Wednesday, April 24, 2024
Homeকিশোর গল্পচালতা গাছের মাঁচা - সত্যেন সেন

চালতা গাছের মাঁচা – সত্যেন সেন

‘চালতা গাছের মাঁচা’ সত্যেন সেন

মানুষ থাকে মাটির উপর ঘরে কি দালানে। আর পাখিরা থাকে গাছের উপর। এইটাই নিয়ম। শুধু এখন বলে নয়, চিরকালই এই নিয়ম চলে আসছে। তবু মানুষের বাচ্চা হয়েও ওরা দু’ভাই গাছের আগায় বাসা বাধল। যে দেখে সে-ই হাসে। এমন কাণ্ড কেউ কোন দিন দেখেছে।

দু’টি ভাই- বল্টু আর পল্টু। ওদের নিত্য নতুন খেলা। এসব খেলার নামও কোন দিন কেউ শোনে নি। কে-যে ওদের মাথায় এসব বুদ্ধি যোগায় কে জানে! খুঁজে খুঁজে শেষে দক্ষিণ দিকের চালতা গাছটাকে ওরা বাছাই করল। এই গাছের মাথায় মাচা বাঁধতে হবে। যেমন কথা তেমনি কাজ। সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু হয়ে গেল। গাছের একেবারে মাথার দিকে তিনটে ডাল পাশাপাশি চলে গেছে। তার উপর বাশ বেধে ওরা দেখতে দেখতে এক দিব্যি মজবুত মাচা বানিয়ে ফেলল।

সেই থেকে কী-যে হয়েছে, দিনের অনেকটা সময় ওরা মাচাতেই কাটায়। লেখাপড়া চুলোয় গেছে, সারা দিন গাছের উপর কাঠ-ঠোকরার মত খালি খুটুর-খাটুর চলছেই। কত যে কাজ! কাজ আর শেষ হয় না। এখানে কমায়, ওখানে বাড়ায়, এখানে কাটে, ওখানে জোড়া দেয়, কাজ লেগেই আছে। বাঁশের মাচার উপর পুরু করে খড়ের গদি বানাল। একেবারে রাজশয্যা। দু’জনে আরাম করে বসা যায়, আবার গুটিশুটি হয়ে শোয়াও যায়।

ওদের খেলার সাথীরা খবর পেয়ে দেখতে এল। মাচা দেখে তারা তারিফ করে বলল, বাঃ, বেশ একখানা বাড়ি হয়েছে তো। বল্টু আর পল্টু আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠল। হবে না? এ-যে তাদের নিজেদের হাতে তৈরি বাসা।

ছেলেরা বলল, কিন্তু তোরা খেলতে আসিস না কেন?

বল উত্তর দিল, খেলব কি রে, আমাদের এখন কত কাজ। পল্টু বলল, তোরা নিজেরাই খেলগে যা, আমাদের কত কাজ, না রে দাদা?

কিন্তু শুধু খেলাধুলোই নয়, পড়াশুনোও তাকে উঠল। মা কেবল রাগারাগি করে, লেখা নেই, পড়া নেই, সারা দিন শুধু গাছের উপরে এসব কি? মায়ের ঘ্যানঘ্যানানিতে উত্যক্ত হয়ে ওরা ওদের বইপত্র বগলদাবা করে নিয়ে মাচার উপর উঠে বসত, আর বলত, নীচে বড় গোলমাল, ওখানে নিরিবিলিতে পড়া নাকি খুব ভাল হয়। মা নীচের থেকে ডাকাডাকি করলে ওরা জবাব দিত, মা, গোলমাল করছ কেন? আমরা পড়ছি যে।

মা ভাল মানুষ, নীচ থেকে খুব পড়ার শব্দ শুনে ভাবত, থাক, পড়ছে পড়ুক। ঘরে থাকলে তো একটুও পড়তে চায় না। কিন্তু পড়াশোনা-যে কেমন এগোচেছ একমাত্র চালতা গাছটাই তা বলতে পারত।

বড় বোন হাসি, তার ইচ্ছা সেও একবার উপরে উঠে দেখে আসে ওদের বাসাটা। এখন তো অনেকেই দেখতে যায়। কিন্তু মেয়েমানুষ কেমন করে গাছ বেয়ে উঠবে! হাসি ডেকে বলল, কি রে, তোরা সারা দিন উপরে এত কি করিস? তোরা কি পাখি হয়ে গেলি?

ওরা বলল, হ্যা, আমরা পাখিই তো।

তবে ওই উপরেই থাক। আর বাড়ি-ঘরে ঢুকতে পারবি না। ওই খানেই খাবি-দাবি, ওই খানেই ঘুমাবি।।

ওরা বলল, দাঁড়াও না, মাচাটাকে আরও বড় করে নিই। ক্রমে ক্রমে সবই হবে। তোমরা তোমাদের ওই মাটিতেই পড়ে থাকবে। আর আমরা থাকব তোমাদের সবার মাথার উপরে।

সত্যি, ক্রমে ক্রমে অনেক কিছুই হতে লাগল। জোড়াতালি দেওয়ার ফলে মাচাটার আকার অনেকটা বেড়ে গেল। ওদের মাথায় নতুন নতুন ফন্দি খেলতে লাগল।

এক দিন দেখা গেল ঝুড়ি ঝুড়ি মাটি গাছের উপর উঠছে। এত বড় গাছ বেয়ে মাটি তোলা বড় সহজ কথা নয়। খাটতে খাটতে ওরা দু’ভাই একেবারে গলদঘর্ম হয়ে উঠল।

নীচে হাসি অবাক হয়ে হা করে এদের কাজ দেখছিল। সে জিজ্ঞেস করল, মাটি তুলে কি করবি রে তোরা?

ওরা বলল, ঘর-বাড়ি তুলব।

-ঘর-বাড়ি তুলবি কি রে? গাছের উপর কেউ ঘর-বাড়ি তোলে নাকি?

বল্টু পল্টুর তখন বাড়তি কথা বলার সময় নেই। তারা ভীষণ ব্যস্ত।

হাসি ঘরে ফিরে ফলাও করে এই গল্প করল। পাড়াশুদ্ধ এই খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, লখার বাড়ির বল্টু আর পল্টু গাছের উপর ঘর-বাড়ি তুলছে। ওরা দু’ভাই নাকি সেখানেই বসবাস করবে।

শুনে সবাই হাসল। কিন্তু বল্টু পল্টুর মা হাসতে পারল না। ওরা যেন দিন দিন বাড়ি-ঘরের সম্পর্ক ছেড়েই দিচ্ছে। নেহাৎ যেটুকু সময় থাকলে নয়, সেইটুকু সময়েই ঘরে থাকে। একটু ফুরসত পেল আর কথা নেই, অমনি গাছের মাথায়। তা ছাড়া অত উঁচু গাছ, পড়ে গেলে আর কি উপায় আছে! মা অনেক চেষ্টা করল কিন্তু এই পাগলদের ঠেকানো তার অসাধ্য। কথা বললে কি কথা শোনে?

হাসি বলল, ওদের ভয় না দেখলে চলবে না।

রাত্রিবেলা খাওয়ার সময় খেতে খেতে সে ওদের বলল, তোরা-যে সব সময় চালতা গাছের উপর বসে থাকিস ভয় হয় না তোদের?

-ভয়?

-কেন, ভয় কিসের?

-ভয়? কিসের? তাও জানিস না? চালতা গাছের কাছেই তো ওই গাব গাছটা।

-হ্যা, আছেই তো গাব গাছটা, তাতে কি হয়েছে?

-কি হয়েছে! এই গাছে-যে একটা ভূত থাকে- এ কথা তো সবাই জানে।। জানিস না, রাতের বেলা গাব গাছের উপর একটা পা আর তোদের চালতা গাছটার উপর একটা পা দিয়ে দাড়িয়ে থাকে!

পল্টু গল্প শুনে ঝুঁকে পড়ল, কেন আপু? অমন করে দাড়িয়ে থাকে কেনো? ওর কষ্ট হয় না? আমি বাড়ি থেকে অঙ্ক করে নিয়ে যাইনি বলে এক দিন অঙ্কের স্যার আমাদের অমনি করে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। বাপরে বাপ, সে কি টনটনানি! পা দুটো যেন ছিড়ে যেতে চায়।।

হাসি বলল, হ্যা, ভূতের আবার কষ্ট! ওরা তো অমনি করে দাড়িয়ে থাকতেই ভালবাসে।।

বল্টু পল্টুর চেয়ে দু’বছরের বড়। সে ভূতের গল্পকে আমল না দিয়ে বলল, আমাদের হেডমাস্টার বলেছেন, ভুত বলে কোন কিছু নেই। এ সবই ফাকি।

-হ্যা, তোমাদের হেডমাস্টার তো সব কথাই জানে! পড়ত এক দিন আসল ভূতের পাল্লায় তবে বেরিয়ে যেত মজাটা। ও বাড়ির ছিদাম কাকা নিজের চোখে দেখেছে, ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে, একটা ঠ্যাং গাব গাছ, আর একটা ঠ্যাং চালতা গাছের উপরে রেখে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট একটা—

বল্টু হয়তো ভবিষ্যৎকালে ভাল উকিল হতে পারবে। সে ফস করে জেরা করে বলল, অমন ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে দেখতে পেল কি করে?

হাসি একটু থেমে গিয়ে ঢোক গিলল, পরক্ষণেই বলে উঠলে, বাঃ দেখতে পারবে না। হাতে টর্চ ছিল যে। টর্চটা জ্বালাতেই দেখে ওরে বাবা, সে কি মুর্তি!

পল্টু বলল, কিন্তু ও আমাদের কি করবে আমি-যে মানী আপার কাছ থেকে মক্তরটা শিখে ফেলেছি। যেই না দেখব, অমনি মন্তরটা ছাড়ব,

ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি।

এমন প্যাদানি দিব তোদের, করবি তোরা কী?

এই মন্তর পড়লে আর কি ভূত থাকতে পারে? মানী আপাকে জিজ্ঞেস করে দেখো।

হাসি বলল, ও সব তন্ত্র মন্ত্র আগেরকার দিনে চলত। আজকালকার দিনে ভূতেরা ওসব মন্তর-টন্তর মানে না। আর তোরা ওর পা রাখবার জায়গাটায় ঘর বানাবি, ও চটবে না?

বল্টু তার কথা উড়িয়ে দিল, হু, তোমার যত বাজে কথা। ও সব ভূত টুত আগেরকার দিনে মানত। আজকালকার লোকে মানে না। হেডমাস্টার বলেন—-

ধেত্তেরি তোর হেডমাস্টার অমাবস্যা রাত্রিতে নিয়ে আসি ধরে তাকে ওই গাব গাছের তলায়। বেরিয়ে যাবে হেডমাস্টারী।

বল্টু-পল্টুকে কিন্তু ভূতের ভয় দেখিয়ে থামিয়ে রাখা গেল না। দিদির কথাটা মনে করে প্রথম প্রথম দু-একদিন গা একটু ছমছম করেছিল। কিন্তু পরে তা কেটে গেল। তারা আবার নিশ্চিত মনে তাদের নতুন ঘর-সংসার করে চলল।

ঘর-সংসার করে চলল বটে, ঘর কিন্তু আর তৈরি করা হোল না। কেমন করে হবে? মাটি তুলে মাচার উপর ঘরের ভিত গাঁথবার কিছু দিন বাদেই ওরা অবাক হয়ে দেখল, কি আশ্চর্য, মাটি খুঁড়ে অনেক ঘাসের অঙ্কুর উঠেছে। দেখ দেখি কাণ্ড। এখানে আবার ঘাস উঠল কেমন করে? এ নিয়ে দুভাই অনেক গবেষণা করল। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা বোঝা গেল। ঘাসের মত দেখতে হলে কি হবে, ওগুলো কিন্তু ঘাস নয়। এগুলো সব ধান গাছের চারা। মাচার উপর ওরা সেই-যে খড় পেতেছিল, তার সঙ্গে-যে কিছু কিছু ধান ছিলো, সে খবর তো ওরা রাখত না। মাটি পেয়ে ধানের চারা মাথা তুলে উঠেছে। একটা চারা টেনে তুলতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে পুরানো প্ল্যানটা বাতিল হয়ে গেল। ঘর নয়, এবার ক্ষেত বানাতে হবে। চারাগুলো দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠল। বল্টুর-পল্টুর আনন্দ আর ধরে না। এরা বলল, আমরা এবার গাছের উপরেই চাষ-বাস করব। শুধু কথার কথাই নয়, ধানক্ষেতের একপাশে ওরা শসার বীজ পুতল। কি মজা, ধান গাছের মত শসা গাছও এক দিন মাথা জাগিয়ে উঠল। প্রথম দুটো-তিনটে পাতা ছাড়ল, তারপর আর সমস্ত শসা গাছের মত সেটিও লতা হয়ে বেয়ে বেয়ে উঠতে লাগল।

এবার ওদের সামাল দিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। ধানক্ষেত আর শসা গাছ নিয়ে তারা লাফালাফি, চেঁচামেচি, মাতামাতি করতে লাগল। কিন্তু মা, মানাআপু আর হাসি আপু কেউ এ কথা বিশ্বাস করতে চায় না। তারা বলল, যত সব বাজে কথা, চালতা গাছের উপরে ধানক্ষেত আর শসাতে এমন কথা কেউ কোন দিন শুনেছে? এমনই মুশকিল ওদের নিয়ে দেখবারও উপায় নেই। ওরা তো কেউ গাছে উঠতে পারে না।

অবশেষে পাড়ার দু’জন ছোকরা গাছে উঠে স্বচক্ষে দেখে এসে সাক্ষ্য দিল, না, কথা ঠিকই। সুন্দর ধান গাছ হয়েছে। আর শসা গাছটায় কুঁড়িও দেখা দিয়েছে একটা। আর ওরা বলল, পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্যের এক আশ্চর্য ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানের কথা শুনেছি, আর এই দেখলাম বল্টু-পল্টুর শূন্য উদ্যান। এরপর মা বোনেরা বিশ্বাস না করে পারল না।

খবরটা এবার সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। স্কুলের ছেলেরা দল বেঁধে দেখতে আসতে লাগল। বল্টু-পল্টুকে আর পায় কে? মুখের চোটে মা, মানী আপু আর হাসি আপুকে ওরা ঠাণ্ডা বানিয়ে ছাড়ল। ওরা বলল, এর পর ওরা একটা একটা করে সবগুলো গাছে এমনি করে ক্ষেত বানাবে, আর নানা রকম ফসল তুলবে তাতে!

মা আঁতকে উঠে বলল, বলিস কিরে?

বল্টু বলল, হ্যা, একটা গাছও বাকি থাকবে না। এমনি করে গাছের মাথায় মাথায় আর একটা পৃথিবী তৈরি করে তুলব আমরা। নীচে থাকবে তোমাদের পৃথিবী, আর তার উপরে আমাদের পৃথিবী।

বাড়ির মানী আপু এতক্ষণ কোন কথা বলে নি। কিন্তু এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না। সে বলে উঠল,এমন কথা বোলো না, বলতে নেই। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ পৃথিবী বানাতে পারে না।

বল্টু বলল, রেখে দাও তোমার সৃষ্টিকর্তা। আমরা কম কিসে? আমাদের হেডমাস্টার বলেন—–

মানীদি এমনিতে ঠাণ্ডা মানুষ, কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎ চটে ওঠে। সে বলল, তোমাদের এই পোড়াকপালে হেডমাস্টারের কথা আর বোলো না। এসব কথা শুনলেও পাপ। এর আগে কারুণও অহংকার করেছিল। একটা বেহেশত বানিয়েছিল। সৃষ্টিকর্তা কারো অহংকার সহ্য করেন না। তাকেও ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।

কি আশ্চর্য সেই রাত্রিতেই ভীষণ ঝড় উঠল। এমন ঝড় শীগগির কেউ দেখেনি। ওরা দু’ভাই শুয়ে শুয়ে ওদের মাচাটার কথাই ভাবছিল। পরদিন ভোর হতে না হতেই এক ছুটে চালতে গাছের তলায় গেল। গিয়ে দেখে হায় হয়, কোথায় গেল মাচা! একটা বাঁশ শুধু ঝুলছে, আর কোন চিহ্ন নেই তার। অনেক খুঁজে কয়েকটা ধানের চারার খোঁজ পাওয়া গেল। কিন্তু শসা গাছটা কোথায়-যে গেছে, অনেক খুঁজেও তার পাত্তা পাওয়া গেল না।

ওরা দু’ভাই চালতা গাছের তলায় গালে হাত দিয়ে বসে পড়ল। ওরা নতুন পৃথিবী গড়তে চলেছিল, কিন্তু এখন আর কোনই উৎসাহ পাচ্ছে না। এমন সর্বনাশ কে করল?

বল্টু-পল্টু ভাঙ্গা মাচার ধ্বংসাবশেষ বাঁশটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইল।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments