এক ছিল জোলা – রুহুল আমিন বাবুল

মজার গল্প: 'এক ছিল জোলা'

জঙ্গলবাড়ি নামে এক রাজ্য ছিল। সে রাজ্যের এক পাশে বাস করত এক জোলা আর তার বউ। জোলা ছিল বোকার হদ্দ আর কুঁড়ের একশেষ। রাতে ঘুম আর দিনের বেলায় টো-টো করে ঘুরে বেড়ানোই ছিল তার কাজ। এ ছাড়া আর কোনো কাজই সে করত না।

সংসার চলত জোলার বউয়ের রোজগারে। একদিন খাবার খেতে বসে জোলার বউ বলল, তুমি রাজার কাছে যাও, একটা কাজ চাও। তিনি তো কত লোককে চাকরি দেন। কত লোক তাঁকে কিত্সা-কাহিনি শুনিয়ে টাকাকড়ি পায়। খালি হাতে তাঁর কাছ থেকে কেউ ফিরে আসে না। তুমিও যাও, একটা কিছু চাও তাঁর কাছে। তুমিও পাবে।

জোলা তার বউয়ের কথা শুনে যায় ঠিকই। কিন্তু এক কান দিয়ে শোনে, আর এক কান দিয়ে বের করে দেয়। কারণ, রাজা কাজ দিলে কী হবে, সে তত কোনো কাজই জানে না। খামোকা লাভ কি রাজার কাছে গিয়ে।

জোলা-বউয়ের তাগাদা কিন্তু শেষ হয় না। রোজ রোজ একই কথা বলে। তাতে বিরক্ত হয় না জোলা। নানা ছুতাছাতায় বউকে ভুলিয়ে সে খাবার সময় খায়। খায়-দায় আর রাজবাড়ি যাবার নাম করে ঘর থেকে বের হয়। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে ঘরে আসে রাতে।

এভাবে তো দিন আর চলে না। জোলা-বউ খুব রেগে যায়। একদিন বলল, ঘরে বসে বসে তুমি রাক্ষসের মতো আর কতদিন খাবে? রাজবাড়ি গিয়ে কিছু পয়সাকড়ি কামাই করো না।

জোলা বলল, আমি তো কিছুই জানি না, রাজার কাছে কী কাজ চাইব? আমি কী কাহিনি শোনাব তাকে?

জোলা-বউ বলল, তুমি যা জানো তাই শোনাবে রাজাকে। |

কিন্তু তাতেও কাজ হল না। বউয়ের যাবতীয় গালমন্দ ধৈর্যের সঙ্গে হজম করে সে। কুঁড়ের মতো বসে বসে খায়, ঘুমায় আর ঘুরে ফিরে বাকি সময় কাটায়। বউ বুঝল সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না।

একদিন জোলা খাবার খেতে এলে বউ ঝাড়ু হাতে চোখ রাঙিয়ে বলল, অকর্মার সর্দার। আজ আমি তোমাকে রাজবাড়ি না পাঠিয়ে ছাড়ছি না। কামাই করার মুরোদ নেই, বিড়ালের মতো খেতে পারো শুধু। আজ ঝাড়ুর বাড়ি খাওয়াব তোমাকে।

জোলা ভাবল এ তো ভারী বিপদ। নিরুপায় হয়ে ছুটতে থাকে রাজবাড়ির দিকে। ছুটতে ছুটতে ভাবে, বউ বলে দিয়েছিল, তুমি পথে যা দেখবে তাই বলবে রাজাকে। কিন্তু রাজবাড়ির পথ আর ফুরায় না! ফুরাবেই বা কীভাবে? জোলা তিন পা এগোয় আর এক পা পিছোয়। আসলে রাজবাড়ি জোলার বাড়ি থেকে মাত্র এক মাইল পথ।

চলার পথে জোলার একটাই ভাবনা, সে কিছুই জানে না, রাজাকে কী বলবে, কী শোনাবে কিসসা? কিছু দূর গিয়ে জোলা দেখতে পায় একটা ব্যাং। ব্যাংটি লাফ দিয়ে বসে, আবার লাফ দেয়, আবার বসে। বিষয়টি দেখে বউয়ের কথা মনে পড়ে জোলার। তার মুখ থেকে একবার উচ্চারিত হয়—‘ফাল্দা বইসা যায়’।

তারপর জোলা কথাটি বার বার আওড়ায় আর রাজবাড়ির দিকে যায়। আর কতটুকু পথ এগিয়ে দেখতে পায় একটা বেজি। কিছু দূর ছুটে গিয়ে জোলা পেছন ফিরে তাকায়। দেখতে পায় বেজি উঁকিঝুঁকি দিয়ে পালিয়েছে জঙ্গলে। জোলা তখন প্রথম কথাটির সঙ্গে আরো কিছু কথা জুড়ে দিয়ে বলতে থাকে –

ফাল্দা বইসা যায়
দৌড়ে ফিরা চায়।
উঁকি দিয়া লুকায়।

কথাগুলো বলে আর পথ চলে জোলা। এসব কথাই আজ সে রাজাকে শোনাবে। কিন্তু পা যে তার চলতে চায় না আর। এক মাইল পথ, অথচ এক দুপুর হেঁটেও শেষ করতে পারে না।

রাজদরবারে হাজির হয়ে জোলা দেখল, লোকজনের অভাব নেই। একেবারে জমজমাট দরবার। কেউ গান গেয়ে, কেউ কিসসা শুনিয়ে, কেউ হাসি-তামাশা করে আনন্দ দিচ্ছে রাজাকে। রাজা বেশ খুশি-খুশি মুখ করে বসে আছেন।

জোলা মনমরা হয়ে বসে থাকল দরবারের এক কোণে। এত বড় রাজার সামনে সে কেমন করে কথা বলবে, এ ভাবনায় সে অস্থির। একবার মনে করে বাড়ি ফিরে যাবে। আবার ভাবে, হয়তো তার বউ ঝাড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এখন গেলেই ঝাড়পেটা করবে।

এদিকে যার যার কাজের পর রাজা নানাজনকে নানা পুরস্কার দিলেন। টাকাকড়ি, হীরা জহরত পেয়ে রাজাকে ধন্য ধন্য করে চলে গেল তারা। জোলার দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না। সে বসে বসে ঠোঁট কামড়াচ্ছিল আর ভাবছিল পথের কথাগুলো বলবে কি না।

মুহূর্তের মধ্যে দরবার লোকশূন্য হয়ে গেল। জোলা আগের মতোই বসে রয়েছে চুপচাপ। হঠাৎ রাজার চোখ পড়ল জোলার দিকে। তিনি জানতে চাইলেন, তুই বসে আছিস কেন? কোনো কাজে এসেছিলি?

জোলার বুকটা কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর কেমন যেন ধুপুড় ধুপুড় শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সে। দুতিনবার গলা খাকারি দিয়ে নিজেকে হালকা করতে চাইল। সাহস করে বলল, মহারাজ। আমি আপনাকে কিছু কথা শোনাতে এসেছি।

জোলার কথা শেষ হতে না হতেই নরসুন্দর হাজির হল রাজার ক্ষৌরকর্মের জন্যে। রাজা বসলেন। নরসুন্দর তার কাজ শুরু করল। রাজা শুনতে চাইলেন জোলার কথাগুলো। জোলা সাহস করে বলতে থাকে—

ফাল্দা বইসা যায়
দৌড়ে ফিরা চায়।
উঁকি দিয়া লুকায়।

জোলার কথা শুনে রাজা খুব অবাক হলেন। এতক্ষণ তিনি তাকে নিরেট বোকা মনে করেছিলেন। আসলে সে অনেক বড়ো পণ্ডিত। রাজাকে কথায় ঠকাবার জন্যে সে ছদ্মবেশ ধারণ করেছে। যে সব কথা সে বলেছে, মস্তবড়ো গণক ছাড়া অন্য কেউ এর অর্থ বুঝতে পারবে না।

জোলার কথাগুলো নিয়ে কেবল রাজা ভাবছেন তা নয়, সাত-ছালা বুদ্ধির নরসুন্দরও জোলার কথা শুনে থ হয়ে গেল। তখন রাজবাড়ির প্রধান গেটের পাশ দিয়ে একটা শেয়াল দৌড়ে পাচ্ছিল। তা দেখে জোলা বলল-

ফাল্দা বইসা যায়
দৌড়ে ফিরা চায়
উকি দিয়া লুকায়।
ওই তো শিবা যায়।

যে নরসুন্দর রাজার ক্ষৌরকর্ম করছিল তার নাম ছিল শিবা। কিন্তু জোলা তা জানত না। তার মুখে শিবা নাম শোনামাত্র নরসুন্দর শিবার হাত থেকে ক্ষুর পড়ে গেল। সে কাপতে কাঁপতে রাজার পায়ে পড়ে বলল, মহারাজ। আমাকে ক্ষমা করবেন—আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ উজিরের। তিনি আমাকে বলে দিয়েছিলেন, ক্ষৌর করবার সময় ক্ষুর দিয়ে যেন আপনার গলা কেটে ফেলি। আমাকে রেহাই দিন মহারাজ।

রাজা তো বিস্ময়ে হতবাক! আর দেরি করলেন না তিনি। সঙ্গে সঙ্গে উজির আর নরসুন্দরকে হাত-পা বেঁধে বন্দিশালায় নিয়ে যাওয়া হল। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলেন রাজা।

আনন্দে ডগমগ করা চোখে রাজা তাকালেন জোলার দিকে। মুহূর্তের মধ্যে জোলাকে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হে গণকঠাকুর, তুমি আমার প্রাণ রক্ষা করেছ। তুমি না এলে শিবা ব্যাটা এতক্ষণে আমাকে কোতল করে ফেলত।

জোলা বুঝল এই তো বড়ো সুযোগ। বোকা জোলা সাহস করে দুটি টাকা চাইল রাজার কাছে। তার ধারণা, দুই টাকার চালডাল কিনে নিয়ে বাড়ি গেলে আজ আর বউয়ের ঝাড়পেটা খেতে হবে না।

রাজা ভাবলেন অন্যকথা। গণকঠাকুর লোভহীন উদার প্রকৃতির লোক। এ জন্যে সে দুটাকার বেশি চাইল না। রাজা অভিভূত হলেন। অনেক ধন-সম্পদ দিলেন তাকে। রাজার পুরস্কার পেয়ে বোকা জোলাও ধনী হয়ে গেল।

Facebook Comment

You May Also Like

About the Author: eBooks

Read your favourite literature free forever on our blogging platform.