইয়া আউগাইয়া যাইতেসিলাম। তখনই পোশাকে কাদা লাগসে। মাটিটা নরম।

কর্নেল বললেন,–তারপর কিছু শুনতে পেলেন?

হালদারমশাই বললেন,–নাঃ! ওরা দুইজনে সেখান থিক্যা উধাও হইয়া গেল।

কর্নেল জিগ্যেস করলেন,–আপনি কাকে ফলো করেছিলেন?

হালদারমশাই বললেন,–তারে চিনি না, কিন্তু আমি বাঁশঝাড়ের ভেতরে যখন আর-এক পাটি জুতা খুঁজত্যাছিলাম, তখনই লোকটারে চোখে পড়সিল। সে শচীনবাবুগগা বাড়ির পাঁচিলের বাহির দিয়া আইত্যাসিল। তারপর একখানে খাড়াইয়া ছিল। আমাকে সে কীভাবে ট্যার পাইল কে জানে। সে আমবাগানের ভেতর দিয়া উধাও হইয়া গেল। কাজেই তারে ফলো না কইর‍্যা উপায় ছিল না।

চণ্ডীবাবু জিগ্যেস করলেন,–লোকটার চেহারা কেমন? পরনে কী পোশাক ছিল?

হালদারমশাই বললেন,–লোকটার চেহারা এক্কেরে ভূতের মতন কালো।

আমি না বলে পারলুম না,ভূতের গায়ের রং কালো, তা কি আপনার পুলিশ লাইফে দেখেছেন?

হালদারমশাই সহাস্যে বললেন,–না ওটা কথার কথা। লোকটার মুখের চেহারা এমনিতেই কুৎসিত। আর একখানা চক্ষু নাই। পরনে যেমন-তেমন একটা ফুলপ্যান্ট, আর সোয়েটার। মাথায় মাফলার জড়ানো ছিল।

চণ্ডীবাবু বলে উঠলেন, তাহলে বাসন্তীর কথাই ঠিক। ওই লোকটা সেই একচোখে বজ্জাত ভুতু।

গোয়েন্দাপ্রবর হাসতে-হাসতে বললেন,–এক্কেরে মানানসই। ভূতের নাম ভুতু হইলে সে মানুষ-ভূত। হ্যাঁ, যে লোকটা তারে দেখা করতে আইসিল, তার চেহারা ভদ্রলোকের মতন। কিন্তু তার গোঁফখানা দেইখ্যা মনে হইসিল, লোকটা দাগি আসামি। ওই যে কথায় আসে না, শিকারি বিড়ালের গোঁফ দেখলে চেনা যায়! ওইরকম গোঁফ ভদ্রলোক রাখে না।

কর্নেল বললেন,–ঠিক আছে, আপনি পুলিশের সামনে যেন মুখ ফসকে এসব কথা বলবেন না।

চণ্ডীবাবু বললেন, আমার খুব অবাক লাগছে। বাসন্তী তাহলে ঠিকই সন্দেহ করেছিল। দ্বিতীয় লোকটার নাম গোপেন। ওর বাবাকে লোকে বলত পোড়াসিংঘি। কারণ, ওর বাবা গোপাল সিংহের মুখের একটা পাশ ছোটবেলায় পুড়ে গিয়েছিল। কেউ-কেউ অবশ্য পোড়া কায়েতও বলত। তার ছেলে গোপেন যে গুণ্ডামি করে বেড়াবে, এমনকি ডাকাত দলেও নাম লেখাবে, এটা কেউ কল্পনা করতেও পারেনি।

কর্নেল বললেন, আপনারা শচীনবাবুকে এসব কথা যেন বলবেন না। দরকার হলে আমি শচীনবাবুর সঙ্গে কথা বলে ওই লোকদুটোর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বতার কারণটা খুঁজে বের করব।

চণ্ডীবাবুর বাড়ি পৌঁছুনোর পর হালদারমশাই সোয়েটার এবং প্যান্টের কাদা পরিষ্কার করতে বাথরুমে ঢুকলেন। চণ্ডীবাবু দোতলায় নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন। শুধু কার্তিক আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল। সে বলল,–সায়েবরা এবার নিশ্চয়ই কফি খাবেন?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, এক কাপ কফি পেলে ভালো হয়।

কার্তিক চলে যাওয়ার পর কর্নেল চাপাস্বরে বললেন,–জয়ন্ত, এখন তোমার কী মনে হচ্ছে, আমাকে খুলে বলো।

একটু ভেবে নিয়ে বললুম,–আমার মনে হচ্ছে, মহীনবাবুকে কোথাও ওই ভুতু আর গোপেন মিলে জোর করে আটকে রেখেছে। তার ওপর অত্যাচার করে পূর্বপুরুষের লুকিয়ে রাখা সোনার মোহর ভর্তি ঘড়া কোথায় আছে, তা জানার জন্যে ওরা চেষ্টা করছে। আর শচীনবাবু সম্ভবত সেই সোনার মোহরের লোভে ওদের ফাঁদে পা দিয়েছে।

কর্নেল বললেন, তাহলে শচীনবাবু চণ্ডীবাবুর কাছে পরামর্শ চাইতে গিয়েছিলেন কেন? আর যদি বা গেলেন, তিনি চণ্ডীবাবুর মুখে আমার পরিচয় পেয়েই গিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তার মতো একজন খোঁড়া মানুষ এতটা ঝুঁকি নেবেনই বা কেন?

এই সময়েই চণ্ডীবাবু ঘরে ঢুকে বললেন,–কফি আসছে। আর যার জন্য কর্নেল সাহেব মনে-মনে অপেক্ষা করছিলেন, সেই শচীনও তার গাবদা মোটা ছড়িটা নিয়ে গেটে ঢুকছে দেখলুম।

কর্নেল বললেন,–বাঃ, সুখবর। তবে আপনি কফি খেয়েই কাজের অছিলায় এ-ঘর থেকে যেন কেটে পড়বেন।

.

ছয়

শচীনবাবুকে কার্তিক আমাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেল। ঘরে ঢুকে শচীনবাবু নমস্কার করে বললেন,–পিসিমার মুখে শুনলুম আপনারা আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন। আমি একটুখানি বাজারের দিকে গিয়েছিলুম। পিসিমার মুখে শুনেই সাইকেলরিকশাতে চেপে চণ্ডীবাবুর বাড়িতে এলুম। দারোয়ান বললেন, হ্যাঁ, কর্নেলসাহেবরা কিছুক্ষণ আগে ফিরে এসেছেন।

চণ্ডীবাবু বললেন,–বসো শচীন। তোমার জন্যে এক কাপ কফি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

শচীনবাবু বললেন,–না কাকাবাবু, এইমাত্র আমি বাজারে চা খেয়ে-খেয়ে মুখ তেতো করে ফেলেছি। আর কিছু খাব না।

চণ্ডীবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–ঠিক আছে। তাহলে তোমরা কথাবার্তা বলো। আমার একটা জরুরি কাজ আছে। কাজটা সেরে নিয়ে আবার আসব।

তিনি চলে যাওয়ার পর কর্নেল বললেন, আপনাদের বাড়িতে যে ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। দিন-দুপুরে পাঁচিলের ওপর দিয়ে কালো কুচ্ছিত একটা বিদঘুঁটে মুখ উঁকি দিচ্ছিল। আমি তাড়া করে যেতেই অদৃশ্য হল।

শচীনবাবু গম্ভীর মুখে বললেন,–কথাটা পিসিমার কাছে শুনে এলুম। আমার মনে হচ্ছে কলকাতা থেকে আপনার মতো খ্যাতিমান রহস্যভেদী সদলবলে এখানে এসে পড়েছেন, তাই ছোটকাকার খুনিরা মরিয়া হয়ে উঠেছে।

হালদারমশাই তার সোয়েটার আর প্যান্টের কাদাগুলো জল দিয়ে আলতোভাবে সাফ করে কফির আসরে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বললেন, আপনাগো বাড়ির লগে একখান বাঁশঝাড় আছে।

শচীনবাবু চমকে উঠে বললেন, হ্যাঁ আছে। কিন্তু আপনি কি সেখানে সন্দেহজনক কিছু দেখেছেন?

হালদারমশাই কী বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল তাকে থামিয়ে বললেন,–ওসব কিছু না। আপনি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন।

শচীনবাবু বললেন,–নিশ্চয়ই দেব। আমি যা যতটুকু জানি সব বলব।

কর্নেল বললেন,–গোপেন আর ভুতু নামে দুটো লোক আপনার কাছে নাকি আড্ডা দিতে আসত।

শচীনবাবু চমকে উঠে বললেন,–পিসিমা বলেছেন? আসলে কী হয়েছে জানেন, ওরা দুজনেই এলাকার নামকরা বজ্জাত। শুধু বজ্জাত বললে ভুল হবে, ওরা না-পারে এমন কাজ নেই। কিন্তু আমার স্কুললাইফে ওরা দুজনেই আমার সহপাঠী ছিল। সেই সূত্রে রাস্তাঘাটে দেখা হলে কথাবার্তা বলেছি। কিন্তু সম্প্রতি কিছুদিন থেকে ওরা একরকম জোর করেই আমার ঘরে ঢুকে আড্ডা দিত। বাধ্য হয়ে পিসিমাকে বলে ওদের চা খাওয়াতে হতো। তারপর ক্রমে-ক্রমে বুঝতে পারলুম, আমার কাছে ওদের আসার একটা উদ্দেশ্য আছে। আমার ধারণা হয়েছিল সম্ভবত সরল সাদাসিধে সন্ন্যাসীটাইপ মানুষ আমার কাকা হয়তো কথায়-কথায় ওদের কাছে জানিয়ে দিয়েছেন, আমাদের পূর্বপুরুষের একঘড়া সোনার মোহর কোথায় পোঁতা আছে, তার খবর তার জানা।

কর্নেলসাহেব, এই কথাটা আমার আপনার কাছে যাওয়ার আগেই মাথায় এসেছিল, কারণ হঠাৎ করে পাগলা বিনোদের মড়া দেখা নিয়ে গুজব আর রাতবিরেতে আমাদের বাড়িতে ভূতুড়ে উৎপাত কেন হচ্ছে। আপনার কাছ থেকে ফিরে এসে যখন আমাদের মন্দিরের হাড়িকাঠের কাছে রক্ত দেখতে পেলুম, তখনই বুঝলুম আমার কাকা হয়তো মোহর ভরতি ঘড়াটা কোথায় আছে তা দেখিয়ে দেয়নি বলেই তাকে ভুতু আর গোপেন মিলে খুন করেছে। তারপর বডিটা গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে। কিন্তু আমি ভুতু আর গোপেনের নাম সাহস করে পুলিশকে বলতে পারিনি। ওদের ভালো চেনে, তাই পিসিমাও মুখ বুজে থেকেছে।

হালদারমশাই বললেন,–ওদের মধ্যে একজনের কি একটা চক্ষু নাই?

শচীনবাবু আবার চমকে উঠে বললেন,–ভুতুর একটা চোখ জন্ম থেকেই নেই। কিন্তু আপনি কেমন করে জানলেন?

আমি বললুম,–আপনি ভুলে গেছেন, উনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। কাজেই উনি এখানে এসেই এখানে-ওখানে ওত পেতে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

কর্নেল বলে উঠলেন,–ভুতু আর গোপেনের না কি ডাকাতের দল আছে?

শচীনবাবু চাপাস্বরে বললেন,–ছিল। থানায় নতুন ওসি আসার পর থেকে এ-এলাকা ছেড়ে ওদের দলের লোকেরা শুনেছি পালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভুতু আর গোপেনের একজন শক্ত গার্জেন আছে। তাই তারা এখনও বেপরোয়া হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবশ্য ওরা তেমন সাংঘাতিক কাজ করে ফেললে নতুন ওসি ওদের রেহাই দেবেন বলে মনে হয় না।

কর্নেল জিগ্যেস করলেন,–সেই প্রভাবশালী গার্জেন কী করেন? তার নাম কী?

শচীনবাবু আবার চাপাস্বরে বললেন,–এসব কথা কানে গেলে লোকটা উলটে আমাকেই পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবে।

কর্নেল একটু বিরক্ত হয়ে বললেন,–আহা, আমি জানতে চাইছি, সে কে? কী করে?

শচীনবাবু এবার ফিসফিস করে বললেন, তার নাম মনীন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী। তিনি এই চণ্ডীবাবুদেরই জ্ঞাতি। কিন্তু চণ্ডীবাবুর ঘোর শত্রু। উনি এখানকার একটা রাজনৈতিক দলের নেতা।

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। এবার বলুন আপনাদের দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি, অ্যাডভোকেট শরদিন্দু চ্যাটার্জির কাছে আপনাদের পূর্বপুরুষের যে দলিলটা আছে, তা কি আপনি কখনও দেখেছেন?

শচীনবাবু বললেন, আমি দেখিনি। বাবাকে একবার শরদিন্দু জেঠু ওটা দেখিয়েছিলেন। বাবা কিছু বুঝতে পারেননি। কিন্তু চণ্ডীকাকুর সঙ্গে আমার অ্যাডভোকেট জেঠুর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব আছে। ছুটি পেলে শরদিন্দু জেঠু এখানে চলে আসেন। চণ্ডীকাকুর বাড়িতেই ওঠেন। উনি একসময়কার নামকরা শিকারি। এখনও বিলে বুনো হাঁস মারতে আসেন।

কর্নেল এবার পকেট থেকে সেই প্রাচীন তুলোট কাগজে নাগরি লিপিতে লেখা দলিলের কপিটা শচীনবাবুর হাতে দিয়ে বললেন, এটা আপনার পূর্বপুরুষের সেই দলিলের কপি।

শচীনবাবু কাগজটা কিছুক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখার পর বললেন, এটা তো কোনও দলিল নয়, কী সব অং বং হং লেখা আছে। কয়েকটা তীর আঁকা আছে।

কর্নেল বললেন,–এটা দেখে আপনার মাথায় কিছু আসছে না?

শচীনবাবু অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন,–না। বাবাও বলেছিলেন কিছুই মাথামুণ্ডু বোঝা যায় না।

কর্নেল তার হাত থেকে কাগজটা ফিরিয়ে নিয়ে পকেটে ভাঁজ করে রাখলেন। তারপর বললেন,–ভুতু এবং গোপেনকে আপনি এই কাগজে যা লেখা আছে তার একটা কপি পৌঁছে দিতে পারবেন? না, শুধু পৌঁছে দিলে হবে না, তাদের বলতে হবে, যে-গুপ্তধনের লোভে আপনার কাকুকে খুন করেছে তারা, এই কাগজটা সেই কাকার কাছ থেকে পাওয়া। এতেই গুপ্তধনের খোঁজ পাওয়া যাবে।

শচীনবাবু অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন,–এটা যদি সত্যি আমাকে পূর্বপুরুষের লেখা হয়, তাহলে এটা কি ওদের হাতে দেওয়া ঠিক হবে?

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–হবে। ওদের যা বিদ্যে, তাতে ওরা এটা থেকে কোনও সূত্রই বের করতে পারবে না। কিন্তু ওরা যদি সত্যি গুপ্তধন হাতানোর উদ্দেশ্যে আপনার সঙ্গে ভাব জমায়, আর রাত-বিরেতে ভূতুড়ে উৎপাত করে থাকে তাহলে ওরা টোপ গিলবে। অর্থাৎ এটার অর্থ উদ্ধারে কারও সাহায্য নেবে।

শচীনবাবু মাথা নেড়ে বললেন,–না কর্নেলসাহেব, এটা ওদের হাতে দেওয়া ঠিক হবে না। ওরা এটার অর্থ উদ্ধারের জন্যে আমার বা আমার রুগ্‌ণ বাবার ওপর জুলুম চালাবে। সারাবছর তো পুলিশ আমাদের রক্ষা করবে না।

কর্নেল বললেন, তাহলে আমাদের যে-কোনও উপায়ে হোক এই টোপটা ওদের গেলাতে হবে। শচীনবাবু, আপনি বুঝতে পারছেন না, এটা একটা ফাঁদ। ঠিক আছে, আপনি এ-বেলা ভেবে দেখার সময় নিন, তারপর বিকেলের দিকে কিংবা রাত্রে আমাদের জানিয়ে দেবেন। কিন্তু একটা কথা, এ-নিয়ে আপনার পিসিমা বা বাবার সঙ্গে কক্ষনো আলোচনা করবেন না।

শচীনবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন,–আচ্ছা কর্নেলসাহেব, আমাদের বাড়িতে রাতবিরেতে যে পাথরের নুড়িগুলো ছোঁড়া হয়, সেগুলো তো পাহাড়ি মুলুকের নদীতে পাওয়া যায়। ভুতু বা গোপেন কখনও অতদুরে কোথাও গেছে বলে মনে হয় না। তাহলে ওরা ওগুলো পেল কোথায়?

কর্নেল বললেন,–আপনার কাকার ঘর তো পুলিশ সার্চ করেছে। তাঁর ঘরে কি কোনও সন্দেহজনক জিনিস, কিংবা ধরুন ওরকম নুড়ি-পাথর পাওয়া গেছে?

শচীনবাবু আবার চাপাস্বরে বললেন,–পিসিমা একদিন কাকার ঘর পরিষ্কার করতে ঢুকেছিল। কাকা তার ঘরে কাউকে ঢুকতে দিতেন না। ওঁর ঘরে সব নানারকম শাস্ত্রীয় বই আর একটা মড়ার খুলি–এইসব নানারকমের অদ্ভুত-অদ্ভুত জিনিস থাকে। তা একদিন পিসিমা কাকার ঘরে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিল। কাকা দরজায় তালা না দিয়ে বাথরুমে ঢুকেছিলেন। পিসিমা ভেতরে উঁকি মেরে বিছানার পাশে তিনটে ওইরকম ডিমালো নুড়ি দেখতে পেয়েছিলেন। উনি ভেবেছিলেন, ভূতের ঢিলগুলো কুড়িয়ে কাকাই বোধহয় ওখানে রেখেছেন। তাই উনি ঢিল তিনটে কুড়িয়ে নিয়ে রান্নাঘরের পাশের পাঁচিল গলিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছিলেন।

আমি বলতে যাচ্ছিম, কর্নেল সেই তিনটে ঢিল আজ কুড়িয়ে পেয়েছেন। কিন্তু কর্নেল যেন কোনও মন্ত্রবলে সেটা টের পেয়েই একবার আমার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে নিয়ে তারপর বললেন,–হ্যাঁ আপনার পিসিমার পক্ষে ভূতুড়ে ঢিল দেখে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তারপর কি আপনার কাকা এ-ব্যাপারে কোনও হইচই বাধিয়েছিলেন?

শচীনবাবু বললেন,–না, আপনাকে তো আগেই বলেছি, কাকা সন্ন্যাসীটাইপ মানুষ। খামখেয়ালি। আমরাই বলতুম, কাকার মাথায় ছিট আছে। তা ছাড়া একটু মনভোলা স্বভাবের মানুষও ছিলেন।

কর্নেল বললেন,–এবার একটা কথা। আপনার কাকা কি কখনও তীর্থ করতে গেছেন?

শচীনবাবু বললেন, হ্যাঁ। কাকা বছরে অন্তত বার দুই-তিনেক তীর্থ করতে যেতেন। প্রতিবারই আমাদের ভয় হত, উনি হয়তো আর বাড়ি ফিরবেন না। কোনও সাধুর কাছে দীক্ষা নিয়ে হিমালয়ে গিয়ে বাস করবেন। কিন্তু কাকা ফিরে আসতেন, তারপর তীর্থের গল্প শোনাতেন।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন,–ঠিক আছে। আপনি বাড়ি ফিরে গিয়ে চিন্তাভাবনা করে দেখুন। আমার কথা মতো ওই কাগজের একটা কপি ভুতু আর গোপেনকে দেবেন কি না। এটা কিন্তু খুব জরুরি।

শচীনবাবু উদ্বিগ্ন মুখে বেরিয়ে গেলেন। তার হাতে সেই মোটা লাঠির মতো ছড়িটা ছিল। সেটাতে ভর দিয়ে খোঁড়াতে-খোঁড়াতেই বেরিয়ে গেলেন।

হালদারমশাই উঠে গিয়ে দরজায় উঁকি মেরে শচীনবাবুর প্রস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ফিরে এলেন। তারপর উত্তেজিতভাবে বললেন,আমি এবার শচীনবাবুরে সুযোগ পাইলেই ফলো করুম। ভদ্রলোকেরে আমার আর সরল মানুষ ঠেকত্যাসে না।

জিগ্যেস করলুম,–কেন বলুন তো?

হালদারমশাই বললেন,–সেই একচক্ষু ভুতু আর তার লগে গোপেনেরে আমি কথা কইতে দেখসি। একচক্ষু বজ্জাতটা শচীনবাবুগো বাড়ির পাশ দিয়া বাহির হইয়া হনহন কইর‍্যা আমবাগানের ভেতর দিয়া যাইত্যাসিল। এখন মনে হইতাসে বাড়ির পেছন দিকে কোথাও ওই একচক্ষু লোকটা শচীনবাবুর লগে গোপনে পরামর্শ করত্যাসিল। অগো তিনজনের মইধ্যে যোগাযোগ আছে। অরা তিনজনে একখান ত্রিভুজ।

কর্নেল সহাস্যে বললেন, আপনার এই ত্রিভুজতত্ত্ব উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আমি বললুম,–এযাবৎকালে গুপ্তধন নিয়ে কয়েক ডজন রহস্যের সমাধান কর্নেল করেছেন। গুপ্তধন কোথাও পাওয়া যায়নি, তা ঠিক। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে সত্যি-সত্যি চাটুজ্যেবাড়ির কোথাও-না-কোথাও সোনার মোহর ভরতি একটা ঘড়া পোঁতা আছে। ওই কাগজটার মধ্যেই তার সংকেত আছে।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–তোমাকে একটা কপি দেব, তুমি চেষ্টা করে দেখতে পারো গুপ্তধনের জায়গাটা খুঁজে বের করতে পারো কি না।

চণ্ডীবাবু এতক্ষণে ঘরে ঢুকলেন। হাসতে-হাসতে বললেন,–শচীনের মুখ-চোখ দেখে মনে হল ওকে আপনি ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। আমাকে খুলে কিছু বলল না, শুধু গোমড়া মুখে একটা কথা বলল, ওবেলা সে সন্ধ্যার দিকে কর্নেলসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসবে।

কর্নেল বললেন,–আচ্ছা মিস্টার রায়চৌধুরী, শচীনের মুখে শুনলুম, আপনাদের এক জ্ঞাতি মণীন্দ্র রায়চৌধুরী

চণ্ডীবাবু কর্নেলের কথার ওপর বললেন,–শচীন কি মণি সম্পর্কে কিছু বলছিল?

কর্নেল বললেন,–তিনি নাকি একটা রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা। আপনাদের সঙ্গে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। একচোখা ভুতু আর গোপেন নাকি তার চ্যালা।

চণ্ডীবাবু বিকৃতমুখে বললেন,–মণি রায়চৌধুরি বংশের কলঙ্ক। আমার ঠাকুরদার বৈমাত্রেয় ভাইয়ের পৌত্র সে। কাজেই রক্তের সম্পর্ক আছে তা বলা যায়ই। কিন্তু তার রাজনৈতিক দল তার কাজকর্মে খুব অসন্তুষ্ট। তা ছাড়া খুলেই বলি, আমি রাজনীতি করি না, কিন্তু মণি এক-একসময় এমন সব সাংঘাতিক কাজ করে যে তার মা গোপনে এসে আমার সাহায্য চায়। আমার মা বেঁচে নেই, কিন্তু মণির মাকে আমি নিজের মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করি।

এই সময় কার্তিক দরজায় উঁকি মেরে বলল,–ঠাকুরমশাই বাজার থেকে ফিরে বললেন, ভুতো আর গোপেনকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে।

.

সাত

ভুতু আর গোপেনকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে শুনেই হালদারমশাই খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন, –আমি ঠিক দেখসিলাম, ওরা দুইজনে কোনও প্ল্যান আঁটতাসে। পুলিশের সোর্স থাকে। তা তো আপনারা জানেন। এই সোর্সই ওগো ধরাইয়া দিসে।

কিন্তু খবরটা শুনে চণ্ডীবাবু তখনই থানায় ফোন করতে গিয়েছিলেন। কর্নেলকে বলেছিলুম,–এবার থানার ওসি ওদের পেটের কথা সব বের করে নেবেন। মাঝখান থেকে আপনি নিজের কৃতিত্ব দেখানোর সুযোগ হারালেন।

কর্নেল মিটিমিটি হসে বলেছিলেন,জয়ন্ত, তোমাকে বরাবর বলে আসছি ন্যায়শাস্ত্রের অপভাষ তত্ত্বের কথা। ইংরেজিতে যাকে বলে হোয়াট অ্যাপিয়ার্স ইজ নট রিয়েল।

কিছুক্ষণ পরে চণ্ডীবাবু ফিরে এসে হাসতে-হাসতে বলেছিলেন,–মণির এক আজব কীর্তি। সে-ই পুলিশের কাছে তার দুই বিশ্বস্ত চ্যালার নামে অভিযোগ করেছিল, তারা তার প্রিয় অ্যালসেশিয়ান কুকুরটাকে চুরি করে না কি বেচে দিয়েছে। চুরি করার সাক্ষীও আছে। তবে ওসি আমাকে বললেন, কর্নেল সাহেবকে খবরটা দেবেন। কুকুর চুরির ব্যাপারটা নিশ্চয়ই কর্নেলের একটা মোক্ষম কু হয়ে উঠবে।

কর্নেল সহাস্যে বলেছিলেন–কুকুর চুরির কারণটা আপনাদের বোঝা উচিত।

কথাটা শুনেই চণ্ডীবাবু চমকে উঠে বলেছিলেন,–শচীনদের মন্দিরের সামনে হাড়িকাঠের কাছে পড়ে থাকা রক্ত পরীক্ষা করে কলকাতার ফোরেনসিক এক্সপার্টরা রায় দিয়েছেন ওগুলো মানুষের রক্ত নয়।

হালদারমশাই গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন। এবার বলে উঠলেন,–কী কাণ্ড! অ্যালসেশিয়ান কুকুরটাকে তাহলে ওই একচক্ষু ভুতু আর গোপেন মন্দিরের সামনে বলি দিয়েছিল। ঠিক কইসি কি না কন কর্নেলসাহেব।

কর্নেল সায় দিয়ে বলেছিলেন,–আপনি ঠিক ধরেছেন হালদারমশাই। রাত্তিরবেলা পথের কুকুর ধরা কঠিন কাজ। তার চেয়ে পোষা কুকুর কোলে তুলে নিয়ে এসে ইচ্ছেমতো তাকে ব্যবহার করা যায়। বেচারা জানত না তাকে ওরা বলি দেবে।

আমি বলেছিলুম,–কুকুর বলি দিয়ে রক্ত ছড়ানোর উদ্দেশ্য কী? কুকুরের বডিটা নিশ্চয়ই গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে। ফরাক্কার ফিডার ক্যানেলের জলে এখন গঙ্গা বারোমাসই কানায়-কানায় ভরা। তোতও তীব্র। কাজেই কুকুরের লাশ এতক্ষণ বহুদূরে পৌঁছে গেছে। কোথাও আটকে গেলে আলাদা কথা।

হালদারমশাই বলেছিলেন,–এতক্ষণ লাশের কিস্যু নাই। শকুনের পাল কুত্তাটা বেবাক খাইয়া ফেলসে।

কেন দুই স্যাঙাত মিলে তাদের গার্জেনের পোষা কুকুর ওখানে বলি দিলো, সেই প্রশ্নের উত্তর আমি কর্নেলের মুখ থেকে আদায় করতে পারিনি। চণ্ডীবাবু বা হালদারমশাইও কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তবে আমার মনে হয়েছিল শচীনবাবুর ছোটকাকা মহীনবাবুকে নিশ্চয়ই ওরা কোথাও আটকে রেখে গুপ্তধনের খোঁজ পেতে চেয়েছিল।

দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর কর্নেল আমাকে ভাত-ঘুমের সুযোগ দেননি।

ওদিকে হালদারমশাই এবার আরও উত্তেজিত হয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তখন বেলা প্রায় আড়াইটে বাজে। কর্নেল আমাকে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতে বললেন। তারপর পকেট থেকে সেই অং বং লেখা কাগজটা বের করলেন। তার প্রকাণ্ড ব্যাগটা থেকে একটা প্যাড বের করে বললেন,–এসো, এই সঙ্কেতগুলোর কোনও সমাধান বের করা যায় কি না দেখি। তোমার মাথায় কিছু এলে আমাকে বলবে। জয়ন্ত এটা কোনও হাসির ব্যাপার নয় কিন্তু।

আসলে আমি তার গাম্ভীর্য দেখে হেসে ফেলেছিলুম। প্যাডটা সেন্টার টেবিলে রেখে হাতে একটা ডট পেন নিলেন। তারপর সেই কাগজটা খুলে পাশে রাখলেন।

কর্নেল বললেন,–ধরা যাক মং-টা মন্দির। কারণ অম্লং থেকে শুরু করলে কিছু বোঝা যাবে না। মং-কে যদি মন্দির ধরি, তাহলে পাঁচ হাত এগোতে হবে মন্দিরের উলটো দিকে। সেটা পেছনের দিক হতে পারে, আবার সামনের দিকও হতে পারে। ধরা যাক মন্দিরটা শচীনবাবুদের শিবমন্দির। মন্দিরের পেছনে কিন্তু পাঁচ হাত জায়গা নেই। অতএব পুকুরের দিকে পাঁচ হাত এগিয়ে যাওয়া যাক। তারপর বাঁ-দিকে দশ হাত এগিয়ে গেলুম-কেমন। তারপর পাঁচ হাত পুকুরের দিকে আবার এগুলুম। এরপর সেখান থেকে ডান দিকে দশ হাত এগুনো যাক। সেখানে আমরা পাচ্ছি অম্লং-কে।

বললুম,–আপনি হং মানে হস্ত ধরছেন?

কর্নেল বললেন,–তীরচিহ্ন দেখে তাই মনে হচ্ছে।

বললুম,–বেশ তো, এবার অম্লং-টা কী?

কর্নেল টাকে হাতে বুলিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকার পর বললেন,–অম্লং বলতেই একটা স্বাদের কথা আসে। অর্থাৎ টক। এখন টক তো কোনও বস্তু হতে পারে না। একটু ভেবে বলো তো জয়ন্ত, পাড়াগাঁয়ে টক বলতে মনে কী ভেসে ওঠে?

বললুম,–টমাটো।

কর্নেল হাসতে-হাসতে বললেন,–ধরা যাক দলিলটা পাঁচশো বছরের নয়, ওটা হয়তো বাড়িয়ে বলা হচ্ছে, কিন্তু টমাটো এদেশে এনেছে পর্তুগিজরা। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, টমাটো তো স্থায়ী কিছু নয়। চাটুজ্যে বাড়িতে টমাটো চাষ কল্পনা করা যায় না।

আমি বলে উঠলুম,–তাহলে অম্লটা কোনও তেঁতুলগাছ নয় তো?

কর্নেল হেসে উঠলেন,–তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ, কিন্তু পাঁচশো কেন দুশো-তিনশো বছরও। কোনও তেঁতুলগাছের আয়ু হতে পারে না।

বলে কর্নেল প্যাডের কাগজটা টেনে নিলেন, এবং মূল কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে ঢোকালেন। প্যাডের কাগজটাও ছিঁড়ে নিলেন। কারণ, এতে ব্যাপারটার ব্যাখ্যা লেখা হয়েছে। দ্বিতীয় কাগজটা এনে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে অ্যাশট্রেতে ঢোকালেন। তারপর তার ওপর নিভে আসা চুরুটটা ঘষটে অ্যাশট্রেতে ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর বললেন,–উঠে পড়ো, বেরুনো যাক।

বললুম,–চণ্ডীবাবুকে সঙ্গে নেবেন না?

কর্নেল বললেন,–না। উনি সম্ভবত তোমার মতো ভাত-ঘুম দিচ্ছেন।

দুজন পোশাক বদলে নিলুম। কর্নেলের নির্দেশে প্যান্টের পকেটে আমার অস্ত্রটা ভরে নিলুম। কর্নেল ওপাশের দরজা খুলে বেল টিপে কার্তিককে ডাকলেন। তখনই কার্তিক এসে হাজির হল। কর্নেল জিগ্যেস করলেন,–তোমার কর্তামশাই কি ঘুমোচ্ছেন?

কার্তিক বলল,–আজ্ঞে না। উনি আধঘণ্টা আগে বেরিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, আপনারা কোথাও যেতে চাইলে আমি যেন ড্রাইভারকে ডেকে দিই।

কর্নেল বললেন,–না, আমরাও তোমার কর্তামশাইয়ের মতো পায়ে হেঁটে বেরুব। তুমি দরজায় তালা লাগিয়ে রাখো।

গেট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে কর্নেল দক্ষিণ দিকে হাঁটতে থাকলেন। সেই সময় সামনের দিক থেকে একটা খালি সাইকেলরিকশা আসছিল। রিকশাওয়ালা নিজে থেকেই থেমে গিয়ে বলল,–সাহেবরা যাবেন নাকি?

কর্নেল ঘড়ি দেখে নিয়ে চাপাস্বরে বললেন,–শীতের রোদ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। রিকশা করেই যাওয়া যাক।

রিকশায় চেপে তিনি বললেন, আমরা যাব চাটুজ্যেমশাইদের বাড়ি।

রিকশাওয়ালা মুখ ঘুরিয়ে সন্দিগ্ধভাবে বলল,–যে বাড়িতে মানুষ খুন হয়েছে—

তার কথার ওপর কর্নেল বললেন,–হ্যাঁ। তবে তোমার ভয় নেই, তুমি খুন হবে না।

রিকশাওয়ালা হাসবার চেষ্টা করে বলল,–আজ্ঞে না স্যার। আমি কারুর সাতে-পাঁচে থাকি না, আমাকে কে খুন করবে?

কর্নেল বললেন,–চাটুজ্যেবাড়ির মহীনবাবুও তো শুনেছি কোনও সাতে-পাঁচে থাকতেন না। সাধু-সন্ন্যাসীর মতো জীবন কাটাতেন। তিনি খুন হলেন কেন?

রিকশাওয়ালা এবার ভয়ার্ত কণ্ঠস্বরে বলল,–সাহেবরা কি ওনাদের আত্মীয়?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। শচীনমাস্টার সম্পর্কে আমার ভাইপো হন।

রিকশাওয়ালা এবার বাঁ-দিকে মোড় নিল। দু-ধারেই ইটের বাড়ি। মাঝে-মাঝে মাটির বাড়ি। এটা গলি রাস্তা। লোক চলাচল খুব কম। রিকশাওলা আপন মনে বলল,–এ-সংসারে মানুষ চেনা বড় কঠিন। ভালোমানুষ কি কখনও খুন হয়?

কর্নেল বললেন,–তাহলে কি তুমি বলতে চাও, মহীনবাবু ভালোমানুষ ছিলেন না?

রিকশাওয়ালা অদ্ভুত শব্দে হাসল। বলল,–ভালোমানুষ হলে কি সে বজ্জাতদের সঙ্গে গাঁজার কলকে টানে?

–কোন বজ্জাতের সঙ্গে উনি গাঁজা খেতেন?

–আপনি চিনবেন না স্যার। দুই বজ্জাতকেই আজ পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। মণি রায়চৌধুরী দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষেছিলেন।

কর্নেল হঠাৎ চুপ করে গেলেন। আমার মনে হল উনি রিকশাওয়ালাকে মনের কথা খুলে বলার সুযোগ দিচ্ছেন। একটু পরে বুঝলুম ঠিক তাই। লোকটা আপনমনে কথা বলতে-বলতে প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে।

–অমন একখানা তাগড়াই কালো রঙের বিলিতি কুকুর ছিল মণিবাবুর। তাকে চুরি করে কোথায় বেচে দিয়ে এসেছে। মণিবাবু কি সহজে ছাড়বেন? এদিকে থানার বড়বাবুও উঁদে দারোগা। কত দাগি ওঁর ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে! কানাভুতু আর গুপে সিংঘিকে কাপড়ে-চোপড়ে করে ছাড়বেন।

অলিগলি ঘুরতে-ঘুরতে রিকশাওয়ালা শর্টকাটেই আমাদের চাটুজ্যেবাড়ির সামনে পৌঁছে দিল।

কর্নেল তার হাতে একটা দশ টাকার নোট গুঁজে দিলেন। সে বলল, আমার কাছে খুচরো তো নেই স্যার।

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। তোমাকে পুরো টাকাটাই বকশিশ দিলুম।

সে সেলাম করে চলে গেল। বুঝতে পারলুম বিকেল হয়ে আসছে, আলো কমে গেছে। সম্ভবত পাগলা বিনোদের জ্যান্ত মড়ার ভয়েই লোকটা যেন পালিয়ে গেল।

কর্নেল দরজার কড়া নাড়তেই দরজা খুলে গেল। দেখলুম শচীনবাবু তার গাবদা ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখে যেন অবাক হলেন। বললেন, আমি এখনই আপনাদের কাছে যাচ্ছিলুম। ভেতরে আসুন স্যার। আমরা ভেতরে ঢুকলে তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন,–ভুতু আর গোপেনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে শুনলুম। তবে আমাদের কেসের ব্যাপারে নয়। ওরা নাকি মণি রায়চৌধুরীর অ্যালসেশিয়ানটাকে চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছে।

কর্নেল বললেন, আপনার পিসিমা কী করছেন?

–পিসিমা বাবার পা টিপে দিচ্ছেন।

–ঠিক আছে। চলুন আমরা একবার মন্দিরের দিকে যাই।

শচীনবাবু খোঁড়াতে-খোঁড়াতে এগিয়ে গিয়ে মন্দিরের দিকের দরজা খুলে দিলেন। একবার পিছু ফিরে দেখলুম বাসন্তী দেবী বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন।

মন্দিরের সামনে গিয়ে কর্নেল বললেন,–আচ্ছা শচীনবাবু, আপনাদের এই বাড়ির কোথাও কি কোনও বিশাল গাছ ছিল, এমন কথা শুনেছেন?

আমাদের পেছন দিকে খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে বাসন্তী দেবী বলে উঠলেন,–তেঁতুলগাছ? ছোটবেলায় ঠাকমার কাছে শুনতুম, কোন যুগে নাকি কামরূপ কামাক্ষা থেকে এক ডাকিনি একটা তেঁতুলগাছে চড়ে গঙ্গাদর্শনে যাচ্ছিলেন। এ-বাড়ির সীমানায় যেই সে এসেছে, অমনি নাকি সূর্য উঠেছিল। দিনের বেলায় নাকি ডাকিনিদের বাহন গাছ আর উড়তে পারে না। সূর্যের ছটা দেখলেই সেইখানে শিকড় গেঁথে দাঁড়িয়ে যায়।

শচীনবাবু বললেন,–হা-হা মনে পড়েছে। সেই তেঁতুল না কি খাওয়া যেত না। ভাঙলেই রক্ত বেরুত। তবে সেসব নেহাতই বাজে গপ্পো।

ততক্ষণে কর্নেল পিঠের কিট ব্যাগ থেকে একটা গোল ফিতের কৌটো বের করে একদিকটা টেনে আমাকে বললেন,–জয়ন্ত, এই ডগাটা ধরো। মন্দিরের ঠিক মাঝামাঝি বারান্দার গায়ে এটা ধরে থাকো। আঠারো ইঞ্চিতে এক হাত, অতএব পাঁচ বা দশ হাতের হিসেব করতে অসুবিধে নেই।

বলে তিনি পকেট থেকে ভাঁজ করা সেই কাগজটা শচীনবাবুকে দিলেন। শচীনবাবু খুলে দেখে বললেন,–এটা সেই পুরোনো দলিল দেখছি।

এরপর কর্নেলের কাণ্ড দেখে শচীনবাবু আর তার পিসিমা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কর্নেল তারপর সামনে এক জায়গায় থামলেন। তারপর বাঁ-দিকে এগিয়ে গেলেন এবং আমাকে বললেন,–এবার ফিতেটা তুমি ওই দাগ দেওয়া জায়গায় ধরে রাখো। তারপর তার যে মাপজোক শুরু হল, তা চণ্ডীবাবুর ঘরে বসে কর্নেল একটা প্যাডের পাতায় লিখে ছিঁড়ে ফেলেছেন। তাঁর মাপজোক শেষ হল যেখানে, সেখানে চাটুজ্যেবাড়ির পাঁচিল। পাঁচিলের নীচে একটা ইটের টুকরো কুড়িয়ে তিনি দাগ দিলেন।

শচীনবাবু বললেন,–কিছুই তো বুঝতে পারছি না কর্নেলসাহেব।

কর্নেল বললেন–চলুন। বাড়ির ভেতরে এই পাঁচিলের নীচের দিকটা একবার পরীক্ষা করব। জয়ন্ত, তুমি ওই চিহ্নের সোজাসুজি দাঁড়িয়ে পাঁচিলের ওপর একটা হাত তুলে রাখবে। তাহলে আমি বুঝতে পারব পাঁচিলের ভেতর দিকে ওপাশে: চিহ্নটা কোথায় পড়বে।

আমি হাত তুলে দাঁড়িয়ে রইলুম। কর্নেল ভে… ণেলেন। তার সঙ্গে শচীনবাবু এবং তাঁর পিসিমাও গেলেন। একটু পরে কর্নেল ডাকলেন,–চলে এসো জয়ন্ত। আমার কাজ শেষ।

ভেতরে গিয়ে দেখলুম, তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে একটা জবাফুলের ঝোঁপ। রক্তজবায় ঝোঁপটা লাল হয়ে আছে।

কর্নেল বললেন,–আশ্চর্য! এখানে দেখছি জবা গাছটার গোড়ায় ঘাসের ভেতরে কয়েকটা নুড়ি-পাথর পড়ে আছে। কিন্তু তার চেয়েও আশ্চর্য, দেওয়ালের নীচে এই অংশে সিঁদুরের ছোপ।

বাসন্তী দেবী বলে উঠলেন,–মহীনের কীর্তি। প্রায়ই দেখতুম, ওখানে বসে সে করজোড়ে যেন ধ্যান করছে।

কর্নেল বললেন,–এই নুড়িগুলো যেমন আছে, তেমনি পড়ে থাক। আর আপনাদের একটা কথা বলতে চাই। মহীনবাবুকে কেউ খুন করেনি। তিনি কোথাও আছেন। হয়তো তাকে আটকে রাখা হয়েছে, অথবা তিনি নিজেই আত্মগোপন করেছেন।

বাসন্তী দেবী এবং শচীনবাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

.

আট

বাসন্তী দেবী এবং শচীনবাবুকে আর কথা বলার সুযোগ না-দিয়ে কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, –চলো জয়ন্ত, আমাদের এখানকার কাজ শেষ। শচীনবাবু, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন। আশা করি ভূতের উপদ্রব আর হবে না।

রাস্তায় বেরিয়ে গিয়ে কর্নেল চাটুজ্যেবাড়ির উত্তরের পাঁচিলের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলেন। তিনি আমার কোনও প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। এই রাস্তাটা সংকীর্ণ এবং ইটের গুড়োয় ভরতি। দেখলুম বাঁ-ধারে একটা নতুন বাড়ি উঠছে। সেখানে কেউ নেই। কর্নেল আরও একটু এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ একটা প্রকাণ্ড নিমগাছের আড়ালে আমাকে টেনে নিয়ে দাঁড় করালেন। নিমগাছটা চাটুজ্যেবাড়ির দেওয়ালের উত্তর-পূর্ব কোণে। সামনে খানিকটা পোড়ো জমি, তার ওপাশে পুরোনো একটা বাড়ি। সেই বাড়ির দিকে তাকিয়ে কর্নেল চাপাস্বরে বললেন,–একটু লক্ষ রাখো। একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পাবে।

কর্নেলের কথা শুনে ভেবেই পেলুম না কখন উনি অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পেলেন। এবং সেই ব্যাপারটা আবার যে ঘটবে, তাই বা কী করে বুঝলেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। আমি কর্নেলের মতো হাঁটু গেড়ে বসে তাকিয়ে রইলুম। তারপর দেখলুম একটা লোক ওই বাড়িটা থেকে কয়েক পা বেরিয়ে এসে চাটুজ্যেবাড়ির দিকে তাকিয়ে কী দেখল। তারপর আবার সেই বাড়িতে গিয়ে ঢুকল। দিনের আলো কমে এসেছে, তবু লোকটার চেহারা দেখেই বুঝতে পারলুম সে একজন সাধুবাবা। তার মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা, মুখে একরাশ কাঁচা-পাকা গোঁফ-দাড়ি। গায়ে একটা গেরুয়া হাফ-হাতা ফতুয়া। পরনে খাটো গেরুয়া লুঙ্গি। লোকটার হাবভাব দেখে মনে হল সম্ভবত সে একজন পাগল। তা না-হলে আমরা তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই অন্তত বার তিনেক ওইভাবে বাড়িটা থেকে বেরুল, আবার যেন কিছু দেখে হন্তদন্ত হয়ে সেই বাড়িতে গিয়ে ঢুকল। তারপর আরও কিছুক্ষণ আমরা বসে রইলুম, কিন্তু সে আর বেরুল না।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে আঙুল রেখে আমাকে চুপ করে থাকার ইঙ্গিত করলেন। তারপর যেদিক থেকে এসেছিলুম, সেদিকেই দুজনে ফিরে চললুম। চাটুজ্যেবাড়ির সামনের রাস্তায় পৌঁছে এবার ডানদিক ঘুরে দুজনে এগিয়ে চললুম। এই পথেই রিকশাওয়ালা আমাদের নিয়ে এসেছিল। কিন্তু পাড়াটা একেবারেই নিঝুম এবং রাস্তাঘাটে কোনও লোক নেই। কর্নেল রিকশাওয়ালার মতো শর্টকাট না-করে সোজা এগিয়ে যাচ্ছিলেন। রাস্তাটায় কবে পিচ দেওয়া হয়েছিল। এখন এখানে-ওখানে পিচ উঠে গেছে। বললুম,–আমরা এ-পথে গিয়ে কোথায় পৌঁছুব?

কর্নেল বললেন,–যেখানে তোক পৌঁছুব, চিন্তু করো না। এবার আমাকে প্রশ্ন করো।

জিগ্যেস করলুম,–ওই সাধুবাবা সম্পর্কে?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ।

বললুম,–আপনি কী করে জানলেন, ওই বাড়িতে এক সাধুবাবা থাকে?

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–আজ সকালের দিকে চাটুজ্যেবাড়ির পাঁচিলে যখন ভূতের মুখোশ পরা লোকটার দিকে ছুটে গিয়েছিলুম। তখনই আমার চোখে পড়েছিল পোড়ো জমিটার ওখানে ওই সাধুবাবা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তখন সঙ্গে চণ্ডীবাবু ছিলেন। তার সামনে ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিলুম।

অবাক হয়ে বললুম,–সর্বনাশ, আপনি চণ্ডীবাবুকেও সন্দেহ করেন নাকি?

কর্নেল বললেন, তুমি তো জানোনা, খেলতে নেমে কখনও আমি নিজের হাতের তাস কাউকেই দেখাই না। এমনকি তোমাকেও না।

এতক্ষণে চোখে পড়ল কিছুটা দূরে রাস্তার একটা বাঁক থেকে একটা গাড়ি এদিকে আসছে। কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে বললেন,–ওই দ্যাখো চণ্ডীবাবুর নাম করতে-করতেই উনি আমাদের খোঁজে ছুটে আসছেন।

গাড়িটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। চণ্ডীবাবু নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন,–কর্নেলসাহেবের খোঁজে বেরিয়েছিলুম। একমিনিট, আমি গাড়িটা ঘুরিয়ে নিই।

বাঁদিকে একটা গলিরাস্তা ছিল। তিনি সেখান দিয়ে গাড়িটা ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর কর্নেল সামনের সিটে এবং আমি ব্যাক সিটে বসলুম। কর্নেল বললেন, আপনি ছিলেন না, অগত্যা আমি আর জয়ন্ত বেরিয়ে পড়েছিলুম। আমাদের হালদারমশাই কি ফিরেছেন?

চণ্ডীবাবু বললেন, না। তার জন্য আমি উদ্বেগ বোধ করছি। কানা ভুতু আর গুপে পুলিশের হাজতে। এতে তাদের বন্ধুরা নিশ্চয়ই রাগে ফুঁসছে। দৈবাৎ তাদের পাল্লায় পড়লে মিস্টার হালদার আক্রান্ত হতে পারেন।

কর্নেল বললেন, আপনি কি ওসি মিস্টার সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন?

চণ্ডীবাবু বললেন,–হ্যাঁ। ওরা বাধ্য হয়ে স্বীকার করেছে মণির কুকুরটাকে ওরা স্বপ্নে বাবা মহাদেবের আদেশ পেয়ে, তার সামনে বলি দিয়েছে। তারপর ধড় আর মুণ্ডু গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে।

কর্নেল জিগ্যেস করলেন,–ওসি কি মণিকে একথা জানিয়েছেন?

চণ্ডীবাবু হাসতে-হাসতে বললেন,–এখনও জানাননি। আমাকেও সতর্ক করে দিয়েছেন। তবে তিনি আপনাকে কথাটা জানাতে বলেছেন।

কিছুক্ষণ পরে ডাইনে-বাঁয়ে সংকীর্ণ রাস্তায় ঘুরতে-ঘুরতে অবশেষে আমরা চণ্ডীবাবুর বাড়ি পৌঁছুলুম। তখন দিনের বোদ প্রায় মুছে গেছে। ঠান্ডাটা বাড়তে শুরু করেছে।

কার্তিক আমাদের ঘরের তালা খুলে দিয়ে বলল,–আপনারা বসুন স্যার। আমি ঠাকুরমশাইকে কফি করতে বলি। আজ ঠান্ডাটা যেন কালকের চেয়ে বেড়ে গেছে।

চণ্ডীবাবু গাড়ি গ্যারেজে রেখে এতক্ষণে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। তারপর সোফায় বসে বললেন,–মিস্টার হালদারের খোঁজে আমি কারুকে পাঠাব নাকি?

কর্নেল বললেন,–থাক। উনি একজন অভিজ্ঞ প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। ওঁর কথা ভাববেন না। আপনাকে এবার একটা কথা জিগ্যেস করি। চাটুজ্যেবাড়ির উত্তরে যে নতুন বাড়িটা হচ্ছে, সেখান থেকে কিছুটা দূরে একটা খুব পুরোনো বাড়ি আছে দেখেছি। ওই বাড়িটা কার?

চণ্ডীবাবু বললেন,–বুঝেছি। ওই বাড়িটার মালিক ছিলেন নলিনী বাঁড়ুজ্যে নামের এক ভদ্রলোক। তিনি দুর্গাপুরে ছেলের কাছে চলে যান। যাওয়ার আগে বাড়িটা দেখাশোনার জন্য হরিপদ হাজরা নামে একটা লোকের ওপর দায়িত্ব দিয়ে যান। হরিপদর বাড়ি পাশেই। গতবছর মণি রায়চৌধুরী তার দলের অফিস করবে বলে বাড়িটা দখল করেছিল। খবর পেয়ে নলিনীবাবু তার নামে মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় তার জয় হয়েছিল। কিন্তু মণি হাইকোর্টে আপিল করেছে। হাইকোর্ট ইনজাংশান দিয়ে বলেছে, যতদিন না মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়, ততদিন ওই বাড়িতে কেউ বাস করতে পারবে না। আসলে নলিনীবাবুর বাড়িটা তার এক জেঠাকমশাইয়ের তৈরি। তাঁর কাছেই নলিনীবাবু ছোটবেলা থেকে থাকতেন। সমস্যা হল জেঠাকমশাই উইল করে তাকে বাড়িটা দিয়ে যাননি।

এই সময় ঠাকুরমশাই প্রকাণ্ড ট্রে এনে সেন্টার টেবিলে রাখলেন। দেখলুম কফির সঙ্গে দু-প্লেট পকৌড়া আছে। অতএব শীত সন্ধ্যায় আরাম করে কফি পান শুরু হল। চণ্ডীবাবু কী বলতে যাচ্ছিলেন, এমনসময় কার্তিক এসে খবর দিল, কর্তামশাই আপনার টেলিফোন এসেছে।

চণ্ডীবাবু কফির কাপ-প্লেট হাতে নিয়েই বেরিয়ে গেলেন।

এই সময়েই কর্নেলকে জিগ্যেস করলুম,চাটুজ্যেবাড়ির পাঁচিলের নীচে জবাগাছের গোড়া খুঁড়লে সত্যিই কি সোনার মোহর ভরতি ঘড়া পাওয়া যাবে?

কর্নেল বললেন,–পাওয়া গেলে অনেক আগেই অন্তত শরদিন্দুবাবু জায়গাটা খুঁড়ে বের করে ফেলতেন। অবশ্য শচীনবাবুরাও তার ভাগ পেতেন।

বললুম,–আপনি ওই সংকেতের জট যেভাবে খুলেছেন, সেই ভাবেই কি অন্য কেউ খুলতে পারেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–একজন অন্তত পেরেছিল। সে হল মহীন চাটুজ্যে। কারণ, তুমি সচক্ষে দেখেছ পাঁচিলের নীচের দিকটা সিঁদুর মাখানো আর নুড়ি পড়ে আছে।

অবাক হয়ে বললুম,–কিন্তু মহীনবাবুর হঠাৎ অন্তর্ধান একটা রহস্যের সৃষ্টি করেছে।

কর্নেল বললেন,–জয়ন্ত তুমি বোঝে সবই, তবে বড্ড দেরিতে। তুমি এখনও বুঝতে পারছ না, ওই পাহাড়ি নদীর নুড়িগুলো কে নিয়ে এসেছিল, এবং কে তা রাতবিরেতে বাড়িতে ছুঁড়ে বাড়ির লোকেদের ভয় দেখিয়েছে। এমনকী, ছাদে উঠেও দাপাদাপি করেছে।

এবার চমকে উঠে বললুম,–কী কাণ্ড! তাহলে কি মহীনবাবুই তার বাড়ির লোকেদের ভূতের ভয় দেখাতেন?

কর্নেল বললেন,–আবার কে? তবে এ-ব্যাপারে তাকে সাহায্য করত কানা ভুতু আর গুপে সিংঘি। তারা শচীনবাবুর কাছে আড্ডা দিতে এসে আসলে মহীনবাবুর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখত। অবশ্য এটা আমার অঙ্ক।

–হঠাৎ আমার চমক জাগল। বললুম,–কর্নেল সেই পুরোনো বাড়িতে যে সাধুবাবাকে দেখলুম, তিনিই মহীনবাবু নন তো?

কর্নেল বলেন, কিছুক্ষণ পরে আবার আমাদের বেরুতে হবে। মনে-মনে তৈরি থাকো। যাওয়ার সময় থানার ওসি মিস্টার সেন এবং পুলিশ ফোর্স আমাদের সঙ্গে থাকবে।

এই সময় কার্তিক এসে বলল,–কর্তামশাই কর্নেলসাহেবকে ডাকছেন। আপনি এখনই আমার সঙ্গে আসুন।

কর্নেল তখনই দ্রুত উঠে গেলেন। আমি চুপচাপ বসে কর্নেলের অঙ্কটাকে নিজের বুদ্ধিমতো কষে দেখার চেষ্টা করলুম। কিন্তু অঙ্কটা বড্ড জটিল। বিশেষ করে মহীনবাবু কেনই বা তাদের পূর্বপুরুষের গুপ্তধনের খবর ওই বজ্জাত কানা ভুতু আর গুপে সিংঘিকে দিতে চাইবেন। তা ছাড়া তিনি তো সাধু-সন্ন্যাসীদের মতো মানুষ। সোনার মোহরে তার লোভ থাকার কথা নয়।

অঙ্কটা কষতে গিয়ে হাল ছেড়ে দিলুম। দেখা যাক কর্নেলের রাতের অভিযান কোথায় গিয়ে পৌঁছায়।

কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ফিরে এলেন। তারপর বললেন,–ওসি প্রণবেশ সেন চণ্ডীবাবুকে ডেকে আমার খবর জিগ্যেস করছিলেন।

বললুম,–তাহলে আপনার প্ল্যান মিস্টার সেনকে জানিয়ে এলেন?’

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। আমার অঙ্ক যদি ঠিক হয়, তাহলে সব রহস্য ফাঁস করে দিয়ে রাত দশটার মধ্যেই ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়তে পারব।

জিগ্যেস করলুম,–চণ্ডীবাবু আমাদের সঙ্গী হবেন তো?

কর্নেল বললেন,–হবেন। তবে উনি আমাদের আগেই বেরিয়ে যাবেন। যেখানে আমরা হানা … দেব, উনি তার কাছাকাছি জায়গায় উপস্থিত থাকবেন। যাই হোক, এখন ওসব কথা নয়।

বলে কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে ধ্যানস্থ হলেন।

সময় কাটতে চাইছিল না। কিন্তু আটটা বাজতে চলল, তখনও হালদারমশাইয়ের পাত্তা নেই। আমি কর্নেলকে কথাটা বললুম। কিন্তু তিনি কোনও জবাব দিলেন না।

সাড়ে-আটটার সময় কর্নেলের নির্দেশে হালকা জ্যাকেটটা খুলে পুরু জ্যাকেট পরে নিলুম। তারপর চণ্ডীবাবু এলেন। দেখলুম তিনি ওভারকোট পরেছেন এবং মাথায় টুপি, মুখে পাইপ। বললুম,–মিস্টার রায়চৌধুরীকে যেন শার্লক হোমস বলে মনে হচ্ছে।

তিনি একটু হেসে বললেন,–হোমসসাহেব কি আমার মতো হাতে রাইফেল নিয়ে ঘুরতেন?

ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। চণ্ডীবাবু আমাদের থানায় পৌঁছে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। দেখলুম ওসি প্রণবেশ সেন কয়েকজন অফিসারসহ থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি কর্নেল এবং আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন,–চলুন বেরোনো যাক।

রাস্তায় বাতিগুলো কুয়াশায় স্নান হয়ে আছে। নির্জন রাস্তা। আঁকাবাঁকা পথে ঘুরতে-ঘুরতে এক জায়গায় গাড়ি থেমে গেল। মিস্টার সেন চাপাস্বরে বললেন,–আর দু-মিনিট। তারপরই লোডশেডিং হবে।

বুঝলুম বিদ্যুৎ অফিসকে বলে রেখেছেন মিস্টার সেন।

তারপর ঠিকই লোডশেডিং হল। রাস্তার আলোগুলো নিভে গেল। কুয়াশা-নামা অন্ধকারে বুঝতে পারছিলুম না কোথায় এসেছি। একটু পরেই জায়গাটা চিনতে পারলুম। আমরা চাটুজ্যেবাড়ির মন্দিরের কাছে এসেছি। একদল পুলিশ বাড়িটার চারদিক ঘিরে ফেলল।

এরপর আমরা কয়েকজন মন্দিরের চত্বরে গেলুম। ঠিক তখনই কানে এল দেওয়ালের ওপাশে ঘসঘস করে চাপা শব্দ হচ্ছে। তারপর কানে এল বাড়ির সদর দরজার দিকে কেউ কড়া নাড়ছে।

শচীনবাবুর কণ্ঠস্বর কানে এল এবং টর্চের আলো দেখতে পেলুম। এদিকে কর্নেল আমাকে কাঁধে হাত রেখে দরজার পাশে গুঁড়ি মেরে বসিয়ে দিয়েছেন। অন্যপাশে মিস্টার সেনও বসেছেন। তারপর হঠাৎ এদিকের দরজাটা খুলে গেল। আবছা দেখলুম একটা লোক বেরিয়ে আসছে। অমনি তার মুখে টর্চের আলো ফেলে ওসি মিস্টার সেন বললেন, শরদিন্দুবাবু, আপনাকে অ্যারেস্ট করা হল।

তারপর একটা ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। ততক্ষণে আরও টর্চের আলো জ্বলে উঠেছে। দেখলুম চণ্ডীবাবুর মতোই ওভারকোট পরা এবং মাথায় হনুমান টুপি পরা তাগড়াই চেহারার ভদ্রলোকের হাতদুটো পেছন দিকে টেনে একজন অফিসার হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। তিনি চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন, কিন্তু তাকে ঠেলতে-ঠেলতে পুলিশ অফিসাররা প্রিজন ভ্যানের দিকে নিয়ে গেলেন।

কর্নেলের পেছনে-পেছনে আমি বাড়িতে ঢুকলুম। তারপর দেখলুম বিকেলে-দেখা সেই সাধুবাবাকে পুলিশ হাতকড়া পরিয়েছে। কর্নেল জবাগাছটার দিকে টর্চের আলো ফেললেন। সেখানে একটা শাবল পড়ে আছে। খানিকটা জায়গায় মাটি খোঁড়া।

শচীনবাবু এগিয়ে এসে বললেন, কী আশ্চর্য! এই সাধুকেই তো একবার সঙ্গে নিয়ে ছোটকাকা আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন।

আমি অবাক হয়ে কর্নেলকে জিগ্যেস করলুম,–তাহলে আপনি যে বলেছিলেন, ওই সাধুবাবাই মহীনবাবু?

কর্নেল বললেন, আমার অঙ্কে এই জায়গায় একটু গণ্ডগোল হয়েছিল, কিন্তু—

বলেই তিনি ওসি মিস্টার সেনকে বললেন,–ওই পুরোনো বাড়িটা পুলিশ ঘিরে রেখেছে তো?

মিস্টার সেন বললেন, হ্যাঁ। চলুন এবার শিগগির সেখানে যাওয়া যাক।

আমরা পাশের গলি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে সেই পোড়ো জমিতে পৌঁছুলুম। ভেতরে একটা ধস্তাধস্তির শব্দ হচ্ছিল। একজন অফিসারের কাঁধের ধাক্কায় এদিকের দরজাটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। তারপর ঘরে ঢুকে টর্চের আলোয় দেখলুম হালদারমশাইয়ের সঙ্গে একটা লোকের মল্লযুদ্ধ হচ্ছে।

হালদারমশাই এবার তাকে ছেড়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন,–কর্নেলস্যার এই হইল গিয়া ঘরের শত্রু বিভীষণ।

এতক্ষণে চণ্ডীবাবু উলটো দিক থেকে দৌড়ে এসে বললেন,–এ কী! মণি তুমি এখানে কেন? তোমার চ্যালারা কোথায়? বুঝেছি, তুমি এখানে আড়ি পেতে বসে চ্যালাদের চাটুজ্যেবাড়িতে হানা দিতে পাঠিয়েছিলে।

ওসি প্রণবেশ সেনের নির্দেশে পুরু সোয়েটার আর হনুমান টুপি পরা এক ভদ্রলোককে একজন অফিসার বললেন, আপনি আমাদের সম্মানিত অতিথি। প্লিজ, রাজনীতির ভয় দেখাবেন না। আমাদের সঙ্গে চলুন।

বলে তাঁর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন।

চণ্ডীবাবু বললেন,–উঠোনের কোণে বেচারা মহীন লুকিয়ে বসেছিল। তাকে কনস্টেবলরা ধরেছে। চলুন সেখানে যাওয়া যাক।

ভেতর দিকের উঠোনে নেমে দেখলুম, দেখতে শচীনবাবুর মতো চেহারার এক ভদ্রলোক বোবার চোখে তাকিয়ে আছেন। এত শীতেও তার গায়ে একটা গেরুয়া ফতুয়া আর পরনে খাটো ধুতি। তিনি চণ্ডীবাবুর দিকে তাকিয়ে কাঁদো-কাঁদো মুখে বললেন,–আমি অতশত কিছু ভাবিনি। শরদিন্দুদা মাঝে-মাঝে আমাকে ডেকে পাঠাতেন, আর বলতেন মণিবাবুর বাড়ি যাবি আর তিনি যা বলবেন, তাই করবি।

কর্নেল বললেন,–তাই আপনি রাতবিরেতে ঢিল ছুঁড়তেন, আর পাগলা বিনোদের মরা সেজে ভয় দেখাতেন।

শচীনবাবুর কাকা মহীনবাবু হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কর্নেল বললেন,–চলো জয়ন্ত, আসুন হালদারমশাই, আশাকরি আপনাকে ঘুসি খেতে হয়নি?

হালদারমশাই হাসবার চেষ্টা করে বললেন, না। আমি দরজায় আস্তে কড়া নাড়সি, আর সে টর্চের আলোয় আমারে দেইখ্যা ঝাপাইয়া পড়সে।

সে-রাত্রে চণ্ডীবাবুর বাড়িতে গিয়ে কফি খেতে-খেতে কর্নেলকে জিগ্যেস করেছিলুম,–সোনার মোহর ভরতি ঘড়াটা উদ্ধার করবেন না?

কর্নেল কিছু বলার আগেই চণ্ডীবাবু বললেন,–ওই কাজটা পুলিশের। সত্যি ওখানে সোনার মোহর ভরা ঘড়া পোঁতা আছে কি না তা পুলিশ খুঁজে দেখবে। আইন অনুসারে সত্যি সেটা পাওয়া গেলে তার মালিক হবে দেশের সরকার। কারণ ওটা পুরাসম্পদ।

এবার শেষ কথাটা বলে ফেলি। আমরা কলকাতায় ফিরে যাওয়ার পর চণ্ডীবাবু কনেলকে টেলিফোনে জানিয়েছিলেন, দশ-বারো ফিট খুঁড়েও ওখানে কিছু পাওয়া যায়নি। তবে গর্তের একপাশে কিছুটা জায়গা দেখে পুলিশের মনে হয়েছে, ওখানে সত্যি গোলাকার কিছু পোঁতা ছিল, কোন যুগে কেউ হাতিয়ে নিয়েছে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments