Saturday, April 20, 2024
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পনিশির ডাক - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

নিশির ডাক – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

নিশির ডাক - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

আমরা তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। জায়গাটা কলকাতার কাছে হলেও বেশ গ্রাম-গ্রাম। পশ্চিমে গঙ্গা। সেদিকে সব মন্দির, বাগানবাড়ি, বাঁশ-বিচালির গোলা। পশ্চিম থেকে একটি মাত্র পিচ বাঁধানো রাস্তা পুবে বাসরাস্তার দিকে চলে গেছে। বাকি সব অলি-গলি, গলির গলি তস্য গলি। পাকা বাড়ি, সাবেক কালের বাড়ি অনেক ছিল, আবার সেইসঙ্গে ছিল, টিন, টালি, খড়ের চালা। বড়-বড় গাছ। নিম, তেঁতুল, বট, অর্জুন। জংলা অবসতি, বাগান। একটা বাগান ছিল সেখানে শুধু কুলগাছ। আমরা সেখানে শীতকালে কুল চুরি করতে যেতুম। হরি মালি তাড়া করলে, মার দৌড়। ধরবে কী করে, আমরা যে ছোট ছিলুম। হরিণের মতো দৌড়োতে পারতুম। কিছু না পেরে হরিদা চিৎকার করে বলত, ‘সরস্বতী পুজোর আগে কুল খাওয়া, দাঁড়া, মা কালীকে বলে দেব।’

সেই সময়ে একদিন আমাদের বন্ধুমহলে খবর রটে গেল, আজ রাতে নিশির ডাক বেরোবে। আজ অমাবস্যা। সেটা কী জিনিস! বিমানই এই গোপন খবরটা এনেছিল। সে সব জানে। বিমান। বললে, জমিদার অনাদি মল্লিকের এখন-তখন অবস্থা। অত বড় বাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি, ঘোড়ার গাড়ি। তাঁকে তো সহজে মরতে দেওয়া যায় না। ডাক্তার-বদ্যি সব জবাব দিয়ে গেছেন। তাই এই শেষ চেষ্টা। অন্যের পরমায়ু কেড়ে নিয়ে তাঁকে বাঁচানো হবে। এক তান্ত্রিক এসেছেন পশুপতিনাথ পাহাড় থেকে। সারা গায়ে তেল-সিঁদুর মেখে তিনি রাত বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে পথে বেরোবেন। হাতে থাকবে জলসমেত মুখ ভোলা একটা ডাব। তিনি পল্লিবাসী সকলের নাম ধরে ডাকতে থাকবেন একে একে। প্রত্যেকের নাম তিনবার করে ডাকবেন। যেই কেউ সাড়া দেবে, অমনি ডাবের খোলার মুখটা টপ করে চাপা দিয়ে দেবেন। অমনি তার প্রাণ ওই ডাবের জলে। আবদ্ধ হয়ে যাবে। ওই জল মল্লিকমশাইকে খাওয়ালে তিনি বেঁচে উঠবেন, আর এ মারা যাবে।

বিমান বললে, ‘খুব সাবধান! আজ আমরা সারারাত জেগে থাকব। ঘুমের ঘোরে ডাক শুনে সাড়া দিয়েছিস কি মরেছিস।’

‘পশুপতিনাথের তান্ত্রিক আমাদের নাম জানবে কী করে!’

‘এ-পাড়ার লোকই জানিয়ে দেবে। লিস্ট ধরিয়ে দেবে।’

বাড়িতে এসে মাকে খুব চুপিচুপি কথাটা বললুম। বাবা খুব কড়া মানুষ। ভূত, প্রেত, তন্ত্র, মন্ত্র। মানেন না। শুধু বলবেন, ‘অঙ্ক কষো, অঙ্ক। অঙ্কই জীবন, অঙ্কই ভগবান।’আর ওই অঙ্কটাই আমি পারি না। তা বাবাকে না বলে মাকে বললুম। তা ছাড়া মায়ের চেয়ে বড় বন্ধু মানুষের আর কে আছে!

মা খুব ভয় পেলেন। মায়ের ছেলেবেলায় এইরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। মা এইসব অলৌকিক ব্যাপার খুব বিশ্বাস করেন। সিঙ্গুরে একবার ভুলভুলাইয়া ভূত মাকে সারারাত জঙ্গলে ঘুরিয়েছিল। আধমাইল দূরে মায়ের বাড়ি, মা কিন্তু কিছুতেই পৌঁছোতে পারলেন না। ভুল রাস্তায় সারারাত চক্কর মারলেন।

সব শুনে মা বললেন, ‘আমরা তো জেগে থাকবই, তবে একজনকে নিয়েই আমার ভয়। সে তোর বাবা। যদি জানতে পারে সারারাত লাঠি হাতে রাস্তার রকে বসে থাকবে। এলেই পিটিয়ে শেষ। করে দেবে, তারপর যা হয় হবে। না জানানোই ভালো। সেখানেও ভয়, ঘুমের ঘোরে ডাক শুনে উত্তর দিয়ে দিলেই হয়ে গেল।’

আমি বললুম, ‘বাবার পাশে আমিই তো শুই। জেগেই থাকব। যদি দেখি উত্তর দিতে যাচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে মুখ চেপে ধরব।’

আমাদের রাত জাগার সব পরিকল্পনা প্রস্তুত। বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে গঙ্গার ধারের বটতলায়। বসে ওই একই আলোচনা হল। সন্ধে হব-হব, বাড়ি ফিরে এলুম। চারপাশ এরই মধ্যে কেমন যেন থমথম করছে। কালীবাড়িতে অমাবস্যার রাতের পুজোর আয়োজন হচ্ছে দেখে এসেছি। অন্য অমাবস্যায় আমরা বন্ধুরা গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি-ভোগ খাওয়ার লোভে ঠিক হাজির হয়ে যেতুম। সে রাত বারোটাই হোক, একটাই হোক। আজ আর কোনও বেরোনো-টেরোনো নয়। টাইট হয়ে বসে থাকো বাড়িতে।

অমাবস্যার রাত অন্ধকার হয় ঠিকই, তবে আজ যেন আলকাতরারাত। ঘরের জানলায় আকাশটা আটকে আছে, মনে হচ্ছে ওইখানেই শেষ। ওর পরে আর কিছু নেই, মাথা ঠুকে যাচ্ছে। তারাগুলো যেন আগুনের মতো জ্বলছে ধকধক করে। রাস্তাতেও আজ যেন তেমন লোক চলাচল নেই। রাত ন’টার আগেই সব যেন নিঝুম মেরে গেল। দোকানপাট বন্ধ। মিষ্টির দোকানের পেছন দিকে হেঁচা বেড়ার দরজাটা খোলা। মাঠে আলো পড়েছে। মজা পুকুর। কচু গাছের ঝোপ। কালো কুকুরটা কড়ার চাঁছি খাওয়ার লোভে সামনের থাবায় মুখ রেখে বসে আছে। এই সবই আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের রান্নাঘরের জানলায় বসে।

রাত দশটার সময় মা বললেন, ‘দেখছিস পলাশ, আজ এরই মধ্যে ঘুমে শরীর যেন ভারী হয়ে আসছে। তোর কিছু মনে হচ্ছে না?

‘মনে হচ্ছে না আবার! ইতিহাস পড়ছিলুম, এমন টুল ধরল, মাথাটাটাই করে দেয়ালে ঠুকে গেল। তাই তো জানলায় এসে বসে আছি।’

‘বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা! সারা পাড়াটাকে মন্ত্রের প্রভাবে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে আস্তে আস্তে।’

‘কীভাবে করে মা?’

‘আমি জানি। খুব একটা উঁচু জায়গায় উঠে বিশাল একটা ধুনুচিতে আগুন জ্বালিয়ে ধুনো দিতে থাকে। তার সঙ্গে মন্ত্র। যেদিকে বাতাস সেই দিকে ধোঁয়াটা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মানুষের শরীর ভারী হয়। ঘুম পায়। বেশ একটা সুখ সুখ লাগে। এই সুখের মধ্যে থেকেই একজন চলে যায়।’

‘এর হাত থেকে বাঁচার উপায়?

‘আমার জানা আছে। লঙ্কা পোড়া। দাঁড়া, চাটুতে কয়েকটা লম্বা পোড়াই। সব প্রভাব কেটে যাবে।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িসুদ্ধ সবাই হাঁচি আর কাশিতে অস্থির। আমাদের পুসিটা একপাশে। থুপপি মেরে ঘুমোচ্ছিল। ফিচ-ফিচ করে হাঁচতে-হাঁচতে উঠে বসল। অবাক হয়ে গেছে। রাত। দশটার সময় এ আবার কী! বাবা বাইরের ঘর থেকে ছুটে এলেন, ‘কী করছ কী তুমি! এর পর লোকে যে থানায় ডায়েরি করবে আমাদের নামে।’

মা শুধু গম্ভীর মুখে একটা কথাই বললেন, ‘যা করছি সবই জীবের মঙ্গলের জন্যে।’

‘এর চেয়ে অমঙ্গল আর কী হতে পারে!’ বলে, বাবা উদ্দাম কাশতে কাশতে পালিয়ে গেলেন। মন্দিরে অমাবস্যার রাতের পুজো শুরু হয়ে গেছে। কাঁসর, ঘণ্টা, জগঝম্পের শব্দ ভেসে আসছে।

রাত এগারোটার সময় রোজ যেমন আমরা শুয়ে পড়ি, সেই রকমই শোয়া হল। আলো-টালো সব নিভে গেছে। এক বিছানায় বাবা আর আমি পাশাপাশি। আর-এক বিছানায় মা। দোতলার ঘর। ঠিক নীচেই রাস্তা। গরমকাল। জানলা-টানলা সব ভোলা। বাবার শ্বাসপ্রশ্বাস যেই বড় হল, মা মশারির ভেতর থেকে ফিশফিশ করে ডাকলেন, ‘পলাশ!’

‘সব ঠিক আছে মা।’

বাবা পাশ ফিরলেন। আমরা দুজনেই চুপ করে গেলুম। মন্দিরের আরতি শেষ। রাত নিঝুম। কোথাও একটা কুকুরও আজ ডাকছে না। শুধু দেয়াল ঘড়ির ঠকাস-ঠকাস শব্দ। টাং করে একটা বাজল। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। আর বোধহয় জেগে থাকতে পারলুম না। আমাকে সাবধান করে মা নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। জোরে-জোরে নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি। ভীষণ ভয় করছে। আমার।

রাত দেড়টা। আজ আর বোধহয় নিশি বেরোল না। সবটাই গুজব। এমনও হয় নাকি! এই সব ভেবে সবে পাশ ফিরে শুয়েছি, এমন সময় দূরে কোথাও চিং করে একটা শব্দ হল। আমার কান খাড়া। বিছানায় আধশোয়া। গম্ভীর গলায় কে টেনে-টেনে সুর করে ডাকছে, ‘অনাথ, অনাথ।’ তিনবার। পরের নাম, ‘দীনবন্ধু, দীনবন্ধু।’ গলাটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে ডাকতে ডাকতে।

আমাদের বাড়ির সামনে। বাবার নাম ধরে ডাকছে, ‘হরিশঙ্কর, হরিশঙ্কর।’ আমার হাত বাবার ঠোঁটের কাছে। তেমন হলেই চেপে ধরব।

খুব ইচ্ছে করছে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি। ভীষণ উত্তেজনা হচ্ছে। বাবাকে ছেড়ে উঠতে পারছি না তাই। ডাকটা ক্রমশই গঙ্গার দিকে চলে যাচ্ছে, ‘কানাই, কানাই, বনমালী, বনমালী, হারাধন, হারাধন।’ শেষে আর শোনা গেল না। বাতাসের শাঁ-শাঁ শব্দ। গঙ্গায় শেষ রাতের। স্টিমারের ভোঁ। ডাকটা কি আবার এদিকে ঘুরে আসবে! এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।

পরের দিন বেশ বেলায় ঘুম ভাঙল। বাইরের রাস্তায় লোকজন, হইচই। রাতের অত বড় ঘটনার কোনও চিহ্নই পড়ে নেই। আরও একটু বেলা বাড়তেই পবিত্রদের বাড়ি ছুটে গেলুম। ওইখানেই আমাদের আড্ডা বসে। তারপর ওইখান থেকেই কোমরে গামছা বেঁধে আমরা গঙ্গায় গিয়ে পড়ি।

সেদিন আর কোনও আলোচনা নয়। একটাই বিষয়, নিশির ডাকে কেউ কি সাড়া দিয়েছিল! না, নিশি ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছিল! আমরা অনুসন্ধানে বেরোলুম। ডেকে ডেকে জিগ্যেস তো করা যায় না, কে মারা গেছে। যেন কিছুই হয়নি, এইভাবে ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে।

এ পাড়া-সে পাড়া, এ গলি-সে গলি ঘুরছি আমরা। জীবন স্বাভাবিক। কোথাও কিছু নেই। তার মানে সব বাজে। কোনও এক পাগলের কীর্তি। বিমান আবার সাহস করে দোতলার বারান্দা। থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে নিশি দেখেছে। বেঁটেখাটো, চারচৌকো, জটাজুটধারী একটা জীব। দগদগে লাল। বেলুনের মতো রাস্তার এক হাত ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে। শেয়ালের মতো কণ্ঠস্বর, নিতাই, নিতাই।’

পাড়ার শেষ মাথায় রাস্তার কলে দাঁড়িয়ে দুজন কাজের মেয়ে বলাবলি করছে, কুলবাগানের হারু কাল শেষ রাতে হঠাৎ মারা গেছে। রাতে খাঁটিয়া পেতে দাওয়ায় শুয়েছিল। সুস্থ-সবল একটা মানুষ। অসুখ নেই, বিসুখ নেই। সকালে দেখা গেল বিছানায় মরে পড়ে আছে!

ছোট-ছোট। হারুদার কুলবাগান। গাছের পর গাছ। গোল গোল পাতার ফাঁক দিয়ে নেমে আসছে প্রখর সূর্যের আলো। ছায়া আছে, তবে কেমন যেন শুকনো ছায়া। মাঝখানে একটা কুঁড়েঘর। খবর পেয়ে কিছু লোকজন এসেছে। খাঁটিয়ায় চিত হয়ে পড়ে আছে আমাদের হারুদা। চেহারাটা কাগজের মতো ফ্যাকফ্যাকে সাদা। সবাই বলাবলি করছে, হার্ট অ্যাটাক।

একমাত্র আমরাই জানি ব্যাপারটা কী! রাত দুটোর সময় মৃত্যুর কণ্ঠস্বর—’হারুউ হারুউ।’ আধো ঘুম, আধো জাগরণে একটি উত্তর—’যাই’। খপ করে ডাবের খোলার মুখ বন্ধ।

এখন ভাবি, এমনও হয়! কিন্তু তার পরে অনাদি মল্লিক আরও অনেকদিন বেঁচে থেকে শেষে আত্মহত্যা করেছিলেন।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments