Tuesday, April 23, 2024
Homeবাণী-কথাজাঁ এরবের - লীলা মজুমদার

জাঁ এরবের – লীলা মজুমদার

লীলা মজুমদার

বিদেশিদের ব্যাপারই আলাদা। দেশ স্বাধীন হবার ১০ বছর আগে যে সমস্ত সায়েব-মেমরা ভারতে আসত, তারা আজকালকার ট্যুরিস্ট আর হিপিদের থেকে একেবারে আলাদা ছিল। একদল আসত রাজ্যশাসন করতে কিংবা ধনের আশায়। আমি তাদের কথা বলছি না।

আমি যাদের কথা বলছি, তাদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শান্তশিষ্ট পড়ুয়া টাইপের ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এদেশের শিল্প, সাহিত্য বা ধর্ম সম্বন্ধে কিছু গবেষণা করা। তারা আগে থেকেই নিজেদের তৈরি করে আসত। নামকরা সব সংস্থার, বা বিখ্যাত ভাষাবিদদের কাছ থেকে পরিচয়পত্র আনত। অনেক সময় আমাদের বন্ধুদের বন্ধুদের ব্যক্তিগত চিঠি আনত। কেউ কেউ সংস্কৃত, পালি, বাংলা পড়তেও পারত।

এখনও যারা আসে তাদের মধ্যেও হয়তো ওই ধরনের কিছু মানুষ থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয় না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকেই বোধহয় অনেক পুরনো নিয়ম বদলে গেছে। এখন আর ওদের দেখতে পাই না। এক যারা সরকারি সূত্রে আসে। তারা অন্য জাত।

মনে আছে ১৯৩৬ সালে পন্ডিচেরি থেকে আমাদের ভাগনে দিলীপকুমার রায় চিঠি দিয়ে জাঁ এরবের বলে এক ফরাসি ভদ্রলোককে আমাদের কাছে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। কিছুদিন তিনি আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। যেমন সুন্দর চেহারা, তেমনি আমুদে মানুষটি। ৬ ফুটের বেশি মাথায়, বলিষ্ঠ শরীর, চোখেমুখে কথা বলতেন নিখুঁত ইংরেজিতে। বয়স ৪০-৪২ হবে।

মাসখানেক ছিলেন আমাদের কাছে। রোজ হয় বেলুড় মঠে, নয় উদ্বোধন আপিসে যেতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ আর বিবেকানন্দস্বামীর জীবন নিয়ে গবেষণা করছিলেন। বই লেখা হবে। বলতেন ওঁদের দেশে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভক্ত আছে।

সারাদিন দেখা পেতাম না। সন্ধ্যায় ফিরে ঠান্ডা জলে চান করে, খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, কৌচে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে রাজ্যের গল্প করতেন। ঘুরতে কোথাও বাকি রাখেননি, বিশেষ করে তিব্বত, চিন, জাপান।

এমন সরস-গম্ভীর মানুষ কম দেখেছি। নিরামিষ খেতেন। রোজ সকালে আসনে বসে ঘণ্টাখানেক ধ্যান করতেন। বলেছিলেন, একসময় বিবেকানন্দস্বামী ওই আসনে বসে ধ্যান করতেন। বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠেছিল।

আরেকবার সাহেবের সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবিতে এক সেট বড় বড় রুপোর বোতাম দেখেছিলাম। সেও নাকি স্বামীজির ব্যবহার করা, কেউ দিয়েছিল তাঁকে। এসব জিনিস ফ্রান্সে ওঁদের সাধনাকেন্দ্রে এখন রাখা হবে। বড় মনকেমন করে উঠেছিল।

বলেছিলাম, ‘আমি হলে কাউকে ও-জিনিস বিদেশে নিয়ে যেতে দিতাম না।’ হেসে বলেছিলেন, ‘ভাগ্যিস আপনার হাতে অনুমতি দেবার ভার নেই। কিচ্ছু ভাববেন না। যেখানে নিয়ে যাচ্ছি, সেখানেও এ-জিনিস কিছু কম শ্রদ্ধা পাবে না।’

ভারী দুঃসাহসী মানুষটি। ধর্মগ্রন্থের খোঁজে তিব্বত গিয়েছিলেন। বিশেষ অনুমতি ছাড়া কোনও সাদামুখো মানুষ তিব্বতে পদার্পণ করতে পারতেন না। তাই তিব্বত গেছিলেন শুনে আমার ভারী কৌতুহল হয়েছিল। আমার দাদামশাই গেছিলেন ১৮৯৯ নাগাদ। তিনি ছিলেন সন্ন্যাসী এবং তীর্থযাত্রী, তবে দুঃসাহসিকও বটে। দাদামশাই তিব্বতের নানা গুম্ফায় তিব্বতী হরফে লেখা দুষ্প্রাপ্য সংস্কৃত পুথি আর তার অনুবাদ দেখে এসেছিলেন শুনে সায়েবের ভারী আক্ষেপ। তিনি সেরকম সুযোগ পাননি।

তারপরেই মুচকি হেসে বললেন, ‘কিন্তু আমার যেমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল, দাদামশায়ের নিশ্চয়ই তা হয়নি। সীমান্ত পেরিয়ে এক সরকারি পান্থশালায় উঠেছি। কাছেপিঠে দু’-একটি গুম্ফা দেখেছি, দু’চারজন লামার সঙ্গে আলাপ করেছি। তারপর গাইড বলল, ‘এখানকার পানশালা না দেখলে কিন্তু কিছুই দেখা হল না।’

গেলাম পানশালা দেখতে। লোকের ভিড়। পানশালা মানে স্রেফ মদের আড্ডা। ফ্রান্সেও যেমন, ওখানেও তেমনি, মদকে লোকে ঘেন্না না করলেই হল। সব শীতের দেশেই এই নিয়ম।

পানশালায় ক’জন মহিলা ছিলেন তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। সবার একরকম পোশাক, একরকম চেহারা, দাড়ি-গোঁফের বালাই নেই। ভীষণ শীত। আংটায় কাঠকয়লা জ্বলছে। হাসি, গল্প, বাঁশের চোঙে কিংবা পিতলের গেলাসে মদ খাওয়া।

গোড়ায় কেউ কোনও অসভ্যতা করছিল না। কিন্তু রাত যতই বাড়তে লাগল, কারও কারও মাথাও গরম হয়ে উঠতে লাগল। জোরে জোরে কথা থেকে তর্কাতর্কি, তর্কাতর্কি থেকে হাতাহাতি, হাতাহাতি থেকে ছোরাছুরি বেরোতে কতক্ষণ?

ভাবছিলাম আমি বিদেশি, এসবের মধ্যে না থাকাই ভাল। গাইড বলল, ‘ব্যস্ত হবেন না। এখানে শান্তিরক্ষার ভাল ব্যবস্থা আছে। শান্তিরক্ষক এই এল বলে!’

যা বলেছিল ঠিক তাই! হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে একজন ইয়া ষণ্ডা বেঁটে শান্তিরক্ষক— ইংরেজিতে যাকে বলে চাকারআউট— এসে দুই হট্টগোলকারীর ঘাড় দুটো দু-হাতে ধরে, তাদের পেছনে লাথি মারতে মারতে, সামনের খোলা দরজা দিয়ে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে এল!

তারপর হাত ঝাড়তে ঝাড়তে যখন আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল, তখন দেখলাম সে একজন ৪০-৪৫ বছর বয়সের মেয়েমানুষ। স্ত্রীস্বাধীনতায় ওরা পৃথিবীর সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে।’

চিন দেশেও গেছিল সায়েব। সেখানে এক নির্জন গ্রামে, কালো তাঁবুতে রাতের আশ্রয়। গাইড পর্যন্ত সঙ্গে ছিল না। ঘোড়াওয়ালাও ওঁকে তাঁবুর সামনে নামিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছিল। ওইটাই নাকি পান্থশালা।

তাঁবুর মালিকের চেহারা দস্যুর মতো বললে কম বলা হয়। স্রেফ দৈত্যের মতো দেখতে। মাথায় সায়েবের চেয়েও লম্বা। ঝুলো গোঁফ, মুখে ভাবের লেশমাত্র নেই, কানে জেডের গয়না। প্রাণ হাতে করে সায়েব তাঁবুতে বসে ভাবছিলেন খিদেয় প্রাণ যায়, কিন্তু খাবারের আশা কম। এমন সময় লম্বা একটা ছোরা হাতে একজন লোক ঘরে ঢুকে, চোখ পাকিয়ে হিড়িং মিড়িং করে কীসব বলে গেল, সায়েব এক বর্ণও বুঝলেন না।

শেষটা একবার চারটে আঙুল, একবার দুটো আঙুল দেখিয়ে কী যেন জানতে চাইল। সায়েবের চক্ষুস্থির! নিশ্চয় জিজ্ঞাসা করছে চার দিন পরে গর্দান নেওয়া হবে, নাকি দু’দিন পরে। ভয়ে ভয়ে সায়েব চারটে আঙুল দেখাতেই, সে ছুটে বেরিয়ে গেল। এবং একটু বাদেই একটা সুন্দর চিনেমাটির থালায় একটা মোটা হাতরুটি, এক দলা মাখন আর চারটে মস্ত মস্ত সেদ্ধ ডিম নিয়ে এল!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments