Wednesday, April 17, 2024
Homeকিশোর গল্পখৃস্টবাহন - সুকুমার রায়

খৃস্টবাহন – সুকুমার রায়

টিয়াপাখির বুদ্ধি - সুকুমার রায়

তার নাম অফেরো। অমন পাহাড়ের মত শরীর, অমন সিংহের মত বল, অমন আগুনের মত তেজ, সে ছাড়া আর কারও ছিল না। বুকে তার যেমন সাহস, মুখে তার তেমনি মিষ্টি কথা। কিন্তু যখন তার বয়স অল্প, তখনই সে তার সঙ্গীদের ছেড়ে গেল; যাবার সময় বলে গেল, “যদি রাজার মত রাজা পাই, তবে তার গোলাম হয়ে থাকব। আমার মনের মধ্যে কে যেন বলে দিচ্ছে, তুমি আর কারও চাকরি করো না; যে রাজা সবার বড়, সংসারে যার ভয় নেই, তারই তুমি খোঁজ কর।” এই বলে অফেরো কোথায় জানি বেরিয়ে গেল।

পৃথিবীতে কত রাজা, তাদের কত জনের কত ভয়। প্রজার ভয়, শত্রুর ভয়, যুদ্ধের ভয়, বিদ্রোহের ভয়— ভয়ে কেউ আর নিশ্চিন্ত নেই। এরকম হাজার দেশ ছেড়ে ছেড়ে অফেরো এক রাজ্যে এল, সেখানে রাজার ভয়ে সবাই খাড়া! চোরে চুরি করতে সাহস পায় না, কেউ অন্যায় করলে ভয়ে কাঁপে।

অস্ত্রেশস্ত্রে সৈন্যসামন্তে রাজার প্রতাপ দশদিক দাপিয়ে আছে। সবাই বলে, “রাজার মত রাজা।” তাই শুনে অফেরো তাঁর চাকর হয়ে রইল।

তারপর কতদিন গেল— এখন অফেরো না হ’লে রাজার আর চলে না— উঠতে বসতে তার ডাক পড়ে। রাজা যখন সভায় বসেন অফেরো তাঁর পাশে খাড়া। রাজার মুখের প্রত্যেকটি কথা সে আগ্রহ করে শোনে! রাজার চালচলন ধরনধারণ ভাবভঙ্গি— সব তার আশ্চর্য লাগে। আর রাজা যখন শাসন করেন, চড়া গলায় হুকুম দেন, অফেরো তখন আবাক হয়ে ভাবে, “যদি রাজার মত রাজা কেউ থাকে, তবে সে এই!”

তারপর একদিন রাজার সভায় কথায় কথায় কে যেন শয়তানের নাম করেছে। শুনে রাজা গম্ভীর হয়ে গেলেন। অফেরো চেয়ে দেখলে রাজার চোখে হাসি নেই, মুখখানি তাঁর ভাবনা ভরা। অফেরো তখন জোড়হাতে দাঁড়িয়ে বলল, “মহারাজের ভাবনা কিসের? কি আছে তাঁর ভয়ের কথা?” রাজা হেসে বললেন, “এক আছে শয়তান আর আছে মৃত্যু— এ ছাড়া আর কাকে ডরাই?” অফেরো বলল, “হায় হায়, আমি এক কার চাকরি করতে এলাম? এ যে শয়তানের কাছে খাটো হয়ে গেল। তবে যাই শয়তানের রাজ্যে; দেখি সে কেমন রাজা!” এই বলে সে শয়তানের খোঁজে বেরুল।

পথে কত লোক আসে যায়— শয়তানের খবর জিজ্ঞাসা করলে তারা বুকে হাত দেয় আর দেবতার নাম করে, আর সবাই বলে, “তার কথা ভাই বলো না, সে যে কোথায় আছে, কোথায় নেই কেউ কি তা বলতে পারে?” এমনি করে খুঁজে খুঁজে কতগুলো নিষ্কর্মা কুঁড়ের দলে শয়তানকে পাওয়া গেল।

অফেরোকে পেয়ে শয়তানের ফূর্তি দেখে কে! এমন চেলা সে আর কখনও পায়নি। শয়তান বলল, “এস এস, আমি তোমায় তামাসা দেখাই। দেখবে আমার শক্তি কত?” শয়তান তাকে ধনীর প্রাসাদে নিয়ে গেল, সেখানে টাকার নেশায় মত্ত হয়ে, লোকে শয়তানের কথায় ওঠে বসে; গরীবের ভাঙা কুঁড়ের ভিতরে গেল, সেখানে এক মুঠো খাবার লোভে পেটের দায়ে বেচারীরা পশুর মত শয়তানের দাসত্ব করে। লোকেরা সব চলছে ফিরছে, কে যে কখন ধরা পড়ছে, কেউ হয়ত জানতে পারে না; সবাই মিলে মারছে, কাটছে, কোলাহল করছে “শয়তানের জয়।”

সব দেখে শুনে অফেরোর মনটা যেন দমে গেল। সে ভাবল, “রাজার সেরা রাজা বটে, কিন্তু আমার ত কৈ এর কাজেতে মন লাগছে না।” শয়তান তখন মুচকি মুচকি হেসে বললে, “চল ত ভাই, একবারটি এই শহর ছেড়ে পাহাড়ে যাই। সেখানে এক ফকির আছেন, তিনি নাকি বেজায় সাধু। আমার তেজের সামনে তাঁর সাধুতার দৌড় কতখানি, তা’ একবার দেখতে চাই।”

পাহাড়ের নীচে রাস্তার চৌমাথায় যখন তারা এসেছে, শয়তান তখন হঠাৎ কেমন ব্যস্ত হয়ে থমকিয়ে গেল— তারপর বাঁকা রাস্তা ঘুরে তড়্‌বড়্‌ করে চলতে লাগল। অফেরো বললে, “আরে মশাই, ব্যস্ত হল কেন?” শয়তান বললে, “দেখছ না ওটা কি?!” অফেরো দেখল, একটা ক্রুশের মত কাঠের গায়ে মানুষের মূর্তি আঁকা! মাথায় তার কাঁটার মুকুট— শরীরে তার রক্তধারা! সে কিছু বুঝতে পারল না। শয়তান আবার বললে, “দেখছ না ঐ মানুষকে— ও যে আমায় মানে না, মরতে ডরায় না,— বাবারে! ওর কাছে কি ঘেঁষতে আছে? ওকে দেখলেই তফাৎ হটি।” বলতে বলতে শয়তানের মুখখানা চামড়ার মত শুকিয়ে এল।

তখন অফেরো হাঁপ ছেড়ে বললে, “বাঁচালে ভাই! তোমার চাকরি আর আমায় করতে হল না। তোমায় মানে না, মরতেই ডরায় না, সেইজনকে যদি পাই তবে তারই গোলাম হয়ে থাকি।” এই বলে আবার সে খোঁজে বেরুল।

তারপর যার সঙ্গে দেখা হয়, তাকেই সে জিজ্ঞাসা করে, “সেই ক্রুশের মানুষকে কোথায় পাব?”— সবাই বলে, খুঁজতে থাক, একদিন তবে পাবেই পাবে। তারপর একদিন চলতে চলতে সে এক যাত্রীদলের দেখা পেল। গায়ে তাদের পথের ধূলা, হাঁটতে হাঁটতে সবাই শ্রান্ত, কিন্তু তবু তাদের দুঃখ নাই— হাসতে হাসতে গান গেয়ে সবাই মিলে পথ চলছে। তাদের দেখে অফেরোর বড় ভাল লাগল— সে বললে, “তোমরা কে ভাই? কোথায় যাচ্ছ?” তারা বললে, “ক্রুশের মানুষ যীশু খৃষ্ট— আমরা সবাই তাঁরই দাস। যে পথে তিনি গেছেন, সেই পথের খোঁজ নিয়ছি।” শুনে অফেরো তাদের সঙ্গ নিল।

সে পথ গেছে অনেক দূর। কত রাত গেল দিন গেল, পথ তবু ফুরায় না— চলতে চলতে সবাই ভাবছে, বুঝি পথের শেষ নাই। এমন সময় সন্ধ্যার ঝাপসা আলোয় পথের শেষ দেখা দিল। ওপারে স্বর্গ, এপারে পথ, মাঝে অন্ধকার নদী। নৌকা নাই, কূল নাই, মাঝে মাঝে ডাক আসে, “পার হয়ে এস।” অফেরো ভাবল, ‘কি করে এরা সব পার হবে? কত অন্ধ, খঞ্জ, কত অক্ষম বৃদ্ধ, কত অসহায় শিশু— এরা সব পার হবে কি ক’রে?’ যাঁরা বৃদ্ধ, তাঁরা বললেন, “দূত আসবে। ডাক পড়বার সময় হলে, তখন তাঁর দূত আসবে।”

বলতে বলতে দূত এসে ডাক দিল। একটি ছোট মেয়ে ভুগে ভুগে রোগা হয়ে গেছে, সে নড়তে পারে না, বাইতে পারে না, দূত তাকে বলে গেল,— “তুমি এস, তোমার ডাক পড়েছে।” শুনে তার মুখ ফুটে হাসি বেরুল, সে উৎসাহে চোখ মেলে উঠে বসল। কিন্তু হায়! অন্ধকার নদী, অকূল তার কালো জল, স্রোতের টানে ফেনিয়ে উঠছে— সে নদী পার হবে কেমন করে? জলের দিকে তাকিয়ে তার বুকের ভিতরে দুর্‌ দুর্‌ করে উঠল। ভয়ে দু চোখ ঢেকে নদীর তীরে একলা দাঁড়িয়ে মেয়েটি তখন কাঁদতে লাগল। তাই দেখে সকলের চোখে জল এল, কিন্তু যেতেই যখন হবে তখন আর উপায় কি? মেয়েটির দুঃখে অফেরোর মন একেবারে গলে গেল। সে হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল। “ভয় নাই— আমি আছি।” কোথা হতে তার মনে ভরসা এল, শরীরে তার দশগুণ শক্তি এল— সে মেয়েটিকে মাথায় করে, স্রোত ঠেলে, আঁধার ঠেলে, বরফের মত ঠাণ্ডা নদী মনের আনন্দে পার হয়ে গেল। মেয়েটিকে ওপারে নামিয়ে সে বলল, “যদি সেই ক্রুশের মানুষের দেখা পাও, তাঁকে বলো, এ কাজ আমার বড় ভাল লেগেছে— যতদিন আমার ডাক না পড়ে, আমি তাঁর গোলাম হয়ে এই কাজেই লেগে থাকব।”

সেই থেকে তার কাজ হল নদী পারাপার করা। সে বড় কঠিন কাজ! কত ঝড়ের দিনে কত আঁধার রাতে যাত্রীরা সব পার হয়— সে অবিশ্রাম কেবলই তাদের পৌঁছে দেয় আর ফিরে আসে। তার নিজের ডাক যে কবে আসবে, তা ভাববার আর সময় নেই।

একদিন গভীর রাত্রে তুফান উঠল। আকাশ ভেঙে পৃথিবী ধুয়ে বৃষ্টির ধারা নেমে এল। ঝড়ের মুখে স্রোতের বেগে পথ ঘাট সব ভাসিয়ে দিল— হাওয়ার পাকে পাগল হয়ে নদীর জল ক্ষেপে উঠল। অফেরো সেদিন শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে— সে ভেবেছে, এমন রাতে কেউ কি আর পার হতে চায়! এমন সময় ডাক শোনা গেল। অতি মিষ্টি কচি গলায় কে যেন বলছে, “আমি এখন পার হব।” অফেরো তাড়াতাড়ি উঠে দেখল, ছোট্ট একটি শিশু ঝড়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, আর বলছে, “আমার ডাক এসেছে, আমি এখন পার হব।” অফেরো বললে, “আচ্ছা! এমন দিনে তোমায় পার হতে হবে!

ভাগ্যিস আমি শুনতে পেয়েছিলাম।” তারপর ছেলেটিকে কাঁধে নিয়ে “ভয় নাই”, “ভয় নাই” বলতে বলতে সে দুরন্ত নদী পার হয়ে গেল।
কিন্তু এবারেই শেষ পার। ওপারে যেমনি যাওয়া অমনি তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে পড়ল, চোখ যেন ঝাপসা হয়ে গেল, গলার স্বর জড়িয়ে গেল।

তারপর যখন সে তাকাল তখন দেখল, ঝড় নেই আঁধার নেই, সেই ছোট্ট শিশুটিও নেই— আছেন শুধু এক মহাপুরুষ, মাথায় তাঁর আলোর মুকুট। তিনি বললেন, “আমিই ক্রুশের মানুষ— আমিই আজ তোমায় ডাক দিয়েছি। এতদিন এত লোক পার করেছ, আজ আমায় পার করতে গিয়ে নিজেও পার হলে, আর তারি সঙ্গে শয়তানের পাপের বোঝা কত যে পার করেছ তা তুমিও জান না। আজ হতে তোমার অফেরো নাম ঘুচল; এখন তুমি Saint Christopher— সাধু খৃষ্টবাহন! যাও, স্বর্গের যাঁরা শ্রেষ্ঠ সাধু, তাঁদের মধ্যে তুমি আনন্দে বাস কর।”

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments