Friday, April 19, 2024
Homeথ্রিলার গল্পতিব্বতী গুপ্তবিদ্যা - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

তিব্বতী গুপ্তবিদ্যা – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

রায়বাড়ির প্রতিমা রহস্য - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

মাদাম ব্লাভাস্কির গুপ্তবিদ্যা

গুম্ফার ভেতর গা ছমছম করা অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু একটু পরেই টের পেলুম, বাইরের উজ্জ্বল রোদ থেকে এসেছি বলেই এমন মনে হচ্ছে। অন্ধকারটা ক্রমশ ফিকে হয়ে গেল। তারপর চোখের দৃষ্টি যত পরিষ্কার হচ্ছিল, তত ভয় পাচ্ছিলুম। চৌকো বিশাল ঘরের ভেতর দুধারে দাঁড়িয়ে আছে যত সব ভয়ঙ্কর চেহারার মূর্তি।…

বিদঘুটে মূর্তিগুলো চোখ কটমট করে এমন ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন আর এক পা বাড়ালেই ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর। চোখের দৃষ্টি যখন একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল, তখন মূর্তিগুলোকে জীবন্ত মনে হল। এমনকী, যেন তাদের ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাসের চাপা শব্দও কানে শুনতে পেলুম।….

এই নির্জন পাহাড়ি গুম্ফায় খেয়ালবশে একা ঢুকে পড়াটা ঠিক হয়নি। সত্যের খাতিরে বলব, আমি ভীতু লোক নই। ভূতপ্রেত বিশ্বাস করি না। জীবনে কত সাংঘাতিক অবস্থায় পড়েছি, কিন্তু বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে ফেলিনি। আজ ওই গুম্ফার ভেতর আমার জ্ঞানবুদ্ধি যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল একটা নিষিদ্ধ জায়গায় ঢুকে পড়েছি এবং একদল সাংঘাতিক জীবের পাল্লায় পড়ে গেছি। শুধু সাংঘাতিক হলেও কথা ছিল, এরা বুঝি বাস্তব পৃথিবীর কেউ নয়—রূপকথার এক ভূতুড়ে এলাকার বাসিন্দা। হয়তো মানুষ দেখলেই এদের জিব লকলক করে ওঠে।…

কয়েক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলুম। না, ভয়ে পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার পাত্র আমি নই। আমার কোমরে রীতিমতো একটা অটোমেটিক রিভলভার আছে। কিম্ভুত প্রাণীগুলো যদি আমার ওপর হামলা করে, যা থাকে বরাতে, গুলি আমি ছুঁড়বই। তাতে এদের গায়ে গুলি বিধবে কিংবা এরা ভড়কে যাবে কি না সেটা কোনও কথা নয়, কথা হল যে অন্তর আমার সাহস বাড়বে গুলির শব্দে।

হু ভয়ের সময় শব্দ একটা শক্তিশালী ব্যাপার। রাতবিরেতে একা কোথাও ভয় পেলে নিজের কাশির শব্দ কিংবা চেঁচিয়ে কথা বলা, অথবা গান করা মোক্ষম কাজ দেয়। সাহস ফিরে আসে। তাই না?

মেজর হরগোবিন্দ সিংহ আমাদের দুজনের কাছে সায় চেয়ে একটু হাসলেন। আমি সায় দিয়ে বললুম, ঠিকই বলেছেন। তা আপনি কি সত্যি সত্যি রিভলভার করে গুলি ছুড়লেন?

মেজর বললেন, আপনার মাথা খারাপ? ব্যাপারটা আসলে যাকে বলে হ্যালুসিনেশন—মনের ভুল থেকেই চোখের ভুল আর কানের ভুল। তিব্বতের বৌদ্ধ গুম্ফাগুলোর নতুন লোককে এভাবে ভড়কে দেয়। ওসব গুম্ফা মহাযানী সম্প্রদায়ের বৌদ্ধদের প্রার্থনাঘর। মহাযানীরা তন্ত্রমন্ত্র, গুপ্তাবিদ্যা বা অকাল্টের চর্চা করে। এসবের সাহায্যে নাকি তার অলৌকিক শক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। কর্নেল সরকার, আপনি নিশ্চয় মাদাম ব্লাভাস্কির কাণ্ডকারখানা জানেন?

আমার ফ্রেন্ড ফিলসফার অ্যান্ড গাইড স্বনামধন্য বুড়ো ঘুঘুমশাই চোখ বুজে ইজিচেয়ারে আরামে বসে চুরুট টানছেন। গলার ভেতর শুধু একটা অস্পষ্ট শব্দ করলেন।

মেজর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মাদাম ব্লাভাস্কি উনিশ শতকে সারা পৃথিবীতে হুলস্থূল কাণ্ড বাধিয়েছিলেন। মাদ্রাজের কাছে তিনি প্রেত-চর্চার একটা আখড়াও বানিয়েছিলেন। মাদাম বলতেন, তিব্বতের রহস্যময় সাধুরা তার গুরু। এক গুরুর নাম ছিল কুট হুর্মি। অদ্ভুত নাম। এই গুরু দিব্যশরীরে চোখের পলকে তার কাছে নাকি হাজির হতেন। কখনও মাদামের প্রেত-চর্চার আসরে শূন্য থেকে ছিটকে পড়ত গুরুদেবের চিঠি। এসব চিঠিকে উনি বলতেন মাস্টার লেটারস। তবে ভারতে স্বাধীনতাবোধক, স্বদেশপ্রীতি এবং আত্মমর্যাদার জ্ঞান সঞ্চার মাদামের প্রেরণা অনেক। সেজন্যেই তিনি ভারতে ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয়া। এই রুশ মহিলার কাছে সত্যি আমরা ঋণী।

এবার ঘুঘুমশায় শ্রীযুক্ত কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের কথা শোনা গেল। চোখ বন্ধ। ঠোঁটের ফাঁকে চুরুট। সাদা দাড়ি চুলকে বললেন, হুম! মাদাম ব্লাভাস্কি রাশিয়া থেকে ভাগ্যের খোঁজে মার্কিনমুলুকে পাড়ি জামান। যখন নিউইয়র্কে গুছিয়ে বসেন, তখন বয়স ছিল বিয়াল্লিশ। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই সেপ্টেম্বর তার বাড়িতে এক ভদ্রলোক মিশরের মমিভূত হাজির করেন। তখনই থিওজফিক্যাল সোসাইটি নামে সর্বপ্রথম একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। সেই সন্ধ্যাতেই। তবে যাই রটুক, মাদাম কদাচ তিব্বতে যাননি।

মেজর বললেন, বলেন কী! আপনি তাহলে এসব মানেন?

কী সব?

অলৌকিক শক্তি—ভূতপ্রেত?

মানি বৈকি।

এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। জানি সর্ববিষয়ে, প্রাজ্ঞ এবং সবকিছুতে নাক গলানো এই ধুরন্ধর গোয়েন্দা ভদ্রলোকের জুড়ি নেই কোথাও। কিন্তু উনি নিজেও ভূত-প্রেত-ট্রেত বিশ্বাস করেন, জানা ছিল না তো! বললুম, কর্নেল নিশ্চয় রসিকতা করছেন?

আমার বৃদ্ধ বন্ধু গম্ভীর মুখে বললেন, ডার্লিং। তুমি নিশ্চয় শেক্সপিয়র পড়েছ। শেক্সপিয়রের মোদ্দা কথাটা হচ্ছে এই : এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন অনেক ব্যাপার আছে যাতে মানুষের অক্কেল গুড়ুম। হয়ে যাবে। জয়ন্ত, রবি ঠাকুরও বলেছেন, বিপুলা এ পৃথিবীতে কথটুকু জানি।

মেজরসায়েব হতাশ ও বিরক্ত হয়ে বাঁকা মুখে বললেন, আপনাকে আমি যুক্তিবাদী মানুষ ভেবেছিলুম। বোঝা যাচ্ছে মাদাম ব্লাভাস্কির কাণ্ডকারখানা আপনি সত্যি বলে মানেন। অথচ দেখুন, লন্ডনের আত্মা-সংক্রান্ত গবেষণা সমিতির পক্ষ থেকে মাদামের ক্রিয়াকলাপের তদন্ত করে বলা রয়েছিল সব জোচ্চুরি। ইতিহাসে এই মহিলার মতো ধূর্ত ঠগ আর দেখা যায়নি।

কর্নেল মৃদুহাস্যে বললেন, হুম। লন্ডনের এই সমিতির সদস্য ছিলেন ববি টেনিসন, উইলিয়াম জেমস প্রমুখ প্রখ্যাত ব্যক্তি। আর ওঁদের পক্ষ থেকে যিনি তদন্ত করেন, তাঁর নাম রিচার্ড হজসন। মাদ্রাজের কাছে বঙ্গোপসাগরের তীরে আডিয়ারে মাদারের আখড়ায় তিনি এসেছিলেন। এটা ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের কথা।

মেজর হরগোবিন্দ বললেন, এত জেনেও আপনি অকাল্টে বিশ্বাস করেন? আশ্চর্য!

তারপর যেন ক্রুদ্ধ হয়েই উঠে দাঁড়ালেন। টুপিটি মাথায় চাপিয়ে এবং ছড়িটি তুলে নিয়ে ভদ্রতাসূচক বিদায় সম্ভাষণ না করেই ঘর থেকে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।

কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! দরজাটা বন্ধ করে এস। শুয়ে পড়া যাক।

আদেশ পালন করে এসে বললুম, নোকটা ভারি অভদ্র তো!

হুঁম। সেজন্যে হরগোবিন্দের বদলে ওঁকে বলা যায় মেজর গোঁয়ারগোবিন্দ। বলে কর্নেল হাসতে হাসতে বিছানার দিকে পা বাড়ালেন।

বাথরুম থেকে ফিরে পোশাক বদলানোর সময় লক্ষ্য করলুম, কর্নেল নাক ডাকছেন।

গ্যাংটক থেকে প্রয় একশো মাইল দূরে তিব্বত-সীমান্তে হিমালয়ের বুকে এই বাংলোটা সড়ক দফতরের। পেছনে খাড়া পাহাড় নেমে গেছে লাচেন চু নদীতে। তার ওপারে ঢালু হয়ে উঠে গেছে আরও পাহাড়। চিরতুষারের এলাকা ওদিকে।

বিকেলে নদীর ওপারের পাহাড়ে একটা গুম্ফা দেখছিলুম। সেই নিয়ে কথা শুরু। মেজর হরগোবিন্দ আমাদের সঙ্গী নন। তিনি আগেই এসেছেন। যেচে পড়ে আলাপ করেছেন। কর্নেল এবং উনি দুজনেই সমরবিভাগের লোক। দুজনেই রিটায়ার করেছেন। অতএব দুজনের মধ্যে ভাব হতে দেরি হয়নি।

কিন্তু যেভাবে চটমটে চলে গেলেন, আমার বিশ্বাস, কাল সকাল থেকে উনি আর কর্নেলের মুখদর্শনও করবেন না। কাল সকালে তিনজনে মিলে নদী পেরিয়ে ওই গুম্ফা দেখতে যাওয়ার কথা। মনে হচ্ছে, মেজর যদি যান, অন্যসময় একা একা যাবেন।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। তারপর দেখি, এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। একটা রাক্ষুসে চেহারার প্রাণী, কতকটা মানুষের মতো দেখতে, হাঁ করে আমার দিকে তেড়ে আসছে। ভয় পেয়ে চেঁচাবার চেষ্টা করলুম। গলা থেকে আওয়াজ বেরোল না। প্রাণীটা অদ্ভুত গর্জন করতে লাগল। কোথাও ঘণ্টা বেজে উঠল।…

তারপর ঘুম ভেঙে গেল। বুঝলুম, দুঃস্বপ্ন নিছক। কিন্তু বাইরে কিছু ঘটছে। একটা হুলস্থুল কাণ্ড বেধে গেছে যেন। হুঁ, ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য। সত্যি সত্যি কোথায় একটা ঘণ্টা বেজে চলেছে ঢং ঢং করে। ঘণ্টার শব্দটা বাড়ছে এবং কমছে। কখনও মনে হচ্ছে, বাইরে নয়, আমার মাথার ভেতরই বাজছে ঘণ্টাটা।

অতিষ্ঠ হয়ে ডাকলুম, কর্নেল! কর্নেল!

কর্নেলের সাড়া এল ওপাশের বিছানা থেকে। ….কী জয়ন্ত? ভয় পেলে নাকি?

ভয় পাওয়ার কী আছে? ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে শুনছেন না?

হুঁম, শুনছি।

ঘন্টা বাজছে কোথায় বলুন তো?

নদীর ওপারে সেই গুম্ফায়।

কিন্তু ওখানে তো শুনেছি কেউ থাকে না।

ঠিকই শুনেছ, ডার্লিং।

তাহলে ওখানে এ দুর্যোগে ঘণ্টা বাজাচ্ছে কে? কেনই বা বাজাচ্ছে?

