Friday, April 19, 2024
Homeবাণী-কথাশিল্পী সুলতান - হুমায়ূন আহমেদ

শিল্পী সুলতান – হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ

ভাইবোনদের নিয়ে বেড়াতে গিয়েছি যশোহর। আমাদের লম্বা পরিকল্পনা–যশোহর থেকে যাব কুষ্টিয়া–রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি দেখব। তারপর যাব মেহেরপুর, দেখব আমবাগানে মুজিবনগর। আমরা পনেরোজন মানুষ, সম্বল একটা নয় সীটের মাইক্রোবাস। মাইক্রোবাসের ড্রাইভার আমাদের কাদের মিয়া। ড্রাইভিং ছাড়া অন্যসব কাজ সে খুব ভাল জানে। আমার প্রবল সন্দেহ সে ডান চোখে দেখে না। রাস্তার ডানদিকে কোন গাড়ি এলে সে মোটেই বিচলিত হয় না। ঐ গাড়ির দিকে সরাসরি। মাইক্রোবাস চালাতে থাকে। আমাদের সবাইকে এক সঙ্গে চেঁচাতে হয়–কর কি? কর কি? কাঁদেরের যন্ত্রণায় গাড়ির ক্যাসেটে গান শোনা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। গান বাজালেই সে মাথা নাড়তে থাকে এবং দু’হাতে স্টিয়ারিং হুইলে তাল দেয়। হাঁটু নাচায়।

এমন বিপদজনক ড্রাইভার নিয়ে দীর্ঘ ভ্রমণ কেউ করবে না। কিন্তু আমার উপায় নেই। কাদেরকে নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছি। সে গাড়ি নিয়ে নানান কায়দা-কানুন করে যাচ্ছে। উদাহরণ দেই, ফাঁকা রাস্তায় ঘণ্টায় সত্ত্বর কিলোমিটার বেগে গাড়ি যাচ্ছে। আচমকা সে ব্রেক কষল। আমরা একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়লাম। আমি বললাম, কি ব্যাপার কাদের?

কাদের নির্বিকার গলায় বলল, ব্রেক ঠিক আছে কিনা একটু টেস্ট করলাম।

টেস্টে কি পাওয়া গেল, ব্রেক ঠিক আছে?

জি, ঠিক আছে আলহামদুলিল্লাহ।

ভবিষ্যতে এরকম টেস্ট করবে না।

জি আচ্ছা।

আরেক দিনের কথা–হঠাৎ কাঁদেরের দিকে তাকিয়ে দেখি সে আপন মনে হাসছে। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, হাসছ কেন?

সে আনন্দিত স্বরে বলল, গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম স্যার। ঘুম ভাঙার পরে দেখি গাড়ি ঠিকমতই চলছে। এইজন্যে হাসতেছি। আল্লাহপাকের কি কুদরৎ!

তুমি তো আমাদের সবাইকে মারবে।

এটা স্যার ভুল কথা বললেন, হায়াৎ-মউতের মালিক আল্লাহপাক। উনার হুকুম ছাড়া কিছু হবে না।

তোমার অবস্থা যা, আমার তো মনে হয় উনি খুব শিগগিরই হুকুম দেবেন। সাবধানে গাড়ি চালাও, খুব সাবধানে।

আমি স্যার খুব সাবধান। এই প্রথম গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়েছি।

এই সাবধানী ড্রাইভারকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানে মানসিক নির্যাতনের ভেতর দিয়ে যাওয়া। যশোরে পৌঁছে ঠিক করলাম–প্রোগ্রাম কাটছাঁট করব। যেখানে না গেলেই নয় সেখানে যাব। যেমন যশোরে দু’টি জায়গায় যাওয়ার কথা–সাগরদাড়ি, মাইকেল মধুসূদনের বসতবাড়ি। এবং নড়াইল, শিল্পী সুলতানের বাড়ি।

সাগরদাঁড়িতে গেলে বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ মাইকেল মধুসূদনের বিখ্যাত মৃত্যুগাথা পড়ে আসা যায়–

“দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে ….
তিষ্ঠ ক্ষণকাল …”

অন্যদিকে আছেন জীবন্ত কিংবদন্তী শিল্পী সুলতান। যিনি ছবি আঁকেন নাচতে নাচতে। ছবি আঁকার সময় অপার্থিব কিছু যেন তাঁর উপর ভর করে। তিনি ঘোরের মধ্যে চলে যান। বিশাল সব ক্যানভাসে যখন তুলি টানেন তখন তাঁর সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপে। এসব অবশ্যি আমার শোনাকথা। তাঁকে আমি কখনো ছবি আঁকতে দেখিনি। তাঁর সম্পর্কে শোনাকথারও কোন অন্ত নেই। বিচিত্র সব গল্প তাঁকে নিয়ে প্রচলিত। একটি হচ্ছে–শিল্পী সুলতানের পাঞ্জাবীর দু’পকেটে দুটি বিড়াল থাকে। তিনি পাঞ্জাবী গায়ে একবার নিউমার্কেটে এসেছেন। এক পকেটমার মানিব্যাগ হাতানোর জন্যে তাঁর পকেটে হাত ঢুকিয়েছে। বিড়াল তার হাত কামড়ে দিল। শুধু যে কামড়ে দিল তাই না, কামড় দিয়ে হাতে ঝুলতে লাগল। কিছুতেই সেই বিড়াল ছাড়ানো যায় না। পকেটমারকে ঘিরে লোকে লোকারণ্য।

শিল্পী সুলতানকে নিয়ে আরেকটি খবর কয়েকদিন আগে পড়লাম। খবরের ক্যাপশান–‘সুলতানের সমুদ্রযাত্রা। শিল্পী সুলতান ৬০ ফুট লম্বা এক নৌকা বানিয়েছেন। পরিকল্পনা হল–তিনি তার জন্মদিনে নৌকা ভর্তি করবেন তাঁর পোষা। পঞ্চাশটা বিড়াল দিয়ে। তারপর যাত্রা করবেন সমুদ্রের দিকে। আর লোকালয়ে ফিরবেন না।

এত কাছে এসে এমন একজন বিচিত্র মানুষের কর্মকাণ্ড না দেখে আসা অন্যায় হবে। আমরা নড়াইলে যাওয়া ঠিক করলাম। মাইক্রোবাসে সবাই বসলাম গাদাগাদি করে। বোঝার উপর শাকের আঁটির মত স্থানীয় দু’জন গাইডও আমাদের সঙ্গে আছেন। কাদেরকে বললাম–গাড়ি খুব আস্তে চালাবে। যা করতে বলা হয় সে তার উল্টোটা করে। কাজেই সে ঝড়ের গতিতে চলল।

শিল্পী সুলতানের বাড়ি ‘চিত্রা নদীর তীরে। বাড়ির ঠিক পেছনেই শান্ত চিত্রা নদী। কি আশ্চর্য! সেই নদীতে সত্যি সত্যি বিশাল এক রঙিন নৌকা। সমুদ্রযাত্রার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে। আমরা নদীর দিকে তাকিয়ে, নৌকার দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম, অপূর্ব! সুলতান সাহেব আনন্দে হেসে ফেললেন। একমাত্র শিশুরাই এত সুন্দর করে হাসতে পারে। তিনি গভীর আগ্রহে বললেন–আমার বাড়িটা দেখুন।

বাড়ির দিকে তাকালাম। প্রাচীন কালের মুনি ঋষিদের তপোবন। তপোবন আমি দেখিনি কিন্তু তপোবনের যে ছবি আমার কল্পনায় আছে তার সঙ্গে সুলতান সাহেবের বাড়ির কোন অমিল নেই। চারদিকে বিচিত্র গাছপালা, লতাগুল্ম। আলো এবং আঁধার। কি পরিষ্কার উঠোন, একটা শুকনো পাতাও নিচে পড়ে নেই। আমি কিছু বলার আগেই সুলতান সাহেব বললেন, কী সুন্দর, ঠিক না?

আমি বললাম, খুবই সুন্দর! এতটা সুন্দর ভাবিনি।

খুশি হয়েছেন?

খুব খুশি হয়েছি।

কাউকে খুশি হতে দেখলে আমার ভাল লাগে।

তিনি ক্রমাগত হাসছেন। তার চোখে-মুখে আনন্দ ঝরে পড়ছে। রোগা লম্বা একজন মানুষ। গায়ে শাদা পাঞ্জাবী। ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে মাথার অগোছালো চুল। স্বপ্নময় চোখ। আমি বললাম, আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি ঢাকার পত্রিকায় আপনার সম্পর্কে যেসব খবর ছাপা হয় তা ঠিক না।

সুলতান সাহেব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি ছাপা হয়?

আপনার না-কি পঞ্চাশটা পোষা বিড়াল আছে।

সুলতান সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, কেন যে এরা বানিয়ে বানিয়ে খবর দেয়। আমার বিড়ালের সংখ্যা খুবই কম–মাত্র পঁচিশ।

কত বললেন?

পঁচিশটা। আর কুকুর তার চেয়েও কম–আটটা মাত্র কুকুর।

ও।

আপনি দেখবেন?

জি দেখব।

এরা বড় ভাল।

সুলতান সাহেব ডাক দিতেই প্রকাণ্ড সব কুকুর নানাদিক থেকে বের হতে শুরু করল। এ কী কাণ্ড! আমি জানলাম, প্রতিটি কুকুর এবং প্রতিটি বিড়ালের আলাদা আলাদা নাম আছে। সেই নামে তাদের ডাকলে তারা সাড়া দেয়।

সুলতান সাহেব তাঁর কুকুরদের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, পত্রিকার লোকেরা বানিয়ে বানিয়ে লেখে। এইসব বানানো লেখা পড়ে আমার মনটা খারাপ হয়। এক পত্রিকায় লিখেছে–আমি নাকি বেজী পুষি। পকেটে বেজীর বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াই।

আপনি বেজী পুষেন না?

সুলতান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, না। আমি সাপ পুষি।

কি পুষেন বললেন?

সাপ। আমার গোটা দশেক কেউটে সাপ আছে। দেখবেন?

আমি আঁৎকে উঠে বললাম, জি না, দেখব না। এরা থাকে কোথায়?

বাগানেই ঘোরাফিরা করে। বড় লক্ষ্মী। যখন এঁকেবেঁকে যায়, বড়ই মায়া লাগে।

আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল–কি শুনছি এসব? বাগানে ঘোরাফেরা করে পোষা কেউটে?

সুলতান সাহেব হাসিমুখে বললেন, লোকজন সাপকে কেন এত ভয় করে আমি কিছুই বুঝি না। আল্লাহ তো এদের খুব পছন্দ করেন।

আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, আল্লাহ এদের পছন্দ করেন?

অবশ্যই করেন। পছন্দ করেন বলেই এমন তীব্র বিষ এদের এতটা করে। দিয়েছেন। অন্য কোন প্রজাতিকে তো এত বিষ দেয়া হয়নি–।

বাগানে ঘুরে বেড়ানোর প্রাথমিক আনন্দ আমার কেটে গেছে। আমি এখন ঘুরছি ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে। আমার দলের অন্যরাও বিচলিত। তবে সুলতান সাহেবের ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা দেখার উত্তেজনায় মনে হচ্ছে তারা খানিকক্ষণের জন্যে সাপের কথা ভুলে গেছে।

চিড়িয়াখানায় নানান ধরনের জীবজন্তু। প্রকাণ্ড এক সারসপাখিও তাদের মধ্যে আছে। আলাদা আলাদা খাঁচায় নানান প্রজাতির বানর। একটি বিশাল আকৃতির বানর। খুব হৈচৈ করছিল। সুলতান সাহেব তাকে আহত গলায় বললেন, তুমি এরকম করছ কেন? তুমি তো বড়ই দুষ্টামি করছ। এরা মেহমান। মেহমানদের সামনে হৈচৈ করা কি ঠিক?

বানর সঙ্গে সঙ্গে ভদ্র হয়ে গেল এবং মাথা চুলকাতে লাগল। যেন সে বলছে–মাফ করে দেবেন স্যার। মিসটেক হয়ে গেছে। আর হবে না।

এর মধ্যে চা দেয়া হয়েছে। চায়ের সঙ্গে দু’তিন রকমের মিষ্টি। নারিকেলের নাড়। এক হিন্দু মহিলা তদারকি করছেন। কঠিন ধরনের মহিলা বলে মনে হল। সুলতান। সাহেব আমাদের সঙ্গে চা খেতে চাচ্ছেন–মহিলা চা দেবেন না। রাগী গলায় তিনি বললেন, লোভ করবেন না। লোভ করা ভাল না। আপনার শরীর কত খারাপ আপনি জানেন না। রোজ আপনাকে অক্সিজেন খাওয়াতে হয়। আজ সকালেও একবার অক্সিজেন খাওয়ালাম।

বিছানার পাশে অক্সিজেন সিলিন্ডার। এমন অসুস্থ একজন মানুষকে বেশিক্ষণ বিরক্ত করা ঠিক না। উঠে দাঁড়ালাম। সুলতান সাহেব বললেন, শরীরটা বড় খারাপ করেছে। ছবি আঁকতে পারছি না। একটা বড় কাজে হাত দিয়েছি–কিন্তু …। আগেও একবার মরতে বসেছিলাম। রওশন এরশাদ আমাকে ঢাকায় নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। একমাস হাসপাতালে ছিলাম। তিনি রোজ খাবার। পাঠাতেন। যখনই সময় পেতেন আমাকে দেখতে আসতেন।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কোন রওশন এরশাদ?

এরশাদ সাহেবের স্ত্রী।

সে কি!

জানি না কি কারণ। উনি আমাকে বড়ই স্নেহ করেন। উনি কেমন আছেন আপনি কি জানেন?

জি না, আমি জানি না। ঐ মহিলার প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই।

আমাকে বড়ই স্নেহ করতেন। মানুষের স্নেহ-ভালবাসা তুচ্ছ করার জিনিস নয়। আমি করি না। ভালবাসা মনে রাখি।

সুলতান সাহেব হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। বিষণ্ণতা তার চোখ থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, অনেক কিছু করার শখ ছিল। করতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে সময় বোধহয় ফুরিয়ে গেল।

আমি প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বললাম, এখন তো ঢাকা হয়েছে শিল্প-সাহিত্যের কেন্দ্র। ঢাকা থেকে এত দূরে আছেন, আপনার অসুবিধা হয় না?

না। দূরেই ভাল আছি। কোলাহল ভাল লাগে না। এখানে প্রবল শান্তি অনুভব করি। ফার ফ্রম দি মেডিং ক্রাউড।

আপনার রুটিন কি? সময় কাটান কি করে?

বেশির ভাগ সময় বাগানে বসে বসে ভাবি।

কি ভাবেন?

সুলতান সাহেব হাসলেন। তিনি কি ভাবেন তা হয়ত কাউকে জানতে দিতে চান। আমি বললাম, আপনি কি আনন্দে আছেন?

হ্যাঁ, আনন্দে আছি। খুব আনন্দে আছি। একদল ছেলেমেয়ে আমার কাছে ছবি আঁকা শিখতে আসে। এরা মনের আনন্দে কাগজে রঙ লাগায়–দেখে খুব আনন্দ পাই। নৌকা তৈরি শেষ হলে ওদের নিয়ে বের হয়ে পড়ব।

কোথায় যাবেন?

সমুদ্রের দিকে যাব। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন নৌকায় অনেক জানালা?

লক্ষ্য করেছি।

বাচ্চারা বসবে জানালার পাশে। যা দেখবে তার ছবি আঁকবে। ভাবতেই ভাল লাগছে।

আমারও ভাবতে ভাল লাগছে।

আমি বললাম, আজ উঠি।

সুলতান সাহেব বললেন, আরো খানিকক্ষণ বসুন।

বসলাম আরো কিছুক্ষণ। লক্ষ্য করলাম সুলতান সাহেবের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তিনি এই শারীরিক কষ্ট অগ্রাহ্য করার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। মনটা খুব খারাপ হল।

বিদায় নেবার আগে সুলতান সাহেবের স্টুডিওতে ঢুকলাম। মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত উঁচু বিশাল এক ক্যানভাস। ছবি অনেকখানি আঁকা হয়েছে। একদল পেশীবহুল নারী পুরুষ কাজ করছে। কি অপূর্ব ছবি! শিল্পী সুলতান তাঁর নিজের স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছেন ক্যানভাসে। ক’জন মানুষ তা পারে?

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments