Friday, March 29, 2024
Homeকিশোর গল্পফাটল - মুর্তজা বশীর

ফাটল – মুর্তজা বশীর

'ফাটল' - মুর্তজা বশীর

মাথার পেছনে ডান হাত রেখে, চিত হয়ে শুয়েছিল পিন্টু। ঘুম তার ভেঙেছিল ছোট বোন রাবেয়ার বাঁশির মতো সরু গলার আওয়াজ শুনে। রোজ ভোরে এমনি বাশির সূর তুলে কোরআন পড়ে তার বোন। মাঝে মাঝে একটু বিরক্তিও লাগে তার। শীতের আমেজ এখনো লেপের ভেতর থেকে পালিয়ে যায়নি, বরং এক উষ্ণতা এখনো ঘিরে। সারা শরীরে উইয়ের ঢিপির মতো বাসা বেঁধেছে।

রাবেয়া বসেছিল দোরগোড়ায়। বারান্দায় রোদ এক চিলতে পড়েছে। সেখানে ছেড়া মাদুর বিছিয়ে দুলে দুলে পড়ছিল রবেয়া। সবদিনের মতো ভোরের রোদ লাটালির ছাদ বেয়ে এখানে এসে জমে থাকে। সদর রাস্তা থেকে কিছু ভেতরের দিকে বাসা। দুপাশে উঁচু দোতলা, তার মাঝে এই একতলায় রোদ আসতে বেলা বেশ হয়ে যায়।

তা নাহলে আরো সকালে তাকে কোরআন নিয়ে বসতে হয়। আব্বা ফজরের নামাজ পড়েই পাটিতে বসে অপেক্ষা করেন তার জন্য। সে এলে তাকে কোরআনের সুরা পড়ান, ভুলচুক সংশোধন করে দেন।

কপালের ভুরু পর্যন্ত ঘোমটা টেনে রাবেয়া পড়েছিল। এই শীতে মাথায় কাপড় তেমন খারাপ লাগে না তার, তবে গরমে বেশ অস্বস্তি মনে হলেও উপায় থাকে না। বারো পেরিয়ে তেরোতে পা দিয়েছে, অমনি তিনি মেয়েকে শাড়ি পরতে বলেছেন। নইলে, চেঁচামেচির শেষ নেই। মুসলমান ঘরের মেয়ে শাড়ি ছাড়া কেমন বেআব্রু রাগে, নিজের চোখে কেমন লজ্জা এসে ভিড় করে। রাবেয়াকে হঠাৎ পড়ার মাঝে থামতে দেখে তিনি প্রশ্ন করেন, কি হলো রে মা, থামলি যে? চোখ বুজে রাবেয়ার মিহি সুরের তিলাওয়াত শুনছিলেন তিনি, হঠাৎ চোখ মেললেন।

আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে হুট করে জবাব দিতে পারল না রাবেয়া। শরীফ সাহেব ঝুঁকে রাবেয়ার ডান হাতের তর্জনী লক্ষ্য করে বললেন, পড়। ইন্নাল্লাহা বি কুল্লি শাইয়িন আলিমু। আইন জবর – লাম যের…।
ঠিক এমনি করে তিনি স্কুলে ইতিহাস পড়ান। ছাত্রদের সন তারিখ দিয়ে মুখস্থ করান সেকেন্দার শাহ, তৈমুরলঙ এর আক্রমণ, সব।।

হাই পাওয়ারের পুরু লেন্সের চশমা নাকের ডগা থেকে সরিয়ে ফেললেও নিষ্প্রভ চোখ দিয়ে গড়গড় করে বলতে পারেন কোন লাইনের পর কি, কোন ঘটনার পর কোন ঘটনা। প্রথম যৌবনে তিনি শখ করে ইতিহসের শিক্ষক হয়েছিলেন। মনে ছিল অফুরন্ত আশা, ছেলেদের ইতিহাস পড়াবেন, নিজের দেশকে ভালভাবে ভালবাসতে শেখাবেন, মানুষদের ভালোবাসতে শেখাবেন। আগে হৃদয়ে পেতেন উষ্ণতা। তারপর জীবনের বাস্তবতায় সেই উদ্দামতা এক সময় কখন যে হারিয়ে গেছে টেরই পাননি। এখন সবকিছু মনে হয় অর্থহীন, বিবর্ণ মৃতদেহ। আপসোস হয় তাঁর এই বার্ধক্যের দোরগোড়ায় এসে নিজের এমন নির্বুদ্ধিতার জন্য। এখন মনে হয় সবকিছু ভুল করেছেন, জীবনে আগাগোড়াই তাঁর মিথ্যে দিয়ে ভরা। অতীতের ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে তিনি অতীতেই রয়ে গেছেন, ভবিষ্যৎও অতীত হয়ে গেছে।

আব্বার জন্য তাই মায়া হয় পিন্টুর। ছোটবেলায় যে আব্বাকে সে দেখেছিল, এখন এই কৈশোরে তাঁকে মনে হয় অন্য কেউ। সেই প্রাণস্ফুর্তি শুকিয়ে গেছে, তার চিহ্ন কোথাও নেই। আব্বাকে দেখলে তার মনে হয় একটা শুকনো নদীর মতো। দিক পাল্টিয়ে যে নদী চলে গেছে, শুধু রেখেছে তার বালির খাদ। তা না হলে আব্বা রাবেয়াকে আরো পড়াতেন, এবং তাকেও ছবি আঁকার ইস্কুলে ভর্তি করতেন।
রাবেয়ার বড় ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়ার। অবশ্য এরও এক কারণ ছিল। পাশের বাড়ির সেই যে কালোমতো পাতলা মেয়েটা হেনা, যার সঙ্গে গলায় গলায় ভাব ছিল, ও মারা যাওয়াতে রাবেয়া ঠিক করল ডাক্তারি পড়ার। কতটুকুন তখন রাবেয়া, এই এগারো বারো হবে। একরকম বিনা চিকিৎসায় মরে গেল হেনা। দুটাকা ভিজিটের ডাক্তার একমাস ধরে চিকিৎসা করেও কিছু করতে পারেনি। পাঁচ টাকা ভিজিটের ডাক্তার সপ্তাহে তিনবার এসে, এক রাশ ফলমূল দুধ মাখন দিলে হয়তো বাঁচত!

কিন্তু তা হয়নি।

কেরানি বাপের চোখের সামনে মেয়েটা শুকিয়ে মরে গেল। রাবেয়া কেঁদেছিল বান্ধবীর মৃত্যুতে। পিন্টু তাকে কিছুতেই থামাতে পারেনি।
ডুকরে ডুকরে কেঁদে বুক ব্যথা করে ফেলেছিল সে। একসময় যখন বুকের ব্যথায় আর কাঁদতে পারল না চোখ তুলে দেখল ভাইকে। বলল, ভাইয়া এমনি করে মরে গেল কেন সে?

এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি পিন্টু। শুধু চোখের কোণে অশ্রু এসে জমে উঠছিল। সেদিকে তাকিয়ে হয়তো জবাব খুঁজে পেয়েছিল রাবেয়া। তাই মাথায় কোঁকড়ানো চুল বাঁকিয়ে বলেছিল, গরীব বলে ভাল ডাক্তার আনতে পারেনি, না ভাইয়া?

কিছুক্ষণ ইতস্তত করে জবাব রাবেয়া নিজেই দিল, আমি ডাক্তার হবো। দেখো ভাইয়া, আমি ডাক্তারি পড়বো।
শুনে হেসেছিল পিন্টু, দূর তা কি তুই পারবি? মুরগির জবাই দেখলে কেমন ভয় পাস তুই।

ডাক্তারি অবশ্য আর পড়া হয়নি তার। তার পরের বছরে এইটে ওঠার পর আব্বা নাম কাটিয়ে দিলেন। চাকরির সময় ফুরানোতে আর দেরি নেই। মেয়েকে পড়ানো যেন পানিতে টাকা ফেলা মনে হলো শরীফ সাহেবের। বিয়ে হলে চলে যাবে, তাকে পড়িয়ে আর কি লাভ হবে? বরং পিন্টু পড়ুক, ওকে পড়ালে আবার পয়সা ঘরে আসবে। ছেলে তার চাকরি করে টাকা আনবে। যে টাকা তিনি খরচ করবেন তা পাই পয়সায় ফেরত আসবে ঘরে।

রাবেয়া অবশ্য খুব কেঁদেছিল। হেনা মারা যাওয়াতে যেমন করে কেঁদেছিল তেমনি। কিন্তু তার কান্নাকে কিছুতেই আমল দেননি তিনি। বরং ধমক দিয়েছেন, শাসিয়েছেন।
-কান্না কিসের শুনি? পড়ে তুই জজ ব্যারিস্টার হবি?
-ডাক্তার হবো।
-ছাই হবি।

মেয়ের সেই অপলক চাহনি কিছুতেই সহ্য করতে পারেননি তিনি। সেই বোবা চাহনিতেও যেন ভাষা ফুটে রয়েছে। সে ভাষায় জ্বালা ধরে মনে। নিজের অক্ষমতায় সে জ্বালা আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে। মেয়ের সামনে থেকে পালিয়ে তবে যেন শান্তি পান।

সেই রাবেয়াকে অবশ্য তিনি নিজেই কোরআন পড়া শেখালেন, যাতে কোরানের সুমধুর বাণীতে সব গ্লানি আপসোস ভরাট হয়ে যায়। মেয়েটার গলায় মাধুর্য আছে, মেয়ে না হলে তাকে মৌলানা করতেন।

পিন্টু কিন্তু আব্বাকে সেজন্য ক্ষমা করতে আজও পারেনি। তার মনে হয়েছে এ অন্যায়, অবিচার। বোন তার ছাত্রী ভালই ছিল, ক্লাসে ফার্স্ট সেকেণ্ড হতো। তার এই পরিণাম দেখে বুক বারবার কেঁপে উঠল। শেষে কি তারও এই অবস্থা হবে?

ম্যাট্রিক পাশ করার পর সে আব্বাকে আভাসে ইঙ্গিতে জানিয়েছে ছবি আঁকা সে শিখবে। কিন্তু সেকথা তিনি কানে নেননি।

শরীরটাকে ধনুকের মতো বেঁকিয়ে আড়মোড়া ভাঙল পিন্টু। বিছানার ময়লা চাদরে উবু হয়ে শুয়ে আধভেজানো দরোজার ফাক দিয়ে বাইরে তাকাল। উঠোনের একধারে, কলপারের পাশ ঘেঁষে ওঠা নারকেল গাছের পাতায় রোদের রেখা। দুটো শালিক। একটা বুঝি মা, তাই অন্যটা তার খয়েরী রঙের ডানা মৃদু কাঁপিয়ে হা করছিল বারবার। চিকন সরু পাতার ফাঁক গলিয়ে রোদের আদর শালিকটার বুকে পিঠে পরছিল। হঠাৎ দেখলে মনে হয় খয়েরী রঙের ওপর সোনালী জরির কাজ। পিন্টুর দেখতে ভাল লাগছিল সেই পালকগুলোর ওপর উজ্জ্বল ছটা। কেমন মসৃণ আর মোলায়েম ও জায়গাগুলো। রীতিমতো নিজের সত্তা দিয়ে অনুভব করা যায়।
চোখভরে চেয়ে তবুও তৃপ্তি মেলে না। রাবেয়াকে নিয়ে তার আব্বা সেখানে বসে।

দোরের চৌকাঠে বাঁ পা রেখেছে শরীফ সাহেব তাকালেন। হাতের তসবিটা মাথার কাছে রেখে জিগগেস করলেন, তা হলে কি ঠিক করলে?

চুপ করে রইল পিন্টু। কিছুক্ষণ পর ইতস্তত করে জবাব দিল, বলেছি তো।।

কি? ঘন আধপাকা ভুরুর নিচে চশমার নিকেলের গোল ফ্রেমের পুরুকাচের ভেতর চোখজোড়া কুঁচকে থাকে। মিনিট দুয়েক গুম ধরে থাকার পর বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়লেন তিনি, ছবি আঁকবেন না কচু করবেন। ছবি এঁকে কি হবে? পয়সা আসবে?

শরীফ সাহেব বুঝে উঠতে পারলেন না ছবি এঁকে লাভ কি। ছোটবেলায় পিন্টু যখন কাগজে কিংবা দেয়ালে ছবি আঁকত ভালই লাগত তার। মনে মনে ভাবতেন প্রতিভা আছে তার ছেলের। তা না হলে নিজের থেকে এমন সুন্দর করে ছবি আঁকতে সে পারত না। আনন্দে তার বুক বরে উঠত। নিজের সহকর্মীদের বলতেন ছেলের কথা, বলতে গর্বে তাঁর মন উচু হয়ে যেত। সবাইকে বলতেন ম্যাট্রিকের পর তাকে আর্ট স্কুলে পড়াবেন। রং কাগজ এনে দিয়েছিলেন ছবি আঁকার জন্য। মাঝে মাঝে তার কাজ নিজে যেচে দেখেছেন। স্ত্রীকেও ডেকে দেখিয়েছেন। দেখিয়ে তৃপ্তি পেয়েছেন। কিন্তু, আজ তাঁর মনে হয় তিনি ফের ভুল করেছেন। নিজেও ভুল করেছিলেন, পিন্টুর জীবনও ভুলে ভরে দিয়েছেন। ছবি আঁকবে যাদের ঘরে বাড়তি পয়সা রয়েছে তাদের ছেলেরা। সামান্য কটা টাকা সারা মাস ঘাম ঝরিয়ে মুখে ফেনা তুলে যা উপার্জন করেন তা এই খেয়ালের পিছনে উড়িয়ে দেবার কোনো যুক্তি খুঁজে পান না তিনি। এটা গরিবের ঘরে ঘোড়া রোগ। হ্যা ঘোড়া রোগ ছাড়া এ আবার কী!

মুহূর্ত কয়েক ইতস্তত করল পিন্টু। রাবেয়ার দিকে তাকাল। মাথা নিচু করে রাবেয়া কী যে পড়ছে শোনা যায় না স্পষ্ট করে। আব্বার দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে বলল, এতে এমন কী ক্ষতি…..

পিন্টুর কথা শেষ করতে দিলেন না শরীফ সাহেব। চেঁচিয়ে ওঠেন, ক্ষতি কি? হ্যা বলে কী! বলি তুই আগে পয়দা হয়েছিস, না আমি?

বারান্দার একপাশে লোহার রড ওপরের টালির ছাদের সঙ্গে মিশেছে। সেখানে হেলান দিয়ে দাড়াল পিন্টু। আব্বার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কলপারে তাকাল। রোদে ভরে গেছে সামনের দোতলা বাসার দেয়াল। নারকেল গাছের পাতা রোদে বালুকণার মতো জ্বলছে। শালিক পাখি দুটো নেই। কলের মুখে কাপড় জড়ানো, তা বেয়ে টিপ টিপ করে পানি পড়ছে নিচে রাখা গত রাতের হাঁড়িপাতিলের ওপর। অ্যালুমিনিয়ামের ঢাকনিটার ওপর পানির চিন চিন শব্দ ওর মনে হলো নিজের মাথার ভেতরে যেন অমনি করে ভেঙে চৌচির হয়ে পড়বে মগজের পানিগুলো। কত আশা আকাঙক্ষা বুকে অজান্তে বাসা বেঁধেছিল। তা যেন আজ ছিটে ফোঁটা হয়ে ছড়িয়ে যাবে। ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকার ঝোঁক। কাঠকয়লা কিংবা ছোট ছোট লাল ইটের টুকরো দিয়ে দেয়ালে কত কী না-ই আঁকত। গাছপালা নদী মানুষ ঘরবাড়ি তার কি ছাই ঠিক আছে! নাওয়া নেই খাওয়া নেই, এঁকেছে শুধু। হালকা মেঘের মতো লঘু পায়ে মনের আকাশে ঘুরে বেরিয়েছে জানা অজানায়। সন্ধেবেলায় বারান্দায় পড়তে বসে আকাশের নানারঙের খেলা দেখে ভাবত অমনি রং ছড়াবে সেও তার কাগজে। বাবার টেবিল থেকে লাল কালো কালির দোয়াত দিয়ে নিজের খাতায় রং ভরিয়েছে।

কিন্তু কে জানত এই তার শেষ হবে, এমনি করে তার সমস্ত রঙের পরিণতি ঘটবে!
আব্বার নিস্পন্দ চাহনির সুমুখে উদ্ধতভাবে বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না সে। সব সাহস এক নিমেষে কর্পূরের মতো উবে যায়। সমস্ত অনুভূতি, চিন্তা, কথা ভূমিকম্পের মতো ওলটপালট হয়ে যায়।

চেঁচামেচি শুনে ইতিমধ্যে মা তার রান্নাঘর থেকে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন। জিগগেস করলেন, কি হয়েছে? এত সকালে ওকে বকছ কেন?
পিন্টুকে একবার দেখে স্ত্রীকে উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে বললেন, কী আর হবে? তোমার ছেলের মাথায় ভীমরতি ধরেছে। ছবি আঁকবে।
বলে তিনি আর দাড়ালেন না। ঘরে চলে গেলেন।

উঠোন থেকে আমিনা বিবি এসে দাঁড়ালেন বারান্দায়। পিন্টুর কাছে এসে বললেন, ছবি আঁকবি, হ্যা বাবা একী কথা তোর?
এধরনের প্রশ্নের বিরক্ত ও রাগ হলো পিন্টুর। তাঁর এধরনের না জানার ভান মেজাজকে বিগড়িয়ে দিল ওর। ভূরু কুঁচকে পাল্টা জিগগেস করল, বাহ আকাশ থেকে পড়লে যেন! আব্বা বলেননি আমাকে আর্ট ইস্কুলে পড়াবেন?

পিন্টুর কথা শুনে নির্বাক হয়ে গেলেন আমিনা বিবি। খানিকক্ষণ একেবারে চুপ মেরে গেলেন। রাবেয়ার মিনমিনে একটানা গলার আওয়াজ হঠাৎ ভয়ে থেমে গেল। হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন শরীফ সাহেব।

বললেন, কীরে, কি বললি?

পিন্টুর গালে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে চড় মারলেন। বললেন, মাথা কিনে নিয়েছ না? বলেছিলাম তো বলেছিলাম।

চড় খেয়ে কাঁদল না পিন্টু। আচমকা শুধু রডের সঙ্গে মাথায় একটা আঘাত পেল। হাত দিয়ে সে জায়গাটা ছুয়ে আব্বার দিকে তাকাল। সারা মুখ কেমন বিকৃত হয়ে গেছে তার। কপালে বলির দাগগুলো আরো খাজ বেঁধে গেছে। মনে হয় আরো দশ বছর যেন এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। অবাক হয়ে গেল পিন্টু।

শরীফ সাহেব আড়চোখে দেখলেন ছেলেকে। কী দেখছে এমন করে পিন্টু? ইচ্ছে হলো আরেকটা চড় মারেন তিনি, যাতে সে চাহনি ভেঙে খান খান করে দিতে পারেন। কিছুতেই সইতে পারছিলেন না।

পিন্টুর দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেলেন শরীফ সাহেব।

মা ছেলের মাথায় হাত বুলালেন। বললেন, খামোকা দিলে তো আব্বাকে চটিয়ে। পিন্টু কথার জবাব দিল না। মাথা নিচু করে রইল।
আমিনা বিবি ফের বললেন, আমাদের ছবি আঁকতে নেই বাবা।।

-হুঁ, যতসব বাজে কথা।

পিন্টুর জবাব শুনে কথা খুঁজে পেলেন না তিনি। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। মুখটা বিশ্রীভাবে হাঁ হয়ে পানখাওয়া কালো দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল।
আজকালকার ছেলেদের কী ব্যারাম হয়েছে বুঝে উঠতে পারেন না তিনি। মুরুব্বি মানে না, মুখে মুখে কথা বলে। নির্বাক হয়ে যান তিনি।

আমিনা বিবি কাঁদেন আর আঁচলে চোখ মোছেন।
-বাবা তুই এত বুদ্ধিমান, তোর মুখে একী কথা? আর তা ছাড়া আল্লাহ না চান, ওনার যদি কিছু হয় তাহলে তো তোকেই তোর ছোট ভাইবোনদের মানুষ করতে হবে, বল?
-হ্যা এটাই বলো এতক্ষণ। আসল কথা এটাই। তোমরা তো শুধু টাকা চেন, আর কী বোঝ? তা ছাড়া চিনবে কী শুনি দিকিন?
-শুধু তর্কটাই তো শিখেছিস।

মুহূর্তকয়েক চুপ করে পিন্টুকে দেখেন। কেমন চোয়াড়ে চেহারা করে রয়েছে। তারও ইচ্ছে হয় ওকে মারার। হোক না কেন ছেলে তার বড় হয়েছে। মার কাছে ছেলে সবসময় ছেলেই। বড় হলেও কিছু যায় আসে না।

ধীর গলায় বলেন, টাকা না থাকলে বাবুর তেজ এতক্ষণ কোন চুলোয় যেত, তার ইয়ত্তা আছে? চাকরি কর, তবে বুঝবি কত ধানে কত চাল। বাপের ওপর খাস তো, বুঝিস না।

তবুও গজগজ করল পিন্টু, রাবুর তো বারোটা বাজিয়েছ, এখন আমি।

শুনে রাগে থ মেরে গেলেন আমিনা বিবি। নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। পিন্টুর গালে সজোরে চড় কষিয়ে দিলেন।
চিৎকার করলেন, বেয়াদব, নালায়েক। এতক্ষণ তবে দেয়ালের সাথে কথা বলছিলাম? এমন বেকুব ছেলের সাথে কথা বলতেও জাতমান থাকে না। ঘেন্না হয়।
-হ্যা বেয়াদপই তো। ঘেন্না তো হবেই। কথা না বললেও পারো। কথা আছে না, সত্যি কথা বললে বাপেও বেজার।

ঘর থেকে তাড়া খাওয়া মোঘের মতো ছুটে এলেন শরীফ সাহেব। কী, কী, বললি?
পিন্টু আর দাঁড়াল না। বারান্দা থেকে নেমে সোজা বাইরে বেরিয়ে গেল। সদর দরোজায় চটের তালি দেয়া দোদুল্যমান পর্দার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন শরীফ সাহেব, যেন কোনো শত্রুকে চ্যালেঞ্জ করছেন, আর যদি এ বাড়িতে ঢুকিস তবে তোর ঠাং ভাঙব।

নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, একি আমার ছেলে?

আমিনা বিবি রাগে ক্ষোভে কেঁদে ফেললেন। রাবেয়া মাথা নিচু করে পাটির বুনুনিতে নখ খুঁটতে লাগল। চোখজোড়া পানিতে ভেসে যায়। কোরআনের অক্ষর ঝাপসা হয়ে ওঠে।

সারাটা দিন ঘুরল পিন্টু। শহরের রাস্তায়, নদীর ধারে পার্কে—সব জায়গায় ঘুরেও বিরাম পেল না। এক অস্থিরতা তাকে চঞ্চল করে তুলল। ঘর থেকে, রাগ হয়ে যখন বেরুল তখন আব্বা আম্মার প্রতি হয়েছিল ভীষণ অভিমান। তার সব আশা যে এমনি করে বাতাসে মিলিয়ে যাবে আদৌ কল্পনা করতে পারেনি। এখন ভাবতে গেলেই সব ভাবনা কান্না হয়ে চোখের মাঝে জড়ো হতে চায়। আব্বার হঠাৎ করে মত পাল্টানো সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। চেষ্টা করেও কোনো সুরাহা পায় না। শুধু এটুকু জানে, আব্বা তার কথার নড়চড় করবেন না। ভাবতেই বুকটা ভেঙে যেতে চায়। তার চেয়ে এই ভাল, আর সে মাথা ঘামাবে না। দরকার নেই। থাক। না পড়িয়ে যদি আব্বা শান্তি পান, তবে পাক।

ঘরে যখন ফিরে এল তখন সামনের দোতলার কার্নিশে রোদ শুয়ে আছে। সূর্য ঢেকে গেছে অন্য পাশের উঁচু ছাদের আড়ালে। বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে রইল পিন্টু। হাতটা পেছনে টান করার সঙ্গে সঙ্গেই কাঁধের কাছে ফেঁসে যাবার শব্দ পেল। একবার দেখার চেষ্টা করে ফের কাত হয়ে রইল। চোখের পাতায় যেন মাকড়সা জাল বুনেছে। ক্লান্তি জড়ো হয়ে বাসা বাঁধছে। ঘুমের ঘোরে শুনল রাবেয়া ডাকল। জবাব দিতে তার মোটেই ইচ্ছে করল না।

রাবেয়া হত দিয়ে মৃদু ঠেলে বলল, ভাইয়া ভাত খাবে?
জোরে একটা শ্বাস টেনে জবাব দিল পিন্টু – না।
মুহূর্ত কয়েক দাড়িয়ে চলে যাচ্ছিল রাবেয়া।

পিন্টু তার পায়ের শব্দ শুনে বলল, রাবু, চা দিতে পারবি? মাথাটা ভেঙে যাচ্ছে রে।
-টিপে দেই ভাইয়া?

ঘাড় কাত করে দরোজার সুমুখে দাঁড়ানো রাবেয়াকে দেখল পিন্টু। বলল, দিবি? না থাক।
আবার পাশ ফিরে শুয়ে রইল সে।

শুয়ে শুয়ে মনে হলো পিন্টুর, ওর কপালে মাকড়সা হেঁটে বেড়াচ্ছে। চোখ মেলতেই দেখল রাবেয়া দাড়িয়ে। হাসল পিন্টু, কীরে?
-চা এনেছি, খাবে না?

উঠে বসে সবে চায়ের কাপটা হাত বাড়িয়ে নিতে শরীফ সাহেব ঘরে ঢুকলেন। আব্বাকে দেখে চমকে উঠল রাবেয়া। কাপ থেকে চা ছলকে নিজের গায়ে পড়ল। পিন্টু বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে যাবে শরীফ সাহেব কান ধরলেন।

-খুব যে তেজ দেখিয়ে বেরিয়ে গেলি? জানি, তেজ কমলেই আবার আসতে হবে।
নিস্পন্দ চোখজোড়া আব্বার দিকে মেলে ধরল পিন্টু। বারকয়েক ঢোক গিয়ে বলল, আব্বা আমি ছবি আঁকা শিখবো না।

কানটা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। কপাল কুঁচকে পিন্টুকে বারকয়েক নিরীক্ষণ করে বললেন, মানে?

আপনি যা বলবেন তাই পড়বো। বলতে গিয়ে চোখ ভিজে এল পিন্টুর। শরীফ সাহেব চমকে উঠলেন। কেমন ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। আবার তাঁর মনে হলো জীবনে এবারও তিনি হেরে গেছেন।

শরীফ সাহেবের কান্না বুক ঠেলে উপরে কেবলি আসতে চায়। প্রাণপণে তা তিনি দমিয়ে রাখতে গিয়ে মুখটা বিকৃত করে ফেললেন।

আব্বার মুখের দিকে নির্নিমেষ ভাবে চেয়ে থাকে পিন্টু। তারপর মাথা ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকাল। কী বিশ্রী ফাটল ধরছে কোণের দিকটায়। বেশ কিছু চুণসুরকি খসে গেছে তার পাশ দিয়ে। কয়েকটা বিবর্ণ ইট বেরিয়ে সেই ফাঁক দিয়ে।।

শরীফ সাহেবের মুখের দিকে তাকাল পিন্টু। কিন্তু কিছুতেই আব্বার চেহারা সে দেখতে পেল না। বারবার চেষ্টা করেও পারল না। মনে হলো সে দেয়াল দেখছে।

সেই বিবর্ণ দেয়ালে ফাটল ধরেছে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments