ঠকিয়ে খাওয়া – লীলা মজুমদার

ঠকিয়ে খাওয়া - লীলা মজুমদার

আমাদের দেশের কত অখ্যাত লোক যে আসলে কত বুদ্ধি ধরে, গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তার ভূরিভূরি প্রমাণ পাওয়া গেছিল। দুঃখের বিষয়, সুযোগের অভাবে বুদ্ধিগুলো প্রায়ই বেআইনিভাবে প্রযুক্ত হওয়াতে, তার অধিকারীদের যথাযযাগ্য স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অবিশ্যি বেআইনি কাজের চমৎকারিত্বেরও যে একটা মনোহর দিক আছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সব চমৎকার ঘটনাকে ঠিক বেআইনিও বলা উচিত নয়।

বিশ্বভারতীর পরম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক নেপালচন্দ্র রায়ের বিষয়ে একটা গল্প আছে, যেটা তাঁর আপনজনরা অস্বীকার করলেও, সে এমনি চমৎকার যে বানানোও যদি হয়, তবু বারবার বলা চলে। একবার তাঁর নিতান্তই কলকাতায় যাওয়া দরকার, অথচ বোলপুর স্টেশনে এসে দেখেন গাড়িতে তিল ধরার জায়গা তো নেই-ই, উপরন্তু ঠিক সেই সময় গার্ড সবুজ নিশান গুটিয়ে নেওয়াতে গাড়িও গুটিগুটি চলতে শুরু করে দিল।

নেপালবাবু আর কী করেন, অগত্যা বাধ্য হয়ে গার্ডের কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে গাড়ির সিঁড়ির ওপর থেকে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে নিলেন। সেও প্রাণপণে লাল নিশান নাড়তে আর সিটি বাজাতে লাগল। গাড়ি থামল। দুজনে উঠে পড়লেন। আবার সবুজ নিশান দেখানো ও গাড়ি ছাড়া। গার্ডের গাড়িতে তাঁদের দুজনার মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু বলতে পারলাম না।

আরেকবার আমার এক জামাইবাবু প্রায় গাড়ি ফেল করেন-করেন, এমন সময় তাঁর উপস্থিতবুদ্ধি বন্ধুরা তাঁকে একরকম কোলপাঁজা করে গার্ডের গাড়িতে ছুড়ে দিলেন। বলাবাহুল্য গার্ড মহা খাপ্পা! ‘জানেন, এরকম বিপজ্জনক বেআইনি কাজ করার জন্য আপনার চাই কি একশো টাকা জরিমানাও হতে পারে?’

জামাইবাবু সেকথার উত্তর না দিয়ে, চোখ লাল করে বললেন, ‘আমার কষ্ট করে রাঁচি থেকে আনানো লিচুগুলো তুমি খেয়ে ফেলছ কেন?’ ফিরিঙ্গি গার্ড ফিক করে হেসে বলল, ‘ডোন্ট মাইন্ড স্যার। এই দেখুন যথেষ্ট আছে, যথেষ্টর চেয়ে বেশিই আছে।’ এই বলে পাশের ঝুড়ির ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে মুঠো মুঠো লিচু বের করে জামাইবাবুর ঝুড়ির ফাঁক তো ভরেই দিল, উপরন্তু তাঁকে এত লিচু খাওয়াল যে তিনি গলে জল। একেই বলে বেআইনি কাজের মনোহর দিক।

সবসময় অবিশ্যি মনোহর দিকটা প্রকট হয় না। সেকালে আরা স্টেশনের দো-আঁশলা স্টেশনমাস্টার নানা বিচিত্র উপায়ে মেলা কাঁচা টাকা জমিয়েছেন। এমন সময় এক সাগরেদ এসে খবর দিল, ‘একটু হুঁশিয়ার হয়ে চলবেন স্যার। যারা ভাগে কম পেয়েছে, তারা কিন্তু চুকলি করেছে।’

সায়েব পড়লেন মহা ফাঁপরে। এই ছোট জায়গার মধ্যে টাকা লুকোবার নিরাপদ জায়গা কোথায়? কাউকে বিশ্বাসও করা যায় না, যে যার নিজের ধান্দায় ঘুরছে। তখন প্রাণের বন্ধু ঘোড়ার ডাক্তার পিন্টো একটা বুদ্ধি দিল। ‘একটা কাজ করো। নোটগুলোকে কাগজে মুড়ে একটা ছোট প্যাকিং কেসে ভরে, আচ্ছা করে স্ক্রুপ্‌ এঁটে বন্ধ করো। ওপরে লিখে দাও ‘নেল্‌স্‌ ওন্‌লি’— পেরেক ছাড়া কিছু নয়। তারপর দাও পাঠিয়ে মেমের কাছে।’

সায়েব হাতে চাঁদ পেলেন। ‘এতই যদি করলে, ম্যান্‌, আরেকটু করো। আমি সব প্যাক্‌ট্যাক্‌ করে দিচ্ছি, কিন্তু পার্সেলটা তুমিই করে দিয়ে এসো। আমি ওটার সঙ্গে জড়িত হতে চাই না। বলা যায় না, যদি কারও চোখে পড়ে যাই। তোমরা তো হরদম ঘোড়ার নাল, পেরেক ইত্যাদি পাঠাও।’

অগত্যা তাই করা হল। পিন্টো বেনামার রসিদ এনে সায়েবকে দিয়ে গেল। সামান্য একটু তদন্ত হল। বলাবাহুল্য কোথাও কিছু পাওয়া গেল না। সব চুকে গেলে পর, হন্তদন্ত হয়ে সায়েব গোমো গিয়ে মেমকে জিজ্ঞাসা করল, ‘পার্সেল পেয়েছিলে তো?’

মেম মহা খাপ্পা, ‘আচ্ছা, প্যাকিং-কেস বোঝাই পেরেক পাঠাবার মানেটা কী? আমি ভাবলাম না জানি কী এসেছে!’ সায়েবের মুখ চুন! কোনও কথা ভেঙেও বলা গেল না। ডিউটিতে ফিরে গিয়ে শুনল প্রাণের বন্ধু পিন্টো পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে গোয়া না কোথায় চলে গেছে!

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় অসম্ভব বলে কিছু ছিল না। মাঝখান থেকে বুদ্ধিমানরা দু’পয়সা করে নিয়েছিল। ব্রিজের গল্পটা শুনেছেন? ব্রিজ মানে তাস-খেলা নয়? স্রেফ যাকে বলে সাঁকো বা পুল, সেই ব্রিজ। তখন যুদ্ধ খুব ঘোরেল হয়ে এসেছে। মিলিটারির স্থাপত্যবিভাগ চোখে-মুখে পথ দেখছিল না। প্রাইভেট কন্ট্রাক্টর লাগাতে হচ্ছিল। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ। টাকাকড়ি নিরাপদে রাখাও এক মহা সমস্যা।

থেকে থেকেই শোনা যেত—ওই জাপানিরা এল! ওই দিশি বিদ্রোহীরা এল! বর্মার পাহাড় ফুঁড়ে এই এসে পড়ল বলে! তাদের ঠেকাবার জন্য সাঁজোয়া বাহিনী যাবে! কিন্তু যাবার পথ কই? নদী পার হতে হবে, সাঁকো কই? সঙ্গে সঙ্গে স্থাপত্য বিভাগ তৎপর হয়ে উঠত। কাঁচা পথ পাকা করো। ভাঙা পথ জোড়া দাও। নেই-পথ তৈরি করো। লড়বে আমেরিকান বাহিনী। পদাধিকারীদের কাছে হুকুম এল বাড়তি কন্ট্রাক্টর লাগিয়ে যেমন করে হোক, সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা ব্রিজ সব তৈরি করে ফেলো। টাকার জন্য ভাবতে হবে না।

সেই সময় উত্তর-পূর্ব বাংলায়— জায়গার নাম বলা তখন বারণ ছিল, এখন ভুলেও গেছি— একটা মাঝারি নদীর ওপর মজবুত ব্রিজ বানাতে হবে। অর্ডার, নকশা, টাকাকড়ি এসে গেল। ব্যস জিনিসপত্র জোগাড় করে তৈরি করে ফেললেই হয়ে গেল। সেখান থেকে সীমান্তের দূরত্ব কাক-ওড়া কুড়ি মাইল। কাছাকাছি জনবসতি নেই।

পদাধিকারী ব্যস্ত হয়ে কন্ট্রাক্টরকে বললেন, ‘তা হলে কাজটা শুরু করে দিন, কী বলেন? টাকাও যখন এসে গেছে।’

কন্ট্রাক্টর বললেন, ‘এত কীসের তাড়া, দাদা? ওপথে কখনও শত্তুর আসে? কে না জানে ওটা হল গিয়ে ভূত-প্রেতের রাজ্য? কাজ করবার একটা মানুষ পাবেন না। তা ছাড়া এত তাড়াতাড়ি কীসের?’

এমনি করে সপ্তাহ যায়, মাস যায়, ব্রিজের কাজও শুরু হয় না, টাকাও শেষ হয়। এমনি সময় একদিন হন্তদন্ত হয়ে পদাধিকারী গিয়ে কন্ট্রাক্টরের ক্যাম্পে হাজির হলেন। ‘সর্বনাশ হয়েছে, মশাই! ইংরেজ কমান্ডার আসছে ব্রিজ্‌ পরিদর্শন করতে। এদিক দিয়ে নাকি শত্তুর আসবে না, কিন্তু আমাদের সাঁজোয়া বাহিনী এগোবে শত্তুরকে আক্রমণ করতে!!’

কন্ট্রাক্টর চায়ের পেয়ালা নামিয়ে বললেন, ‘অত ভাবনা কীসের, দাদা? লিখে দিন অর্ডারের ভাষার অস্পষ্টতার দরুন ব্রিজ্‌টা এখানে না করে, হিমালয়ের পাদদেশে একটা ছোট নদীর ওপর করা হয়েছে। অ্যাওয়েটিং ফার্দার অর্ডার্স। ব্যস্‌৷ চুকে গেল!’

হলও তাই। তবে ঠিক চুকে গেল না। মিলিটারি থেকে দু’গুণ টাকা এল। যথাস্থানে সত্বর নতুন ব্রিজ তৈরি হোক, দিন রাত মজুর লাগাও। তার জন্যে বাড়তি টাকা। আর ভুল জায়গার ব্রিজের ওপর দিয়ে সুবিধা পেয়ে যদি জাপানিরা হানা দেয়, তাই সেটা ভেঙে ফেলার জন্যে এই এই টাকা!

বলাবাহুল্য সেই নেই-সাঁকো ভেঙে ফেলার টাকার অবিলম্বে সদগতি হল। আর ঠিক জায়গায় সাঁকো তৈরি করার আগেই যুদ্ধ থেমে গেল। মিলিটারি তখন অন্যান্য আরও জরুরি কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ব্রিজের জন্য দেওয়া ওই সামান্য দশ-পনেরো লাখ টাকার হিসেবও কেউ দেখতে চাইল না।

Facebook Comment

You May Also Like

About the Author: eBooks

Read your favourite literature free forever on our blogging platform.