Thursday, April 18, 2024
Homeরম্য গল্পফুল্স প্যারাডাইজ - আইজ্যাক বাশেভিস সিঙ্গার

ফুল্স প্যারাডাইজ – আইজ্যাক বাশেভিস সিঙ্গার

'ফুল্স প্যারাডাইজ' আইজ্যাক বাশেভিস সিঙ্গার

কোনও এক সময়, কোনও একখানে, কাদিশ নামে এক লোক বাস করত। অ্যাটজেল নামে তার এক ছেলে ছিল, একমাত্র সন্তান। কাদিশের বাসায় দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়, আকসাহ নামে এক এতিম মেয়েও থাকত। অ্যাটজেল লম্বা চেহারার ছেলে। কালো চুল তার, কালো চোখের মণি। আর আকসাহ নীলনয়না এবং সোনালি চুলের অধিকারিণী। দু’জনে ওরা সমবয়সী। ছেলেবেলায় একসাথে খেলা করত, একসাথে পড়াশোনা করত, খেত। সবাই একরকম ধরেই নিয়েছিল, বড় হলে বিয়ে হবে ওদের।।

কিন্তু ওরা বড় হওয়ার পরপরই অ্যাটজেল হয়ে পড়ল অসুস্থ। এ ধরনের অসুস্থতার কথা কেউ কোনওদিন শোনেনি: অ্যাটজেল নিজেকে মৃত কল্পনা করতে শুরু করল।

হঠাৎ করে এরকম চিন্তা ওর মাথায় ঢুকল কী করে? সবাই ধারণা করল, এজন্যে দায়ী ওর ছেলেবেলার আয়া। সে ওকে অনর্গল স্বর্গের গল্প শোনাত। সে বলত, স্বর্গে কাজ কিংবা পড়াশোনা কোনও কিছুই করার দরকার পড়ে না। স্বর্গে গেলে মানুষ বুনো ষাঁড়ের ও তিমির মাংস খায়; পান করে প্রিয় বান্দাদের জন্যে খোদার আলাদা করে তুলে রাখা পবিত্র পানীয়। ওখানে যত খুশি খাও আর ঘুমাও, কেউ কিছু বলতে আসবে না-কোনও কাজ তো নেই।

অ্যাটজেল স্বভাবে অলস। সাতসকালে উঠে পড়তে বসা তার ধাতে সয় না। একদিন বাবার ব্যবসার দায়িত্ব ওকেই বুঝে নিতে হবে, জানে, এবং এজন্যে সে রীতিমত চিন্তিত।

স্বর্গে যেতে হলে মরা ছাড়া যেহেতু গতি নেই, ও কাজটাই ঝটপট সেরে ফেলবে, সিদ্ধান্ত নিল সে। চিন্তাটা এমনভাবেই জড়িয়ে গেল ওর মগজে, শীঘ্রিই নিজেকে মৃত কল্পনা করতে শুরু করে দিল সে।

ওর বাবা-মা পড়ে গেল মহা ফাঁপরে। চিন্তায়-চিন্তায় ঘুম হারাম তাদের! ওদিকে গোপনে কান্নাকাটি করে আকসাহ। সবাই মিলে কত চেষ্টাই না করল, কিন্তু বান্দা মানতে নারাজ সে জীবিত। তার কেবল এক কথা, আমাকে তোমরা কবর দিচ্ছ না কেন? দেখতে পাচ্ছ না আমি মরে গেছি? এই তোমাদের জন্যেই আমার স্বর্গে যাওয়া হচ্ছে না।

রাজ্যের ডাক্তার ডাকা হলো ছেলের চিকিৎসার জন্যে। তারা কতভাবেই না বোঝাল সে বেঁচে আছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল, ও কথা বলছে, নিয়মিত পেট পুরে খাচ্ছে। কিন্তু কদিন পর থেকে দেখা গেল খাওয়া-দাওয়া একরকম ছেড়ে দিয়েছে অ্যাটজেল, কথাও প্রায় বন্ধ। ছেলেটা বাচবে না, ভয় পেল ওর পরিবার।

শোকে মুহ্যমান কাদিশ মস্ত এক বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হলো। ভদ্রলোকের নাম ড. ইয়োয়েজ। রোগীর সমস্যার কথা শুনে, কাদিশকে বললেন তিনি, ‘আটদিনের মধ্যে আপনার ছেলেকে সারিয়ে তুলব আমি, কিন্তু একটা শর্ত আছে। আমি যা বলব সব মানতে হবে আপনাদের-আমার কথা শুনতে যত অদ্ভুতই লাগুক কেন।

কাদিশ রাজি হলো এবং ডাক্তার কথা দিলেন সেদিনই আসবেন। কাদিশ বাড়ি ফিরে সবাইকে ডাক্তারের নির্দেশের কথা জানাল।

ডাক্তার এলে, তাকে সোজা অ্যাটজেলের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ছেলেটি বিছানায় শোয়া, অনাহারে ফ্যাকাসে আর লিকলিকে হয়ে পড়েছে।

ডাক্তার ওকে একনজর দেখার পরই চেঁচিয়ে উঠলেন, বাসায় লাশ ফেলে রেখেছেন কেন আপনারা? কবর দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না কেন?

ডাক্তারের গর্জন শুনে বাবা-মার মুখ শুকিয়ে আমসি, কিন্তু অ্যাটজেলের চোখজোড়া ঝিক করে জ্বলে উঠল। মুখে ফুটল হাসি। ‘কী, বলেছিলাম না?’ বলে উঠল ও।।

ডাক্তারের কথা শুনে হকচকিয়ে গেলেও, প্রতিশ্রুতির কথা ঠিকই খেয়াল আছে বাবা-মার। কাজেই, তখুনি শেষকৃত্যের আয়োজন করতে শুরু করল তারা।

ডাক্তার অনুরোধ করেছেন একখানা ঘর সাজাতে হবে স্বর্গের অনুকরণে। ফলে, দেয়ালে ঝোলানো হলো সাদা সাটিন। সব ক’টা জানালা শক্ত করে এঁটে, পর্দা লাগিয়ে দেয়া হলো। দিন রাত ওখানে জ্বলবে শুধু মোমবাতি। ঠিক হলো কাজের লোকেরা পিঠে ডানা বেঁধে, সাদা পোশাকে ফেরেশতার অভিনয় করবে।

খোলা এক কফিনে শোয়ানো হলো অ্যাটজেলকে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হলো তার। খুশি ধরে না অ্যাটজেলের, পুরোটা সময় ঘুমিয়ে কাবার করল সে। ঘুম যখন ভাঙল, অচেনা এক কামরায় নিজেকে আবিষ্কার করল।

‘আমি কোথায়?’ প্রশ্ন করল ও।

‘স্বর্গে, হুজুর,’ জবাব দিল এক ডানাধারী ভৃত্য।

‘ভীষণ খিদে পেয়েছে,’ বলল অ্যাটজেল। তিমির মাংস আর পবিত্র পানীয় পেলে মন্দ হত না।

খাস ভূত্য হাততালি দিতেই, ছুটে এল ফেরেশতার দল। সোনালি ট্রেতে করে ডালিম, মাংস, মাছ, খেজুর, আনারস আর পিচ ফল নিয়ে এসেছে। দীর্ঘদেহী এক ভৃত্য পানপাত্র ভরে এনেছে পবিত্র পানীয়।

গোগ্রাসে গিলল অ্যাটজেল। খাওয়া সেরে ঘোষণা করল এখন সে বিশ্রাম নেবে। দু’জন দেবদূত কাপড় ছাড়তে সাহায্য করল ওকে এবং গোসল করিয়ে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শোয়াল। যে-সে বিছানা নয়, সিল্কের চাদর মোড়া আর ওপরে লাল মখমলের শামিয়ানা টাঙানো। শীঘ্রি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল অ্যাটজেল।

ঘুম যখন ভাঙল তখন সকাল। কিন্তু ঘরের ভেতর তেমনি অন্ধকার। খড়খড়ি নামানো এবং মোমবাতি জ্বলছে। ওর ঘুম ভাঙতে দেখে, কাজের লোকেরা গতকালকের মত সেই একই খাবার নিয়ে এল।

অ্যাটজেল জবাব চাইল, দুধ, কফি, তাজা রোল আর মাখন নেই তোমাদের কাছে?

‘জী না, হুজুর। স্বর্গে এলে সবসময় একই খাবার,’ বলল ভৃত্য।

‘এখন কি দিন নাকি রাত?’

‘স্বর্গে, হুজুর, দিন-রাত নেই।’

একই খাবার আজও খেতে হলো অ্যাটজলকে। বলা বাহুল্য, গতকালের মত খুশি হতে পারল না সে। খেয়েদেয়ে জানতে চাইল ও, ক’টা বাজে?

‘স্বর্গে সময়ের হিসাব রাখা হয় না,’ জবাব দিল ভৃত্য।

‘আমি এখন কী করব?’ অ্যাটজেল জবাব চাইল।

‘স্বর্গে কেউ কিছু করে না, হুজুর।’

‘অন্য সব সাধু-সন্তরা কোথায়?’

‘এখানে সব পরিবার আলাদা-আলাদা থাকে,’ জবাব এল।

‘এখানে বেড়াতে যাওয়া যায় না?’

‘স্বর্গে একেকটা জায়গা অনেক দূরে দূরে। একখান থেকে আরেকখানে যেতে কয়েক হাজার বছর লেগে যায়।’

‘আমার পরিবারের লোকজন কবে আসবে?’

‘আপনার বাবার আয়ু এখনও বিশ বছর, আর আপনার মার ত্রিশ। পৃথিবীর মায়া কাটাবেন, তারপর তো আসবেন।’

‘আর আকসাহ?’

‘তার আরও পঞ্চাশ বছর দেরি আছে।’

‘আমাকে কি ততদিন একা থাকতে হবে নাকি?’

‘জী, হুজুর।’

মুহুর্তের জন্যে চিন্তামগ্ন হলো অ্যাটজেল, মাথা নাড়ল। তারপর প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, আকসাহ এখন কী করবে?’

‘আপাতত আপনার জন্যে শোক করছে। তবে শীঘ্রিই আপনাকে সে ভুলে যাবে। অন্য কোনও সুদর্শন তরুণের সাথে পরিচয়-টরিচয় হবে, শেষে বিয়েও হয়ে যাবে। জ্যান্ত মানুষদের তো এই-ই নিয়ম।’

অ্যাটজেল সটান উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে পায়চারি শুরু করল। অনেক বছর বাদে ওর কিছু একটা করার সাধ জাগল মনে, কিন্তু স্বর্গে তো হাত-পা বাঁধা। বাবাকে বড় মনে পড়ছে, প্রাণ কাঁদছে মার জন্যে; বুক ভেঙে যেতে চাইছে আকসাহর কথা ভাবতেই। আহা, পড়ার কিছু একটা এখন পেত যদি। ঘুরে বেড়াতে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে, ওর প্রিয় ঘোড়াটা দাবড়াতে মনটা আকুলিবিকুলি করে উঠল। *

একটা সময় এল, বিষন্নতা চাপা দেয়া আর সম্ভব হলো না। জনৈক ভূত্যের উদ্দেশে মন্তব্য করল ও, ‘বেঁচে থাকা দেখতে পাচ্ছি যতটা মনে করেছিলাম ততখানি খারাপ না।’

‘বেঁচে থাকা বড় কষ্টের, হুজুর। পড়াশোনা করতে হয়, কাজ করতে হয়, টাকা রোজগার করতে হয়। অথচ এখানে তো ওসব ঝামেলা নেই।’

‘এখানে হাঁ করে বসে থাকার চাইতে বরং কাঠ কাটা আর পাথর বওয়াও ভাল। এরকম কদ্দিন চলবে?’

‘চিরদিন।’

‘চিরদিন এখানে পচে মরতে হবে নাকি আমাকে?’

মনের দুঃখে মাথার চুল ছিড়তে লাগল অ্যাটজেল। তারচেয়ে আমার মরণও ভাল।

‘আপনি তো মরেই আছেন, আবার মরবেন কীভাবে?’

স্বর্গবাসের অষ্টম দিনে, অ্যাটজেল যখন অতিষ্ঠ, এক ভৃত্য ওর কাছে এসে শেখানো বুলি আওড়াল, হুজুর, মস্ত ভুল হয়ে গেছে। আপনি মারা যাননি। আপনাকে এখন স্বর্গ ছাড়তে হবে।

‘আমি বেঁচে আছি?’

‘জী, আপনাকে আমি পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাব।’

অ্যাটজেলের তো খুশিতে বাকবাকুম দশা। কাজের লোকটা ওর চোখ বেঁধে, বাড়ির দীর্ঘ করিডর ধরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, ওর পরিবার যেখানটায় অপেক্ষা করছে সেখানটায় নিয়ে এল। এবার খুলে দেয়া হলো ওর চোখের বাঁধন।

ঝলমলে রোদ ছিল সেদিন। খোলা জানালা গলে সূর্যকিরণ এসে ঘরে পড়েছে। বাগান থেকে ভেসে আসছে পাখিদের কলতান আর ভ্রমরের গুঞ্জন। খুশির চোটে বাবা-মাকে, আকসাহকে একে-একে জড়িয়ে ধরল অ্যাটিজল।

‘তুমি কি আমাকে এখনও ভালোবাসো?’ আকসাহকে প্রশ্ন করল ও।।

‘নিশ্চয়ই, অ্যাটজেল। তোমাকে কি আমি ভুলতে পারি?’

‘তা হলে আর দেরি না করে আমাদের বিয়েটা সেরে ফেলা উচিত।’

শীঘ্রিই বিয়ের আয়োজন করা হলো। বিশেষ অতিথি হলেন। ড. ইয়োয়েজ। দূর-দূরান্ত থেকে এল মেহমান। সাতদিন-সাতরাত ধরে চলল অনুষ্ঠান।

সুখের সংসার হলো ওদেৱ। স্বামী-স্ত্রী বহু বছর বাঁচল। ও ঘটনার পর কোথায় পালাল অ্যাটজেলের আলসেমি! গোটা দেশে ওর মত করিকর্মা ব্যবসায়ী আর দুটো ছিল না।

বিয়ের পর জানতে পারে অ্যাটজেল, ড. ইয়োয়েজ কীভাবে তার ভূত ছাড়ান এবং ও যে বোকার স্বর্গে বাস করে এসেছে সে কথা। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনীদের কাছে ড. ইয়োয়েজের আজব চিকিৎসার গল্প ফলাও করে প্রায়ই বলত ওরা স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু শেষ করত এই বলে, তবে স্বর্গ আসলে কেমন জায়গা কেউ বলতে পারে না।’

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments