Saturday, April 20, 2024
Homeবাণী-কথানতুন পুতুল - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নতুন পুতুল – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অনধিকার প্রবেশ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এই গুণী কেবল পুতুল তৈরি করত; সে পুতুল রাজবাড়ির মেয়েদের খেলার জন্যে।

বছরে বছরে রাজবাড়ির আঙিনায় পুতুলের মেলা বসে। সেই মেলায় সকল কারিগরই এই গুণীকে প্রধান মান দিয়ে এসেছে।

যখন তার বয়স হল প্রায় চার কুড়ি, এমনসময় মেলায় এক নতুন কারিগর এল। তার নাম কিষণলাল, বয়স তার নবীন, নতুন তার কায়দা।

যে পুতুল সে গড়ে তার কিছু গড়ে কিছু গড়ে না, কিছু রঙ দেয় কিছু বাকি রাখে। মনে হয়, পুতুলগুলো যেন ফুরোয় নি, যেন কোনাকালে ফুরিয়ে যাবে না।

নবীনের দল বললে, ‘লোকটা সাহস দেখিয়েছে।’

প্রবীণের দল বললে, ‘একে বলে সাহস? এ তো স্পর্ধা।’

কিন্তু, নতুন কালের নতুন দাবি। এ কালের রাজকন্যারা বলে, ‘আমাদের এই পুতুল চাই।’

সাবেক কালের অনুচরেরা বলে, ‘আরে ছিঃ।’

শুনে তাদের জেদ বেড়ে যায়।

বুড়োর দোকানে এবার ভিড় নেই। তার ঝাঁকাভরা পুতুল যেন খেয়ার অপেক্ষায় ঘাটের লোকের মতো ও পারের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

এক বছর যায়, দু বছর যায়, বুড়োর নাম সবাই ভুলেই গেল। কিষণলাল হল রাজবাড়ির পুতুলহাটের সর্দার।

বুড়োর মন ভাঙল, বুড়োর দিনও চলে না। শেষকালে তার মেয়ে এসে তাকে বললে, ‘তুমি আমার বাড়িতে এসো।’

জামাই বললে, ‘খাও দাও, আরাম করো, আর সবজির খেত থেকে গোরু বাছুর খেদিয়ে রাখো।’

বুড়োর মেয়ে থাকে অষ্টপ্রহর ঘরকরনার কাজে। তার জামাই গড়ে মাটির প্রদীপ, আর নৌকো বোঝাই করে শহরে নিয়ে যায়।

নতুন কাল এসেছে সে কথা বুড়ো বোঝে না, তেমনিই সে বোঝে না যে, তার নাতনির বয়স হয়েছে ষোলো।

যেখানে গাছতলায় ব’সে বুড়ো খেত আগলায় আর ক্ষণে ক্ষণে ঘুমে ঢুলে পড়ে সেখানে নাতনি গিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে; বুড়োর বুকের হাড়গুলো পর্যন্ত খুশি হয়ে ওঠে। সে বলে, ‘কী দাদি, কী চাই।’

নাতনি বলে, ‘আমাকে পুতুল গড়িয়ে দাও, আমি খেলব।’

বুড়ো বলে, ‘আরে ভাই, আমার পুতুল তোর পছন্দ হবে কেন।’

নাতনি বলে, ‘তোমার চেয়ে ভালো পুতুল কে গড়ে শুনি।’

বুড়ো বলে, ‘কেন, কিষণলাল।’

নাতনি বলে, ‘ইস্‌‍! কিষণলালের সাধ্যি!’

দুজনের এই কথা-কাটাকাটি কতবার হয়েছে। বারে বারে একই কথা।

তার পরে বুড়ো তার ঝুলি থেকে মালমশলা বের করে; চোখে মস্ত গোল চশমাটা আঁটে।

নাতনিকে বলে, ‘কিন্তু দাদি, ভুট্টা যে কাকে খেয়ে যাবে।’

নাতনি বলে, ‘দাদা, আমি কাক তাড়াব।’

বেলা বয়ে যায়; দূরে ইঁদারা থেকে বলদে জল টানে, তার শব্দ আসে; নাতনি কাক তাড়ায়, বুড়ো বসে বসে পুতুল গড়ে।

বুড়োর সকলের চেয়ে ভয় তার মেয়েকে। সেই গিন্নির শাসন বড়ো কড়া, তার সংসারে সবাই থাকে সাবধানে।

বুড়ো আজ একমনে পুতুল গড়তে বসেছে; হু হল না, পিছন থেকে তার মেয়ে ঘন ঘন হাত দুলিয়ে আসছে।

কাছে এসে যখন সে ডাক দিলে তখন চশমাটা চোখ থেকে খুলে নিয়ে অবোধ ছেলের মতো তাকিয়ে রইল।

মেয়ে বললে, ‘দুধ দূয়া পড়ে থাক্‌‍, আর তুমি সুভদ্রাকে নিয়ে বেলা বইয়ে দাও। অত বড়ো মেয়ে, ওর কি পুতুলখেলার বয়স।’

বুড়ো তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘সুভদ্রা খেলবে কেন। এ পুতুল রাজবাড়িতে বেচব। আমার দাদির যেদিন বর আসবে সেদিন তো ওর গলায় মোহরের মালা পরাতে হবে। আমি তাই টাকা জমাতে চাই।’

মেয়ে বিরক্ত হয়ে বললে, ‘রাজবাড়িতে এ পুতুল কিনবে কে।’

বুড়োর মাথা হেঁট হয়ে গেল। চুপ করে বসে রইল।

সুভদ্রা মাথা নেড়ে বললে, ‘দাদার পুতুল রাজবাড়িতে কেমন না কেনে দেখব।’

দু দিন পরে সুভদ্রা এক কাহন সোনা এনে মাকে বললে, ‘এই নাও, আমার দাদার পুতুলের দাম।’

মা বললে, ‘কোথায় পেলি।’

মেয়ে বললে, ‘রাজপুরীতে গিয়ে বেচে এসেছি।’

বুড়ো হাসতে হাসতে বললে, ‘দাদি, তবু তো তোর দাদা এখন চোখে ভালো দেখে না, তার হাত কেঁপে যায়।’

মা খুশি হয়ে বললে, ‘এমন ষোলোটা মোহর হলেই তো সুভদ্রার গলার হার হবে।’

বুড়ো বললে, ‘তার আর ভাবনা কী।’

সুভদ্রা বুড়োর গলা জড়িয়ে ধরে বললে, ‘দাদাভাই, আমার বরের জন্যে তো ভাবনা নেই।’

বুড়ো হাসতে লাগল, আর চোখ থেকে এক ফোঁটা জল মুছে ফেললে।

বুড়োর যৌবন যেন ফিরে এল। সে গাছের তলায় বসে পুতুল গড়ে আর সুভদ্রা কাক তাড়ায়, আর দূরে ইঁদারায় বলদে ক্যাঁ-কোঁ করে জল টানে।

একে একে ষোলোটা মোহর গাঁথা হল, হার পূর্ণ হয়ে উঠল।

মা বললে, ‘এখন বর এলেই হয়।’

সুভদ্রা বুড়োর কানে কানে বললে, ‘দাদাভাই, বর ঠিক আছে।’

দাদা বললে, ‘বল্ তো দাদি, কোথায় পেলি বর।’

সুভদ্রা বললে, ‘যেদিন রাজপুরীতে গেলেম দ্বারী বললে, কী চাও। আমি বললেম, রাজকন্যাদের কাছে পুতুল বেচতে চাই। সে বললে, এ পুতুল এখনকার দিনে চলবে না। ব’লে আমাকে ফিরিয়ে দিলে। একজন মানুষ আমার কান্না দেখে বললে, দাও তো, ঐ পুতুলের একটু সাজ ফিরিয়ে দিই, বিক্রি হয়ে যাবে। সেই মানুষটিকে তুমি যদি পছন্দ কর দাদা, তা হলে আমি তার গলায় মালা দিই।’

বুড়ো জিজ্ঞাসা করলে, ‘সে আছে কোথায়।’

নাতনি বললে, ‘ঐ যে, বাইরে পিয়ালগাছের তলায়।’

বর এল ঘরের মধ্যে; বুড়ো বললে, ‘এ যে কিষণলাল।’

কিষণলাল বুড়োর পায়ের ধুলো নিয়ে বললে, ‘হাঁ, আমি কিষণলাল।

বুড়ো তাকে বুকে চেপে ধরে বললে, ‘ভাই, একদিন তুমি কেড়ে নিয়েছিলে আমার হাতের পুতুলকে, আজ নিলে আমার প্রাণের পুতুলটিকে।’

নাতনি বুড়োর গলা ধরে তার কানে কানে বললে, ‘দাদা, তোমাকে সুদ্ধ।’

ভাদ্র ১৩২৮

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments