Saturday, April 20, 2024
Homeরম্য গল্পমজার গল্পকালো সায়েব - লীলা মজুমদার

কালো সায়েব – লীলা মজুমদার

কালো সায়েব - লীলা মজুমদার

আমার বাবার কাছে গল্প শুনেছি ঠাকুরদা যখন ছোট ছিলেন, তখন আমাদের দেশে বাঘ-বাঘেল্লা গিজগিজ করত। বাঘ বলতে চকরা-বকরা চিতে নয়। তাকে ওদেশের লোকে বাঘ বলেই স্বীকার করত না। বলত নাকি বিল্লি, বড় জোর মেকুর। বাঘের গায়ে হলুদ-কালো ‘ডুরা’ কাটা থাকে।

বাবারা যেখন ছোট ছিলেন তখন আর বিশেষ বাঘটাগ দেখা যেত না। খালি একবার দেখেছিলেন, সে গল্প আগেও বলেছি। এবার বিস্তারিত শুনুন। বড় জ্যাঠামশাই সারদারঞ্জন কলকাতায় অধ্যাপনা করেন, ছুটিছাটায় দেশে যান। ছোট পিসিমা বাবা আর ছোট জ্যাঠা মসূয়াগ্রামে ঠাকুমার কাছে থাকেন। বাবাকে সামলাবার জন্য একজন ষন্ডামতো চাকরও থাকে।

পুজোর আগে বাবারা অস্থির, ‘ঠাকুরদা কবে আইব?’ ঠাকুরদা মানে বড়দা, আসল ঠাকুরদা নয়, আশাকরি সেটা বলে দিতে হবে না। ওখানকার ডাকগুলি বড় মিষ্টি ছিল। বড়দা মেজদা সেজদা ন-দা ছোড়দা নয়। ঠাকুরদা, সোনাদা, সুন্দরদা, ধনদা, ফুলদা ইত্যাদি। তবে ছোটপিসিমা বাবাকে ফুলদা না বলে শম্ভুয়া বলেই ডাকতেন শুনেছি।

সে যাই হোক, শেষটা একদিন ঠাকুরদা আর সুন্দরদা তো আইলেন। সঙ্গে নতুন কাপড়, জামা, জুতো, মিষ্টি, হকি-স্টিক, নতুন ফুটবল ইত্যাদি। কিন্তু ‘ঠাকুরদা’র বড্ড বেশি কড়া শাসন। নতুন জিনিসগুলো পুরনো হবার আগেই ছোট ভাইরা বুলি ধরল, ‘মা ঠাকুরদা কবে যাইব?’

সুখের বিষয়, এই সময় ঠাকুরদা ওঁদের মাছ ধরতে, কাছিম মারতে আর শেয়াল শিকার করতে নিয়ে যেতে লাগলেন। ফাঁদ পেতে শেয়াল আর খরগোশ ধরা হত। গ্রামের লোকরা মহা খুশি। শেয়ালে বাঙি খেয়ে যায়। বাঙি হল গিয়ে ফুটি। খরগোশে শাকসবজি নষ্ট করে। একদিন সকালে কেউ উঠবার আগে, ফাঁদ দেখতে গিয়ে বাবা আর ছোট জ্যাঠা দেখেন, ফাঁদের সমস্তটা জায়গা জুড়ে, খরগোশের বদলে গোঁফ ফুলিয়ে বাঘ মশাই বসে আছেন। এর আগে এত কাছে থেকে ‘ডুরা’ কাটা বাঘ বাবারা কখনও দেখেননি। কথাটা ঠাকুমার কানে যেতেই ফাঁদ পাতা বন্ধ হল।

আমাদের ছোটবেলায় গল্প শোনা মানেই ছিল রামায়ণ মহাভারতের গল্প, মসূয়ার নানা গল্প, কিংবা জরিপের কাজে বাবার বনে বনে ঘোরার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। মাঝে মাঝে অন্যরাও চমৎকার গল্প বলতেন। মেজজ্যাঠার জামাই অরুণ চক্রবর্তী আগে ছোটনাগপুরের বন্য অঞ্চলের কাছাকাছি নানা জায়গায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদে ছিলেন। জামাইবাবুর বন্ধুবান্ধবরা বেজায় গল্পে ছিলেন। জামাইবাবু আবার সেসব গল্প আমাদের বলতেন। তার একটা বলি।

ওঁদের এক সায়েব-প্যাটার্নের সহকর্মী ছিলেন। তাঁকে সবাই কালা সায়েব বলত। ট্যুরে বেরোলেই তিনি এমন সব জায়গা বেছে রাত কাটাবার চেষ্টা করতেন যেখানকার বাবুর্চির ভাল রাঁধিয়ে বলে সুনাম। সরকারি ডাকবাংলোয় সাধারণত এরকম লোক মজুত থাকত। তাই আত্মীয়স্বজন কি বন্ধুবান্ধব থাকলেও, তাদের এড়িয়ে উনি ডাকবাংলোতেই উঠতেন।

সেকালে মোটর গাড়ির এত চল ছিল না। সায়েব-সুবোরা ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতেন। চমৎকার সব ঘোড়াও দেখা যেত। বলাবাহুল্য কালা সায়েবেরও ঘোড়া ছিল। একবার ওইরকম ট্যুরে বেরিয়ে, সেদিনের কাজ সেরে দেখলেন সূর্য পাটে নেমেছেন।

ছোট শহর; পাশে বন; তার উপকণ্ঠে সুন্দর ডাকবাংলো। পেছনে আমবাগান। চৌকিদার বাবুর্চি থাকার কথা। অথচ হাঁকডাক করে কারও সাড়া পাওয়া গেল না। একটা ন্যাংটো ছোকরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল। তাকে তাড়া দিতেই সে ছুটে গিয়ে চৌকিদার বাবুর্চিকে ডেকে আনল। আমবাগানের পেছনে তাদের কোয়ার্টার।

তারা এসেই সায়েবকে ভাগাবার চেষ্টা করতে লাগল। পুরনো ডাকবাংলো, নড়বড়ে দরজা-জানলা, ধারেকাছে জনমানুষ নেই, জায়গা খারাপ, কেউ এখানে রাত কাটায় না ইত্যাদি। মাত্র দু’মাইল এগিয়ে গেলেই ছেত্রীর হোটেলে চমৎকার ব্যবস্থা পাবেন। দোতলা বাড়ি, বামুন-ঠাকুর, লোকজনের আলাদা ঘর, আস্তাবল। সায়েব বললেন, ‘আমার ঘোড়া আর লোকজন হয় গ্রামে থাকবে, নয় তোমাদের কোয়ার্টারে। আমি সরকারের কর্মচারী, এখানেই থাকব। ভাল চাও তো ঘরদোর খোলো। চিমনি জ্বালো, বড্ড শীত। রাতে ঘি-ভাত আর মুরগির কারি বানাও। বেশি কথা বলো না। আমি ভূতটুতে বিশ্বাস করি না। আগে গরম জল লে আও।’

কড়া মেজাজ দেখে সবাই চটপট কাজে লাগল। সব ব্যবস্থা হল। লোকজন ঘোড়া-সহ চলে গেল। বসবার ঘরের চিমনিতে কাঠের আগুন জ্বলল। স্নানের ঘরে গরম জল পৌঁছল। রান্না চড়ল। তার আগে চা বিস্কুট হল।

রান্নাও দেখতে দেখতে হয়ে গেল। মনে হল চৌকিদার, বাবুর্চি কাজ সেরে চলে যেতে পারলেই বাঁচে। সবই ভাল, খালি ঘরে কেমন একটা সোঁদা-সোঁদা গন্ধ। হয়তো এরা সবাইকে ভাগায়। ঘরদোর খোলেই না।

সাড়ে সাতটায় চমৎকার ডিনার খাওয়াল বাবুর্চি। আটটার মধ্যে খাওয়া শেষ। সঙ্গে সঙ্গে ধোয়া-পাকলা, দরজা-জানলা বন্ধ, ছিটকিনি দেওয়া, সব সারা।

লণ্ঠন হাতে চৌকিদার বাবুর্চি এসে বলল, ‘সায়েব তা হলে শুয়ে পড়ুন। আমরা রান্নাঘরের দরজার বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাচ্ছি। সকালে সাড়ে ছটায় চা দেব।’ সায়েব বললেন, ‘তোমরা যাও। আমি চিমনির ধারে বসে কিছু রিপোর্ট লিখব। পরে শোব।’

ওরা এ-ওর দিকে চেয়ে বলল, ‘সত্যি বলছি, এঘর ভাল নয়। আপনি শোবার ঘরে গিয়ে কাজ করুন। আমাদের কথা শুনুন। ওঘরেও আংটায় আগুন দিয়েছি।’ কিন্তু সায়েব কোনও কথাই শুনলেন না। ওদের ভাগিয়ে দিয়ে, চিমনির পাশে কৌচে শুয়ে কাগজপত্র দেখতে লাগলেন। পেট ভরে খেয়ে, আরামে গরমে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লেন, নিজেই টের পেলেন না।

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখেন, তেল ফুরিয়ে লম্প নিবে গেছে। চিমনির কাঠ পুড়ে কয়লা। তারই সামান্য আলোতে দেখা যাচ্ছে চিমনির সামনে গালচের ওপর হলুদ-কালো ডোরা কাটা একটা গালচে না কী যেন পড়ে আছে। ঘরের সেই সোঁদা গন্ধটা বেজায় বেড়ে গেছে। আধা অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতেই সায়েব আঁতকে উঠলেন। চিমনির সামনে ও যে মস্ত বাঘ! থাবার ওপর মুখ রেখে ঘুমোচ্ছে!

মিছিমিছি পনেরো বছর হকিমি করেননি সায়েব। সঙ্গে সঙ্গে কৌচের অন্য দিক দিয়ে নেমে, চটি টটি ফেলে রেখে, এক দৌড়ে ওধারে শোবার ঘরে ঢুকে, দরজায় খিল দিতে তাঁর এক মিনিটও লাগল না। বুকটা ঢিপঢিপ করছিল। ও কি সত্যি বাঘ, না আর কিছু?

আশ্চর্যের বিষয়, দাঁত কপাটি থামলে ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে খাবার ঘরে পেয়ালা পিরিচের টুংটাং শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ধূমায়িত চা এল। চানের ঘরে গরম জল এল। চান করে তৈরি হয়ে, চমৎকার ব্রেকফাস্টও পেলেন। লোকজনেরা ঘোড়া নিয়ে এসে গেল।

চৌকিদার বাবুর্চির পাওনা চুকিয়ে, চলে যাবার আগে সায়েব বললেন, ‘কাল রাতে এঘরে কে এসেছিল? এ কার চুল?’ এই বলে মাটি থেকে এক গুছি হলুদ-কালো, লম্বা লোম তুলে দেখালেন। অমনি তারা দুজনে ওঁর পায়ে পড়ল।

‘সায়েব, ওর কথা রিপোর্ট করলে, হেডকোয়ার্টার থেকে শিকারি এসে ওকে গুলি করে মেরে ফেলবে। কাউকে কিছু বলে না ও। গরমকালে ওর দেখাও পাওয়া যায় না। এখন বুড়ো হয়েছে, দাঁতগুলো গেছে, শীতের রাতে বনে ওর বড় কষ্ট হয়। তাই বাসন-ধোয়ার ঘরের জানলা খুলে রাখি। রাতে এসে শুয়ে থাকে, তাড়ালেও যায় না।’

এই বলে তারা হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল। সায়েব বললেন, ‘কী জ্বালা! বাঘ এসে তোমাদের ঘরে রাত কাটাবে, তাতে আমার কী!’ এই বলে ঘোড়ায় চেপে রওনা হয়ে গেলেন।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments