Thursday, April 25, 2024
Homeকিশোর গল্পমমি ও সপ্তম চাঁদের রহস্য

মমি ও সপ্তম চাঁদের রহস্য

মমি ও সপ্তম চাঁদের রহস্য

রাত প্রায় বারোটা। কাশেমের সাইলেন্ট করে রাখা মোবাইলটা ভাইব্রেট করে উঠলো। এটা মিসড কল হবারই কথা। তাই ফোনটা না তুলে চুপচাপ পকেটে ফেলে একেবারে নিঃশব্দে ল্যাচ-কীটা টেনে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল কাশেম। কারণ ওমরের সঙ্গে সেই রকমই কথা আছে। একবার পেছন ফিরে খালি দেখলো, বাড়ির কেউ জেগে গেল কি না। নাঃ, কেউ কিছু টের পায়নি। সবাই ঘুমোচ্ছে।

একটু এগিয়ে গলি পেরিয়ে বড়ো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা জিপটায় উঠে, পেছনের সীটে আগে থেকেই বসে থাকা নাসেরের পাশে বসে পড়লো কাশেম। সামনে ড্রাইভারের সীটে ওমর। মোবাইলে একবার সময় দেখে ওমরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো কাশেম, ‘সব ঠিক আছে তো বস?’

মাথাটা একটু নেড়েই খুব স্পিডে জিপ ছুটিয়ে দিল ওমর। সময় এসে গেছে। তার এতদিনকার চেষ্টার। পরিশ্রমের।

দ্য কাউন্ট ডাউন হ্যাজ বিগান।

চারদিক একেবারে শুনশান। চুপচাপ। দু’একটা কুকুর ছাড়া কেউ নেই। তারাও ঘুমিয়ে আছে। মরুভূমির ঝড়ের ঠিক আগের মতো সব কিছু কেমন থম মেরে আছে। একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।

নাকি এসবই ওমরের আশংকিত উত্তেজিত মানসিকতার প্রতিফলন!

ঘড়ির দিকে ওমর তাকিয়ে দেখে রাত সাড়ে বারোটা। আর এক ঘন্টা। তারপরেই এস্পার কি ওস্পার। এক মুহূর্তের জন্য ওমরের হৃদপিণ্ডটা যেন বন্ধ হয়ে গেল। একটা ভয় তার হৃদপিণ্ডটাকে শক্ত মুঠোয় চেপে ধরলো। উঃ, ঘরের নিশ্চিন্ত আশ্রয়, তার আরামের বিছানা তাকে যেন হাত বাড়িয়ে ডাকছে।

এক মুহূর্তের জন্য ওমরের পা-টা এক্সিলেটরের ওপর থেকে আলগা হয়ে সরে যেতে চাইলো।

পরমুহূর্তেই মনকে শক্ত করে জিপটাকে সে, প্রায় জোর করেই, অ্যাসফল্টের রাস্তা ছেড়ে মরুভূমির দিকে ঘুরিয়ে দিল।

নাসের এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল, টেনশনেই বোধহয়। জিপটা শহরের এলাকা ছাড়িয়ে নির্জন মরুভূমিতে ঢুকে যাবার পরে সে একটা মস্ত হাই তুলে ওমরের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এখনো তো ঘন্টা খানেক লাগবে মনে হয়। কি বলিস?’

সামান্য মাথা নেড়ে একই রকম ভাবে গাড়ি চালাতে লাগলো ওমর।

চুপচাপ গাড়ি চালাতে থাকলেও ওমরের মনের মধ্যে তখন তুমুল উত্তেজনা।

সত্যি কথা বলতে কি নাসের আর কাশেমের উত্তেজনাও কম নয়। এ সময়ে ঘুম কী আর আসে! সম্ভবই নয়। তারা তিন জনেই কম-বেশি উত্তেজিত। তা ছাড়াও মরুভূমির বালিতে গাড়ি চলার সময় এমন লাফায়! কাজেই ঘুমটুম তো দূরের কথা, ঢুলও আসে না।

কাশেম ভাবছে গত ইতবারের কথা। প্রথম যেদিন তাকে আর নাসেরকে নিজের বাড়িতে ডেকে, ওমর কথাটা পেড়েছিল।

আসলে সে, ওমর আর নাসের এক এলাকায় যে থাকে তাই নয়, একেবারে ছোট্টো থেকে অভিন্নহৃদয় বন্ধু।

এখন যদিও তারা একসঙ্গে স্কুলে যায় না, ডানপিটেমি করে না, যে যার কাজে ব্যস্ত, কিন্তু বন্ধুত্ব ঠিক তেমনই আছে।

ওমরের পিতৃপুরুষের চালু কাপড়ের ব্যবসা। সেটা মোটামুটি ওর দাদাই দেখে। ও ওর হায়ারোগ্লিফিক্স শেখার নেশাতেই মগ্ন। বড়ো বড়ো পণ্ডিতদের কাছে যায়। পড়াশুনো করে। ওই নিয়েই আছে।

তবে কাশেমের অত টাকার ভাগ্য নেই। স্কুল শেষ করে সে গাইডের কাজ নিয়েছে। ট্যুরিস্টদের পিরামিড-টিরামিড দেখায়, উটে চড়িয়ে ঘোরায়, এইসব আর কি। আর নাসেরের বডি বানাবার শখ। শুধু নিজে বডি বানিয়ে সন্তুষ্ট নয় সে, একটা জিমও খুলেছে। ভালোই চলছে ব্যবসা। এই তিরিশ-বত্রিশ বছরের মধ্যে তারা জীবনে একটু হলেও এগিয়েছে বলা যায়। জীবন এ ভাবেই চলছিলো।

এরই মধ্যে ওমর তাদের ডেকে নিয়ে জানালো যে সে এমন পিরামিডের হদিশ পেয়েছে যার খবর কেউ জানে না। সে তাদের সেখানে নিয়ে যাবে। কারণ বন্ধুদের বাদ দিয়ে সে এ আনন্দ, উত্তেজনা একা উপভোগ করতে চায় না। জীবনের সব ঘটনা যাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় তারাই তো বন্ধু। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে এ কথা তারা কাউকে বলতে পারবে না।

বন্ধুদের দলে নেবার আর একটা উদ্দেশ্য, একটা স্বার্থও অবশ্য তার ছিল, কিন্তু তখনই সে, সে কথা ভাঙেনি।

সেদিন ওমরের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে নাসের বলে উঠেছিল, “পাগল হয়েছিস নাকি? কেউ বলে? কে না জানে নতুন পিরামিড খুঁজে পাওয়া মানেই ধনরত্নের সম্ভার। এ খবর নিজেদের বাইরে কাউকে বলা যায় ? গাধা ভাবিস নাকি আমাদের? কি বলিস কাশেম?”

এ কথা বলার সময় নাসেরের লোভে চকচকে চোখদুটো কাশেমের চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

একটু নার্ভাস গলায় কাশেম বলেছিল, “দামি জিনিসপত্র যা পাবো আমরা ভাগ বাঁটওয়ারা করে নিয়ে নেবার পরে আর্কিওলজিকাল ডিপার্টমেন্টে কিন্তু এই পিরামিডের খবরটা জানিয়ে দিতে হবে।”

উত্তরে ওমর শুধু একটা ‘হুঁঃ’ বলে চুপ করে গিয়েছিল।

ওমরের মাথাতেও তখন নানা চিন্তা চলছিল। পুরো কাহিনী সে বন্ধুদের বলেনি তো।

একদিন মরুভূমির মধ্যে জিপ নিয়ে অনেকটা পথ হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ওই পিরামিডটা সে হঠাৎই আবিষ্কার করে ফেলেছিল।

ইজিপ্টিওলজি তার একমাত্র প্যাশান। পিরামিডের গঠন, মাপজোক, হায়ারোগ্লিফিক্স – এ সবের আকর্ষণে, পুরো ব্যাপারটা বোঝার জন্য যাকে বলে আত্মস্থ করা আর কি–সে কোন-না-কোন পিরামিডের ভেতরে রোজই প্রায় হানা দিত। সেই বিদ্যা এবার কাজে লেগেছিল। তাও একদিনে হয়নি।

কয়েক মাস এসে এসে সারাদিন মাপজোখ করেও পিরামিডের মূল দরজা সে খুঁজে পায়নি। তারপরে অনেকটা আকস্মিকভাবেই পিরামিডের পাশের দিকের একটা ছোট সরু দরজা সে আবিষ্কার করে ফেলেছিল।

কোদাল দিয়ে ক্রমাগত বালি সরাতে সরাতে একটা শক্ত কিছু তার কোদালে ঠেকেছিল। সব বালি পরিষ্কার হবার পর খুবই সরু একটা দরজা সে দেখতে পায়। এতই সরু সে দরজা যে একজন লোক কোনোক্রমে ঢুকতে পারে।

সেই দরজা থেকে খুব খাড়া সিঁড়ি একেবারে নীচে নেমে গেছে এক মাঝারি আকারের ঘর পর্যন্ত। আর সেই ঘরের ঠিক মাঝখানে, অন্য সব পিরামিডের মতনই ছিল একটা মমির কফিন, যা অনেক চেষ্টা করেও ওমর খুলতে পারেনি।

তবে মমির আশপাশে প্রথামাফিক কোনো সোনাদানা ছিল না। শুধুমাত্র স্যার্কোফেগাসের ওপর রাখা ছিল কালো রঙের, না-শেয়াল না-বেড়ালের একটা মূর্তি আর তার নিচে চাপা দেওয়া হায়ারোগ্লিফিক্সে লেখা একটা প্যাপাইরাস। ব্যাস, আর কিছু নয়।

চারপাশে দামি কিছু দেখতে না পেয়ে একটু হতাশ হলেও কৌতূহলবশত সে মোবাইলে প্যাপাইরাসটার একটা ছবি তুলে নিয়ে এসেছিল। হতে তো পারে ঐ প্যাপাইরাসের মধ্যে সোনাদানার গুপ্ত কোনো হদিস দেওয়া আছে!

তাছাড়া সেই মুহূর্তে তার আর কীই বা করার ছিল, আর্কিওলজিকাল অফিসে খবর দেওয়া ছাড়া এবং এই মুহূর্তে সে ইচ্ছে তার একেবারেই ছিল না। বেআইনি কাজ জেনেও তার কৌতূহল আর লোভ তাকে তা করতে দেয়নি।তারপর দীর্ঘ প্রায় পাঁচ-ছ’ মাসের চেষ্টায়, দিন রাত গবেষণা করে, পরিশ্রম করে প্যাপাইরাসের অনেকটারই মর্মোদ্ধার করতে পেরেছিল ওমর।

যে সব জায়গায় সে আটকে যাচ্ছিল, বুদ্ধি করে বাদবাকি লেখা গোপন করে, শুধু সেই অংশগুলোর অর্থ সে হায়ারোগ্লিফিক্স বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল। এর জন্য তাকে বহু ছুটোছুটি করতে হয়েছে। সহজে হয়নি।

শেষ পর্যন্ত যা সে বুঝতে পেরেছিল তাতে সে বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেছিল। এ কীভাবে সম্ভব!

ওই প্যাপাইরাসে লেখা ছিল –

‘এখানে মহামান্য আফ্রার রানি আনেৎ বিশ্রাম নিচ্ছেন। সপ্তম পূর্ণ চাঁদের দিনে তিনি আবার উঠবেন। তিন জন বন্ধু অথবা তিন জন শত্রু তাঁকে সেই চিরনিদ্রা থেকে জাগাতে পারবে। আর যারা তাকে চিরনিদ্রা থেকে তুলবে, তারাও লাভবান হবে। তারা অশেষ সম্পদের অধিকারী হবে।’

আনেৎ?! এ নামে কোনও রানির কথা সে তো কোনো বইতে পড়েনি! কিন্তু সে চিন্তা পরে। আসল তো সোনাদানা। আর প্যাপাইরাসে স্পষ্ট ধনসম্পদের কথা লেখা আছে। আগে তো সেটা হাতে আসুক।

প্যাপাইরাসে লেখা আছে সপ্তম মাসের পূর্ণ চাঁদের দিনে প্যাপাইরাসে লেখা মন্ত্র ও প্রক্রিয়ার সাহায্যে রানি আনেৎ জাগবেন আর তখনই ধনরত্নেরও হদিস পাওয়া যাবে।

ওমর আবার নতুন করে এ বিষয়ে পড়াশোনা, প্রায় গবেষণাই বলা যায়, শুরু করে দিয়েছিল। পড়তে পড়তে সে জানতে পারলো, পুরনো ইজিপশিয়ান বছর শুরু হতো মাস ‘তুত’-এর প্রথম দিন থেকে। অর্থাৎ এখনকার ১১ সেপ্টেম্বর নাগাদ। তাহলে তার সপ্তম মাস শুরু হচ্ছে এপ্রিলের ১১ তারিখ থেকে। সুতরাং এখনকার এপ্রিল মাসের পূর্ণ চাঁদ অর্থাৎ পূর্ণিমার দিনই হচ্ছে সেই দিন যেদিন রানি আনেৎ জাগবেন। …ইউরেকা!

আর তখনই ওমরের মাথায় এই প্ল্যান খেলে যায়। প্যাপাইরাসের লেখায় বলা হয়েছে তিন বন্ধু বা তিন শত্রুর কথা।

বাহ, নাসের আর কাশেম তো তার সত্যিকারের বন্ধু। তাদের সংগে নিলে নিশ্চয়ই কিছু উপকার হবে। কিন্তু ওদের পুরোটা বলা যাবে না। ওই ধনরত্নের কথাই শুধু বলতে হবে।

তবে খটকা একটাই। সে নিজে আনেৎ বলে কোন রানির নাম পায়নি। আর বিশেষজ্ঞরাও এমন কারুর সন্ধান দিতে পারেননি। তবে হতেই তো পারে, এদ্দিন এঁর কথা জানা ছিলো না। তাহলে সেই এই আবিষ্কারের কৃতিত্বও পাবে ওমর, আর তার সাথে অতুল বৈভব। ভাবতেই আনন্দে, লোভে তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল।

ওই যে প্রায় এসেই গেছি, ভাবলো ওমর।

বেশ মেঘ করেছে। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। চাঁদও প্রায় মেঘে ঢাকা। মাঝে মাঝে অবশ্য মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে। আর চাঁদের এই লুকোচুরি খেলায় মরুভূমির বালিতে সাদা কালোর কাটাকুটি পুরো জায়গাটাকে কেমন যেন ভয়াল, রহস্যময় করে তুলেছে। দিনের আলোয় যেমন লাগে, অন্য দিন যেমন লাগে, তার থেকে কত আলাদা!

একটু যেন অন্যমনস্কভাবে গাড়িটা থামিয়ে নাসের আর কাশেমের দিকে তাকিয়ে ওমর বলল, “জিপ এখানেই থাক। বাকি সামান্য রাস্তা, চল হেঁটে যাই। মানে হেঁটেই যেতে হবে আর কি…”

অল্পই বালির রাস্তা। সেটুকু হেঁটে পার হয়ে সিঁড়ির মুখে এসে পৌঁছলো তারা। ওই যে দেখা যাচ্ছে, একটা সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে।

টর্চের আলোয় সেই খাড়া সিঁড়ি ভেঙে তারা তিন বন্ধু পিরামিডের ভেতরে এসে যখন দাঁড়ালো, তখন টর্চের হালকা আলোয় সাজসজ্জাহীন একটা অতি সাধারণ কফিন দেখা গেলেও, চারপাশের বাকি সব কিছুই কেমন যেন অস্পষ্ট, রহস্যময়! একটা দমবন্ধ করা ভৌতিক পরিবেশ।

ওমর তার পকেট থেকে দুটো বড় মোমবাতি বের করে জ্বালিয়ে দিলো।

চোখও এরমধ্যে অন্ধকারে খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। তাই হালকা আলোতেও তারা দেখতে পেল স্যার্কোফেগাসের পাশে সাজানো রয়েছে নানা আকারের পাত্র, আর তার ভেতর নানা রঙের নানা ধরনের গুঁড়ো, জড়িবুটি, যা তারা কস্মিনকালেও কোনোদিন দেখেনি।

সেখানেই একটা প্রদীপ, আর বেড়াল বা শেয়াল গোছের একটা প্রাণীর মমি। নাসের আর কাশেম সবিস্ময়ে দেখতে থাকলো ওমর কী করে।

ওমর প্রথমেই প্রদীপটাকে জ্বালিয়ে দিলো। অবশ্য জিনিসটা খানিকটা প্রদীপের মতন দেখতে বটে, তবে পুরোপুরি প্রদীপ বলা চলে না। আর আকারেও অনেক বড়ো। গামলা ধরনের অনেকটা। ওমর তার ভেতরের আগুনে, পাশে রাখা প্যাপাইরাস আর তার মোবাইল খুলে অজানা ভাষায় কিছু বিড়বিড় করতে করতে একেকটা কৌটো খুলে গুঁড়ো, জড়িবুটি ওই আগুনের মধ্যে ফেলতে লাগলো। বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ তো ওমরের চলছেই।

এবার ওমর ইশারায়, তার মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বাকি দু’জনকে একটা ত্রিভুজের মতো আকৃতিতে মমির চারপাশে ঘুরতে বললো।

দেখতে দেখতে ধোঁয়ায় যখন চারপাশটা প্রায় ঢেকে গেছে, তখনই পিরামিডের ওপরের কোনো এক ছিদ্র থেকে মার্বেলের মত অর্ধস্বচ্ছ চাঁদের আলো এসে পড়লো মমির ঠিক উপরে। আর হঠাৎই মমির ঢাকনাটা খুলে গেল।

এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল তিন জনেই। তিন জনেরই বিস্ফারিত চোখ কফিনে শোয়ানো মমির বুকের দিকে।

মুরগির ছোট ডিমের মতো একটা হীরে মমির বুকের ঠিক উপরে চাঁদের আলোয় আশ্চর্য নীলাভ দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

কী আশ্চর্য তার আভা। কী অমোঘ তার আকর্ষণ!

লোভ সামলাতে না পেরে নাসের যেই পাথরটা নেবে বলে হাত ছুঁইয়েছে, সেই মুহূর্তে যেন কয়েকশো ভোল্টের ধাক্কায় ঘরের একেবারে কোণে ছিটকে পড়লো সে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে ওমর আর কাশেমও অন্য দু’দিকে গিয়ে ছিটকে পড়লো।

নাসেরের মাথাটা এমন জোরে মেঝের পাথরে ঠুকে গেল যে শুধু ফুলে গিয়ে ক্ষান্ত হলো না, মাথার পেছনে হাত দিয়ে নাসেরের মনে হলো বোধহয় একটু রক্তও পড়ছে।

ওমর আর কাশেমের ঝটকা অপেক্ষাকৃত কম লাগায় দুজনের মাথার পেছনে দুটো আলু হয়েই ক্ষান্ত দিয়েছে। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তারা উঠে বসে দেখে, তাদের চোখের সামনে ঘটছে এক গায়ে কাঁটা দেওয়া অবিশ্বাস্য ঘটনা।

চাঁদের হালকা রুপোলি আলো আর ধোঁয়ার মধ্যে আস্তে আস্তে রূপ নিচ্ছে এক অপুর্ব সুন্দরী নারীর, ঠিক যেন ঘন কুয়াশা দিয়ে তৈরি রহস্যময় আবছা এক অবয়ব। যেন এ জগতের কেউ নয়। ঠিক যেন কোনো পরীর অস্পষ্ট অবয়ব। যেমন রহস্যময় তেমন রাজকীয়।

“আ-আপনি কে?” কোনো রকমে ভাঙা ভাঙা স্বরে, ঠিক জিজ্ঞাসা নয় যেন কঁকিয়ে ওঠল ওমর।

খুব ধীর স্বরে ছায়াময় আভাসের মতো সেই ট্রান্সলুসেন্ট মূর্তি বলতে থাকে (যার এক বর্ণও নাসের বা কাশেম বুঝতে পারেনি। তাদের মধ্যে ইজিপ্টিওলজি নিয়ে দীর্ঘদিন চর্চা করা ওমরই একমাত্র বুঝতে পেরেছিল। পরে সে তাদের বলে দেয়)

“আমি রানি আনেৎ। মহামান্য ফারাও-এর প্রিয় স্ত্রী। আমাদের তিন বোনেরই ফারাওএর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু আমার সম্মান, ফারাওএর আমাকে বেশি ভালোবাসা, আমার অন্য দুই বোন সহ্য করতে পারেনি। তারা আমার খাবারে এমন কিছু মেশাতে থাকে, যার ফলে আমি ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ি।

“আমার কয়েক জন অত্যন্ত বিশ্বস্ত ভৃত্য ছিল। তাদের মধ্যে আবার তিন জন ছিল আমার সবথেকে বিশ্বস্ত। তাদেরই কাছে জানতে পারি, আমার অসুস্থতার সুযোগে আমার অন্য দুই বোন আমার বিরুদ্ধে, ফারাওকে প্রতারণা করার এমন অভিযোগ বানিয়েছে এবং কিছু বানানো প্রমাণও তার সঙ্গে হাজির করেছে যে, ক্রুদ্ধ ফারাও রাজবংশের ইতিহাস থেকে আমার নাম মুছে দিতে আদেশ দিয়েছেন।”

কিছুক্ষণ থেমে, আবার বলে চললেন রানি, “আমি মৃত্যুশয্যায় বলে, সেই মুহূর্তে কোনো ভয়ংকর শাস্তি ফারাও আমাকে দিতে পারেননি, কিন্তু শাস্তি হিসেবে আমার জন্য বহুদূরে একটা খুবই সাধারণ ও ছোট পিরামিড নির্দিষ্ট করেছেন, যেখানে আমার নাম অবধি লেখা থাকবে না।

“একথা শুনে আমার মনের মধ্যে প্রচণ্ড রাগ আর প্রতিহিংসা জেগে উঠেছিল। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম আমার আয়ু ফুরিয়ে আসছে। আমার বিশ্বস্ত ভৃত্যদের মধ্যে একজনকে দিয়ে, যে বৈদ্য আমাকে দেখছিলেন তাঁকে ডেকে পাঠালাম। সেই বৈদ্য শুধু যে আমার প্রতি একান্তভাবে বিশ্বস্ত ছিলেন তাই নয়, আমার বাবার প্রাণের বন্ধুও ছিলেন। আর আমাকে খুবই স্নেহ করতেন।

আমার বাবাও বৈদ্য ছিলেন। কিন্তু তিনি শুধুই যে বৈদ্য ছিলেন তা নয়, মমি বানাবার কৌশল এবং সেই মমিকে জাগাবার গূঢ় কৌশলও তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। আর আমার এ বিষয়ে আগ্রহ দেখে সে কৌশল তিনি বোনেদের মধ্যে একমাত্র আমাকেই শিখিয়েছিলেন।

“যাইহোক, যদিও তখন আমার কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিল, তবু আমার বিশ্বস্ত বৈদ্য আসার পরে, মমি জাগাবার পুরো প্রক্রিয়া ক্ষীণ স্বরে আমি তাঁকে বলতে থাকি আর তিনি সেটা লিখে নেন।

“আমার আশা ছিল আমার বিশ্বস্ত অনুচর তিন জন আমাকে প্রতিশোধ নেবার জন্য জেগে উঠতে সাহায্য করবে। তাই সেই বৈদ্যকে আমি মমি জাগাবার নির্দেশ লেখা প্যাপাইরাস আমার মৃত্যুর পরে আমার মমির পাশে রেখে দিতে বলি।

“তারপরে আমার তিন বিশ্বস্ত ভৃত্যকে আমার তিন ছড়া অমূল্য গলার হার দিয়ে দিই, আর তার বিনিময়ে মা’আতের কাছে তারা প্রতিজ্ঞা করে যে যত বছরই লাগুক না কেন, তারা অবশ্যই প্যাপাইরাসে লেখা মন্ত্র ও প্রক্রিয়ার সাহায্যে আমাকে মৃত্যুনিদ্রা থেকে জাগাবে, যাতে যারা আমাকে আজ তিলে তিলে মেরে ফেলছে তাদের উপর আমি প্রতিশোধ নিতে পারি আর আমার ফারাওএর কাছেও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারি।

“সেদিনই সন্ধ্যায়, আমার দৈহিক ক্রিয়া যখন প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে, তখন আমাকে প্রায় মৃত দেখে, যাদের আমি সব থেকে বিশ্বস্ত ভাবতাম, আমার সেই তিন ভৃত্য আমার জ্ঞান নেই ভেবে আমার সামনেই আলোচনা করতে লাগলো, কেমন তারা আমাকে ঠকিয়ে বিশ্বাস জিতে, অন্য দুই রানির কাছ থেকে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে আমার খাবারে নানা বিষাক্ত জিনিস মিশিয়ে, আমাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমি কত বোকা, সেই কথা বলে তারা হো-হো করে হাসছিল।

“আর তখনই আমি রাগে ক্ষোভে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি যে জেগে উঠে দুই রানির সঙ্গে এই প্রতারক ভৃত্যদের উপরও প্রতিশোধ আমি নেবই।”

আনেতের কথা, গলার সম্মোহক স্বর ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসে।

কিছুক্ষণ চারদিক চুপচাপ হয়ে যায়। এক আশ্চর্য ভৌতিক নীরবতা।

কোনোরকমে সেই নীরবতার মধ্যে ওমরের প্রায় ফিসফিসে স্বর যেন কঁকিয়ে ওঠে, “আ-ম-রা…..আম-রা তিন জন আপনাকে জেগে উঠতে সাহায্য করেছি। আর আমরা তো আপনার নির্দেশ অনুযায়ী তিন বন্ধুও। হে, মহামান্য রানি আনেৎ, আপনি নিশ্চয়ই আমাদের পুরস্কৃত করবেন। অন্তত আপনার বুকে যে হীরেটি রাখা ছিল, সেটি দিয়ে আমাদের ধন্য করবেন”–আকুল আগ্রহে লোভাতুর ভাবে বলে ওঠে ওমর।

“যে কোনো তিন বন্ধু নয় মূর্খ। আমার তিন বন্ধু বা শত্রু। তবে সে শর্তও পূর্ণ হয়েছে। বন্ধু নয়। আমার তিন শত্রু আমাকে জাগিয়েছে।

“তোমরাই আমার সেই তিন প্রতারক ভৃত্য ছিলে।”

এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ামূর্তির চোখ রাগে লাল হয়ে উঠলো। আর সেখান থেকে একটা লাল তড়িৎপ্রবাহের মতো কিছু ওমর, নাসের আর কাশেমের একেবারে কাছাকাছি এসেই কেন যেন হঠাৎ থমকে গেল।

কুঁকড়ে ভয়ে পোকার মত পড়ে থাকা তিন জনের দিকে তাকিয়ে নিজেকে যেন একটু সামলে নিয়ে, শান্ত গলায় রানি আনেৎ বললেন, “এতদিন প্রতিশোধের জ্বালায় জ্বলেছি, সেই প্রবল ইচ্ছে আমাকে অন্যলোকে যেতে দেয়নি। অনেক কষ্ট পেয়েছি। লোভের বশে হলেও তোমরা আমাকে মুক্তি দিয়েছ। আমি অন্যলোকে চললাম। আমি তোমাদের ক্ষমা করলাম। মা’আত তোমাদের বিচার করবেন।”

রানি আনেৎ এই কথা বলতেই চাঁদের আলোর সঙ্গে সেই ছায়ামূর্তিও ওই ঘর থেকে, তাদের তিন জনের চোখের সামনে থেকে নিঃসীমে মিলিয়ে গেল। চারপাশে আবার নিকষ কালো অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের মধ্যে ঘরের কোনা থেকে কী যেন একটা ছুটে এসে তাদের তিনজনকে আচঁড়ে কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করে দিল। প্রাণভয়ে, আতংকে হাতড়াতে হাতড়াতে কোনো রকমে তারা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো।

তারপর তাদের আর কিছুই মনে নেই।

জ্ঞান ফিরলে দেখে তারা বালির উপর শুয়ে আছে, আর তাদের ঘিরে জনা তিনেক উটওয়ালা আর দু’জন পুলিশ। ওখানে তাদের পড়ে থাকতে দেখে ওরাই এলাকার থানায় খবর দিয়েছে।

পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে আসার পরে তারা শোনে যে পিরামিডের ভেতরে কোনো মমি, মানুষের বা পশুর, পাওয়া যায়নি। একটা পাথর শুধু পাওয়া গেছে। কিন্তু সেটা মোটেই হীরে নয়। পাথরটাকে কায়রো মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

যদিও তাদের গল্পটা পুলিশ আদৌ বিশ্বাস করেনি, কিন্তু তাদের ক্ষতবিক্ষত মুখ এবং অজ্ঞান অবস্থা দেখে পুলিশ এটা বুঝতে পেরেছে, মমি চুরি করা তাদের কাজ নয়। চুরি করার উদ্দেশ্য হয়তো তাদের ছিল, কিন্তু তারা সফল হয়নি। মমি নিয়ে গেছে অন্য কোনো লোক। বা অন্য কোনো দল।

কিন্তু কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে অবৈধভাবে পিরামিডে ঢোকার অপরাধে ঈজিপ্টের আইন অনুযায়ী জরিমানা আর তার সঙ্গে হাজতবাসের শাস্তির আদেশ অবশ্য তারা এড়াতে পারেনি।

তাদের মুখের ক্ষত ধীরে ধীরে কয়েক মাস, বলা যায় প্রায় বছর খানেক বাদে শুকিয়ে গেলেও, সেই ক্ষতের দাগ তাদের মুখ থেকে কোনো দিনই মিলিয়ে যায়নি। কলংকচিহ্ন হয়ে থেকেই গেছিল। তাদের সব অপরাধের চিরস্থায়ী সাক্ষী হয়ে।

হয়তো এটাই ছিল মা’আতের বিচার।

লেখা: আর্যা ভট্টাচার্য

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments