
ইহুদী সাল্লাম বিন জুবাইর সেই সকাল থেকে বসে আছে ইয়াসরিবের বাজারে। তার সব মাল-সামান বিক্রি হয়ে গেছে। লাভও হয়েছে দেদার কিন্তু এই গোলাম বাচ্চাটা যেন তার গলায় কাঁটার মতো আটকে আছে। সেই সকাল থেকে এটার কাছেও কেউ ঘেঁসছে না। এই বাচ্চাটা না দু’পয়সা আয়-রোজগার করতে পারবে আর না করতে পারবে ঘরের কোনো কাজ-কাম, এ চিন্তাই বোধ হয় খদ্দেরদের ঠেকিয়ে রেখেছে। এসব সাতপাঁচ ভাবছিল সাল্লাম।
এমন সময় আওস গোত্রের সুন্দরী যুবতী সাবিতা বিনতে ইয়ারিবের নজরে পড়লো এই ছোট্ট গোলামটি। সাবিতা বিড়বিড় করলোঃ ইস না জানি কার কলিজার টুকরো। বাচ্চাটাকে কিনে নেবার ইচ্ছে জাগলো তার মনে।
জিজ্ঞেস করলোঃ কি হে সাল্লাম! তোমার এ গোলামটার নাম কি?
– বনি কালব গোত্রের যে ব্যক্তি একে আমার কাছে বিক্রি করেছে সে এর নাম বলেছিল সালেম।
– এর বাপের নাম কি?
– তাতো জানি না। তবে ঐ কালবি লোকটি বলেছিল, শিশুটি ভদ্র ও অভিজাত বংশের। আর এ নাকি ইসতাখার খান্দানের……।
– হাঁ-হাঁ ঐ যে ইসতাখার খান্দান উবলায় বাস করতো। সারা ইরাকে এদের ব্যবসা ছড়িয়ে আছে। আচ্ছা এসব আমি ভালো করেই জানি। এখন আমি গোলামটাকে কিনতে চাই।
ভালো দামেই সাবিতা গোলামটাকে কিনে নিল। আয়-রোজগার করার জন্যে বা নিজের খেদমত করার জন্যে সে গোলামটাকে কিনেনি। আসলে শিশুটির প্রতি করুণা ও মমতার বশেই সে তাকে কিনে নিয়েছিল। পথে যেতে যেতে সে মনে মনে বিড়বিড় করছিল, ‘লা’নত! হাজার বার লা’নত! যারা মানুষের প্রতি রহম করেনা, দুর্বলের প্রতি করুণা না করে- তাদের ওপর লানত! যে মায়ের ছেলে হারিয়ে যায় আহ! তার কী কষ্ট! যে ছোট্ট শিশুটি এখনো মাকে চেনে না, বাপকে চেনে না, নিজের কোন আত্মীয় স্বজনের চেহারা যার চোখে ভাসে না, আহা সে কতবড় হতভাগা! আহ এ রকম যদি আমার কোন বাচ্চা হতো। ডাকাতরা যদি আমার ওপর হামলা করে তাকে লুট করে নিয়ে যেতো, তাহলে আমার দশাটা কেমন হতো! এ অবস্থায় আমি কেমন করে বেঁচে থাকতাম। জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত কি আমি নিজের বাচ্চাটির কথা ভুলতে পারতাম? কখনোই না। দুনিয়ায় বেঁচে থাকাই তো আমার জন্যে অসম্ভব হয়ে পড়তো। দুনিয়ার সব নিয়ামত যেনো আমার কাছে হারাম মনে হতো। সাবিতা নিজের মনের আয়নায় যেন বাচ্চার মাকে দেখতে পাচ্ছিল। সে ভাবছিল কিসরার সৈন্যরা যখন একে লুটেরাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি তখন এই
ইয়াসরিবে একে কিভাবে রক্ষা করবো?
এ শহরে তো আগে থেকেই বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে আছে। তার ওপর ইহুদী ও বদ্দুরা একে ঘিরে আছে চারদিক থেকে। এ ঘটনার পর সাবিতার বিয়ের পয়গাম এলো আওস ও খাযরাজদের বড় বড় ঘর থেকে। কিন্তু সে এখন বিয়ে করতে রাজি ছিল না। নানান অজুহাত দেখিয়ে বিয়ে এড়িয়ে গেলো। ছোট্ট সালেমকে নিয়েই সে মেতে রইলো।
এর এক বছর পরে কুরাইশদের একটি কাফেলা সিরিয়া থেকে ফেরার পথে ইয়াসরিবে কয়েক দিন বিশ্রাম নিল। এই কাফেলায় ছিলেন আবু হুযাইফা হাইসাম বিন উতবাহ। সাবিতার সম্পর্কে অনেক কথাই শুনেছিলেন আবু হুযাইফা। আর তার গোলামটির কথাও। লোকের মুখে মেয়েটির অসম্ভব গুণপনার কথা শুনে আবু হুযাইফা বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন সাবিতার কাছে। সাবিতা প্রথমে কানই দেয়নি। কিন্তু পরে শুনলো কুরাইশ বংশে আবু হুযাইফার মর্যাদার কথা। এমন এক কাবাগৃহের তারা খাদেম যে গৃহের ওপর আক্রমণকারী হস্তী সেনাদলকে আল্লাহ আবাবিল পাখি দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সাবিতা বিয়েতে রাজী হয়ে গেলো। বিয়ের পর আবু হুযাইফা স্ত্রী ও গোলামটিকে সাথে নিয়ে মক্কায় চলে এলেন। আবু হুযাইফা ছিলেন জোয়ান। কুরাইশদের বিভিন্ন আসরে তাঁকে দেখা যেতো সব সময় সরগরম।
কিন্তু এবারের মজলিস তেমন জমছিল না। কোথাও যেন কিছু ঘটে গেছে বলে তাঁর মনে হচ্ছিল। এবারের মজলিসগুলো যেন কিছুটা প্রাণহীন। যেন কিসের অভাব। তিনি একটু গম্ভীরভাবে ভেবে দেখলেন। তাইতো এখানে উসমান বিন আফফানকে (রাঃ) দেখি না তো। তালহা বিন উবায়দুল্লাহ তামিমী (রাঃ) কোথায়? অমুক বন্ধু, অমুক দোস্ত, কই তাদের দেখছি না। তো? তারা কোথায়? তারা কেন আসে না? যাকে জিজ্ঞেস করেন আবু হুযাইফা সেই চুপ করে থাকে। কেউ কেউ জবাব দিলেও তা ইংগিতপূর্ণ, বুঝে ওঠা মুশকিল। বন্ধুদের খুঁজে খুঁজে হতাশ হয়ে শেষে ভাবলেন তারা তো এই শহরেই থাকে, আচ্ছা তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখি না কেন? প্রথমে গেলেন উসমানের বাড়িতে। উসমানের (রাঃ) বয়স চল্লিশ। তাঁর চেয়ে দশ বছর বেশী। কিন্তু তার প্রাণের দোস্ত। সবচেয়ে বেশী ভালোবাসেন তাঁকে। যেমন রুচিশীল, তেমনি জ্ঞানী, তেমনি আবার মধুর স্বভাবের। বাড়িতেই পেলেন উসমানকে। উসমান তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলেন। হাসি মুখে বললেন, কেমন আছো আবু হুযাইফা?
আবু হুযাইফা নিজের মনের প্রশ্নের জবাব খুঁজছিলেন। কোথায় কিসের যেন পরিবর্তন উসমানের চেহারার মধ্যে তিনি পেলেন। আগের চাইতেও উসমানকে যেন আরো বেশী গম্ভীর, আরো বেশী সহনশীল মনে হচ্ছে।
“উসমান। তোমাকে আমি মক্কার সব আসরে খুঁজে বেড়িয়েছি। সিরিয়া থেকে বাণিজ্য কাফেলা ফিরে আসার পর থেকেই তোমাকে খুঁজে ফিরছি। বলতো, তোমার কি হয়েছে? তুমি কেন মজলিসে যাওয়া ছেড়ে দিলে?”
“এ মজলিস আমার একদম পছন্দ নয়। ওখানকার আলোচনাগুলোও একেবারে বাজে।”
“ব্যাপার কি? তোমার কওম কি তোমাকে কোনো কষ্ট দিয়েছে?” উসমান চুপ করে থাকলেন। কোনো কথা বললেন না।
“তাহলে উসমান। কিছু নিশ্চয়ই ঘটেছে। তোমাকে লাত ও উযযার কসম….।”
লাত ও উযযার নাম শুনতেই আবু হুযাইফা দেখলেন, বন্ধুর কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে। মুখে বিরক্তি। চোখে ক্রোধের ছায়া। এমন তো তিনি আগে কখনো দেখননি। তিনি থেমে গেলেন। এবার কথা ঘুরিয়ে নিলেন। “উসমান! তোমার সাথে আমার কতকালের দোস্তি। তুমি আমার প্রাণের দোস্ত। তোমাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসি। সবচেয়ে বেশী বিশ্বাস করি। তোমার সাথে এতদিনের বন্ধুত্বের দোহাই, বলো, বলো, তোমার প্রাণে কিসের ব্যথা? তোমার মনের কথা বলো।”
উসমান অত্যন্ত ঠান্ডা মেজাজে কোমল ভাষায় বললেনঃ “দেখো আবু হুযাইফা, আমাদের বন্ধুত্ব যদি টিকিয়ে রাখতে চাও তাহলে তোমার ঐসব দেবতাদের লাত ও উযযার দোহাই দিতে পারবে না আমার কাছে, যারা আসলে কোন ক্ষমতাই রাখে না।”
আবু হুযাইফা তো অবাক! বলে কি উসমান! প্রথমে তিনি চুপ হয়ে গেলেন। তারপর বিরক্তিভরা কণ্ঠে বললেন, “উসমান! তাহলে তো মনে হচেছ তুমি বিধর্মী হয়ে গেছো।”
“না…না… আবু হুযাইফা আমি বিধর্মী হয়ে যাইনি বরং আমি সত্য ধর্মের সন্ধান পেয়ে গেছি। আবু হুযাইফা, তুমি তো একজন বুদ্ধিমান যুবক। তোমার বয়স তেমন বেশী না হলেও তুমি তো দুনিয়ার অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। অনেক দেশ দেখেছো। অনেক জাতির কথা শুনেছো। দেশে দেশে জাতির মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখেছো। কালের যুগের অনেক ভাঙ্গাগড়ার ঘটনা তোমার সামনে আছে। তা থেকে অনেক জ্ঞান, অনেক অভিজ্ঞতা তুমি সঞ্চয় করেছে। আচ্ছা তুমি বলো, তোমার মতো বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন লোকেরা কেমন করে এই সব কাঠের তৈরী, ইট-পাথর ও মাটির তৈরী মুর্তিগুলোর পূজা করতে পারে? এগুলোকে তো আমার তোমার মতো মানুষেরাই বানিয়েছে। আবার যে কেউ চাইলে এগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলতেও পারে।”
সত্যিই আবু হুযাইফা চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে বললেন? “উসমান! তুমি আমাকে ভাবিয়ে তুললে। এমন করে তো কোনদিন ভেবে দেখিনি। সত্যিই অবাক হচ্ছি, তুমি যা বলছে তা একশো ভাগ সত্যি। আশ্চর্যের ব্যাপার, আজ পর্যন্ত এ কথাটা একবারও মনে জাগেনি। বাপ-দাদারা ওই মুর্তিগুলোকে পূজা করে আসছে। তাদের দেখাদেখি আমরাও পূজায় যোগ দিয়েছি।”
“তাহলে এখন তো সত্য প্রকাশ হয়ে গেছে? এখন তো জানলে? কি করবে এখন?”
“আমাকে নিয়ে চলো সেখানে যেখান থেকে তোমরা পেয়েছে এই সত্যের আলো।”
“কবে যাবে?”
“আজ, এখনই।”
বিকেলে সন্ধ্যে হবার আগেই আবু হুযাইফা ইসলাম গ্রহণ করলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে। মুসলমান হয়ে ঘরে ফিরে এলেন। প্রিয়তমা স্ত্রী সাবিতা শুনলেন সব কথা স্বামীর মুখ থেকে। কী অনাবিল আনন্দে উদভাসিত তার স্বামীর হৃদয়! সাবিতা সহজেই এটা অনুভব করতে সক্ষম হলেন। এই আনন্দের সন্ধানই তো তিনি করে ফিরছেন গত কয়েক বছর ধরে। সাবিতা ঈমান আনলেন আল্লাহ ও তাঁর নবী মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর। তাঁদের গোলাম সালেমের মনও স্বামী স্ত্রীর কথাবার্তা শুনে সত্যের ডাকে সাড়া দিল। সেও ঈমান আনলো। এভাবে সেদিন রাত হবার আগে আগেই মক্কায় মুসলিম ঘরানার সংখ্যা আরো একটি বেড়ে গেলো।
কিছুদিন পরে সাবিতা শুনলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাত লাভের সুখবর শুনাচ্ছেন তাদের যারা গোলাম আযাদ করে দিচ্ছে। তখনি তিনি তার ইরানী গোলামকে ডেকে বললেনঃ “সালেম! আজ থেকে তুমি মুক্ত স্বাধীন। এখন তুমি যাকে ইচছা তাকে নিজের অভিভাবক বানাতে পারো।”
সালেম আবু হোযাইফাকে বললোঃ “আপনি কি আমার অভিভাবক হবেন?”
আবু হুযাইফা বললেনঃ “না, হে খোকা। তুমি আজ থেকে আমার ছেলের মতই থাকবে।”