জয়ন্ত, তখন বলছিলুম, পৃথিবীতে এখনও অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে এবং আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়।

বিরক্ত হয়ে বললুম, তাহলে ভূতে ঘণ্টা বাজাচ্ছে বলতে চান?

কর্নেল যেন আপন মনে বললেন, ঝড়বৃষ্টি দুর্যোগের রাতেই ওরা জেগে ওঠে। যত অশরীরী অতৃপ্ত আত্মারা এই গুম্ফায় গিয়ে প্রার্থনা করে। ওরা মুক্তি চায়। নিছক মুক্তি নয়, বৌদ্ধধর্ম যাকে বলে মহাপরিনির্বাণ। তারপর তার জন্ম নেই, জরা ব্যাধি নেই, মৃত্যু নেই। আহা! সে কী খাস

অবস্থা।

তারপর আচমকা ওঁর নাকডাকা শুরু হল ফের। আমার আর ঘুম হল না। ঝড়ের দাপটে বাংলোটা কেঁপে উঠছিল। ভয় হচ্ছিল, উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে হাজার ফুট গভীর নদীতে ফেলে দেবে।

আর সেই অদ্ভুত ঘণ্টার শব্দ একটানা শোনা যাচ্ছিল। কখনও মৃদু কখনও তীব্র। এমন অস্বস্তিকর রাত জীবনে আসেনি।

মেজরের অন্তর্ধান রহস্য

সকালে ঘুম ভেঙে দেখি, গোয়েন্দাপ্রবর যথারীতি প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন। বাইরে আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার। বিশ্বাস হয় না, রাতে অমন ঝড়জল হয়েছে। তবে গাছপালা ঝোপঝাড়ের রং খুলে গেছে। একটু পরেই কর্নেল ফিরলেন। বললেন, দুঃসংবাদ ডার্লিং! লাচেন চু নদীতে রাতারাতি জল বেড়ে গেছে। জল না কমলে ওপারের গুম্ফা দেখতে পাওয়া যাবে না। তবে তার চেয়েও দুঃসংবাদ, আমাদের মেজরসায়েবের পাত্তা নেই। চৌকিদার যা বলল, তা ভারি অদ্ভুত। বেড-টি দিতে গিয়ে দেখে, ওঁর ঘরের দরজা খোলা। বিছানা লণ্ডভণ্ড। মেঝেয় একপাটি আর দরজার কাছে একপাটি স্লিপার পড়ে আছে। কেউ বা কারা তাকে জবরদস্তি ধরে নিয়ে গেছে।

সে কী! বলে হন্তদন্ত হয়ে পা বাড়ালুম।

কর্নেল আমার হতে ধরে বাধা দিয়ে বললেন, ঝুটঝামেলায় গিয়ে লাভ কী জয়ন্ত? চৌকিদার থানায় গেছে। পুলিশে এসে ও নিয়ে মাথা ঘামাক। বরং চলো, বাজারের দিকে গিয়ে কোথাও ব্রেকফাস্ট করা যাক। খিদে পেয়েছে।

পুলিশ তো আমাদেরও জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করবে!

যখন করবে, যা জানি বলব। এখন চলো, খালি পেটে কেবল ভাবনা বাড়ে।

পা বাড়িয়ে বললুম, কিন্তু আমরা তো কিছু জানি নে এ ব্যাপারে।

কর্নেল দরজায় তালা এঁটে বললেন, নদীর ধারে এক জায়গায় দেখলুম পাথরের গা বেয়ে অজস্র অর্কিড গজিয়েছে। এসব অর্কিডের এখন ফুল ফোটে। অবিশ্বাস্য সে দৃশ্য ডার্লিং! ফলের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি উড়ছে। নীল পাখনায় কালো ফুটকিওলা একজাতের প্রজাপতি দেখলুম। আমার সংগ্রহে এ প্রজাপতি নেই। আঁতকে উঠে বললুম, সর্বনাশ! আমি আপনার পেছন পেছন ছুটোছুটি করে বেড়াতে পারব না বলে দিচ্ছি।

মেজরের ঘরটা বাংলোর পেছন দিকে। গেট থেকে দেখা যায় না। খুব কৌতূহল ছিল। কিন্তু কর্নেল যেন তা টের পেয়েই আমার কাধ ধরে একরকম ঠেলে নিয়ে চললেন। ঘোরালো পথ ধীরে ধীরে নেমেছে উপত্যকার সমতলে। পিচের রাস্তায় কিছুটা হেঁটে বাজারে পৌঁছলুম। ছোট বাজার ভিড়ভাট্টা নেই। একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে খেয়ে নিলুম আমরা। তারপর ডাইনে একটা সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ পেরিয়ে যেখানে পৌঁছলুম, সেখানে অজস্র পাথর এলোমেলো পড়ে আছে। যেন কোনও ঐতিহাসিক প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ।

পাথরগুলোর ভেতর দিয়ে সঙ্কীর্ণ পায়েচলা পথ। নদীর ধারে পৌঁছে কর্নেল এদিক ওদিক দেখে নিয়ে হঠাৎ চাপাগলায় বললেন, বসে পড়ো, বসে পড়ো!

একটা পাথরের আড়ালে আমাকে টেনে বসিয়ে দিয়ে উনি গলায় ঝুলন্ত বাইনোকুলারটা চোখে রেখে নদীর ওপারে কিছু দেখতে থাকলেন। জিজ্ঞেস করলুম, ব্যাপারটা কী?

কর্নেল মুচকি হেসে বাইনোকুলারটা আমাকে দিলেন। চোখে রেখে যা দেখলুম, তাতে আমি হতভম্ব। নদীর ওপারে পাহাড়ের গায়ে একটা চওড়া চাতালে দাঁড়িয়ে আছে দুটো লোক। তাদের একজন স্বয়ং মেজর হরগোবিন্দ। মুখের চেহারা অস্পষ্ট বলে দ্বিতীয় লোকটিকে চিনতে পারলুম না। দুজনে কী যেন পরামর্শ চলেছে।

কর্নেল বললেন, মেজরসায়েব কার সঙ্গে কথা বলছেন, চিনতে পারছ তো জয়ন্ত?

বললুম, না তো। কে ও? একে কি কোথাও দেখেছি?

দেখেছ ডার্লিং! আশাকরি, গ্যাংটকের সেই ম্যাজিশিয়ানটিকে তোমার মনে আছে। আশ্চর্য কিছু ম্যাজিক দেখেছিলুম। চারধারে লোকের চোখের পাহারা। তার মধ্যে সেই জাদুকর তাক লাগানো খেলা দেখাচ্ছিল। খেলা ভাঙলে কর্নেল তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। বুড়ো মাঝে মাঝে যেন কেমন শিশু হয়ে ওঠেন। ম্যাজিক দেখে সে কী খুশি! ম্যাজিশিয়ানকে দশ টাকা বখশিস পর্যন্ত দিয়ে বসলেন।

লোকটা এখন মেজর হরগোবিন্দ সিংয়ের সঙ্গে কথা বলছে নদীর ওপারে এক দুর্গম জায়গায়। আর মেজর ভদ্রলোক নাকি নিখোঁজ হয়েছেন। ঘরের বিছানা লণ্ডভণ্ড। পায়ের চটি ছিটকে পড়েছে। কারা জবরদস্তি ধরে নিয়ে গেছে।

মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যায় না। গুম হয়ে আছি দেখে কর্নেল বললেন, কিছু বুঝলে জয়ন্ত?

একটুও না। আপনি বুঝেছেন কি?

নাঃ, অতএব ব্যাপারটা বোঝা দরকার। চলো জয়ন্ত, ওপারে যাই।

যাবেন কীভাবে? নদীতে এখন বান যে।

কর্নেল বললেন, মাইলটাক উজানে একটা দড়ির সাঁকো আছে এস। কিন্তু সাবধান! পাথরের আড়ালে আড়ালে আমাদের যেতে হবে।

যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম, খালি চোখেও দেখা যাচ্ছে ওপাশের পাহাড়ের চাতালে দুটি ছোট্ট আবছা মূর্তি।

গুম্ফায় ‘মারে’র আবির্ভাব

আমার বৃদ্ধ বন্ধুটির শারীরিক দক্ষতা দেখলে তাক লেগে যাবে। ভাগ্যিস ছাত্রজীবনে মাউন্টেনিয়ারিংয়ের ভাল ট্রেনিং নিয়েছিলুম এবং বার দুই পর্বত অভিযানে দৈনিক সত্যসেবকের পক্ষ থেকে সাংবাদিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলুম। প্রাণান্তকর রজ্জুসেতু পেরিয়ে বিস্তর পাহাড়ি গোলক-ধাঁধায় ঘুরে ঘুরে যখন চাতালের কাছে পৌঁছলুম, তখন অবস্থা শোচনীয়।

মেজর এবং ম্যাজিশিয়ান আমাদের অপেক্ষায় বসে থাকার পাত্র নন। বেমালুম নিপাত্তা হয়ে গেছেন ততক্ষণে। হবেন, এ তো জানা কথা। কর্নেলও কম গোঁয়ার নন দেখা যাচ্ছে।

আমার মনের কথা আঁচ করে গোয়েন্দবর বললেন, ডার্লিং! এ বৃদ্ধের প্রতি রুষ্ট হয়ো না। আমরা খুব পবিত্র জায়গায় এসে পৌঁছেছি। হেরোর বৎস, ওই সেই রহস্যময় গুম্ফা—যেখানে ঝড়ের রাতে ঘণ্টা বাজে।

ঘুরে দেখি, আরে তাই তো! ডাইনে একফালি রাস্তার মাথায় গুম্ফা দেখা যাচ্ছে। আমরা উত্তর ঘুরে পূর্বে এসেছি। ওপারে পশ্চিমে আমাদের বাংলোটাও দেখা যাচ্ছে।

কর্নেল চাতাল মতো জায়গাটায় চোখ বুলিয়ে বললেন, চলো। আমরা গুম্ফার দিকে যাই। এবেলা আমরা গুম্ফার লামা মহোদয়ের আতিথ্য নেব। ভেবো না, ওঁরা খুব অতিথিবৎসল।

এদিকটায় গাছপালা নেই বললেই হয়। কিছু ঝোপঝাড় আছে। গুম্ফার সামনে প্রকাণ্ড একটা রঙিন প্রার্থনাচক্র। মন্ত্র খোদাই করা আছে। দেখে মনে হল, হাজার বছরের পুরনো। কাঠের বারান্দায় উঠতেই এক প্রৌঢ় লামা হাসিমুখে হিন্দিতে বললেন, আইয়ে! আইয়ে! কাহাসে আতে হ্যায় আপনোক?

আলাপ-পরিচয়ের পর ভেতরে নিয়ে গেলেন। চৌকো প্রশস্ত ঘর। সামনে বেদির ওপর বিশাল বুদ্ধমূর্তি। কিন্তু দুধারে দেয়াল-ঘেঁষে দাঁড় করানো মূর্তিগুলো দেখে চমকে উঠলুম। মেজরসায়েব ঠিক এমনি বর্ণনা দিয়েছিলেন মনে পড়ল। বিকট সব মূর্তি সারবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ছাদের ওপর দিক থেকে সূর্যের আলো এসে পড়েছে ঘরে। নইলে অন্ধকার জমে থাকত।

পাশের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন লামা। আমরা মেঝেয় বসলুম। উনি কাঠের আসনে বসে বললেন, আমি সকালে আসি। সন্ধ্যার আগে চলে যাই। ওপর দিকে নতুন গুম্ফায় আমরা অনেকে মিলে থাকি। এই গুম্ফাটা দেখাশোনার দায়িত্ব আমার ওপর। তাই রোজ আসতে হয়।

কর্নেল বললেন, শুনেছি, এ গুম্ফায় রাতে থাকলে বিপদ ঘটে। তা কি সত্যি?

লামা একটু হেসে, বললেন, এমনকী দিনেও মার কখনও কখনও দেখা দেয় এ গুম্ফায়। খুব সাহসী না হলে এখানে দিনেও থাকা কঠিন। এই তো, আজ সকালে যখন দরজা খুলে ঢুকলুম, স্পষ্ট দেখলুম মার দাঁড়িয়ে আছে। বিকট তার মূর্তি। জোরে মন্ত্র পড়তে শুরু করলুম, তখন অদৃশ্য হয়ে গেল। আসলে গুম্ফার ছাদের মাথায় ওই যে দেখলাম সূর্যের আলো ঢোকার ব্যবস্থা, ওটাই মার কে দিনে দুর্বল করে রাখে। মার অন্ধকারের শক্তি কিনা! যাকগে, আপনারা ক্ষুধার্ত। আপনাদের সেবার অনুমতি দিন।

লামা একটা বেতের ঝুড়ি থেকে চাপাটি, দুধ আর ফল বের করলেন। ক্ষিদে পেয়েছিল প্রচণ্ড। গোগ্রাসে খেলুম। কোনার দিকে ফায়ারপ্লেসও রয়েছে। সেখানে আগুনের কুণ্ড জ্বেলে চা তৈরি করলেন লামা। চা খেয়ে ক্লান্তিটা চলে গেল। কর্নেল বললেন, আমরা প্রার্থনাঘরটা এবার দেখতে চাই।

লামা বললেন, নিশ্চয়। চলুন। আমি এখন ওঘরে প্রর্থনায় বসব।

প্রার্থনাঘরে ঢুকেই লামা হঠাৎ চমকে উঠলেন। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় মন্ত্র পড়তে থাকলেন। কর্নেল আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, দেখতে পাচ্ছ জয়ন্ত?

সূর্য নিশ্চয়ই পশ্চিমে একটু ঢলেছে। ছাদের সেই জায়গাটা দিয়ে রোদ সোজাসুজি ঢুকছে না। তার ফলে ঘরের ভেতরটা এখন অস্পষ্ট। আবছায়ার মতো কী একটা দাঁড়িয়ে আছে বেদির তলার দিকে। অবিকল মানুষের মতো একটা কালো মূর্তি। দেখামাত্র আমার হৃদপিণ্ডে রক্ত চলকে উঠল। যা দেখছি তা কি সত্যি? কারণ মূর্তিটা আসলে মেঝে থেকে দুফুট উঁচুতে শূন্যে ভাসছে এবং দুলছে।

তারপরই বাইরে একটা শনশন শব্দ উঠল প্রার্থনাঘরের দরজাগুলো মচমচ করে উঠল এবং বাইরে থেকে ঝড়ো হাওয়া এসে ঢুকল ঘরে। ছাদের ঘুলঘুলিতে যেটুকু আলো আসছিল, হঠাৎ তাও বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকার ঘরটা ভরে গেল। তারপর কড় কড় কড়াৎ করে বাজ পড়ল কোথায়। মেঘ ডাকতে থাকল। দরজা দিয়ে বিদ্যুতের ঝিলিক ঢুকল ঘরে মুহুর্মুহু। তাই দেখলুম, শূন্যে দাঁড়ানো মূর্তিটা ভীষণ দুলছে। তারপর শুরু হয়ে গেল বুক হিম করা সেই ঘন্টাধ্বনি-কাল রাতের মতো। ঢং ঢং ঢং ঢং….কখনও তীব্র, কখনও মৃদু। তার তালে তালে রহস্যময় ছায়ামূর্তি দুলতে থাকল।

লামার চিৎকার শুনলুম, পালিয়ে আসুন!

কর্নেল আমার কাঁধ আঁকড়ে বলে উঠলেন, নোড়ো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।

লামাকে ছিটকে বড় দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখলুম। সেই সঙ্গে চোখে পড়ল, বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি চলেছে। কাঠের তৈরি প্রাচীন গুম্ফা মচমচ করে কাঁপছে। এ বেদির ওখানে মারকে আর দেখতে পেলুম না। সে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এদিকে ঘনঘন বাজ হাঁকড়াচ্ছে। কানে তালা ধরে যাচ্ছে মেঘের গর্জনে। বিদ্যুতের তীব্র ছটা এসে ঢুকছে ঘরের ভেতরে। ভয়ে চোখ বুজে ফেলছি। বিকট মূর্তিগুলো যেন এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।

কতক্ষণ মারের সেই উপদ্রব চলল বলা কঠিন। যখন সব শান্ত হল, তখন কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, এস জয়ন্ত! লামার ঘরে একটা হ্যারিকেন দেখেছি। সেটা জ্বেলে নিয়ে আসি।

হ্যারিকেনটা জ্বেলে দুজনে প্রার্থনাঘরে ফিরে এলুম। বিকট মূর্তিগুলোকে সেই আলোয় বড় ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। কর্নেল কী করতে চান, বুঝতে পারছিলুম না। বুদ্ধমূর্তির কাছে গিয়ে উনি হঠাৎ অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন, সর্বনাশ! মার বেচারা এখানে পড়ে আছে দেখছি! বেদির নিচে বাঁদিকে একটা মূর্তির পায়ের কাছে উপুড় হয়ে কেউ পড়ে আছে। কর্নেল গুম হয়ে বললেন, বেচারা মারা পড়েছেন জয়ন্ত।

তাহলে যাকে দেখে মার ভেবে লামা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলেন এবং আমারও হৃৎকম্প হচ্ছিল, তিনি আসলে মেজরসাহেব! কিন্তু আশ্চর্য, ওঁকে শূন্যে দাঁড়ানো দেখছিলুম কেন?

কর্নেল হ্যারিকেন তুলে ছাদের দিকটা দেখছিলেন। বললেন, হুম। এই দেখ জয়ন্ত। কড়িকাঠের আঁটা আংটা থেকে একটা ছেড়া দড়ি ঝুলছে। আমরা যখন ওপাশের ঘরে লামার কাছে ছিলুম, তখনই ওঁকে কেউ বা কারা খুন করে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছিল এখানে। দড়িটা ছিঁড়ে মেজরসায়েবের মড়া পড়ে গেছে। আমরা যাতে ভয় পেয়ে গুম্ফা থেকে পালিয়ে যাই, তার জন্যে এই কাণ্ড করা হয়েছিল।

কর্নেল বিশাল বেদির ওপর উঠে গেলেন। তারপর উত্তেজিতভাবে ডাকলেন, দেখে যাও জয়ন্ত।

গিয়ে দেখি, বুদ্ধমূর্তির পিঠের দিকটা ভাঙা এবং মুক্মি খোলের মধ্যে কতকালের পুরনো একগাদা পুঁথি তছনছ অবস্থায় রয়েছে। কেউ বা কারা মরিয়া হয়ে কিছু হাতড়েছে। গুপ্তধন ছিল নাকি?

বললুম, কর্নেল, মেজরকে খুন করে সেই ম্যাজিশিয়ান ব্যাটা গুপ্তধন হাতিয়ে পালিয়েছে। তাছাড়া আর কোনও ব্যাখ্যা হয় না। আমার মনে হচ্ছে…..

বুটের শব্দ তুলে একদল পুলিশ ঢুকছিল গুম্ফায়। কর্নেল ভারী গলায় বললেন, আমাদের দুর্ভাগ্য মিস্টার শর্মা! যা ঘটবার ঘটে গেছে।

শেষ চমক

পরদিন সকালে বাংলোর বারান্দায় বসে কর্নেলের কাছে রহস্যকথা শুনছি, পুলিশ অফিসার মিঃ প্রভুদয়াল শর্মা এলেন। বললেন, এইমাত্র মর্গ থেকে আসছি। আশ্চর্য ব্যাপার কর্নেল, ডেডবডির মুখে…..

কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, নকল দাড়ি। অর্থাৎ মরাটা মেজরের নয়। ম্যাজিশিয়ান তেতিরামের।

মিঃ শৰ্মা আবাক হয়ে বললেন, জানতেন নাকি? তখন তো বলেননি!

বললে পুশিমহলে রটত। হরগোবিন্দ সাবধান হয়ে যেত। তাকে ধরতে পারতেন না সহজে। বলে কর্নেল চুরুট ধরাতে মন দিলেন।

শর্মা বললেন, হরগোবিন্দ ধরা পড়েছে গ্যাংটকে। সে মোটেই মিলিটারির লোক নয়। খুব পুরনো দাগি। ততিরামের কাছে তিব্বতী গুপ্তবিদ্যার পুঁথি ছিল একটা। তাতে এই গুম্ফার বুদ্ধমূর্তির ভেতরে একটি পদ্মরাগ মণির হদিশ ছিল। তোতিরামের এক সাহস হয়নি। তাই হরগোবিন্দের সাহায্যে নিয়েছিল। তবে হরগোবিন্দ চালটা চেলেছিল ভাল। তাকে কেউ ধরে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে, এই ব্যাপারটা তাকে আত্মগোপনের সময় দিত অনেকখানি। ভাগ্যিস, আপনি টের পেয়েছিলেন!

কর্নেল বলেন, পরশু রাতে ঝড়ের আগে বাইরে পায়ের শব্দ শুনে উঁকি মেরে দেখি, মেজরসায়েব এবং তোতিরাম বাংলা থেকে নেমে যাচ্ছে। বারান্দার আলো পড়েছিল লনে। তা হলে কিছু টের পেতুম না।

বললুম, কিন্তু ঝড়ের সময় ঘণ্টা কোথায় বাজে?

কর্নেল বললে, গুম্ফার ভেতর ছাদে ঝুলন্ত ঘন্টাটা ঝড়ের ধাক্কায় দোলে।…

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments