Friday, April 19, 2024
Homeরম্য গল্পমজার গল্পহতে পারে - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

হতে পারে – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

হতে পারে - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

নেপাল থেকে এসেছেন মস্ত বড় এক যোগী। দু-হাতে ছটা ছটা বারোটা আঙুল। দু-পায়েও তাই। উচ্চতা সাড়ে চার ফুট। গোল পিপের মতো চেহারা। গায়ের রং ছাই ছাই। চোখে রঙিন চশমা। যোগী বলে পরিচয় না দিলে আমেরিকান ছবির গুন্ডা বলে মনে হতে পারে।

আশেপাশে কোনও ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন মহাপুরুষের আবির্ভাব হলে সাধারণ মানুষের মনে বড় আশা জাগে। ইদানীং জীবনধারণ করতে গিয়ে হাতের বাহুতে কবচের মতো একটি সত্য আমাদের গলায় ঝুলে গেছে। সত্যটি হল, আমাদের কিছু করার নেই, যা করার সবই গ্রহরা করছে। যেমন করাচ্ছে তেমনি করছি, যেমন করাবে তেমনি করব! গ্রহ আমাদের কন্ট্রোলে নেই। এ তো রেশনের চাল ডাল গম আটা নয় যে, মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকবে! আজ বাসমতী তো কাল দুর্বাসমতী। আজ পাঞ্জাব গম তো কাল বাংলা গম।

কোষ্ঠী ছকে গ্রহদের জলসা। তারা কী গান গাইবে আমরা জানি না। জানেন জ্যোতিষীরা। তিনি জানেন। আমরা জানি। আর মন খারাপ করে বসে থাকি। মাঝেমধ্যে বটের শিকড়, অশ্বথের জটা, বনচাঁড়ালের ডাল, নারকেলের ছাল, গন্ডারের নাক, চেয়ারের হাতলের কাঠের টুকরো, তামার পয়সা, জুতোর পেরেক, ঘোড়ার নাল পরে গ্রহদের চক্রান্ত ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। যাঁদের পয়সা বেশি তাঁরা হিরে, মুক্তো, চুনি, পান্না পরে লড়াই করার চেষ্টা করেন। যুদ্ধ দু রকমের। এক হল পেঁয়ো যুদ্ধইট, পাটকেল, তির, ধনুক, গুলতি, বালতি নিয়ে। আর এক হল আধুনিক যুদ্ধ স্টেনগান, ব্রেনগান, মিসাইল, অ্যাটম বোমা নিয়ে।

কিন্তু কোনও যোগীর কৃপাদৃষ্টিতে মানুষের জীবন ভেলভেট হয়ে যেতে পারে। একবার কপালে আঙুল ছুঁইয়ে কিংবা মাথায় হাত বুলিয়ে জীবনের সব চড়াই উতরাই সমান করে দিতে পারে। মনে আছে কৃষ্ণ কুজাকে সোজা করে দিয়েছিলেন, রামচন্দ্র পা ঠেকিয়ে অহল্যাকে উদ্ধার করেছিলেন। যোগীদের নানা কীর্তি-কাহিনি নিয়ে ইয়া মোটা মোটা সব বই আছে। পড়লে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। ড্রয়ারে কুড়িটা ঘুমের ট্যাবলেট রেডি রেখেও মনে হয়, আহা আরও কিছুকাল বেঁচে থাকা যাক।

সন্ধের আবছা অন্ধকার। নীল আলো। ধূপের ধোঁয়া। যোগী বসে আছেন রেশমের চাদর ঢাকা নরম বিছানায়। বাইরে প্রচুর দর্শনার্থী। জট পাকিয়ে বসে আছেন। একজন, দুজন মাঝে-মধ্যে। দর্শনলাভে ধন্য হয়েছেন। খোঁটা ধরে যাঁরা আসছেন তাঁরাই আগেভাগে ঢুকতে পারছেন। যাঁদের খোঁটা নেই তাঁরা ফ্যা ফ্যা করছেন। আমি রাশুকে ধরেছি। রাশু হল স্থানীয় নেতা। পুডিং-এ যেমন ছুরি চালাতে জানে, খুঁড়িতেও তেমনি অনায়াসে ছুরির কায়দা দেখাতে পারে। রাশু আমাকে। একটু অন্য চোখে দেখে, কারণ আমার মেয়েটি বড় হয়েছে এবং সুন্দরী। তার মানে এই নয় যে রাশু আমার জামাই হবে। রাশুর অনুমতি বা উপদেশ ছাড়া আমার জামাই যাতে কেউ না হতে পারে, রাশু তাই চোখে চোখে রেখেছে। মেয়ের খাতিরে আমার খাতির। যেমন জামাইয়ের পয়সায় শ্বশুরের তীর্থভ্রমণ।

যোগীরাজ মাখনের মতো মোলায়েম হেসে বললেন, রামনাথ সুখ দায়ী। আগে মানুষ মরে ভূত হত, এখন ভূত হয়ে মরে। হেরে ভূত হওয়া বলে একটা কথা শুনেছ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

জীবনের সর্বক্ষেত্রে হারতে হারতে ভূত হয়ে একদিন মরে যাওয়া। ভূতের মুখে সেই রামনামটি বলিয়ে দিয়ে ভূতের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ।

হারতে তো চাই না প্রভু! আমি যে জিততেই চাই।

ওইটাই তো তোমার দুঃখের প্রধান কারণ। হারতে হারতে হারা-মনটাকে শেষ করে দে একেবারে। হারতে তোমাকেই হবেই। যেমন মরতে তোমাকে হবেই।

প্রভু বড় ভয় পাই। ভয়ে ভয়েই আধমরা। কোনও কিছু আমি সহজে পাই না। সহজে হয় না। সবসময় বাধা। কী করলে জীবনটা একটু সহজ হবে? কোনও কবচ, কোনও স্টোন, শেকড় কিংবা মাদুলি।

ওসব কিস্যুই কিস্যু নয়। বসে বসে শুধু লিস্টি করো। তোমার জীবনে কী কী হতে পারে। যেমন ধরো, তোমার চাকরি চলে যেতে পারে। চাকরি চলে গেলে অভাব আসতে পারে। অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়ে তুমি অসৎ পথে চলে গিয়ে চোর-ছ্যাঁচোড় হয়ে যেতে পারো, লোক ঠকাতে পারো, ধোলাই থেকে জেল সব কিছুই হতে পারে। আচ্ছা, জেলে গেলে কী হতে পারে? তোমার পরিবার-পরিজন লজ্জায় তোমার নাম মুখে আনতে পারবে না। বেইজ্জতির একশেষ। কেউ দয়া করে তাদের। বাঁচিয়ে রাখতে পারে। কোনও দূর আত্মীয় কিংবা কোনও প্রতিবেশী অথবা তোমার কোনও বন্ধু, তোমার স্ত্রী সুন্দরী হলে, তোমার তেমন তেমন হলে, উপকার করার ছলে এগিয়ে এসে ফাইনালি ফাঁসিয়ে দিয়ে সরে পড়বে। এর ফলে তোমার উত্তরপুরুষের মঙ্গলই হবে। তারা বুঝতে পারবে, জগৎ হল ভাঙাও আর ভেঙে যাও। নাচাও আর নেচে যাও। মূলধন হল লোভ আর লালসা।

লোভের সামনে শিকার হয়ে গলায় গামছা দিয়ে প্রাপ্য বুঝে নাও। আর একটু বুদ্ধিমান হলে খেলে যাও, খেলিয়ে যাও। গাধার নাকের সামনে খুড়োর কলের মতো গাজর ঝুলিয়ে কাজ হাসিল করতে থাকো। জীবন হল জুয়া। এই জ্ঞান যত তাড়াতাড়ি হয়ে যায় ততই ভালো। বেদান্তও বলছে, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। তুমি কে, কে তোমার, এই হল শ্রেষ্ঠ জ্ঞান।তারপর ধরো তোমার ক্যানসার হতে পারে। ক্যানসার হলে বৃথা সারাবার চেষ্টা করবে না। ক্যানসার সরায়, সারে না। তোমার স্ত্রী উন্মাদ হতে পারে। তোমার ছেলে বখে যেতে পারে, মেয়ে প্রেম করে ভেগে যেতে পারে। তোমার পক্ষাঘাত হতে পারে। যা যা হতে পারে লিস্ট করো আর মনে করো একে একে সেইসব হয়ে চলেছে। উপনিষদ বলছে, ভয়কে মেরে অভী হলেই কেল্লামাত।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments