Saturday, April 20, 2024
Homeথ্রিলার গল্পরহস্য গল্পডোডো - মানবেন্দ্র পাল

ডোডো – মানবেন্দ্র পাল

ডোডো - মানবেন্দ্র পাল

জীবনে সেদিন যে অদ্ভুত রোমাঞ্চকর ঘটনাটা ঘটে গেল সেটা কিছুতেই আর ভুলতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে–এ কি কখনো সম্ভব? ডোডো কি এখনও আমাকে মনে রেখেছে?

আবার তখনই মনে হয়েছে–মনে না রাখবেই বা কেন? আমিই কি ভুলতে পেরেছি?

তখন আমি ইস্কুলে পড়ি। মফস্বল শহর। আমাদের বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে মিশনারি সাহেবদের বেশ বড়ো একটা হাসপাতাল ছিল। খাস ইউরোপীয়ান সাহেব ডাক্তাররা সপরিবারে সেখানে থাকত। ঐ সাহেবপল্লীটাকে এখানকার লোকে বলত মিশন। কারো বড় রকমের অসুখ করলে লোকে বলত–মিশন হাসপাতালে নিয়ে যাও। সেরে উঠবেই।

আমার বাবা ছিলেন নামকরা ডাক্তার। সেই সূত্রে হাসপাতালের সাহেব ডাক্তারদের সঙ্গে বেশ খাতির ছিল। তারা প্রায়ই বড়দিনে, ইংরিজি নববর্ষে, ছেলেমেয়েদের জন্মদিনে আমাদের নেমন্তন্ন করতেন। বাবা-মার সঙ্গে আমিও ঘোড়ার গাড়ি চেপে সাহেবদের বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে যেতাম। ওঁদের মধ্যে বাবার বেশি বন্ধুত্ব ছিল ম্যাকলার্ন সাহেবের সঙ্গে। মেমসাহেবও ছিলেন খুব মিশুকে। তিনি চাইতেন আমরা যেন প্রায়ই ওঁদের বাড়ি বেড়াতে যাই। সেইজন্যে বিশেষ বিশেষ দিন ছাড়াও আমরা ম্যাকলার্ন সাহেবের বাড়ি যেতাম।

এই বাড়িতেই ডোডোর সঙ্গে আমার ভাব হয়। আমারই বয়সী ডোডো। সাহেব-বাচ্চা। সাদা ধবধবে রঙ। কেঁকড়ানো কটা চুল। চোখের মণি নীলচে। ভারি সুন্দর দেখতে। কিন্তু তাকে সবসময়ই কেমন যেন বিষণ্ণ মনে হতো।

পরে জেনেছিলাম–ডোডো ম্যাকলার্নদের নিজের কেউ নয়। ওঁদের কোনো আত্মীয়ের ছেলে। মা-বাপ মরে গিয়েছিল বলে ওকে এঁরা পালন করতেন।

ডোডোর সঙ্গে আমার এমন ভাব হয়ে গিয়েছিল যে প্রায়ই ওর কাছে যেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু তখন আমি ছেলেমানুষ। একা যেতে পারতাম না। মা-বাবা যখন যেত শুধু তখনই ওর সঙ্গে দেখা হতো।

একদিন ওঁদের বাড়ি গিয়েছি। তখন সন্ধ্যে হয় হয়।

–গুড ইভনিং ডক্টর ম্যাকলার্ন! বলে বাবা হাসতে হাসতে আমাদের নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন। ম্যাকলার্ন সাহেবও তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে গুড ইভনিং বলে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন।

কিন্তু সেদিন ম্যাকলার্ন সাহেব কী একটা ব্যাপার নিয়ে হাসপাতালের হেড কম্পাউন্ডার চৌধুরী সাহেব আর অন্য কম্পাউন্ডারের সঙ্গে খুব বিরক্ত হয়ে কথা বলছিলেন।

আমরা গিয়ে পড়তে ম্যাকলার্ন সাহেব ওঁদের সরিয়ে দিয়ে বাবার সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন।

ওঁরা বহুদিন বাংলাদেশে থাকতে থাকতে বাংলা কথা বুঝতে পারতেন। ভাঙা ভাঙা বাংলাতে কথাও বলতে পারতেন।

যাই হোক আমি ডোডোকে খুঁজছিলাম। বিরাট কম্পাউন্ডওলা বাড়ি। অনেক ঘর। তার সঙ্গে টানা হাসপাতাল। ও যে কোথায় আছেখুঁজতে খুঁজতে বাগানের ধারে ছোটো ঘরটায় ওকে পেলাম। দেখি এই গরমেও ডোডো গলায় মাফলার জড়িয়ে চুপচাপ বসে আছে।

আমায় দেখে ও তো খুব খুশি। কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম– তোমার কি অসুখ করেছে?

ও বলল, হ্যাঁ। টনসিল সেপটিক হয়ে গেছে। অপারেশান হবে।

যদিও তখন শুনতাম টনসিল কাটানো খুব বিপজ্জনক ব্যাপার, তবু বন্ধুকে সাহস দিয়ে বললাম, ভয় কী? বাড়িতে বড় বড় ডাক্তার

ডোডো ম্লান হেসে বলল, না, অপারেশনের জন্যে চিন্তা করছি না।

–তবে? এমন চুপচাপ বসে?

ও হঠাৎ আমায় থামিয়ে দিয়ে কিছু একটা শোনার জন্যে কান পাতল।

ড্রয়িংরুমে তখন বাবার সঙ্গে ম্যাকলার্ন সাহেবের কথা হচ্ছিল। সাহেব বেশ উত্তেজিত হয়ে বলছিলেন–হাসপাতাল থেকে প্রায়ই যদি এত দামী দামী ওষুধ চুরি যায় তাহলে আমার স্টেপ নেওয়া উচিত বলুন।

বাবা বললেন, আপনি কাউকে সন্দেহ করেন?।

–সন্দেহ! না, এরা সবাই পুরনো লোক। শুধু শুধু কী করে সন্দেহ করি বলুন।

ডোডো আমার দিকে ফিরে হাতটা ধরে বলল, অপারেশনের জন্যে নয়, মনটা আমার খুব খারাপ হয়ে আছে বন্ধু।

–কেন?

ডোডো তখনই কিছু বলল না। কী যেন ভাবতে লাগল। একটু পরে বলল, কারো নামে লাগাতে নেই। ক্রাইস্ট তাতে দুঃখ পান। তবু আমার মনে হয়–যে দুষ্ট লোক– যে পরের ক্ষতি করে–যে চোর তাকে ধরিয়ে দিলে অন্যায় হবে না। ক্রাইস্ট নিশ্চয় আমায় ক্ষমা করবেন। তুমি কী বল?

বললাম–নিশ্চয়। কিন্তু….কিন্তু তুমি কার কথা বলছ?

ও তখন খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে আমার হাতটা ধরে বলল–ঐ যে শুনলে আংকেল ওষুধ চুরির কথা বলছিলেন। রোজ রোজ চুরি। চুরি করে সেই ওষুধ বাজারে বিক্রি করে দেয়।

–কে? বোকার মতো জিজ্ঞেস করলাম।

ডোডো বললে, চোর যে কে আংকল তো ধরতে পারছেন না। সন্দেহ করছে কম্পাউন্ডারকেই। কিন্তু কম্পাউন্ডার তো অনেক জনই–মিস্টার চৌধুরী, মিস্টার মণ্ডল, মিস্টার বিশ্বাস, মিস্টার ই

ডোডো একটু থামল। তারপর বলল, তাছাড়া এখানকার যে হেড ক্লার্ক তাকেও আংকেলের সন্দেহ। কিন্তু, বন্ধু আমি জানি কে চোর। বলে উত্তেজনায় আমার হাতটা চেপে ধরল।

–তুমি জান?

–হ্যাঁ।

–তো আংকেলকে বলছ না কেন?

–কী করে বলব তাই ভাবছি, আর মনে মনে দুঃখ পাচ্ছি। সে মানুষটা খুবই পুরনো, আমাদের সকলেরই নিজের লোকের মতো। আমি তাকে খুবই শ্রদ্ধা করতাম।

–তুমি ঠিক জান, সেই চুরি করেছে?

–Yes! খুব জোর দিয়ে কথাটা বলতে গিয়ে ও কেশে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে গলার ব্যথায় কাতর হয়ে পড়ল।

একটু সামলে নিয়ে বলল, আজই দুপুর বেলা–একা একা হাসপাতালে ঘুরছি। ঘুরতে ঘুরতে ওষুধের ঘরের কাছে যেই এসেছি অমনি জানালার ফাঁক দিয়ে দেখি–

কথা শেষ হলো না। হঠাৎ ডোডো চমকে উঠল–Who is there? কে ওখানে?

সঙ্গে সঙ্গে বাগানের দিকের জানলার পাশ থেকে কেউ চট করে সরে গেল।

আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ভয়ে ভয়ে বললাম–চোর?

ডোডো বলল, বোধহয়। আমাদের কথা শোনার চেষ্টা করছিল।

একটু ভেবে বলল, চলো, ভেতরে গিয়েই বসি।

.

এর দুদিন পরে ডোডোর টনসিল অপারেশান হলো। অপারেশান সফল হয়েছে। আমি তো মা-বাবাকে নিয়ে সেইদিনই বিকেলে ডোডোকে দেখতে গেলাম।

ডোডোর জ্ঞান ফিরেছে। ওর সর্বাঙ্গ চাদর দিয়ে ঢাকা। ডোডো শুধু একবার তাকাল। সে চাউনি দেখে বুঝলাম ও চিনতে পেরেছে। কিন্তু কষ্ট লাগল যখন দেখলাম ওর হাত পা লোহার খাটের সঙ্গে বাঁধা। নার্স বলল, ও ভালোই আছে।

পরের দিন বেলা তখন দশটা। ইস্কুল যাবার জন্যে রেডি হচ্ছি, বাবা শুকনো মুখে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে আর মাকে একসঙ্গেই দুঃসংবাদটা দিলেন–ডোডো কাল গভীর রাত্তিরে মারা গেছে।

আজ এতকাল পরেও মনে আছে, আমি চিৎকার করে বলেছিলাম–মারা যায়নি। ওকে মেরে ফেলা হয়েছে।

বাবা আমাকে ধমকে উঠেছিলেন। বলেছিলেন–পাগল নাকি? অত বড়ো হাসপাতাল। ম্যাকলার্ন সাহেবের বাড়ির লোক। মেরে ফেললেই হলো! আর কেনই বা মারবে?

বাবাকে কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু মাকে সব বলেছিলাম। ডোডো স্বচক্ষে চুরি করতে দেখেছিল। কিন্তু নাম বলবার আগেই ওকে থামতে হয়েছিল।

কিন্তু মাও সেদিন দশ বছরের ছেলের কথা বিশ্বাস করেনি। বলল, তাছাড়া, কেউ খুন করেছে বুঝতে পারলে সাহেব ছেড়ে দিত?

যুক্তি অবশ্য অকাট্য। তারপর আর ও নিয়ে ভাবিনি।

কিন্তু অনেক পরে কলকাতার কর্মজীবনের মাঝে মাঝে যখন ডোডোর কথা মনে হতো তখনই ভাবতাম–সত্যিই কি ওর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল? না কি খুন করা হয়েছিল?

হ্যাঁ, সাহেবের বাড়ির কেস। খুন সন্দেহ হলে সহজে ছেড়ে দিত না ঠিকই। কিন্তু মনে রাখতে হবে–ডোডো ওঁদের নিজেদের কেউ ছিল না। সেজন্যে হয়তো যতটা তলিয়ে দেখা উচিত ছিল ততটা দেখেননি।

.

প্রায় চল্লিশ বছর পর আবার একদিন দেশে আসার সুযোগ হলো। সাহেবরা এখন আর নেই। তবে জায়গাটার নাম মিশন এখনও আছে। এখানে একটা ইস্কুল হয়েছে। সেই ইস্কুলে রবীন্দ্র জন্মোৎসব। আমায় সভাপতি হতে হয়েছে।

আমি যেতেই যিনি আমায় সাদর অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এলেন তার বয়স প্রায় আশি। সাদা ধবধবে চুল, চোখে পুরু লেন্সের চশমা। ইনি সেই চৌধুরী সাহেব যিনি হাসপাতালের হেড কম্পাউন্ডার ছিলেন। বর্তমানে তিনি এই স্কুলের প্রেসিডেন্ট। পুরনোদের মধ্যে সেই ক্লার্কবাবুটিও বেঁচে আছেন। তবে দুঃখের কথা তার ছেলেটি তাকে অবশ্য চিনতাম না–একটা খুনের মামলায় জেল খাটছে।

খুনের কথা শুনেই মনটা আমার ছ্যাৎ করে উঠল। ডোডোর কথা মনে পড়ে গেল। সে যাকে চুরি করতে দেখেছিল তার নামটা প্রকাশ করে যেতে পারেনি। তার আগেই মরতে হয়েছিল। সে কি তবে ঐ ক্লার্কবাবুরই কাজ? নইলে তার ছেলে খুনী হয় কী করে?

সভা শেষ হতে রাত হয়ে গেল। খাওয়াদাওয়া করে যখন শুতে গেলাম রাত তখন দশটা বাজে।

আমার শোবার ব্যবস্থা হয়েছিল ম্যকলার্ন সাহেবের বাড়িতেই। বাড়িটা যদিও পুরনো তবু এই একটা ঘরই মোটামুটি ভালো ছিল। জানালা বা দরজায় কোনো খিল ছিল না, তবে দরজায় লোহার ছিটকিনিটা টিকে ছিল কোনোরকমে। যাক, তাই যথেষ্ট। বাড়িতে ইলেকট্রিকের কোনো ব্যাপার ছিল না। তবে উদ্যোক্তারা একটা লণ্ঠন দিয়ে গিয়েছিল। দরজায় ছিটকিনি এঁটে লণ্ঠনে তেল কতটা আছে দেখছি, কে যেন দরজায় শব্দ করল–ঠুকঠুক

বুকটা কেন কে জানে ধড়াস করে উঠল।

–কে?

–শুয়ে পড়লেন নাকি?

–না। যাই।

বলে উঠে দরজা খুলে দিলাম।

দেখি চৌধুরী সাহেব এক হাতে টর্চ অন্য হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে।

–আপনি আবার এত রাতে?

উনি হাসলেন। বাঁধানো দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠল।

–না, দেখতে এলাম কোনো অসুবিধে হচ্ছে কিনা। বুঝতেই পারছেন প্রেসিডেন্টের অনেক দায়িত্ব।

–না না কিছুমাত্র অসুবিধে নেই।

–বেশ। খুশি হলাম। বৃদ্ধ চৌধুরী সাহেব আবার একটু হাসলেন।

–ভয়টয় পাবেন না তো?

আমি হেসে বললাম, কিসের ভয়?

–এই আর কি–পুরনো বাড়ি তো!

-না চৌধুরী সাহেব, ভূতের ভয় আমি পাই না। তাছাড়া এ বাড়ি আমার চেনা। তবে যদি ডোডোর প্রেতাত্মা দেখা দেয়।

এতকাল পরে ডোডোর কথা শুনে বৃদ্ধর মুখটা কিরকম হয়ে গেল। ঢোক গিলে বললেন, ডোডোকে মনে আছে?

-নিশ্চয়। ওকে কি ভুলতে পারি? ঐ লম্বা ঘরটার একেবারে শেষ দিকের বেডে ও মারা গিয়েছিল না?

-হ্যাঁ। বলেই বৃদ্ধ পিছু ফিরলেন। তারপর টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে রাস্তায় গিয়ে নামলেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাঁর লাঠির শব্দ শুনতে পেলাম–ঠকঠকঠক্‌।

ঘুম আসছিল না। কেবলই ডোডোর কথা মনে হচ্ছিল। তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল, না তাকে খুন করা হয়েছিল? খুন করলে কে খুন করল? এ রহস্য তাহলে চিরদিনই অমীমাংসিত থেকে গেল। ভাবতে ভাবতে এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

তখন কত রাত জানি না। হঠাৎ মনে হলো ঘরের মধ্যে যেন একটা পাখি ক্রমাগত পাখা ঝাঁপটাচ্ছে। সেই শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো মাথাটা বেজায় ঘুরছে। শুধু মাথা ঘোরাই নয়, সেই সঙ্গে গলার মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা। আমি ঢোক পর্যন্ত গিলতে পারছি না। মনে হচ্ছিল কেউ যেন ছুরি দিয়ে গলাটার আধখানা কেটে দিয়েছে।

আমি ভয়ানক ভয় পেলাম। এ আমার কি হলো! শুধু তাই নয়, আমার মুখ দিয়ে অনর্গল লালা পড়ে জামা ভিজিয়ে দিচ্ছে। হাত দিয়ে মুছতে গেলাম। কিন্তু হাত তুলতে পারলাম না। দু হাত লোহার খাটের সঙ্গে বাঁধা। শুধু হাত নয় সমস্ত চাদর ঢাকা শরীরটাই বাঁধা।

আমি আবার চমকে উঠলাম। মনে করতে চেষ্টা করলাম–এ অবস্থা কখন আমার হলো? কে করল?

কোনোরকমে চোখ মেলে তাকালাম। অল্প অল্প আলো। লক্ষ্য পড়ল দেওয়ালের দিকে। একেবারে সামনের দেওয়ালে গির্জার মতো একটা ঘড়ি। এমন ঘড়ি আমি কখনও দেখিনি। ঘড়িতে তখন কঁটায় কাঁটায় রাত দুটো।

চোখ সরে গেল পাশের দেওয়ালে। সেখানে ঝুলছে পঞ্চম জর্জের ছবি। এ ছবি– এ ছবি যেন ছোটোবেলায় কোথায় দেখেছি।

কোনোরকমে ঘাড়টা একটু কাত করলাম। কিন্তু ওরা কারা? ঐ যে একটু দূরে সার সার লোহার খাটে নিঃসাড়ে শুয়ে? সব যেন মৃত।

তবে কি হাসপাতালে রয়েছি?

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। নিরুপায় হয়ে এদিক-ওদিক দেখতে চেষ্টা করলাম। ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না। সব যেন ঝাপসা। না, কেউ নেই। না কোনো ডাক্তার, না কোনো নার্স।

..একটু জল খাওয়ার দরকার…নিদেন এক টুকরো বরফ। জিব শুকিয়ে যাচ্ছে।

এমনি সময়ে কে যেন সন্তর্পণে ঢুকল।

আঃ বাঁচলাম। তবু একজন জীবন্ত মানুষ।

কিন্তু ওকে ডাকব কী করে? আমি তো কথা বলতে পারছি না।

না, লোকটা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। খুব যেন চেনা মনে হচ্ছে।…একটু একটু করে চিনতে পারলাম। এঁকে অনেক বার ম্যাকলার্ন সাহেবের বাড়িতে দেখেছি। চৌধুরী সাহেব। হাসপাতালের হেড কম্পাউন্ডার।

তিনি কাছে এসে দাঁড়ালেন। কিন্তু হাতে ওটা কী? ইনজেকশানের সিরিঞ্জ? কেন? ইজেকশান দেবেন?

চৌধুরী সাহেব কাছে এসে দাঁড়ালেন। বাঁধন খুলে আমার বাঁ হাতটা তুলে নিলেন। আমি যথাসম্ভব করুণ চোখে তার দিকে তাকালাম। যেন বলতে চাইলাম–Please push slowly. দয়া করে আস্তে আস্তে দেবেন।

কিন্তু উনি যখন আমার হাতে উঁচটা ফোঁটাচ্ছেন তখন তার চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। কী ভয়ঙ্কর সে দৃষ্টি!

বুঝতে পারলাম না উনি অমন করে আমাকে দেখছেন কেন?

সঙ্গে সঙ্গেই উঁচটা বিঁধিয়ে দিলেন। আর পা থেকে ঘাড় পর্যন্ত সমস্ত শিরাগুলো ঝনঝন করে উঠল।

তা-র-পর

তারপরের কথা আমি জানি না। পরে লোকমুখে যা শুনেছি তাই লিখছি।

তখন সবে সূর্য উঠবে উঠবে করছে–ইস্কুলের দারোয়ান দেখল প্রেসিডেন্টবাবু লাঠি হাতে ম্যাসাহেবের বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। এত ভোরে প্রেসিডেন্টবাবু বেরোন না। নিশ্চয় কোনো জরুরি দরকারে যাচ্ছেন বলে দারোয়ানও এগিয়ে গেল।

দারোয়ান দেখল যে ঘরে কলকাতার বাবুটি শুয়েছিল চৌধুরী সাহেব সেই ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছেন আর বলছেন–আর কত ঘুমোবেন মশাই? উঠুন। চা নিয়ে আসছে।

দারোয়ান দূরে দাঁড়িয়ে দরজা খোলার শব্দ শুনল। তারপরেই কী হলো হঠাৎ চৌধুরী সাহেব ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন–ডোডো–ডোডো–

বলেই তিনি যেন প্রাণভয়ে ছুটতে লাগলেন।

দারোয়ান তো অবাক। চৌধুরী সাহেব ঘরের মধ্যে এমন কী দেখলেন যাতে এত ভয় পেয়ে গেলেন? ডোডোই বা কী জিনিস? আর বুড়ো মানুষটি যেভাবে ছুটছেন–

ভাবতে ভাবতে দারোয়ান দেখল চৌধুরী সাহেবের হাত থেকে লাঠিটা ছিটকে পড়ে গেল। কিন্তু তবু চৌধুরী সাহেব বাড়ির দিকে ছুটছেন। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে– চোখ-মুখ লাল।

–বাবু, দাঁড়ান বাবু, দাঁড়ান… বলতে বলতে দারোয়ান ছুটে গেল ওঁর কাছে। সেই সময়ে চৌধুরী সাহেবের একপাটি চটি খুলে গেল। আর তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়লেন রাস্তার ওপর।

সেই যে পড়লেন আর উঠলেন না।

ততক্ষণে ভিড় জমে গেছে। চৌধুরী সাহেবের বডিটা তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ওরা এসে দাঁড়াল ম্যাসাহেবের বাড়িতে। এমন কী দেখে চৌধুরী সাহেবের মতো সাহসী পুরুষ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন?

না, ঘরের মধ্যে ভয় পাবার মতো কিছুই ছিল না। আমি যেমন ঘুমোচ্ছিলাম তেমনই ঘুমোচ্ছি।

ওরা খুব আশ্চর্য হলো। প্রথমত, দরজা খুলে দিল কে? দ্বিতীয়ত, আমাকে দেখে ভয় পাবার কী ছিল? তৃতীয়ত, কি ডোডো বলে যদি কারো প্রেতাত্মাকে তিনি দেখেই থাকেন তাহলে হঠাৎ আজ কেন? এ বাড়িতে তিনি তো এর আগে অনেকবারই একা একা এসেছেন।

এসব রহস্যের কোনো মীমাংসা আমিও করতে পারিনি। তবে চলে আসবার সময় ঐ ঘরের কোলঙ্গায় একটা জিনিস দেখে অবাক হয়েছিলাম। যখন ঘরে ঢুকেছিলাম যত দূর মনে আছে–কোলঙ্গায় ওটা ছিল না।

জিনিসটা আর কিছুই নয় একটা পুরনো ভাঙা ইনজেকশানের সিরিঞ্জ।

[শারদীয়া ১৩৯৪]

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments