Friday, April 19, 2024
Homeগোয়েন্দা গল্পকিশোর গোয়েন্দা গল্প: জিনের বাদশা রহস্য

কিশোর গোয়েন্দা গল্প: জিনের বাদশা রহস্য

কিশোর গোয়েন্দা গল্প: জিনের বাদশা রহস্য

আমার মাসুদ মামা এই দুনিয়ার সবচেয়ে বোকা লোক। তিনি নিজেকে একজন গোয়েন্দা হিসেবে দাবি করেন। নিজেকে তিনি ভাবেন মাসুদ রানা। নিজের নামে একটা ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়েছেন, সেখানে পরিচয় লেখা, মাসুদ রানা, প্রাইভেট ডিটেকটিভ। মামার নাম মাসুদুর রহমান। ডাক নাম মাসুদ। রানাটা তিনি নিজেই যোগ করে নিয়েছেন। তিনি যখন তাঁর ভিজিটিং কার্ড কাউকে বের করে দেন, লোকেরা হাসে। বলে, আপনিই সেই মাসুদ রানা?

তিনি গম্ভীর মুখে বলেন, জি! আমিই সেই। টানি সবাইকে, কাউকে জড়াই না।

কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে আপনার কখনো দেখা হয়েছিল?

জি না।

দেখা করেন নাই কেন? আপনি মাসুদ রানা পছন্দ করেন না?

কোন মাসুদ রানা?

ওই যে গোয়েন্দা সিরিজ! কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা। সেবা প্রকাশনী থেকে বের হয়।

কী যে বলেন! পছন্দ মানে, সেই রকম পছন্দ! আমার ২২০টা মাসুদ রানা গোড়া থেকে শেষ অবধি মুখস্থ। বলব?

না, বলতে হবে না। তো আপনি যখন এতই মাসুদ রানার ভক্ত, কাজীদার সঙ্গে দেখা করবেন না?

করব। তবে আমি অপেক্ষা করছি সেই দিনের জন্য, যেদিন কাজীদা নিজেই আমাকে ডেকে নেবেন। আমি আগে দু-চারটা অপারেশন করে নিই। এখনো তো আমার তেমন নাম-ধাম হয়নি। এখন গিয়ে আমি কী পরিচয় দেব!

কখনো গিয়েছিলেন তাঁর কাছে?

গিয়েছিলাম। আমি গেটে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম। বললাম, আমার নাম মাসুদ রানা। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দুর্ধর্ষ স্পাই। তখন দারোয়ান হাসতে লাগল। বলল, আপনাকে নিয়ে ছয়জন হলো। মানে কী! আমি জিজ্ঞেস করলাম। দারোয়ান বলল, ভেতরে আরও পাঁচজন দাবি করছে, তারা সবাই মাসুদ রানা। আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন। আপনাদের সবাইকে জাতীয় মনোরোগ ইনস্টিটিউটে পাঠানো হবে। ডাক্তাররা আপনাদের সমস্যার সমাধান করবে। ডাক্তার মোহিত কামালের নাম শুনেছেন? খুব ভালো পাগলের ডাক্তার। বুঝুন অবস্থা! পাঁচটা পাগল বসে আছে। আমাকে সেই পাগলের পাশে গিয়ে বসতে বলে। দেখলাম, সত্যি সত্যি একটা মাইক্রোবাস এসে গেছে। তাতে লেখা, জাতীয় মানসিক রোগ ইনস্টিটিউট। আমি পালিয়ে বাঁচলাম। আপনারাই বলুন, আমাকে কি পাগলের মতো দেখাচ্ছে? আমি পাগল? তাই চলে এসেছি। আসল কথা কী জানেন, আমি পাগল না। আমি লোকটা একটু সরল।

আমার মাসুদ মামা নিজেকে সরল বলে মনে করেন বটে। আসলে কথাটা হবে তিনি বোকা।

আচ্ছা! আমার ছোট মুখে এত বড় বড় কথা শোভা পায় কি না, সেটাও প্রশ্ন। আমি টুকন। ভালো নাম নাফিস আল হুসাইন। আমি পড়ি ক্লাস সেভেনে, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে।

আমার প্রিয় বই অবশ্য মাসুদ রানা নয়। আমার ছোট খালা বলে দিয়েছেন, মাসুদ রানা বড়দের বই। তুই আঠারো বছরের আগে মাসুদ রানা পড়বি না। তুই পড়বি ফেলুদা। আমি সত্যজিত্ রায়ের ফেলুদা পড়ি। আমার নিজেকে তোপসে বলে মনে হয়।

এবার আমরা একটা অপারেশনে যেতে চাই। আব্বু-আম্মু কিছুতেই যেতে দেবেন না। তাঁদের ধারণা, বোকাটার সঙ্গে বাইরে গেলে আমি আর আস্ত ফিরব না। কিন্তু মামা বেড়াতে যাচ্ছেন রংপুরে। আমি ঠিক করেছি, আমিও তাঁর সঙ্গে যাব। আমি বারবার বলছি, মামার সঙ্গে অবশ্যই আমি যাব। মামা-ভাগনে যেখানে, আপদ নাই সেখানে।

আব্বু বললেন, তুমি রংপুরে কেন যেতে চাও বলো?

আমি বললাম, রংপুরে গিয়ে আমি বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান দেখব। মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

আম্মু বললেন, রোকেয়ার বাড়ি দেখতে যাবি? অবশ্যই যাওয়া উচিত। টুকনের আব্বু, না কোরো না।

আব্বু বললেন, আচ্ছা যাও। গাধাটাকে দেখেশুনে রেখো।

আম্মু বললেন, মাসুদকে তুমি গাধা বল কেন। ও তো অত বোকা নয়।

আব্বু বললেন, কত বোকা হলে একটা লোক গাধা হয়? সেবার রান্নাঘরে আগুন লাগল। আর মাসুদ পানি মনে করে তার মধ্যে কেরোসিন ঢেলে দিল। এর পরেও বলবে সে গাধা নয়?

মাসুদ মামা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, তোমরা মিনারেল ওয়াটারের বোতলে কেরোসিন রাখলে আমি বুঝব কী করে, এটা কেরোসিন না পানি। দিব্যি ওই বোতলের গায়ে লেখা ছিল পিওর ওয়াটার। বিশুদ্ধ পানি। আগুনে বিশুদ্ধ পানি ঢালা যাবে না, এটা কোথাও লেখা আছে?

আমরা ব্যাগ গোছাচ্ছি। মামা তাঁর ডিটেকটিভের ব্যাগ সামলাচ্ছেন। দুরবিন, আতশকাচ, ক্যামেরা, দড়ি, সেফটিপিন, ক্যাসেট রেকর্ডার, নোটবই, পেনসিল, কলম। একটা মাল্টিফাংশান ছুরি। যেটা একই সঙ্গে চাকু, স্ক্রু ড্রাইভার, বোটল ওপেনার ইত্যাদি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। মামা আমাকে আরেকটা অংশ দেখিয়ে বললেন, এটা হলো মাস্টার কি। এটা দিয়ে যেকোনো তালা খোলাও যায়। আমাদের সঙ্গে একটা রিভলবার থাকা উচিত, সেটা নেই। বাংলাদেশে আসলে প্রাইভেট গোয়েন্দাগিরির কোনো অনুমতিই নেই। এ দেশের সব গোয়েন্দাই সরকারি গোয়েন্দা। তবে রিভলবার পিস্তল বন্দুকের লাইসেন্স অনেকেরই থাকে। মাসুদ মামার পিস্তলও নেই, লাইসেন্সও নেই।

মামা একবার বাসায় পেড়েছিলেন কথাটা—ইয়ে মানে, ঠিক করেছি একটা রিভলবার কিনব। লাইসেন্সওয়ালা রিভলবার।

শুনে আম্মু বললেন, রিভলবার দিয়ে কী করবি?

আমি তো ডিটেকটিভ। ডিটেকটিভদের একটা রিভলবার দরকার হয়।

আম্মু বললেন, রিভলবার কেন দরকার হয়? তুই কি ডাকাতি-ছিনতাই করবি?

না না, তা কেন? মাসুদ মামা জবাব দিলেন, আত্মরক্ষা করব।

আম্মু বললেন, তোর কাছে একটা রিভলবার থাকা মানে খাল কেটে কুমির আনা। ওই রিভলবারের জন্যই তোকে ছিনতাইকারী ধরবে। একটা রিভলবার পেলে তাদের অনেক লাভ হবে। দেখা যাবে, আমাদের বাসায় রাতের বেলা গ্রিলকাটা চোর ঢুকেছে। ঢুকেই তোর গলায় ছুরি ধরে বলছে, দে তোর রিভলবার। আর তুই ভয়ে গোঁ গোঁ করছিস। তোর গলা দিয়ে কোনো শব্দই বেরোচ্ছে না।

না না, আমি জুডোর এক প্যাঁচে ওই চোরকে ধরাশায়ী করব। ওর হাত থেকে ছুরি পড়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মামা জুডোর একটা প্যাঁচ দেখালেন, কারাতের এক লাথি, পা তাঁর উঠে গেল আমার কপাল বরাবর, তারপর সেটা লাগল গিয়ে আমাদের ডাইনিং রুমের শোকেসে। শোকেসের কাচ ভেঙে মামার পা গেল কেটে। পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে মামা পড়ে রইলেন বিছানায়। তাঁকে ইয়া বড় বড় ইনজেকশন দিতে হলো সাতটা। এরপর তিনি আর কোনো দিনও পিস্তল-রিভলবার কিনতে চাননি।

আজকেও যখন মাসুদ মামা ব্যাগ গোছাচ্ছেন, একবার পুরো জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা রিভলবার বড্ড দরকার ছিল রে। তাই না? কী বলিস?

আমি বললাম, মামা, তোমার পায়ের ইনজুরিটা কি সেরেছে? ওই যে ডাইনিং রুমের শোকেসে লাথি মেরে যেটা তুমি বাধিয়েছিলে!

শুনেই মামার মুখটা চুন হয়ে গেল।

মামা বললেন, একটা নকল রিভলবার সঙ্গে রাখব নাকি?

আমি বললাম, মামা, আবারও!

মামা একবার তাঁদের কলেজের নাটকে অভিনয় করছিলেন। সেই নাটকের জন্য তাঁর একটা রিভলবার দরকার ছিল। ইস্টার্ন প্লাজার বাচ্চাদের খেলনার দোকান থেকে একটা রিভলবার কিনে এনেছিলেন। নাটকের আগের রাতে ড্রেসড রিহার্সাল ছিল। সেটা সেরে তিনি ব্যাগে নাটকের পোশাক-আশাক, নকল দাড়ি-গোঁফ একটা ব্যাগে ভরে বেবিট্যাক্সিতে ফিরছিলেন। পথে তাঁকে পুলিশ আটকে দিল। বেবিট্যাক্সি চেক করা হবে।

পুলিশ হাত তুলতেই ট্যাক্সি থেমে গেল। পুলিশ নাকি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কে?

তিনি যথারীতি জবাব দিয়েছিলেন, মাসুদ রানা। শখের গোয়েন্দা।

দেখি, ব্যাগ দেখি!

ব্যাগ খুলতেই বেরিয়ে এল পিস্তল। নকল দাড়ি-গোঁফ।

পুলিশ বলল, আপনাকে একটু থানায় আসতে হবে।

মাসুদ মামা বললেন, আমার অপরাধ?

পুলিশ বলল, সেটা থানায় গিয়েই আপনার সঙ্গে আলাপ করা যাবে।

তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে পিঠমোড়া করে হাত বেঁধে নিয়ে গেল ধানমন্ডি থানায়।

তারপর তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে আব্বু-আম্মুকে যে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল, সে এক ইতিহাস। থানায় নাকি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, ঢাকায় আপনার পরিচিত কে আছে? মামা বলেছিলেন, রাহাত খান।

পুলিশ জিজ্ঞেস করেছিল, রাহাত খান কে?

মামা উত্তর দিয়েছিলেন, রাহাত খানকে চেনেন না? বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের প্রধান।

আপনি গোয়েন্দা?

জি, শখের গোয়েন্দা। মাসুদ রানা। আপনারা কেউ মাসুদ রানা বইটা পড়েন নাই।

পুলিশ ডিপার্টমেন্টে মহা হইচই পড়ে গিয়েছিল। একটা লোক নিজেকে গোয়েন্দা পরিচয় দিচ্ছে। ভুয়া গোয়েন্দা। এটা বুঝতে তাদের অনেক সময় লেগে গিয়েছিল যে মাসুদ মামা আসলে ভুয়া গোয়েন্দা নন। কাল্পনিক গোয়েন্দা। তিনি গোয়েন্দাগিরি করে বেড়ান মনে মনে। তিনি কারও ক্ষতি করেন না। তবে মাসুদ মামা যদি প্রথমেই বলতেন, এই পিস্তলটা খেলনা পিস্তল আর এটা নাটকের একটা উপকরণ মাত্র, তিনি আসছেন তাঁদের কলেজের নাটকের রিহার্সাল শেষ করে, তাহলে হয়তো তাঁকে তাড়াতাড়িই ছেড়ে দিত পুলিশ। কিন্তু পুলিশের হাতে বের করে দিলেন তাঁর নিজের ভিজিটিং কার্ড, যেখানে তাঁর নাম লেখা মাসুদ রানা। আলাপ করার চেষ্টা করতে লাগলেন তাঁর মুখস্থ মাসুদ রানা সিরিজের বিভিন্ন দুর্ধর্ষ অভিযান নিয়ে। ব্যাপারটায় বেশ প্যাঁচ লেগে গেল। পুলিশ প্রথম দিকে বড় একজন ক্রিমিনালকে ধরে ফেলেছি ভেবে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, বেশ কিছুক্ষণ পরে তারা বুঝতে পারল, তারা যাঁকে ধরেছে, তিনি আসলে একজন বোকা মানুষ। যিনি বাস্তবে বসবাস করেন না, বাস করেন কল্পনার রাজ্যে।

যাক, অনেক চেষ্টা-তদবির করে আব্বু তাঁকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন সেবার।

কাজেই আমি মামাকে যখনই বললাম, ‘মামা, আবার!’ মামা ব্যস্ততার ভান করে অন্য কাজে মন দিলেন।

আমিও আমার ব্যাগ গোছাতে লাগলাম। কাপড়চোপড়। টুথপেস্ট, টুথব্রাশ। আম্মু আমাকে একটা মোবাইল ফোনও দিলেন। বললেন, যদিও ছোটদের হাতে মোবাইল ফোন দিতে নাই, তবু তোকে একটা ফোন দিয়ে রাখতে চাই। তুই হারিয়ে-টারিয়ে গেলে ফোন দিতে পারবি।

আব্বু বললেন, টুকন তো হারিয়ে যাবে না। হারিয়ে গেলে মাসুদই যাবে। তখন টুকন তাকে উদ্ধার করতে পারবে।

আমরা এখন যাত্রা আরম্ভ করব।

আব্বু, আম্মু আর আমার ছোট বোন টুপাই আমাদের বিদায় দিচ্ছে। আমরা একটা সিএনজিচালিত বেবিট্যাক্সিতে উঠব। সকাল ১০টায় আমাদের বাস ছাড়বে কল্যাণপুর থেকে। কলাবাগানের বাসার সামনে থেকে আমরা রওনা হচ্ছি।

টুপাই পড়ে ক্লাস ফোরে। সে বলল, ভাইয়া, রংপুর থেকে আমার জন্য রং নিয়ে এসো।

টুপাইয়ের চোখে পড়েছে শীতকালের নরম রোদ, বাসার সামনে একটা কাঁঠালচাঁপা গাছের ছায়ার ফাঁক গলে, একটা টুনটুনি পাখি ঝাঁপাচ্ছে সেই ডালে, হলুদ রঙের ফ্রকপরা টুপাইয়ের চোখ দুটো ভাসা ভাসা, তাতে কী যে মায়া মাখানো! সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। রংপুরে রং পাওয়া যায়, তোকে কে বলল?

টুপাই বলল, বাহ, তাহলে এর নাম রংপুর কেন?

আমি বললাম, তাহলে এই যে আমাদের বাসা কলাবাগানে, একটা কলার গাছ দেখা তো! ধানমন্ডিতে ধান কই? বেগুনবাড়িতে বেগুন? সেগুনবাগিচায় সেগুন?

মাসুদ মামা পরেছেন একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, তাতে পকেট যে কতগুলো ঠিকঠিকানা নেই, কেডস পরেছেন একজোড়া, পিঠে একটা ব্যাকপ্যাক, বেশ বড়সড়ই, এই ব্যাকপ্যাকেই তাঁর গোয়েন্দাগিরির জিনিসপাতি, কাপড়চোপড় ইত্যাদি। আমার পিঠেও ব্যাকপ্যাক আছে, আর হাতে আছে একটা পিএসপি, পোর্টেবল প্লেস্টেশন। রাস্তার একঘেয়েমি দূর করতে এটা দিয়ে খেলা যাবে।

মামা বললেন, বাবা টুকন, প্লেস্টেশনটা আর নিয়ো না, তোমার হাতে এমনিতেই একটা মোবাইল ফোন আছে, ওতেও তো গেমস আছে। একসাথে দুটো জিনিস রাখার দরকার নাই।

আমি মামার এই কথাটা মানলাম। টুপাইকে পিএসটিটা দিয়ে দিলাম। টুপাই খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলল, তোমরা যত দিন পারো, তত দিন থেকো। তাড়াহুড়া করার দরকার নাই। আমি তত দিন একটু শান্তিমতো গেমস খেলে নিই।

আম্মু বললেন, ভাই মাসুদ, রংপুরে গিয়ে তোরা উঠবি কই?

মাসুদ মামা বললেন, কেন, রোকেয়াপুর বাসায়।

কোন রোকেয়াপু? আম্মু কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন।

কেন! আমাদের রোকেয়াপু। ওই যে নাদিয়া ফুপুর মেয়ে।

রোকেয়া রংপুরে থাকে নাকি? ও তো থাকে রূপপুরে। আম্মু বললেন।

আরে, তোমরা না বললে টুকন রোকেয়ার বাড়ি যেতে চায়, এই জন্য রাজি হয়েছি?

আম্মু রেগে গেলেন। আব্বু হো হো করে হাসতে লাগলেন। আম্মু বললেন, গাধার গাধা। এই রোকেয়া তো বেগম রোকেয়া। যার নামে রোকেয়া হল, রোকেয়া কলেজ, রোকেয়া ইউনিভার্সিটি। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। নারী মুক্তির অগ্রদূত।

আব্বু বললেন, না না, আমাদের মাসুদ তো বেগম রোকেয়ার নানাশ্বশুর। ওকে আদর করে ওরা বাড়িতে রাখবে, খাওয়াবে, পরাবে।

মামা বললেন, ঠিক আছে ঠিক আছে। কোনো ব্যাপার না। টাকাপয়সা আছে। একটা ভালো দেখে হোটেল-টোটেলে উঠে পড়ব।

আব্বু তখন পকেট থেকে হাজার পাঁচেক টাকা বের করে দিলেন মামার হাতে। বললেন, এই পাঁচ হাজার টাকা ধার দিলাম। এসে ফেরত দিবি। যা আল্লাহর নামে রওনা হ।

আমরা স্কুটারে উঠে বসলাম। স্কুটার স্টার্ট দিল। আমি আম্মুর দিকে তাকালাম। আম্মুর চোখ ছলছল করছে। মামা বললেন, চলেন কল্যাণপুর।

আমারও একটু একটু খারাপ লাগছে। কোথায় যাচ্ছি, ঠিকমতো জানিও না। আর যাঁর সঙ্গে যাচ্ছি, তিনি হলেন এই দুনিয়ার সবচেয়ে বোকা লোক।

আগমনী এক্সপ্রেস হলো বাসের নাম। এসি বাস। ভলভো কোম্পানির তৈরি বাস। আমরা বসেছি ৪ নম্বর সিটে। বাস রওনা দিল। বাসের যাত্রীদের অনেকেই দেখি কম্বল চেয়ে নিচ্ছে। বাসে যাত্রী জনা ত্রিশেক। ওদের কাছে কম্বল আছে ১০-১২টা।

আমি তাড়াতাড়ি একটা কম্বল চেয়ে নিলাম। অন্য যাত্রীরাও চাইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসের সুপারভাইজার বললেন, আর কম্বল নাই।

মামা বললেন, টুকন, তুই কম্বল নিলি কেন? এই কম্বলে তো গন্ধ! কে না কে এর আগে গায়ে দিয়েছে। ছি!

আমি বললাম, পিঠের নিচে দিয়ে রাখি। যদি শীত লাগে, তাহলে গায়ে দেব, তা না হলে দেব না!

মামা বললেন, তুই একটা ভেড়া।

আমি বললাম, তুমি এটা কী বলছ!

মামা বললেন, সরি! তোর কম্বলটার গায়ে ভেড়ার লোম। সেখান থেকে ভেড়ার গায়ের গন্ধ আসছে।

বাস ধীরে ধীরে রংপুরের দিকে এগোতে লাগল। শীত যে কত ভয়াবহ হতে পারে, আমার কোনো ধারণাই ছিল না। একে তো রংপুরের বিখ্যাত শীত, তার ওপরে এসি বাস, সবাই শীতে কাঁপতে লাগল। আমি কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম। একটু পরে দেখি, মামা আমার কম্বল ধরে টানাটানি করছেন।

আমি বলি, মামা, ভেড়ার লোম!

আরে, কম্বল তো ভেড়ার লোম দিয়েই বানানো হবে।

মামা, এতটুকুন কম্বলে আমারই হয় না। এর মধ্যে আবার তুমি টানাটানি কোরো না তো!

ঠান্ডা লাগে তো! এই কন্ডাক্টর সাহেব। এসি বন্ধ করেন।

কন্ডাক্টর বললেন, এসি বন্ধ করা যাবে না। তাহলে সামনের কাচ ঘোলা হয়ে যাবে। কিছুই দেখা যাবে না। অ্যাকসিডেন্ট হবে।

মামা শীতে থরথরিয়ে কাঁপতে লাগলেন। আমাদের বাক্সপেটরা সব গাড়ির নিচে লকারের মধ্যে রাখা। এগুলো এখন বের করারও উপায় নেই।

মামা বললেন, ভাই, হয় কম্বল দিন। না হলে গাড়ি থামিয়ে লকার থেকে শীতের কাপড় বের করতে দিন।

সবাই বলল, রংপুরের এসি বাসে উঠবেন, আগে হুঁশ ছিল না!

মামা বললেন, আগে হুঁশ ছিল না, আবার এখন শীতেই আমি বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছি। আমাকে বাঁচান।

একজন বয়স্ক মহিলা যাচ্ছিলেন ওই বাসে। উনি বললেন, আহা বেচারি! আচ্ছা, আমার কাছে একটা অতিরিক্ত শাল আছে। উনি ওটা নিতে পারেন।

তিনি একটা টকটকে গোলাপি রঙের গায়ের চাদর দিলেন মামাকে। মামা সেটাই জড়িয়ে রইলেন। আমি আম্মুর দেওয়া মোবাইল ফোনে গোলাপি রঙের শাল গায়ে দেওয়া মামার একটা ছবি তুলে রাখলাম। ভবিষ্যতে এটা কাজে লাগবে। আম্মু আর আব্বু দেখলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবেন।

আমরা রংপুর বাস টার্মিনালে নামলাম। পাশেই পর্যটন করপোরেশনের মোটেল। সেখানেই প্রথমে খোঁজ নিতে গেলাম। রুম পাওয়া গেল। বাইশ শ টাকা ভাড়া। ডাবল রুম। এসি আছে। আমরা রুম নম্বর ২১৩-তে উঠে পড়লাম। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। খুব শীত। এসির কোনো দরকারই ছিল না। বাথরুমে ঠান্ডা গরম পানি আছে। গরম পানি ছেড়ে গোসল সেরে নেওয়া উচিত।

মামা বললেন, আমিই প্রথম ঢুকি।

আমি বললাম, তথাস্তু। মামা বাথরুমে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

একটু পরে মামার আর্তনাদ শোনা গেল বাথরুম থেকে। ওরে মরে গেলাম রে।

আমি দৌড়ে গেলাম বাথরুমের দরজায়। বন্ধ কবাটে মুখ রেখে বললাম, মামা, কী হয়েছে?

মামা বললেন, গরম পানিতে পুড়েই গেলাম রে…

ঠান্ডা পানি ঢালো।

খুঁজে পাচ্ছি না।

মরে গেলাম…

খোলো দরজা…আমি বেয়ারা ডাকছি।

আমি দৌড়ে ফোনে জিরো টিপে বললাম, ভাই গরম পানিতে মামা পুড়ে গেছে, দৌড়ে আসেন। ঠান্ডা পানি বেরোয় কীভাবে?

একজন বেয়ারা এলেন।

বললাম, ঠান্ডা পানি লাগবে। মামা ভেতরে গরম পানিতে পুড়ে গেছেন।

তিনি একটা ফ্রিজ খুললেন। ঠান্ডা পানির বোতল খুলে বাথরুমের দরজায় টোকা দিলেন। দরজা খোলেন। দরজা খুলল।

মামার কোমরে তোয়ালে জড়ানো। মামা মাথায় ঠান্ডা পানি ঢাললেন। তোয়ালে খুলে গেল। মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলেন।

মামা বসে পড়ে দুহাতে নিজেকে আড়াল করলেন।

আমরা তাঁর মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালছি।

আমরা যাব পায়রাবন্দে। নাশতা সেরে নিয়ে আমরা মোটেলের বাইরে এলাম। নটা বাজে। ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে চারপাশ। একটা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করা গেল। কুয়াশা চিরে সেটা ছুটে চলেছে। একটু দূরে গিয়ে দেখা গেল, কুয়াশা নেই। রোদ ঝকঝক করছে।

আধঘণ্টার মতো সময় লাগল মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে পৌঁছাতে। মহাসড়কের ওপর থেকেই সাইনবোর্ড দেখাচ্ছে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের। পার্শ্বসড়ক ধরে যেতে হলো আরও খানিকক্ষণ। দুই পাশে ধানখেত। এখন ধান কাটা হয়ে গেছে। কাটা ধানের গোড়া পড়ে আছে খেতে। শালিক পাখি সেই খেতে মনে হয় পোকা খুঁটছে। দু-একটা গরু-ছাগলও চড়ছে।

বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রে নারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। সুন্দর আধুনিক ভবন। পাশেই আছে বেগম রোকেয়ার পৈতৃক ভিটা, বাসভবনের ধ্বংসাবশেষ। সেখানে একটা পাঠাগারও আছে। ঝাউগাছের সারি লাগানো হয়েছে লাল ইটের স্মৃতিকেন্দ্রের পাশে। মামা বললেন, রোকেয়া আপুর বাসাটা কিন্তু এর চেয়ে খারাপ কিছু হতো না? কেন যে আপা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করল আমি ঠিক বুঝলাম না!

আমি বললাম, মামা, আবারও তুমি বোকার মতো কথা বলছ? কথা থামাবে!

মামা বললেন, না মানে, বেগম রোকেয়ার বাড়ি তো আসলে নাই। যা আছে তা কতগুলো ভাঙা ইটের দলা। এইটা ঠিক দেখতে আসার কী হলো?

মামা, এই বাড়ির একজন মেয়ে বাড়ির নিয়মকানুন অমান্য করে লেখাপড়া শিখেছিলেন। বাংলা পড়া নিষিদ্ধ ছিল। ইংরেজি পড়া নিষিদ্ধ ছিল। তিনি তাঁর ভাইয়ের কাছে চুপি চুপি লেখাপড়া শিখলেন। বাংলা শিখলেন। ইংরেজি শিখলেন। কলকাতায় গিয়ে স্কুল বানালেন। মেয়েদের ডেকে ডেকে লেখাপড়া করালেন। তাই তো আজকে বাংলাদেশের মেয়েরা সব দিক থেকে কত এগিয়ে। আর তাঁর পৈতৃক বাড়ি আমরা দেখতে আসব না? এটা কোনো কথা হলো? নাহ, মামা, তোমার সঙ্গে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে।

মামা বলল, আরে আমি তো গোয়েন্দা মানুষ। আমার আগ্রহের বিষয় গোয়েন্দা গল্প। আমি কি বেগম রোকেয়া নিয়ে পড়াশোনা করেছি নাকি! বেগম রোকেয়া যদি নিখোঁজ হয়ে যেতেন, তাহলেই না কেবল আমি তার রহস্য উদ্ধার করতে লেগে পড়তে পারতাম। তার আগে তো আমি পারি না।

আমরা গেলাম তাজহাট জমিদারবাড়ি দেখতে। দেখা হলো। সামনে থেকেই সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলা বরাবর। সেই প্রবেশদ্বারের দুই পাশে দুটো সিংহস্তম্ভ। বিশাল বাড়ি। এখন সরকারি অফিস হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।

তাজহাট জমিদারবাড়ির ভেতরে কতগুলো প্যাঁচানো সিঁড়ি আছে। সেসব বেয়ে আমরা বিভিন্ন ঘরে উঁকিঝুঁকি মারলাম। তারপর বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বেশ রোদ উঠেছে। গায়ের গরম কাপড়গুলো যেন এখন বোঝা মনে হচ্ছে। একটু খিদেও যেন পেয়েছে।

মামা বললেন, আশপাশে নিশ্চয়ই কোনো বাজার আছে। দোকানপাট আছে। একটু চা খাওয়া দরকার।

আমি বললাম, ঠিক বলেছ। এখন একটা কিছু মুখে দিতে পারলে ভালোই লাগবে।

একটা রিকশা নিয়ে আমরা চললাম মাহিগঞ্জ বাজারে।

সত্যি, এখানে দোকানপাট বেশ জমজমাট।

একটা দোকানে জিলাপি ভাজা হচ্ছে। গরম গরম জিলাপি নামানো হচ্ছে চিনির রসে। দেখে আমার জিবে জল চলে এল।

রাস্তার ওপরে রোদের মধ্যে বেঞ্চ পাতা।

আমরা দুজন সেখানে বসলাম। মামা বললেন, জিলাপি দেন দেখি। খেয়ে দেখি কেমন আপনাদের জিলাপি।

এই সময় আমাদের পাশে চব্বিশ-পঁচিশ বছরের একজন যুবক এসে বসলেন।

তিনি একটা সংবাদপত্র মেলে ধরলেন। মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন।

মামা খবরের কাগজে উঁকিঝুঁকি মারছেন। বোধ হয় কাগজে কোনো খুনের খবর ছাপা হয়েছে। খুনের খবরের প্রতি মামার অপার আকর্ষণ।

ভদ্রলোক বললেন, আপনি পড়বেন? নেন। এই পাতাটা আপনি নেন। আমি অন্য পাতা পড়ি।

মামা ধন্যবাদ দিয়ে কাগজ নিয়ে পড়তে লাগলেন।

জিলাপি এসে গেল।

জিলাপি খেতে গিয়ে টপটপ করে রস ফেলে মামা ভদ্রলোকের পত্রিকাটাকে মাখিয়ে ফেললেন।

তারপর বলে উঠলেন, সরি সরি…

ভদ্রলোক বললেন, না না, কোনো অসুবিধা নাই। আপনি পেপার পড়েন।

মামার চা এল। ভদ্রলোক বললেন, আপনারা পেপার পড়েন। আমার বাসায় এই পেপার আমি রাখি। কাজেই এটা থাকুক। আপনারা পড়েন। আমাকে উঠতে হবে। তিনি চলে গেলেন। বললেন, টুকন সাহেব, আসি।

মামা মুগ্ধ। বললেন, দেখলি টুকন, কী রকম ভদ্রলোক। আজকালকার দুনিয়ায় তো ভদ্রলোক পাওয়াই যায় না।

মামা দাম পরিশোধ করলেন।

তারপর আমরা রিকশা নিয়ে চললাম শহরের দিকে। উদ্দেশ্য, রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি এলাকা দেখব।

ঠিক তখনই মামা পকেট হাতড়ে বললেন, এই রে আমার মোবাইল ফোনটা তো খুঁজে পাচ্ছি না।

রিকশাওয়ালা রিকশা ঘোরান। নিশ্চয়ই ওই জিলাপির দোকানে পড়ে আছে। আমার মনে আছে, আমি বেঞ্চে আমার পাশেই রেখেছিলাম।

আমাদের রিকশা আবার গেল জিলাপির দোকানে। মোবাইল ফোনের সেটটা সেখানে দেখা গেল না।

মামা বললেন, আমার মনে আছে, আমি এই দোকান পর্যন্ত মোবাইল ফোন নিয়ে এসেছিলাম। কারণ, আমি এখানে বেঞ্চে বসে একবার সময় দেখেছি মোবাইলেই। আমার মনে আছে। তখন বাজে ১১টা এক মিনিট।

দোকানিকে জিজ্ঞেস করা হলো। তিনি বললেন, না তো চাচা, মুই তো তোমার মোবাইল দেখম নাই।

আমি বললাম, মামা, আমার মোবাইল ফোন থেকে তোমার মোবাইল ফোনে কল দিই।

মামা বললেন, তাই তো করতে হবে।

ফোন করলাম। প্রথমে রিং হলো। এরপর ফোনটা বোধ হয় অফ করে দিল। আর রিং হয় না।

মামা বললেন, জগতে একজনও ভালো মানুষ দেখলাম না।

তিনি দোকানির উদ্দেশে বললেন, আচ্ছা, আমার পাশে যিনি বসেছিলেন, এই পেপারটা যিনি রেখে গেলেন, তাঁকে কি আপনি চেনেন?

দোকানি জানালেন যে তাঁকে এর আগে কখনো দেখা যায়নি এই এলাকায়। আজকাল নতুন নতুন বাসা হচ্ছে, বাইরের মানুষ এসে ভাড়া নিচ্ছে, সবাইকে তাঁরা চিনতে পারেন না।

মামা খুব মন খারাপ করলেন। বললেন, শোন টুকন, আমি মন খারাপ করেছি মোবাইল ফোন হারিয়ে, এটা সত্য। তবে তার চেয়েও বেশি মন খারাপ করেছি মানুষকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না দেখে।

আমি বললাম, মামা, তুমি না গোয়েন্দা। তুমি না প্রতিটা মানুষকেই সন্দেহ করো।

সেটাই গোয়েন্দাজীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ রে। আমার তো ওই দোকানিটাকেও সন্দেহ হচ্ছে।

আমরা রিকশায় উঠে পড়েছি। রিকশা চলতে শুরু করেছে।

রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি এলাকায় পৌঁছাতে এক ঘণ্টা লাগল। শহরের ভেতরে বেশ যানজট। রিকশাই বেশি। পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গেই টাউন হল। মাঠে শহীদ মিনার। টাউন হলটাও পুরোনো। পাঠাগার ভবনটাও সাবেক আমলের। মামা বললেন, আমার কিছু ভালো লাগছে না রে টুকন। আমার মোবাইল ফোনটা উদ্ধার করতেই যদি আমি না পারলাম, আমি কিসের গোয়েন্দা।

আমরা দিনাজপুর গেলাম। কান্তজীর মন্দির দেখলাম। টেরাকোটার কাজ মুগ্ধ হওয়ার মতো। পোড়ামাটি দিয়ে এত সুন্দর সুন্দর কাজ করে রেখেছে মন্দিরের গায়ে। কিন্তু মামার সেদিকে খেয়ালই নেই। বলেন, আরে এসব ঐতিহাসিক জিনিস, আর্ট কালচার আমার সাবজেক্ট না। আমার মন পড়ে আছে আমার মোবাইল ফোনে। ঢাকা ফিরে গেলে আপা-দুলাভাই কী রকম হাসাহাসি করবে আমাকে নিয়ে, ভেবে দেখ। রামসাগর দেখতে গেলাম দিনাজপুর শহরের অদূরে। বিশাল পুকুর। পাড় এত উঁচু যেন পাহাড়। তার ওপরে গাছ। তার ওপরে রেস্টহাউস। এত বড় পুকুর যে এক পাড় থেকে আরেক পাড় দেখাই যায় না।

আমরা পুকুরের পাড়ে হাঁটছি। স্থানীয় একজন বললেন, জানেন তো, এই রামসাগর খননের কাহিনি।

কী রকম?

মামা জিজ্ঞাসু নয়নে তাকালেন সেই লোকের দিকে।

তিনি বললেন, এক ছিলেন রাজা। তাঁর প্রজারা কষ্ট পাচ্ছে। পানির কষ্ট। বৃষ্টি হয় না। খাবার পানি নাই। তখন রাজা বললেন, পুকুর খোঁড়ো। অনেক বড় পুকুর খোঁড়া হলো। অনেক গভীর পুকুর খোঁড়া হলো। তবু পানি ওঠে না। তখন রাজা বললেন, পুকুরের মধ্যখানে একটা ঘর বানাও। আমি সেই ঘরে থাকব। স্বপ্নে দেখেছি। আমি যদি ওই পুকুরের মধ্যখানে ঘর বানিয়ে রাত্রি কাটাই, তাহলেই পানি উঠবে। আমি তা-ই করব।

মধ্যখানে একটা ছোট্ট ঘর বানানো হলো। রাজা সেই ঘরে গিয়ে উঠলেন। ভোরবেলা লোকে দেখল, পুকুর জলে ভরে গেছে।

রাজার কী হলো? আমি বললাম।

ওই ঘরেই রয়ে গেছেন। আর বের হতে পারেননি।

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এ কী কথা? একটা লোক প্রজাদের দুঃখ দূর করার জন্য পুকুর বানালেন। আবার তাঁকেই কিনা জীবন দিতে হলো?

ফেরার পথে মাইক্রোবাসে মামা বললেন, কী রে তোর মন খারাপ কেন?

ওই রামসাগরের রাজাটার জন্য।

মামা বললেন, তুই ওই গল্প বিশ্বাস করেছিস?

হ্যাঁ।

পাগল। এসব তো গল্প। একজন রাজা পুকুরের মধ্যে ঘর বানিয়ে ওখানে ঢুকলেন, তারপর পানি এল, এটা কোনো বৈজ্ঞানিক কথা হলো! এসব রূপকথা শুনবি, কিন্তু বিশ্বাস করবি না।

আমরা রংপুরের পর্যটনের মোটেলে ফিরে এসেছি। রাতের বেলা মোটেলেই খাওয়ার আয়োজন। এরই মধ্যে মামার সিমটা তোলা হয়েছে। আগের নম্বরটাই। একটা মোবাইল সেটও কেনা হয়েছে। সস্তা দেখে। এটা দিয়ে কেবল ফোনই করা যায়। ফটো-টটো তোলা যায় না।

ঢাকা থেকে ফোন এল। ফোন করেছেন আব্বু। আব্বুর ফোন পেয়ে আমি একটু অবাকই হলাম।

সাধারণত আম্মুই আমাকে ফোন করেন। নিয়মিত খোঁজখবর নেন। আজকে কী হলো?

আমার ধারণাই সত্যি। আব্বু বললেন, শোন, তোর মা তো ভয়ংকর কাজ করেছে। ত্রিশ হাজার টাকা এক জিনের বাদশাকে পাঠিয়ে দিয়েছে।

আমি বলি, কী বলো এসব? জিনের বাদশা। ত্রিশ হাজার টাকা। আমি তো কিছুই বুঝছি না। নাও, মামার সঙ্গে কথা বলো।

আমি ফোনটা মাসুদ মামার হাতে দিলাম।

জি দুলাভাই বলেন…মামা আব্বুর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন। আম্মুর সঙ্গেও কথা বললেন।

রাতের খাবার শেষে মামা আমাকে ঘটনা বললেন খুলে।

আম্মুর কাছে ফোন এসেছে। বলে, মা গো, তোমার ছেলে টুকন ভালো আছে। তোমার ভাই মাসুদও ভালো আছে। তারা রংপুরে গেছে।

আম্মু বলেছেন, আপনি কে বলছেন।

তখন উত্তর এসেছে, আমি জিনের বাদশা। মা রে, আল্লাহ তাআলা নিজে বলেছেন, তিনি জিন আর মানুষ সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ তাআলার এবাদত করার জন্য। আমি এই এলাকার জিনের বাদশা। তোর ছেলেকে দেখে রাখছি। সামনে ওর একটা বিপদ হতে পারে। তোর ভাই মাসুদ তো সেটা সামলাতে পারবে না। টাকাপয়সা লাগবে। তুই এক কাজ কর। আমাকে নয় শ নিরানব্বই টাকা ফ্লেক্সি করে দে। আমি তোর ছেলেকে দেখছি।

আম্মু ছেলের বিপদের কথা শুনে ভয় পেয়ে নয় শ নিরানব্বই টাকা দিয়েছেন।

তারপর আবারও ফোন।

জিনের বাদশা বলে, তোর ছেলেটা খুব লক্ষ্মী। তার চেয়েও লক্ষ্মী তোর মেয়েটা। ওর নাম তো টুপাই, না! খুব ভালো মেয়ে। জিনেরা তার জন্য দোয়া করবে। আর শোন, ঠিকমতো আল্লাহকে ডাকবি। মনের মধ্যে কোনো অহংকার রাখবি না। আর হিংসা। শোন, তোর মনের মধ্যে লোভ আছে। লোভ ভালো জিনিস না। তবে, তোর সামনে সুখবর আছে। তোর কাছে জিনের বেগমের সোনার গয়না পৌঁছে যাবে। তোর যে দুইটা সোনার বালা আছে, ওই দুইটা তুই তোর বালিশের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখ। সাত দিন পরে খুলবি। দেখবি, বালা চারটা হয়ে গেছে। শোন, বাইশ হাজার টাকা পাঠা। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পাঠা। কাউকে বলবি না…

আম্মু কাউকে না বলে এ পর্যন্ত ত্রিশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন।

মামার কাছে সব শুনে আমি তো থ। আমরা বসে আছি রংপুরের মোটেলের ঘরে। দুজনে দুই খাটে। সাদা রঙের চাদর। দুটো করে বালিশ। সাদা টিউবলাইট দেয়ালে জ্বলছে।

মাসুদ মামা বললেন, যাক, একটা কাজ পাওয়া গেল। এবার গোয়েন্দাগিরিটা করেই দেখিয়ে দিতে হবে। যে করেই হোক, এই প্রতারক চক্রকে খুঁজে বের করবই। আর তাদের তুলে দেব পুলিশের হাতে।

আমি বললাম, মামা, তুমি এই খবর পড়ো নাই পত্রপত্রিকায়? জিনের বাদশার নাম করে প্রতারণা করা হচ্ছে?

মামা বললেন, পড়েছি মনে হচ্ছে।

এটা বেশ পুরোনো সমস্যা। কিন্তু এত দিনেও যখন সমাধান হয়নি, বুঝতে হবে, প্রতারক দলটা বেশ শক্তিশালী।

তো?

তো এদের বিরুদ্ধে লাগতে গেলে বিপদ-আপদ আসতে পারে।

তা তো পারেই। গোয়েন্দাদের জীবন তো বিপদেরই জীবন। ভয় পেলে কি আমার চলবে? মামা ডান হাতে তুড়ি বাজিয়ে বললেন।

আমি বললাম, বটে। তো এখন কাজটা শুরু করবে কোত্থেকে? সুতার মাথাটা তো তোমাকে পেতে হবে।

খুব সোজা। বুবুকে যে মোবাইল ফোন থেকে ফোন করেছে, সেই মোবাইল ফোনের পেছনে লাগব। বের করে ফেলব সেই ফোনটা কোথাকার।

কীভাবে করবে?

ফোন করব। ফোন করে কথা বলব। পটিয়ে ফেলব।

আর যদি ফোন বন্ধ থাকে?

ফোনটা বন্ধ থাকলে মোবাইল অপারেটরদের হেল্প নিতে হবে।

মামা আব্বুর কাছ থেকে জিনের বাদশার ফোন নম্বর নিলেন। তারপর ফোন করলেন সেই নম্বরে। ফোন বন্ধ।

মামার চোখে-মুখে হতাশা। আমি বললাম, মামা, এবার?

মোবাইল অপারেটরের হেল্প নিতে হবে।

কীভাবে নেবে? তুমি চাইলেই মোবাইল অপারেটর তোমাকে হেল্প করবে কেন?

করবে না বলছিস?

করবে না বলছি না। তবে তুমি কাকে ধরবে? কেন ওরা তোমার কথা শুনবে? তুমি কি পুলিশ? তুমি কি সরকারের লোক?

আমি গোয়েন্দা।

তার কোনো প্রমাণ আছে?

প্রমাণ! এই যে আমার ভিজিটিং কার্ড।

ভিজিটিং কার্ড কোনো প্রমাণ? আমি যদি লিখি, আমার নাম টুকন, আমি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন, তাতে কি আমি ক্যাপ্টেন হয়ে গেলাম?

তাহলে উপায়?

উপায় একটা আছে। তাহের ফুপা না মোবাইল কোম্পানিতে কাজ করেন। তাঁকে ধরো।

রাইট। তোর মাথায় তো বুদ্ধি আছে। তাহের ভাইজান পারবে এই নম্বরগুলোর হদিস বের করতে।

আর জিশান আংকেলকে ফোন করো। জিশান আংকেল আমাদের হেল্প করতে পারবেন।

রাইট।

জিশান আংকেল হলেন আমার ক্লাসমেট হাসিবের বাবা। তিনি পুলিশের অনেক বড় কর্মকর্তা।

হঠাৎ মামা বললেন, এই গোয়েন্দা তুই না আমি?

তুমি।

তাহলে তুই সব সমস্যার সমাধান দিচ্ছিস কেন রে?

কোথায় সমাধান দিলাম। আমি কেবল দুটো পরামর্শ দিলাম। সমস্যার তো কোনো সমাধান হয় নাই।

তাই তো…সমস্যার তো সমাধান হয় নাই। আচ্ছা বল তো, এই জিনের বাদশা কেসটা কোত্থেকে শুরু করি।

বললাম না, মোবাইল নম্বরগুলোর পেছনে লাগতে হবে। ওগুলো কাদের, কোত্থেকে ব্যবহার করা হয়, সেসব…আমি বললাম।

মামা বললেন, আচ্ছা, ওরা বুবুকে তোর সম্পর্কে, টুপাই সম্পর্কে এত কিছু বলতে পারল কীভাবে। তাহলে কি ওরা আমাদের পরিচিত কেউ?

আমি বললাম, তুমি তো একটা ভালো প্রশ্ন করেছ। এইটা তো একটা ধাঁধা। এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে আমাদের সমস্যার সমাধান আছে। ফেলুদা হলে ঠিক বের করে ফেলতেন।

আরে রাখ তোর ফেলুদা। মাসুদ রানার মতো কোনো ডিটেকটিভই হয় না।

মামা, আমি যতদূর জানি মাসুদ রানা ডিটেকটিভ না, স্পাই।

স্পাই আর ডিটেকটিভ আলাদা নাকি?

মনে হয়। হোক আলাদা। আমাদের সামনে একটা রহস্য এসেছে, একটা অপরাধ ঘটেছে, সেটার কূলকিনারা আমাদের বের করতেই হবে। এই হলো কাজ। এটা স্পাইয়ের কাজ, নাকি ডিটেকটিভের কাজ, তাতে আমাদের কিছুই যায় আসে না।

তাহের ফুপাকে ফোন করা হলো। তাঁকে মামা পুরো ঘটনা খুলে বললেন। আম্মু কীভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন, বলা হলো। ঠিক কখন কখন ফোন এসেছে, তা-ও জানানো হলো। ফুপা এক ঘণ্টা সময় নিলেন।

এক ঘণ্টা পরে জানা গেল, ফোন গেছে সব রংপুর থেকে। এবং তাজহাট এলাকা থেকে।

মামা বললেন, জিনের বাদশা তাহলে তাজহাট এলাকায় থাকে?

আমি বললাম, জি মামা। তাজহাট এলাকাতেই থাকে। চলো, ওই এলাকায় আরেকবার যাই।

মামা বললেন, কেন বল তো?

আমি বললাম, এখন আমি জানি, ঘটনার পেছনে কে। এটা পানির মতো সোজা।

মামা বললেন, কী রকম?

আমি বললাম, তোমার মোবাইল ফোনটা চুরি হওয়াই সব ঘটনার মূলে। তোমার মোবাইল ফোনে সব আছে। আমার নাম। তোমার নাম। আম্মুর নাম্বার। এমনকি দামি সেটে ফটো আছে। এসএমএস আছে। এমনকি তোমার ই-মেইলও ওই সেটে খোলা অবস্থায় পাওয়া যায়। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। ফেসবুকে ঢুকলেই তো সব পাওয়া যাবে। মানে আমাদের পরিবারের পুরোটা খোঁজ সে পেয়ে যাবে। তারপর আম্মুকে ফোন করে জিনের বাদশার গল্প বলে টাকা আদায় করা কোনো ব্যাপারই না।

মামা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বাপরে, তুই তো দেখছি সাংঘাতিক। তোর মাথায় এত বুদ্ধি। বড় হলে তুই একটা বিশাল গোয়েন্দা হবিই।

মামা আর আমি এখন জানি, আমাদের সন্দেহভাজন লোকটা থাকে তাজহাট এলাকার বাবুপাড়ায়। সেখান থেকেই সে সবগুলো ফোন করে থাকে।

আমরা বসে আছি তাজহাটের সেই জিলাপির দোকানে। যেখানে জিলাপি খেতে গিয়ে মামার মোবাইল ফোনটা হারিয়ে গিয়েছিল।

সকালবেলা। রোদ উঠেছে কুয়াশা চিরে। ছায়া পড়েছে লম্বা লম্বা। মামা বললেন, আপনার দোকানের জিলাপির এমন স্বাদ। তাই আবার চলে এলাম। দিন দেখি গোটা চারেক জিলাপি।

জিলাপি এল। গরম গরম জিলাপি। চিনির রস থেকে সদ্য ওঠানো। আমি খুব মজা করে জিলাপি খাচ্ছি।

মামা বললেন, ভাই, ওই যে সেদিন যে লোকটা এখানে বসেছিলেন, পেপার পড়ছিলেন, তাঁকে কি আর কখনো দেখেছেন?

দোকানি বললেন, কোন লোকটার কথা কইতেছেন জানি?

ঠিক তখনই আমার নজর পড়ল সামনের রাস্তায়। সেই লোকটাকেই যেন দেখতে পাচ্ছি। গলায় সবুজ রঙের মাফলার জড়ানো।

আমি বললাম, ওই যে লোকটা যাচ্ছেন, গলায় সবুজ মাফলার জড়ানো, গায়ে নীল রঙের সোয়েটার, উনি…

জিলাপির দোকানি বললেন, হয় হয়, উনি কাইলকাও আসিয়া বসছিল এই দোকানে। ওনার কথা আপনেরা আরেকবার পুছ করছিলেন।

মামা বললেন, টুকন, কুইক। উঠে পড়। লেটস ফলো দ্যাট পারসন।

আমি জ্যাকেটের ক্যাপ টেনে মাথা ঢেকে নিলাম। মামারও মাথায় একটা মাংকি টুপি। সেটা টেনে তিনি কান ঢেকে নিলেন। লোকটা আমাদের দিকে আসছে। তারপর দোকানটা পেরিয়ে চলে যেতে লাগল। এরই মধ্যে আমি আমার মোবাইল ফোনে কথা বলার ভান করতে করতে তার দুটো ফটো নিঃশব্দে তুলে নিলাম। মামা ফিসফিসিয়ে বললেন, শাবাশ। লোকটা চলে যাচ্ছে। তার পেছনটা দেখা যাচ্ছে। মামা বললেন, গেট আপ। মুভ।

আমরা দুজনে প্রায় ৫০ ফুট পেছন থেকে ওই সবুজ মাফলারকে অনুসরণ করতে লাগলাম।

তিনি কিছুদূর গিয়ে একটা রিকশা ভাড়া করলেন। আমরাও একটা রিকশা নিয়ে নিলাম। বললাম, ভাড়া যা লাগে দেব, আপনি ওই রিকশার পেছনে পেছনে চলেন।

আমাদের রিকশা ছুটছে। কনকনে ঠান্ডা বাতাস এসে লাগছে চোখে-মুখে। আবার রোদও আছে বেশ ঝকঝকে। কাজেই ভালোই লাগছে। তবে আমার বুক ধুঁকধুঁক করে কাঁপছে। একধরনের উত্তেজনা বোধ করছি। গরম লাগছে। একটু একটু করে ঘামছি।

সামনের রিকশা রাস্তা থেকে একটা গলিতে ঢুকে পড়ল। আমাদের রিকশা দুই মিনিট পরে ঢুকল সেই গলিতে।

আমাদের রিকশাওয়ালা বলল, মুই জোরে চালাবার পারোম। চালামো?

মামা বললেন, না না, যেভাবে যাচ্ছেন, সেভাবেই যান।

এভাবে খানিক চলার পরে লোকটা রিকশা ছেড়ে দিলেন। আমরা দূরত্ব বজায় রেখে আমাদের রিকশা দাঁড় করালাম। তিনি একটা বাড়ির পেছনের সরু গলিতে ঢুকলেন। রিকশাওয়ালাকে ৩০ টাকা দিয়ে আমরাও তাঁর পিছু নিলাম। তারপর তিনি একটা শজনে গাছের নিচে একটা বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেন। ভেতর থেকে গেট খুলে গেলে তিনি ঢুকে গেলেন সেই বাড়ির ভেতরে। যাওয়ার আগে একবার যেন আমাদের দিকে তাকালেন। আমার বুকটা ব্যাঙের মতো লাফিয়ে উঠল।

সামনের দিকে একটা মুদির দোকান। আমরা সেই দোকানে গেলাম।

মামা বললেন, আপনার কাছে দেশলাই হবে?

আমি একটু অবাকই হলাম। মামা তো সিগারেট খান না। দেশলাই চাচ্ছেন কেন?

মামা বললেন, আপনাদের দোকানের মোয়া মনে হচ্ছে ভালো হবে। দেন তো দেখি।

দোকানি বলল, কী চাইলেন?

মোয়া।

মামা দেখিয়ে দিলেন। দোকানি বললেন, ও মলা। আচ্ছা কয়টা মলা লাগিবে? আপনারা কোটে থাকি আসচেন?

মামা বললেন, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি।

দোকানি বলল, ও ঢাকা থাকি। কার কাছে?

না ঠিক কারও কাছে না। তবে আমাদের একজন পুরোনো বন্ধু আছে এখানে। আপনি দেখলে চিনবেন হয়তো। টুকন, তোমার মোবাইল থেকে ওনার ফটোটা দেখাও তো।

আমি মোবাইল ফোনে সবুজ মাফলারওয়ালা লোকটার ছবি বের করে দেখালাম দোকানিকে।

তিনি বললেন, ও, সুরুজ মিয়া। ওই বাড়িতে থাকে।

মামা বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ সুরুজ মিয়ার কথাই হচ্ছে।

নতুন আসচে পাড়াত। তবে লোকটা খরচ করবার পারে ভালো। বাকি তো থোয় না, বরং পাঁচ শ টাকার নোট দিয়া বলে, কত হইল নেন। খুব দিলদরিয়া আছে।

সুরুজ মিয়ার বাড়ি কই বলে মনে হয়?

কথা শুনি মনে হয় গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা এলাকার মানুষ।

বাড়িতে কে কে থাকে?

তা তো কবার পারি না। কিন্তুক ধরেন বাড়িত একটা কাজের লোক আছে। আর বাইরে মানুষজনও খুব আইসে।

মামা দেশলাই আর মুড়ির মোয়ার দাম দিয়ে দিলেন। আমরা উঠে পড়লাম।

মামা বললেন, ঘরে বসে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। এরপর আমরা কী করব। চল রিকশা নিই।

রিকশা নেওয়া হলো। আমরা মোটেলে ফিরে এলাম।

মোটেল ঘরে আমি বসে আছি সবুজ রঙের সোফাটায়। মামা বসেছেন বিছানায়। মামা জুতার ফিতা খুলতে খুলতে বললেন, এবার আমাদের কী করা উচিত?

আমি বললাম, মামা, আমি গোয়েন্দা নাকি তুমি গোয়েন্দা? তুমিই বলো।

মামা বললেন, আমরা তো প্রধান অপরাধীকে শনাক্ত করে ফেলেছি। ওই সবুজ মাফলারওয়ালাই আসল ক্রিমিনাল।

আমি বললাম, সুরুজ মিয়া।

রাইট।

গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় বাড়ি।

রাইট। কাজেই আমাদের এখনকার কাজ হবে পুলিশের সাহায্য নেওয়া। পুলিশ সুরুজ মিয়াকে অ্যারেস্ট করবে। আর দুদিনের রিমান্ডে নেবে। রিমান্ডে নিলেই সেই বাপ বাপ বলে সব স্বীকার করবে। কীভাবে সে মানুষকে প্রতারণা করে। কে কে তার সঙ্গে জড়িত। সব।

আমি বললাম, তাহলে আর কী! চল পুলিশকে জানাই।

প্রথম কাজ হলো জিশান আংকেলকে জানানো।

মামা বললেন, ফোন কর জিশান আংকেলকে।

হাসিবকে ফোন করলাম ওর বাবার ফোন নম্বরের জন্য। হাসিব বলল, বাবা তো বাসাতেই আছে। আমিও বাসাতেই। দাঁড়া এক মিনিট, বাবাকে ফোন দিচ্ছি। বাবা, বাবা…

জিশান আংকেল ফোন ধরে পুলিশি গলায় বললেন, হ্যালো…

আংকেল। আসসালামু আলাইকুম। আমি টুকন বলছিলাম, আংকেল।

হ্যাঁ, বাবা, বলো…

আংকেল। আমরা একটা সমস্যায় পড়েছি। আমরা এখন রংপুরে। আমার মামার মোবাইল ফোনটা চুরি হয়ে গেছে।

খুব দামি মোবাইল সেট?

জি আংকেল। তবে ফোন করেছি মোবাইল সেটের জন্য না। আরও বড় সমস্যা।

কী সমস্যা?

আংকেল, জিনের বাদশার সমস্যা।

জিনের বাদশার সমস্যা। হ্যাঁ হ্যাঁ শুনেছি বটে সমস্যাটার কথা। মোবাইল ফোনে নিজেকে জিনের বাদশা বলে পরিচয় দেয়। তারপর পটিয়ে টাকা আদায় করে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই। আপনি আমার মাসুদ মামার সঙ্গে কথা বলেন আংকেল প্লিজ।

মামা ফোন নিলেন। ব্যাপারটা খুলে বললেন। জানালেন যে তাঁর মোবাইল ফোন চুরি হয়ে গেছে। সেই সেটের মধ্যে ফেসবুক ছিল, ই-মেইল ছিল, ফটো ছিল, ভিডিও ছিল। সেসব দেখে আমাদের সম্পর্কে জেনে কী করে আমার মার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে জিনের বাদশা সেজে। আমরা খবর নিয়েছি, সবগুলো কল গেছে রংপুরের তাজহাট এলাকা থেকে। ফোনটা যিনি চুরি করেছেন, তাঁর নাম সুরুজ মিয়া। বড়ই সন্দেহজনক লোক। এলাকায় নতুন এসেছেন। টাকাপয়সা খরচ করেন দেদার। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেছে। এই সুরুজ মিয়াকে ধরলেই সব ধরা পড়ে যাবে।

মামাকে কী সব নির্দেশ দিলেন জিশান আংকেল। মামা জি জি করে ফোন রেখে দিলেন। বললেন, চল, কোতোয়ালি থানায় যেতে হবে। হাসিবের বাবা থানাকে এখনই সব ইনস্ট্রাকশন দিয়ে দেবেন। গিয়ে পরিচয় দিলেই কাজ হয়ে যাবে।

আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম মোটেল থেকে। উঠে পড়লাম আরেকটা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায়। থানাটাও বেশ দূরেই। থানার সামনে মাঠ। তাতে লোকজনের ভিড়। থানার বারান্দার পিলারের সঙ্গে অনেক সাইকেল রাখা। এক পাশে অনেক পুরোনো রিকশার স্তূপ। মনে হয়, অবৈধ রিকশা ধরে এনে পালা করে রাখা হয়েছে।

থানার অফিসার ইনচার্জ সুদর্শন। তাঁর বুকে লেখা হারুন অর রশিদ। আমরা এগিয়ে যেতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আসেন আসেন।

আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, তুমি টুকন? আমি বললাম, জি।

আর উনি তোমার…

আমি বললাম, মাসুদ মামা।

হারুন সাহেব বললেন, আসেন মাসুদ সাহেব। বসেন। স্যার ফোন করেছিলেন। বলেন তো আপনাদের ঘটনাটা।

মামা পুরো ঘটনা আবার বর্ণনা করলেন।

ওসি সাহেব ঘটনার নোট নিলেন। তারপর বললেন, বাসাটা আপনারা লোকেট করতে পারবেন? আমি আপনার সাথে আমার লোক পাঠাচ্ছি। এক্ষুনি ওই সুরুজ মিয়াকে ধরে আনা হবে। আপাতত সন্দেহজনক গতিবিধির কারণে ৫৪ ধারায় অ্যারেস্ট করে আনি। পরে মামলা করা যাবে।

মামা বললেন, ঠিক। আমরাও তাই সাজেস্ট করি।

পুলিশের মোটরসাইকেলের পেছনে উঠতে হলো। দুটো মোটরসাইকেল। একটার পেছনে উঠলেন মামা। আরেকটার পেছনে বসলাম আমি।

আবার তাজহাটের সেই মোড়। তারপর রাস্তা ধরে খানিক যাওয়া। তারপর গলি। তারপর সেই রহস্যময় মানুষের রহস্যময় টিনে ছাওয়া সাদা পাকা বাড়ি।

বাড়িটা দেখিয়ে আমাদের কাজ শেষ। আমাদের দুই পুলিশ আংকেল নামিয়ে দিয়ে গেল মোটেলে। নামার পরে আমি আংকেল দুজনকে আমার মোবাইল ফোন বের করে সুরুজ মিয়ার ফটোও দেখিয়ে দিলাম।

ওরা সব বুঝে নিয়ে মোটরসাইকেলের ধোঁয়া ছেড়ে চলে গেলেন। বেলা বেজে গেছে তিনটা। পেট চোঁ চোঁ করছে। আগে কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার।

রাত আটটার দিকে খবর এল, সুরুজ মিয়া ধরা পড়েছেন। তাঁকে থানায় আনা হচ্ছে। ওসি হারুন অর রশিদ মামাকে ফোন করে অনুরোধ করেছেন যেন আমরা গিয়ে একবার সুরুজ মিয়াকে শনাক্ত করে আসি যে আসল সুরুজ মিয়াই ধরা পড়েছেন কি না।

তিনি গাড়ি পাঠাচ্ছেন আমাদের জন্য।

পুলিশের গাড়িতে করে যাওয়া গেল থানায়। দূর থেকে দেখলাম লোকটাকে।

সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম, হারুন আংকেল এই লোকই সেই লোক।

হারুন অর রশিদ বললেন, ঠিক আছে তাহলে। আজকে আপনারা যান। রেস্ট নেন। কাল যদি লাগে একবার আসবেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় কোনো হেল্প যদি লাগে…

আচ্ছা আচ্ছা আসব। বলে আমরা বিদায় নিলাম। পুলিশের গাড়িই পৌঁছে দিল আমাদের।

জিনের বাদশা ধরা পড়েছে। আমরা নিশ্চিত মনে ঘুমাতে গেলাম। গোয়েন্দা হিসেবে মামা বেশ সাফল্যই পেলেন বলা যায়। তবে এই কৃতিত্বের ভাগ আমাকেও দিতে হবে। জিশান আংকেল আমার বন্ধুর বাবা।

গোল বাধল আরেকটু রাতে। আমি ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। মামার সস্তা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল তারস্বরে। ঘুম ভেঙে গেল।

মামা ফোন ধরলেন, হ্যালো…

মামা বললেন, জি।

আমি বললাম, মামা, ফোনের স্পিকার অন করো। আমিও শুনি।

মামা স্পিকার অন করলেন।

বাবা, মাসুদ। ভালো আছিস তো বাবা…ফোনের স্পিকারে একটা গমগমে গলা।

হ্যাঁ, ভালো আছি। কে বলছেন?

আমি তোর দাদা আবুল কালাম বলছি রে। গলা শুনে টের পাচ্ছিস না।

দাদা আবুল কালাম। আমার দাদা তো সেই কবেই মারা গেছে।

হ্যাঁ রে, মারা তো গেছিই। মারা যাওয়ার পরে কি আর কথা বলা যায় না। যায় রে।

আপনি আসলে কে বলছেন সেটা বলেন। মামার গলায় কাঁপন।

তুই আমার নাতি মাসুদ। তুই আমার সাথে এইভাবে কথা বলছিস কেন। আচ্ছা আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না। দেখ, তোর ছাদের দিকে তাকা। আমার ছায়া দেখতে পাবি।

শুনে আমার আত্মা খাঁচাছাড়া প্রায়। মামা ভয়ে ভয়ে তাকালেন ছাদের দিকে। ডিম লাইটে একটা ছায়া নড়ছে বটে।

এরপর তিনটা ঠক ঠক ঠক শব্দ।

কী, তিনটা শব্দ শুনতে পেলি? আমি তোর দাদারে। আমার শরীর নাই। তবে আমার আত্মা আছে। আমার আত্মা তোর রুমে গেছে। তুই তো এখন রংপুরে পর্যটন মোটেলে। তাই না?

আমাদের ঘরে লোবানের গন্ধ। আতরের গন্ধ। আমি ভয়ে কম্বলের নিচে মাথা লুকিয়ে ফেললাম।

মামা বলছেন, দাদা, আমাকে এত রাতে ভয় দেখাচ্ছেন কেন?

তোর সামনে খুব বিপদ। তোর বিপদ হবে। টুকনেরও বিপদ হবে। তোরা তাড়াতাড়ি রংপুর ছেড়ে ঢাকা চলে যা। আর এই নম্বরে ঢাকায় গিয়ে ১৫ হাজার এক টাকা পাঠা। না হলে টুকনকে জিনের বাদশা ধরে নিয়ে যাবে। জিনের বাদশা তো আগুনে তৈরি। তোদের মোটেলের ঘরে ঢোকা তার পক্ষে কোনো ব্যাপার না। দরজা-জানালা খোলা থাকার দরকার পড়ে না। সে বাতাসে মিশে যেতে পারে। বাতাসে মিশেই যেকোনো কাউকে তুলে নিয়ে আসতে পারে। বুঝলি।

ঘরে লোবানের গন্ধে শ্বাস নেওয়াও কঠিন।

ধপ ধপ ধপ করে জোরে জোরে শব্দ হচ্ছে। আমি কম্বলের নিচে।

মামা বুঝি অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

কী রে। ভয় পেলি নাকি, হ্যালো হ্যালো। ফোন কেটে গেল বোধ হয়। হি হি হি শব্দ হচ্ছে।

মামার মুখ থেকে গোঙানির শব্দ হচ্ছে। আবার ফোন বাজছে। কেউ ধরছে না। আবার বাজল।

মামা বোধ হয় মরেই যাবে। বুকে অনেকখানি সাহস সঞ্চয় করে আমি উঠে পড়লাম। লাইট জ্বালালাম।

বাইরে হঠাৎ চিৎকার। ধর ধর ধর…ভয়ে আমার সারা শরীর কাঁপছে। শীতের রাতেও আমার শরীর ঘামছে।

মামার মুখে ফেনা উঠেছে। আমি তার গায়ে ধাক্কা দিতে লাগলাম। মামা, মামা…

আমি টেবিল থেকে পানির বোতল নিয়ে মামার চোখে-মুখে ছিটাতে লাগলাম। একটু পরে মামার জ্ঞান ফিরে এল।

মামা বললেন, কাল সকালবেলাতেই আমরা ঢাকা চলে যাব। আমাদের আর গোয়েন্দাগিরির দরকার নাই।

সকালবেলা বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙল। আমরা সব লাইট জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পর্যটনের ডাইনিং রুমে নাশতা করতে গিয়ে শুনলাম, কাল রাতের বেলায় চোর এসেছিল মোটেলে। দারোয়ানেরা চোর প্রায় ধরেই ফেলেছিল। অল্পের জন্য…

দিনের আলোয় সাহস ফিরে আসছে। আমরা ঠিক করলাম, থানায় যাব।

থানায় যেতেই ওসি হারুন আংকেল আমাদের বললেন, বসেন বসেন। কথা আছে।

কী কথা?

দাঁড়ান। সুরুজ মিয়াকেও ডাকি।

সুরুজ মিয়া এলেন। বসলেন আমাদেরই পাশে।

হারুন আংকেল বললেন, একটা সেমসাইড হয়ে গেছে। সুরুজ মিয়া আসলে পুলিশেরই গোয়েন্দা বিভাগের লোক। তিনি ঢাকা থেকে এসেছেন জিনের বাদশারই তদন্ত করতে। খুব বেড়ে গেছে ইদানীং জিনের বাদশার অত্যাচার। তিনি আমাকে রিপোর্ট করে গিয়েছিলেন। কিন্তু আসলে তো তাঁর নাম সুরুজ মিয়া না। তাই আমি কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। আর তাঁর গোঁফজোড়াও নকল।

সুরুজ মিয়া তাঁর নকল গোঁফ খুলে রেখে হো হো করে হেসে উঠলেন।

আমি আর মামা দুজনেই হাঁ হয়ে গেলাম। আমাদের গোয়েন্দা অভিযান এভাবে মাঠে মারা গেল। আমাদের ক্রিমিনাল আমাদের সামনে বসে হো হো করে হাসছেন। এখন।

এদিকে রাতের বেলা কীসব কাণ্ডই না ঘটেছে। আমি তো প্যান্ট ভিজিয়েই ফেলেছিলাম প্রায় রাতের বেলা। এখন দিনের আলোয় থানায় পুলিশের সামনে বসে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে।

মামা বললেন, ভাই সুরুজ মিয়া…

সুরুজ মিয়া বললেন, আমার নাম আবদুল মোক্তাদির।

ভাই আবদুল মোক্তাদির, আপনি কেন সুরুজ মিয়া হলেন না? মামা বলতে লাগলেন, আমরা একটা ডিটেকটিভ কেসের সমাধান করে ফেলেছিলাম, আপনি উল্টে দিলেন।

আবদুল মোক্তাদির বললেন, আপনি বললে আমি সুরুজ মিয়া হতে পারি। কিন্তু তাতে তো জিনের বাদশার হাত থেকে মানুষ বাঁচবে না।

মামা বললেন, ঠিক বলেছেন। আপনাকে অ্যারেস্ট করার পরও আমার কাছে জিনের বাদশার ফোন এসেছিল।

মামা আর আমি মিলে গত রাতে কী কী ঘটেছে, সবিস্তারে বর্ণনা করলাম।

মোক্তাদির হাসতে লাগলেন।

মামা বললেন, হাসেন কেন?

না হাসার কোনো কারণ নাই। আমি তো জিনের বাদশা না। যে বা যারা জিনের বাদশা তারা বাইরে আছে। তাদের নিজেদের গোয়েন্দা আছে। যারা মানুষের খোঁজখবর নিয়ে তাদের ফোন করে। তাজহাট এলাকায় তাদের নেটওয়ার্ক ভালো হওয়ারই কথা। আপনারা দুজনে জিনের বাদশার রহস্য উন্মোচন করতে এসেছেন। আর ওরা আপনাদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়?

কিন্তু ওরা আমার সম্পর্কে এত জানল কী করে?

হারুন অর রশিদ বললেন, আপনি কিন্তু বলেছিলেন, ওরা সব জেনেছে আপনার মোবাইল ফোনটা থেকে।

আবদুল মোক্তাদির বললেন, সেটটা কার কাছে আছে, তাকে ধরতে পারলেই হলো।

তারপর তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। পেয়ে গেছি।

আমি বললাম, আমিও পেয়ে গেছি।

মামা বললেন, সেকি। আমি মাসুদ রানা। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আর তোমরা পেয়ে গেলে।

আমি বললাম, ফোনটা হারিয়েছে ওই দোকান থেকে। জিলাপির দোকান। আমরা সন্দেহ করেছিলাম সুরুজ মিয়া মানে মোক্তাদির আংকেলকে। তিনি নিজেই পুলিশের লোক। তাহলে বাকি থাকল ওই জিলাপির দোকানদার নিজে।

আর তার সামনে আমরা অনেক কথা বলাবলিও করেছি। বললেন মামা।

কুইক।

মোক্তাদির আংকেল ছুটে বেরিয়ে গেলেন। হারুন আংকেল লোক দিলেন তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্য। আমরা থানায় বসে রইলাম।

এক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ ধরে আনল জিলাপিওয়ালাকে।

তার নাম মজনু মিয়া।

তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আমি আর মামা পাশে বসে আছি।

মোক্তাদির আংকেল বললেন, মাসুদ সাহেবের মোবাইল ফোনটা কই।

মজনু মিয়া বলল, কোন মোবাইল ফোন?

মামা হেসে বললেন, কিছুই জানেন না। আমি আপনার দোকানে গিয়ে পরে খোঁজ নিয়েছি কি না যে আমার মোবাইল ফোন হারিয়ে গেছে, আপনি পেয়েছেন কি না…

মজনু মিয়া প্রথমে অস্বীকার করল। তারপর বলল, ফোনটা আসলে সে দিয়েছে জাহাঙ্গীর বাদশাকে।

জাহাঙ্গীর বাদশার কাছে ছুটলাম আমরা।

তার বাড়ি দোতলা। বাইরে উঁচু প্রাচীর। লোহার বিশাল গেট বন্ধ।

পুলিশ তার বাড়ি ঘিরে ফেলল।

দরজা খুলে ভেতরে যাচ্ছি। আতর আর লোবানের গন্ধ। যেটা আমরা গত রাতে পেয়েছি।

জাহাঙ্গীর বাদশা পুষ্পপ্রেমিক। বাড়ির ভেতরে ফুলের বাগান। তার লম্বা দাড়ি, লম্বা গোঁফ।

আমরা যেতেই তিনি একটা ব্রিফকেস হাতে নিয়ে বললেন, আসেন আসেন, আমি আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছি। এই ব্রিফকেসে বোমা আছে। এই পুরা বাড়ি ধ্বংসের জন্য এটা যথেষ্ট। আপনারা কেউ নড়বেন না। সবাই পাশের ঘরে ঢোকেন। আমাকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেন।

হারুন অর রশিদ আর মোক্তাদির আংকেল পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন।

আমরা সবাই পাশের ঘরে গেলাম।

সেই লোবানের গন্ধ। আতরের গন্ধ। ঘরের মেঝেতে একটা লাল গালিচা। পুরো ঘরে আর কিছু নেই। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ হয়ে এল।

তারপর বাতি গেল বন্ধ হয়ে। আমরা একটা অন্ধকার ঘরে আটকা।

মামা বললেন, এখন কী হবে।

হারুন আংকেল বললেন, এখন জাহাঙ্গীর পালিয়ে যাবে। যাওয়ার সময় উড়িয়ে দিয়ে যাবে এই বাড়িটা। আমরা সবাই মারা পড়ব।

মোবাইল ফোনগুলোর আলোয় আমরা ঘরটায় আলো জ্বালানোর চেষ্টা করছি। হারুন আর মোক্তাদির আংকেল ফোন করে কোথায় কোথায় সাহায্য চাইতে লাগলেন।

মিনিট সাতেক সময় আমরা বন্দী ছিলাম ওই ঘরে।

তারপর দরজা গেল খুলে।

দেখলাম পুলিশের লোক।

পুলিশ বলল, স্যার, এই লোকটা পালিয়ে যাচ্ছিল স্যার। আমরা তাকে ধরে ফেলেছি। লোকটা আমাদের ব্রিফকেস ভর্তি বোমার ভয় দেখাচ্ছিল। আমি স্যার তার ব্রিফকেসেই গুলি করেছি। ব্রিফকেস হাত থেকে পড়ে গেছে। ব্রিফকেসে কিছু ছিল না স্যার।

ঘরের বাতি জ্বলে উঠল। আমি দেখতে পেলাম, মামার প্যান্ট ভেজা।

আমরা ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি। কুখ্যাত জিনের বাদশা রহস্য উন্মোচন করার জন্য আমাদের খুবই প্রশংসা হচ্ছে চারদিকে। স্থানীয় কাগজ রংপুর প্রকাশিকায় আমাদের সাক্ষাৎকারও বেরিয়েছে।

আসলে হারুন আঙ্কেলই সব কৃতিত্ব আমাদের দিয়ে চলেছেন। তিনি বলছেন, এই দুজন মজনু মিয়াকে শনাক্ত করেছিল বলেই আমরা জাহাঙ্গীর বাদশা পর্যন্ত যেতে পেরেছি।

জাহাঙ্গীর বাদশা আসলে ছিল একটা ছিঁচকে প্রতারক। গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় বহু লোকের কাছ থেকে সে ধারদেনা করেছিল। পরে তার মাথায় আসে জিনের বাদশার নাম করে লোক ঠকানোর বুদ্ধি। সেটা করে সে খুব বড়লোক হয়ে যায়। রংপুরের তাজহাট এলাকায় একটা দোতলা বাড়ি ভাড়া নেয় সে। নিজেকে একজন প্রকৃতিপ্রেমিক আর পুষ্পপ্রেমিক হিসেবে দাবি করে। আর দাবি করে একজন পরহেজগার মানুষ হিসেবে।

মজনু মিয়া মোবাইলটা তার কাছে বিক্রি করেছিল এগারো হাজার টাকায়। সেটটার দামই অবশ্য ৪০ হাজার টাকা। সেখানেও তার লাভ। তবে সেটের মধ্যে পাওয়া অনেক তথ্য তাকে আরেকজনকে শিকারে পরিণত করতে সাহায্য করে।

মামা বললেন, সব রহস্যের উন্মোচন হলো। কিন্তু আমাদের মোটেল রুমে দাদার আত্মা এলেন কী করে?

আমি বললাম, মামা, এই বুদ্ধিটা তোমার মাথায় নাই। তুমি নিজেকে গোয়েন্দা দাবি করো। মজনু মিয়ার দোকানে বসে আমরা নানান গল্পই তো করেছিলাম। মজনু মিয়া সব তথ্য জানিয়েছে জাহাঙ্গীরকে। তখন মজনু মিয়া লোক পাঠিয়েছে মোটেলে। আমাদের ঘরের বাইরে তারা শব্দ করেছে। ঘরের ভেন্টিলেটর দিয়ে আতর আর লোবানের ধোঁয়া ঢুকিয়ে দিয়েছে। তারাবাতিও ঢোকাতে পারে। আর ফোনে তোমার দাদার গল্প করেছে। তোমার দাদাকে নিয়ে তুমি একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছিলে, মনে নাই।

মামা বললেন, এই টুকন। তুই এত কথা বলছিস কেন? গোয়েন্দা কে? তুই না আমি?

আমি বললাম, তোমার নাম মাসুদ রানা। গোয়েন্দা তো তুমিই।

আমাদের বাস বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু পার হচ্ছে। কী সুন্দর নদী। নদীর মাঝখানে চর। চরে আবার কাশফুল ফুটে আছে।

বাংলাদেশটা এত সুন্দর।

লেখা: আনিসুল হক

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments