Friday, March 29, 2024
Homeগোয়েন্দা গল্পশার্লক হোমস: দ্য মাসগ্রেভ রিচুয়াল

শার্লক হোমস: দ্য মাসগ্রেভ রিচুয়াল

শার্লক হোমস: দ্য মাসগ্রেভ রিচুয়াল

শার্লক হোমসের চিন্তায় শৃঙ্খল ছিল, পোশাকে পরিপাট্য ছিল, কিন্তু পরিচ্ছন্নতা ছিল না ব্যক্তিগত অভ্যাসে। পারস্য দেশের চটির মধ্যে তামাক, কয়লা রাখার জায়গায় চুরুট, কাঠের ম্যান্টলপিসে ছুরি দিয়ে গাঁথা জবাব-না-দেওয়া চিঠি, যেখানে সেখানে কাগজের স্তুপ আর যত্রতত্র রাসায়নিক বিশ্লেষণের সরঞ্জাম। গুছিয়ে রাখা ওর ধাতে নেই– কাউকে গুছোতেও দেবে না। কুঁড়ের বাদশার মতো দিনরাত হয় বেহালা, নয় বই নিয়ে বসে থাকত চেয়ারে। একদিন তো চেয়ারে বসেই এক-শোটা কার্তুজ নিয়ে পিস্তল ছুড়তে লাগল দেওয়াল লক্ষ করে এবং গুলির দাগ দিয়ে চুনকাম খসিয়ে V.R অক্ষর দুটো ফুটিয়ে তুলল দেওয়ালে।

ন-মাসে ছ-মাসে একবার অমানুষিক পরিশ্রম করে পুরোনো কেসের কাগজপত্র সাজিয়ে রাখত একটা বাক্সে। ফিতে দিয়ে বাঁধত, ক্রমিক সংখ্যা দিত। দলিলগুলো ছিল ওর বুকের পাঁজর। কিন্তু ওই একবারই। তারপর আবার আলসেমিতে পেয়ে বসত। উদ্যম বিস্ফোরিত হয়েই মিলিয়ে যেত— আসত অপরিসীম নিস্ক্রিয়তা।
একদিন বিরক্ত হয়েই বললাম ঘরের কোণে ছড়ানো কাগজের ডাইগুলো সাজিয়ে রাখতে। বিরস বদনে শোবার ঘরে উঠে গেল হোমস। হিড় হিড় করে একটা পেল্লায় বাক্স টানতে টানতে ফিরে এল একটু পরেই। চেয়ার টেনে নিয়ে বসল পাশে।
ডালা খুলে নষ্টামির সুরে বলল, ভায়া ওয়াটসন, এর মধ্যে এমন সব কেস আছে যা তুমি টেনে বার করতে চাইবে, নতুন কেস ভেতরে পুরতে চাইবে না।
দেখলাম বাক্সটার তিন ভাগ ভরতি রাশি রাশি লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা কাগজের বান্ডিল।
পুরোনো মামলার দলিল?, বললাম আমি।
হ্যাঁ। আমার জীবনীকারটি আমার জীবনে আসার আগে যেসব আশ্চর্য মামলার কিনারা করেছিলাম, এর মধ্যে আছে সেইসবের বৃত্তান্ত।
বলতে বলতে নীচ থেকে একটা কাঠের বাক্স টেনে বার করল হোমস। বাচ্চাদের খেলনার বাক্সের মতো ডালাটা একপাশে টেনে খুলতে হয়। ভেতরে থেকে বেরোল অদ্ভুত কতকগুলো জিনিস।
দলা পাকানো একটা কাগজ, মান্ধাতার আমলের একটা পেতলের চাবি, একটা কাঠের গোজের সঙ্গে সুতো দিয়ে বাঁধা মরচে পড়া তিনটে ধাতুর টুকরো।
অবাক হয়ে বললাম, অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস জোগাড় করেছ দেখছি।
এর সঙ্গে যে-ইতিহাসটা জড়িয়ে আছে, সেটাও কম অদ্ভুত নয়। বলে, জিনিসগুলো একে একে সাজিয়ে রাখল টেবিলে। নিবিড় চোখে চেয়ে রইল সেইদিকে। দুই চোখে দেখলাম আত্মপ্রসাদের ঝিলিক।
বলল, ‘মাসগ্রেভ-সংহিতা’ যাতে কখনো না-ভুলি, এ-সংগ্রহ সেই কারণেই।
মাসগ্রেভ-সংহিতা নামটা এর আগেও তোমার মুখে শুনেছি। ঘটনাটা শুনিনি। বলবে?

দুই চোখে দুষ্টুমি নাচিয়ে হোমস বললে, তাহলে কিন্তু কাগজের পাহাড় যেমন তেমনি পড়ে থাকবে। কেসটা কিন্তু সত্যিই অসাধারণ। আমার কীর্তির তালিকা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এ-ঘটনা না প্রকাশ পেলে।
লন্ডনে প্রথমে এসে বাসা নিলাম ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কোণে মন্টেগু স্ট্রিটে ‘গ্লোরিয়া স্কট’ কেসেই প্রথম বুঝি কোন পথে জীবিকা অর্জন করতে হবে আমাকে। মাসগ্রেভ সংহিতা আমার তৃতীয় কেস।
প্রথম দিকে কেস আসত ছাত্ৰবন্ধু মারফত। বাকি সময়টা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বই পড়তাম, নিজেকে আরও তৈরি করতাম।
রেজিনাল্ড মাসগ্রেভ পড়ত একই কলেজে। খানদানি চেহারা। চেহারা দেখলেই চোখের সামনে যেন ভেসে উঠত সামন্তযুগের বিরাট খিলানওয়ালা পুরোনো প্রাসাদ। উত্তর অঞ্চলে সুপ্রাচীন মাসগ্রেভদের মূল অংশ থেকে ওরা বিচ্ছিন্ন হয়ে এসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পশ্চিম সাসেক্সে হালস্টোনে ।
বছর চারেক ওকে দেখিনি। হঠাৎ একদিন হাজির হল মন্টেগু স্ট্রিটের বাসায়। বলল, হোমস, কলেজে যেসব ভেরকি দেখিয়ে অবাক করে দিতে সবাইকে, শুনলাম সেই সব কায়দায় অনেক সমস্যার সমাধান করছ ইদানীং?
সায় দিলাম আমি ও তখন বললে, হালস্টোনে অদ্ভুত কতকগুলো ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ হালে পানি পাচ্ছে না।
শুনে মনটা নেচে উঠল আমার। পুলিশ যেখানে থই পায় না, আমি সেখানে কিছু করতে পারব, এ-বিশ্বাস আমার বরাবরের। আর এইরকম সমস্যার জন্যেই তো হা-পিত্যেশ করে বসেথাকা ।
সাগ্রহে বললাম, কী ব্যাপার বলো তো?
রেজিনাল্ড সিগারেট ধরিয়ে বললে, বছর দুই হল বাবা মারা গেছে। আমি এখনও বিয়ে করিনি। পুরোনো আমলের বাড়ি। ফি বছরে শিকারের জন্যে অনেক লোককেও নেমস্তন্ন করতে হয়। কাজেই বেশ কিছু চাকরবাকর দরকার হয়। আটজন ঝি, রান্নার ঠাকুর, বাটলার, দুজন দারোয়ান, আর একটা বাচ্চা চাকর। এ ছাড়া বাগান আর আস্তাবল দেখাশুনোর জন্যেও লোক আছে।
এদের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো লোক হল বাটলার ব্রানটন। আগে স্কুল মাস্টারি করত। চাকরি যাওয়ার পর বাবা খাসচাকরের কাজ দেয়। খুব সুন্দর চেহারা। স্বভাবও তেমনি। বছর চল্লিশ বছর বয়স। বেশ কয়েকটা ভাষা বলতে পারে, যেকোনো বাজনা বাজাতে পারে। কুড়ি বছর আমাদের বাড়িতে আছে।
দোষ ওর একটিই. মেয়েদের প্রতি দুর্বলতা। যতদিন বউ ছিল, ব্রানটনও বেশ ছিল। বিপত্নীক হওয়ার পরেই আরম্ভ হল মেয়েদের নিয়ে খেলা। ঝি র‌্যাচেলকে তো বিয়ে করবে বলে কথাও দিয়ে দিল— কিন্তু তারপরেই তাকে ছেড়ে আর একটি মেয়ের সঙ্গে এমন মাখামাখি আরম্ভ করল যে ব্ৰেন-ফিভার হয়ে গেল র‌্যাচেলের। শরীর আধখানা হয়ে গেল। মেয়েটি সত্যিই ভালো। কিন্তু ওয়েলসের মেয়ে তো, উত্তেজিত হয় পান থেকে চুন খসলে। ছায়ার মতো এখন বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়— আগেকার র‌্যাচেল আর নেই।

এই হল গিয়ে হালস্টোনের প্রথম নাটক। দ্বিতীয় নাটকের শুরুতে বদনাম নিয়ে চাকরি খোয়াল ব্রানটন।
ব্রানটনের গুণ অনেক। বুদ্ধিও প্রখর। কিন্তু এই বুদ্ধিই ওর সর্বনাশ করে ছাড়ল। বেশি বুদ্ধি থাকার জন্যেই সব জিনিসই জানতে চাইত—সব ব্যাপারেই কৌতুহল থাকত— যা ওর জানার কথা নয়— সে-ব্যাপারও। ছোট্ট একটা ঘটনায় একদিন চোখ খুলে গেল আমার।
গত বেম্পতিবার রাত্রে খাওয়ার পর কড়া পানীয় খাওয়ায় ঘুম আসছিল না। রাত দুটোর সময় ভাবলাম– ধুত্তোর, জেগে শুয়ে থাকার চাইতে বরং আধ-পড়া উপন্যাসখানা শেষ করি। বইটা বিলিয়ার্ড-ঘরে রেখে এসেছিলাম। ড্রেসিংগাউন গায়ে চাপিয়ে আনতে চললাম।
লাইব্রেরি-ঘরের পাশ দিয়ে যেতে হয় বিলিয়ার্ড-রুমে। হঠাৎ দেখলাম আলো বেরুচ্ছে লাইব্রেরির খোলা দরজা দিয়ে। চমকে উঠলাম। নিশ্চয় চোর ঢুকেছে। কেননা, আলো নিভিয়ে গেছিলাম। বাড়িটা আমাদের পুরোনো। প্রায় সব বারান্দা আর করিডোরের দেওয়ালে হাতিয়ার টাঙানো থাকে। একটা টাঙি পেড়ে নিয়ে পা টিপে টিপে গিয়ে দাঁড়ালাম লাইব্রেরি-রুমের দরজায়।
দেখলাম, ইজিচেয়ারে বসে ঘাড় হেট করে একমনে একখানা ম্যাপের মতো কাগজ দেখছে ব্রানটন। কোনোদিকে হুশ নেই। পরনে পূর্ণ পোশাক, রাতের পোশাক নয়। স্তম্ভিত হয়ে দেখছি এই দৃশ্য। ম্যাপখানা দেখা শেষ করে উঠে গেল ও দেরাজের কাছে। চাবি দিয়ে পাল্লা খুলে একটা কাগজ টেনে বার করল খুপরি থেকে। টেবিলের ছোটাে আলোর পাশে মেলে ধরে পড়তে লাগল তন্ময় হয়ে।
পারিবারিক কাগজপত্রে ওর এই গোপন কৌতুহল দেখে রাগে ঘেন্নায় গা জ্বলে গেল আমার। এক পা এগুতেই চেয়ার থেকে ছিটকে গেল ব্রানটন। দেখলাম ভয়ে ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল মুখ। ম্যাপের মতো কাগজখানা ঝট করে ভাঁজ করে রেখে দিল বুকপকেটে। ফেটে পড়লাম আমি। বলে দিলাম, সকাল হলেই যেন এ-বাড়ি থেকে বিদেয় হয়। এত বড়ো স্পর্ধা!
ঘাড় হেট করে বেরিয়ে গেল ব্রানটন। এত তন্ময় হয়ে কী পড়ছিল, দেখবার জন্যে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম, কাগজখানা খুব একটা দরকারি কিছু নয়। মাসগ্রেভ-সংহিতা। ধর্মীয় নির্দেশের কায়দায় শ্লোকের মতো লেখা কতকগুলো বাণী। মাসগ্রেভ বংশে সাবালক হলেই প্রত্যেককে এটা একবার পড়তে হয়। এ ছাড়া এর আর কোনো দাম নেই।
চাবি লাগানো ছিল দেরাজে। পাল্লা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছি, এমন সময়ে দেখলাম ব্রানটন আমার সামনে দাঁড়িয়ে।

কাকুতিমিনতি করে একমাস সময় চাইল। লোকে যদি জানে, গলা ধাক্কা খেয়ে রাতারাতি চাকরি গিয়েছে, মাথা কাটা যাবে। তাই যেন নিজেই চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছে— এইভাবে এক মাসের নোটিশ দিতে চাইল।
আমি বললাম, তোমার মতো বদ চরিত্রের লোককে একমাস এ-বাড়িতে আর রাখা যায় না। যাই হোক, অনেকদিন নুন খেয়েছ, পাঁচজনের সামনে তাই তোমার মাথা হেট করব না। সাতদিন সময় দিলাম।
ও যেন কঁকিয়ে উঠল। কাতরভাবে পনেরোটা দিন সময় চাইল। আমি একদিনও বাড়ালাম না। বিধ্বস্ত মুখে মাথা নীচু করে ও চলে গেল।
দু-দিন মুখ বুজে কাজ করে গেল ব্রানটন। আমিও কারো কাছে কিছু ভাঙলাম না। তৃতীয় দিন সকালে রোজকার মতো সারাদিনের নির্দেশ নিতে আমার টেবিলে এল না।
ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে র‌্যাচেলকে দেখলাম। রোগভোগের জন্যেই মুখখানা বড্ড বেশি লম্বা আর ফ্যাকাশে ঠেকল। বললাম, এখন ওর কাজ করার দরকার নেই। গায়ে শক্তি আসুক। ডাক্তার যদি বলে, তাহলে কাজে লাগবে।
ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে রইল র‌্যাচেল। আচমকা পাগলের মতো হাসতে আর কাঁদতে কাঁদতে বললে, চলে গেছে ব্রানটন… চলে গেছে।
কোথায় গেছে?

জানি না… জানি না… ব্রানটন পালিয়েছে. পালিয়েছে… হাঃ হাঃ হাঃ…— তারপরেই হাউ হাউ করে কান্না।
দেখলাম হিস্টিরিয়ায় ধরেছে র‌্যাচেলকে। লোকজন ডেকে ওকে ঘরে নিয়ে যেতে হুকুম দিলাম। নিজে গেলাম ব্রানটনের ঘরে। বিছানায় শোয়নি রাতে, কিন্তু কালো সুট পরে বেরিয়েছে– অথচ জুতো রেখে গেছে, শুধু চটি পায়ে দিয়েছে। জানলা দরজা বন্ধ। টাকাপয়সা, ঘড়ি, জামাকাপড় সব রয়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার তো। তাহলে ও গেল কোথায়?
বিরাট বাড়ির সর্বত্র খোঁজা হল— চিলেকোঠা থেকে পাতালঘর পর্যন্ত ওকে পাওয়া গেল না। পুলিশ ডাকলাম। আগের রাত্রে বৃষ্টি হয়েছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে বাগানের ভিজে মাটির রাস্তায় নিশ্চয় পায়ের ছাপ থাকত— তাও নেই। জিনিসপত্র না-নিয়েই উধাও হয়েছে ব্রানটন এবং অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে।

দু-দিন প্রলাপ বকে গেল র‌্যাচেল। নার্স মোতায়েন করলাম দিনে রাতে। তৃতীয় রাতে র‌্যাচেল ঘুমোচ্ছে দেখে নার্স চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে উঠে দেখলে সে নেই। জানলার নীচ থেকে তার পায়ের ছাপ গিয়ে শেষ হয়েছে জলার ধারে। হ্রদের জল মাত্র আট ফুট গভীর। জাল ফেলা হল জলে। র‌্যাচেলকে পাওয়া গেল না। কিন্তু জালে উঠে এল একটা কাপড়ের থলির মধ্যে অদ্ভুত কতকগুলো জিনিস। জং-ধরা কতকগুলো বেরং ধাতব টুকরো আর কয়েকটা ম্যাটমেটে রঙের নুড়ি বা কাঁচ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ব্রানটন বা র‌্যাচেলের টিকি দেখা যায়নি। পুলিশ হালে পানি পাচ্ছে না। হোমস, তাই এসেছি তোমার কাছে। ওয়াটসন, অদ্ভুত অন্তর্ধান কাহিনি শুনে মনটা আমার নেচে উঠল। সবগুলো ঘটনা দেখে মনে মনে পরপর সাজিয়ে নিলাম। ব্রানটন আর র‌্যাচেল দুজনেই নিখোঁজ। র‌্যাচেল প্রথমে ভালোবাসত ব্রানটনকে— পরে তাকে দু-চক্ষে দেখতে পারত না। সে উদ্দাম, উত্তাল, আবেগময়— ওয়েলসের মেয়েরা যা হয়। ব্রানটন পালিয়ে গেছে, এই ঘটনায় তার হিস্টিরিয়া হয়েছিল। তারপর লেকের জলে অদ্ভুত জিনিস বোঝাই থলি ফেলে উধাও হয়েছে।
বললাম, ম্যাসগ্রেভ, ব্রানটন যে-কাগজখানা দেখছিল, সেটা কোথায়?

এই নাও, বলে এই কাগজটা বাড়িয়ে দিল মাসগ্রেভ। সেইসঙ্গে বললে, এটা কিন্তু এমন কিছু গুরুতর ব্যাপার নয়।
ওয়াটসন, এই সেই কাগজ। মাসগ্রেভ-সংহিতা। অদ্ভুত ছড়া, বিচিত্র প্রশ্নোত্তর। সাবালক হলেই মাসগ্রেভ বংশধরদের পড়তে হত। শোনো পড়ছি :
এটা কার?
যে গেছে, তার।
পাবে কে?
যে আসবে, সে।
মাস-টা তখন কী?
প্রথম থেকে ষষ্ঠ।
সূর্য তখন কোথায়?
ওক গাছের মাথায়।
ছায়া তখন কোথায়?
এলম গাছের তলায়।
পায়ের মাপ কেমন?
উত্তরে দশ আর দশ, পুবে পাঁচ আর পাঁচ, দক্ষিণে দুই আর দুই, পশ্চিমে এক আর এক, তার পরেতে নীচে।
বিনিময়ে দেব কী?
যা আছে সব— আবার কী?
দিতেই-বা যাব কেন?
বিশ্বাসের দাম যে তাই।
মাসগ্রেভ বললে, তারিখ নেই। কিন্তু বানান দেখে মনে হয় সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে লেখা। আসল রহস্যের কিনারা এতে হবে না।
আমি বললাম, আমার কিন্তু মনে হয় একটা রহস্যের সমাধান করলে আর একটারও হয়ে যাবে। একটা কথা বলে রাখি। কিছু মনে কোরো না। ব্রানটন তোমাদের বংশের দশ পুরুষের যেকোনো ব্যক্তির চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। কাগজটা সে আগেও অনেকবার দেখেছে। শেষবার দেখছিল ঝালিয়ে নেওয়ার জন্যে— সেই সময় তুমি ওকে ধরে ফেলেছিলে।
মাসগ্রেভ বললে, হতে পারে। এমন কিছু দরকারি নয় বলেই কাগজখানা ওইভাবে রেখে দেওয়া হয়েছিল। তবে এর কোনো বাস্তব দাম আছে বলে মনে হয় না।
ঠিক উলটো। এটা দারুণভাবে একটা বাস্তব ব্যাপার। ব্রানটন ঠিক সেই চোখেই এ-কাগজ দেখেছিল। ম্যাপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছিল ছড়ার কথা। ম্যাপটা পকেটে নিয়ে গেছে, তাই না?
হ্যাঁ। কিন্তু ম্যাপের সঙ্গে মাসগ্রেভ-সংহিতার কী সম্পর্ক বুঝছি না।
সেট বোঝবার জন্যেই প্রথম ট্রেনে সাসেক্স যাব।

বিকেল বেলা পৌঁছোলাম হালস্টোন। বাড়িটা প্রকাণ্ড (ইংরেজি “L” অক্ষরের মতো। একটা দিক বেজায় পুরোনো। দরজার মাথায় লেখা ১৬০৭। এদিকটা এখন গুদোমঘর আর মদ রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর একটা দিক পরে তৈরি হয়েছে। বাড়ির সামনে বাগান। বাগান ঘিরে পুরোনো আমলের প্রকাণ্ড গাছ। লোকটা দু-শো গজ দূরে বড়োরাস্তার ধারে।
আগে থেকেই কেসটা সম্বন্ধে একটা সিদ্ধান্ত মাথার মধ্যে খাড়া করে নিয়েছিলাম। মাসগ্রেভ-সংহিতাই এই রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু। আজব ছড়াটা আবোল-তাবোল বকুনি মোটেই নয়।
কোনো এক বুদ্ধিমান পূর্বপুরুষ হেঁয়ালি দিয়ে একটা পরম সত্যকে গোপন করেছেন, প্রতিটি বংশধরের সামনে সেই গুপ্ত সত্যকে মেলে ধরা হয়েছে— কেউ আসল অর্থ ধরতে পারেনি। পেরেছে ব্রানটন। ছড়ার মানে সে বুঝেছে। সেইমতো ম্যাপ এঁকেছে। নিশ্চয় কোনো একটা লুকোনো জায়গার হদিশ সেই ম্যাপে আর এই ছড়ার মধ্যে আছে। আমাকেও তা খুঁজে বার করতে হবে ওকগাছ আর এলম গাছের অবস্থান জেনে নিয়ে। আশ্চর্য সুন্দর একটা ওকগাছ দেখলাম বাড়ির ঠিক সামনেই রাস্তার ডান পাশে। গাছ তো নয়— মহীরুহ-সম্রাট বললেই চলে। পাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছিল। মাসগ্রেভকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, কাগজের ছড়া যখন লেখা হয়, এ-গাছ তার চাইতেও পুরোনো। নর্মানরা ইংলন্ড জয় করে যখন, তখনও ছিল। পরিধি তেইশ ফুট। আমার এক নম্বর অনুমান তাহলে সত্যি হল। ছড়ার মধ্যে ওকগাছের উল্লেখ করা হয়েছে কেন বোঝা গেল। এবার দেখা দরকার এলম গাছটা কোথায়। জিজ্ঞেস করলাম মাসগ্রেভকে। যখন লেখা হয়, সেই সময়কার কোনো এলম গাছের হদিশ সে জানে কি না।

ও বললে, নিশ্চয় জানি। কিন্তু দশ বছর আগে বাজ পড়ে পুড়ে গেছে। গুড়িটাও কেটে ফেলা হয়েছে।
কোথায় ছিল গাছটা, জিজ্ঞেস করলাম।
নিয়ে গিয়ে জায়গাটা দেখাল মাসগ্রেভ। বাড়ি থেকে ওকগাছ পর্যন্ত লাইন টানলে ঠিক মাঝখানে পড়ে সেই জায়গাটা। দু-নম্বর অনুমানও সত্যি হতে চলেছে বুঝলাম।
জিজ্ঞেস করলাম, এলম গাছটা কতখানি উঁচু ছিল, জানা আছে কি?
ঝট করে মাসগ্রেভ বললে, চৌষট্টি ফুট।
আমি তো অবাক ওর ঝটপট জবাব শুনে। তারপর শুনলাম, ট্রিগোনোমেট্রির অঙ্ক শেখবার সময়ে মাস্টারমশায়ের পাল্লায় পড়ে বাগানের সবকটা গাছের উচ্চতা সে বার করেছে। এলম গাছের উচ্চতাও সে জানে।
জিজ্ঞেস করলাম, মাসগ্রেভ, কখনো এ-প্রশ্ন তোমাকে করেছে?
মাসগ্রেভ অবাক হয়ে বললে, তুমি জানলে কী করে?

মাস কয়েক আগে সহিসের সঙ্গে কথা কাটাকাটির সময়ে সত্যিই আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, কত উঁচু ছিল এলম গাছটা।
বুঝলাম, ঠিক পথে তদন্ত চলেছে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ওকগাছের মাথা ছোবে তপনদেব। আশ্চর্য-সংহিতার একটা কথা মিলে যাবে। এখন দেখতে হবে এলম গাছের শেষ প্রান্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে। কাজটা খুবই কঠিন, কেননা এলম গাছই নেই। কিন্তু ব্রানটন যা পেরেছে, আমি তা পারব না, তা কি হয়? মাসগ্রেভকে নিয়ে গেলাম ওর পড়ার ঘরে। কাঠের এই গোজটা বানিয়ে নিলাম, তাতে বাঁধলাম এই লম্বা দড়িটা, এক গজ অন্তর একটা গিট দিলাম। তারপর একটা ছিপ নিলাম, লম্বায় ছ-ফুট। মাসগ্রেভকে নিয়ে ফিরে এলাম এলম গাছ যেখানে ছিল, সেইখানে। ওকের মাথা ছুঁয়েছে সূর্য। ছিপটা খাড়া করে গেঁথে ছায়াটা মেপে দেখলাম লম্বায় ন-ফুট।
হিসেবটা এখন জলের মতো সোজা। ছ-ফুট লম্বা ছিপের যদি ন-ফুট লম্বা ছায়া পড়ে চৌষট্টি ফুট লম্বা গাছের ছায়া হবে ছিয়ানব্বই ফুট লম্বা, একই লাইনে পড়বে সেই ছায়া। ছিয়ানব্বই ফুট মেপে পৌছে গেলাম বাড়ির দেওয়ালের কাছে। গোজটা পুতলাম সেখানে। দু-ইঞ্চি তফাতে দেখলাম শঙ্কুর মতো কাঠি দেবে গেছে। অর্থাৎ ব্রানটন এইখানে চিহ্ন দিয়েছিল। আমি এখন চলেছি তার মাপের পেছন পেছন।
এই পয়েন্ট থেকে পা ফেলে এগোতে হবে। আগে পকেট কম্পাস দিয়ে দেখে নিলাম উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম ঠিক কোন কোন দিকে। বাড়ির সমান্তরাল লাইনে এগোলাম বাঁ-পায়ে দশ পা, আবার ডান পায়ে দশ পা। একটা খোঁটা পুতলাম সেখানে। ঠিক সেইভাবে হিসেব করে পাঁচ পা ফেললাম পুবদিকে, দু-পা দক্ষিণ দিকে। সেকেলে দরজার সিঁড়ির গোড়ায় পৌছে গেলাম। এখন দু-পা পশ্চিমে এগোনো মানে পাথর-বাঁধানো গলিপথে দু-পা ফেলা। সংহিতায় ঠিক এই জায়গার কথাই বলা হয়েছে।
ওয়াটসন, জীবনে এ-রকম হতাশ হইনি। মুহুর্তের জন্যে মনে হল নিশ্চয় গোড়ায় গলদ করে বসেছি। হিসেবে ভুল হয়েছে। পড়ন্ত রোদ পড়েছে গলিপথের মেঝেতে। সর্বত্রই একইরকম নিরেট আওয়াজ শুনলাম, ফাটল বা চিড় কোথাও দেখলাম না। আমার কাজ দেখে মাসগ্রেভের টনক নড়েছিল। আমার উদ্দেশ্য ও আঁচ করেছিল। হিসেবটা ঠিক আছে কি না দেখার জন্যে বার করল সংহিতা।
বললে সোল্লাসে, তার পরেতে নীচে— হোমস, ‘তার পরেতে নীচে’ কথাটা খেয়াল করছ না কেন?
আগে ভেবেছিলাম, এ-কথার মানে পাথর খোড়া। এখন বুঝলাম ভুল করেছি। উত্তেজিত গলায় বললাম, এর নীচে পাতাল-কুঠরি আছে নাকি?
আছে, আছে, সেকেলে বাড়ি তো!– একদম নীচে যেতে হবে, এই দরজা দিয়ে।
ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেখানে পৌঁছোলাম, এক নজরেই বোঝা গেল, আগেও সেখানে লোক এসেছে। লণ্ঠনটা রাখলাম একটা পিপের ওপর।
আগে এখানে কাঠ রাখা হত। মাঝখান থেকে কাঠ সরিয়ে মেঝে খালি করা হয়েছে। জংধরা লোহার আংটা লাগানো পাথরের চাই বসানো সেখানে। আংটায় জড়ানো একটা পুরু চেককাটা মাফলার।
অবাক হয়ে মাসগ্রেভ বললে, এ তো ব্রানটনের মাফলার দেখছি। এখানে মরতে এসেছিল কেন?

দুজন পুলিশের সামনে আংটা ধরে পাথরটা টেনে তোলা হল। একা পারলাম না। একপাশে পাথর রেখে অন্ধকার গর্তের মধ্যে নামিয়ে দেওয়া হল লণ্ঠন।
লম্বায় চওড়ায় চার ফুট আর সাত ফুট গভীর একটা কুঠরির মধ্যে এক কোণে পেতলের পাত দিয়ে মোড়া একটা কাঠের বাক্স দেখলাম। ডালাটা খোলা। গায়ে চাবি লাগানো— এই সেই চাবি, ওয়াটসন। ধুলো আর ছাতলা লাগানো কাঠে পোকা লেগেছে। কতকগুলো গোলমতো ধাতুর চাকতি— মানে, সেকেলে মুদ্রা ছাড়া বাক্সর ভেতরে আর কিছু নেই। একটা মুদ্রা আমার কাছে রেখেছি— এই দেখ।
সেই মুহুর্তে বাক্সর দিকে কারো নজর যায়নি। দেখছিলাম, বাক্সের গায়ে মাথা ঠেকিয়ে দু-হাত দু-পাশে ছড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে বসে থাকা একটা নিস্পন্দ মনুষ্য-মূর্তিকে। পরনে কালো সুট। মুখ নীরক্ত নীল। দেখেই চিনতে পারল মাসগ্রেভ। ব্রানটন।
ব্রানটন অন্তর্ধান-রহস্যের সমাধান হল বটে, কিন্তু মাসগ্রেভ-সংহিতা যে-তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেল। বুঝলাম না, ব্রানটন মারা গেল কীভাবে, র‌্যাচেলের ভূমিকাই-বা কী।
আমার যা পদ্ধতি, তাই করলাম। মনে মনে ব্রানটনের জায়গায় কল্পনা করে দেখলাম কী-কী ঘটতে পারে। ব্রানটন বুদ্ধিমান পুরুষ। পাতাল-কুঠরিতে নিশ্চয় দামি কিছু লুকোনো আছে জানতে পেরে সে একাই সব আত্মসাৎ করবে ঠিক করলে। কিন্তু অতবড়ো পাথর এক সরানো সম্ভব নয়। দোসর চাই। বাড়ির কাউকে বিশ্বাস করা যায় না— একমাত্র র‌্যাচেলকে ছাড়া। র‌্যাচেল তাকে ভালোবাসত। মেয়েদের প্রেম কখনো মরে না— সব পুরুষই তাই ভাবে। মিষ্টি কথায় বশ করে র‌্যাচেলকে নিয়ে সে এল পাতাল-কুঠুরিতে।
কিন্তু একজন মেয়েছেলেকে নিয়ে পেল্লায় এই পাথর সরাতে নিশ্চয় হিমশিম খেয়েছে ব্রানটন। কাজটা সহজ করার জন্যে নিশ্চয় অন্য কায়দার কথা ভাবতে হয়েছে। মেঝের ওপর ছড়িয়ে থাকা কাঠগুলো পরীক্ষা করলাম। চেপটা-হয়ে-যাওয়া কতকগুলো ছোটো কাঠ পেলাম। তারপর একটা ফুট তিনেক লম্বা কাঠের একদিক চেপটে গেছে দেখেই বুঝলাম কী বুদ্ধি খাটিয়েছিল ব্রানটন। ভারী পাথরটা একটু একটু করে টেনে তুলছে আর ফাঁকের মধ্যে কুচে কাঠ ঠেসে ধরেছে। এইভাবে খানিকটা উঠে আসার পর গুড়ি মেরে ও ভেতরে ঢুকেছে, তারপর আংটার গায়ে বড়ো কাঠখানা ঢুকিয়ে পাথরে ঠেস দিয়ে রেখেছে। অতবড়ো পাথরের সমস্ত ওজন ওই কাঠের ওপর পড়ায় একটা দিক ওইভাবে চেপটে গিয়েছে।

ব্রানটন তো ভেতরে ঢুকল। র‌্যাচেল দাঁড়িয়ে রইল বাইরে। বাক্স খুলে জিনিসপত্র বার করে র‌্যাচেলের হাতে দিল ব্রানটন। তারপর?
অনেকগুলো সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে এরপরে। কেন্টের উদ্দাম রক্ত বইছে র‌্যাচেলের ধমনীতে। প্রতিশোধস্পৃহা তার অণু-পরমাণুতে। গর্তের ধারে দাঁড়িয়ে হাতে মূল্যবান সম্পদ নিয়ে সে কি হঠাৎ প্রতিহিংসা কামনায় পাগল হয়ে গিয়েছিল? যে-লোকটির বিশ্বাসঘাতকতায় তার আজ এই অবস্থা, তাকে শায়েস্তা করার মোক্ষম সুযোগ পেয়ে আংটায় লাগানো কাঠটা ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল? না, আপনা থেকেই কাঠ সরে যাওয়ায় দমাস করে পাথর পড়ে গর্তের মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? জানি না কী ঘটেছিল। এইটুকু শুধু কল্পনা করতে পারি যে জীবন্ত কবর হয়ে গেল লোভী ব্রানটনের। কবরের ভেতর তার গোঙানি আর দমাদম লাথি ঘুসি মারার চাপা শব্দ বেরিয়ে এল বাইরে। আর সিঁড়ি বেয়ে পাগলের মতো থলি হাতে দৌড়োতে লাগল র‌্যাচেল— পেছনে তখন দম বন্ধ মরতে বসেছে তার অভিশপ্ত প্রেমাস্পদ পুরুষ।
এই কারণেই পরদিন সকালে আমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল র‌্যাচেল। হিস্টিরিয়া রুগির মতো কেঁদেছে আর হেঁসেছে। তারপর পালিয়েছে বাড়ি ছেড়ে। পাথরের নুড়ি আর ধাতুর টুকরো সমেত থলিটা ফেলে গেছে জলার জলে।
পাতাল-কুঠরিতে কুড়ি মিনিট ধরে পুরো ঘটনাটা মনে মনে সাজিয়ে নিলাম। মুখ কালো করে পাশে বসে রইল মাসগ্রেভ ।

ব্রানটনের দেহ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গর্ত থেকে। লণ্ঠন নামিয়ে বাক্সের মুদ্রাগুলোর দিকে তাকিয়ে ও বললে, হোমস, সংহিতার রচনাকাল সঠিক আঁচ করেছিলাম। মুদ্রাগুলো প্রথম চালর্সের।
সঙ্গেসঙ্গে সংহিতার প্রথম কথা দুটো বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠল মাথার মধ্যে। চিৎকার করে বললাম, প্রথম চালর্সের আরও সম্পদ এবার তাহলে পাওয়া যাবে। সেই থলিটা কোথায়?
পড়ার ঘরে গেলাম দুই বন্ধু। জল থেকে উদ্ধার করা থলি বার করে ভেতরের জঞ্জালের স্তুপ বার করে রাখল আমার সামনে। ওর ধারণায় ওগুলো জঞ্জালই– কোনো দাম নেই। দেখতে অবশ্য সেইরকমই। কালচে মেরে আছে ধাতুর টুকরো, পাথরগুলো ম্যাড়মেড়ে অনুজ্জ্বল। একটা নিয়ে ঘঁষলাম জামার হাতায়— ভেতর থেকে রোশনাই ঠিকরে এল আগুনের ফুলকির মতো। ধাতুর টুকরোগুলো ডবল রিং-এর আকারে তৈরি। কিন্তু বেঁকিয়ে মূল আকার নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বললাম, মাসগ্রেভ, রাজার মৃত্যুর পরেও রাজার দল ইংলন্ডে আধিপত্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে যখন দেশ ছেড়ে পালায়, দামি দামি জিনিসপত্র মাটিতে পুঁতে রেখে গিয়েছিল ফিরে বসে ভোগ করার জন্যে।
লাফিয়ে উঠল মাসগ্রেভ, আমার পূর্বপুরুষ র‌্যালফ মাসগ্রেভ দ্বিতীয় চার্লসের ডান হাত ছিলেন কিন্তু।
আমি বললাম, “তাহলে তো হয়েই গেল– সব বোঝা গেল। এবার বুঝেছ তো এগুলো জঞ্জাল নয় মোটেই? এর অর্থমূল্য তো আছেই, তার চাইতেও বেশি হল এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব।
অবাক হয়ে ও বললে, জিনিসগুলো কী বলে মনে হয় তোমার?
ইংলন্ডের পুরোনো রাজমুকুট।
রাজমুকুট!
হ্যাঁ, রাজমুকু!
সংহিতার প্রথম আর দ্বিতীয় কথাটা মনে করে দেখো। ‘এটা কার?’ ‘যে গিয়েছে তার। ‘পাবে কে?’ ‘যে আসবে, সে’। অর্থাৎ প্রথম চার্লস খুন হয়েছেন, মুকুটটা তারই। কিন্তু দ্বিতীয় চার্লস তো আসবেনই— মুকুট মাথায় দেবেন তখন।
কিন্তু পুকুরে গেল কীভাবে?

খুলে বললাম, কীভাবে। সব শুনে মাসগ্রেভ বললে, দ্বিতীয় চার্লস ফিরে আসার পর রাজমুকুট তার হাতে গেল না কেন?
জবাবটা কোনোদিনই পাবে না। তিনি জানতেন, দেহ রাখার আগে কাউকে বলে যাননি, অথবা জানাতে ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু সংহিতার মাধ্যমে উত্তরাধিকারীকে জানিয়ে গেছেন কোথায় আছে সেই অমূল্য রাজমুকুট। সেই থেকে বংশপরম্পরায় খবরটা সবাই পড়েছেন— কিন্তু মানে ধরতে পারেননি। যে পেরেছে, সে এ-বংশের কেউ নয়। প্রাণ দিয়ে অন্যায় কৌতুহলের দাম দিতে হয়েছে।

ওয়াটসন, মাসগ্রেভ-সংহিতার কাহিনি তো শুনলে। রাজমুকুটটা দেখে যদি চোখ সার্থক করতে চাও তো হালস্টোন প্রাসাদে চলে যাও। অনেক টাকার বিনিময়ে প্রাসাদেই সেটা রাখার অধিকার পেয়েছে মাসগ্রেভরা। আমার নাম করলেই দেখাবে তোমাকে। র‌্যাচেল মেয়েটার আর খবর পাওয়া যায়নি। পাপের স্মৃতি নিয়ে বোধ হয় ভিনদেশে পালিয়েছে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments