Saturday, April 20, 2024
Homeরম্য গল্পছেলে মানুষ কর - লীলা মজুমদার

ছেলে মানুষ কর – লীলা মজুমদার

লীলা মজুমদার

দুনিয়াতে যতরকম শক্ত কাজ আছে, তার মধ্যে ছেলেপুলে মানুষ করা হল সব চাইতে বড়। তা সে পিটিয়ে সিধে করাই যাক, কিংবা আহ্লাদ দিয়ে মাথায় তোলাই যাক। অনেক কাল আগে একটা বেশ মজার গল্প শুনেছিলাম। সুমতিদিদি ছিলেন একজন নামকরা শিক্ষাবিদ। তিনি গেছিলেন ইউরোপে আরও উচ্চশিক্ষা লাভ করতে। শিক্ষার উদ্দেশ্যই হল ছোট ছেলেমেয়েদের মানুষ করে তোলা। বলা বাহুল্য সুমতিদি চিরকুমারী।

সেদেশে একদিন ট্রেনের কামরায় আমার কামিনীদির সঙ্গে তাঁর দেখা হল। কামিনীদিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল রত্ন এবং আরেকজন শিক্ষাবিদ। তাঁর সঙ্গে তাঁর ৪-৫ বছরের ছেলে। ছেলেটা সুমতিদিকে খালি খালি চিমটি কাটতে লাগল। সুমতিদি কামিনীদিদিকে বললেন, ‘আপনার ছেলেকে সামলান। আমাকে খালি খালি চিমটি কাটছে। ভারী দুষ্টু হয়েছে তো!’

কামিনীদিদি আহত হয়ে বললেন, ‘ছিঃ! অমন কড়া কথা বললে ওর কচি মনে দাগা লাগবে। সারা জীবন ও তার চিহ্ন বয়ে বেড়াবে।’

সুমতিদি বললেন, ‘তা হলে যেমন করে পারেন চিমটি কাটা বন্ধ করুন। আমার কচি মন নেই, তাতে দাগাও পড়ছে না। কিন্তু আধবুড়ো গায়ে কালসিটে পড়ছে।’

কামিনীদিদি ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘দেখছ বাবা, মাসিমার গায়ে কালসিটে পড়ে যাচ্ছে। ওঁকে চিমটি কাটছ কেন?’

ছেলে বলল, ‘আমার ইচ্ছে করছে, তাই।’

‘খুব বেশি ইচ্ছে করছে কি?’

‘হ্যাঁ, খুব বেশি ইচ্ছে করছে।’

তখন কামিনীদিদি সুমতিদিদিকে বুঝিয়ে বললেন, ‘দেখুন, শিশুর প্রবল ইচ্ছায় কখনও বাধা দিতে নেই। তা হলে বড় হলে ওর মধ্যে নানারকম মানসিক বিকার দেখা যাবে। আচ্ছা, বাবা, খুব আস্তে আস্তে চিমটি কেটো, কেমন?’

সুমতিদি সিধে হয়ে উঠে বসে বললেন, ‘দেখুন, শুধু ওর নয়, আমারও প্রবল ইচ্ছাতে বাধা দিলে এখনই মানসিক বিকার দেখা দেবে। ফের যদি ও আমাকে চিমটি কাটে, আমিও ওকে এইসা এক রামচিমটি দেব যে ও নিজের নাম ভুলে যাবে!’

সঙ্গে সঙ্গে কামিনীদিদি ছেলেকে ডেকে বললেন, ‘ও কী হচ্ছে? এক্ষুনি আমার কাছে এসে বসো বলছি।’ ব্যাপার দেখে ছেলেও সুড়-সুড় করে মায়ের পাশে গিয়ে বসল। বাকি পথটা শান্তিতে কাটল।

শুনলাম কলকাতায় একটা ক্লাব আছে, তার সদস্যরা কখনও নিজেদের ছেলেমেয়েদের ধমকধামক মারধোর করেন না। ওসব করলে নাকি শিশুর চিত্তের স্বাভাবিক কোমলতা একেবারে উবে যায়। তবে অন্যদের ত্যাঁদড় ছেলেমেয়েদের তাঁরা বকেন কিংবা ঠ্যাঙান কি না বলতে পারি না। একবার ওই ক্লাবের এক সদস্যর ছেলের জন্মদিনে খেলনা কেনা হবে। ছেলে মা-বাবাকে বলল, ‘তোমরা ভাল খেলনা চেন না। আমি নিজে পছন্দ করে কিনব।’

ক্লাবের সভাপতি খুশি হয়ে বললেন, ‘ভালই তো। আমার এক বন্ধুর খেলনার দোকান আছে। সেখানে সুবিধাদরে ভাল জিনিস পাওয়া যাবে।’ তাই ঠিক হল। সভাপতির সঙ্গে ছেলে, তার মা আর বাবা গেলেন সেই দোকানে। অত খেলনা দেখে ছেলের মুন্ডু ঘুরে গেল। একবার বলে, ‘এটা নেব!’ তার পরেই বলে, ‘না, ওটা নেব!’ শেষে একটা মস্ত কাঠের দোলনা ঘোড়ায় চেপে আর নামতে চায় না!

খালি বলে, ‘এইটে কিনব!’ এদিকে ঘোড়ার দাম প্রায় দুশো টাকা, ছেলের মা-বাবার সাধ্যের বাইরে। তাকে ভোলাবার বহু চেষ্টা হল। এটা দেখানো হল, সেটা দেখানো হল, ঘোড়ার নিন্দে করা হল। কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। ওই ঘোড়া ছাড়া সে কিচ্ছু নেবে না!

শেষটা চ্যাঁচামেচি, কান্নাকাটি। ছেলে ঘোড়া থেকে নামবেও না, বাড়িও যাবে না। মা-বাবা হয়রান হলেন। দোকানদার ভদ্রলোকও তাজ্জব বনে গেলেন। দোকানঘরে ছোটখাটো একটা খণ্ডপ্রলয় শুরু হয়ে গেল। অন্য খদ্দেররা হাঁ!

বন্ধুর অবস্থা দেখে, ক্লাবের সভাপতি শেষ পর্যন্ত ছেলের মা-বাবাকে বললেন, ‘তোমরা একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াও। আমি ছেলেকে রাজি করিয়ে নিয়ে আসছি।’

মা-বাবা বাইরে গেলেন। সভাপতি ছেলের কানে-কানে গুটিকতক কথা বলবামাত্র ছেলে ঘোড়ার পিঠ থেকে তড়াক করে নেমে পড়ে, বাইরে গিয়ে মা-বাবার হাত ধরে টানতে টানতে বলল, ‘এক্ষুনি বাড়ি চলো!’ মা-বাবা তো অবাক! ‘কিন্তু খেলনা কেনা হল না যে?’ ‘বাপি কাল কিনে দেবে। বাড়ি চলো।’

তারা বিদায় হলে, দোকানদার সভাপতিকে বলল, ‘এ কী ম্যাজিক দেখলাম? কী বললে ওর কানে কানে?’

সভাপতি কাষ্ঠ হাসলেন, ‘বললাম— ব্যাটা লক্ষ্মীছাড়া! এই মিনিটে যদি নেমে মা-বাবার সঙ্গে বাড়ি না যাস তো প্যাঁদানি দিয়ে আলুভাতে বানিয়ে দেব!— আচ্ছা, আসি, ভাই।’

আরেকটা সত্যি ঘটনা শুনুন। এক ইতিহাসের ছাত্র গবেষণা করছিল। অধ্যাপকের বাড়ি গিয়ে তাকে অনেক কাজ করতে হত। অধ্যাপক আর তাঁর স্ত্রী দেবতুল্য মানুষ, কিন্তু তাঁদের ছেলেটি পাজির পা-ঝাড়া! চ্যাঁচামেচি, কাজে ব্যাঘাত তো করতই, তার ওপর একটা শক্ত কাঠের বল দিয়ে হতভাগ্য ছাত্রের মাথায় পিটত। কিন্তু কিছু বলার উপায় ছিল না, কারণ ছেলের মা-বাবা সারাক্ষণ ধমক-ধামক মারপিটের কুফল সম্বন্ধে বড় বড় বক্তৃতা দিতেন।

চুপ করে সব সয়ে যেত ছাত্র। তারপর গবেষণা শেষ হল; থিসিস গৃহীত হল; ছাত্র ডক্টরেট পেল। তখন এক শুভদিনে এক হাঁড়ি রাজভোগ নিয়ে গুরুকে আর গুরুপত্নীকে প্রণাম করে, বেরিয়ে যাবার সময় ছেলেকে বলল, ‘আমার সঙ্গে একটু বাইরে এসো তো দেখি।’ ছেলে ভাবল নিশ্চয় ভালমন্দ কিছু পাওয়া যাবে। বাইরে এসেই তার গালে একটা বিরাশি সিক্কার চড় কষিয়ে ছাত্র বলল, ‘যা, মা-বাবাকে বলগে যা!’ এই বলে বাড়ি চলে গেল।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments