Friday, April 19, 2024
Homeবাণী-কথাসূর্যকান্তর প্রশ্ন - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সূর্যকান্তর প্রশ্ন – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নার্সিংহোমের খাটে শুয়ে সূর্যকান্ত কী ভাবছেন এখন?

সাদা ধপধপে চাদরের ওপর সূর্যকান্তর লম্বা শরীরটা যেন পুরো খাট জুড়ে আছে। চোখ বোজা। একটা হাত বুকের ওপর রাখা। একটু দূরে জানলার কাছে বসে আছে একজন নার্স। ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল সূর্যকান্তকে, কিছুক্ষণ আগে তিনি খানিকটা ছটফট করছেন। এখন তিনি ঘুমিয়ে না জেগে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

মমতা কাল সারারাত সূর্যকান্তর শিয়রের কাছে জেগে বসেছিল। এখন তাকে জোর করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। আর কারুকে এখন এ-ঘরে ঢুকতে দেওয়া হবে না। দরজার বাইরে থেকে অনেকেই উঁকি মেরে দেখে যাচ্ছে। নার্সিংহোমের বাইরে বেশ। ভিড়। দূর-দূর থেকে অনেকে ছুটে আসছে সূর্যকান্তর খবর নেওয়ার জন্য।

সূর্যকান্তর বয়েস বাহান্ন, বেশ নিটোল স্বাস্থ্য, লম্বা, মেদহীন শরীর। কিছুদিন আগে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন, অন্য কোনও নেশা নেই, এককালে খেলাধুলোর ঝোঁক ছিল। এখনও প্রায় শীতকালে ব্যাডমিন্টন খেলেন। তবু এরকম একটি কাণ্ড ঘটে গেল।

খাদিমগঞ্জ থেকে একটা জিপে ফিরছিলেন সূর্যকান্ত। সারাদিন ধরে ধকল গেছে খুব। দুপুরে ভালো করে খাওয়াও হয়নি, সন্ধেবেলা হেডোডাঙ্গায় পৌঁছে সত্যনারায়ণ পুজোর সিন্নি খাওয়ার কথা। সূর্যকান্ত পরিশ্রম করতে পারেন প্রচণ্ড, তাঁর সঙ্গের লোকেরাও মেতে থাকে, খিদে-তেষ্টার কথা জানায় না।

পৌষ মাসের অপরাহ্ন, আকাশের আলো মিলিয়ে যায় দ্রুত। রাস্তার দুপাশে খোলা মাঠ ধূ-ধূ করছে, পাতলা কুয়াশার মতন নেমে আসছে অন্ধকার। ঠান্ডা-ঠান্ডা বাতাস বইছে।

সূর্যকান্ত বসেছিলেন জিপের সামনে। সাধারণত তিনি সামনের সিটেই বসতে ভালোবাসেন, কখনও-কখনও নিজেই জিপ চালান। কিন্তু বাবলু আর জয়দীপ কিছুতেই তাঁকে সামনে বসতে দেবে না। দু-দিন আগেই একটা নির্জন রাস্তায় তাঁর জিপ আটকাবার চেষ্টা হয়েছিল, হঠাৎ দমাদ্দম করে এসে পড়েছিল পাথর। এর আগেও মানু দত্তর লোকেরা তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে দুবার। সূর্যকান্ত ভয় পান না, কিন্তু বাবলু-জয়দীপরা ঝুঁকি নিতে চায় না। থানা থেকে একজন বডিগার্ড দেওয়া হয়েছে, বন্দুক নিয়ে সে বসে আছে ড্রাইভারের পাশে।

চলন্ত গাড়িতে বাবলু আর জয়দীপ নানান কথা বলে যাচ্ছে, সূর্যকান্ত চুপ করে শুনছিলেন। মাঝে মাঝে ছোট-ছোট কিল মারছিলেন। নিজের বুকে। কীসের যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। খানিকটা বাতাস যেন আটকা পড়ে গেছে বুকের মধ্যে কিছুতে বেরুতে পারছে না। এরকম তাঁর কখনও হয়নি আগে।

কথার মাঝখানে হঠাৎ তিনি হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে জিগ্যেস করলেন, দ্যাখ তো বাবলু, আমার জ্বর এসেছে নাকি?

বাবলু হাতটা ছুঁয়ে বললেন, কই না তো। গা তো গরম নয়।

তারপর সে সূর্যকান্তর কপালে হাত রেখে তাপ অনুভব করতে গিয়ে চমকে উঠে বলল, এ কী সূর্যদা, আপনি ঘামছেন?

সূর্যকান্ত বললেন, ঘামছি তাই না? মাঝে-মাঝে শরীরটা ঝাঁঝাঁ করছে, ঠিক জ্বরের মতন, তার পরেই আবার ঘাম হচ্ছে।

জয়দীপ বলল, আমার তো শীত-শীত লাগছে। এর মধ্যে আপনার ঘাম হবে কেন?

বাবলু বলল, তারপর দু-রাত তো ঘুমই হয়নি। রাত দুটো-আড়াইটেয় শুয়েই আবার ভোর পাঁচটায় ওঠা। সূর্যদা, আজ রাত দশটায় শুয়ে পড়বেন। ঘুম চাই ভালো করে না হলে খাটবেন কী করে?

সূর্যকান্ত বললেন, হ্যাঁ, আজ ঘুমোব।

খানিক বাদে সূর্যকান্ত আবার বললেন বড্ড জলতেষ্টা পাচ্ছে রে। গাড়িতে কি জলের বোতল টোতল আছে?

বাবলু আর জয়দীপ পরস্পরের দিকে তাকাল। গরমকাল নয়, তাই গাড়িতে জল রাখার কথা ওরা ভাবেনি।

জয়দীপ বলল, আর মাইলসাতেক পরে কমলাপুর, সেখানে গিয়ে খাবেন।

সূর্যকান্ত বুক চেপে ধরে বললেন, তেষ্টায় গলা ফেলে যাচ্ছে রে। অতক্ষণ থাকতে পারব না। গাড়িটা এখানে থামাতে বল তো!

এই মাঠের মধ্যে কোথায় জল পাওয়া যাবে? নালা ডোবা থাকলেও তো সেই জল পান করা যাবে না!

গাড়ি চালাচ্ছে পরিতোষ, সে বলল সামনে একটা কুঁড়ে দেখা যাচ্ছে, আলো জ্বলছে, ওখানে থামাব।

সূর্যকান্ত বললেন, হাঁ, থামা।

মাঠের মাঝখানে জিপ থামলে হঠাৎ মানু দত্তের লোকেরা এসে হামলা করবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল বাবলু-জয়দীপরা। কিন্তু সূর্যকান্ত প্রায় ছটফট করছেন তৃষ্ণায়।

জিপটা থামতে জয়দীপ বলল, আপনি বসুন সূর্যদা, আমি জল আনছি।

সূর্যকান্ত বললেন, তোকে যেতে হবে না। আমি খেয়ে আসছি। যার বাড়ি, তার সঙ্গে একটু কথাও বলে আসব।

বাবলু বলল, আপনার শরীর ভালো লাগছে না, আপনি বসুন না, আমরা জল আনছি।

সূর্যকান্ত সেকথা শুনলেন না। লাফিয়ে নামলেন জিপ থেকে। একটুখানি টলে গিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, এমন কিছু শরীর খারাপ নয় সে নিজে জল খেতে যেতে পারব না।

কুঁড়েঘরটা রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে, একেবারে মাঠের মধ্যে। বাড়িটার সামনে একটা মস্ত তালগাছ। বন্দুকধারী গার্ডটি নেমে দাঁড়িয়েছে জিপ থেকে। সূর্যকান্ত একটু হেসে বললেন, তোমায় আসতে হবে না। বন্দুক নিয়ে কি কেউ লোকের বাড়িতে জল চাইতে যায়?

দুপাশে বাবলু আর জয়দীপ, সূর্যকান্ত রাস্তা ছেড়ে মাঠের মধ্যে নেমে এগিয়ে গেলেন কয়েক পা। তারপর এমনভাবে হঠাৎ ঝুপ করে পড়ে গেলেন মাটিতে যে বাবলু-জয়দীপরা তাঁকে ধরারও সুযোগ পেল না।

মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যকান্তর জ্ঞান চলে গেছে।

একটুক্ষণের জন্য দিশেহারা হয়ে গেল বাবলু-জয়দীপরা। ছোটাছুটি করে কুঁড়েঘরটা থেকে জল এনে সূর্যকান্তকে খাওয়াবার চেষ্টা করল, মাথায় জল ছেটাল, কিন্তু কিছুতেই সূর্যকান্তর সাড়া এল না। সূর্যকান্তর মতন একজন স্বাস্থ্যবান মানুষ কোন কারণে আচমকা এমন অসুস্থ হয়ে পড়তে। পারেন, সে সম্পর্কে ওদের কোনও ধারণাই নেই।

অজ্ঞান সূর্যকান্তকে নিয়ে নার্সিংহোমে পৌঁছতে পৌঁছতে হয়ে গেল রাত দশটা। হাসপাতালের বদলে নার্সিংহোমে নিয়ে আসার কারণ ডাক্তার সন্তোষ মজুমদার সূর্যকান্তর বন্ধু মানুষ। নার্সিংহোম ছেড়ে এক জায়গায় তাস খেলতে গিয়েছিলেন তাঁকে খুঁজে আনতে সময় লেগে গেল আরও আধঘণ্টা।

সূর্যকান্তকে একনজর দেখেই সন্তোষ মজুমদারের মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি নিজেই যেন অজ্ঞান হয়ে যাবেন।

সূর্যকান্তকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে এনে ওষুধ দিতে-দিতে সন্তোষ মজুমদার সব ঘটনা শুনলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, জল খাওয়ার জন্য সূর্য যে জিপ থেকে লাফিয়ে নামল, তাতেই ওর…তোমরা ওকে জোর করে বসিয়ে রাখতে পারলে না? অবশ্য তোমরাই বা বুঝবে কী করে? তারপর খাদিমগঞ্জ থেকে কমলাপুর খুব খারাপ রাস্তা, জিপটা এসেছে লাফাতে লাফাতে…ইস, গাড়িটা থামিয়ে সূর্যকান্তকে যদি শুইয়ে রাখতে পারতে…ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, এই সময় একটু নড়াচড়া করা মানেই মৃত্যুকে আরও কাছে ডেকে আনা…।

সন্তোষ মজুমদার সূর্যকান্তকে নিজের দায়িত্বে রাখতে সাহস পাচ্ছেন না। এই মফস্বল শহরের নার্সিংহোমে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিছুই নেই, সবরকম ওষুধও পাওয়া যায় না, সূর্যকান্তকে বাঁচাতে হলে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া দরকার। হাসপাতালের ডাক্তার চন্দন রায় দেখতে এসে বললেন, এই অবস্থায় সূর্যকান্তকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়াও খুব বিপজ্জনক, পথেই চরম কিছু ঘটে যেতে পারে।

সূর্যকান্ত গুন্ডা-বদমাইশদের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন শুনলে কেউ অবাক হত না। কিন্তু তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে শুনে সবাই অবাক। এমন নীরোগ, সুস্থ-সমর্থ মানুষটার হার্ট হঠাৎ বেঁকে বসল কেন?

আর ঠিক এগারো দিন পরে ভোট। সূর্যকান্তর জেতার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। এখন কি লোকে আর এরকম একটা মুমূর্ষু মানুষকে ভোট দেবে?

সূর্যকান্ত নিজে নির্বাচনে দাঁড়াতে চাননি। তিনি রাজনীতির লোকও নন। সূর্যকান্তর বাবা ছিলেন উকিল, তিনি শেষ বয়েসে এখানে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সূর্যকান্ত সেই কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক। ছাত্রদের শুধু পড়িয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, আরও বহুদিকে তাঁর উৎসাহ। ছাত্রদের সঙ্গে খেলাধুলো করা, পিকনিকে যাওয়া, গান গাওয়া এসব তো আছেই। তা ছাড়া তিনি ছুটির সময় ছাত্র-ছাত্রীদের ছোট-ছোট দল করে বিভিন্ন গ্রামে পাঠাতেন, যাতে গ্রামের নিরক্ষর মানুষরাও কিছুটা লেখাপড়ার স্বাদ পেতে পারে। গ্রামের মানুষদের কিছু-কিছু স্বাস্থ্যবিধি। বোঝনো, গাছপালা রক্ষা করা বিষয়ে সচেতন করে তোলা, এইসব কাজ নিয়েও তিনি ঘুরেছেন বহু গ্রামে। এ মহকুমার অনেকেই তাঁকে চেনে।

এই এলাকায় আগে পরপর তিনবার এম পি হয়েছিলেন বিধুভূষণ রায়। পুরোনো আমলের জেলখাটা, আদর্শবাদী মানুষ, সবাই তাঁকে ভক্তিশ্রদ্ধা করত। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই ডামাডোল চলছে। একবার বামপন্থীরা, একবার কংগ্রেসিরা জেতে। দু-পক্ষে মারামারি হয়। গত নির্বাচনে হঠাৎ জিতে গেল মানু দত্ত, নির্দল প্রার্থী হিসেবে। মানু দত্ত যে গুন্ডা ও স্মাগলারদের নেতা, তা সবাই জানে। সে তিন-চারখানা পেট্রল পাম্পের মালিক, আর কতরকম ব্যাবসা তার আছে তার ঠিক নেই। প্রচুর টাকা ছড়ায় বলে তার সাঙ্গোপাঙ্গ অনেক। গুন্ডার সর্দারও দিব্যি ভোটে জিতে যায়। জিতে যাওয়ার পর মানু দত্ত অন্যান্য দলের সঙ্গে দরাদরি শুরু করে দিল। সে কখনও এ দলে, কখনও ও-দলে যায়। পুলিশও তাকে ভয় পায়।

সূর্যকান্ত এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। একদিন তাঁর ছেলে নীলকান্ত বলল, বাবা, আমাদের এই মহকুমার মানু দত্তর মতন একজন বদমাশ লোক নেতা সেজে যাচ্ছে, সে চতুর্দিকে অত্যাচার। করে বেড়ায়, চোর-ডাকাতদের পোষে, তবু সে লোকসভায় আমাদের প্রতিনিধিত্ব করবে, এটা ভাবতে আমাদের লজ্জা করে।

সূর্যকান্ত দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, সত্যি তো লজ্জার কথা। দেশটা এরকমই হয়ে যাচ্ছে। জানিস, ওই মানু দত্ত আমার সঙ্গে ইস্কুলে পড়ত। এক ক্লাসে। স্কুল ফাইনাল পাশ করতে। পারেনি, তার আগে থেকেই ও স্মাগলারদের সঙ্গে মিশতে শুরু করে। এখন সে দিল্লিতে মন্ত্রীদের সঙ্গে ওঠা-বসা করে।

নীলকান্ত বলল, বাবা, আমার কলেজের বন্ধুরা বলছে, তোমাকে দাঁড়াতে। মানু দত্তকে যে-কোনও উপায়ে এবার হারানো দরকার।

সূর্যকান্ত সে প্রস্তাব হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু তার পরদিন থেকে দলে-দলে ছেলে এসে তাঁকে ওই একই অনুরোধ জানাতে লাগল।

সূর্যকান্ত যতই অস্বীকার করেন ততই তারা চেপে ধরে। এল ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা, তারা সূর্যকান্তকে সাহায্য করবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের একটা বিরাট দল এল ওই একই প্রস্তাব নিয়ে।

একসময় সূর্যকান্ত নিমরাজি হলেও ঘোর আপত্তি তুললেন মমতা। রাজনীতি মানেই অনেক নোংরা ব্যাপার, অনেক মিথ্যে কথা ও গালাগাল, অন্য পার্টির ওপর কুৎসিত দোষারোপ, টাকাপয়সায় ছিনিমিনি খেলা। এই পরিবেশের মধ্যে তিনি তাঁর স্বামীকে যেতে দিতে চান না কিছুতেই।

তখন একদল ছাত্র অনশন করতে শুরু করল এই বাড়ির সামনে। নীলকান্তও তাদের মধ্যে একজন।

দুদিন সেই ছেলেরা একেবারে কিছুই না খেয়ে শুয়ে থাকার পর মমতা কেঁদে ফেললেন।

তখন সূর্যকান্ত রাজি হলেন এই শর্তে যে, তিনি কোনও দলের হয়ে দাঁড়াবেন না। কারুর কাছ থেকে টাকা নেবেন না। কেউ যদি গাড়ি দিয়ে সাহায্য করে কিংবা স্বেচ্ছাসেবকদের একবেলা খাওয়াতে চায় তাহলে ঠিক আছে। তাঁর নিজের বিশেষ টাকা নেই, অন্যের টাকা নিয়েও তিনি নির্বাচনে লড়বেন না।

সূর্যকান্ত নির্দল হিসেবে দাঁড়াবার পর বামপন্থী এবং কংগ্রেসিরা আলাদা-আলাদাভাবে এসে তাঁকে ধরেছিল, নিজেদের দলে আসবার জন্য। সূর্যকান্ত বলেছিলেন, আমি কোনও দলে যাব না কেন জানেন? এক দলে গেলেই অন্য দলকে গালাগাল দিতে হয়। সত্য-মিথ্যে মিলিয়ে অনেক রকম অভিযোগ তুলতে হয়। কিন্তু আমার স্ত্রী মাথার দিব্যি দিয়েছেন, আমি কারুকে গালাগালাও দিতে পারব না, একটা মিথ্যে কথাও উচ্চারণ করতে পারব না। আমি লড়ব শুধু সততার পক্ষে। গুন্ডামি, অরাজকতা, মিথ্যে আর কুরুচির বিরুদ্ধে। মানুষের ভালোবাসাই আমার একমাত্র সম্বল।

ভোটের প্রচারে নেমে সূর্যকান্ত অভিভূত হয়ে গেলেন। সাধারণ মানুষ আসলে দলাদলি, অশান্তি, ধর্মীয় বিরোধ এসব কিছুই চায় না। তিনি যেখানেই যান, হাজার-হাজার লোক তাঁর কথা শুনতে আসে। মুসলমানরা তাঁকে নিজেদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায়। হরিজনরা চাঁদা তুলে তাঁর। লোকজদের খাওয়ায়। হিন্দুরা তাঁকে আশীর্বাদ করে। সূর্যকান্ত সব জায়গায় বলেন, আমি মন্দির কিংবা মসজিদ গড়ার পক্ষে নই, আমি চাই আরও ইস্কুল-কলেজ-হাসপাতাল হোক, গ্রামের। মেয়েদের উপার্জনের ব্যবস্থা হোক। ধর্ম থাকুক যার-যার বাড়িতে, আর আমি ধর্মের বিপক্ষে নই, কিন্তু ধর্মের নামে যারা ছুরি-বোমা চালায় তারা সবাই পাষণ্ড, অধার্মিক, আপনারাও এই কথাটা। ঘোষণা করুন।

একদিন মানু দত্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল রাস্তায়। মানু বাঁকা হেসে বলেছিল, সূয্যি, তুইও শেষপর্যন্ত লোভে পড়ে ভোটে দাঁড়ালি? তোর মতন ভালো মানুষের জন্য এসব লাইন নয়। পারবি ছেড়ে দে, ছেড়ে দে!

সূর্যকান্তও হেসে বলেছিলেন, মানু, লোকের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে, তোদের লাঠি-বন্দুক চোখরাঙানি দেখেও সাধারণ মানুষ আর ভয় পাচ্ছে না। তুই এবার এসব ছেড়ে দে। নইলে দেখবি, একদিন হাজার-হাজার নিরীহ মানুষ তোদের মতন লোকদের তাড়া করছে!

সূর্যকান্তর জনপ্রিয়তা যত বাড়তে লাগল, ততই খেপে উঠল মানু দত্ত। সে নিজের চ্যালাদের লেলিয়ে দিয়ে মারবার চেষ্টা করেছিল সূর্যকান্তকে। তিনি বডিগার্ড নিতে চাননি, তবু থানা থেকে একজনকে দেওয়া হয়েছে। সবাই বুঝে গিয়েছিল, সূর্যকান্ত নির্ঘাত জিতবেন। তার মধ্যে হঠাৎ বজ্রপাতের মতন এরকম একটা ব্যাপার হয়ে গেল।

ডাক্তারদের চোখ-মুখ দেখলেই বোঝা যায়, সূর্যকান্তর বাঁচার আশা খুব কম। কয়েকদিন বা কয়েক ঘণ্টার আয়ু আছে তাঁর।

প্রথম দুদিন সম্পূর্ণ ঘোরের মধ্যে কাটলেও আজ সূর্যকান্তর জ্ঞান ফিরেছে। তিনি চোখ বুজে আছেন, কারুর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু তাঁর মাথা পরিষ্কার।

একটা কথাই তাঁর মনে আসছে বারবার। কেন এরকম হল? শরীরের ওপর তেমন অত্যাচার করেননি কখনও, হৃদযন্ত্রটা তবু কেন এমন দুর্বল হল? মানুষের জন্ম-মৃত্যুর কথা কিছুই বলা যায় না, তা ঠিকই। তাহলেও, মানু দত্তর মতন লোকেরা বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকবে, আর তাঁকে মরতে হবে অসময়ে, এটা কীরকম বিচার? কে এই বিচার করে? ঈশ্বর? তবে কি ঈশ্বর গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন? তিনি মানু দত্তদেরই জিতিয়ে দিতে চান?

একটু পরে তিনি চোখ মেলে নার্সকে বললেন, একবার ডাক্তারকে ডাকুন তো!

সূর্যকান্ত পরিষ্কার গলায় কথা বলছেন শুনে নার্স খুশি হয়ে দৌড়ে চলে গেল। অনেক রোগ-মৃত্যু দেখেছে এই নার্স, কিন্তু সে-ও সূর্যকান্তর জন্য লুকিয়ে-লুকিয়ে কাঁদছিল।

তক্ষুনি এসে উপস্থিত হলেন সন্তোষ মজুমদার। শুরু করে দিলেন নানারকম পরীক্ষা। সূর্যকান্ত আপত্তি জানাতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিতে পারলেন না। শরীর দুর্বল। তিনি ফিসফিস করে। বললেন, সন্তোষ আর-একটু কাছে আয়। সন্তোষ মজুমদার বন্ধুর খুব কাছে মুখটা আনলেন।

সূর্যকান্ত জিগ্যেস করলেন, ঠিক করে বল তো, আমার কি বাঁচার আশা আছে?

সন্তোষ মজুমদার একটু ইতস্তত করে কিছু বলতে যেতেই সূর্যকান্ত আবার বললেন, সত্যি কথা বল। আমাকে শুধু-শুধু সান্ত্বনা দেওয়া দরকার নেই। আমি আর কখনও সুস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াতে পারব?

সন্তোষ মজুমদার বললেন, আমরা ডাক্তাররা আর কতটুকু জানি? অনেক কিছু অলৌকিকভাবে ঘটে যায়। তুই তো ভগবানে বিশ্বাস করিস না, আমি করি। ভগবানের দয়া হলে তুই নিশ্চয়ই। আবার সেরে উঠবি।

সূর্যকান্ত বড় নিশ্বাস ফেলে বললেন, ভগবানের দয়া। ভগবান কি রাগ করে আমায় এমন রোগ দিলেন? আমি কী অন্যায় করেছি?

সন্তোষ মজুমদার বললেন, ওসব কথা এখন ভাবিস না। কথা বলতে হবে না, চুপ করে থাক। সব ঠিক হয়ে যাবে।

সূর্যকান্তর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। শারীরিক কষ্টের চেয়েও তাঁর মানসিক কষ্ট হচ্ছে অনেক বেশি। তিনি কোনও উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। মানু দত্তর মতন লোকেরা এত অন্যায় অত্যাচার। করেও কী করে ভোটে জেতে? কত লোক ধর্মের নামে ছুরি শানায়, অন্য ধর্মের মানুষের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, ধর্মের নামে নৃশংস খুনোখুনি হয়, তবু লোকে ধর্ম কিংবা ঈশ্বরের ওপর ভরসা রাখে কী করে?

সূর্যকান্তর অসুস্থতার খবর রটে গেছে চতুর্দিকে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা এখন প্রচার করছে যে সূর্যকান্ত বেঁচে উঠলেও কোনওদিন আর পূর্ণ কর্মক্ষম হবেন না। সুতরাং এই লোককে জয়ী করে কী হবে?

সূর্যকান্তর সমর্থকরা মুষড়ে পড়েছে খুব। কেউ-কেউ যখন-তখন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে। সূর্যকান্ত যুবসমাজকে মাতিয়ে রেখেছিলেন, এই অঞ্চলে একটা সুস্থ, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তখন তারা একেবারে দিশেহারা।

সেদিন বিকেলবেলা হঠাৎ মানু দত্ত সদলবলে এল নার্সিংহোমে। সূর্যকান্তর সঙ্গে বাইরের কারুকেই দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না, কিন্তু মানু দত্ত ওসব বাধা মানবার পাত্র নয়। তার দলের লোকেরা চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিল।

মানু দত্ত তাদের থামতে বলে, সন্তোষ মজুমদারের সামনে হাতজোড় করে বেশ আবেগের সঙ্গে বলল, দেখুন ডাক্তারবাবু, আমি, আমি সূর্যকান্তর অপোনেন্ট হিসেবে আসিনি, আমি এসেছি আমার পুরোনো ইস্কুলের বন্ধুকে দেখতে। সে এত অসুস্থ, তাকে একবার দেখে যাব না? আমি কি এতই অমানুষ?

সন্তোষ মজুমদার বুঝলেন, আপত্তি জানিয়ে লাভ নেই। তাহলে তাঁর নার্সিংহোম এরা ভেঙে দিয়ে যাবে। সূর্যকান্তর সঙ্গে দেখা করতে আসাটা নিশ্চয়ই মানু দত্তর একটা রাজনৈতিক চাল। সঙ্গে ফটোগ্রাফার নিয়ে এসেছে।

সূর্যকান্তর নাকে তখন অক্সিজেনের নল। নিশ্বাস খুব ক্ষীণ। কিন্তু এখনও মাথা পরিষ্কার। মানু দত্তকে চিনতে তাঁর অসুবিধে হল না। মানু দত্ত কী বলছে তা তিনি শুনতেও পাচ্ছেন, কিন্তু উত্তর দিতে পারছেন না।

খানিকক্ষণ মামুলি সান্ত্বনার কথা বলার পর মানু দত্ত খুব কাছে এসে বলল, সূর্য, তুই আমার পুরোনো বন্ধু, তোকে আমি বাঁচাবই। মতভেদ যতই থাকুক, তবু বন্ধুকে বন্ধু দেখবে না? তোর জন্য কলকাতা থেকে আমি বড় ডাক্তার আনব। যত টাকা লাগে লাগুক। আমার গাড়িতে ডাক্তার আনতে পাঠাচ্ছি এক্ষুণি। তোকে বাঁচতেই হবে।

হঠাৎ সূর্যকান্ত বুঝতে পারলেন মানু দত্তর আসল উদ্দেশ্যটা। সে চ্যালাদের দিয়ে বোমা ছুঁড়িয়ে সূর্যকান্তকে জখম করতে চেয়েছিল আগে, এখন সে সূর্যকান্তকে বাঁচাবার জন্য এত ব্যস্ত কেন? কারণ একটাই। সূর্যকান্ত এখন হঠাৎ মরে গেলে এই কেন্দ্রে নির্বাচনই বন্ধ হয়ে যাবে। আবার কবে হবে তার ঠিক নেই। মানু দত্ত এবারে যে এত টাকাপয়সা খরচ করল, তা বরবাদ হয়ে। যাবে। আবার নতুন করে সবকিছু করতে হবে পরের বার। সূর্যকান্ত আর দশটা দিন অন্তত বেঁচে থাকলেও মানু দত্ত জিতে যেতে পারে।

সূর্যকান্তর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল, তিনি দুদিকে মাথা নেড়ে অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, না!

অর্থাৎ তিনি বলতে চাইলেন, মানু দত্তকে তিনি এবার জিততে দেবেন না।

ভগবান তাঁর ওপর রাগ করেছেন কিংবা পরে আবার দয়া করবেন কি না, তা নিয়ে আর সূর্যকান্ত মাথা ঘামাতে চান না। অক্ষম দুর্বল হয়ে, সবরকম অবিচার মেনে নিয়ে তিনি বাঁচতেও চান না। এখনও মানু দত্তর মতন মানুষকে হারাবার ক্ষমতা তাঁর আছে।

সূর্যকান্ত দুর্বল হাতটা তুলে নাক থেকে খুলে নিলেন অক্সিজেনের নল!

সূর্যকান্তর নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, মাথার মধ্যে শুনতে পাচ্ছেন মৃত্যুর পদশব্দ। তবু তিনি। ভাবতে লাগলেন, নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাবে এখানে। আবার কয়েক মাস পরে যখন নির্বাচন হবে তার মধ্যে অন্য কেউ, আর-একজন সাহসী, সত্যবাদী কেউ কি মানু দত্তের প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারবে না? সূর্যকান্তর বুকে শেষ ধ্বনিটা এইরকম, পারবে, পারবে, পারবে…নিশ্চয়ই পারবে!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments