Thursday, April 25, 2024
Homeথ্রিলার গল্পব্ল্যাক প্যান্থার রহস্য - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ব্ল্যাক প্যান্থার রহস্য – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

রায়বাড়ির প্রতিমা রহস্য - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সেবার অক্টোবরে ধরমতাল হ্রদ দেখে লোহাগড় ফেরার পথে বিকেল হয়ে গেল।

ওটা আসলে প্রাগৈতিহাসিক যুগে মৃত একটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। হাজার-হাজার বছর ধরে বর্ষার জল জমে বিশাল হ্রদ হয়েছে। মধ্যিখানে ক্ষুদে দ্বীপের মতো কয়েকটা জঙ্গুলে জলটুঙি।

আমার বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ বন্ধু বাইনোকুলারে কোনও জলটুঙির শীর্ষে কবে নাকি সেক্রেটারি বার্ড আবিষ্কার করে গিয়েছিলেন। এবারকার অভিযান তার ছবি তুলতে। দুঃখের বিষয়, সেবার তার ক্যামেরায় টেলিলেন্স ছিল না। এবার তাই টেলিলেন্স এনেছিলেন।

সেক্রেটারি বার্ডকে বাংলায় কেরানি পাখি বলা হয়। কারণ সারসজাতীয় এই পাখিকে দেখলে মনে হয় কানে কলম গোঁজা আছে। কিন্তু ধুরন্ধর প্রকৃতিবিদের চেয়ে পাখিটা আরও ধুরন্ধর। কয়েক ঘন্টা ছুটোছুটি, বাইনোকুলারে খোঁজাখুঁজি এবং ক্যামেরার টেলিলেন্স তাক করা ব্যর্থ হল। কতবার টুপি খসে গিয়ে ওঁর টাক চকমক করল। সাদা সান্তাক্লজ দাড়িতে মাকড়সা জালসমেত আটকে গেল। অবশেষে লোহাগড় খনিজ সম্পদ দফতরের পাবলিক রিলেশন অফিসার (পি আর ও) ইকবাল আমেদ তাড়া দিলেন, কর্নেল, এবার ফেরা যাক। এলাকার পরিস্থিতি ভাল নয়। কয়েকটা জঙ্গি গেরিলা গ্রুপ মাথাচাড়া দিয়েছে। হাইওয়েতে প্রায়ই হামলা চালায় ওরা। আমার আগের পি. আর, ও—

তাঁকে থামিয়ে কর্নেল তুম্বোমুখে বললেন, শুনেছি। তবে আলো কমে আসছে। চলো, ফেরা যাক।

আমাদের জিপে প্রায় তিন কিলোমিটার সঙ্কীর্ণ বিচ্ছিরিরকমের উতরাই পথ দিয়ে নেমে হাইওয়েতে পৌঁছলাম। সেই সময় হঠাৎ কর্নেল বললেন, আমেদ, চা খাব।

আমেদ জিপ থামিয়ে বললেন, এখানে চা খাবেন কী! পাবেন কোথায়?

প্রকৃতিবিদ জিপ থেকে নেমে অমায়িক হাসলেন। পাহাড়ি রাস্তার ধারে নিরিবিলি চায়ের আড্ডায় একটু বসলে ক্লান্তি দূর হয়। চলে এসো!

পাশেই শালপাতার ছাউনি-দেওয়া একটা চায়ের দোকান চোখে পড়ল। চাওয়ালার চেহারা আদিবাসীর। একা বসে ঝিমোচ্ছিল সে। আমাদের দেখে ব্যস্তভাবে উনুনে লকড়ি গুঁজে দিল। গাছের ডাল দিয়ে তৈরি বেঞ্চে আমরা বসলাম। উদ্বিগ্ন আর বিরক্ত মুখে তরুণ পি. আর, ও ঘনঘন ঘড়ি দেখছিলেন। কর্নেল চাওয়ালার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। ওঁর গল্প মানে পাখি, প্রজাপতি, অর্কিডের খোঁজখবর। তবে চাওয়ালা হাইওয়ের ওধারে পাহাড় দেখিয়ে শুধু একটা শম্বর হরিণের খবর দিচ্ছিল, যার শিং নাকি গোনা যায় না।

হাইওয়েতে দিনশেষে যানবাহনের আনাগোনা এখন সত্যিই কম। আমরা চা খেতে-খেতে একটা সবুজ অ্যাম্বাসাডার বাঁক ঘুরে এসে গতি কমাল। তারপর চায়ের দোকানের সামনে থেমে গেল। পেছনের সিটে দুজন প্রৌঢ় ছিলেন। একজন মুখ বাড়িয়ে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন, বরমদেও থান আর কতদূর?

চাওয়ালা ভাঙা হিন্দিতে বলে দিল, সামনে ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে ডাইনে জঙ্গলের ভেতর বটের ডগায় লাল কাপড় উড়ছে দেখবেন।

গাড়িটা চলে গেল। আমেদ বাঁকা মুখে হাসলেন। বাইরের লোক। নইলে ঝুঁকি নিত না।

কর্নেল বললেন, বাঙালি। বাঙালির হিন্দিটা সহজে রপ্ত হয় না। তা ছাড়া বাঙালি সম্ভবত বাতিকগ্রস্ত জাত। আমাকে একটা সেরা নমুনা বলতে পারো। কাজেই অবেলায় বরমদেও নামে কোনও দেবতার থান দর্শনে যাত্রা বাঙালির পক্ষেই স্বাভাবিক। কিন্তু খটকা খটকা লাগছে। বলে উনি বাইনোকুলারে গাড়িটা দেখতে থাকলেন।

আমেদ বললেন, কিসের খটকা?

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন। অপূর্ব! বলে আমাদের দিকে ঘুরলেন। গাড়ির পেছনে কাচে লেখা আছে আলফা ট্রেডিং কোম্পানি, তারাপুর।

আমেদ বললেন, তারাপুর প্রায় উনিশ-কুড়ি কিলোমিটার আপে। সেখানে অনেক বাঙালি আছে। কিন্তু খটকাটা কিসের?

ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঙালি আজকাল পিছিয়ে পড়েছে। সিদ্ধিদাতা গণেশ যেন কোনও কারণে অপ্রসন্ন। বরমদেও কি ঠেকাতে পারবেন?

আমেদ চা শেষ না করেই উঠে দাঁড়ালেন। ঘড়ি দেখে বললেন আমাদের এখনও তিরিশ কিলোমিটার যেতে হবে। পৌনে পাঁচটা বাজে।

তাঁর তাড়ায় উঠে পড়তে হল। জিপ চালানোয় তার দক্ষতা ধরমতাল রোডে দেখছি। নদীর ব্রিজে পৌঁছে দূরে উতরাইয়ের নিচে সেই সবুজ অ্যাম্বাসাডার চোখে পড়ল। দুধারে ঘন জঙ্গল আর বড়-বড় পাথর। আমেদ সম্ভবত জঙ্গি গেরিলাদের আতঙ্কে জিপ ছোটাচ্ছিলেন। সবুজ গাড়িটার কাছে যাওয়ার আগেই কর্নেল বলে উঠলেন, রোখো, রোখখা, জাস্ট আ মিনিট।

আমেদ অগত্যা ব্রেক কষলেন। কর্নেল নেমে গিয়ে বললেন, বরমদেও নিশ্চয় ব্রহ্মদেব। সম্ভবত ব্রহ্মা, ব্রহ্মার মন্দির এ-যাবৎ একটিই আবিষ্কৃত হয়েছে। দ্বিতীয়টি আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমারই হোক—চান্স ছাড়তে চাই না।

উনি হন্তদন্ত ডাইনের জঙ্গলে ঢুকলেন। একফালি পায়ে-চলা পথ দেখা যাচ্ছিল। সবুজ গাড়িটার মুখ এখন উলটো দিকে ঘোরানো। ড্রাইভার হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। নাইট ডিউটির পর ঘুমনোর সময় পায়নি নাকি? জিপের শব্দেও চোখ খুলল না।

আমেদ নামলেন না। আমি নেমে গেলাম। ব্রহ্মামন্দির দর্শনের কৌতুহল জেগেছিল। পায়ে-চলা পথে এগিয়ে গেলাম। দুপাশে বড়-বড় পাথরও পড়ে আছে। সামনে বিশাল বটগাছের তলায় পাথরের বেদির কাছে কর্নেল বাঁ দিকে ঘাসের ওপর ঝুঁকে কিছু দেখছিলেন। এতক্ষণে সোজা হলেন। তারপর ক্যামেরা তাক করলেন। ফ্লাশগান কয়েকবার ঝিলিক দিল। কাছে গিয়ে বললাম, শুধু বেদি দেখছি! মূর্তি নেই?

কর্নেল নির্বিকার মুখে শান্তভাবে বললেন, শিগগির আলফা কোম্পানির ড্রাইভার আর আমেদকে ডাকো।

কেন?

সদ্য একটা মার্ডার হয়েছে। ওই দ্যাখো।

প্রায় ঝাঁপ দিয়ে এগিয়ে দেখি, ধুতি-পাঞ্জাবি-পরা একটা লোক বেদির নিচে বাঁ-পাশে ঘাসের ভেতর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মাথার পেছনে টাটকা রক্ত। রক্ত তখনও গড়িয়ে পিঠে আর ঘাসে পড়ছে। আমার মাথা ঘুরে গেল। কর্নেলের সঙ্গদোষে এ-যাবৎ অনেক খুনখারাপি দেখেছি। তাই হয়তো ভিরমি খেয়ে পড়ে গেলাম না। কর্নেল বললেন, হাঁ করে কী দেখছ? ওদের খবর দাও।

দৌড়ে গিয়ে আমেদকে বললাম, মার্ডার! মার্ডার! কর্নেল ডাকছেন!

আমেদ প্রলাপ বকতে থাকলেন, কর্নেলকে চলে আসতে বলুন, কর্নেলকে ডাকুন! সবুজ গাড়ির ড্রাইভার আমার ডাকাডাকিতে চোখ খুলে প্রথমে বলল, নেহি! কৈ টেরাক পাকাড় লিজিয়ে। তারপর আমার বিদঘুটে হিন্দিতে ঘটনা শুনে সে কী বুঝল জানি না, আস্তেসুস্থে বেরিয়ে গদাইল-করি চালে থানের পথে পা বাড়াল। আমেদ তখনও প্রলাপ বকছেন।

পরে শুনেছিলাম, আগের পিআরও-র মুক্তিপণের টাকা সরকারি লালফিতের ফাঁসে আটকে পড়ার দরুন জঙ্গিরা তাঁর মৃতদেহ ফেরত পাঠিয়েছিল।

তো আমেদকে কিছুতেই ধাতস্থ করা যাচ্ছিল না। তখন আবার থানের দিকে ছুটে গেলাম। আলফা কোম্পানির ড্রাইভার আচমকা আমাকে প্রায় ধাক্কা মেরে গাড়ির দিকে চলে এল। তারপর গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। কর্নেল অকুস্থলের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। উত্তেজিতভাবে বললাম, ড্রাইভারটা পালিয়ে গেল যে!

কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে বললেন, পালায়নি। কুঁয়ারডি থানায় খবর দিতে গেল।

এঁর সঙ্গী ভদ্রলোক কোথায় গেলেন?

বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল বললেন, যাচ্ছেতাই জঙ্গল আর পাথর। জঙ্গিদের দেখতে পাওয়া অসম্ভব।

বুক ধড়াস করে উঠল। জঙ্গি মানে?

আমেদ ঠিকই বলেছিল। বলে কর্নেল পকেট থেকে একটা ভাজকরা কাগজ দিলেন। ডেডবডির পাশেই একটুকরো পাথর চাপিয়ে রাখা ছিল এটা।

কাগজটা খুলে দেখি একটা লেটারহেড। ওপরে ছুটন্ত একটা কালো চিতাবাঘের ছবি। হিংস্র মুখটা এদিকে ঘুরে আছে। তার নিচে ইংরেজিতে ছাপানো ব্ল্যাক প্যান্থার লিবারেশন ফ্রন্ট। তারপর লাল কালিতে যে কথাগুলো ছাপানো, বাংলায় মোটামুটি তা এরকম :

নিপীড়িত মানবতার স্বার্থে একটি ছারপোকা আটক করা হয়েছে। এর মুক্তিপণ তিন লক্ষ টাকা। কাহো প্রপাতের মাথায় যে গুহা আছে, তার মধ্যে টাকা রেখে রেখে এলে এর মুক্তি। পুলিশ নাক গলালে মৃতদেহ ফেরত যাবে। ৪৮ ঘন্টা সময় দেওয়া হল।….

আমার হাত কাঁপছিল। কাগজটা কর্নেলকে ফেরত দিলাম। কর্নেল বললেন, তুমি গিয়ে আমেদের কাছে থাকো। বেচারার নার্ভাস হয়ে পড়া স্বাভাবিক। তুমি থাকলে ও সাহস পাবে। …

কুঁয়ারডি থানায় বসে ওসি. রামলগন সিংহের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তখন রাত প্রায় নটা। কর্নেলকে উনি চেনেন, এতে অবাক হইনি। বললেন, কেন্দ্র সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য নিরাপত্তাবাহিনী পাঠিয়েছে। কোনও ঘটনা ঘটলেই পাহাড়-জঙ্গলে চিরুনি-তল্লাশ চালায়। আমরা সঙ্গে থাকি। কিন্তু এ-পর্যন্ত অবস্থা যা ছিল, তা-ই। নাহ্, ভুল বলছি। ক্রমশ বাড়ছে বলাই উচিত। কিন্তু আমার ধারণা, জঙ্গিদের লক্ষ্য ছিলেন অবনী মুখার্জি। সুভাষ সিংহ বাধা দিতে গিয়েই মারা পড়েছেন। কেন বলছি, শুনুন। সারা জেলায় সুভাষবাবু ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষ করে আদিবাসীদের জন্য উনি অনেক করেছেন। আপনি তারাপুরে গেলে সব জানতে পারবেন। তাই বলছি, জঙ্গিরা বাধ্য হয়ে ওঁকে মেরেছে। চঁচামেচি করেছিলেন কিংবা বাধা দিয়েছিলেন। এও সম্ভব, জঙ্গিদের মধ্যে চেনা মুখ ছিল। আমি তারাপুরে যখন ছিলাম, তখন আইবি-র গোপন রিপোর্টে আভাস ছিল, সুভাষবাবু নাকি জঙ্গিদের ফান্ডে টাকা দেন। কিন্তু শক্ত প্রমাণ ছাড়া ওঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে হইহই শুরু হয়ে যাবে। বিধানসভা থেকে সংসদ পর্যন্ত নড়ে উঠবে। এই দেখুন না, সুভাষবাবুর মৃত্যুর খবর পেয়ে কী ঘটে। আমার তো বুক ঢিপঢিপ করছে।

সিংহ অট্টহাসি হাসলেন। কর্নেল বললেন, ড্রাইভার কিষেনদ কোনও শব্দ বা চঁচামেচি শুনতে পায়নি। অথচ বাতাস বইছিল থানের দিক থেকে।

বলছে নাইট ডিউটি করে আজ দিনে ঘুমনোর সময় পায়নি।

কান্‌হো প্রপাত কোথায়?

এখান থেকে কম করে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, দুর্গম পাহাড়-জঙ্গল এলাকায়। তারাপুর থেকে অবশ্য বিশ-পঁচিশের মধ্যে। রিজার্ভ ফরেস্টের কোর এরিয়ার পড়ে। জন্তু-জানোয়ার আছে। আমি ভাবছি, অবনীবাবুর পক্ষ থেকে ওখানে টাকা পৌঁছে দেবে কী করে?

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, খুব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলেছেন মিঃ সিংহ!

মিঃ সিংহ ঘড়ি দেখে বললেন, ব্ল্যাক প্যান্থার বলেছে, আমরা যেন নাক না গলাই। ঠিক আছে। আগে অবনীবাবুর ফ্যামিলির লোকেরা কী বলে জানা যাক। আমারা রিস্ক নেব না। ওরা যদি টাকা দেয়, বরং ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকেদের মারফত পাঠানো যাবে। অবনীবাবু বহালতবিয়তে ফেরত এলে তখন ওঁর স্টেটমেন্ট নিয়ে তার ভিত্তিতে চিরুনি-তল্লাশে নামব। কর্নেলসায়েব কী বলেন?

মর্গের প্রাথমিক রিপোর্ট কখন আশা করছেন?

তারাপুর এখান থেকে চব্বিশ কিলোমিটার। কাজেই আজ রাত্রে পাওয়ার আশা নেই। তবে আপাতদৃষ্টে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মেরেছে মনে হল। খুলি লম্বালম্বি ফেটে গেছে। আপনিও তো পরীক্ষা করলেন।

কর্নেল কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন, বললেন না। ইকবাল আমেদ ব্যস্তভাবে বললেন, কর্নেল, পৌনে দশটা বাজে।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। মিঃ সিংহ একটু হেসে বললেন, সঙ্গে পুলিশভ্যান এসকর্ট করবে। পিআরও সায়েবের মাথার দাম আমরা বুঝি।

লোহাগড়ে নদীর ধারে খনিজ সম্পদ দফতরের সুদৃশ্য বাংলোয় আমরা উঠেছিলাম। একবাল আমেদ গেটে আমাদের নামিয়ে দিয়ে কোয়ার্টারে চলে গেলেন। পেছনে পুলিশভ্যান।

লনে হাঁটতে হাঁটতে কর্নেল হঠাৎ হেসে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার?

তিনটে পটকা।

তার মানে?

কর্নেল প্যান্টের পকেট থেকে সত্যি তিনটে পটকা বের করে দেখালেন। বরমদেও থানে এই তিনটে টাটকা পটকা ঘাসের মধ্যে খুঁজে পেয়েছি। মশলায় ভেজাল থাকলে বা দৈবাৎ ভিজে গেলে কিংবা ঠিকঠাক আছাড় না মারলে পটকা ফাটে না। তা ছাড়া ঘন ঘাসের ওপরও পটকাবাজি নিষ্ফল।

জঙ্গিরা পটকা ফাটাতে চাইবে কেন? ওদের তো এ-কে-৪৭ রাইফেল থাকে।

হুঁ। কালাশনিকভ! এই নামের এক সামরিক অফিসার এই দুর্ধর্ষ আগ্নেয়াস্ত্র অনেক দুঃখে মাথা খাটিয়ে তৈরি করেছিলেন। তবে এক্ষেত্রে একটা যুক্তি আছে। চঁচামেচি শুনে কিষেনদ কিংবা রাস্তা থেকে কেউ ছুটে এলে তাদের ভাগিয়ে দিতে পটকা যথেষ্ট। কালাশনিকভের গুলি খামোখা খরচ করে লাভ কী? হাতে রাইফেল দেখবে এবং পটকার শব্দ শুনবে। দুয়ে-দুয়ে চার হবে এবং লেজ তুলে পালাবে।

কর্নেল আবার হেসে উঠলেন। বললাম, কিষেনাদের ঘুমনোটা আশ্চর্য! নাইট ডিউটি বাজে কথা। জঙ্গিদের সঙ্গে ওর নিশ্চয় যোগসাজশ আছে।

অনেক ড্রাইভার সুযোগ পেলেই ঘুমোয় দেখছি। কিন্তু কথা হল, আলফা কোম্পানির দুই মালিক বরমদেও থানে আসবেন, জঙ্গিরা জানত তা হলে?

সায় দিয়ে বললাম, হ্যাঁ। কিষেনৰ্চাদের কাছেই জেনেছিল। আর দেখুন, ওরা আগে থেকেই অপহরণপত্র ছাপিয়ে রেখেছে।

কর্নেল হঠাৎ হললেন, সকালে তারাপুর যাচ্ছি কিন্তু!

আঁতকে বললাম, কর্নেল, ওরা সাধারণ খুনে নয়, জঙ্গি গেরিলা গ্রুপ। এতবড় একটা দেশের সরকার ওদের জব্দ করতে পারছে না।

এই সময় কেয়ারটেকার ভদ্রলোক এসে পড়লেন। পি আর ও সায়েব এইমাত্র ফোন করেছিলেন। ডিনার রেডি সার।

এই বাতিকগ্রস্ত বৃদ্ধের পাল্লায় পড়ে অনেক দুর্ভোগে ভুগেছি। এবার নির্ঘাত জঙ্গিদের গুলিতে প্রাণটা যাবে। ওঁর অবশ্য কিছু হবে না। ব্ল্যাক প্যান্থারদের গেরিলা যুদ্ধের কৌশল শেখাতে চাইবেন। ওটা নাকি ওঁর সামরিক জীবনের সেরা লাভ।

সকাল সাড়ে সাতটায় ব্রেকফাস্ট করে বাসস্টেশনে গেলাম। আমেদ তখনও ওঠেননি। তাঁর জন্য কর্নেল চিরকুটে বার্তা রেখে এসেছিলেন। আটটায় তারাপুরগামী বাস ছাড়ল। কুঁয়ারডি পেরিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ দীর্ঘ জ্যাম। কন্ডাক্টর খোঁজ নিয়ে এসে ঘোষণা করল, বরমদেও থানের সামনে দশ-বিশ হাজার লোক রাস্তা আটকেছে।

এক বাঙালি যাত্রী মাতৃভাষায় ফুসে উঠলেন, রোজ এই অবরোধ। কথায়-কথায় রাস্তা আটকানো চাই। বলে রাষ্ট্রভাষায় কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করলেন, আজ হুয়া ক্যা? কিস্‌কা বিল্লি মর গেয়ি?

কন্ডাক্টর হাসল। বহুত্ বড়ি বিল্লি বাবুজি! সুভাষজিকো মার ডালা।

ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। ওরে বাবা! কৌন মারা?

মালুম নেহি।

ভদ্রলোক বোঁচকা-বুঁচকি গুছিয়ে নেমে গেলেন। কর্নেল পিঠে তার কিটব্যাগ এঁটে বললেন, ওঠ জয়ন্ত! নেমে পড়া যাক।

নেমে দেখি, সেই ভদ্রলোক এবং আরও কিছু বাসযাত্রী একটা টিলার নিচে পায়ে-চলা পথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে সঙ্গ ধরলেন। ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন, ওদিকে কোনও বাসরুট আছে নাকি?

ভদ্রলোক থমকে দাঁড়ালেন। কী আশ্চর্য! আপনাকে সায়েব ভেবেছিলাম। এরিয়ার মিশনারি সায়েবরা আছেন। তা…

কর্নেল পকেট থেকে নেমকার্ড বের করে দিলেন। উনি বিড়বিড় করে পড়তে থাকলেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। নেচারিস্ট। তারপর মুখ তুলে বললেন, নমস্কার! নমস্কার! আপনি মিলিটারির লোক। তা নেচারিস্ট মানে?

প্রকৃতিপ্রেমিক বলতে পারেন। আপনি কোথায় থাকেন? এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?

তারাপুরে আমার বাড়ি। ছোটখাটো ব্যবসা করি। আমার নাম সদানন্দ রায়। এই পথে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেলে নদীর ব্রিজে পৌঁছনো যাবে। তারপর ধরমতাল রোডের মোড়ে একটা কিছু পেয়ে যাব—জিপ কিংবা অটোরিকশা।

চলুন, আমরাও তারাপুর যাব। গল্প করতে-করতে হাঁটলে ক্লান্তি আসে না।

আজ্ঞে, কথাটা ঠিকই বলেছেন।

কে এমন মারা গেলেন যে, ললাকে রাস্তা আটকাল?

সুভাষ সিঙ্গির কথা আর বলবেন না সার! বিয়েটিয়ে করেনি। সমাজসেবা করে বেড়াত। কোম্পানি লাটে তুলে দিয়েছিল। এবার অবনী হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে। অবনী ওর পার্টনার স্যার! বুঝলেন তো?

ওঁদের ব্যবসা কিসের?

রকমারি অর্ডার সাপ্লাইয়ের। ধরুন, এরিয়ার মিশনারি স্কুল-কলেজ অর্ডার দিল, এত খাতা চাই, কি কালি-কলম চাই কি চেয়ার-টেবিল চাই—আবার গভমেন্ট অফিস যদি অর্ডার দিল-

কর্নেল বললেন, বুঝেছি। বাঘের দুধের অর্ডার দিলেও সাপ্লাই দেয়।

অদ্ভুত শব্দে হাসতে লাগলেন সদানন্দবাবু। ঠিক ধরেছেন। তবে ওই যে বলছিলাম, সিঙ্গি ব্যবসা লাটে তুলেছে দান-খয়রাত করে। ইদানীং বাতিক উঠেছিল বরমদেওয়ের থানে মন্দির গড়ে দেবে। অবনী মুখুজ্যে বেগতিক দেখে কলকাতায় ব্রাঞ্চ করেছে। ওর ছেলে মৃণাল দেখাশোনা করছে। এবার পাড়াতাড়ি গুটিয়ে অবনী কাটবে। ফ্যামিলি অলরেডি পাঠিয়ে দিয়েছে, জানেন?

তারাপুরের বাড়িতে অবনীবাবু এখন একা থাকেন বুঝি?

হ্যাঁ। সুভাষ সিঙ্গিও থাকত। নিজে কোনও বাড়ি করেনি।

জঙ্গলের গাঢ় ছায়ায় যেতে-যেতে কানে এল, ডাইনে দূরে মানুষ-জনের কোলাহল। কর্নেল বললেন, বরমদেওয়ের থান কি কাছাকাছি?

সদানন্দবাবু বললেন, আজ্ঞে! ডান দিকে ওই যে বটগাছ দেখছেন। তবে এবার একটু পা চালিয়ে আসুন সার! অবরোধ হটাতে পুলিশ গুলি ছুড়তে পারে।

ছুড়ুক না! আমরা দমাদ্দম পটকা ফাটাব।

সদানন্দবাবু গুলি-গুলি চোখে তাকালেন। পটকা ফাটাবেন? ওরে বাবা! টেররিস্ট ভেবে সিকিউরিটি ফোর্স ছুটে আসবে।

আপনার ওই ব্যাগে তারাকাঠির প্যাকেট দেখছি। আসন্ন দেওয়ালি উপলক্ষে বাজি, পটকা, হাওয়াই, তুবড়ি কিনতে নিশ্চয় কলকাতা গিয়েছিলেন?

আজ্ঞে। তা–

দিন না কয়েকটা পটকা। দাম দেব।

কী বলছেন সার?

কর্নেল পকেট থেকে একটা পটকা বের করে বললেন, তা হলে আমারটা ফাটাই। উনি একটা পাথরে জোরে পটকাটা ছুড়ে মারলেন। প্রচণ্ড শব্দে ফাটল এবং কানে তালা ধরে গেল।

সদানন্দবাবু অমনই প্রায় দৌড়তে শুরু করলেন। বললাম, কোনও মানে হয়? যদি সত্যি সিকিউরিটি ফোর্স ছুটে আসে?

কর্নেল একচোট হেসে বলেন, কষ্ট করে আর তারাপুর যেতে হল না। সদানন্দবাবুর কাছেই। সব হদিশ পাওয়া গেল। এবার ওঁকে সঙ্গছাড়া করার দরকার ছিল। দ্বিতীয়ত, একাগ্রচিত্ত এক বালক ব্যাধের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হল।

একটি বনচর ছেলে গুলতি আর মুঠোয় বাঁটুল নিয়ে বাঁ দিকের ঝোপ থেকে কখন বেরিয়ে এসেছে, লক্ষ করিনি। কর্নেল তাকে ইশারায় ডাকলেন। তার মুখে ক্ষোভের চিহ্ন স্পষ্ট। কর্নেল হিন্দিতে বললেন, পাখিটা উড়ে গেছে। সেজন্য দুঃখ কোরো না। বখশিশ দিচ্ছি।

তার হাতে একটা দশ টাকার নোট খুঁজে দিলেন কর্নেল। সে অবাক চোখে নোটটা দেখতে থাকল।

কর্নেল বললেন, ওটা লুকিয়ে রাখো। তুমি থাকো কোথায়?

সে আঙুল তুলে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দেখাল। তারপর হেঁড়া-খোঁড়া নোংরা হাফপেন্টুলের পকেটে নোটটা ঢোকাল।

এখানে কাছাকাছি কোথাও জল আছে?

সে ইশারায় আমাদের অনুসরণ করতে বলল। ঝোপঝাড়, পাথর আর উঁচু গাছের ভেতর দিয়ে কিছুদূর চলার পর একটা ছোট্ট ডোবা দেখা গেল। ডোবার জলটা গাঢ় হলুদ। কর্নেল আমাকে অবাক করে ডোবার চারদিকে ঘুরতে শুরু করলেন। কখনও ঝুঁকে বা হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরতে-ঘুরতে একখানে থামলেন। তারপর ছেলেটিকে কাছে ডেকে বললেন, আরও বখশিশ পাবে। জলে মাছ আছে মনে হচ্ছে। পাক হাতড়ে একটা মাছ ধরতে পারলে মাছটা তোমার। পাঁকে অন্য কিছু পেলে আমার।

ছেলেটি একটু দোনামনা করছিল। কর্নেল আবার একটা দশ টাকার নোট তার হাতে খুঁজে দিলেন। তখন সে নোটটা পেন্টুলের পকেটে ভরে ফেলল এবং নিঃসঙ্কোচে পেন্টুল খুলে রেখে জলে নামল! জল তত গভীর নয়। তার কোমর অবধি ড়ুবল মাত্র। কমবয়সীদের যা স্বভাব। জল তার সরল আদিম মনকে ভূতের মতো পেয়েছিল। কর্নেল বারবার বলছিলেন, পাক হাতড়াও! পাঁকে মাছ পাবে।

আমি থ হয়ে বসে ব্যাপারটা দেখছিলাম। কিছুক্ষণ পরে সে হাত-খানেক লম্বা কী একটা জিনিস তুলে ধরল। কর্নেল শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, ওটা আমার! ছুড়ে দাও।

এতক্ষণে দেখলাম জিনিসটা ইঞ্চিদেড়েক মোটা একটা লোহার রড। কর্নেল রডটা কিটব্যাগে ঢুকিয়ে বললেন, কুইক জয়ন্ত, কুঁয়ারডি থানায় মার্ডার-উইপনটা জমা দিয়ে লোহাগড় ফিরতে হবে। ধরমতালের সেক্রেটারি বার্ডের ছবি না তুলে কলকাতা ফিরছি না।

বললাম, জঙ্গিরা তা হলে এই রড়টা দিয়েই—

জঙ্গিরা না। অবনী মুখুজ্যে।

অ্যাঁ? সে কী!

কর্নেল হাঁটতে-হাঁটতে বললেন, তিনটে পটকা দেখেই খটকা বেধেছিল। সদানন্দবাবুর কথাগুলো স্মরণ করো। ওইখানে সুভাষবাবু মন্দির গড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কাজেই তাঁকে ডেকে এনে আচমকা পেছন থেকে মাথায় রডের ঘা মারা সো ইজি। জঙ্গিদের লেটারহেড? সুভাষবাবুর সঙ্গে ওদের যোগাযোগ ছিল, আই বি রিপোর্টে তার আভাস আছে। অর্ডার সাপ্লায়ার কোম্পানির পার্টনার সুভাষবাবুর পক্ষে লেটারহেড সাপ্লাই করা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অবনীবাবুর অগোচরে এ কাজ অসম্ভব। কাজেই অবনীবাবু একটা লেটারহেড আত্মসাৎ করেছিলেন। তবে অতিবুদ্ধির গলায় দড়ি বলে কথা আছে। পটকা ফাটিয়ে কিডন্যাপিং কেকে আরও মজবুত ভিত্তিতে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন অবনীবাবু। ঘাসে পটকা ফাটেনি। কাজেই আমার খটকা …কালাশনিকভ হাতে থাকলে পটকার কথা মাথায় আসবে কেন? হ্যান্ডগ্রেনেডের অভাব নেই জঙ্গিদের। কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। নিজেকে নিজে কিডন্যাপ করলে ঘরের টাকা ঘরেই ফিরবে। তবে আমার ধারণা, অবনীবাবু অত ঝুঁকি নেবেন না। কাহো প্রপাত এলাকায় অবশ্যই জঙ্গিদের ঘাঁটি আছে। তার প্রমাণ ওই লেটারহেড। অবনীবাবু ধুলো-কাদা মেখে থানায় হাজির হয়ে বলবেন, পালিয়ে এসেছি।

বৃদ্ধ রহস্যভেদী সত্যি অন্তর্যামী। কুঁয়ারডি থানায় ছেড়া শার্ট এবং ধুলো-কাদামাখা অবনী মুখুজ্যে করুণ মুখে বসেছিলেন। কয়েক মিনিট পরেই অবশ্য তাঁকে হাজতে ঢোকানো হয়েছিল…।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments