Read Free Bangla Books Online



আবার দেখা হবে – আনিকা তাবাসসুম

আবার দেখা হবে - আনিকা তাবাসসুম

‘তাড়াতাড়ি কর মা, ট্রেন মিস হয়ে যাবে।’ বাবার তাড়া শুনে দ্রুত ব্যাগ গোছাতে লাগলাম আমি। কলেজ ছুটি হয়েছে, বাড়ি যাচ্ছি। আমি রীতিমতো উড়ছি আনন্দে। দ্রুত ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়লাম। স্টেশনে পৌঁছে ভারী ব্যাগটা টানতে টানতে ঢুকলাম ওয়েটিংরুমে। সবার বিমর্ষ চেহারা দেখেই বুঝলাম, ঘাপলা আছে কোথাও। ওয়েটিংরুমের এক কোণে বসে লুঙ্গি পরা এক লোক খুব মনোযোগ দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিল। বাবা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই, ট্রেন কখন আসবে?’ দাঁত বের করে হেসে লোকটা বলল, ‘ট্রেইন আটকায়া দিছে। দুই ঘণ্টা লেট।’ বাবা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানে কী?’ লোকটা তার হাসি আরেকটু বিস্তৃত করে বলল, ‘মানে হইল ট্রেনের ইঞ্জিন নষ্ট হইছে। আসতে দুই ঘণ্টা দেরি হইব।’ শুনে সব আনন্দ হাওয়া হয়ে গেল আমার। দুই ঘণ্টা লেট! কোনো মানে হয়? বাবা অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই।

স্টেশনের লম্বা একটা খাম্বার গোড়ায় বসে পা দোলাচ্ছি আমি। মেজাজ খুব খারাপ। বাবা খাবার কিনতে গেছেন পাশের দোকানে। এই সময়ে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক ফোকলা দাঁত বের করে হেসে আমাকে বলল, ‘দুইটা টাকা দিবা মা?’

ট্রেন লেট করায় এমনিতেই মেজাজ ছিল খারাপ আমার। তার ওপর এই উটকো ঝামেলা। দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, ‘দুই টাকা দিতে হবে কেন? পাঁচ-দশ টাকা দিলে কী সমস্যা?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল লোকটা। পরক্ষণেই হেসে বলল, ‘মা-র কি মেজাজ খারাপ?’ যথেষ্টই খারাপ ছিল আমার মেজাজ। কিন্তু লোকটার এ কথায় একটু অবাকই হলাম। বললাম, ‘মেজাজ এতক্ষণ খারাপই ছিল। এখন অত বেশি খারাপ না।’

‘বাড়িতে যাইতাছ নাকি?’

‘জি।’

‘অ।’

কথা শেষ করে আয়েশ করে মাটিতে বসল লোকটা। চোখের ঘোলাটে চশমাটা মুছতে লাগল ময়লা কাপড় দিয়েই। মনে মনে ভাবলাম, লোকটার সঙ্গে কথা বলেই দেখি। সময়টাও কাটবে।

‘আপনি কোথায় থাকেন, চাচা?’

‘এইখানেই।’

‘একা থাকেন?’

‘হ।’

‘ছেলেমেয়ে নাই?’

লোকটা উদাস হয়ে বলল, ‘আছে গো মা।’

‘তারা আপনার সঙ্গে থাকে না?’

‘না, তারার কি এত সময় আছে? তাগো কত কাম! বুড়া বাপরে দেখনের সময় নাই।’

‘আপনার প্রতিদিন কেমন রোজগার হয় চাচা?’

‘বেশি ভালা না। আজকাল মানুষ ট্যাকা দিবার চায় না। সবাই কিপটা।’

আমি হাসলাম। চাচাও আমার সঙ্গে হাসলেন। তারপর আপন মনে বলতে লাগলেন, ‘তোমার লাহান আমার একটা মাইয়া আছিল। বড় আদর করত আমারে। একদিন ট্রেনের নিচে পইড়া মইরা গেল। মাইয়াটার মায়া আমি ছাড়তে পারি নাই। ওর মতন কাউরে দেখলেই কথা কইতে ইচ্ছা করে।’

চাচার কথা শেষ না হতেই ঘণ্টা বেজে উঠল। ট্রেন চলে এসেছে। আমি পেছন থেকে বাবার কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ‘জলদি আয় মুনা, ট্রেন চলে এসেছে।’ তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে চাচার হাতে দিলাম আমি। সেটা ফিরিয়ে দিয়ে উনি বললেন, ‘দুই ট্যাকাই দেও মা। তোমার কাছ থিকা দশ টাকা নিমু না।’ আমি হেসে দুই টাকার একটা নোটই দিলাম চাচাকে। চাচা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফেরত আইবা কবে?’

‘দশ দিন পর।’

‘কয়টার ট্রেন?’

‘লেট না হলে চারটায় পৌঁছাবে।’

‘অ।’

ট্রেন চলতে শুরু করেছে। বাবা আবার ডাকলেন, ‘তাড়াতাড়ি আয় মুনা। কার সঙ্গে এত কথা বলিস?’ ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে চাচাকে বললাম, ‘আসি চাচা, ভালো থাকবেন।’

‘তুমিও ভালা থাইকো মা।’

আমি আর দাঁড়ালাম না। ছুটলাম বাবার হাত ধরে। ট্রেনে উঠে জানালা দিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখি অচেনা সেই বৃদ্ধ তাকিয়ে হাসছেন আমার দিকে। আমি জানি, এই লোকটির সঙ্গে আবার দেখা হবে আমার। দশ দিন পর, এই রেলস্টেশনেই।

Facebook Comment

You May Also Like