দাগ – ফয়সল সৈয়দ

দাগ - ফয়সল সৈয়দ

সময় ভাল যাচ্ছে না। দেশ ক্রান্তিকাল পার করছে।

যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হওয়ার সাথে সাথে দেশের ভেতরে অরাজকতা দিনদিন বেড়ে চলছে। সাঈদির রায়ের পর থেকে তো দেশের ভেতরে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে গেল। একদিনে দুইশ জন মানুষ মারা গেল। যার উত্তাপ এখনো আছে।

হোসাইন তরফদার বার বার পাত্র পক্ষকে ফোন করে জানতে চাচ্ছে, তারা আসছে কিনা? পরামর্শ দেয় সমস্যা হলে আরো কয়েকদিন পরে আসতে। পাত্রপক্ষ দেরি করতে চায় না। তাদের কাছে সময় খুবই কম। ছেলে পনের দিন পর আমেরিকায় চলে যাবে। মেয়ে পছন্দ হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে সব কিছু সেরে ফেলতে চায় তারা। হোসাইন তরফদারের বড় মেয়ে রূপাকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। রূপার তুলনায় ছোট মেয়ে সুবর্না সুন্দরী। তাই তাকে সকালে নানার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বড় ছেলে সাজ্জাদ তরফদার চট্রগ্রাম থেকে সপরিবার এসেছে। রূপা জানালা দিয়ে ভাই আর বাবাকে দেখে। বাবাকে এটা করতে ভাইয়া বাঁধা দিচ্ছে, ওটা করতে বারণ করছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাবা কেমন করে যেন হয়ে যাচ্ছে শিশুর মতোন। যে ভাই বাবার ভয়ে তটস্হ থাকত, সবসময়। বাবার সামনে কথা বলতে গিয়ে তোতলাতো। সেই ভাই বাবার চোখের সামনে গত বছর ভাবীকে নিয়ে চট্রগ্রাম চলে গেল। এ সংসারে তার বউকে মূল্যায়ন করছে না কেউ। ইদানীং মা সহ্য করতে পারছে না তাকে। বোনদেরও উস্কানি দিচ্ছে মা। মা নীরবে অশ্রু ফেলতে থাকে। ভাইয়া ঘুরে ফিরে দোষারোপের আঙুল তোলে মার দিকে। বাবার লা-জবাব। নির্লিপ্ত চোখে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে সব। ভাই চলে যাওয়ার পর মা প্রতিদিন কথায় কথায় কাঁদত। ছেলের কথাগুলো তীরের আঘাতের মত প্রতিনিয়ত তাকে দংশন করত। তবু মা ভাইয়াকে মোবাইলে যোগাযোগ করত। খোকা তুই এখন কোথায়? কেমন আছিস বাবা? খেয়েছিস? বউ মা কোথায়? ভাল আছে। বউ মার কথা জিজ্ঞেস করতে মা গলা শুকিয়ে যেত। চোখে মুখে ফোটে উঠতো এক রকম গ্লানির ছায়া।

—মা তোমার কাছে খারাপ লাগলে। ভাইয়াকে কল দাও কেন। রূপা বলে।
—কি করবো মা । মনকে তো বুঝাতে পারি না। আর ভুলতেও পারি না ছেলের বউয়ের কথাগুলো।
মা হাপিয়ে উঠে বলে— কী যুগ এসেছে বাবা! আমরা যখন বউ তখন কাক-ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে যেতাম তোর দাদীর ভয়ে। আর এখন আটটা নয়টা বাজলেও ঘুম ভাঙ্গে না নবাবজাদীদের। মার মুখে রক্ত জমে যায় কথা বলতে বলতে। সময় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। রূপা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করে। কলেজ ডিঙ্গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শেষ করেছে বাংলায়। আজ পর্যন্ত কোনো ছেলে এসে বলেনি, রূপা আমি তোমাকে ভালবাসি। রূপা জানে, না-বলা কারণটিও। সমাজে যে ছেলেটি সবচেয়ে কালো, বাবা-মা অপবাদ ঘুচাতে সে ছেলেটির নাম রাখে লাল মিয়া। রূপার বেলায়ও তাই হয়েছে। ঠোঁটের ডান পাশে কালো দাগটি দেখে আঁতকে উঠে রূপা। বুকের মধ্যে টেউ খেলতে থাকে জিইয়ে থাকা অযাচিত ভয়গুলো। কী বিশ্রি দাগরে! দাগটি রূপা সৌন্দর্যের কলঙ্ক, উদ্যেক্তার অভিশাপ।

শহর থেকে এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে ছেলে, ছেলের বউ, একমাত্র নাতি সানজিদ এসেছে। মা স্বাভাবিক আচরণ করছে যেন কিছু হয়নি ইতোপূর্বে। কাজের মেয়ে জুলেখা সানজিদকে নিয়ে ব্যস্ত। একটু সুযোগ পেলে আম্মু-আম্মু বলে চিৎকার করে। জুলেখা আদর করে কোলে তুলে নেয়। বিশাল দেহাকৃতি আম গাছটার দিকে তাকিয়ে বলে— দেখ, দেখ সানজিদ ঐ গাছটির ডালে একটা কালো ভূত লুকিয়ে আছে। আমরা ওকে ধরে খপ করে খেয়ে ফেলবো। সানজিদ হাসে, অবুঝ মিষ্টি হাসি। শান্ত বিকেল। বাতাসে বাতাসে সোনালী ধানের আভা ঝিলিক মারে। অস্পষ্ট কলগুঞ্জন। বড় আম গাছটার ছায়া দ্বিগুণ আকার ধারণ করেছে। মৃদু বাতাসে সবুজ পাতাগুলো নাচছে। হোসাইন তরফদারের অস্থিরতার মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। লাঠি হাতে একবার পুকুর পাড়ে আরেকবার ঘরে, আবার পুকুরপাড়ে মন-না-মতি পায়চারি। আর যাকে যেখানে পাচ্ছে উপদেশের নোলক দিচ্ছে, এটা কর ওটা কর, এটা কর না, ওটা কর না। মনে মনে সান্ত্বনাসূচক হরেক রকম বালা মুসিবতের দোয়া দরূদও পড়ছে।

বাড়ির পরিবেশ খণ্ড প্রলয়। লোক সমাগম ধীর গতিতে বেড়েই চলছে। তার মধ্যে চার বছরের সানজিদ যেন যোগ সংযোগের দূত। কথায় কথায় কাঁদছে, কারণে অকারণে কাঁদছে, ধরলে আরও বেশি কাঁদছে। মাঝে মাঝে গায়ে হাত তুলছে, লাথিও মারছে, জুলেখা আদর করে কোলে নিতে চাইলে চট করে দেয় এক থাপ্পড়। থাপ্পড় খেয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে জুলেখা। সানজিদ এবার হাসে, হি হি করে হাসে, লাফিয়ে লাফিয়ে দুহাতে তালি দিয়ে হাসে। আম্মুর আঁচল টেনে টেনে হাসে। দাদীর দিকে তাকিয়ে হাসে। জুলেখা প্রথমে একটু রাগলেও কিছুক্ষণ খিল খিল করে হাসতে থাকে, লজ্জার হাসি। মেয়েটি নিজের অবস্থান সম্পর্কে খুবই সচেতন।

রাতের আকাশে বাতাসে এখন উত্তাপ নেই কোথাও। রূপা হলুদ শাড়ী পড়ে খোঁপায় সোনালি রঙের কয়েকটি ফুল গুজে একেবারে পাত্রের মুখোমুখি লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বসে আছে। পাত্র পক্ষের অতিথিরা বিরতিহীন এক্সপ্রেসের মতোন এক একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে মারছে। প্রশ্নের ওজন বুঝে কিছু প্রশ্নের উত্তর (কর্তব্যবোধে) ভাইয়ের বউ দিতে লাগল। আর কিছু স্বয়ং রূপাকে দিতে হল।

হোসাইন তরফদার বাহিরে গদাইলস্করি চালে হাঁটছে। সময় অপচয়ের হাঁটা। পুকুর পাড়ের নারিকেল গাছের ডালগুলো ঝিরঝির বাতাসে নড়ছে। পুকুরের মাছগুলো চুপি চুপি কথা বলছে। অলস মনে ভাবছে। দেখতে দেখতে কেমন করে সোনালি দিনগুলোর চলে গেল। ক্ষণিকের জন্য টেরই পেল না। হাঁটি হাঁটি পা ফেলে দেহগুলো আজ কত বড় হয়ে গেছে। ভাবতে অবাক লাগে। সময়ের একচেটিয়া আধিপত্যে পৃথিবীর মানুষগুলো একেবারেই অসহায়।

টেবিলে সারি সারি আয়োজন। এতক্ষণে পাত্রপক্ষ (হয়ত) একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। চেহারা দেখে হোসাইনের তো তাই মনে হল। পাত্রের বাবা স্মিত সুরে হোসাইন তরফদারকে কাছে ডাকল। ডাকটা শুনে মুখে মুচকি হাসির রেশ ফুটে উঠলেও অন্তরে ধক করে একটা ধকল খেল। বয়সের ধারে এখন তিনি খুব সহজে অনেক কিছু আগাম আঁচ করতে পারেন। কিছু প্রকাশ করেন, কিছু প্রকাশ করেন না। পরিবেশ থমথমে। দুপক্ষের গতি কমে এসেছে। আগ্রহের খাতায় ছিদ্র এখনো প্রকাশ পায়নি। কনের পক্ষে এখানেই স্বস্তি, ভরসা। কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কেউবা বসে আছে। হাসতে হাসতে দুপক্ষের মাঝে হালকা রসিকতা চলছে। দুপক্ষে কে কী করে, কোথায় থাকে। পরিচয় হওয়ার পর। যুদ্ধাপরাধী প্রসঙ্গ উঠে আসে তাদের কথায়। হরতাল, অবরোধে মানুষের জনজীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে গুজবটি নিয়েও কথা বলে কয়েকজন। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত বি,এন,পি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কথা বলতে গিয়ে হাসি রোল উঠে যায়। সংসদে সালাউদ্দিন দাঁড়িয়ে বলে—মাননীয় স্পিকার কোনো সংসদ সদস্যকে চোর বলা যাবে কিনা। স্পিকার বলে—না, বলা যাবে না।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলে—তাহলে আমি শেখ সেলিমকে চোর বললাম না। কথার পিঠে কথা চলতে থাকে। কথার ফাঁকে পাত্রের বাবা রূপার হাতে কয়েক হাজার টাকা গুছে দেয়। এমন ভাবে দেয়, উপস্থিত কৌতুহলী দর্শকদেরও টাকার অংকটা নজরে পড়ল না। হোসাইন তরফদারের দুচোখে ব্যর্থতার গ্লানি। পরাজয়ের নির্মম হতাশা। ভেতর থেকে কয়েকজন পরিচিত নারীর সহানুভূতি উড়ে আসল রূপার কানে। সাজ্জাদ লৌহ মানব আকৃতিতে দেয়ালে পিঠ ছেঁড়ে দাঁড়িয়ে রইল। অনুভূতিহীন, নির্লিপ্ত, জড়। নিজেকে শুধু বাবার মত অপারগতার কাতারে একজন সদস্য মনে করলো, আর কিছু না।

জুলেখা কাঁদছে। এক এক করে টেবিলের সারি সারি আয়োজন সব সরিয়ে নিচ্ছে। মুখের ভাব দমিয়ে রাখতে সচেষ্ট হলেও চোখের ভাব দমিয়ে রাখতে পারছে না। ওড়না দিয়ে বারবার আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।

হোসাইন তরফদার উঠানে বসে হাঁ করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। চাঁদ হাসছে, প্রতিরাতে তো চাঁদ হাসে। তবে আজ তার
হাসি একটু বাঁকা দেখাছেন কেন।
—রূপা, মা রূপা। হোসাইন তরফদার মেয়েকে ডাকতে থাকে।

Facebook Comment

You May Also Like

About the Author: eBooks

Read your favourite literature free forever on our blogging platform.