Friday, April 19, 2024
Homeকিশোর গল্পচিরামবুরুর গুপ্তধন - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

চিরামবুরুর গুপ্তধন – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

চিরামবুরুর গুপ্তধন - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফাঁপরে পড়েছি। হঠাৎ দেখি, ইয়া এক বড় কেঁদো বাঘ হালুম করে সামনে দাঁড়াল। পা দুটো মাটিতে সেঁটে গেছে ভয়ের চোটে। তারপর দেখি, বাঘটা আদতে বাঘই নয়, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। তিনি কেন বাঘ হয়ে গেছেন বুঝলুম না। খুশি হয়ে বললুম, বললুম, মাই ডিয়ার ওল্ড ম্যান! হাউ ড়ু ইউ ড়ু? কর্নেল হাউমাউ করে কেঁদে বললেন, ভাল না ডার্লিং। আমার লেজ হারিয়ে গেছে। এ বয়সে লেজ হারানোর চেয়ে অপমানজনক কিছু নেই। কর্নেলের লেজ হারানোর কথা শুনে আমিও দুঃখে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললুম।…

তারপরই টের পেলুম আমি মশারির ভেতরে শুয়ে আছে আছি। আশ্চর্য, আমার চোখ দুটো যেন ভিজে সঁতসেতে। ধড়মড় করে তক্ষুণি উঠে বসলুম এবং খিকখিক করে হাসতে থাকলুম। কী বিদঘুটে স্বপ্ন রে বাবা!

টেবিলের সামনে ঝুঁকে বসে কী-সব নাড়াচাড়া করছিলেন যিনি, তার মাথায় তখনও প্রাতঃভ্রমণের নীলচে টুপি। সেই টুপি ও তার সাদা গোঁফ দাড়িতে তখনও জঙ্গলের শুকনো পাতার কুচি, কাঠকুটো, পাখির বিষ্ঠা, মাকড়সার জালের ছেড়া অংশ, এমনকী দু-একটা পোকামাকড়ও খুঁজে পাওয়া সম্ভব। না ঘুরেই সম্ভাষণ করলেন, গুড মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।

মশারি থেকে বেরিয়ে বললুম, হাসছি কেন, জিজ্ঞেস করলেন না?

হাসছিলে নাকি? তুমি তো খুঁঃ খুঁঃ করে কাঁদছিলে মনে হল।

কাঁদছিলুম আপনার দুঃখে। একটু চটে গিয়ে বললুম। আপনার লেজ হারানোর কান্না দেখে আমারও কান্না পেয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য, আপনি আমায় জাগিয়ে দেননি। লেজটা আপনারই ছিল।

আমার লেজ! বলে কর্নেল নিজের পশ্চাদ্দেশে হাত বুলিয়ে নিলেন। তারপর হাসতে হাসতে বলনে, ডার্লিং। সত্যি যদি মানুষের লেজ থাকত, ব্যাপারটা কত সুখের হত বল তো! লেজ দিয়ে পিঠ চুলকানো, মাছি তাড়ানো, আবার দরকার হলে কাউকে লেজের বাড়ি মারা-কত কাজ হত! তাছাড়া, কারও ওপর রাগ হলে মুখে সেটা প্রকাশ না করলেও চলত। লেজ খাড়া হলেই টের পেত আমি রেগেছি। ব্যাপারটা কি সভ্য মানুষের পক্ষে ভদ্রতাসম্মত হত না ডার্লিং? আরও ভেবে দ্যাখো, লেজ থাকলেও তারও পোশাক দরকার হত। নিত্যনতুন ডিজাইনের লেজ-ঢাকা তৈরি করত টেলাররা। নাম দিত টেলেক্স। আর মহিলাদের বেলায় টেলেক্সি। ম্যাক্সির মতো।

আমার এই বৃদ্ধ বন্ধু একবার মুখ খুললে সহজে বন্ধ করেন না। বাথরুমে ঢুকে পড়লুম। আধ ঘণ্টা পরে বেরিয়ে দেখি, তখনও তেমনি বসে আছেন। পাশে অবশ্য ব্রেকফাস্টের ট্রে রেখে গেছে বাংলোর চৌকিদার। বললুম, লেজ সম্পর্কে আরও কথা থাকলে এবার বলতে পারেন। এখন আমি ফ্রি।

কর্নেল কতকগুলো ছবি দেখছিলেন। ছবিগুলো সদ্য প্রিন্ট করা। এখনও ভিজে রয়েছে। বললেন, লেজ মুখের শ্রম কমিয়ে দিত, জয়ন্ত! তোমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সম্পাদক মশাইয়ের সামনে গিয়ে লেজ নাড়তে শুরু করলেই তিনি খুশি হতেন। রিপোর্টিংয়ে ভুল বেরুলে লেজটা শিথিল করে মেঝেয় ফেলে রাখতে। তারপর লেজটা গুটিয়ে সম্পাদকের চেম্বার থেকে বেরুতে। সাতখুন মাফ!

হ্যাঁ লেজ। আমার জাদু-ক্যামেরার রাতের ফসল, জয়ন্ত! কর্নেল মুচকি হেসে বললেন।

অবিশ্বাস্য! মানুষের কখনও লেজ হয়? ছবিটা ভাল করে দেখে আমার বিস্ময় বেড়ে গেল। কর্নেল! এ নিশ্চয় কোনও প্রাণী, মানুষের মতো দেখতে এই যা।

কর্নেল ব্রেকফাস্টের ট্রে টেনে নিয়ে আওড়ালেন, বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি! জয়ন্ত, পাশের ঘরের ভদ্রলোকনৃবিজ্ঞানী ডঃ দীননাথ মহাপাত্র আমায় এরকম একটা আভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু কানে নিইনি। কাল সন্ধ্যায় গোপনে একখানা ক্যামেরা পেতে এসেছিলুম। উদ্দেশ্য তো জানো। জন্তুদের জল খাওয়ার সময় ছবি তোলা। ভোরে ক্যামেরা আনতে গিয়ে জলার ধারে বালির ওপর মানুষের পায়ের ছাপ দেখতে পেলুম। অবাক লাগল। খুব বদনাম আছে জলাটার। বাগাদা আদিবাসীদের ওটা তীর্থক্ষেত্র ছিল প্রাচীন যুগে। কিন্তু গত পঞ্চাশ-ষাট বছরে ওখানে তার যায় না। অভিশাপ লেগেছে নাকি। তো পায়ের ছাপ কাদের তা দেখতেই পাচ্ছ।

এই সময় দরজার বাইরে ডঃ মহাপাত্রের সাড়া পাওয়া গেল। আসতে পারি কর্নেল?

কর্নেল ঘুরে বললেন, আসুন, আসুন! তারপর ট্রেটা তুলে ছবিগুলোর ওপর রাখলেন। বুঝলুম, কোনও কারণে ব্যাপারটা নৃবিজ্ঞানী ভদ্রলোককে জানাতে চান না কর্নেল। কাজেই আমাকেও মুখ বুজে থাকতে হবে।…..

বিবর্তনবাদ ও কার্টুন

ডঃ মহাপাত্র কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, কাল আপনাকে বাগাদা ট্রাইবের কথা বলছিলুম। বাংলার বাগদি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে চেহারা ও পেশায় কী আশ্চর্য মিল! এরাও মাছ ধরে। আবার একসময় এরাও সেকালের বাঙালি বাগদি গোষ্ঠীর মত লাঠিয়ালি, ডাকাতিতেও পটু। এখনও তারা শক্ত গাছের ডাল থেকে তৈরি লাঠি ব্যবহার করে। ধাতুর ব্যবহার এদের মধ্যে অচল। কাজেই একই ট্রাইবের দুটি গোষ্ঠী দু জায়গায় বাস করছে। আরও মজার কথা এই, মধ্যপ্রদেশ এবং মহরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলে বাউরি ট্রাইব রয়েছে। মোটামুটি ফর্সা বা তামাটে গায়ের রং। আশা করি, বাঙালি বাউরি সম্প্রদায়ের কথা আপনি জানেন কর্নেল। তো কথা হল—এরা ভারতের আদিম বাসিন্দা। অস্ট্রিক জাতির একটা শাখা।

বনজঙ্গল বেড়াতে এসে এসব কচকচি কার বা ভাল লাগে? রাগ হল দেখে যে, গোয়েন্দাপ্রবর দাড়ি নেড়ে সায় দিচ্ছেন এবং প্রশংসাসূচক উক্তিও করছেন। এক্সকিউজ মি বলে সোজা বাইরে চলে গেলুম। এপ্রিলে চিরামবুরু পাহাড় ও জঙ্গলের সৌন্দর্য তুলনাহীন। যতদূর চোখ যায়, অসংখ্য টিলা ও পাহাড়। সবুজ, খয়েরি, লাল, সাদা কত রঙের বাহার! একটি টিলার গায়ে এই বাংলো।

লনের ঘাসে কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর দেখি, কথা বলতে বলতে দুই পণ্ডিত বেরুচ্ছেন। হ্যাঁ, মার্কো পোলো বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপে লেজওয়ালা মানুষ দেখার কথা বলেছেন। পনেরো শতকের কথা। তো লেজ নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কর্নেল! আমাদের শিরদাঁড়ার শেষপ্রান্ত যেটা ককসিক্স বা পিকচঞ্চু বলা হয় কোকিলের ঠোঁট আর কী—সেটাই লেজের প্রমাণ। বিবর্তনের একটা পর্যায়ে লেজ খসে গিয়েছিল। কারণ হল ভাষা। মানুষের ভাষাই যখন ভাবপ্রকাশে সমর্থ তখন লেজের দরকারটা কী?

কর্নেল বললেন, ঠিক, ঠিক। তবে ধরুন, হাতের নিয়মিত ব্যবহারে হাতের ক্ষমতাও বেড়েছিল। লেজের কাজ হাতে আরও ভালভাবে করা যায়। কাজেই ..

হঠাৎ কথা থামিয়ে কর্নেল কান খাড়া করে কী শুনলেন। তারপর দৌড়ে ঘরে ঢুকলেন। ডঃ মহাপাত্র হকচকিয়ে গেছেন দেখলুম। একটা পরে কর্নেল বাইনোকুলার নিয়ে বেরিয়ে এলেন। তারপর দৌড়ে বাংলোর গেট পেরিয়ে ঢালুতে বন বড় পাথর আর ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হলেন। কোথায় একটা পাখি ডাকছিল টু টু টুইক!…

ডঃ মহাপাত্রর কাছে গিয়ে বললুম, ওঁর ওই বাতিক। পাখি প্রজাপতি ঘাসফড়িং পোকামাকড় নিয়ে থাকেন।

ও! উনি একজন ন্যাচারালিস্ট তাহলে! আমি ভেবেছিলুম শিকারি।

একটু হেসে বললুম, প্রকৃতিবিজ্ঞানী। তো ডঃ মহাপাত্র, কর্নেলের কাছে কি লেজওয়ালা মানুষের ছবিটা দেখলেন?

ডঃ মহাপাত্র চোখ বড় করে বললেন, অ্যাঁ! ছবি! কোথায় ছবি! কিসের ছবি?

অমনি বুঝলুম, ভুল করেছি। ঝটপট বললুম, মানে একটা কার্টুন আর কী! বিলিতি পাঞ্চ পত্রিকার।

ডঃ মহাপাত্র একটু হেসে বলনে, তাই বলুন। তবে কর্নেল কার্টুন দেখাননি আমায়। প্লিজ, আপনি নিয়ে আসুন না ওটা, দেখি। পাঞ্চের কার্টুনের কোনও তুলনা হয় না। নিশ্চয় ডারউইন-শতবার্ষিকী উপলক্ষে বেরিয়েছে।

বেগতিক দেখে বললুম, দুঃখিত ডঃ মহাপাত্র! কর্নেলের জিনিসপত্রে আমাদের হাত দেওয়াটা ঠিক হবে না।

তাও ঠিক। বলে ডঃ মহাপাত্র মুখ গোমড়া করে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। কিন্তু ওঁকে কর্নেল ওই অদ্ভুত ছবিটা কেন দেখাতে চাইছেন না কে জানে! নাকি কর্নেল নিজেই মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে লেজওয়ালা মানুষ আবিষ্কারের গৌরব পেতে চান?….

জঙ্গলের বিপদ আপদ

কর্নেল সেই যে পাখির পেছনে দৌড়ুলেন, তো আর ফেরার নাম নেই। দুপুর পর্যন্ত বনজঙ্গলে একটু ঘোরাঘুরির ইচ্ছে ছিল। একা যেতে সাহস পাচ্ছিলুম না। ভাবলুম নৃবিজ্ঞানী ভদ্রলোককে ডাকব নাকি?

কিন্তু উনি নিশ্চয় চটে আছেন আমার ওপর। অগত্যা একা বেরিয়ে পড়লুম। জঙ্গলে রাস্তা -হারানোর সহজ উপায় হয়, চলার সময় কিছু চিহ্ন ছড়িয়ে রাখা। আমি অবশ্য রাস্তা ধরে যাচ্ছিলুম না। কখনও পাথুরে জমির ওপর দিয়ে, কখনও ঝোপঝাড়ের ভেতর ফাঁকা জায়গা দিয়ে, কখনও বা উঁচু গাছপালার ভেতর দিয়ে। খেয়ালখুশি মতো হেঁটে যাওয়া। একটা করে গাছের ডাল ভেঙে চিহ্ন রাখছিলুম। ফেরার সময় চিহ্নগুলো কাজে লাগবে।

একসময় থমকে দাঁড়ালুম। হাতি-বাঘ-ভালুকের কথা মনে পড়ে গেল। সঙ্গে কেন যে রাইফেলটা নিতে ভুলে গেলুম! এখন আর আফসোস করে লাভ নেই। অনেকটা দূরে চলে এসেছি। একখানা বেশ উঁচু জায়গা। ঘন ঘাস আর বেঁটে চ্যাপ্টা পাতাওয়ালা একরকম গাছ গজিয়ে রয়েছে। তারপর ঢালু হয়ে মাটিটা নেমে গিয়ে একটা গভীর শালবনে ঢুকেছে। ডাইনে একটু দূরে একটা প্রকাণ্ড কালো পাথর, তার কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটা রুনিগাছ। পাথরটা ঢেকে লতার ঝালর। ঝালরে চোখ ঝলসানো ফুলের সাজ। ফুলগুলো কাছে থেকে দেখার জন্য এগিয়ে গেলুম। রুনিগাছটার তলায় গিয়ে সেই দাঁড়িয়েছি, কালো পাথরটা থেকে কালো কুচকুচে একটা প্রাণী ঝুপ করে গড়িয়ে হাত-দশেক তফাতে মানুষের মতো দুঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর কানে তালা-ধরানো এক ডাক ছাড়ল আঁ-অ্যাঁ!

সর্বনাশ! এ তো দেখছি একটা ভালুক। ইংরেজিতে এদের বলা হয় শ্লথ বিয়ার। মারাত্মক হিংস্র জানোয়ার। দিশেহারা হয়ে দৌড়াতে থাকলুম। প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ভালুকটার তীক্ষ্ণ নখে আমার পিঠ ফালাফালা হয়ে যাবে।

শালবনের ভেতর দিয়ে বহু দূর দৌড়ে যাওয়ার পর ফাঁকা ঘাসজমিতে পৌঁছলুম। জমিটাতে অসংখ্য পাথর ছড়ানো। কতবার যে আছাড় খেলুম, প্যান্টশার্ট ছিঁড়ে গেল কাটাঝোপে, তারপর সামনে পড়ল নলখাগড়ার জঙল। জঙ্গল ছুঁড়ে গিয়ে হুড়মুড় করে জলে পড়লুম। ভালুকটাকে এতক্ষণ একবারও ঘুরে দেখার সাহস পাইনি। এবার জলাটার মাঝ-অবধি একবুক জলে এগিয়ে ঘুরে দাঁড়ালুম। কোথায় ভালুক?

ভালুকটার সঙ্গে নিশ্চয় রেসে জিতে গেছি। জলাটা তত বেশি বড় নয়। ওপারে বালিয়াড়ি দেখা যাচ্ছিল। খুব সাবধানে জলের ভিতর পা ফেলে এগোতে হচ্ছিল। কাদার মধ্যে পাথর রয়েছে প্রচুর। জল কোথাও এককোমর, কোথাও একবুক। বালির তটে পৌঁছে দু-পা ছড়িয়ে বসে রইলুম কিছুক্ষণ। নিজের বোকামির জন্য রাগ হচ্ছিল খুব। তেষ্টাও পেয়েছিল। কিন্তু জলটা খাওয়া উচিত হবে কি না বুঝতে পারছিলুম না।

কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লান্তি চলে গেল। তখন উঠে দাঁড়ালুম। তারপর চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে চমকে উঠলুম। কর্নেল কি এই জলার ধারেই কোথাও ক্যামেরা পেতে রেখেছিলেন? সেই লেজওয়ালা মানুষের ছবিটা এখানকার বলেই তো মনে হচ্ছে। ভালুকের চেয়ে লেজওয়ালা মানুষ কতটা বিপজ্জনক কে জানে! এখান থেকে ঝটপট কেটে পড়াই ভাল।

বালিয়াড়ির পর প্রকাণ্ড পাথরের স্তুপ সার-সার দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফাঁক গলিয়ে যাব কি না ভাবছি, হঠাৎ বাঁ দিকের স্তূপটার আড়াল থেকে একটা বিদঘুটে চেহারার লোক বেরিয়ে এল। তার গায়ের রং কুচকুচে কালো। কোমরে এক টুকরো লাল ন্যাকড়া জড়ানো। গলায় একগুচ্ছের লাল পাথরের মালা। দুহাতে ওই রকম লাল পাথরের মালা জড়ানো। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ। থ্যাবড়া নাক। কপালে লাল রঙের কয়েকটা আঁকিবুকি। তার মাথায় একরাশ জটাচুল। তার হাতে বেঁটে কাঠের লাঠি। লাঠিটায় বিকট সব মুখ খোদাই করা আছে। সে ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে চেঁচিয়ে উঠল, কে তুমি? এখানে কেন এসেছ? মরার সাধ হয়েছে তোমার?

এবার আরও চমকে উঠলুম তার লেজ দেখে। হ্যাঁ, লেজ। ছবিতে ঠিক যেমনটি দেখেছি কতকটা হনুমানের লেজের মতো দেখতে, কিন্তু বেশ মোটা। তত লম্বা নয় অবশ্য। তাছাড়া ঠিক এই লোকটাকেই তো ছবিতে দেখেছি।

সেই ভোরবেলা থেকে টানা দুঃস্বপ্ন দেখছি না তো? চোখ রগড়ে নিয়ে তাকালুম। তারপর দেখলুম, ওর লেজটা খাড়া হচ্ছে। তারপর সেই লেজওয়ালা লোকটা আচমকা কাঠের লাঠিটা তুলে আমার মাথায় মারল। টের পেলুম, ভূমিকম্প হচ্ছে এবং আমি পড়ে যাচ্ছি। আমার চোখের সামনে অন্ধকার।

ডঃ মহাপাত্রের দুরবস্থা

চোখ মেলে দেখি, আলো জ্বলছে এবং আমি বাংলোর খাটে শুয়ে আছি। তাহলে আগাগোড়া সবটাই লেজঘটিত দুঃস্বপ্ন। ওঠার চেষ্টা করতেই পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনলাম, উঁহু, নোড়ো না, নোড়া না!

একটু তফাতে বসে আছেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। একটা কিছু করছেন। মাথাটা চিনচিন করছিল। হাত দিয়ে টের পেলুম ব্যান্ডেজ রয়েছে। কর্নেল একটু হেসে পাশে এসে বসলেন। বললেন, বনেজঙ্গলে গোঁয়ার্তুমি ভাল না ডার্লিং! তোমার কতবার পইপই করে বলেছি। ভাগ্যিস, আজ একটু সকাল-সকাল জলাটার ধারে ক্যামেরা পাততে গিয়েছিলুম। ধরেই নিয়েছিলুম তুমি ডঃ মহাপাত্রর সঙ্গে বরমডির আদিবাসী মেলায় গেছ। চৌকিদার সঠিক কিছু বলতে পারল না। তাকে তুমি বা ডঃ মহাপাত্র কিছু বলে যাওনি।

আমার শরীর অস্বাভাবিক দুর্বল। কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। তারপর গরম দুধ নিয়ে ফিরলেন। বললেন, দুধটা খেয়ে নাও। রাত মোটে সাড়ে-আটটা। সাতটার সময় একবার জ্ঞান হয়েছিল তোমার। তখন ব্রান্ডি খাইয়ে দিয়েছি। কী-সব ভুল বকছিলে–লেজওয়ালা মানুষের কথা বলছিলে। কর্নেল হাসতে লাগলেন।

জোর করে উঠে বসলুম। ভুল বকিনি। আমি ঠিক আছি। জলার ধারে একটা লেজওয়ালা বিদুঘুটে মানুষ আমার মাথায় লাঠির বাড়ি মেরেছিল। আপনার ছবির কিম্ভুত প্রাণীটাই।

বলো কী! আমি ভেবেছিলুম পাথরের স্তুপে উঠে পা হড়কে গেছে এবং মাথায় চোট লেগেছে।

না। বলে আগাগোড়া যা ঘটেছিল, সব বললুম কর্নেলকে।

কর্নেল ভুরু কুঁচকে একবার টাকে একবার দাড়িতে অভ্যাসমতো হাত বুলিয়ে বললেন, হুম! কিন্তু আমাদের নৃবিজ্ঞানী গেলেন কোথায়? বড় ভাবনায় পড়া গেল দেখছি।

এ-রাতে ঘুমটা স্বভাবত গভীর হয়েছিল। দুঃস্বপ্ন দেখিনি। দেখিনি লেজ-ঘটিত কোনও দৃশ্যও। মশারির ভেতর থেকে আমার বৃদ্ধ বন্ধুটিকে কালকের মতোই আপন কাজে মগ্ন দেখলুম। কৃতজ্ঞতায় মন নুয়ে রইল। কাল ওই বিপদসঙ্কুল জলার ধার থেকে এই শক্তিমান বুড়োমানুষটি আমায় কাঁধে করে অতটা পথ বয়ে এনেছেন। ছেড়া নোংরা পোশাক বদলে দিয়েছেন। স্নেহশীল পিতার মতো আচরণ করেছেন। আস্তে বললুম, গুড মর্নিং মাই ডিয়ার ওল্ড ম্যান!

কর্নেল মর্নিং বলে উঠে এসে মশারি তুলতে থাকলেন। তড়াক করে উঠে বসে বললুম থাক্ আর শোবার দরকার নেই। আপনার রাতের ক্যামেরায় কী ফসল তুললেন দেখি।

টেবিলের একটা ছবি তুলে দেখে হকচকিয়ে গেলুম। জলার ধারে সেই পাথরের স্তুপ বলেই মনে হচ্ছে। একটা স্কুপের কাছে হাঁটু দুমড়ে বসে আছেন নৃবিজ্ঞানী ডঃ দীননাথ মহাপাত্র। হাতে শাবলজাতীয় কিছু।

কী কাণ্ড! অবাক হয়ে বললুম। নৃবিজ্ঞানী দেখছি প্রত্নবিজ্ঞানীর মতো খননকার্যে লিপ্ত হয়েছেন। কর্নেল, ওখানে কি প্রাচীন সভ্যতা লুকিয়ে আছে নাকি?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে রাতদুপুরে লুকিয়ে কেউ করে না, ডার্লিং—যদি না তুতানখামেনের মতো কোনও সম্রাটের গুপ্তধন পোঁতা থাকে।

মাই গুডনেস! ডঃ মহাপাত্র কি গুপ্তধন খুঁজছেন ওখানে?

জানি না। বলে কর্নেল ব্রেকফাস্টের ট্রে টেনে নিলেন। বললেন, শিগগির বাথরুম সেরে এসো। বেরুব।

বাথরুম থেকে ফিরে জিজ্ঞেস করলুম, ডঃ মহাপাত্র রাতের খাটুনির পর নিশ্চয় এখনও বিশ্রাম নিচ্ছেন? গুপ্তধন পেলেন কি না ওঁকে জিজ্ঞেস করার জন্য মন ছটফট করছে।

উনি ফেরেননি।

সে কী!

কর্নেল কোনও কথা না বলে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলেন। আমি কফিটুকু ঝটপট গিলে নিলুম। এই সময় বাইরে মোটরগাড়ির গর গর শব্দ শোনা গেল। দুজনে বেরিয়ে দেখি, বন দফতরের অফিসার সূর্যপ্রসাদ রাও জিপ থেকে গেটের কাছে নামছেন। হন্তদন্ত এসে বললেন, কর্নেল! সাংঘাতিক ব্যাপার। বাগদা আদিবাসীরা ডঃ মহাপাত্রকে প্রচণ্ড মারধর করেছে। ভ্যাগ্যিস ফরেস্ট গার্ডরা ভোরবেলা ওদের বস্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ওঁকে উদ্ধার করে আমাকে খবর দেয়। আমি গিয়ে ওঁকে বরমডি হাসপাতালে রেখে এলুম। বাঁচবেন কি না বলা কঠিন।

কর্নেল বললেন, বাগাদা বস্তিতে কেন গিয়েছিলেন ডঃ মহাপাত্র? মিঃ রাও বললেন, ওদের দেবতার থান আছে জঙ্গলের ভেতর একটি ছোট্ট লেকের ধারে। ওখানে বাইরের কোনও লোকের যাওয়া বারণ। ওরা বলল, এই লোকটা তাদের পবিত্র থানের অপমান করেছে। ওদের বোঝানো বৃথা। তাছাড়া গভর্নমেন্ট এখন ট্রাইবালদের ব্যাপারে খুব সতর্ক। বস্তার এলাকার বিদ্রোহের কথা তো জানেন।

হুম। তাহলে ডঃ মহাপাত্রকে ওরা দেবতার থান থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল বলুন!

ঠিক বলেছেন। বলে মিঃ রাও ডঃ মহাপাত্রের ঘরের তালা খুললেন। বললেন, ওঁর পকেটে চাবিটা ছিল। ওঁর জিনিসপত্র কী-সব আছে, হাসপাতালে পৌঁছে দিতে হবে।

লেজ তুলে পলায়ন

মিঃ রাও চলে গেলে কর্নেল বললেন, জয়ন্ত, সঙ্গে রাইফেল নাও তোমার। সেই ভালুকটার মুখোমুখি হলে আত্মরক্ষা করতে পারবে। কিংবা ধরো, দৈবাৎ সেই লেজওয়ালা মানুষটা এসে পড়ল ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করে তাকে ভয় দেখাবে।

কর্নেল হাসছিলেন। রাইফেল কাঁধে নিয়ে পা বাড়িয়ে বললুম, আমরা যাচ্ছি কোথায়?

গুপ্তধন খুঁজতে।

সারা পথ আর মুখ খুললেন না গোয়েন্দপ্রবর। সতর্কভাবে সেই জলার ধারে পৌঁছে স্তূপগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, খোঁড়ার জায়গাটা বাগাদারা বুজিয়ে ঠিকঠাক করে দিয়েছে আগের মতো। যাই হোক, তুমি চারিদিকে লক্ষ্য রাখখা। বাগাদারা যে-কোনো সময় এসে হামলা করতে পারে। আমি এমন কিছু অনুমানই করিনি। নইলে কোন সাহসে এখানে ক্যামেরা পাততে আসব?

একটা পাথরের স্তুপের গায়ে খাঁজে কী একটা ভোলা রয়েছে। কর্নেল সেটা তুলে নিয়ে বললেন, আরে! এটা দেখছি ডঃ মহাপাত্রর নোটবই। এখানে রেখে গুপ্তধন খুঁজছিলেন নাকি?

নোটবইটা ছোট। প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। স্তূপগুলোর গায়ে অদ্ভুত সব আঁকিবুকি চোখে পড়ছিল। কর্নেল সেগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এইসময় হঠাৎ আমার পিছনে চাপা শব্দ হল। ঘুরে দেখি, কালকের সেই লেজওয়ালা। লাঠিটা যেই তুলেছে, আমিও রাইফেল তাক করেছি। ধমক দিয়ে বললুম, ফ্যাল হতচ্ছাড়া হনুমান! ফেলে দে লাঠিটা! নইলে গুলি করে মারব।

লাঠিটা ফেলে সে পিঠটান দেওয়ার জন্য ঘোরা মাত্র কর্নেল তীরের মতো এসে ওর লেজ ধরে হ্যাচকা টান মারলেন। লেজটা খুলে এল। সে অজানা ভাষায় চাচাতে-চাঁচাতে পড়ি-কি মরি করে পালিয়ে গেল।

কর্নেল লেজটা দেখতে দেখতে বললেন, একটা চমৎকার ট্রাইবাল আর্টের নিদর্শন! যাই হোক জয়ন্ত! আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়। চলো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কেটে পড়ি। বাংলোতে পৌঁছেই ঝটপট সব গুছিয়ে নিয়ে বেরুতে হবে।

কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে এগোলেন। আমি পা বাড়াতে গিয়ে ঘুরে বললুম, আমিই বা ট্রাইবাল আর্টের এ-নিদর্শন হাতছাড়া করব কেন? বিশেষ করে এটা আমার একটা স্মারকচিহ্ন হয়ে থাকবে—মার খাওয়ার!

বিদঘুটে বেঁটে লাঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে কর্নেলের সঙ্গ ধরলুম।…

বাদশাহি সোনাদানা

চিরামবুরু-বরমডি রোডে একটা কাঠ বোঝাই ট্রাক পেয়ে গিয়েছিলুম। বরমডিতে কর্নেলের সামরিক জীবনের বন্ধু মেজর অর্জুন সিংয়ের বাড়ি। ওখান থেকেই আমরা চিরামবুরু জঙ্গলে গিয়েছিলুম। মেজর অর্জুন সিং আমাদের দেখে হকচকিয়ে গেলেন, কী ব্যাপার? এত শিগগির চলে এলেন যে জঙ্গল থেকে।

কর্নেল বললেন, পরে বলছি সব! এখন ভীষণ খিদে-তেষ্টায় ভুগছি।

মেজর অর্জুন সিং হো-হহা করে হেসে উঠলেন। তারপর ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রচুর খাদ্য এল টেবিলে। খেতে-খেতে কর্নেল চিরামবুরুর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন।

মেজরসাহেব বললেন, আপনাকে তো বলেইছিলুম মশাই, বাগাদা ট্রাইবের ওঝা সবসময় লেজ পরে থাকে। ওদের বিশ্বাস, রামায়ণের হনুমানজির অবতার ওদের ওঝা।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু আসার সময় ট্রাকে বসে ডঃ মহাপাত্রের নোটবইটা পড়ে ফেলেছি। ওতে মোগল আমলের এক ঐতিহাসিক মির্জা মেহেদি খানের বই থেকে একটা উদ্ধৃতি আছে। পড়ে শোনাচ্ছি।

নোটবইটা বের করে কর্নেল পড়তে যা বলেন।…দাক্ষিণাত্য থেকে বাদশাহ আলমগিরের পুত্র শাহজাদা মুহম্মদ বিদ্রোহ দমন করে ফিরে আসার সময় বিস্তর ধনরত্ন নিয়ে যান। পথিমধ্যে সিরামবোরাত নামক ভীষণ অরণ্যে শাহজাদার পশ্চাদ্বর্তী দলটি জংলিদের কবলে পড়ে। জংলিরা রাতের অন্ধকারে তাদের অনেক ধনরত্ন লুণ্ঠন করে। পরে অগ্রবর্তী দলের নায়ক মান খাঁ জংলিদের ওপর প্রতিশোধ নেন। আমি মর্দান খায়ের জামাতা সেহাবুদ্দিনের কাছে শুনেছি, জংলিদের অস্ত্র বলতে শুধু কাঠের লাঠি ছিল। তাদের দলপতির নাকি বানরের মতো লেজ ছিল। মর্দান খাঁ জংলিদের বন্দি করেন। কিন্তু লুষ্ঠিত ধনরত্নের সন্ধান পাননি। জংলিরা বলে, সব জিনিস তাদের লেজওয়ালা দলপতি কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। মর্দান খাঁ জঙ্গল তল্লাশ করে তার সন্ধান পাননি। ফলে ক্রোধের বশে তিনি জংলিদের হত্যা করেন।

কর্নেল বললেন, এর তলায় ডঃ মহাপাত্রের নোট রয়েছে। লিখেছেন, বাগদাদের নিয়ে গবেষণার সময় ওদের একটি লোক-কথায় মির্জা মেহেদি খানের বর্ণিত ঘটনার সূত্র রয়েছে। বাগাদা ওঝারা নাকি বংশপরম্পরায় সেই ধনরত্নের সন্ধান জানে। ওই ওঝাদের কিন্তু কৃত্রিম লেজ থাকে।

ডঃ অর্জুন সিং অভ্যাসমতো হো হো করে হেসে বললে, লোক-কথা? লোক-কথা মানেই। গালগল্প!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments