
কবর দেয়ার পাঁচ দিন পর ইলিয়াস মিয়া দৌলতপুরে সশরীরে হাজির হলে সারা গ্রামে তোলপাড় শুরু হলো। যত যাই হোক, ইলিয়াস মিয়া তো আর ঈসা (আঃ) নন, যে জীবিত হয়ে কবর ছেড়ে এভাবে সে উঠেও আসতে পারেন।
প্রাথমিক ভীতি কাটিয়ে উঠে চারপাশে জড়ো হয়ে লোকেরা তার হাত পা ছুঁয়ে দেখতে লাগলো। এ কি সত্যিই ইলিয়াস মিয়া? হ্যা, ইলিয়াস মিয়ার মতই তো অমাবস্যার অন্ধকারের মতো কুচকুচে কালো গায়ের রঙ, থ্যাবড়া নাক, ভাঙা গাল ও ঈষৎ কুঁজো পিঠ। এমনকি গা থেকে ভরভর করে কাঁচা বিড়ির গন্ধও ভেসে আসছে!
গ্রামবাসীদের এই মাত্রাতিরিক্ত ঔৎসুক্যে বেশ বিরক্ত ইলিয়াস মিয়া, সেই তখন থেকেই শূয়োরের মত মুখ দিয়ে ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ করে যাচ্ছে সে, হাত-পা নেড়ে কিছু একটা বলারও চেষ্টা করছে। তবে গ্রামের মানুষদের অনবরত প্রশ্নবাণের একটারও জবাব দিচ্ছে না।
অধৈর্য মুদি দোকানদার ফয়েজ উদ্দীন, যার দোকানের নাম ফয়েজ অ্যান্ড কোং এবং যেখানে মুখরোচক সব খাবার পাওয়া যায়, শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললো, “কিরে ইলিয়াইছ্যা! তোর কি জবান গেছে গা?”
ভিড়ের মধ্য থেক কেউ একজন বলে উঠলো “ফয়েজ অ্যান্ড কোং-এর শনপাপড়ি খাইছে মনে অয়!”
একটা হাসির হুল্লোড় উঠলো। চোখ গরম করে উদভ্রান্তের মতো চারপাশে তাকাতে থাকলো ফয়েজ উদ্দীন। “কোন বান্দীর পুতে কইলো এই কথা?” বান্দির পুতটাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সে হয়তোবা বাতাসের সাথে মিশে গেছে অথবা ফয়েজ উদ্দীনের পিছনেই পকেটে হাত দিয়ে নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
তবে এটা নিয়ে দৌলতপুরের মানুষজন খুব একটা চিন্তিত নয়। তাদের সমস্ত মনোযোগ তখন নিবদ্ধ মৃতদের জগৎ থেকে উঠে আসা ইলিয়াস মিয়ার উপর।
৭০ বছরের বৃদ্ধ সলিম উদ্দিন, যার বাড়িতে ইলিয়াস মিয়া মৃত্যুবরণ করার আগে কামলা খাটতো, বেখাপ্পা এক প্রশ্ন করে বসলো, “মুনকের নেকির তোরে কি জিগাইলো রে, ইলিয়াছ? তা, ওরা দেখতে ক্যামুন?”
ইলিয়াস মিয়ার অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো না মুনকার-নাকিরের নাম শুনেছে সে, চেহারা দেখা তো দূরের কথা। হাত-পা নেড়ে আবারো কিছু একটা বলতে চাইলো সে, কিন্তু গলা থেকে স্রেফ জান্তব আওয়াজ ও মুখ থেকে একপশলা থুথুই বের হলো।
কথা বলার জন্য এত আকুলি-বিকুলি সত্ত্বেও ইলিয়াসকে কথা বলতে অসমর্থ হতে দেখে সবাই একমত হলো যে সে বোবা হয়ে গেছে।
মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ সগির উল্লাহ এত সময় চুপচাপ সবকিছু দেখছিলেন। হঠাৎ নীরবতা ভাঙলেন তিনি। মেহেদী লাগানো দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে তিনি বললেন, “লক্ষণ ভালা না মিয়ারা। ইলিয়াসের কবর ঠিকমত দেয়া অয় নাই। এই জন্য লাশ কবর থিকা উইঠা আসছে।”
ইমাম সাহেবের কথা গিলতে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিল সমবেত মানুষজন। কবর ঠিকমত দেয়া না হলে যে পালে পালে সব মৃতদেহ কবর ছেড়ে উঠে আসে, এমন কথা তো সচরাচর শোনা যায় না অবশেষে ইলিয়াস মিয়ার কবর খোঁড়াখুঁড়ির দায়িত্ব যারা পালন করেছিল তাদের মধ্যে থেকে একজন, মুহিব আলী, ঈষৎ অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললে, “এইডা কি কন, ইমাম সাব? কবর তো ঠিকমতনই দেয়া অইছে।”।
“হ, ঠিকমতনই তো কবর দিলাম, ইমাম সাব,” কথাটায় সায় জানালো মুহিব আলীর কবর খোঁড়ার সহযোগী জামাল শেখ। “অয় নাই, অয় নাই,” এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন ইমাম। তার মুখের কঠিন অভিব্যক্তি ও মাথা নাড়ানোর প্রবলতা দেখে ভ্রম হতে পারে এটা বুঝি কোন প্রাইমারি স্কুলের ক্লাসরুম যেখানে ইমাম সাহেব একজন অংক শিক্ষক আর বাকি দুজন অংক মিলাতে না পারা হতভাগা ছাত্র, যাদের পশ্চাৎদেশে সপাং সপাং বেত পড়লো বলে।
তারপর, পরবর্তী দশ মিনিট কবর হয়েছে কি হয় নি এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলতে লাগলো। গলা ক্রমশ চড়তে লাগলো সবার। তবে ইমাম সাহেবের দল ভারী হওয়ায় একসময় পরাজয় মেনে নিল অন্য পক্ষ। প্রথমে পুরনো কবরটা খুঁড়ে দেখা হবে, এ বিষয়ে একমত হলো সবাই।
গ্রামের মুরুব্বিদের নির্দেশে কয়েকজন কোদাল নিয়ে ছুটলো গোরস্থানের দিকে। তাদের পিছু পিছু জরাজীর্ণ গোরস্থানটিতে ভেঙে পড়লো পুরো দৌলতপুর গ্রাম। তারা গোরস্থানের ভাঙা দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বিড়ি ফুকতে ফুকতে ও পান খেতে খেতে গল্প-গুজব চালিয়ে গেল, সেই সাথে গলা বাড়িয়ে দেখতে লাগলো কোদাল চালনা।
ঝাঁকিয়ে শীত পড়েছে, পুরো দিন সূর্যের দেখা মিলে নি। গাছের পাতা থেকে টুপ টুপ করে শিশির পড়ছে। শীত নিবারণের জন্য সবার গায়ে ভারী জামা-কাপড় থাকলেও ইলিয়াস মিয়া গ্রেফ একটি পাতলা শার্ট পরে আছে। এটা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেল, পরকালে একবার গেলে আর ঠান্ডা-ঠুণ্ডা লাগে না।
ইলিয়াস মিয়াকে অনেকটা জোর করেই এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। এখন তাকে একটা আধ-খাওয়া পেন্সিল বের করে একটা ছেড়া কাগজে কিছু একটা লিখতে দেখা যাচ্ছে। ফজল আলীর গুণধর পুত্র স্বপন হঠাৎ কোনখান থেকে দৌড়ে এসে ছোঁ মেরে কাগজটা নিয়ে গেল। এ নিয়ে প্রচন্ড হাসাহাসি চললো বাচ্চাদের মাঝে। তখন মুরুব্বি গোছের একজন এসে বাচ্চাদের তাড়িয়ে দিলেন।
কবর খোঁড়ার একপর্যায়ে সাদা কাফনের দেখা মিললো। কাফন খুললে বেরিয়ে আসলো, কি আর বের হবে, ইলিয়াস মিয়ার গলিত লাশ। প্রচন্ড দুর্গন্ধে ভরে গেল চারপাশ, নাকে হাত দিতে বাধ্য হলো বাই।
কবর খুঁড়ে সত্যিকার অর্থেই লাশ পেয়ে কিছুটা যেন বিভ্রান্ত দৌলতপুরবাসী। ইলিয়াস মিয়া যদি সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় দ্বিতীয় সুযোগ পেয়েই থাকে তাহলে তো কবর খালি থাকার কথা, তাই না?
তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসলেন ইমাম সাহেব, নিজের ঝাঁপি থেকে বের করলেন আরেকটি অনন্যসাধারণ ব্যাখ্যা। “আরে মিয়ারা, ইলিয়াসের শরীল ঠিকই এই কবরে আছে, কিন্তু তার আত্না আছে আমাদের সাথে। বুঝবার পারলা?”
কথাটা শুনে অনেক কষ্ট করেও হাসি থামাতে পারলো না কলেজের ছুটিতে নানাবাড়িতে বেড়াতে আসা মনির।’হাসির শব্দ শুনে অগ্নিবর্ণ চোখে তার দিকে তাকালেন ইমাম সাহেব। “এইডা হাসির বিষয় না।”
মনিরের ছোটমামা তাকে তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে সরিয়ে দিলেন, বিব্রত স্বরে ক্ষমা চাইলেন ইমামের কাছে, “বাচ্চা মানুষ, ইমাম সাব। মাফ কইরা দেন।”
ইমাম সাহেব তখন চোখ বন্ধ করে ধ্যানের জগতে হারিয়ে গেছেন। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে; তিনি চোখ খুলবেন, দেখাবেন আলোর দিশা। একসময় চোখ খুললেন তিনি, তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন ইলিয়াস মিয়ার দিকে (না, কবরের জন নয়। যে এখনো বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে)। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে চারপাশের সবাই ইলিয়াস মিয়ার দিকে তাকালো। হঠাৎ সবাই তার দিকে বড় বড় চোখ মেলে তাকানোয় ইতিমধ্যেই বেশ ভড়কে যাওয়া ইলিয়াস মিয়া আরো বেশি ভড়কে গেল।
“ওরে আবারো কবর দেওন লাগবো,” বিচারের রায় দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন ইমাম সগির উল্লাহ। “মানুষের বেশ ধইরা ইবলিশ নাইমা আইছে এই গ্রামে। সবকিছু নাশ কইরা দিবো ও। তাই তাড়াতাড়ি কবর দেয়া ছাড়া আর কোন গতি নাই। তবে, এইবার কবর বান্ধন লাগবো যাতে আর কবর ছাইড়া উইঠা আসতে না পারে।”
গ্রামের লোকেরা হতবিহবল চোখে একবার ইমামকে এবং একবার ইলিয়াস মিয়াকে দেখতে লাগলো। ইলিয়াস মিয়ার আপাত নিরীহ মুখখানাতে তারা কুটিলতার চিহ্নও আবিষ্কার করে ফেললো এবং ভবিষ্যৎ দূরাশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উঠলো।
অতএব, সদ্য খোঁড়া কবরটির পাশেই আরেকটি কবর খোঁড়া হলো, আর মাঝখান দিয়ে কোদালের কোপে অযথাই মারা গেল কয়েকটা কেঁচো। ইমাম সাহেব মালকোঁচা মেরে কবরের মাপ-জোক করে দেখলেন, বিড়বিড় করে সারাক্ষণ দোয়া আওড়াতে লাগলো।
ওদিকে সলিম উদ্দিনের বাড়িতে ইলিয়াস মিয়াকে দাফন করানোর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সে দুই-তিনবার পালিয়ে যেতে চেয়েছে কিন্তু চৌকস গ্রামবাসীরা তাকে ঠিকই পাকড়াও করে নিয়ে এসেছে। গোসল করিয়ে কোরবানীর গরু-ছাগলের মতই হাত-পা বেঁধে ফেলা হলো তার।
অতঃপর তাকে গোরস্থানে নিয়ে আসা হলো। খবর শুনে দূর-দূরান্ত গ্রাম থেকে মজা দেখার জন্য অনেকে এসে হাজির হয়েছে। একে ঠেলে তাকে গুঁতিয়ে তারা প্রাণভরে ইলিয়াস মিয়াকে দেখে নিচ্ছে। তাদের ঠেলা-ধাক্কার তীব্রতায় গোরস্থানের পুব পাশের দেয়াল গেল ধসে, দেয়াল থেকে পড়ে মাথা ফাটালো তোতা মিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র ভোতা মিয়া। তবে ভোলা মিয়া ফাটা মাথা নিয়েই বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লো রাজুর উপর, তার কান্নাভেজা অভিযোগ, রাজু তাকে ঠেলা মেরে ফেলে দিয়েছে। লড়াইরত দুজনকে অনেক কষ্টে আলাদা করা হলো, সামান্য চড়-থাপ্পড় মেরে রাজুকে বাড়িতে আর ভোতা মিয়াকে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
তারপর? তারপর আর কি হবে, ইলিয়াস মিয়াকে চ্যাংদোলা করে কবরের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। তার পায়ের বাঁধন কিভাবে জানি খুলে গেছে, লাথি মেরে সে জামাল শেখের নাক ফাটিয়ে দিলো। জামাল শেখ নাক ধরে কঁকাতে লাগলো আর ভারসাম্য হারিয়ে পুরো দলটাই মাটিতে পড়ে গেল। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে পড়লো ইলিয়াস মিয়া, প্রাণপণ দৌড় লাগালো।
কিন্তু তৎপর গ্রামবাসীরা তাকে যেতে দেবে কেন? চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে ঝাঁপিয়ে পড়লো সবাই তার উপর, দেখে মনে হতে পারে গোরস্থানে রাগবি ম্যাচ হচ্ছে।
তারপর? তারপর আর কিইবা হতে পারে বলেন, হাত-পা বেঁধে ইলিয়াস মিয়াকে আবারো চ্যাংদোলা করা হলো। নাক চেপে কঁকিয়ে কঁকিয়ে পশু-পাখির নাম ধরে গালি-গালাজ দিতে থাকা জামাল শেখের জায়গা পূরণ করলো মোক্তার উদ্দিন। এবং তারা ইলিয়াস মিয়াকে টেনে-হিচড়ে বয়ে এনে কবরে ফেলে দিলো। অসহায় পশুর মত জান্তব আওয়াজ বের হতে লাগলো তার মুখ দিয়ে, চোখে তীব্র আতঙ্ক। উঠার চেষ্টা করলো সে, কিন্তু হাত-পা বাঁধা থাকায় কিছুই করতে পারলো না। তার আতঙ্কভরা চোখ আস্তে আস্তে ঢেকে যেতে লাগলো যখন গ্রামের লোকেরা মাটি ফেলে কবর ভরাট করা শুরু করলো। বেশ দ্রুতই কবর ভরাট হয়ে গেল যেনবা কেউ রিমোট কন্ট্রোলে ফাস্ট-ফরোয়ার্ড বাটন টিপেছে।
তো, ঠিক এইভাবে, হ্যা বন্ধুরা, এইভাবেই সমাধি ঘটলো ইলিয়াস মিয়ার ১৫ সেকেন্ডের ছোট, বোবা ও বধির যমজ ভাই ইস্রাফীল মিয়ার যে কিনা বড় ভাইয়ের মতই ভাগ্য পরিবর্তনে এখানে এসেছিল। ভাই যে ৫ দিন আগে মারা গেছে, এটা সে জানতোই না। তার লিখতে থাকা অসমাপ্ত ও অজগ্র কাটাকুটিতে ভরা চিরকুটটা, যা কিনা স্বপন ছিনিয়ে নিয়েছিল, মানুষের পায়ের চাপায় পিষ্ট ও ধূলো মলিন। কিন্তু তবুও তা পড়া যায়। সেখানে লেখা : আমি ইস্রাফীল মিয়া। ইলিয়াস মিয়ার যমজ…
লেখক: জাহিদ হোসেন