Saturday, April 20, 2024
Homeকিশোর গল্পফিঙে আর কুঁকড়ো - উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

ফিঙে আর কুঁকড়ো – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

upendrakishore-roy-chowdhury-golpo-mala

একটা দানব ছিল, তার নাম ছিল ফিঙে। সে দেড়াশো হাত লম্বা শালগাছের ছড়ি হাতে নিযে বেড়াত। আর একটা দানব ছিল, তার নাম কুঁকড়ো। সে ঘুঁষো মেরে লোহার মুগুর থেঁতলা করে দিত।

আর যত দানব ছিল, তাদের সকালকেই কুঁকড়ো ঠেঙিয়ে ঠিক করে দিয়েছে, এখন সে ফিঙের সন্ধানে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। এ কথা শুনে অবধি ফিঙের আর ঘুম হয় না, কাজেই সে কুঁকড়োকে এড়াবার জন্য খালি দেশ- বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। ফিঙে সমুদ্রের ধারে গেলে, তা শুনে কুঁকড়ো সেই দিক পানে রওনা হল। সে খবর পেয়েই ফিঙে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে তার নিজের ঘরে চলে এল।

ঘরখানি ছিল একটা উঁচু পর্বতের উপর। সেখান থেকে দশ দিনের পথ অবধি দেখতে পাওয়া যায়। কাজেই ফিঙে ভাবল যে, ওখানে গেলে কুঁকড়ো নিতান্ত আচমকা এসে তাকে মারতে পারবে না। ফিঙেকে অমন ব্যস্ত হয়ে ফিরে আসতে দেখে তার স্ত্রী ঊনা বলল, ‘কি হয়েছে?’ ফিঙে আঙুল দিয়ে সমুদ্রের দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ঐ কুঁকড়ো আসছে। বেটা ঘুঁষো মেরে লোহার মুগুর থেঁতলা করে দেয়। এবারে দেখছি ভারি বেগতিক।’

ঊনা সেদিকে দেখল, সত্যি সত্যিই কুঁকড়ো আসছে, কিন্তু এখনো সে ঢের দূরে, তিন- চার দিনের কমে এসে পৌছবে না। তখন সে ফিঙেকে বলল, ‘তোমার কোন ভয় নেই। তুমি পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকো, আমি কুঁকড়োকে ঠিক করে দিচ্ছি।’ কিন্তু ফিঙের মনের ভয় তাতে গেল না। সে মাথা হেঁট করে বসে কত কথা ভাবতে লাগল।

ঊনা কিন্তু ততক্ষণে চুপ করে ছিল না। সে গ্রামের লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে যার ঘরে যত ভাঙা দা, কুডুল, কাস্তে, খন্তা , কোদাল, হুড়কো, ছিটকিনি আর পেরেক ছিল, সব চেয়ে ঝুড়ি ভরে নিয়ে এল। তারপর সেই গুলো ভিতরে পুরে পুরে সে দুদিন ধরে খালি পাটিসাপটাই তয়ের করল। ফিঙে অবাক হয়ে হয়ে দেখে, আর বলে,‘ও কি করছ? ঊনা বলে, ‘যাই করি না কেন- তুমি চুপ করে থাকো।’

পিঠে হয়ে গেলে ঊনা তিন গামলা ছানাও তয়ের করল। তারপর ফিঙেকে অনেক পরামর্শ দিয়ে, অনেক সন্ধান শিখিয়ে রেখে,সে সব ঠিকঠাক করে রাখল। এখন কুঁকড়ো এলেই হয়।

পরদিন দুপুরবেলা কুঁকড়ো এসে উপস্থিত হয়েছে। এসেই ভয়ংকর গর্জনে আকাশপাতাল কাঁপিয়ে জিজ্ঞাসা করল,‘ফিঙে কোথায়?’ ঊনা বলল, ‘সে ত বাড়ি নেই। কুঁকড়ো বলে নাকি একটা ছোকরা তাকে খুঁজতে সমুদ্রের ধারে গিয়ে ভারি বড়াই করছিল, তাই শুনে ফিঙে বিষম রেগে লাঠি হাতে তাকে মারতে বেরিয়েছে। যদি তাকে দেখতে পায়, তবে আর বেচারাকে আস্ত রাখবে না।’

তা শনে কুঁকড়ো ভারি আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘আমিই ত কুঁকড়ো , তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছি।’ এ কথায় ঊনা হো হো করে হেসেই কুটিপটি। তারপর অনেকক্ষণ নাক সিঁটকিয়ে কুঁকড়োর পানে তাকিয়ে থেকে সে বলল, ‘এই টিকটিকির মত জোয়ানটি হয়ে তুমি ফিঙের সঙ্গে যুদ্ধ করবে? অমন কাজও করতে নাই বাছা। কেন ফিঙের হাতে প্রাণ দেবে? আমার কথা শুনে চলো, আমি তোমাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছি। ততক্ষণ একটা কাজ কর দেখি। বড্ড হাওয়া আসছে, ফিঙে বাড়ি নেই, কে ঘরখানিকে ঘুরিয়ে দেবে? দেখো ত তুমি পার কি না।’

কুঁকড়ো ভাবল, ‘বাবা! হাওয়া থামাতে হলে ফিঙে এই ঘরটা ঘুরিয়ে দেয় নাকি? এখন আমি যদি “না” বলি, তবে ত দেখছি আমার বড্ড নিন্দে হবে।’ তখন সে আগে খুব করে তার ডান হাতের মাঝের আঙুলটা মটকে নিল। আঙুলটাতেই তার যত জোর ছিল, ওটি না হলে সে কিছুই করতে পারত না। আঙুর মটকানো হয়ে গেলে সে দুহাতে ঘরখানিকে জড়িয়ে ধরে তাতে এমনি পাক দিল সে দেখতে দেখতে পাহাড়ের চূড়া সুদ্ধ ঘরখানি ঘুরে গেল।

এতক্ষণ ফিঙে কি করছে? সে ঊনার পরামর্শে তার নিজের খোকা সেজে, কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে, আর কুঁকড়োর কাণ্ড দেখে সেই কাঁথার ভিতরে ভয়ে ঘেমে আর কেঁপে অস্থির হচ্ছে।

এদিকে ঊনা আবার কুঁকড়োকে বলল,‘বেশ বাপু! লক্ষ্মী ছেলে তুমি। আহা! ঘরে এক ফোঁটা জল নেই, তোমাকে কি দিয়ে একটু মেঠাই খেতে দিই। পাহাড়টার নীচে জল থাকে, ফিঙে পাহাড় সরিয়ে তাই তুলে আনে। আজ ত সে বাড়ি নেই, এখন উপায় কি হবে? দেখো ত বাপু, তুমি পাহাড়টা ঠেলে একটু জল আনতে পার কি না!’

কুঁকড়ো আবার খুব করে তার আঙুল মটকে নিয়ে, সেই পাহাড়ের নীচে গিয়ে এমনি গুতো মারল যে তাতে দশহাত গভীর এক প্রকাণ্ড দীঘি হয়ে গেল, আর তাতে জলও হল তেমনি। তা দেখে ঊনা আর একটু হলেই ‘মাগো!’ বারে চেঁচিয়ে ফেলছিল,কিন্তু সে ভারি বুদ্ধিমতী মেয়ে তাই তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলল, ‘চলো,এখন তোমাকে কিছু পিঠে খেতে দিই গে।’

এই বরে ঊনা কুঁকড়োকে ঘরে এনে দিয়েছে সেই পিঠে খেতে। সে বেটাও এমনি লোভী- একেবারে তার দশটা তুলে নিয়ে মুখে দিয়েছে। দিয়েই সে ‘উঃ- হুঃ- হুঃ-’ বলে এমনি ভয়ংকর চেঁচিযে উঠল যে, আর একটু হলেই তাতে ঘরের ছাত উড়ে যেত। বেজায় ব্যস্ত হয়ে সেই পিঠে চিবোতে গিয়ে তার চারটে দাঁত ভেঙে রক্তারক্তি হয়ে গিয়েছে, কাজেই না চেঁচাবে কেন?

ঊনা তখন বলল, ‘আরে অত চেঁচিও না, খোকার ঘুম ভেঙে যাবে আমি ভাবছিলাম তুমি জোয়ান লোক, ঐ পিঠে খেতে তোমার ভাল লাগবে। ফিঙে আর খোকা ও পিঠে খুব খায়।’

বলতে বলতে সেই খোকাটা কাঁথার ভিতর থেকে ষাঁড়ের মত চেঁচিয়ে বলল ‘অঁ- য়্যা-আ-আ বদ্দ খিদে পেয়েথে! পিতে থাব।’ খোকার গলার সে আওযাজ শুনেই ত কুঁকড়োর পিলে চমকে উঠেছে। ঊনা অবশ্য খোকার জন্য ভালো পিঠে করে রেখেছিল। তাই থেকে কয়েকটা খেতে-দিল। কুঁকড়ো ত আর তা জানে না। সে দেখল, যাতে তার নিজের দাঁত ভেঙে গেঙে গেছে, ‘খোকা’ তাই কপাকপ খাচ্ছে। কাজেই সে ভাবল, ‘বাবা গো, খোকাই যদি অমনি পিঠে খেতে পারে, তবে বাব না জানি কি করতে পারে! ভাগ্যিস সে বেটা বাড়ি নেই।’

এমন সময়‘খোকা ’ আবার বলল, ‘পাথল দে। দল বাল কব্ব! ঊনা তাকে একতাল ছানা, আর কুঁকড়োকে একটা সাদা পাথর দিয়ে বলল, ‘খোকার ঐ এক খেলা- পাথর টিপে জল বার করে। তুমিও একখানা পাথর টিপে দেখো ত।’ কুঁকড়ো সেই পাথর প্রাণপণে টিপেও তা থেকে জল বার করতে পারল না। খোকার ছানা থেকে অবশ্য জল বার হতে লাগল। তা দেখে কুঁকড়ো ঠকঠক কারে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘বাবা গো! আমি এই বেলা পালাই। এই খোকার বাবা এলে আমাকে আস্ত রাখবে না। আমার খালি দেখতে ইচ্ছে করছে যে এই খোকার দাঁতগুলো কেমন, যা দিয়ে সে ঐ পিঠেগুলো খায়।’

এই বলে সে তাড়াতাড়ি গিয়ে যেই ‘খোকা’র মুখে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছে, অমনি খোকাও কটাস করে তার সব- কটি আঙুল একেবারে গোড়াসুদ্ধ কামড়িয়ে নিয়েছে, সেই আঙুলেই নাকি ছিল কুঁকড়োর জোর, কাজেই সে আঙুল কাটা যেতে হায় হায় করে মাটিতে পড়ে গেল। ‘খোকা’ও তখন লাফিয়ে উঠে তার সেই দেড়শো হাত লম্বা শালের ছড়িগাছি দিয়ে তার হাড় ভাঙতে আর কিছুমাত্র দেরি করল না।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments