Saturday, April 20, 2024
Homeকিশোর গল্পগণশার চিঠি - লীলা মজুমদার

গণশার চিঠি – লীলা মজুমদার

লীলা মজুমদার

ভাই সন্দেশ, অনেক দিন পর তোমায় চিঠি লিখছি। এর মধ্যে কত কী যে সব ঘটে গেল যদি জানতে, তোমার গায়ের লোম ভাই খাড়া হয়ে গেঞ্জিটা উঁচু হয়ে যেত, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসত, হাঁটুতে হাঁটুতে ঠকঠক হয়ে কড়া পড়ে যেত!

আজকাল আমি মামাবাড়ি থাকি। আমার মনে হয় ওঁরা কেউ ভালো লোক নন। এঁদের মধ্যে মাস্টারমশাই তো আবার ম্যাজিক জানেন। আমি ম্যাজিক করতে দেখিনি, কিন্তু মন্দা বলেছে ওর ইস্কুলে বছরের প্রথম প্রথম মেলাই ছেলেপুলে থাকে, আর শেষের দিকে গুটিকতক টিমটিম করে। এদিকে মাস্টারমশাইয়ের ছাগলের ব্যাবসা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ কিন্তু বাবা সুবিধের কথা নয়। ছেলেগুলো যায় কোথা? মাস্টারমশাইয়ের চেহারাটাও ভাই কীরকম যেন! সরু-ঠ্যাং পেন্টেলুন উনি কক্ষনো ধোপর বাড়ি দেন না। সাদা-কালো চৌকোকাটা কোট পরছেন তে পরছেনই! আবার চুলগুলো সামনের দিকে খুদে খুদে, পিছনের দিকে লম্বা মতন, মধ্যিখানে দাঁড় করানো! মাঝের গোঁফ বেঁটেখাটো, পাশের গোঁফ ঝুলে ঝুলো! ওঁর জুতোগুলো কে জানে বাব কীসের চামড়া, কীসের তেলে চুবিয়ে, কীসের লোম দিয়ে সেলাই করা! ও বাবাগো, মাগো! ইচ্ছে করে ওঁর ইস্কুলে কে যাবে! মান্‌কে স্বচক্ষে দেখেছে, প্রথম সপ্তাহে ঘরের ভিতর সাতটা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে, আর ঘরের বাইরে দুটো ছাগল নটে চিবুচ্ছে; মাস্টারমশাই গা নাচাচ্ছেন!পরের সপ্তাহে মাকে আবার দেখেছে ঘরের ভিতর ছটা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে আর ঘরের বাইরে তিনটে ছাগল নটে চিবুচ্ছে; মাস্টারমশাই জিভ দিয়ে দাঁতের ফোকর থেকে পানের কুচি বের কচ্ছেন। আবার তার পরের সপ্তাহে হয়তো দেখবে ঘরের ভিতর পাঁচটা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে, আর ঘরের বাইরে চারটে ছাগল নটে চিবুচ্ছে; মাস্টারমশাই সেফটিপিন দিয়ে কান চুলকোচ্ছেন! শেষটা হয়তো ঘরের দরজায় তালা মারা থাকবে, আর ঘরের বাইরে ন-টা ছাগল নটে চিবিয়ে দিন কাটাবে! মাস্টারমশাই খাড়ায় শান দেবেন!

তা ছাড়া সেই যে বিভু আরশুল্লা পুষত, এবার গুবরেপোকাও খেয়েছিল, সে বলেছে সে দেখেছে– মাস্টারমশাইয়ের বাস্কে হলদেটে তুলোট কাগজে লাল দিয়ে লেখা খাতা আছে, সে লাল কালিও হতে পারে, অন্য কিছুও হতে পারে! ওঁর লেবু গাছে মাকড়সারা কেন জানি জাল বোনে না; পেঁপে গাছে সেই গোল-চোখ চকচকে জন্তু নেই, দেয়ালে টিকটিকি নেই। একটা হতে পারে মাস্টারমশাইয়ের রোগা গিন্নি মোটা বাঁশের ডগায় ঝটা বেঁধে দিনরাত ওত পেতে থাকেন। কিন্তু কিছু বলা যায় না! মন্দা তো ওবাড়ি কোনোমতেই যায় না, মেজোও বাড়ির ছায়াটি মাড়ায় না, আর ছোটো ছেলে ধনা, তার তোওবাড়ির হাওয়া গায়ে লাগলেই সর্দি কাশি হয়ে যায়। রামশরণ পর্যন্ত বাড়ির কুল খায় না, গুঁড়িয়ার মা শজনেডাঁটা নেয় না!

মা কিন্তু ওদের কুমড়োডাঁটা দিব্যি খান; আর বড়োমামা তো ওঁরই দাদা, ওই একই ধাত! ওঁরা চমৎকার গল্প বলতে পারেন, কিন্তু ভূত কী ম্যাজিক, কী মন্তর-পড়া এসব একেবারে বিশ্বাস করেন না! কে জানে কোনদিন হয়তো কানে ধরে ওইইস্কুলেই আমাকে ভরতি করে দেবেন, আর শেষটা কি সারাজীবন ব্যা-ব্যা করে নটে চিবুবঃ ইস্কুল থেকে ফিরতে দেরি দেখে বড়োমামা হয়তো চটি পায়েই খোঁজ নিতে গিয়ে দেখবেন, পাথরের উপর শিং ঘষে শান দিচ্ছি! কেঁউ কেঁউ, ফেঁৎ ফোৎ!– কান্না পেয়ে গেল ভাই।

অ্যাদ্দিনে তোমায় লিখছি ভাই, আর হয়তো লেখা হবে না। দিব্যি টের পাচ্ছি দিন ঘনিয়ে আসছে। বড়োমামা যখন-তখন আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গোঁফের ফাঁকে বিশ্রী ফ্যাচরফ্যাচার হাসেন। বুঝছি গতিক ভালোনয়। দু-একবার তিন তলার ছাদে গিয়ে ব্যা-ব্যা করে ডেকে দেখেছি, সে আমার ঠিক হয় না। কেউ যখন দেখছে না গোটাকতক দুব্বো ঘাস চিবিয়ে দেখেছি– বদ খেতে, তাতে আবার ছোট্ট শুয়ো পোকা ছিল! খোনকে বলেছি গলায় দড়ি বেঁধে একটু টেনে বেড়াতে, ও কিন্তু রাজি হল না। এদিকে অভ্যেস না থাকলে কী যে হবে তাও তো জানি না!

এইসব নানা কারণে এতকাল চিঠি লিকতে পারিনি, বুঝতেই তো পারছ।

একদিন সন্ধ্যাবেলা আর তর সইল না। কেডস পায়ে দিয়ে সুটসুট মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি বেড়া টপকে, ছাগলদড়ি ডিঙিয়ে, জানলার গরাদ খিমচে ধরে, পায়ের বুড়ো আঙুলে দাঁড়িয়ে চিংড়িমাছের মতন ডান্ডার আগায় চোখ বাগিয়ে ঘরের ভিতর উঁকি মারলাম।

দেখলাম মাস্টারমশাই গলাবন্ধ কোট খুলে রেখে মোড়ায় বসে হুঁকো খেতে চেষ্টা করছেন, আর গিন্নি মাটিতে বসে কুলো থেকে খাবলা খাবলা শুকনো বড়ি তুলছেন– কোনটা আস্ত উঠছে, গিন্নি হাসছেন; কোনটা আধখাচড়া উঠছে, গিন্নি দাঁত কিড়মিড় করছেন। আর মাস্টারমশাই গেলাস ভেঙেছেন বসে সমস্তক্ষণ বকবক করছেন ভাই, বড়ো ভালো লাগল।

কিন্তু আনন্দের চোটে যেই খচমচ করে উঠেছি, মাস্টারমশাই চমকে বললেন, ওটা কী রে? ভাবলুম এবার তো গেছি! কান ধরে ঝুলিয়ে ঘরে টেনে আনলেন,নখ দিয়ে খিমচে দিয়ে গিরগিটির মতন মুখ করে বললেন-ও বাঁদর! বললুম, আজ্ঞে সার, ছাগল বানাবেন না স্যার! বললেন, বাঁদর আবার কবে ছাগল হয় রে? গিন্নিও ফিসফিস করে যেন বললেন, ওটিকে রাখো, আমি পুষব।

ভয়ের চোটে কেঁদে ফেললুম। গিন্নি মাথায় হাত বুলিয়ে শিং আছে কিনা দেখে বললেন, তোমার মতন আমার একটি খোকা ছিল। জিজ্ঞেস করলুম, তার কী হল? বললেন, তার এখন দাড়ি গজিয়েছে। বলে বড়ো বড়ো বাতাসা খেতে দিলেন। তারপর বাড়ি চলে গেলাম। জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না, দাড়ির সঙ্গে সঙ্গে খুরও গজিয়েছিল কি না।

ইস্কুলের কথা এখনও কিছু ঠিক হয়নি, এই ফাঁকে তোমায় লিখছি। এ চিঠির আর উত্তর দিয়ো। দেখা করতে চাও তো খোঁয়াড়ে-টোয়াড়ে খোঁজ কোরো। ইতি–
তোমার গণশা

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments