Friday, April 19, 2024
Homeকিশোর গল্পরায়বাড়ির প্রতিমা রহস্য - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

রায়বাড়ির প্রতিমা রহস্য – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

রায়বাড়ির প্রতিমা রহস্য - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে কর্নেলকে নমস্কার করলেন। নমস্কারের সময় তাঁর ছড়িটা ডানদিকে বগলের সঙ্গে আটকে রেখেছিলেন। তারপর বললেন, আমি সুদর্শন রায়। গতরাতে কনকপুর থেকে আপনাকে ট্রাঙ্ককল করেছিলুম।

কর্নেল বললেন, বসুন সুদর্শনবাবু।

সুদর্শন রায় সোফায় বসলেন। তার ছড়িটা পাশে ঠেস দিয়ে রেখে বললেন,–ট্রাঙ্ককলে একটা কথা বলা হয়নি। একে তো বিচ্ছিরি কীসব শব্দ। তারপর হঠাৎ লাইনটা কেটে গেল। ভবানীপুরে আমার মাসতুতো ভাই জয়কৃষ্ণ রায়চৌধুরিই আমাকে আপনার কাছে আসতে বলেছিল।

–হ্যাঁ। জয়কৃষ্ণবাবু আমাকে গতকাল টেলিফোনে আপনার কথা বলেছেন।

বলেছে?–ভদ্রলোক উৎসাহে একটু চঞ্চল হয়ে উঠলেন।–তা হলে আপনার কাছে আমার আসবার কারণও নিশ্চয় জানিয়েছে?

কর্নেলের হাতে অনেকগুলো পোস্টকার্ড সাইজের রঙিন ছবি ছিল। ছবিগুলো প্রজাপতির। গত অক্টোবরে সরডিহার জঙ্গলে অনেক ঘোরাঘুরি করে ক্যামেরায় দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির প্রজাপতির ছবি তুলে এনেছিলেন। এতক্ষণ সেই ছবিগুলো দেখিয়ে তিনি আমাদের কান ঝালাপালা করছিলেন। অবশ্য প্রাইভেট ডিটেকটিভ কৃতান্তকুমার হালদার–আমাদের প্রিয় হালদারমশাই মনোযোগী ছাত্রের মতো শুনছিলেন। কী বুঝছিলেন তা তিনিই জানেন!

এমন একটা অবস্থায় কোন কনকপুরের সুদর্শন রায় এসে বাঁচালেন। ভদ্রলোক বয়সে প্রৌঢ়। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ আছে। সিঁথি-করা কাঁচাপাকা চুল আর পুরু গোঁফে শৌখিনতার ছাপও স্পষ্ট। গায়ে সার্জের পাঞ্জাবি, পরনে ধুতি। হাঁটু অবধি পশমের মোজা। কাঁধে ভাঁজ করা নকশাদার কাশ্মীরি শাল। অনুমান করলুম, নভেম্বরের শেষাশেষি কলকাতায় ফ্যান চললেও তাঁদের কনকপুরে জাঁকিয়ে শীত পড়েছে এবং টুপি বা মাফলার নিশ্চয় তার কাঁধের সুদৃশ্য পুষ্ট ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছেন। শুধু তাঁর ছড়িটা সাদাসিধে রকমের। দেখে বোঝা যায় মোটা বেতের ছড়ি এবং মাথাটা ছাতার বাঁটের মতো ঘোরালো। কালো রঙের বাঁট। হালদারমশাই গুলি-গুলি চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে হাসি পেল। কিন্তু এখন আবহাওয়া গুরুগম্ভীর।

যাই হোক, ভদ্রলোকের প্রশ্নের উত্তরে কর্নেল বললেন,–জয়কৃষ্ণবাবু কিছুটা জানিয়েছেন। তবে টেলিফোনে শুধু ওইটুকু জানা যথেষ্ট নয়। উনি আমার পুরোনো বন্ধু। আমার মতো ওঁরও কিছু বাতিক আছে। পাখি দেখা, অর্কিড সংগ্রহ, ক্যাকটাসের বাগান করা।

সুদর্শনবাবু বললেন, হ্যাঁ, জয়কৃষ্ণ একসময় নাম করা শিকারিও ছিল। আমার ঠাকুরদা ছিলেন কনকপুরের জমিদার। কনকপুরের পূর্বে পাঁচখালি নামে একটা মহাল ছিল তার আমলে। ওই মহালটা জলজঙ্গলে কিছুটা দুর্গম ছিল। এখনও ওদিকটায় তত উন্নতি হয়নি। জয়কৃষ্ণ বাইশ বছর বয়সে পাঁচখালির জঙ্গলে একটা বাঘ মেরেছিল। তারপর তো পশুপাখি মারা আইন করে নিষিদ্ধ হল। তবু জয়কৃষ্ণ–ওর ডাকনাম আপনি হয়তো জানেন…

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–ঝন্টুবাবু।

–তো ঝন্টু পাঁচখালির জঙ্গলমহলে যাওয়া ছাড়েনি। ওই তল্লাটের মানুষজন ওকে দেবতার মতো ভক্তি করে। আজকাল আর তত যায় না।

এই সময় ষষ্ঠীচরণ কফি আনল। কর্নেল বললেন,–কফি খান সুদর্শনবাবু। কফি নার্ভ চাঙ্গা করে।

সুদর্শনবাবু কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন,–ঝন্টু আপনাকে কতটুকু জানিয়েছে জানি না। তবে ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপনীয়।

কথাটা বলে সুদর্শনবাবু আমাদের দিকে একবার তাকিয়ে নিলেন। কর্নেল বললেন,–আলাপ করিয়ে দিই। এ আমার তরুণ বন্ধু খ্যাতিমান সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি। আর উনি মিঃ কে. কে. হালদার। প্রাক্তন পুলিশ ইন্সপেক্টর। রিটায়ার করার পর প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন। এঁরা দুজনেই আমার বিশ্বস্ত সহচর।

সুদর্শনবাবু আমাদের নমস্কার করলেন। তারপর বললেন, ঘটনার পর আমি কোনো প্রাইভেট ডিটেকটিভের কাছে যাওয়ার কথা ভেবেছিলুম। কিন্তু আমার দাদা সুরঞ্জন পুলিশের উপরতলায় কাকেও ধরার পক্ষপাতী। ঝন্টুর পুলিশমহলে জানাশোনা আছে। কিন্তু সে আপনার কাছে আসবার জন্য পরামর্শ দিয়েছিল।

কর্নেল বললেন, আপনি এঁদের সামনে স্বচ্ছন্দে ঘটনাটা জানাতে পারেন।

সুদর্শনবাবু একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, আমাদের রায়পরিবারের গৃহদেবী মহালক্ষ্মী। কোজাগরী পূর্ণিমার রাত্রে ঘরে-ঘরে লক্ষ্মীপুজো হয়। আমাদের দেবী মহালক্ষ্মীরও ওই রাত্রে পুজো হয়। সারা বছর ওই রাত্রিটা বাদে প্রতিমা রাখা হয় আমাদের দোতলা বাড়ির ওপরতলায় বিশেষভাবে তৈরি একটা ঘরের দেওয়ালসংলগ্ন আয়রনচেস্টে। ঘরের দরজার তালা আর ওই আয়রনচেস্টের তালার দুটো করে চারটে চাবি ছিল। বাবা মৃত্যুর আগে দুটো চাবি আমাকে আর দুটো চাবি আমার দাদা সুরঞ্জনকে দিয়েছিলেন। এবার ব্যাপারটা খুলে বলি। দরজার তালা খুলতে হলে প্রথমে দাদার চাবিটা ঢুকিয়ে একপাক ডাইনে ঘোরাতে হবে। তারপর আমার চাবিটা তালায় ঢুকিয়ে বাঁদিকে একপাক ঘোরাতে হবে। তবেই দরজার তালা খুলবে।

হালদারমশাই অবাক হয়ে বললেন,–কন কী? একখান চাবি দিয়া তালা খুলব না?

-না। এরপর আয়রনচেস্ট খুলতে হলেও আগে দাদার চাবি তারপর আমার চাবি ঢুকিয়ে একইভাবে ঘোরাতে হবে। তবেই আয়রনচেস্ট খুলবে। তারপর আমরা দুভাই রুপোর থালায় মহালক্ষ্মীকে বের করব। আয়রনচেস্ট একইভাবে বন্ধ করব। ঘর থেকে বেরিয়ে দেবীকে তুলে দেব আমাদের পুরুতঠাকুর দেবনারায়ণ মুখুজ্যের হাতে। দুভাই মিলে এবার ঘরের দরজার তালা আটকে দেব। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি বাড়ির মাঝামাঝি জায়গায়। সিঁড়ির নীচে অপেক্ষা করবে বাড়ির লোকজন। আমরা সবাই যাব ঠাকুরবাড়িতে। সেখানে মন্দিরের বেদিতে দেবীকে রেখে পুজোআচ্চা শুরু হবে। মোটামুটি এতবছর ধরে এটাই নিয়ম।

কর্নেল বললেন,–বুঝলুম। কিন্তু ঘটনাটা কী?

সুদর্শনবাবু জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন,–অক্টোবর মাসে কোজাগরী পূর্ণিমার রাত্রে দাদা আর আমি আয়রনচেস্ট থেকে দেবীকে বের করে দেখি, মাথার মুকুট নেই। গলার জড়োয়া নেকলেস নেই। দেখামাত্র আমাদের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল। দাদা ঠান্ডামাথার মানুষ। কিন্তু আমি মাথার ঠিক রাখতে পারিনি। চিৎকার, চ্যাঁচামেচি করে হইচই বাধিয়ে দিলুম। খবর রটতে দেরি হয়নি। পাড়ার ভদ্রলোকেরা ছুটে এসেছিলেন। তারপর পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল। থানার অফিসার ইন-চার্জ আমাদের দুভাইকে পৃথকভাবে জেরা করে শেষে খুব হম্বিতম্বি শুরু করলেন। দাদা, না হয় আমি, যে-কোনো একজন চুরি করেছি–এই তাঁর মত।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, আপনার দাদা কোথায় চাবি রাখতেন, সে কথা আপনি নিশ্চয় জানতেন না?

সুদর্শনবাবু বিষমুখে বললেন,–কর্নেলসায়েব! আপনিও থানার বড়বাবুর মতো কথা বলছেন!

–না। এটা নিছক একটা প্রশ্ন। তা ছাড়া, আমি কখনওই বলছি না আপনার দাদা কোথায় চাবি রাখতেন, তা আপনার জানা ছিল। যাই হোক, এবার বলুন আপনার চাবি আপনি কোথায় রাখতেন?

সুদর্শনবাবু তাঁর বেতের মোটা ছড়িটা হাতে নিয়ে বললেন,–এই ছড়ির ভেতরে। বলে তিনি কালো রঙের অর্ধবৃত্তাকার বাঁটটা ঘোরাতে শুরু করলেন। বাঁটটা খুলে গেল। তারপর ছড়িটা তুলে তিনি একটু নাড়া দিতেই খুদে রিঙে আটকানো দুটো চাবি ছিটকে নীচে পড়ল। চাবিদুটো কুড়িয়ে নিয়ে তিনি বললেন,–কী ধাতুতে তৈরি জানি না। তবে চাবি দুটোর ওজন আছে।

কর্নেল বললেন,–চাবি দুটো একটু দেখতে চাই।

সুদর্শনবাবু তার হাতে চাবি দিলেন। চাবিদুটোর গড়ন দুরকমের। একটা ইঞ্চিতিনেক লম্বা, অন্যটা তার চেয়ে ছোট। কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে আতশকাঁচ বের করে টেবিলল্যাম্প জ্বেলে দিলেন। তারপর আতশকাঁচ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখে চাবিদুটো সুদর্শনবাবুকে ফেরত দিলেন। সুদর্শনবাবু চাবিদুটো ছড়ির গর্তে ঢুকিয়ে ঘোরালো বাঁটটা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে আঁট করে দিলেন।

কর্নেল বললেন,–এই বেতের ছড়িটা আপনি কতদিন আগে কিনেছিলেন? আমার ধারণা এটা অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়েছিলেন। তাই না?

-ঠিক ধরেছেন। আগে চাবিদুটো আমি আমার ঘরে আলমারির লকারে রাখতুম। বছর তিনেক আগে পাঁচখালি এলাকার একটা বসতিতে দশরথ নামে একটা লোককে দিয়েছড়িটা তৈরি করিয়েছিলুম। ওদের ডোম বলা হয়। পাঁচখালি এলাকায় বেতের জঙ্গল আছে। ডোমেরা বেতের তৈরি ধামা, ধান-চাল মাপবার পাত্র, চুপড়ি, দোলনা এইসব জিনিস তৈরি করে কনকপুরে চৈত্রসংক্রান্তির গাজনের মেলায় বেচতে আসে। দশরথ খুব পাকা কারিগর। আমাদের ছোটবেলায় বাবা দশরথকে দিয়ে বেতের এক সেট টেবিল-চেয়ার তৈরি করিয়েছিলেন। সেগুলো এখনও আছে।

-আপনি বেতের ছড়িতে চাবি রাখা নিরাপদ মনে করেছিলেন। এর কি কোনো বিশেষ কারণ ছিল?

সুদর্শনবাবু একটু চুপ করে থাকার পর বললেন,–গ্রামে আমার ঠাকুরদার প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুল আছে। একটা লাইব্রেরিও আছে। ঠাকুরমার নামে নাম। রত্নময়ী পাঠাগার। বাবা লাইব্রেরিঘরের সঙ্গে আরও একটা ঘর তৈরি করে দিয়েছিলেন। ওই ঘরে তাস, ক্যারাম, দাবা এইসব খেলার আসর বসত। বিকেল চারটে থেকে রাত্রি নটা অবধি সেখানে খেলা চলত। দাবা খেলার নেশা আমার আছে। এদিকে আমার শোওয়ার ঘরে সেই আলমারি আছে। বছর দিনেক আগে রাত সাড়ে নটায় বাড়ি ফিরে দেখি, শোওয়ার ঘরের দরজার তালা ভাঙা। আমার যা স্বভাব। চিৎকার-চাচামেচি করে হুলস্থূল বাধিয়েছিলুম। দাদা এসে আমাকে বললেন, ঘরে ঢুকে দেখেছ কিছু চুরি গেছে কি না? তারপর নিজেই ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন। আমি ঘরে ঢুকে দেখলুম, সবকিছু ঠিকঠাক আছে।

হালদারমশাই একটু হেসে বললেন,–চোর তালা ভাঙছিল। কিন্তু চুরির সময় পায় নাই।

কর্নেল বললেন, আপনার ফ্যামিলি, মানে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা?

সুদর্শনবাবু আস্তে বললেন,–আমি বিয়ে করেছিলুম। কিন্তু আমার স্ত্রী ব্লাডক্যান্সারে মারা যান। তারপর আর বিয়ে করিনি। জমি-পুকুর-বাগান দেখাশোনা এসব নিয়েই থাকতুম। শুধু সন্ধ্যা থেকে দাবা।

–তা হলে আপনি সেই ঘটনার পর এই ছড়ি তৈরি করিয়েছিলেন?

–ঠিক ধরেছেন। ছড়িটা বাইরে গেলে সবসময় হাতে থাকবে। আবার দাবার আসরে বসলেও ছড়িটা আমার হাতের পাশে রাখা থাকবে। কোলে ফেলে রাখতেও অসুবিধে নেই।

–আপনার দাদা কী করেন?

–আপনাকে বলেছি, জমিসম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব আমি নিয়েছিলুম। কারণ ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় আমার মন ছিল না। ঝন্টুকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন। আর দাদার কথা জিজ্ঞেস করছেন? দাদা পড়াশুনায় খুব ভালো ছিল। কনকপুর হাইস্কুলে দাদা মাস্টারি করত। দুবছর আগে রিটায়ার করেছে। শোভা-বউদিকে আমি মায়ের মতো শ্রদ্ধা করি।

–আপনার দাদার ছেলেমেয়ে?

–এক মেয়ে এক ছেলে। মেয়ের বিয়ে হয়েছিল বহরমপুরে। তার স্বামী সরকারি অফিসার। তার বদলির চাকরি। এখন সুনন্দা শিলিগুড়িতে থাকে। তার একটি মেয়ে আছে। দাদার ছেলে গৌতম ঝন্টুর বাড়িতে থেকে কোনো কলেজে পড়ত। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। ঝন্টুর তদ্বিরে সে আমেরিকাতে পড়তে গেছে। কর্নেলসায়েব! দাদা-বউদির প্রতি আমার এতটুকু ঈর্ষা নেই। অথচ বজ্জাত লোকেরা এখন কতরকম আজেবাজে কথা রটাচ্ছে।

-এবার কোজাগরী পূর্ণিমার দিন কি আপনার দাদার মেয়ে-জামাই-নাতনি সবাই এসেছিল?

–হ্যাঁ। তা ছাড়া, আরও কিছু আত্মীয়স্বজনও এসেছিল। প্রতিবছর ওই একটা দিন আমাদের রায়পরিবারে একটা বড় উৎসব। পরদিন কাঙালিভোেজন, বস্ত্রদান এসবও হয়। এবার কিছুই হয়নি।

-এখন বাড়িতে কারা আছে?

–দাদা-বউদি। বাবার আমলের কাজের লোক হরিপদ আর গোবিন্দ। গোবিন্দ জমিসম্পত্তি দেখাশোনার কাজে আমাকে সাহায্য করে। সে আমার বিশ্বস্ত লোক। হরিপদ বাড়ির সব ফাইফরমাশ খাটে। রান্না করে মোনাঠাকুর। সে-ই হাটবাজার করে। আর আছে কাজের মেয়ে শৈলবালা। আমি দুধের জন্য একটা গাইগরু পুষেছি। গোরুর দেখাশোনা, দুধ দোহানো এসব কাজও শৈল করে।

–একটু ভেবে বলুন সুদর্শনবাবু! কোজাগরী পূর্ণিমার দিন আপনি ঘুম থেকে ওঠার পর সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত আপনার এই ছড়িটা কোথায় ছিল?

সুদর্শনবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন–আমি ঘরে থাকলে ছড়িটা ব্র্যাকেটে ঝোলানো থাকে। দোতলা থেকে নীচে কোনো কাজে নামলে ঘরে নতুন দামি তালাটা এঁটে দিই। বাড়ি থেকে বাইরে বেরুলে ছড়িটা আমার হাতেই থাকে। সেদিও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

কর্নেল এতক্ষণ পরে চুরুট ধরালেন। তারপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন–তা হলে আপনার এবং আপনার দাদার চাবি প্রতিবছর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন ওই একবার বের। করতে হয় দুজনকে। তাই তো?

–হ্যাঁ। ওই একবার।

–বছরের অন্যসময়, ধরুন গত একবছরে কখনও কি আপনি ছড়ির বাঁট খুলে চাবিদুটো আছে কি না দেখে নিয়েছেন?

–খুলে দেখার দরকার হয় না। কেন জানেন? ছড়িটা হাতে নিয়ে মাটিতে ঠেকিয়ে হাঁটতে হয়। আমি অভ্যাসবশে ঠিক বুঝতে পারি ভিতরে চাবি আছে কি না।

–তার মানে, আবছা শব্দ শুনতে পান?

–ঠিক ধরেছেন কর্নেলসায়েব!

–আর-একটা কথা। আপনি দোতলায় থাকেন। আপনার দাদা-বউদি?

–দোতলায়। বুঝিয়ে বলি। দোতলায় মোট ছখানা ঘর। সিঁড়িটা মাঝখানে। তিনটে করে ঘর তার দুধারে। টানা বারান্দা আছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকে, মানে পূর্বের প্রথম ঘরটাতে থাকেন মহালক্ষ্মী। পরের ঘরে জমিদারি আমলের দামি আসবাবপত্র রাখা আছে। পূর্বের শেষ ঘরটাতে থাকে দাদা-বউদি। কনকপুরে বিদ্যুৎ আসবার পর বারান্দার ওদিকটায় দেওয়াল তুলে অ্যাটাচড় বাথরুম করা হয়েছে। আর আমি থাকি পশ্চিমের একেবারে শেষ ঘরটাতে। বাকি দুটো ঘরের মধ্যে আমার পাশের দুটো ঘর আত্মীয়স্বজন বা কোনো বিশেষ অতিথি এলে তাদের জন্য রাখা হয়েছে। ঝন্টু গেলে আমার পাশের ঘরে শোয়।

-এবার কোজাগরী পূর্ণিমার কদিন আগে আপনার দাদার মেয়ে-জামাই-নাতনি এসেছিলেন?

–দুর্গাপুজোর আগেই এসেছিল। ষষ্ঠীর দিন।

-–তারা আপনার পাশের ঘরে, নাকি অন্য ঘরে ছিলেন?

–আমার পাশের ঘরে। দাদার নাতনি পিংকি আমার কাছে ভূতের গল্প শুনতে চায়। সে আমার বিছানায় শুতে।

–তার পরের ঘরে কেউ ছিলেন ওই সময়?

–আমাদের মামাতো ভাই পরেশ। সে থাকে রাঁচিতে। ল্যাব রিসার্চের অফিসে চাকরি করে। সত্যি বলতে কী, মহালক্ষ্মীপুজোর সব কাজের ঝামেলা সে-ই সামলায়।

–পরেশবাবু সম্পর্কে আপনার কোনো সন্দেহের কারণ নেই তা হলে?

–না। পুলিশ তাকে খুব জেরা করেছিল। কিন্তু তাকে অ্যারেস্ট করেনি।

–তা হলে পুলিশ কাকে অ্যারেস্ট করেছে?

–পুলিশের যা নিয়ম। খামোকা গোবিন্দ আর হরিপদকে দিন পাঁচেক আটকে রেখেছিল। দাদা আর আমি বড়বাবুকে ধরাধরি করে বেচারাদের ছাড়িয়ে এনেছিলুম।

–আচ্ছা সুদর্শনবাবু, আপনাদের গৃহদেবী মহালক্ষ্মীর কি কোনো ছবি তোলা হয়েছিল?

–হ্যাঁ। কনকপুর এখন প্রায় টাউন হয়ে উঠেছে। ছবি তোলার স্টুডিয়োও আছে। গতবছর কোজাগরী পূর্ণিমার দিন দাদা কমলা স্টুডিয়ো থেকে রামবাবুকে ডেকে এনেছিল। প্রতিমার ছবি খুব সুন্দর তুলেছিল রামবাবু। রঙিন ছবি। অনেকগুলো কপি করে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে দাদা বিলি করেছিল। আর নীচের তলায় বসার ঘরের জন্য একটা ছবি বড় করে বাঁধানো হয়েছিল। আমার কপিখানা দেখাচ্ছি।

বলে সুদর্শনবাবু তার ব্যাগ থেকে বাঁধানো প্রায় ৯ ইঞ্চি লম্বা আর ৬ ইঞ্চি চওড়া ফ্রেমে বাঁধা একটা রঙিন ছবি বের করে দিলেন। ছবিটা কর্নেল দেখে নিয়ে হালদারমশাইকে দিলেন। তিনি দেখার পর আমাকে দেখতে দিলেন। দেখে মনে হল, মূর্তিটা প্রাচীন। কষ্টিপাথরে তৈরি। মাথায় রত্নখচিত মুকুট। গলায় জড়োয়ার হার।

কর্নেল বললেন,–একমিনিট। আমি এই ছবি থেকে আমার ক্যামেরায় ছবি তুলে নিচ্ছি। দরকার হতে পারে।

কর্নেল তার ক্যামেরায় ছবি তুলে নেওয়ার পর বললেন, ঠিক আছে সুদর্শনবাবু! আমি আপনাদের গৃহদেবী মহালক্ষ্মীর চুরি যাওয়া অলংকার উদ্ধারের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব। বাড়ি ফেরার পথে আপনি মিঃ রায়চৌধুরিকে জানিয়ে যেতে পারেন, আমি আপনাদের সাহায্য করতে চেয়েছি।

সুদর্শনবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–ঝন্টুর বাড়ি গেলে শেয়ালদা স্টেশনে সাড়ে এগারোটার ট্রেন ফেল করব। মাঠে পাকা ধান কাটা শুরু হয়েছে। আমাকে দুপুরের মধ্যেই পৌঁছতে হবে। আপনি কবে কনকপুর যাচ্ছেন তাই বলুন!

কর্নেল বললেন,–যত শিগগির পারি, যাব। কিন্তু একটা শর্ত। আপনার দাদা আর আপনি ছাড়া ওখানকার কেউ যেন জানতে না পারে, আমি কেন কনকপুরে গেছি। আর-একটা কথা। আপনাদের বাড়িতে আমরা উঠব না। মিঃ রায়চৌধুরির কাছে শুনেছি, কনকপুরের কাছাকাছি ইরিগেশন বিভাগের একটা বাংলো আছে। সেখান থেকে আপনার সঙ্গে যথাসময়ে যোগাযোগ করব।

সুদর্শনবাবু বললেন, আপনার ইচ্ছা। তারপর আমাদের সবাইকে নমস্কার করার পর ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেতের ছড়িটা মুঠোয় ধরে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।

গোয়েন্দাপ্রবর বললেন-হেভি মিস্ত্রি।

কর্নেল এইসময় একটু ঝুঁকে সোফার নীচে থেকে একটা ছোট্ট কার্ড কুড়িয়ে নিলেন। তারপর সেটা দেখে নিয়ে পকেটস্থ করে বললেন, হ্যাঁ। হেভি মিস্ত্রিই বটে। সুদর্শনবাবুর ব্যাগ থেকে ছবি বের করার সময় এই কার্ডটা ছিটকে পড়েছিল মনে হচ্ছে। কার্ডটা কলকাতার এক জুয়েলারি কোম্পানির।

হালদারমশাই ও আমি দুজনেই চমকে উঠেছিলুম। দুজনে একই সঙ্গে বলে উঠলুম, –জুয়েলারি কোম্পানির কার্ড?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, চন্দ্র জুয়েলার্স কোম্পানি। চৌরঙ্গিতে এঁদের বিশাল দোকান। এই কোম্পানি কলকাতার অন্যতম সেরা রত্নব্যবসায়ী। কিন্তু এঁদের কার্ড সুদর্শনবাবু পকেটে না রেখে ব্যাগে রেখেছিলেন কেন?

গোয়েন্দাপ্রবর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–ভদ্রলোকরে ফলো করুম!

তারপর তিনি সবেগে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল কিছু বললেন না। আমি ব্যস্তভাবে বললুম, –হালদারমশাইকে নিষেধ করা উচিত ছিল। আপনার কথা নিশ্চয় শুনতেন। অথচ আপনি এঁকে বাধা দিলেন না?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, তুমি তো জানো, হালদারমশাই গোয়েন্দাগিরির সুযোগ পেলে ছাড়তে চান না। তা ছাড়া, ইদানীং ওঁর হাতে কোনো কেস নেই। এমন একটা অদ্ভুত রহস্যের গন্ধ পেয়ে উনি চুপচাপ বসে থাকার পাত্র নন। তা ছাড়া, হালদারমশাই পঁয়ত্রিশ বছর পুলিশে চাকরি করেছেন। ওঁকে নিয়ে তোমার উদ্বেগের কারণ নেই।

বললুম, কিন্তু সুদর্শনবাবুদের মহালক্ষ্মীদেবীর মুকুট আর জড়োয়া নেকলেস চুরি গেছে। এই অবস্থায় সুদর্শনবাবুর কাছে একজন বিখ্যাত রত্নব্যবসায়ীর কার্ড!

–আবার বলছি। কার্ড সবাই পকেটে রাখে। সুদর্শনবাবু কার্ডটা তার ব্যাগে ছবিটার সঙ্গে খুঁজে রেখেছিলেন। কেন ওখানে রেখেছিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর তিনিই দিতে পারেন। বরং চলো! এগারোটা বাজে। আমরা এক চক্কর ঘুরে আসি।

–কোথায় যাবেন?

–আমি পোশাক বদলে আসি। তারপর বলব।

কর্নেলের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে নীচে নেমে আমার গাড়িতে উঠে বসলুম। কর্নেল যথারীতি আমার বাঁদিকে বসলেন। গেট পেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি বললেন,–পার্ক স্ট্রিট হয়ে চৌরঙ্গি। তারপর সোজা দক্ষিণে।

রবিবার বলে রাস্তায় গাড়ির ভিড় ছিল না। চৌরঙ্গিতে বাঁদিকে বাঁক নিয়ে বললুম,–সোজা দক্ষিণেই যাচ্ছি। কিন্তু পৌঁছুব কোথায়? কর্নেল বললেন, ভবানীপুরে।

-–তাই বলুন। সুদর্শনবাবুর মাসতুতো ভাইয়ের বাড়ি!

–নাঃ! চলো তো! আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।

হাজরা রোডের মোড় পেরিয়ে কর্নেলের নির্দেশে ডাইনে একটা রাস্তায় গাড়ি ঘোরালুম। তারপর বাঁদিকে আঁকাবাঁকা গলি রাস্তায় ঘুরতে-ঘুরতে একটা চওড়া রাস্তার মোড়ে পৌঁছুনোর পর কর্নেল বললেন,–এসে গেছি। ডানদিকের ওই বড় বাড়িটা। গেটের সামনে হর্ন বাজাবে।

গেটে দারোয়ান ছিল। সে গেট খুলে দিল। নুড়িবিছানো পথের দুধারে দেশি-বিদেশি গাছপালা, আর মরশুমি ফুলের উজ্জ্বলতা। গাড়িবারান্দার তলায় পৌঁছুলে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক প্রৌঢ় ভদ্রলোককে সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলুম। কর্নেল নামতেই তিনি নমস্কার করে সহাস্যে বললেন, আমার সৌভাগ্য! অনেকদিন পরে আপনার দর্শন পেলুম।

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–সৌভাগ্য আমারই। কারণ টেলিফোন যিনি ধরেছিলেন, তিনি বললেন, আপনি সাড়ে বারোটার মধ্যে বেরোবেন। তাই আমার তরুণ সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্তের গাড়িতে এসে গেলুম।

আমি গাড়ি পার্ক করার জন্য একটু এগিয়ে যেতেই ভদ্রলোক বললেন, আপনি গাড়ি থেকে নেমে আসুন। আমার লোক গাড়ি ঠিক জায়গায় রেখে আপনাকে চাবি ফেরত দেবে।

গাড়ি থেকে নেমে গেলুম। কর্নেল আলাপ করিয়ে দিলেন। জয়ন্ত! ইনি কলকাতা কেন, সারা ভারতের শ্রেষ্ঠ রত্নবিশারদ মিঃ অবনীমোহন চন্দ্র। চৌরঙ্গিতে এঁদের চন্দ্র জুয়েলার্স কোম্পানি প্রায় দুশো বছর ধরে ব্যবসা করছেন। তুমি শুনলে অবাক হবে, ব্রিটেনের রাজপরিবারে এঁর পূর্বপুরুষ প্রাচীন ভারতীয় ডিজাইনের অনেক অলঙ্কার সাপ্লাই করতেন।

ততক্ষণে আমি বুঝে গেছি, হঠাৎ কর্নেলের এখানে আসবার উদ্দেশ্যটা কী। পোশাক বদলাতে ঘরে ঢুকে কর্নেল টেলিফোন করেই এখানে এসেছেন। চার ধাপ সিঁড়ির উপর বারান্দায় উঠেছি, সেই সময় উর্দি পরা একটা লোক আমার গাড়ির চাবি দিয়ে গেল। আধুনিক রীতিতে সাজানো প্রশস্ত ঘরে মিঃ চন্দ্র আমাদের বসিয়ে কর্নেলের মুখোমুখি বসলেন। তিনি বললেন,–সাড়ে বারোটা নাগাদ আমার বেরুনোর কথা। যাই হোক, আপনার জন্য কফি করতে বলেছি। কফি খেতে-খেতে কথা হবে।

দেখলুম, পাশের ঘরের পর্দা তুলে একজন পরিচারক এগিয়ে এল। সে সেলাম ঠুকে সোফার সেন্টার টেবিলে একটা ট্রে রেখে গেল। আমার আর কফি পানের ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু কফির পেয়ালা তুলে নিতেই হল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে আস্তে বললেন, আপনার কোম্পানির একটা কার্ড পেয়েছি। কোথায় পেয়েছি বা কী করে পেয়েছি, এখন তা বলতে চাইনে। সময়মতো নিশ্চয় তা আপনাকে জানাব।

মিঃ চন্দ্র যেন একটু অবাক হয়েছিলেন। বললেন, আমাদের কোম্পানির কার্ড তো আমরা যাকে-তাকে দিই না। কেউ কোনো অলঙ্কার যত বেশি টাকারই কিনুন না কেন, তাকেও আমরা কার্ড দিই না। ক্যাশমেমোই যথেষ্ট। তবে বিশেষ-বিশেষ ক্ষেত্রে কার্ড দিতে হয়।

–কোন ক্ষেত্রে?

–ধরুন, কোথাও গিয়ে কোনো পয়সাওয়ালা লোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হল এবং তিনি তাঁর পরিবারে কারও বিয়ে উপলক্ষে বিশেষ অর্ডার দিয়ে অলঙ্কার কিনতে চান, তাঁকে কার্ড দিই, আবার কলকাতার কোনো ধনী পুরুষ বা মহিলা আমাদের দোকানে এলেন এবং তাদের টাকার দরকার আছে বলে দামি অলঙ্কার বিক্রি করতে চাইলেন, তাদের কার্ড দিতে হয়। তারা তো সঙ্গে করে সেই অলঙ্কার নিয়ে যান না। কারণ আজকাল সঙ্গে দামি অলঙ্কার নিয়ে বেরুনোর রিস্ক আছে। তারা কার্ড চেয়ে বলেন টেলিফোনে তারা জানাবেন, কখন আমার কোম্পানির এক্সপার্টরা গিয়ে সেই অলঙ্কার পরীক্ষা করে দরদাম স্থির করবেন।

–বুঝলুম। এ ছাড়া আর কাউকে…..

মিঃ চন্দ্র কর্নেলের কথার উপর একটু থেমে বললেন,–খুলেই বলি। গত বছর আমাদের দোকানে অতবড় একটা চুরির কিনারায় পুলিশ যখন হিমশিম খাচ্ছিল, তখন আপনার সাহায্য নিলুম। আপনি দুদিনেই পাঁচলক্ষ টাকার নেকলেস-সহ চোরকে ধরে দিয়েছিলেন। আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ কর্নেলসায়েব!

কর্নেল দ্রুত বললেন,–ও কথা থাক। কী খুলে বলতে চাইছিলেন, বলুন।

–নানা দেশের রত্নকারবারিদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। খাঁটি মুক্তো আমরা এজেন্ট মারফত কুয়েত, আবু ধাবি, কাতার এইসব আরব দেশ থেকে আমদানি করি। আপনার কাছে লুকোনোর কারণ নেই। কাস্টমসের চোখ এড়িয়ে গোপনে এই লেনদেন হয়। এজেন্টের কাছে। আমাদের কার্ড থাকে। আবার হংকংয়ে আমাদের এজেন্ট আছে। হংকং সবরকমের রত্নের বাজার। হংকংয়ের এজেন্টের কাছে আমাদের কার্ড আছে।

–তা হলে আপনার কোম্পানির কার্ডের একটা গুরুত্ব আছে। সেই কার্ড যে-ভাবে হোক, আমার হাতে এসে গেছে। দেখাচ্ছি, তবে কার্ডটা আপনাকে দেব না। আগেই সেটা বলে রাখলুম।

বলে কর্নেল বুকপকেট থেকে সেই কার্ডটা বের করে মিঃ চন্দ্রের হাতে দিলেন। মিঃ চন্দ্র কার্ডটা দেখার পর বললেন,–কী আশ্চর্য! এই কার্ডটা আমাদের কোম্পানির কার্ড। এই যে দেখছেন, তলার দিকে ছোট্ট গোল রবার সিলের ছাপ, তার উপর আমার হাতে এ এম সি সই করা আছে কালো কালিতে। এটা কোনোভাবে মোছা যাবে না। কারণ পেনের এই কালিটা বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি। কর্নেলসায়েব! এই কার্ড নিশ্চয় আমার কোম্পানির কোনো এজেন্টের কাছে ছিল। এতে একটা নাম্বার আছে, খালি চোখে তা দেখা যাবে না। হাতে সময় কম। তা না হলে নাম্বার পরীক্ষা করে রেজিস্টারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে এই এজেন্টের নাম-ঠিকানা বলে দিতুম।

–এজেন্টের কার্ড দৈবাৎ হারিয়ে গেলে তিনি নিশ্চয় আপনাকে জানাবেন? মিঃ চন্দ্র জোর দিয়ে বললেন, অবশ্যই জানাবেন। কিন্তু এখনও তো কেউ জানাননি! এটাই অবাক লাগছে।

–তিনি বা আপনি কার্ড হারানোর জন্য পুলিশকে নিশ্চয় জানাবেন। ডায়রি করবেন থানায়।

মিঃ চন্দ্র হঠাৎ একটু দমে গেলেন যেন। আস্তে বললেন,–না, তার অসুবিধে আছে। কারণ আপনি আশা করি অনুমান করতে পারছেন। রত্নব্যবসায়ীদের অনেক ঝক্কি আছে। অনেকসময় এজেন্ট জেনে বা না জেনে এমন জুয়েলস বিক্রেতার খবর দিল, যিনি আয়কর ফাঁকি দিতে চান কিংবা জুয়েলস চোরাই মাল। তা ছাড়া, বিদেশ থেকে গোপনে রত্ন আমদানির কথাও আপনাকে বলেছি। কাস্টমস বা রেভেনিউ ইনটেলিজেন্সের গোয়েন্দাদের সূত্রে পুলিশ ওই এজেন্টের খবর পেলে বিপদের ঝুঁকি আছে।

কর্নেল তার হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে বললেন,–সব বুঝলুম। আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি উঠি। শুধু একটা অনুরোধ। কোন এজেন্টের কার্ড কোথায় কীভাবে হারিয়েছে, সেই খবর আপনি নিশ্চয় পাবেন। পাওয়ার পর আমাকে তা জানাবেন। আমি কথা দিচ্ছি, এতে আপনাদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেই দায়িত্ব আমার। চলি মিঃ চন্দ্র। নমস্কার…..

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে স্নানাহারের পর ড্রয়িংরুমের ডিভানে গড়িয়ে পড়েছিলুম। ভাত-ঘুমের অভ্যাস। কর্নেল যথারীতি ইজিচেয়ারে বসে চুরুট টানছিলেন।

আমার চোখে ভাসছিল, আমরা চলে আসবার সময় অবনীমোহন চন্দ্রের গম্ভীর ও উদ্বিগ্ন মুখ। এটা স্পষ্ট, তার এজেন্টরা আসলে কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবেই কাজ করেন। অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে রিপ্রেজেন্টেটিভ। কিন্তু বিদেশি অনেক কোম্পানির মতো চন্দ্র জুয়েলার্স এজেন্ট শব্দটাই ব্যবহার করেন। তা ছাড়া, তারা চোরাই জুয়েলারিও কেনেন। কনকপুরে রায়বাড়ির গৃহদেবী মহালক্ষ্মীর রত্নখচিত সোনার মুকুট আর জড়োয়া নেকলেস যে-ই চুরি করুক, সুদর্শনবাবুর সঙ্গে চন্দ্র জুয়েলার্সের কোনো এজেন্ট গোপনে যোগাযোগ করেছে, নাকি সুদর্শনবাবু নিজেই সবার অগোচরে চন্দ্র জুয়েলারি কোম্পানির এজেন্ট? অমন ধোপদুরস্ত পোশাক-আশাক আর চেহারা দেখে মনে হয় না তিনি জমিজমা সম্পত্তির দেখাশোনা করেন। চাষবাস-পুকুর-বাগান নিয়ে যাঁরা থাকেন, তাদের চেহারায় রুক্ষ ছাপ পড়তে বাধ্য।

উত্তেজনায় আমার ভাত-ঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল। কথাটা কর্নেলকে বলার জন্য উঠে বসলুম। সেই সময় টেলিফোন বাজল।

কর্নেল হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। …হ্যাঁ। বলছি।… বলুন মিঃ চন্দ্র! …এক মিনিট! আমি লিখে নিচ্ছি। কর্নেল টেবিল থেকে ছোট্ট প্যাড আর ডটপেন নিয়ে বললেন-বলুন। কে, কে, সেন! পুরো নাম বললে ভালো হয়। কাঞ্চনকুমার সেন। ঠিকানা? মানে ওঁর বাড়ির ঠিকানা…ঠিক আছে। এখন আপনি কোথায় আছেন?… মিঃ সেন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন কীভাবে?… বুঝেছি। ব্যবসার স্বার্থে এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগের একটা ব্যবস্থা করে রাখতেই হয়। …হ্যাঁ। আমি আছি। মিঃ সেনকে আমার কাছে পাঠাতে পারেন। তার সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে চাই। …না, না। আপনার আসবার দরকার হবে না। আপনি একটা চিঠি লিখে দেবেন ওঁকে। আপনার হাতের লেখা চিনতে অসুবিধে হবে না। …ঠিক আছে। রাখছি।

কর্নেল রিসিভার রেখে আমার দিকে ঘুরলেন। মুখে মিটিমিটি হাসি। উঠে গিয়ে তার কাছাকাছি সোফায় বসলুম। বললুম,–সব বুঝে গেছি। এখন শুধু কাঞ্চনকুমার সেন নামে চন্দ্র জুয়েলার্সের এজেন্টের প্রতীক্ষা। তবে শুধু একটা প্রশ্ন। এই ভদ্রলোকের ঠিকানা কী?

কর্নেল প্যাডটা দিলেন। দেখলুম, লেখা আছে ১৩-বি, রামপদ শেঠ লেন, কলকাতা ৭। বললুম,–কলকাতা ৭ কোন এলাকা?

–বড়বাজার। বলে কর্নেল হাত বাড়িয়ে টেবিলের কোনায় রাখা টেলিফোন গাইডের উপর থেকে একটা আকার ছোট কিন্তু মোটাসোটা বই টেনে নিলেন। লক্ষ করলুম, বইটার নাম কলকাতার পথ নির্দেশিকা। কর্নেল পাতা উল্টে খুঁজে দেখার পর বললেন,–গলিটা আপার চিৎপুর রোড থেকে শুরু হয়েছে। এটা অনেক পুরোনো স্ট্রিট গাইড। তা হোক। রামপদ শেঠ লেন খুঁজে বের করার অসুবিধে নেই। আপার চিৎপুর রোডে ঢুকলেই ~য়ে যাব।

অবাক হয়ে বললুম,–কাঞ্চনবাবু তো আসছেন। তার বাড়ি খুঁজতে যাওয়ার কথা বলছেন কেন?

কর্নেল গাইড বুকটা যথাস্থানে রেখে আস্তে বললেন,–দরকার হতেও পারে।

এই সময় ডোরবেল বাজল। কর্নেল অভ্যাসমতো হাঁক দিলেন,–ষষ্ঠী!

একটু পরে যিনি সবেগে ঘরে ঢুকলেন, তিনি কাঞ্চন সেন নন। আমাদের হালদারমশাই। তিনি সোফায় বসে বললেন,–সুদর্শনবাবুকে ফলো করছিলাম। উনি ট্যাক্সি ধরছিলেন। আমিও একখান ট্যাক্সি ধরলাম। উনি কইছিলেন শেয়ালদা স্টেশনে ট্রেন ধরবেন। কিন্তু উনি চললেন উল্টাদিকে। এক্কেরে ভবানীপুরে। বাড়িটার নাম…

কর্নেল বললেন,–মাতৃধাম?

অবাক হয়ে গোয়েন্দাপ্রবর বললেন,–আপনি জানলেন ক্যামনে?

কর্নেল হাসলেন। ওটা ওঁর মাসতুতো ভাই ঝন্টু অর্থাৎ আমার বন্ধু জয়কৃষ্ণ রায়চৌধুরির বাড়ি। বোঝা যাচ্ছে, আমার এখান থেকে বেরিয়ে সুদর্শনবাবু শেষপর্যন্ত আমার কথা মেনে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তো আপনি এখন সম্ভবত শেয়ালদা স্টেশন থেকে আসছেন?

হালদারমশাই শ্বাস ছেড়ে বললেন, “হুঁঃ!

–আপনার খাওয়াদাওয়া?

–স্টেশনের কাছে একটা হোটেলে খাইয়া লইলাম।

আবার ডোরবেল বাজল। কর্নেল ষষ্ঠীর উদ্দেশে হাঁক দেওয়ার পর আস্তে বললেন, –হালদারমশাই! সম্ভবত এমন কেউ আসছেন, যাঁর সঙ্গে শুধু আমিই কথা বলব। আপনারা দুজনে বরং ডিভানে বসে পত্র-পত্রিকা পড়ার ভান করুন।

হালদারমশাই ও আমি ডিভানে গিয়ে বসলুম। হালদারমশাই দেওয়ালে হেলান দিয়ে খবরের কাগজ খুলে পা ছড়িয়ে বসলেন। আমি একটা রঙিন পত্রিকা খুলে বসলুম। তারপর দেখলুম, একজন রোগাটে গড়নের টাই-স্যুট পরা ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। তার বাঁ-হাতে ব্রিফকেস। তিনি নমস্কার করে বললেন, আমি কে. কে. সেন। মিঃ এ. এম. চন্দ্রের কাছ থেকে আসছি। এই তার চিঠি।

কর্নেল চিঠিটা পড়ে দেখে বললেন,–দাঁড়িয়ে কেন? বসুন মিঃ সেন!

ইনিই তাহলে সেই এজেন্ট। সোফায় বসে তিনি মৃদুস্বরে বললেন,–গত শুক্রবার আমাকে একটা কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল। যে ভদ্রলোকের বাড়িতে ছিলুম, আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার বাড়িতেই আমার কার্ডটা কীভাবে দৈবাৎ পড়ে গিয়েছিল। পরদিন অর্থাৎ গতকাল শনিবার ফিরে গিয়ে তাকে ব্যাপারটা জানালুম। তিনি তন্নতন্ন খুঁজলেন। বাড়ির সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু কার্ডের খোঁজ মিলল না। সেই কার্ড আপনার হাতে কীভাবে এল?

কর্নেল বললেন,–যেভাবেই আসুক, আপনার কার্ড আপনি ফেরত পাবেন। কিন্তু আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন।

–বলুন!

–এই ধরনের সাধারণ কার্ডের বদলে কোম্পানি আপনাদের আইডেন্টিটি কার্ড দেয় না কেন?

–অসুবিধে আছে। কী ধরনের অসুবিধে, তা আপনি মিঃ চন্দ্রের কাছে জেনে নিতে পারেন। এজেন্টদের অনেকসময় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়।

–মিঃ চন্দ্রের কাছে জানবার দরকার মনে করছি না। তবে আমার ধারণা, চোরাই জুয়েলারি বেচা-কেনার ক্ষেত্রে এজেন্টদের ব্যক্তিগত পরিচয় গোপন রাখা উচিত। দৈবাৎ পুলিশ এজেন্টের আইডেন্টিটি কার্ড পেয়ে গেলেই বিপদ। তাতে এজেন্টের ছবি থাকে। কাজেই এই কার্ড নিরাপদ।

–ঠিক বলেছেন স্যার।

–এবার আমি জানতে চাই, আপনি শুক্রবার কোথায় গিয়েছিলেন এবং কার কাছে গিয়েছিলেন! মুখে বলার দরকার নেই। আপনি লিখে দিন। মিঃ চন্দ্রের খাতিরে একথা আমি গোপন রাখব।

কাঞ্চন সেনের মুখে উদ্বেগ ও অস্বস্তির ছাপ ফুটে উঠল। বললেন, কোম্পানির স্বার্থে এসব কথা আমাদের গোপন রাখতে হয়। প্লিজ স্যার, কার্ড ফিরে না পেলে আমাকে মিঃ চন্দ্র কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবেন। এ বাজারে এমন বেশি মাইনের চাকরি–তা ছাড়া, কমিশনেরও ব্যবস্থা আছে, এটা চলে গেলে বিপদে পড়ব।

আপনি কেন বা কী কাজে সেই ভদ্রলোকের কাছে গিয়েছিলেন, আমি তা জানতে চাইছি না। আপনাকে তো কথা দিচ্ছি, মিঃ চন্দ্র আমার খুব চেনাজানা মানুষ–তার খাতিরে আমি ওকথা গোপন রাখব। হা–আগে আপনাকে কার্ডটা দেখাই।–বলে কর্নেল বুকপকেট থেকে কার্ডটা বের করে দেখালেন।

কাঞ্চন সেন একটু ইতস্তত করে বললেন,–কার্ডটা আপনি কি কোথাও কুড়িয়ে পেয়েছেন স্যার?

-হ্যাঁ। কুড়িয়ে পেয়েছি।

–কোথায় বলুন তো স্যার?

–যদি বলি, আপনি যেখানে পাদুটো রেকেছেন, সেখানে?

কাঞ্চন সেন নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন,–এটা স্যার অসম্ভব ব্যাপার।

–কেন অসম্ভব? ধরুন, শুক্রবার আপনি যে ভদ্রলোকের কাছে গিয়েছিলেন, তিনি কোনো কারণে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন এবং দৈবাৎ পকেট থেকে কিছু বের করতে গিয়ে কার্ডটা পড়ে গিয়েছিল। তিনি চলে যাওয়ার পর আমি ওটা দেখতে পেয়ে কুড়িয়ে রেখেছি। তারপর মিঃ চন্দ্রের কাছে গিয়েছি।

কাঞ্চন সেন এবার চাপাস্বরে বললেন,–অসম্ভব ব্যাপার স্যার। জোর দিয়ে বলছি, এটা অসম্ভব। আমাকে যিনি গোপনে খবর দিয়ে যেতে বলেছিলেন, আপনার কাছে তার আসবার কথা নয়। মিঃ চন্দ্রের কাছে আপনার পরিচয় পেয়েছি স্যার!

–ঠিক আছে। আপনি সেই ভদ্রলোকের নাম-ঠিকানা এই কাগজে লিখে দিন। আপনার টেলিফোন নাম্বারও লিখবেন। আমি আজ রাত্রের মধ্যে আপনার কথার সত্যতা আমার বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে কোনো কৌশলে যাচাই করে নেব। আপনার কথা সত্য হলে আপনি কার্ড পাবেন। আমি আপনার টেলিফোনে আপনাকে খবর দেব।

কাঞ্চন সেন ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু ভেবে নিলেন। তারপর কর্নেলের দেওয়া কাগজে কিছু লিখে কর্নেলকে দিলেন। তারপর করুণ মুখে ভাঙা গলায় বললেন, স্যার! দয়া করে শুধু একটা কথা মনে রাখবেন। আমার প্রাণ এখন আপনার হাতে।

কথাটা বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল কাগজটা ভাঁজ করে বুকপকেটে ঢোকালেন। তারপর হালদারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে সকৌতুকে বললেন–আপনার কথা ঠিক হালদারমশাই! হেভি মিস্ত্রি।

কাঞ্চন সেন চলে যাওয়ার পর আমি ও হালদারমশাই কর্নেলের কাছে সেই নাম-ঠিকানা জানতে চেয়েছিলুম। কিন্তু কর্নেল গম্ভীর মুখে বলেছিলেন,–ভদ্রলোককে কথা দিয়েছি এটা গোপন থাকবে। কাজেই এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নয়।

হালদারমশাই বলেছিলেন–আপনিও কইলেন হেভি মিস্ট্রি। তা হইলে এবার আমি কী করুম কন কর্নেলস্যার!

এ কথা শুনে কর্নেলের গাম্ভীর্য চিড় খেয়েছিল। সহাস্যে বলেছিলেন, আমার মতো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ঠিক হবে না হালদারমশাই! অবশ্য বনের মোষ তাড়াতে গিয়ে দুর্লভ প্রজাতির পাখি, প্রজাপতি বা অর্কিডের খোঁজ পেলে আমার বরং লাভই হয়। তো আপনার সাহায্য নিশ্চয় আমার দরকার। এক মিনিট।

বলে তিনি টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করেছিলেন। তারপর সাড়া পেয়ে বলেছিলেন–মিঃ রায়চৌধুরি? কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। …হ্যাঁ। সুদর্শনবাবু এসেছিলেন। ফেরার সময় আপনার সঙ্গে দেখা করেও গেছেন। …না। উনি আমাকে বলেননি। তবে আমার হাতে সে-খবরও আছে। বলে কর্নেল হেসে উঠলেন। তারপর বললেন,–যথাসময়ে বলব। এখন একটা জরুরি কাজের কথা বলতে চাই। আপনি তো বুঝতেই পারছেন, আমার বয়স থেমে নেই। এই বৃদ্ধ বয়সে আগের মতো একা কোনো কাজে নামতে ভরসা পাই না। আমাকে সাহায্য করেন একজন ধুরন্ধর ডিটেকটিভ। তিনি প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। রিটায়ার করার পর প্রাইভেট ডিটেকটিভ। এজেন্সি খুলেছেন। তাঁর নাম মিঃ কে. কে. হালদার। …তা হলে সুদর্শনবাবু তার কথা আপনাকে বলেছেন? এবার শুনুন। সুদর্শনবাবুকে তখনই যে-কথা বলা দরকার ছিল, বলিনি। কিন্তু ইতিমধ্যে কিছু তথ্য আমার হাতে এসে গেছে। তাতে মনে হচ্ছে, কেসটা জটিল।…বললুম তো! যথাসময়ে জানতে পারবেন। আপনাকে আমি একটা অনুরোধ করছি। সুদর্শনবাবুকে ট্রাঙ্ককলে জানিয়ে দিন, কাল সোমবার যে-কোনো সময়ে মিঃ হালদার তার সঙ্গে দেখা করবেন। মিঃ হালদারের ডিটেকটিভ এজেন্সির কনট্র্যাক্ট ফর্মে তাকে একটা সই করতে হবে। এই ফর্মালিটিজ উভয়ের স্বার্থেই মেনে চলা দরকার। তবে চুক্তিপত্রে সইয়ের ব্যাপারটা গোপনে হওয়া উচিত। ঘুণাক্ষরে কেউ যেন টের না পায়। চুক্তিপত্রে সই করলে সুদর্শনবাবু হবেন মিঃ হালদারের ক্লায়েন্ট। …হ্যাঁ, টাকার প্রশ্ন আছে। তবে টাকার অঙ্ক যাই হোক, সুদর্শনবাবু যেন সই করতে দ্বিধা না করেন। তবে নেহাৎ অ্যাডভান্স হিসেবে আপাতত একশো টাকা না দিলে মিঃ হালদারের অসুবিধে হবে।..হা। তা হলে আপনি বরং একটা চিঠি লিখে দেবেন মিঃ হালদারকে। এখনই আপনার কাছে মিঃ হালদারকে পাঠাচ্ছি। তবে আপনি ট্রাঙ্ককলে সুদর্শনবাবুকে শুধু জানিয়ে রাখবেন, তার পরিচিত এক ভদ্রলোক আমার পক্ষ থেকে তার কাছে যাবেন। ব্যস!… ধন্যবাদ মিঃ রায়চৌধুরি। মিঃ হালদার তাঁর সরকারি আইডেন্টিটি কার্ড নিয়েই আপনার কাছে যাচ্ছেন।…ঠিক আছে। রাখছি।…

ইতিমধ্যে ষষ্ঠীচরণ কফি এনেছিল। কফি পানের পর হালদারমশাই যথেষ্ট চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলেন। কর্নেল বলেছিলেন,–মিঃ জয়কৃষ্ণ রায়চৌধুরির বাড়ি আপনি ভবানীপুরে দেখে এসেছেন।

হঃ। দেখছি। বলে গোয়েন্দাপ্রবর সবেগে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।

কর্নেল বলেছিলেন,–একটা কথা হালদারমশাই!

-–কন কর্নেলস্যার!

–আপনার আর আমার কাছে আসবার দরকার নেই। মিঃ রায়চৌধুরির সঙ্গে দেখা করার পর বাড়ি ফিরে আমাকে টেলিফোনে শুধু জানিয়ে দেবেন, কনকপুরে কাল কোন ট্রেনে যাচ্ছেন। কীভাবে যেতে হবে, তা মিঃ রায়চৌধুরির কাছে জানতে পারবেন। কনকপুরে হোটেল থাকা সম্ভব। না থাকলে সুদর্শনবাবুর বন্ধু হিসেবে রায়বাড়িতে থাকতে পারবেন। আমরা দুজনে উঠব সেচদফতরের বাংলোতে। দরকার হলে গোপনে সেখানে যোগাযোগ করবেন। কিন্তু সাবধান হালদারমশাই! কনকপুরে আমরা আপনার অপরিচিত। এই কথাটা সবসময় মনে রাখবেন। বুঝলেন তো?

–বুঝেছি কর্নেলস্যার।

বলে প্রাইভেট ডিটেকটিভ পর্দা ফুঁড়ে উধাও হয়ে গেলেন।

.

বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ হালদারমশাইয়ের ফোন এল। জয়কৃষ্ণ রায়চৌধুরি তাঁকে সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটের ট্রেনে কনকপুর যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। কনকপুর স্টেশন থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে। সাইকেলরিকশা, বাস, অটো সবই পাওয়া যায়।

কর্নেল সেচদফতরের এক কর্তাব্যক্তির বাড়িতে টেলিফোন করে কনকপুর ইরিগেশন বাংলোয় থাকার ব্যবস্থা করে নিলেন।

পাঁচটায় দ্বিতীয় দফার কফি দিয়ে গেল ষষ্ঠীচরণ। তখন আলো জ্বলে উঠেছে। শীত না পড়লেও ততক্ষণে সন্ধ্যার আমেজ এসে গেছে। কফি খেতে-খেতে বললুম,–আচ্ছা কর্নেল, আপনি কাঞ্চন সেনের কথার সত্যতা যাচাই করবেন বলছিলেন। কীভাবে করবেন?

কর্নেল হাসলেন।–করব না।

–সে কী! তা হলে ভদ্রলোককে কার্ডটা তখনই ফেরত দিলেই পারতেন।

–জয়ন্ত! কাঞ্চন সেন আমাকে মিথ্যা ঠিকানা দিলে আমার শর্ত শোনার পর দ্বিধায় পড়ে যেতেন। ওঁর মুখে কোনো দ্বিধার চিহ্ন দেখতে পাইনি। তা ছাড়া, উনি ওঁর মালিকের কাছে আমার পরিচয় পেয়েছেন। আমার সঙ্গে ছলচাতুরির সাহস ওঁর নেই।

–কী আশ্চর্য! তা হলে কার্ডটা…

আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন,–তবু আমি রিস্ক নিতে চাইনি। যেন সত্যিই আমি ওঁর দেওয়া নাম-ঠিকানার সত্যতা যাচাই করব, এ জন্য আমার সময় দরকার–এই কৌশলটুকু এক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেই হয়েছে।

একটু ইতস্তত করে বললুম–কাঞ্চন সেন সুদর্শনবাবুর নাম-ঠিকানা দেননি এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন,–তোমার নিশ্চিত হওয়ার কারণ?

–কার্ড রাখার কথা পকেটে। ব্যাগের ভিতরে কেউ কার্ড রাখে না।

–কিন্তু সুদর্শনবাবুর ব্যাগ থেকেই কার্ডটা নীচে পড়েছিল।

–কনকপুর গিয়ে সুদর্শনবাবুকে জিজ্ঞেস করা উচিত।

–চেপে যাও জয়ন্ত! এর পর সুদর্শনবাবুর সঙ্গে দেখা হলে যেন কখনও কার্ডের কথা তুলবে না।

–হালদারমশাইকে নিষেধ করেননি। কিন্তু উনি যদি জিগ্যেস করেন?

–হঠকারী হলেও হালদারমশাই বুদ্ধিমান। বিচক্ষণ পুলিশ অফিসার ছিলেন। তুমি ওঁকে নিয়ে যতই কৌতুক করো, নিজের কাজে উনি যথেষ্ট সিরিয়াস।

বলে কর্নেল ড্রয়ার থেকে প্রজাপতির রঙিন ছবির খাম বের করলেন। সকালে এই ছবিগুলো আমাদের তিনি দেখাচ্ছিলেন। বক্তৃতা শোনার ভয়ে আমি সটান বাথরুমে গেলুম। তারপর ফিরে আসার সময় একটা বুকশেলফের উপর অগোছালো অবস্থায় পড়ে থাকা কয়েকটা বই খুঁজে অবিশ্বাস্যভাবে একটা মলাটছেঁড়া ইংরেজি গোয়েন্দা উপন্যাস পেয়ে গেলুম।

কিন্তু কর্নেল নিজের কাজে ব্যস্ত। একেকটা ছবি টেবিলল্যাম্পের আলোয় রেখে আতশকাঁচ দিয়ে কী দেখে-টেখে একটা প্যাড়ে কী সব লিখে চলেছেন। বুঝলুম, এর পর সময়মতো একটা প্রবন্ধ লিখে ছবিগুলো সঙ্গে দিয়ে কোনো বিদেশি পত্রিকায় পাঠাবেন। শুনেছি, তার এসব প্রবন্ধের বাজারদর কমপক্ষে একশো মার্কিন ডলার।

রাত নটার মধ্যে তার কাজ শেষ হল। তারপর ছবি ও কাগজপত্র গুছিয়ে ড্রয়ারে ভরার পর তিনি চুরুট ধরালেন। ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুরুট টানার পর হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন এবং টেলিফোনটা কাছে টেনে আনলেন। বুকপকেট থেকে ভাজকরা একটা কাগজ খুলে দেখে রিসিভার তুলে কর্নেল ডায়াল করতে থাকলেন।

বুঝলুম, এনগেজড টোন। কর্নেল কয়েকবার ডায়াল করার পর বিরক্ত হয়ে রিসিভার রেখে দিলেন। বললুম,–সম্ভবত কাঞ্চন সেনকে ফোনে পাচ্ছেন না।

কর্নেল ঘুরে আমার দিকে তাকালেন। তুম্বো মুখে বললেন, আমার হাতে ব্যথা ধরে গেছে জয়ন্ত! এখানে এসো। এই নাম্বারটা ধরে দাও।

তাঁর কাছাকাছি সোফায় বসে তার নির্দেশমতো একটা নাম্বার ডায়াল করলুম। এনগেজড। মিনিট তিনেক পরে আবার ডায়াল করলুম। এনগেজড। তৃতীয়বার চেষ্টার পর বললুম–টেলিফোনটা খারাপ।

কর্নেল এবার নিজে রিসিভার তুলে একটা নাম্বার ডায়াল করলেন। সাড়া এলে বললেন,–মিঃ এ. এম. চন্দ্রের সঙ্গে কথা বলতে চাই।…আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।…মিঃ চন্দ্র! আপনার কোম্পানির এজেন্ট কাঞ্চন সেন…ও মাই গড! বলেন কী? কখন?…জাস্ট আ মিনিট মিঃ চন্দ্র। পুলিশকে কি আপনি তার কার্ড সম্পর্কে কিছু বলেছেন?…আপনি বুদ্ধিমান। …ও. কে.! ও. কে.! আমি দেখছি।..হ্যাঁ। আমি ওঁর বাড়িতে এখনই যাচ্ছি। …হ্যাঁ। পুলিশকে জানিয়েই যাচ্ছি।… আপনি ভাববেন না। কার্ড আপনি যথাসময়ে ফেরত পাবেন। রাখছি।

হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। বললুম,–কাঞ্চন সেনের কী হয়েছে?

কর্নেল ডায়াল করতে-করতে বললেন,–কাঞ্চনবাবুকে কেউ তার ঘরে গুলি করে মেরেছে।

তারপর তিনি টেলিফোনে সাড়া পেয়ে বললেন,–কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি! ও. সি. হোমিসাইড মিঃ সান্যালের সঙ্গে কথা বলতে চাই। … বেরিয়েছেন? ঠিক আছে।

টেলিফোন ছেড়ে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,–জয়ন্ত! রেডি হয়ে নাও। কুইক! আমি পোশাক বদলে নিয়ে আসছি।

কিছুক্ষণ পরে আমরা নীচে গেলুম। তারপর গাড়িতে চেপে বললুম,–কনকপুরের রায়বাড়ির অদ্ভুত কেসে হাত দিতে না দিতেই একটা বডি পড়ে গেল!

কর্নেল আমার কথা কানে নিলেন বলে মনে হল না। বললেন,–পার্ক স্ট্রিট হয়ে ডাইনে ঘুরে গিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ হয়ে চলো। তারপর হ্যারিসন রোডসরি, পুরোনো নামটা মাথায় গেঁথে আছে–

–বুঝেছি। মহাত্মা গান্ধী রোডে পৌঁছে চিৎপুরের দিকে এগোব। তবে ওই এলাকায় রবিবারে বলে কিছু নেই। জ্যামে পড়তেই হবে।

কর্নেল কোনো কথা বললেন না। আপার চিৎপুর রোড এখন রবীন্দ্র সরণি। কর্নেল নাম্বার লক্ষ করছিলেন। সংকীর্ণ রাস্তায় ট্রাম বাস ট্রাক ঠেলাগাড়ি রিকশার ভিড়। কর্নেল রাস্তায় একটা লোককে রামপদ শেঠ লেনের কথা জিজ্ঞেস করলে সে সামনের দিকে তর্জনী তুলল। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে গলিটার মোড়ে পৌঁছলুম। গলির ভিতরে ল্যাম্পপোস্টের টিমটিমে আলো। কিন্তু পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে প্রাণপণে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করছে। আমার গাড়িতে ‘প্রেস’ স্টিকার লাগানো দেখে একজন কনস্টেবল বাঁ-দিকের এক চিলতে ফুটপাতের উপর গাড়ি দাঁড় করাতে বলল। বা-দিকে দুটো চাকা সেই ফুটপাতে ওঠালুম। কর্নেল নেমে গিয়ে বললেন,–গাড়ি লক করে এসো! একজন চেনা পুলিশ অফিসারকে দেখতে পাচ্ছি।

পুলিশের একটা বেতার ভ্যান আর দুটো জিপ ডানদিকে একটা ছ’তলা বাড়ির সামনে দাঁড় করানো ছিল। কর্নেলকে দেখে সেই পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে নমস্কার করলেন। তারপর একটু হেসে বললেন, স্যার! আপনি এখানে?

–প্রণব! তোমাদের বড়বাবু আর লালবাজারের ও. সি. হোমিসাইড কোথায়?

-–ওঁরা একটু আগে চলে গেছেন স্যার!

–ভিকটিমের বডি?

–আধঘণ্টা আগে মর্গে পাঠানো হয়েছে।

-–আমি ভিকটিমের ফ্ল্যাটটা দেখতে চাই। লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের কেউ আসেননি?

প্রণববাবু কথা বলতে-বলতে সিঁড়িতে উঠছিলেন। বললেন,–ডি. ডি. থেকে এস. আই. নরেশবাবু আর দুজন অফিসার এসেছেন। ভিকটিম বিখ্যাত জুয়েলারি কোম্পানির কর্মচারী। কাজেই কর্নেলসায়েবের আবির্ভাবে আমি অবাক হইনি। নরেশবাবুরাও হবেন না!

বললুম–ছ’তলা বাড়ি। লিফট নেই?

–প্রাচীন আমলের বাড়ি। তবে ভিকটিম ভদ্রলোক থাকতেন তিনতলার একটা ঘরে। ফ্ল্যাটবাড়ি বলা যায় না। তবে অ্যাটাচড বাথরুম আছে।

তিনতলার টানা বারান্দা দিয়ে এগিয়ে যেতেই নরেশ ধরকে দেখতে পেলুম। তিনি কর্নেলকে দেখে বললেন,–, যা ভেবেছিলুম। চন্দ্ৰসায়েবের একটা কেসে স্বনামধন্য কর্নেলসায়েব লড়েছিলেন। অতএব এই কেসে তাঁকে দেখতে পাব, এটা স্বাভাবিক।

কর্নেল হাসলেন। আশা করি অরিজিতের কানেও খবরটা মিঃ চন্দ্র তুলেছেন?

–ডি. সি. ডি. ডি. সায়েবের তাড়া খেয়েই আমাদের ছুটে আসতে হয়েছে। উনি আপনাকেও নিশ্চয় একটু উঁকি মারতে বলেছেন?

–না নরেশবাবু। অরিজিৎ লাহিড়ি এই বৃদ্ধের দাড়ি ধরে টানেননি। যাকগে। চলুন। ঘরটা একটু দেখে নিই।

নরেশবাবুর পিছনে কর্নেল ও আমি মোটামুটি চওড়া ঘুরে ঢুলুম। দুজন অফিসার ঘরের ভিতর কিছু করছিলেন। আমাদের দেখে তারা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। নরেশবাবু বললেন–ওহে

আলম! এঁকে চিনতে পারছ কি?

একজন অফিসার কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন-আমার সৌভাগ্য! কর্নেলসায়েবের সঙ্গে আলাপের সুযোগ পেলুম।

অন্যজন নমস্কার করে বললেন,–কর্নেলসায়েব আমাকে হয়তো চিনতে পারবেন। আমি মানিক দত্ত। এন্টালি থানায় ছিলুম।

কর্নেল ঘরের ভিতর চোখ বুলিয়ে বললেন,–কাঞ্চনবাবু একা থাকতেন?

নরেশবাবু বললেন, হ্যাঁ। কথায় বলে, একা না বোকা!

কর্নেল ডানদিকে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,–মার্ডার এখানেই হয়েছে। নরেশবাবু! বডি কী অবস্থায় ছিল?

–বাথরুমের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়েছিলেন ভদ্রলোক। পা-দুটো বাথরুমের দরজার বাইরে। মাথার পিছনে প্রায় পয়েন্টব্ল্যাংক রেঞ্জে গুলি করেছে খুনি।

–পাশের ঘরের কেউ গুলির শব্দ শোনেনি?

–পাশের দুটো ঘরে দুজন করে চারজন থাকেন। ও দুটো ঘরকে মেস বলা যায়। চারজনই বাঙালি। হুগলি, হাওড়া, বর্ধমানে বাড়ি। বিভিন্ন দোকানের কর্মচারী ওঁরা। শনিবার বিকেলে বাড়ি চলে যান। ফেরেন সোমবার সকালে। তার ওপাশে সিঁড়ি। তারপর চারটে ঘরে এক মারোয়াড়ি ফ্যামিলি থাকেন। কাঞ্চনবাবুর ঘরে সকাল-সন্ধ্যা লোজন আসতে দেখেছেন ওঁরা। আর গুলির শব্দ শুনতে পাওয়া এই এলাকায় আজ রোববারেও সম্ভব নয়, তা নিজেই বুঝে নিন। মোটরসাইকেলের শব্দ তো সব সময়। তার ওপর নীচের তলায় একটা লোহালক্কড়ের দোকান। রোববারেও লোহার পাত কাটার শব্দ শুনছিলুম। বিরক্ত হয়ে বন্ধ করতে বলেছি।

কর্নেল কোণের দিকে খাটের পাশে টেবিলে একজন মহিলার ছবি দেখে বললেন,–কাঞ্চনবাবুর স্ত্রী সম্ভবত।

নরেশবাবু বললেন,–হ্যাঁ, সম্ভবত। কাঞ্চনবাবুর দেশের বাড়ির ঠিকানায় খোঁজ নিলে জানা যাবে।

–দেশের বাড়ির ঠিকানা পেয়েছেন তা হলে?

–একটা চিঠি থেকে পাওয়া গেছে। কাঞ্চনবাবুর দাদা প্রাণকান্তবাবুর চিঠি। ভাইকে পুজোর সময় বাড়ি যেতে লিখেছেন। টাকাকড়িও চেয়েছেন।

-–ঠিকানাটা দিতে আপত্তি আছে?

নরেশবাবু হাসলেন।–কক্ষনও না। ডি. সি. ডি. ডি. সায়েব শুনলে আমার চাকরি যাবে। লিখে নেবেন কি?

কর্নেল পকেট থেকে খুদে নোটবই আর জুটপেন বের করলেন।–বলুন।

–গ্রাম রানিপুর, পোস্ট অফিস কনকপুর, জেলা নদিয়া।

কনকপুর শুনে আমি চমকে উঠেছিলুম। কর্নেল নির্বিকারমুখে নাম-ঠিকানা লিখে বললেন, –ছোট একটা সোফাসেট আছে দেখছি। সেন্টার টেবিলে দুটো চায়ের কাপ। চা শেষ করে কাঞ্চনবাবু বাথরুমে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। সেই সময় তাঁর গেস্ট তাকে গুলি করেছে। তো ডেডবডি প্রথম কে দেখেছিল?

নরেশবাবু বললেন,–মারোয়াড়ি ফ্যামিলির একটা বাচ্চা ওদের বারান্দায় খেলনা ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে খেলছিল। তার দিদি সিঁড়ির মাথা থেকে বল ছুড়ছিল। তারপর বলটা এই ঘরের বারান্দায় এসে পড়েছিল। কিন্তু এখানে বারান্দায় তখন আলো ছিল না। তাই ওরা এখানে আসতে ভয় পাচ্ছিল। তখন মেয়েটির দাদা মোহনলাল বল কুড়াতে আসে। দরজা অর্ধেক খোলা। অথচ ভিতরে অন্ধকার। তার সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক।

কর্নেল টেলিফোন দেখিয়ে বললেন,–ওটা কি ডেড?

নরেশবাবু টেবিলের পিছন থেকে ছেঁড়া তার তুলে দেখলেন।–খুব হুঁশিয়ার খুনি। ঘরের আলোও নিভিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু দরজার কপাট পুরো লাগানোর হয়তো সময় পায়নি।

কর্নেল সোফার কাছে হাঁটু মুড়ে বসে টর্চ জ্বাললেন। তারপর আতশকাঁচ দিয়ে কিছুক্ষণ কী সব পরীক্ষা করলেন, তিনিই জানেন। নরেশবাবু মুচকি হেসে বললেন,–ফরেন্সিক এক্সপার্টদের জন্য অপেক্ষা করছি। দেখা যাক, তার আগে কর্নেলসায়েবের শ্যেনচক্ষুতে খুনির কোনো ক্ল মেলে কি না।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–ধনবান রত্নব্যবসায়ীর কর্মচারী। কাজেই ফরেন্সিক এক্সপার্টরা আসবেন বইকি। আমি নিছক হাতুড়ে এসব ব্যাপারে।

–হাতের তাস আপনি দেখাবেন না। তা জানি!

কর্নেল হাসলেন।–দেখলুম, লোকটার কাপ থেকে একটুখানি চা পড়ে গিয়েছিল। খুব গরম চা ফুঁ দিয়ে খেতে গেলে এমনটা হতেই পারে। আসলে সে শিগগির চা খেয়ে নিয়ে হাতের কাজ শেষ করতে চেয়েছিল।

নরেশবাবু বললেন,–কাঞ্চনবাবু নিজেই চা তৈরি করে খেতেন। কেরোসিন কুকার আর চায়ের সরঞ্জাম দেখেই তা বোঝা যায়। খেতেন হোটেলে। কারণ চাল-ডাল বা রান্নার পাত্র দেখছি না।

কর্নেল ঘরের ভিতর আবার একবার ঘুরে দেখে নিয়ে বললেন,নরেশবাবু! কেউ কাঞ্চন সেনের ঘর থেকে কিছু নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে খুন করেনি। সে কাঞ্চনবাবুকে খুন করতেই এসেছিল। আর-একটা কথা। সে এই কাজের জন্য রবিবার সন্ধ্যাটা বেছে নিয়েছিল। খুনের নিরাপদ জায়গা কাঞ্চনবাবুর এই ঘর, তা সে বুঝতে পেরেছিল।

–আপনি কি বলতে চান, খুনি আগে থেকে টেলিফোনে কাঞ্চনবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেই এসেছিল?

–তা আর বলতে? আচ্ছা, চলি নরেশবাবু! বলে কর্নেল ঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুত হাঁটতে থাকলেন। তাকে অনুসরণ করতে আমার অবস্থা শোচনীয় বললে ভুল হয় না।…

.

সে-রাত্রে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফেরার পর তাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, কাঞ্চন সেনকে কারও খুন করার মোটিভ কি থাকতে পারে? আমার ধারণা, কেউ কোনো বিষয়ে তার মুখ চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। তাই না?

কর্নেলকে বড় বেশি গম্ভীর দেখাচ্ছিল। তিনি বলেছিলেন, আমি অন্তর্যামী নই, জয়ন্ত!

–কী আশ্চর্য, আপনি যেন কোনো কারণে বেজায় চটে গেছেন! খুনির প্রতি, নাকি আমার প্রতি?

আমি কৌতুকের মেজাজেই বলেছিলুম কথাটা। লক্ষ করেছিলুম, কর্নেলের স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকের মেজাজও নেই। তিনি বলেছিলেন,জয়ন্ত! আমি নিজের প্রতি নিজেই চটে গেছি।

–সে কি!

–একচক্ষু হরিণের গল্পটা নিশ্চয় তুমি জানো! আমি হঠাৎ কী করে একচক্ষু হরিণ হয়ে গিয়েছিলুম বুঝতে পারছি না।

–একটু খুলে বলবেন কি?

–খিদে পেয়েছে। ষষ্ঠী! এগারোটা বাজতে চলল! খেয়াল আছে?

ষষ্ঠী পর্দার পিছনেই ছিল। উঁকি মেরে বলল,–আপনি বসে-বসে চুরুট খাচ্ছেন বাবামশাই! আপনিই বলেন, চুরুট খাওয়ার সময় আমি যেন আপনাকে ডিসটাপ না করি।

কর্নেল তখনই চুরুট অ্যাশট্রেতে ঘষে নিভিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।–চুপ হতভাগা! খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেলে এবার থেকে ডিসটাপ করবি। উঠে পড়ো জয়ন্ত! নাকি তোমাকে ডিসটাপ করে ফেললুম?

এবার স্বাভাবিক আবহাওয়া ফিরে এসেছিল। বলেছিলুম,–ষষ্ঠীকে আপনি বাংলা পড়িয়েছেন। ইংরেজিও নাকি পড়াতে চান। তার আগে ওর ডিসটাপ-টা শুধরে দেবেন।

–তোমাকে ওই দায়িত্বটা দিলুম। বলে কর্নেল বাথরুমে ঢুকেছিলেন।

সে-রাতে বিছানায় শুয়ে কাঞ্চন সেনের হত্যাকাণ্ডে কর্নেলের নিজের প্রতি চটে যাওয়া এবং নিজেকে একচক্ষু হরিণ বলার কারণ খুঁজতে নাকাল হয়েছিলুম। শুধু এটুকু বোঝা যায়, কাঞ্চন সেনকে কেউ খুন করতে পারে, কর্নেল নিশ্চয় তা ভাবেননি। কিন্তু কাঞ্চন সেন খুন হওয়ার পর তাঁর হয়তো মনে হয়েছে, এরকম একটা শোচনীয় সম্ভাবনার কথা তার মাথায় এলেও যে-কোনো কারণে হোক, সেটা তিনি তখন গ্রাহ্য করেননি। পরে তাই তার অনুশোচনা হয়েছে।

কর্নেল তার অ্যাপার্টমেন্টে আমার রাত্রিবাসের সময় একবার বলেছিলেন,–ডার্লিং! ইংরেজিতে একটা প্রবচন আছে, তার মোদ্দা মানেটা হল : রাত্রিকালে যে-সব চিন্তাভাবনা আসে, সেগুলোর বিরুদ্ধে সতর্ক থেকো “Beware of the thoughts, come in night।” সতর্ক না থাকলে অনিদ্রার রোগে ভুগবে।

লাইনটা মনে পড়ে গেলে সতর্ক হয়েছিলুম বটে, কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ নয়। সকাল থেকে রাত্রি–পুরো একটা রবিবার ঘটনার পর ঘটনার ধাক্কায় এ যাবৎ অসংখ্যবার বিপর্যস্ত হয়েছি। এটা নতুন কিছু নয়। তবু শুধু মনে ভেসে উঠছিল, কাঞ্চন সেনের করুণ মুখে বলা শেষ কথাটা : স্যার! দয়া করে শুধু একটা কথা মনে রাখবেন। আমার প্রাণ এখন আপনার হাতে।

কর্নেলের একসময় একটা লালরঙের ল্যান্ডরোভার গাড়ি ছিল। গাড়িটা কবে বেচে দিয়েছেন। কিন্তু গ্যারেজটা কাউকে ভাড়া না দিয়ে খালি রেখেছেন। আমার ফিয়াট গাড়িটা সেখানেই রাত্রিযাপন করে। গ্যারেজের চাবি ষষ্ঠীর জিম্মায় থাকে।

পরদিন সকাল নটায় ব্রেকফাস্টের পর কর্নেল বললেন, তুমি তোমার সল্টলেকের ফ্ল্যাটে গিয়ে সোয়েটার-জ্যাকেট-টুপি-মাফলার এইসব গরম পোশাক-আশাক নিয়ে এসো। তোমার লাইসেন্সড আর্মস সঙ্গে থাকা দরকার। তোমার গাড়িতেই ফিরে আসব। গাড়িটা আমার গ্যারেজ থাকবে। ট্যাক্সির ওপর ভরসা করা ঠিক হবে না…..

শেয়ালদা স্টেশনে এগারোটা পঁচিশের ট্রেনে তত বেশি ভিড় ছিল না। কর্নেলের সেই চিরাচরিত ট্যুরিস্টের বেশ। পরনে জ্যাকেট, পায়ে হান্টিং বুটজুতো। গলা থেকে ঝুলন্ত ক্যামেরা আর বাইনোকুলার পিঠে সাঁটা সেই কালো কিটব্যাগ, যেটার মাথার দিকে প্রজাপতিধরা জালের হাতল বেরিয়ে তার বাঁ-কাঁধের ওপর দিয়ে বেখাপ্পা খুদে ছড়ির মতো দেখাচ্ছিল। আর-একটা ব্যাগ তার পোশাক-আশাক ইত্যাদিতে ঠাসা। লক্ষ করছিলুম, যাত্রীরা তাকে লক্ষবস্তু করে ফেলেছে। এটা অবশ্য সবখানেই দেখে আসছি।

একটা নাগাদ কনকপুর স্টেশনে নেমে দেখলুম, পিছনের চত্বরে বাস, সাইকেলরিকশার ভিড়। এক্কা ঘোড়ার গাড়িও চোখে পড়ল। ছোট্ট একটা বাজার আছে। কর্নেল বললেন,–জয়ন্ত! আমাদের পক্ষে একাগাড়িই ভালো। সাইকেলরিকশায় ঠাসাঠাসি হবে। তা ছাড়া, লক্ষ করো, বেচারা এক্কাওয়ালারা যাত্রী পাচ্ছে না। ক্রমশ গ্রামাঞ্চলের মানুষ নেহাৎ দায়ে না ঠেকলে সেকেলে যানবাহনের প্রতি অবহেলা দেখাতে শুরু করেছে।

ট্রেনে আসবার সময় শীতের হিম টের পাচ্ছিলুম। চত্বরে নেমে রোদ্দুর আরাম দিল। তারপর যা হয়, বিদেশি ট্যুরিস্ট ভেবে সাইকেলরিকশাওয়ালারা ঘিরে ধরেছিল। কর্নেল সোজা গিয়ে একটা এক্কাগাড়িতে উঠে বসলেন। বিহার অঞ্চলে কর্নেলের সঙ্গে একাগাড়িতে চাপার অভিজ্ঞতা আমার আছে। ঘোড়াটার পাঁজরের হাড় গোনা যায়। কিন্তু এক্কাওয়ালা মহানন্দে তাকে পক্ষিরাজে রূপান্তরিত করতে চাইছিল। কর্নেল তাকে বললেন,–তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। ইরিগেশন বাংলোয় যেতে কনকপুরের বাইরে দিয়ে একটা রাস্তা আছে শুনেছি। সেই রাস্তায় চলো।

এক্কাওয়ালা কর্নেলের মুখে বাংলা কথা শোনার আশা করেনি। সে একবার ঘুরে কর্নেলকে দেখে নিয়ে বলল,–সায়েবরা কি বলকাতা থেকে আসছেন সার?

–হ্যাঁ। তোমার নাম কী?

–আমার নাম মকবুল সার।

–কনকপুরের লোক তুমি?

–না সার! ডুবো জায়গায় বাড়ি ছিল। বানবন্যায় নাকাল হয়ে ইস্টিশানের কাছে বসত করেছি।

–ডুবো জায়গাটা কোথায়?

–পাঁচখালি। এখান থেকে অনেকটা দূর। খালবিল নদীনালা আর জঙ্গল। গরমেন বাঁধ বেঁধেছিল। বাঁধ বারবার ভেঙে যায়। কনটেকটারবাবু টাকা লুঠেপুটে খায়। বেশি কী বলব সার?

–লোকজনের বসতি নেই ওই অঞ্চলে?

–তা আছে সার! বেদে আছে। সাঁওতাল আছে। আমার মতো কত গরিব-গুরবোও আছে।

-–আচ্ছা, ওদিকে শুনেছি বেতের জঙ্গল ছিল একসময়। বেতের আসবাবপত্র নাকি কলকাতায় চালান যেত?

–এখনও আছে! কালুখালিতে কয়েকঘর ডোম আছে। তারাই বেতের কাজ করে।

–মকবুল! তুমি তো একসময় ওই এলাকায় ছিলে। কালুখালিতে দশরথ নামে একটা লোক ছিল জানো?

মকবুল হাসল।–সায়েবরা তা হলে আগে এসেছেন এ তল্লাটে?

–হ্যাঁ। আমার এক শিকারি বন্ধুর সঙ্গে এসেছিলুম। উনি দশরথকে আমার জন্য একটা বেতের চেয়ার তৈরি করে দিতে বলেছিলেন। লোকটার হাতের কাজ খুব সুন্দর!

–দশরথ এখন বুড়ো হয়ে গেছে। তা হলেও তার হাতের কাজ খুব পাকা।

–ওহে মকবুল! আমার মনে হচ্ছে, ডাইনের রাস্তায় যেতে হবে।

–সার! দুধারে জঙ্গল। কাঁচা রাস্তায় ঘোড়াটার কষ্টও হবে।

-–ঠিক আছে। একটু আস্তেই না হয় চলো। আমরা তো জল-জঙ্গলে ঘুরতেই এসেছি। বখশিস পাবে!

বখশিসের লোভে এক্কাগাড়ি ডাইনের রাস্তায় নিয়ে গেল মকবুল। কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে হয়তো পাখি-প্রজাপতি বা গাছের ডালে পরজীবী অর্কিড খুঁজতে মন দিলেন। মাটির রাস্তাটা সংকীর্ণ। মাঝবরাবর হলুদরঙের ঘাস এবং তার দুপাশে ধুলোয় মোটরগাড়ির টায়ারের দাগ। জিজ্ঞেস করলে মকবুল আমাকে বলল,–চোরেরা রাতবিরেতে জঙ্গলের গাছ কাটে। কাঠগোলা থেকে লরি এসে সেই কাঠ নিয়ে যায়। কখনও থানাপুলিশ হয় সার! অভাবী লোকেরা পেটের দায়ে চোর হতেই পারে। কিন্তু আসল চোর তো কড়ি-কাঁড়ি টাকা নিয়ে বসে আছে। তাদের ধরে কে?

প্রায় এক কিলোমিটার চলার পর কাঁচারাস্তাটা ডাইনে বাঁক নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। এক্কাগাড়িটা এবার পিচরাস্তায় উঠল। কর্নেল বাইনোকুলারে সামনেটা দেখে নিয়ে বললেন,–ইরিগেশন বাংলো দেখা যাচ্ছে। জয়কৃষ্ণ রায়চৌধুরির সঙ্গে বছর তিনেক আগে ওই বাংলোতে উঠেছিলুম।

বললুম,–তা হলে তো আপনার চেনা জায়গা!

–কতকটা। নৌকো করেই ঘুরেছিলুম। সেটা ছিল ডিসেম্বর মাস। সাইবেরিয়ান হাঁস দেখেছিলুম। ছবি তোলার সুযোগ পাইনি। তা ছাড়া, কনকপুরেও যাওয়া হয়নি। মিঃ রায়চৌধুরিও বলেননি, কনকপুরে তার আত্মীয় আছেন। গত পরশু তার টেলিফোন পেয়ে সেটা জেনেছি।

–ভদ্রলোক সম্ভবত তার মাসতুতো দাদাদের এড়িয়ে চলেন। তাই না? কর্নেল চাপাস্বরে বললেন,–তা-ই বা বলি কেমন করে? রায়বাড়ির রহস্যজনক চুরির ঘটনা সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ লক্ষ করেছি। পুলিশের উঁচুতলায় তার প্রভাব সত্ত্বেও সুদর্শনবাবুকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন।

এবার আমাদের ওপর উত্তরের বাতাস এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। মকবুলের মন এখন তার হাড়জিরজিরে টাটুর দিকে। প্রবল বাতাস ঠেলে পা বাড়াতে বেচারার কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। কর্নেল মকবুলকে বারবার বলছিলেন, তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ইচ্ছেমতো ওকে চলতে দাও!

বললুম,–জঙ্গল এলাকাটা বিশাল মনে হচ্ছে।

কর্নেল বললেন, সরকারি বনসৃজন স্কিমের ব্যাপার। এখানকার মাটি খুব উর্বর। সেবার এসে এত ঘন জঙ্গল দেখিনি।

–তা হলে ফরেস্টবাংলো নিশ্চয় কোথাও আছে?

–আছে। ওই কাঁচারাস্তা দিয়ে এগোলে কমপক্ষে তিন কিলোমিটার দূরে। রাস্তার অবস্থা তো দেখলে! রাস্তা পাকা হতে কত বছর লাগবে কে জানে! সরকারি ব্যাপার।

পিছন ফিরে দেখে নিয়ে বললুম,–কনকপুর দেখা যাচ্ছে। জঙ্গল ঘুরে না এলে কখন পৌঁছে যেতুম।

কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। রাস্তার বাঁদিকে পশ্চিমে বিস্তীর্ণ ধানখেতে পাকা ধান কাটছে লোকেরা। ডানদিকে জঙ্গল থেকে একটা জলভরা খাল বেরিয়ে রাস্তার সমান্তরালে চলেছে। বাংলোটা মনোরম। পিছনের দিকে, উত্তরে ও পূর্বে বিশাল জলাধার। বাতাসে উত্তরঙ্গ সেই জলাধারে দূরে কয়েকটা নৌকো দেখা যাচ্ছিল।

গেটের সামনে একাগাড়ি দাঁড় করাল মকবুল। একজন প্যান্ট-শার্ট সোয়েটার পরা ভদ্রলোক ততক্ষণে গেটের কাছে এসে গেছেন। তিনি করজোড়ে নমস্কার করে বললেন,–ভেরি-ভেরি সরি স্যার। ইঞ্জিনিয়ারসায়েব স্টেশনে জিপগাড়ি পাঠাতে বলেছিলেন। কিন্তু গাড়িটা মাঝপথে বিগড়ে গিয়েছিল। মেকানিক ডেকে আনতে দেরি দেখে পাঁচুবাবুর ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে ফোন করেছিলুম। ওরা বলল,–এত শিগগির গাড়ি দিতে পারব না। আমার অপরাধ নেবেন না স্যার!

কর্নেল হাসলেন। –না। আপনার উদ্বেগের কারণ নেই। আমরা মকবুলের গাড়িতে চেপে খুব আনন্দ পেয়েছি। আপনি বুঝি বাংলোর কেয়ারটেকার?

–আজ্ঞে! আমার নাম সুখরঞ্জন দাশ। বলে তিনি হাঁক দিলেন,–অ্যাই ভোঁদা। ওখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস হতভাগা? সায়েবরা এসে গেছেন! মালপত্তর নিয়ে যা!

কর্নেল মকবুলের হাতে একটা ভাজকরা নোট গুঁজে দিলেন। তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে সেলাম ঠুকে কর্নেল ও আমার ব্যাগদুটো নামাল। ভোঁদা নামে বেঁটে একজন যুবক এসে ব্যাগদুটো নিয়ে এগিয়ে গেল। গেটের পর মোরামবিছানো পথ। সরকারি বাংলো যেমন হয়। ফুলে ও সুন্দর গাছপালা-লতা-গুল্মে সাজানো। পশ্চিমপ্রান্তে তিনটে একতলা ঘর। তার মধ্যে একটা গাড়ি রাখার গ্যারেজ।

একজন মালি খুরপি দিয়ে একটা ঝোঁপের গোড়ার মাটি খুঁড়ছিল। সে সটান উঠে দাঁড়িয়ে কর্নেলের উদ্দেশে সেলাম ঠুকল। একতলা ঘরের বারান্দায় সম্ভবত তার বউ পা ছড়িয়ে বসে ভাত খাচ্ছিল। বউটি ঘোমটা টেনে পিছন ফিরে বসল।

দোতলা বাংলোর বাঁদিকে সিঁড়ি। সুখরঞ্জনবাবু, তাঁর পিছনে ভোঁদা সবেগে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যাওয়ার পর আস্তে-সুস্থে কর্নেল ও আমি ওপরে গেলুম। ওপরে শেষপ্রান্তের ঘরটিতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্নেল ঘরে ঢুকে বললেন–সুখরঞ্জনবাবু! বছর তিনেক আগে আমি আর আমার বন্ধু এই ঘরে ছিলুম।

সুখরঞ্জনবাবু বললেন,–আজ্ঞে স্যার! আমি একবছর হল জয়েন করেছি। তখন কেয়ারটেকার ছিলেন নিত্যগোপাল মুখুজ্যে।

-হ্যাঁ। নিত্যগোপালবাবু। নামটা মনে পড়ল।

-হঠাৎ স্ট্রোকে উনি মারা যান। বলে সুখরঞ্জনবাবু তেড়ে গেলেন ভোঁদার দিকে।–হাঁ করে দেখছিস কী? ঠাকমশাই বোধ করি লেপের তলায় ঢুকে পড়েছে। গিয়ে বল সায়েবরা এসে গেছেন। দুটো বাজতে চলল।

ভোঁদা তখনই দুপদাপ শব্দ করতে-করতে চলে গেল। হোঁকা মোটা বেঁটে যুবকটিকে দেখে ন্যালা-ভোলা মনে হচ্ছিল। কর্নেল বললেন,–সেবার রান্নার লোক ছিল না। মুখুজ্যেমশাই নিজেই আমাদের রান্না করে খাইয়েছিলেন।

–আজ্ঞে স্যার! অমন মানুষ আজকাল খুঁজে পাওয়াই কঠিন। যাক্‌গে। এত বেলায় স্নান না করাই ভালো। বাথরুমে গিজার আছে। গরমজলে হাত-মুখ ধুয়ে নিন। খাবার এখানে পাঠিয়ে দেব, নাকি…

কর্নেল হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন।–আমরা নীচের ডাইনিং ঘরেই খাব। আপনার ব্যস্ত হওয়ার কারণ নেই।

সুখরঞ্জন বেরিয়ে গেলেন। বললুম,বাপস! এ যে বিহারের পাহাড়ি শীত! জানলাও খোলা যাবে না।

কর্নেল বাথরুমে ঢুকে গেলেন। আমি উত্তরের পর্দা সরিয়ে কাঁচের জানলা একটুখানি ফাঁক করে দেখে নিলুম। নীচের দিকে জলাধারের তীরে বাঁধানো ঘাট। সেখানে একটা সাদা রঙের বোট বাঁধা আছে। কিন্তু ঠান্ডা হিম জলাধারে রোয়িং করা অম্ভব। অবশ্য কর্নেলের কথা আলাদা। তাঁর মিলিটারি শরীর।

একটু পরে আমরা ঘরের দরজায় তালা এঁটে নীচে ডাইনিংরুমে গেলুম। ঠাকমশাই করজোড়ে নমস্কার করলেন। কর্নেল প্রশ্ন করে জেনে নিলেন, তার নাম বাসুদেব ঠাকুর। তার বাড়ি রানিপুর। কথায়-কথায় জানা গেল, প্রাণকান্ত সেনকে তিনি চেনেন। প্রাণকান্তবাবুর ভাই কাঞ্চন সেন কলকাতায় বড় একটি চাকরি করে। গরিব দাদাকে পাইপয়সা সাহায্য করে না। দাদার বাড়ি আসেও না।

সুখরঞ্জনবাবু একটু তফাতে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বললেন, আমার বাড়ি কনকপুরে। কাঞ্চন কনকপুর হাইস্কুলে আমার ক্লাসফ্রেন্ড ছিল স্যার! আপনি তাকে চেনেন?

কর্নেল বললেন, আমার এক বন্ধুর কোম্পানিতে ভদ্রলোক চাকরি করেন। সেই সূত্রে একটু আলাপ হয়েছিল। আমার তো পাখিটাখি দেখার বাতিক আছে। কাঞ্চনবাবু বলেছিলেন, তাদের গ্রামের ওদিকে বিশাল বিল আছে। সেখানে শীতের সময় প্রচুর জলচর পাখি আসে। তার কাছে খবর পেয়েই সেবার আমি এখানে পাখি দেখতে এসেছিলুম। তুবে উনি বিল বলেছিলেন। আমি এসে দেখেছিলুম, ওয়াটারড্যাম।

ভোঁদা বারান্দায় রোদে বসেছিল। সে জড়ানো গলায় অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে বলে উঠল,–কাঁছনবাবু না? এই তো সেদিন–কঁকপুরে এসেছিল। বাঁছুবাবু না? বাঁচুবাবুর সঙ্গে বাজারে না? একসঙ্গে রিকশাতে চেঁপেছিল।

সুখরঞ্জনবাবু হাসতে-হাসতে তাকে ধমক দিলেন।–চুপ হতভাগা! স্পষ্ট করে একটা কথা বলতে পারে না। জানেন স্যার? রাতবিরেতে ওর কথা শুনলে আঁতকে উঠতে হয়। আস্ত ভূত!

কর্নেল বললেন,–ওর বাড়ি কোথায়?

ঠাকমশাই বললেন, আমার গ্রামের ছেলে স্যার! বাবা-মা নেই। কনকপুর বাস্ট্যান্ডে মোট বইত। এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে ফাইফরমাশ খাটত। ইঞ্জিনিয়ারসায়েব ওকে এখানে চাকরি দিয়েছিলেন।

খাওয়ার পর ওপরের ঘরে গিয়ে বসেছিলুম,–কর্নেল! ভোঁদা কোন বাঁছুবাবুর সঙ্গে ক’দিন আগে কনকপুর বাজারে কাঞ্চন সেনকে দেখেছে। বাঁছুবাবুটি কে জেনে নিলেন না কেন?

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বলেছিলেন,–কম্বলে ঢুকে ভাতঘুম দিয়ে নিতে পারো।

–ইচ্ছে তো করছে। কিন্তু রোদ দেখে লোভ হচ্ছে।

তা হলে বারান্দায় রোদে বসতে পারো।–বলে তিনি একটা চেয়ার নিয়ে বারান্দায় গেলেন। তারপর দেখলুম, বাইনোলারে তিনি সম্ভবত কনকপুর দর্শন করছেন।

রোদের আরাম না কম্বলের আরাম, এই টানাটানির খেলায় শেষপর্যন্ত কম্বল জিতে গেল। আমি কম্বলের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিলুম।

তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছি। ঘুম ভেঙেছিল ঠাকমশাইয়ের ডাকে। তিনি চায়ের কাপ-প্লেট হাতে নিয়ে ডাকছিলেন। দেখেই বুঝেছিলুম কর্নেলের নির্দেশ। ঠাকমশাই সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন। বললেন,–বড়সায়েব ভোঁদাকে নিয়ে পাখি দেখতে বেরিয়ে গেছেন।

চায়ের কাপ-প্লেট নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখি, দূর পশ্চিমে অর্ধবৃত্তাকার গাঢ় নীল সুর্য যথাসাধ্য রং ছড়িয়ে রেখেছে। কিন্তু প্রাকসন্ধ্যার ধূসরতা দ্রুত লাল রংটা মুছে ফেলছে। পূর্ব-দক্ষিণে সেই সরকারি জঙ্গলের গায়ে দেখতে-দেখতে ঘন নীল কুয়াশা জমে উঠল। চা শেষ করতে-করতে দক্ষিণে কনকপুরের আলোর বিন্দু ফুটে উঠতে দেখলুম। বারান্দার চেয়ারে বসে আমার প্রকৃতি দর্শনের একটু পরেই বাংলোর নীচের তলায় আলো জ্বলে উঠল। গেটের দিকে আলো পড়তেই কর্নেল আর ভোঁদাকে দেখতে পেলুম।

একটু পরে কর্নেল উঠে এসে যথারীতি সম্ভাষণ করলেন,–গুড ইভনিং জয়ন্ত! আশা করি ভাতঘুমটা ভালোই হয়েছে।

বললুম,–গুড ইভনিং বস! ভোঁদাকে নিয়ে কতদূর ঘুরলেন?

কর্নেল বারান্দার আলোর সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন। তারপর ভিতরে তাঁর কিটব্যাগ, ক্যামেরা আর বাইনোকুলার রেখে একটা চেয়ার নিয়ে এলেন। তিনি চেয়ারে বসে আস্তে বললেন,–ইচ্ছে করেই একটা রিস্ক নিয়েছিলুম। সাংঘাতিক কিছু ঘটে যেতে পারত। তৈরি ছিলুম বলে ঘটেনি। অবশ্য ভোঁদা ছেলেটি সত্যিই যাকে বলে হাঁদারাম। কী ঘটল তা বুঝতে পারেনি।

কথাটা শুনেই চমকে উঠেছিলুম। বললুম, কেউ হামলা করেছিল। তাই না?

কর্নেল হাসলেন। ড্যামের ধারে উঁচু বাঁধের পথে হাঁটছিলুম। বাঁধের দুধারেই গাছপালা ঝোঁপঝাড়। ডাইনে খানিকটা ঢালু জমির নীচে:সেই খালটা। আসবার সময় খালটা তুমি দেখেছ। তো আগেই ঢালু জমিতে একটা বটগাছ লক্ষ করেছিলুম। কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটা লোককে গুঁড়ির ওধারে আড়ালে যেতে দেখেছিলুম।ভোঁদা হাঁটছিল আমার বাঁদিকে। বটগাছটার কাছাকাছি বাঁধের পথে পৌঁছুনোর আগেই দেখি, লোকটা গুঁড়ি মেরে ঢালু জমিতে ঝোঁপের মধ্যে বসে পড়েছে। তার হাতে কী একটা ছিল–সম্ভবত দেশি পিস্তল। আমার উপায় ছিল না, ঝোঁপটার গোড়া লক্ষ্য করে এক রাউন্ড ফায়ার করতেই হল। অমনই লোকটা বটগাছের আড়াল দিয়ে উধাও হয়ে গেল। ভোঁদা ভেবেছিল, আমি পাখি মারবার চেষ্টা করলুম। তার কথায় পরে আসছি। নেমে গিয়ে বটগাছটার কাছে বাইনোকুলারে দেখলুম, লোকটা খালের ধারে-ধারে ঝোঁপঝাড়ের ভিতর দিয়ে পড়ি-কি-মরি করে দৌড়ে পালাচ্ছে। কাঁচারাস্তায় পৌঁছে সে একবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। তারপর আমাকে দেখতে পেয়ে আবার দৌড়ে উধাও হয়ে গেল। ভোঁদা তখনও বাঁধে দাঁড়িয়ে ছিল। দেখার মতো মূর্তি। চোখ বড়। জিভ খানিকটা বেরিয়ে আছে। ফিরে গিয়ে বললুম, পাখিটা মারতে পারলুম না ভোঁদা! ভোঁদা তার বুলিতে যা বলতে চাইছিল, তা বুঝলুম। এদিকটায় বনমুরগি চরে বেড়ায়। কিন্তু তারা বেজায় চালাক।

এইসময় কফি আর স্ন্যাক্স ট্রেতে করে নিয়ে এলেন ঠাকমশাই। তার পিছনে ভেঁদা। ভোঁদা ঘর থেকে বেতের টেবিল এনে রাখল। ঠাকমশাই সহাস্যে বললেন,–বড়সায়েব বনমুরগিকে গুলি করেছিলেন শুনলুম। ভোঁদা তো হেসে অস্থির। বনমুরগি ফাঁদ পেতে ধরতে হয়। বুঝলেন স্যার? আগের দিনে মুমহররা এসে বনমুরগি ধরত। আজকাল আর তাদের দেখতে পাই না!

ভোঁদা অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ভুতুড়ে হাসি হাসল। তারপর ঠাকমশাইয়ের তাড়া খেয়ে চলে গেল।

ঠাকমশাই বনমুরগি এবং মুমহরদের সম্পর্কে আরও কিছু বলতেন। গেটের দিকে তাকিয়ে কর্নেল বললেন,–ঠাকমশাই! আমার সঙ্গে এক ভদ্রলোকের দেখা করতে আসার কথা। মনে হচ্ছে, তিনি এসে গেছেন। ওঁকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। পটে যা কফি আছে, এতেই হবে। আপনি শুধু একটা কাপ-প্লেট পাঠিয়ে দেবেন।

বাসুদেব ঠাকুর চলে গেলেন। গেটের কাছে হালদারমশাইকে দেখা যাচ্ছিল। মাথায় হনুমানটুপি, পরনে প্যান্ট আর গায়ে সোয়েটারের ওপর কোট চাপানো।

আমাদের দেখতে পেয়ে তিনি হাত নাড়ছিলেন। একটু পরে ভোঁদা তাকে পৌঁছে দিয়ে গেল। তারপর ঠাকমশাই কাপ-প্লেট নিয়ে এলেন। হালদারমশাইকে বিনীতভাবে নমস্কার করে চলে গেলেন।

গোয়েন্দাপ্রবরকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। কর্নেল বললেন,–কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিন হালদারমশাই।

আমি বললুম,–আপনি এলেন কীসে? হালদারমশাই বললেন,–রিকশোওলারা সন্ধ্যার পর এদিকে আইতেই চায় না। একজন হাঁকল তিরিশ টাকা লাগব। হঃ! দুইখান পাও থাকতে অগো সাধাসাধি করুম ক্যান?

কর্নেল তার হাতে কফির কাপ তুলে দিয়ে বললেন,–উঠেছেন কোথায়?

–উঠছি তো রায়বাড়িতে। সুদর্শনবাবু ওনার দাদা সুরঞ্জনবাবুর লগে আমার পরিচয় দিছেন। উনিও খুশি হইয়া কন্ট্রাক্ট ফর্মে সই করছেন। প্রথমে এটুখানি হেজিটেট করছিলেন ভদ্রলোক। তখন সুদর্শনবাবু মিঃ রায়চৌধুরির লেটারখান ওনারে পড়তে দিছিলেন। দোতলায় সুদর্শনবাবুর পাশের ঘরে আছি।

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–কতদূর এগোলেন বলুন!

প্রাইভেট ডিটেকটিভ চাপা স্বরে বললেন,–সুরঞ্জনবাবু কোথায় চাবি লুকাইয়া রাখেন, তা দেখছি। সুদর্শনবাবু তখন বাইরে গিছলেন। ওনার বউদি ভদ্রমহিলা ছিলেন নীচের তলায়। সুরঞ্জনবাবু আমার ঘরে বইয়্যা ওনাদের ফ্যামিলি হিসটরি কইতাছিলেন। সেইসময় কথাটা তুলছিলাম।

–বাঃ! তারপর?

–উনি নিজের বেডরুমে লইয়া গিছলেন। খাটের মাথার দিকের দেওয়ালে ওনার ঠাকুরদার একখান পোর্ট্রেট টাঙানো আছে। ছবিটার পিছনে দেওয়ালে ছোট্ট তাক আছে। একসময় সেখানে ওনাদের মহালক্ষ্মী দেবীর নকলে তৈরি মাটির ছোট্ট প্রতিমা থাকত। ওনার ঠাকুরদার পোর্ট্রেটখান থাকত অন্য দেওয়ালে। চাবি লুকাইয়া রাখতেন সেই প্রতিমার তলায়। পরে প্রতিমা আলমারির মাথায় রাইখ্যা তাকের মাপে লোহার একখান চৌখুপি বানাইয়া আনছিলেন। বাঁদিকে একখানে আঙুলে চাপ দিলে কপাটের মতন সামনেটা খুইল্যা যাইত। ভিতরে হাবিজাবি জিনিসের মধ্যে চাবি দুইখান লুকাইয়া রাখতেন। চৌখুপির সামনের পাতে দেওয়ালে রঙ করা ছিল। তার ওপরে ঠাকুরদার পোর্ট্রেট। পোর্ট্রেটের তলায় ময়লা দাগ পড়নের কথা। কেউ ছবিখান সরাইলে দাগ দেইখ্যা জানা যাইব। তাই কি না?

–ঠিক বলেছেন। হালদারমশাই বললেন, সুদর্শনবাবুর ঘরের তালা কেউ একবার ভাঙছিল, তা তো অলরেডি শুনছেন! তারপর সুরঞ্জনবাবুও সতর্ক হইয়া তার চাবিদুইখান এমন জায়গায় রাখছিলেন, ভাবা যায় না। বলে হালদারমশাই খিখি করে হেসে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলুম,–কোথায় রেখেছিলেন?

গোয়েন্দাপ্রবর বললেন,–ওনার ঘরে বইপত্তরের মধ্যে পুরোনো পঞ্জিকা আছে অনেকগুলি। একখান পুরোনো অ্যাত্তো মোটা পঞ্জিকার মাঝখানে চৌকো এটুখানি গর্ত করছেন।

কর্নেল বললেন,–পাতা কেটে গর্ত?

–ঠিক কইছেন কর্নেলস্যার। ব্লেড দিয়া এক ইঞ্চিরও বেশি গর্ত করছেন। চৌকো গর্ত। তার মধ্যে দুইখান চাবি।

হালদারমশাই আবার খিখি করে হেসে উঠলেন। বললুম,–অদ্ভুত ব্যাপার তো!

–হঃ! কার সাইধ্য ট্যার পায়, পুরোনো পঞ্জিকার মধ্যে গুপ্তধন লুকাইয়া আছে! হালদারমশাই কণ্ঠস্বর আরও চাপা করলেন। কাজটা কিন্তু সহজ নয়। চিন্তা করেন কর্নেলস্যার! ব্লেড দিয়া অতগুলি পাতা কাটতে সময় কত লাগছে? তিনইঞ্চির বেশি লম্বা আর আধা ইঞ্চি চওড়া কইর‍্যা পাতা কাটছেন।

বললুম,–এক ইঞ্চিরও বেশি গভীর করতে হলে পঞ্জিকাটা খুবই মোটা হওয়া উচিত।

কর্নেল বললেন, আগের দিনে কিছু প্রকাশক প্রকাণ্ড শাস্ত্রীয় পঞ্জিকা প্রকাশ করতেন। সঙ্গে জ্যোতিষচর্চা, মেয়েদের ব্রতকথা, শাস্ত্রীয় পাঁচালি পুরে দিতেন। সস্তা নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা এ সব আট-নশো পৃষ্ঠার পঞ্জিকা আমি দেখেছি। আমার এক বন্ধুর পঞ্জিকাসংগ্রহের বাতিক আছে।

কর্নেলের কথার ওপর হালদারমশাই বললেন–বেশিক্ষণ থাকুম না। দুইখান ইমপর্ট্যান্ট কথা আছে।

–বলুন!

–আইজ সকালে বাজার এরিয়ায় গিছলাম। বড় বেশি ঠান্ডা! রাস্তার ধারে রৌদ্রে খাড়াইয়া চা খাইলাম। তারপর ভিড়ের মধ্যে ক-পাও হাঁটছি, পিছন থেইক্যা কে আমার হাতে কী একখান দিলা। ঘুইর‍্যা দেখি এক পোলাপান। সে কইল, এক বাবু আমারে দিতে কইছে। তারপরই সে পলাইয়া গেল। তারে তাড়া করলে মাইনরো ভিড় করবে। জিগাইবে কী ব্যাপার। তাই মাথা ঠান্ডা রাখলাম। এই দ্যাখেন কী কাণ্ড!

হালদারমশাই কোটের ভিতর পকেট থেকে ভাজকরা একটুকরো কাগজ বের করে কর্নেলকে দিলেন। কর্নেল চোখ বুলিয়ে দেখার পর গম্ভীর মুখে বললেন, ক্রমশ একটু-একটু করে ঘটনাটা স্পষ্ট হচ্ছে। রায়বাড়ির গৃহদেবীর জুয়েলস চুরি করে চোর। অথচ তা কনকপুর থেকে নিয়ে যেতে পারেনি এবং বেচতেও পারেনি।

কর্নেলের হাত থেকে প্রায় দলাপাকানো কাগজের টুকরোটা চেয়ে নিলুম। কাগজে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা আছে :

‘টিকটিকির লেজ কাটিয়া দিলেও লেজ গজাইতে পারে। মস্তক কাটিলে কী হইবে?’

হালদারমশাই বললেন,–কর্নেলস্যার! পঁয়তিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করেছি। আমারে কয় টিকটিকি? আইজ বেলা বারোটা পর্যন্ত বাজার এরিয়ায় এখানে-সেখানে ঘুরছি। পোলাটারে খুঁজছি। দেখা পাই নাই!

বললুম,–ভদ্ৰপরিবারের ছেলে, নাকি সাধারণ ঘরের?

-নাঃ! নোংরা পোশাক! পরনে ছেঁড়া হাফপ্যান্ট। জুতা নাই।

কর্নেল বললেন,–ঘটনাটা কি আপনার মক্কেলদের জানিয়েছেন?

–কক্ষনও না। অগো কমু ক্যান?

–ঠিক করেছেন। আর কী কথা বলতে চাইছিলেন, এবার বলুন!

হালদারমশাই সম্ভবত উত্তেজনায় নস্যি নিতে ভুলে গিয়েছিলেন। এবার একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন–সুদর্শনবাবু বিকালে ওনাগো ক্লাবে যাইতে কইছিলেন। আমি ওনারে কইলাম, বাইরে আপনাগো লগে মেলামেশা করনের অসুবিধা আছে। উনি যাওয়ার পর আমি আবার বাজার এরিয়ায় গেলাম। পোলাটারে খুঁজছিলাম। শেষে ঠিক করলাম, আপনার লগে কনসাল্টের দরকার আছে। তারপর একটা চৌরাস্তার মোড়ে খাড়াইয়া ওয়েট করছিলাম। ক্যান কী, আপনি কইছিলেন সন্ধ্যার পর আমি য্যান গোপনে এই বাংলোয় আসি।

কর্নেল বললেন,–হালদারমশাই! এবার কথাটা কী বলুন!

গোয়েন্দপ্রবর চাপা স্বরে বললেন,–বাঁ-দিকে মোড়ের মুখে একখান দোতলা বাড়ি থেইক্যা সুরঞ্জনবাবু আর-একটা লোকেরে বারাইতে দেখলাম ওনারা আমারে লক্ষ করেন নাই। ততক্ষণে আলো জ্বলছে। সুরঞ্জনবাবুরে দেইখ্যা মনে হইল, কিছু ঘটছে। দুইজনে সাইকেলরিকশোতে চাপলেন। কিন্তু ওনারা বাড়ির দিকে গেলেন না। উল্টাদিকে গেলেন। আমার খটকা বাধছে।

–কিছু ঘটে থাকলে রায়বাড়ি ফিরেই জানতে পারবেন। সুরঞ্জনবাবুর সঙ্গের লোকটার চেহারা, পোশাক নিশ্চয় লক্ষ করেছেন?

–করছি। বয়স তিরিশ-বত্রিশের বেশি না। গোঁফ আছে। মাথায় মাফলার জড়ানো ছিল। গায়ে অ্যাশকালার ফুলহাতা সোয়েটার। পরনে মেটে রঙের টাইট প্যান্ট। জুতা লক্ষ করি নাই।

এই সময় বাংলোর দিকে একটা গাড়ি এগিয়ে আসতে দেখলাম। বাংলোর গেটের কাছে আসতেই চোখে পড়ল একটা জিপগাড়ি। ভোঁদা থপথপ করে এগিয়ে গিয়ে খুলে দিল। জিপগাড়িটা লন পেরিয়ে নীচে এসে থামল। কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন,–ইঞ্জিনিয়ারসায়েবের গাড়ি। এতক্ষণে বোধহয় মেকানিকরা গাড়িটা সচল করে দিয়েছে।

একটু পরে একজন টাই-স্যুট এবং কানঢাকা টুপি পরা এক ভদ্রলোক এবং তার পিছনে কেয়ারটেকার সুখরঞ্জনবাবু এগিয়ে এলেন। সুখরঞ্জনবাবু বললেন, স্যার! আমাদের ইঞ্জিনিয়ারসায়েব!

ইঞ্জিনিয়ারসায়েব নমস্কার করে কর্নেলকে বললেন-কর্নেলসায়েবের খুব কষ্ট হয়েছে বুঝতে পারছি। কিন্তু সরকারি গাড়ির অবস্থা কী আর বলব?

সুখরঞ্জনবাবু একটা চেয়ার এনে দিলে তিনি বসলেন। কর্নেল বললেন,–আলাপ করিয়ে দিই। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি। আর ইনি আমার বন্ধু মিঃ কে, কে. হালদার। অবশ্য মিঃ হালদার কনকপুর রায়বাড়ির গেস্ট!

–আমি এ. কে. গোস্বামী। চিফ ইঞ্জিনিয়ার মিঃ কে. এল. বোস আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন, আপনার যেন কোনো অসুবিধা না হয়। কিন্তু প্রথমেই অসুবিধা ঘটিয়ে ফেলেছি। ক্ষমা করবেন।

–ও কিছু না। বছর তিনেক আগে ডিসেম্বরে আমি মিঃ জয়কৃষ্ণ রায়চৌধুরির সঙ্গে এই বাংলোয় এসে কয়েকটা দিন ছিলুম।

আমি তখন ফরাক্কায় ছিলুম।–বলে মিঃ গোস্বামী ঘড়ি দেখলেন। আপনার সঙ্গে আলাপ করতে আর কৈফিয়ত দিতে এসেছিলুম। মিঃ বোস বলে দিয়েছেন, আপনার গাড়ির দরকার হলে যেন ব্যবস্থা করে দিই। জিপগাড়িটা আমাকে আমার কোয়ার্টারে পৌঁছে দিয়ে বাংলোয় থাকবে।

কর্নেল বললেন,–ধন্যবাদ মিঃ গোস্বামী। আমার গাড়ির দরকার হবে না। আমি জল-জঙ্গলে ঘুরতে এসেছি। আমার কিছু হবি আছে। পাখি, প্রজাপতি, অর্কিডের খোঁজে ঘুরে বেড়াই। নৌকোর ব্যবস্থা করে নেব। আমার এই কার্ডটা রাখুন!

কর্নেল তার নেমকার্ড দিলেন। মিঃ গোস্বামী কার্ডটা দেখে নিয়ে পকেটে ঢোকালেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–রোয়িং করার একটা ছোট্ট বোট আছে। তবে এখন যা অবস্থা, রোয়িং করার রিস্ক আছে। সুখরঞ্জনবাবুকে বললে নৌকোর ব্যবস্থা করে দেবেন। আমি চলি কর্নেলসায়েব! ফিশারিজ কো-অপারেটিভের একটা আর্জেন্ট মিটিং শেষ করে আসছি। কো-অপারেটিভের প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারিকে বসিয়ে রেখে এসেছি। কিছু কাজ এখনও শেষ হয়নি।

কর্নেল বললেন,–মিঃ গোস্বামী! তা হলে একটা অনুরোধ। আমার বন্ধু মিঃ হালদারকে রায়বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দিলে খুশি হব। আপনি না এলে ওঁকে কষ্ট করে হেঁটে যেতে হত।

–নিশ্চয় পৌঁছে দেব। চলুন মিঃ হালদার!

গোয়েন্দাপ্রবরের আরও কিছুক্ষণ হয়তো থাকার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এই শীতে জিপগাড়িতে ফেরার সুযোগ পেয়ে উনি খুশিই হলেন।

একটু পরে আমরা ঘরে গিয়ে বসলুম। কিছুক্ষণ পরে কর্নেলের নির্দেশে এবার ভোঁদা কফির ট্রে রেখে গেল। বোঝা যাচ্ছিল কর্নেলকে তার ভালো লেগেছে। তার সেবা করতে পারলে সে যেন ধন্য হয়ে যাবে।

কফি খেতে-খেতে কর্নেল হালদারমশাইয়ের সেই কাগজটা টেবিলল্যাম্পের আলোতে আতশকাঁচ দিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। তারপর তিনি টেবিলল্যাম্প নিভিয়ে দরজার পর্দা তুলে বাইরেটা দেখে এলেন। চেয়ারে বসে তিনি আস্তে বললেন–হালদারমশাই সুদর্শনবাবুকে কার্ডটার কথা বলেননি। আবার সুদর্শনবাবুরও কার্ডটা সম্বন্ধে মাথাব্যথা থাকলে হালদারমশাইকে জানাতেন। এ থেকে আমার ধারণা কার্ডটা কেউ ইচ্ছে করেই সুদর্শনবাবুর ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়েছিল।

-কেন?

–প্রশ্নের আগে তুমি চিন্তা করো, কখন কার্ডটা ঢোকানো হয়েছিল? কলকাতা যাওয়ার জন্য উনি ব্যাগে মহালক্ষ্মীর ফোটো এবং কিছু জিনিসপত্র ঢুকিয়েছিলেন। তারপরই কার্ডটা ঢোকানো হয়েছিল। বাড়িতে এটা কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। কাজেই স্টেশনে যাওয়ার সময় বাসের ভিড়ে অথবা ট্রেনে ওঠার পর কেউ কার্ডটা ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয়। তুমি লক্ষ করে থাকবে, দুদিকে বোতাম আঁটা কাপড়ের ব্যাগ। এবার তোমার প্রশ্নের একটা উত্তর দেওয়া যায়। সে জানত, সুদর্শনবাবু কোথায় যাচ্ছেন এবং কেন যাচ্ছেন। বাঁধানো ফোটো বের করলেই কার্ডটা বেরিয়ে পড়ার কথা। ওঁর হইচই বাধানোর স্বভাব। কার্ড দেখতে পেলেই উনি আমাকে দেখাতেন। লোকটা ভেবেছিল, উনি যা-ই বলুন, চন্দ্র জুয়েলার্সের কার্ড দেখলে আমার মনে ওঁর প্রতি সন্দেহ জাগবে। আমি ওঁকে অবিশ্বাস করব। তখনই ঘর থেকে বের করে দেব। নয়তো ওঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেব। কারণ ওঁর ব্যাগ থেকে কার্ডটা ছবির সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে। আমি কার্ডটা প্রখ্যাত রত্নব্যবসায়ী চন্দ্র জুয়েলারি কোম্পানির।

হাসি পেল কথাগুলো শুনে। বললুম,–কার্ডটা ঠিকই বেরিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সুদর্শনবাবুর দৃষ্টি তখন আপনার দিকে ছিল।

কর্নেলও হাসলেন। সুদর্শনবাবুর অজান্তে কার্ডটা পড়ার ফলে তাঁর প্রতি আমার সন্দেহ আরও প্রবল হওয়ার কথা। কিন্তু এটাই অদ্ভুত ব্যাপার জয়ন্ত, চালাকির মাত্রাটা বেশি হলেই চালাক নিজের ফাঁদে নিজেই পড়ে। কার্ড লোকে বুকপকেটে রাখে। সুদর্শনবাবুর বুকপকেটে ভিড়ের মধ্যে কার্ডটা সে ঢুকিয়ে দিতেও পারত। তা দেয়নি। কারণ সে চেয়েছিল, কার্ডটা মহালক্ষ্মীর ফোটোর সঙ্গে থাকলে ওটা ছিটকে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য।

–তা হলে সে জানত সুদর্শনবাবুর ব্যাগে মহালক্ষ্মীর বাঁধানো ছবি আছে?

–নিশ্চয়ই জানত।

–কর্নেল! এবার বলুন ভোঁদার মুখে শোনা বাঁছুবাবুটি কে?

–তুমি সুখরঞ্জনবাবু বা ঠাকমশাইকে জিগ্যেস করোনি কেন?

–ঠিক আছে। খাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করব। কাঞ্চনবাবু আপনাকে যার নাম-ঠিকানা লিখে দিয়েছিলেন, তিনি নিশ্চয় সেই লোক।

কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে বললেন,–গ্যারান্টি দিতে পারছি না।

–তার মানে এটা আপনার ট্রাম্পকার্ড। তুরুপের তাস?

কর্নেল চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দিলেন। কিছুক্ষণ পরে বাইরে থেকে সাড়া দিয়ে সুখরঞ্জনবাবু বললেন,–আসতে পারি স্যার?

বললুম,–আসুন সুখরঞ্জনবাবু!

–আপনারা কখন ডিনার খাবেন জানতে এলুম!

কর্নেল বললেন, শীতের রাত্রে আপনাদের কষ্ট দেব না। নটায় খেয়ে নেব।

সুখরঞ্জনবাবু চলে যাচ্ছিলেন। বললুম,–একটা কথা সুখরঞ্জনবাবু!

–বলুন স্যার?

–তখন ভোঁদা আপনার ক্লাসফ্রেন্ড কাঞ্চনবাবুর সঙ্গে কাকে দেখেছিল, তা-ই নিয়ে কর্নেলসায়েবের সঙ্গে আমার তর্ক হয়েছে। কর্নেল বলছেন, ভদ্রলোকের নাম বাঞ্ছাবাবু। লোকে বলে বাঙ্কুবাবু। আমি বলছি বাচ্চুবাবু। কারটা ঠিক?

সুখরঞ্জনবাবু হাসতে-হাসতে বললেন,–কনকপুরে বাঙ্কুবাবুও আছেন। বাচ্চুবাবুও আছেন। বাঙ্কুবাবুর নাম বাঞ্ছারাম দত্ত। নামকরা ব্যবসায়ী। আর বাচ্চুবাবুর নাম বিশ্বনাথ সিংহ। বাচ্চুবাবু হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। ভোঁদাকে নিয়ে প্রবলেম আছে স্যার। ও কার নাম বলছে, তা বোঝার সাধ্য কারও নেই। লোকটিকে দেখিয়ে দিলে তবে বোঝা যাবে ভোঁদা কার নাম বলছে।

-কাঞ্চনবাবুর সঙ্গে দুজনের মধ্যে কার সম্পর্ক থাকতে পারে?

-কাঞ্চন বড় চাকরি করে। সায়েব সেজে থাকে, তা-ও শুনেছি। সে ওই দুজনের সঙ্গে এক রিকশোতে বসে কোথায় যাবে? ভোঁদার একটা বদভ্যাস আছে স্যার। ওর সামনে কারও কথা নিয়ে আলোচনা করলে ও বলবে, তাকে অমুক জায়গায় দেখেছে।

কর্নেল হাসলেন। –ভোঁদা দিব্যদর্শী!

আজ্ঞে স্যার! ছেলেটা এমনিতে খুব ভালো। সরল। বিশ্বাসী। শুধু একটাই দোষ। বিশ্বসুন্ধু লোককে ও চেনে।–বলে সুখরঞ্জনবাবু হাসতে-হাসতে বেরিয়ে গেলেন।

একটু পরে বললুম,–কর্নেল! সুখরঞ্জনবাবু দুটো গুলি ছুঁড়ে গেলেন। টার্গেটে কোনটা বিঁধল!

কর্নেল আস্তে বললেন, কোনওটাই টার্গেটে বেঁধেনি।…

প্রচণ্ড শীতের আরামও আছে। সকাল আটটায় আমার ঘুম ভেঙেছিল ঠাকমশাইয়ের ডাকে। তার হাতে চায়ের কাপ-প্লেট। ঠাকমশাই বিনীতভাবে বললেন–বড়সায়েব বলে গেছেন, আপনি বেড-টি খান।

বিছানায় বসে বেড-টি খাওয়ার মতো আনন্দ আর কীসে আসে, বিশেষ করে এমন শীতের সময়? চা নিয়ে বললুম,–বড়সায়েব কখন বেরিয়েছেন!

–আজ্ঞে সেই ছটায়। ফ্লাস্কে কফি তৈরি রেখেছিলুম। উনি ভোঁদাকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন!

–সুখরঞ্জনবাবু কী করছেন?

–উনি নৌকোর ব্যবস্থা করতে গেছেন। বড়সায়েব গতরাত্রে নৌকোর কথা বলছিলেন না?

বলে বাসুদেব ঠাকুর চলে গেলেন। তারপর বাথরুমে গিয়ে দাড়ি কামিয়ে বেরুলুম। রাত-পোশাক ছেড়ে প্যান্ট-শার্ট-জ্যাকেট পরে বারান্দায় গিয়ে বসলুম। নীল কুয়াশা দূরে সরিয়ে রোদ নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে, যতদূর দেখা যায়।

ন’টা নাগাদ কর্নেল ফিরে এলেন। সঙ্গে অনুগত ভোঁদা। কর্নেল ওপরে এসে যথারীতি সম্ভাষণ করলেন,–মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।

–মর্নিং বস! আশা করি আজ কোথাও আরেক রাউন্ড ফায়ার করার দরকার হয়নি?

কর্নেল হাসলেন। ভেঁদা আজ সত্যি একটা বনমুরগি আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু তাকে নিরাশ হতে হয়েছে। ওকে বললুম, দেখছ না বেচারা রোগে ভুগে আধমরা হয়ে গেছে?

বলে তিনি ঘরে ঢুকলেন। বাথরুম সেরে তিনি শুধু প্যান্টটা বদলে নিলেন। হান্টিং বুট ব্রাশ দিয়ে সাফ করলেন। টুপি থেকে মাকড়সার জালের ছেঁড়া কিছু অংশ সাফসুতরো করে বললেন,–এখনও সুখরঞ্জনবাবু ফেরেননি। দেখা যাক। ঠাকমশাইকে বলে এলুম, দশটায় ব্রেকফাস্ট করার পর কফি খাব।

সুখরঞ্জনবাবু ফিরে এলেন প্রায় আধঘন্টা পরে। খবর দিলেন,–ছই নৌকো পাওয়া গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে যাবে। ওই যে বাঁধের ডাইনে খাল আছে, ওই খাল বেয়ে আসবে। বড্ড বেশি দর হাঁকছিল বেচু। ষাট টাকায় রফা হয়েছে।

ব্রেকফাস্টের পর কফি খাওয়া হল। কর্নেলের কথামতো আবার ফ্লাস্কভর্তি কফির ব্যবস্থা করলেন ঠাকমশাই। লক্ষ করলুম, একটা খাবার প্যাকেটও তৈরি হয়ে আছে। ভোঁদা খালের ধারে গিয়ে অপেক্ষা করছিল। পৌনে এগারোটায় সে থপথপ করে ভালুকের মতো হেঁটে এসে খবর দিল, নৌকো এসে গেছে।

নৌকোটা ছোট। বেচুমাঝি কর্নেলকে হাঁ করে দেখছিল। কর্নেল বললেন, “তোমার নাম বেচু?

–আজ্ঞে হুজুর!

–তোমার নৌকোয় তো হাল বা দাঁড় নেই দেখছি!

বেচু একটু হেসে বলল,–ওসবের দরকার হয় না হুজুর। এই যে লগি দেখছেন, এই যথেষ্ট। নৌকো তো ড্যামে ঢুকবে না। এই খাল দিয়ে গিয়ে ডাকিনিতলার ঝিলে পড়বে। ঝিলে তত বেশি জল নেই। তারপর আবার খাল। হুজুর কালুখালি যাবেন শুনলুম। তা আজ্ঞে, দু-ঘণ্টা তো লাগবে।

নৌকোয় ছইয়ের সামনে বসলেন কর্নেল। ভোঁদা বসল তার সামনে নৌকোর ডগায়, আমি ছইয়ের মুখে বসলুম। বেচু ভোঁদাকে চেনে দেখে অবাক হইনি। সে ভোঁদাকে বলল,–এই ভোঁদারাম! তোর নীচে ফাঁক দিয়ে দ্যাখ, একখানা দা আছে। বের করে হাতে রাখ। হুজুরদের মাথায় ঝোঁপঝাড়ের ডাল-লতাপাতা ঠেকতে পারে। আগেই দায়ে কেটে ফেলবি।

ভোঁদা নৌকোর তলা থেকে একটা লম্বা চকচকে দা বের করে রাখল। তার মুখে হাসি।

কর্নেল মুখে ভয়ের ছাপ ফুটিয়ে বললেন,–কী সর্বনাশ! দেখো বাবা ভোঁদা, যেন আমার মাথায় কোপ দিয়ো না।

ভোঁদা বলল,–নাঁ ছাঁর! এ কাঁছ খুঁব পাঁরি। আঁমি নাঁ? আঁমি আঁমনার ছাঁর উলথোঁ দিকে বঁসে নাঁ? কোঁপ–কোঁপ মাঁরব!

নৌকোর পিছনে দাঁড়িয়ে বেচু লগি ডুবিয়ে ঠেলে দিল। তারপর কখনও ছইয়ের বাঁ-পাশ, কখনও ডানপাশ দিয়ে হেঁটে নৌকো এগিয়ে নিয়ে চলল। একটু পরে কর্নেলকে চাপাস্বরে ইংরেজিতে বললুম–অন্য একটা কাজে এসে নিজের বাতিকে মেতে উঠলেন! হালদারমশাইয়ের জন্য আমার উদ্বেগ হচ্ছে! আপনার এই জলজঙ্গলে নৌযাত্রা কি পরে করা যেত না?

কর্নেল চুরুট টানছিলেন। ধোঁয়া ছেড়ে ইংরেজিতে বললেন,–জয়ন্ত! সব চেয়ে সেরা রহস্য প্রকৃতির ভিতরে লুকিয়ে আছে।

–কিন্তু এটা ক্লান্তিকর। একঘেয়ে!

–প্রকৃতিতে কত বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে তুমি জানো না!

সেই সময় খালের ওপর ঝুঁকে পড়া ঝোঁপের ডালে ভেঁদা দায়ের কোপ মারতেই কী একটা পাখি উড়ে গেল। কর্নেল বাইনোকুলার তুলে দেখে নিয়ে উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন,–উডডাক! জয়ন্ত! দেখলে তো?

উডডাক দুর্লভ প্রজাতির পাখি। অবিকল হাঁসের মতো দেখতে। কিন্তু এ পাখি জলচর নয়। কর্নেলের পাল্লায় পড়ে উডডাকের কথা শুধু শুনেছি তা-ই নয়, তার পিছনে কতবার পাহাড়ি বনজঙ্গলে হন্যে হয়ে ঘুরেছি। ভোঁদা তার ভাষায় কী সব আওড়াল বুঝলুম না।

বেচু বলল,–ভাগ্যি ভালো হুজুর! এখন শীতের সময়। অন্যসময় হলে সাপের দেখাও পাওয়া যেত!

কর্নেল বললেন, তুমি কোথায় থাকো?

–শেতলপুরে হুজুর! ওই যে বলছিলুম ডাকিনিতলার ঝিল। তার কাছাকাছি। এই খাল বেয়ে নৌকো আনা সহজ নয় আজ্ঞে! সুখরঞ্জনবাবু বললেন, কলকাতা থেকে সায়েবরা এসেছেন। তাই-অ্যাই ভোঁদা!

ভোঁদা খালে ঝুঁকে পড়া লতাপাতার একটা ঝালর কেটে ফেলল।

কর্নেল বললেন,–ওহে বেচু! তা হলে দেখছি, জঙ্গলের এই খাল বেয়ে নৌকো আনতে তোমার খুব কষ্ট হয়েছে।

বেচু হাসল,–আমার কী কষ্ট বড়হুজুর? আমি পাঁচখালি তল্লাটের লোক। কনকপুর তল্লাটের লোকে আমাদের বলে বুনো। আই ভোঁদা!

ভেঁদা দুদিক থেকে খালে ঝুঁকে পড়া ডাল-লতাপাতায় কোপ মারল। কর্নেল বললেন,–ভোঁদা তুমি এদিকে সরে এসো। আমাকে দা-খানা দাও! যা বলছি শোনো!

বেচু মজা পেয়ে হেসে উঠল। আমি বললুম,–বেচু! উনি একসময় মিলিটারিতে ছিলেন। মিলিটারি বোঝো?

-বুঝব না কেন ছোটহুজুর? পাঁচখালি থেকে বাংলাদেশের বডার তত দূরে নয়। ছোটবেলা থেকে আঁকে-ঝাঁকে মিলিটারি দেখেছি।

কর্নেলকে দেখিয়ে বললুম,–ইনি সেই মিলিটারি অফিসার। ইনি কর্নেলসায়েব। জঙ্গলে-পাহাড়ে যুদ্ধ করে জীবন কাটিয়েছেন। জঙ্গলের মধ্যে যুদ্ধ করতে হলে ঝোঁপঝাড় কেটে এগোতে হয়। কাজেই এ কাজে ওঁর হাত পাকা।

বেচু আরও সমীহ করে বলল, “আজ্ঞে! সুখরঞ্জনবাবু যেন তা-ই বলছিলেন বটে! হ্যাঁ, হ্যাঁ। কল্লেলসায়েব!

ভোঁদা ভুতুড়ে হাসি হেসে বলল,–আঁমি দাঁনি-দাঁনি! কঁনেল সাঁয়েম!

তার ‘কঁনেল সাঁয়েম’ তখনই ডানধারের উঁচুগাছ থেকে ঝুলে পড়া লতার একটা বিশাল ঝালর প্রায় নিঃশব্দে কেটে ফেললেন। আমি জানি ওঁর পিঠে আঁটা কিটব্যাগে ভাঁজ করা ধারালো জঙ্গল-নাইফ আছে, তবে বেচুর দা তার চেয়ে সাংঘাতিক।

ওয়াটারড্যামের উঁচু বাঁধ বাঁদিকে রেখে অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পর নৌকো চলল ডানদিকে। জঙ্গলের ভিতরে শীতের ঝরাপাতার স্তূপ দেখা যাচ্ছিল। প্রায় এক ঘন্টা ক্লান্তিকর যাত্রার পর বেচু বলল,ডাকিনিতলার ঝিলের কাছে এসে পড়েছি হুজুর!

কিছুক্ষণ পরে সামনে বিশাল আকাশ চোখে পড়ল। ঝিলের গড়ন ধনুকের মতো বাঁকা। কোথাও-কোথাও ঘন কচুরিপানার ঝক। কর্নেল বললেন,–এবার কফির তৃষ্ণা পেয়েছে। ভোঁদা ওই ব্যাগটা এগিয়ে দে বাবা! জয়ন্ত! তুমি ব্যাগ থেকে কাপটা বের করো। ভোঁদা কফি খেতে পারে না। ওকে আর বেচুকে বরং বিস্কুট বের করে দাও।

দুরে ধানখেত আর ধূসর গ্রাম চোখে পড়ছিল। কফি খেতে-খেতে রোদে এতক্ষণে চাঙ্গা হয়ে উঠলুম। ঝিলের জলের একধারে কোথাও জাল পাতা আছে। ডাইনে উঁচু জমির উপর মাঝে-মাঝে কয়েকঘর করে বসতি দেখা যাচ্ছিল। ঝিলের ঘাটে ছেলেমেয়েরা জল ছিটিয়ে স্নান করছিল। আমাদের দেখে–অবশ্য কর্নেলকে দেখেই বলা উচিত, নিস্পন্দ পুতুল হয়ে যাচ্ছিল।

তারপর আবার একটা কচুরিপানাভরা খালে নৌকো ঢুকল। কর্নেল বাইনোকুলারে একটা গাছের ডালে সারসের ঝাক দেখার পর দ্রুত ক্যামেরার টেলিলেন্স ফিট করে ফেললেন। তারপর কয়েকটা ছবি তুললেন। ঘাটে বাঁধা ঘোট-ঘোট নৌকো কোথাও। বিদেশি ছবিতে দেখা অবিকল ক্যাননা। সেই ক্যানো বেয়ে চলেছে কোনও মেয়ে। কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলুম,–এখানে ক্যাননা দেখছি! আশ্চর্য তো!

কর্নেল মিটিমিটি হাসলেন শুধু। বেচু বলল, “হুজুর! ওগুলোকে বলে ডোঙ্গা। তালগাছের গুঁড়ি খোদাই করে তৈরি।

আবার একটা খালে নৌকো ঢুকল। দুধারে ঘন জঙ্গল। কর্নেল বললেন,–বেচু! কালুখালি আর কতদূর?

বেচু বলল,–এসে গেছি বড়হুজুর। এই খাল থেকেই কালুখালি গ্রাম। সামনে যে বাঁক দেখছেন, তার মুখেই ডাইনে-বাঁয়ে দুটো বসতি।

-তুমি দশরথকে চেনো?

কথাটা শুনেই চমকে উঠলুম। বেচু বলল,–খুব চিনি বড়হুজুর। দশরথ কেন যে এখানে পড়ে আছে কে জানে? ওর হাতের বেতের কাজ কলকাতা অব্দি একসময় চালান যেত। কনকপুরের দত্তবাবুরা ওকে দিয়ে নৌকোবোঝাই মাল নিয়ে যেতেন। তা হুজুর, দশরথের অবিশ্যি দোষ নেইকো। বুড়ো হয়ে গেল। এ তল্লাটে বেতের জঙ্গলও কমে এল। বড়জোর ধামা, চুপড়ি এইসব জিনিস তৈরি করে ওরা কনকপুরে চৈত-সংক্রান্তির গাজনের মেলায় বেচতে যায়। এ সব জিনিস সরু বেতে তৈরি হয়। আগে দশরথরা তৈরি করত মোটা বেতের চেয়ার-টেবিল। এখন অমন বেত খুঁজে পাওয়াই কঠিন।

বাঁকের মুখে গিয়ে ডানদিকের ঘাটে নৌকো রাখল বেচু। একটা গাছের গুঁড়িতে দড়ি দিয়ে নৌকোর ডগার দিকটা বেঁধে দিল। কর্নেল একলাফে নেমে গিয়ে বললেন,–ভোঁদা! ব্যাগটা নিয়ে এসো।

নৌকোর ডগা টলমল করছিল। বেচু তার বাঁশের লগি আমাকে ধরতে বলল। টাল সামলে নেমে গেলুম। কর্নেল বললেন, বেচু! তুমি তোমার নৌকোয় বসে থাকে। আমরা বেশি দেরি করব না।

ঘড়ি দেখলুম। একটা বেজে গেছে। ঢালু পাড় বেয়ে উপরে উঠে দেখি, একদল নানাবয়সি নর-নারী, কাচ্চা-বাচ্চা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেল একজনকে বললেন, দশরথ কোথায়?

অবাকচোখে কর্নেলকে সবাই দেখছিল। যে লোকটাকে কর্নেল দশরথের কথা জিজ্ঞেস করলেন, সে শুধু আঙুল তুলে একটা কুঁড়েঘরের সামনে একটা গাছের তলায় বাঁশের মাচানে বসে থাকা এক বৃদ্ধকে দেখাল।

আমরা তার কাছে যেতেই সে চোখ তুলে তাকাল। কর্নেল বললেন, তুমি দশরথ?

দশরথের পরনে খাটো ধুতি। খালি গা। মোটাসোটা মানুষ। সে বলল,–কে বলছেন আজ্ঞে? চোখে ভালো দেখতে পাইনে।

সেই লোকটা বলল,–দুই সায়েব তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন দাশুখুড়ো! কর্নেল বললেন,–কলকাতা থেকে এসেছি!

দশরথ মাচা থেকে নেমে ঝুঁকে প্রণাম করে বলল, আমার সৌভাগ্য সার! ও রঘু! সারদের বসতে দে। মাদুরখানা এনে মাচানে পেতে দে শিগগির!

কর্নেল দশরথের কাঁধে হাত রেখে বললেন, তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না দশরথ! আমি বসব না। শোনো! আমার এক বন্ধুর হাতে তোমার তৈরি ছড়ি দেখেছিলুম। সেই ছড়ি দেখে আমার খুব লোভ হয়েছে। বুঝলে? মোটা বেতের ছড়ি। মাথার দিকটা ছাতার বাঁটের মতো বাঁকানো। কালো রঙের বাঁট। বাঁটটা ঘোরালে খুলে যায়। কনকপুরের জমিদারবাড়ির সুদর্শনবাবুকে তুমি ওইরকম একটা ছড়ি তৈরি করে দিয়েছিলে। তাই না?

–আজ্ঞে সার! বুঝেছি! তবে ওরকম বেত খুঁজে পাওয়া আজকাল কঠিন!

–তোমাকে আমি অগ্রিম পুরো টাকাই দিয়ে যাব। বলো, কত টাকা দিতে হবে।

দশরথ হাসবার চেষ্টা করে বলল,–কথা দিয়ে যদি কথা রাখতে না পারি সার?

–তুমি পারবে। ওইরকম বেত খুঁজতে হলে তুমি এ বয়সে একা তো পারবে না।

–আজ্ঞে! আমার নাতি কানু এসব খোঁজখবর রাখে!

–তাকে বখশিস দেব। কোথায় সে?

একজন লোক বলল,–কানু আমার ছেলে সার। উনি আমার বাবা। কানু বেত কাটতেই গেছে। আমাদের সার বেত নিয়েই কাজ। দলবেঁধে ওরা জঙ্গলে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। খুব কষ্টের কাজ।

কর্নেল আমাকে অবাক করে দশরথের হাতে একটা একশোটাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললেন, –একশোটাকা রাখো। ছড়ি তৈরি হলে তোমার নাতিকে দিয়ে ইরিগেশন বাংলোর সুখরঞ্জনবাবুকে পৌঁছে দিয়ো। উনি আমাকে কলকাতায় ছড়িটা পৌঁছে দেবেন। ইরিগেশন বাংলো তুমি নিশ্চয় চেনো?

দশরথকে চঞ্চল দেখাচ্ছিল। সে বলল,–চিনি বইকি সার! তবে আগাম টাকা–

কর্নেল তাকে বাধা দিয়ে বললেন,–টাকা নিয়ে ভেবো না। শুনেছি তুমি কমাস আগে কনকপুরের এক ভদ্রলোককেও ওইরকম ছড়ি তৈরি করে দিয়েছ?

দশরথ হাসল।–আজ্ঞে সার! দিয়েছি বটে। অনেক খুঁজে মোটা বেতখানা পেয়েছিলুম।

–কী যেন নাম ভদ্রলোকের?

–দত্তবাবু। বাঞ্ছারাম দত্ত। দশ-বারো বছর আগে ওনাকে মোটা বেতের চেয়ার-টেবিল তৈরি করে দিতুম। নৌকো বোঝাই করে নিয়ে যেতেন। কলকাতায় চালান দিতেন।….

সেচবাংলোয় ফিরতে বিকেল চারটে বেজে গিয়েছিল। সুখরঞ্জনবাবু কর্নেলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, দশরথের সঙ্গে দেখা হল স্যার? কী বলল?

কর্নেল বললেন,–অ্যাডভান্স দিয়ে এসেছি। ছড়ি তৈরি হলে আপনার কাছে পৌঁছে দেবে। আপনি যখন সময় পাবেন, কলকাতা গেলে আমাকে দিয়ে আসবেন।

আমি বলেছিলুম,লোকটা এখনও গরিব থেকে গেছে কেন, বোঝা গেল না!

সুখরঞ্জনবাবু বলেছিলেন,–বন্যা স্যার! দু-একটা বছর অন্তর বন্যা! বন্যায় ওদের ঘর-সংসারের সবকিছু ভেসে যায়। তবু ওখানে না থেকেও ওদের উপায় নেই। শুধু বেত নয়, ওই এলাকায় বাঁশঝাড়ও প্রচুর। বাঁশ থেকেও ওরা কতরকম জিনিস তৈরি করে। বাঁশ অবশ্য কিনতে হয়। বেত কিনতে হয় না। তবে স্যার বলতে নেই–এই ওয়াটারড্যাম করেই বন্যা বেড়ে গেছে। বেশি বৃষ্টি হলেই জল ছেড়ে দেওয়ার অর্ডার আসে। হিতে বিপরীত হয়েছে। তা স্যার, আপনাদের খাওয়াদাওয়া?

কর্নেল বলেছিলেন,–ডাকিনিতলার ঝিলের ধারে নৌকো বেঁধে লুচি-আলুরদমের শ্রাদ্ধ করেছি। বেচু অবশ্য কাছেই তার বাড়িতে খেতে গিয়েছিল।

সুখরঞ্জনবাবু পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন, চাপাগলায় বলেছিলেন, দুপুরে কনকপুর বাজারে গিয়েছিলুম। রানিপুরের একজন চেনা ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তার কাছেই একটা সাংঘাতিক কথা শুনলুম স্যার!

-সাংঘাতিক কথা মানে?

-কাঞ্চনকে কলকাতায় কারা নাকি মার্ডার করেছে। আজ সকালে ওর দাদা প্রাণকান্তবাবুর কাছে খবর এসেছিল। উনি খবর পেয়েই কলকাতা গেছেন।

-বলেন কী? কাঞ্চনবাবুর সঙ্গে আমার তত বেশি চেনাজানা ছিল না। কিন্তু ভদ্রলোক খুন হয়ে গেলেন! আশ্চর্য তো!

–স্যার! আমিও খুব অবাক হয়েছি। খারাপ লাগছে। আফটার অল একসময় আমার ক্লাসফ্রেন্ড ছিল। একটু চাপা স্বভাবের ছেলে ছিল। তবে ওকে ব্যাড বয়দের দলে ফেলা যেত না।

–যাকগে! আমরা ক্লান্ত। ঠাকমশাইকে কফির তাগিদ দিন। হ্যাঁ–একটা কথা শুনে যান। আপনাদের ভোঁদার কানে যেন ওই খারাপ খবরটা না পৌঁছয়।

–আমার মাথাখারাপ স্যার? ভোঁদা বলছিল, কদিন আগে নাকি তাকে কার সঙ্গে কনকপুর বাজারে দেখেছে! ভেঁদার স্বভাব বড় বাজে। পুলিশের কানে গেলে ওকে লক-আপে ঝোলাবে না?

-–ঠাকমশাই রানিপুরের লোক। তাকে বলেছেন নিশ্চয়?

–বলেছি। উনিও অবাক।

–উনি ভোঁদার কানে খবরটা তুলবেন না তো?

সুরঞ্জনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, আমি অলরেডি ঠাকমশাইকে সাবধান করে দিয়েছি।

–বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছেন।

সুখরঞ্জনবাবু চলে গিয়েছিলেন। আমি বাথরুমে ঢুকে গরমজলে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়েছিলুম। কিছুক্ষণ পরে বারান্দা থেকে কর্নেল ডাকলেন,–জয়ন্ত! কফি! নার্ভ চাঙ্গা করে নাও।

বারান্দায় গিয়ে বসলুম। কফিতে চুমুক দিয়ে বললুম,–প্রশ্নটা করার সুযোগ পাইনি। হঠাৎ আপনার মাথায় বেতের ছড়ির বাতিক চাগিয়ে উঠল কেন? আপনার ঘরে অনেক সুন্দর ছড়ি দেখেছি।.একটাও ব্যবহার করতে আজ পর্যন্ত দেখিনি। সুদর্শনবাবুর ছড়িটা নেহাত ছড়ি।

–কুটিরশিল্পের সৌন্দর্য তুমি বুঝবে না জয়ন্ত! তাই ও নিয়ে কোনো কথা নয়। কফি খেয়ে তৈরি হয়ে নাও। বেরুব।

–সর্বনাশ! আবার কোথায় যাবেন?

–কনকপুর!

–পায়ে হেঁটে!

–পায়ে হেঁটে। নৌকোয় পাঁচ-ছঘণ্টা বসে পায়ে বাত ধরে গেছে। পেশি সচল করা দরকার।

–কিন্তু এখনই তো সন্ধ্যা হয়ে এল!

–তাতে কী? কনকপুর পর্যন্ত দুধারে লাইটপোস্ট আছে। ওই দেখো, আলো জ্বলে উঠল।

–কাল সন্ধ্যায় এই আলোগুলো জ্বলতে দেখিনি!

বোধহয় বিদ্যুতের যে ফেস থেকে এই রাস্তার আলো জ্বলে, সেটা খারাপ ছিল। যাই হোক, আলো নিয়ে আলোচনায় লাভ নেই। কর্নেল হাসতে-হাসতে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ঘরে গিয়ে বললেন,–টর্চ নেবে। লোডেড ফায়ার আর্মস সঙ্গে নেবে।

ভিতরে গিয়ে বললুম,–আপনার সেই বনমুরগি বাঁদিকের বন থেকে সাড়া দেবে না তো?

কর্নেল হাসলেন। কাল এসেই বাইনোকুলারে দেখে হিসেব করে নিয়েছি। কনকপুরগামী পিচরাস্তা থেকে বাঁদিকের জঙ্গলের দূরত্ব অন্তত একশো মিটারের বেশি। ডানদিকে অনেকদূর অবধি ধানক্ষেত। তারপর কনকপুরের আগে ডানদিকে বিদ্যুতের সাবস্টেশন। আলোয়-আলোয় ছয়লাপ। তার চেয়ে বড় কথা, চন্দ্র জুয়েলার্স কোম্পানির এজেন্ট কাঞ্চন সেন খুন হয়ে যাওয়ার খবর ইতিমধ্যে রটে গেছে। আর কিছু বলার দরকার আছে কি?

–নাঃ! আমাদের প্রতিপক্ষ সতর্ক হয়ে গেছে।…

ভোঁদা আমাদের সঙ্গী হতে চেয়েছিল। সুখরঞ্জনবাবুও বলেছিলেন,–ওকে নিয়ে যান স্যার। যেখানে যেতে চান, ও সেখানে পৌঁছে দেবে। রিকশাওয়ালারা কাছের জায়গাকে দূর বানিয়ে ছাড়বে।

কর্নেল বললেন,–কনকপুর আমার চেনা জায়গা। ভোঁদাকে দরকার হবে না।

প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা একেবারে জনহীন। বিদ্যুতের সাবস্টেশন পেরিয়ে গিয়ে বাঁদিকে খেলার মাঠ। ক্রিকেট ব্যাট হাতে একদল ছেলে তখনও দাঁড়িয়ে কী নিয়ে তর্কাতর্কি করছে। ডাইনে দোতলা বাড়িটার শীর্ষে আলো জ্বলছিল দেখলুম, বড়-বড় হরফে লেখা আছে ‘ফণিভূষণ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়’।

একটু পরে মানুষজন আর সাইকেলরিকশোর আনাগোনা দেখা গেল। একটা সাইকেলরিকশো দাঁড় করিয়ে কর্নেল বললেন,–থানায় যাব।

রিকশোওয়ালা বলল,–দশ টাকা লাগবে সার!

কর্নেল উঠে বসলেন। তার তাগড়াই গড়নের জন্য পুরো গদিটাই দরকার ছিল। ঠাসাঠাসি চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে বসলুম। কর্নেল রিকশোর হুড তুলে দিলেন। বসতি এলাকার বড় রাস্তায় এই শীতসন্ধ্যাতেও যানবাহন আর মানুষের ভিড়। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ছোট রাস্তায় একটার পর একটা আঁক নিতে-নিতে যেখানে পৌঁছলুম, সেখানে ঘন বসতি নেই। গাছপালার ফাঁকে বাড়িগুলোকে দেখে সরকারি অফিসের কোয়ার্টার মনে হচ্ছিল। তারপর একটা চওড়া রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে রিকশো থামল। রিকশোওয়ালা বলল,–এসে গেছি সার!

ডাকদিকে থানার গেট। গেটে বেয়নেট লাগানো বন্দুক হাতে সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে ছিল। আগে কর্নেল, তারপর আমি নামলুম। রিকশাওয়ালা টাকা পেয়ে সেলাম ঠুকে বলল,–সায়েবদের দেরি না হলে আমি এখানে অপেক্ষা করব। বলুন সার!

কর্নেল বললেন, তুমি চলে যাও। আমাদের অনেক দেরি হবে।

রিকশোওয়ালা রিকশো ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল। কর্নেলকে অনুসরণ করলুম। কয়েকধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে সদর দরজায় পৌঁছে কর্নেল বেঞ্চে বসে থাকা একজন কনস্টেবলকে বললেন,–ও, সি. মিঃ ভাদুড়ির সঙ্গে দেখা করতে চাই।

কনস্টেবল তর্জনী তুলে কোনার একটি ঘর দেখিয়ে দিল। সেই ঘরের দরজার পর্দা তুলে কর্নেল বললেন,–আসতে পারি? আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

–আপনিই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার? আসুন! আসুন স্যার!

কর্নেলের সঙ্গে ভিতরে ঢুকলুম। কর্নেল তাঁর নেমকার্ড এগিয়ে দিলেন। টেবিলের ওধারে একজন মধ্যবয়সি উর্দিপরা অফিসার কার্ডটি দেখার পর উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে কর্নেলের সঙ্গে করমর্দন করলেন। সামনের চেয়ারে একজন ধুতিপাঞ্জাবি পরা স্থূলকায় ভদ্রলোক বসেছিলেন। তাঁর গায়ে শাল এবং মাথায় মাফলার জড়ানো। তিনি কর্নেলকে দেখছিলেন। কর্নেল বললেন,–পরিচয় করিয়ে দিই। আমার তরুণ বন্ধু সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি।

ও. সি. মিঃ ভাদুড়ি আমার সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, আপনারা বসুন প্লিজ! তারপর সেই ভদ্রলোকের দিকে ঘুরে তিনি বললেন, ঠিক আছে অমলবাবু! আমি দেখব কী করা যায়। আপনি কাল বেলা এগারোটার পর একবার টেলিফোন করবেন। আসবার দরকার নেই। নমস্কার।

ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন। তার কাছাকাছি বাঁদিকের চেয়ারে একজন পুলিশ অফিসার ফাইল হাতে বসেছিলেন। মিঃ ভাদুড়ি বললেন, রমেনবাবু! স্বনামধন্য কর্নেলসায়েবের কথা আপনাকে বলেছি। আপনি গেস্টদের পথ্য কফি আর স্ন্যাকসের ব্যবস্থা করুন। ফাইল রেখে যান।

রমেনবাবু তখনই উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমে কর্নেলকে তারপর আমাকে নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন। তারপর মিঃ ভাদুড়ি বললেন, পুলিশ সুপারের মেসেজ পেয়েছি আজ দুপুরে। বিকেলে ভাবছিলুম, ইরিগেশন বাংলোয় আপনার সঙ্গে দেখা করে আসব। আসলে আমার ব্যক্তিগত কৌতূহল। ও. সি. হাসলেন। আপনার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছিলুম আমার এক কলিগের কাছে। তিনি আই. বি.-তে ছিলেন। এখন রিটায়ার করেছেন।

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–গুজবে কান দেবেন না। তো প্রথমেই একটা কথা জেনে নিই। কলকাতা থেকে প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ কে. কে. হালদার এসেছেন। উনি কি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন?

-হ্যাঁ স্যার! আজ দুপুরে এসেছিলেন উনি। ওঁকে প্রয়োজনে সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছি। উনি তো একেবারে ঘটনাস্থলে গেস্ট হয়ে আছেন। ওঁকে সাবধানে থাকতে বলেছি। উনি একটা লোকের চেহারা আর পোশাকের বর্ণনা দিয়েছেন। আমাদের সোর্সকে বলেছি, তাকে শনাক্ত করবে।

-আর-একটা কথা। আপনার এরিয়ায় রানিপুর গ্রামের এক ভদ্রলোক কলকাতায় চাকরি করতেন। কলকাতায় তার ঘরেই কেউ তাকে গত পরশু রবিবার সন্ধ্যায় মার্ডার করেছে।

মিঃ ভাদুড়ি আস্তে বললেন,–হা স্যার। ডি. আই. জি. সায়েবের মাধ্যমে একটা কেস ফাইল হয়েছিল। পুলিশ সুপার ফাইলটা আমার কাছে পাঠিয়েছেন।

-কাঞ্চন সেন সম্পর্কে?

ও. সি. একটু হেসে বললেন, আপনি সম্ভবত আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছেন স্যার!

–জানি না। শুধু জানতে চাইছি, কাঞ্চনবাবু সম্পর্কে খোঁজখবর আপনারা নিয়েছেন কি না।

–কাঞ্চনবাবু ক’দিন আগে কনকপুর এসেছিলেন। আমাদের সোর্স থেকে এ খবর পেয়েছি।

এই সময় একজন কনস্টেবল ও সেই পুলিশ অফিসার ট্রেতে কফি আর পটাটোচিপস, চানাচুর নিয়ে এলেন। ও. সি. বললেন, রমেনবাবু! আমরা কিছু কনফিডেনশিয়াল কথা সেরে নিই। কেমন?

রমেনবাবু ও কনস্টেবলটি তখনই বেরিয়ে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন, –আমার ধারণা, মিঃ হালদার যে লোকটির পরিচয় জানতে চেয়েছেন, রায়বাড়িতে তার অবাধ গতিবিধি আছে। তা ছাড়া, লোকটা সম্ভবত স্থানীয় ব্যবসায়ী বাঞ্ছারাম দত্তের কর্মচারী। আমার ধারণার ভিত্তি আছে মিঃ ভাদুড়ি।

মিঃ ভাদুড়ি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিলেন। আস্তে বললেন,–আই সি!

–আরও বলছি। সে রবিবার সকালের ট্রেনে কলকাতা গিয়েছিল। সেদিন সে কলকাতায় ছিল। সন্ধ্যায় কাঞ্চন সেনকে খুন করে সে সেই রাত্রে কনকপুরে ফিরে এসেছিল। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, আমি তাকে দেখেছি।

–মাই গুডনেস! কোথায় দেখেছেন তাকে?

–গতকাল বিকেলে ইরিগেশন বাংলো থেকে ওয়াটারড্যামের বাঁধের পথে আমি যাচ্ছিলুম। আমার সঙ্গে বাংলোর ভোঁদা নামে একটি ছেলে ছিল। লোকটা আমাকে গুলি করে মারার জন্য ডানদিকের ঢালু জমিতে ঝোঁপের আড়ালে বসে পড়ার আগেই তাকে আমি দেখে ফেলেছিলুম। আমার সামরিক জীবনের অভ্যাস মিঃ ভাদুড়ি! বিশেষ করে বনজঙ্গলে চলার সময় আমি ১৮০ ডিগ্রি বরাবর নজর রাখি।

-তারপর?

–সে তৈরি হওয়ার আগেই আমার লাইসেন্সড সিক্সরাউন্ডার রিভলভার থেকে ঝোঁপের গোড়ায় এক রাউন্ড ফায়ার করেছিলুম। অমনই সে গুঁড়ি মেরে ঝোঁপের আড়াল দিয়ে পালিয়ে যায়। বাইনোকুলারে একটু পরে তাকে জঙ্গলে গা ঢাকা দিতে দেখি। ভোঁদা একটু বোকাসোকা। তাকে বলেছিলুম, বনমুরগি মারতে গুলি করলুম। বনমুরগিটা পালিয়ে গেল।

-ও মাই গড! কর্নেলসায়েব! শয়তানটা কে আমি তা বুঝতে পেরেছি। আজ রাতেই তাকে লক-আপে ঢোকাব। আপনি প্লিজ ঘটনাটা উল্লেখ করে একটা ডায়রি করুন। কারণ তার গার্জেন প্রভাবশালী লোক।

–করছি। এবার বলুন, রায়বাড়ির গৃহদেবীর মুকুট আর জড়োয়া নেকলেস চুরির কেসে কি এগোতে পারছেন না?

–সমস্যা হল, প্রাথমিক তদন্তের পর মনে হয়েছিল ওঁদের দুই ভাইয়ের মধ্যে যে-কোনো একজন চুরি করে জুয়েলস বিক্রি করে দিয়েছেন। দুই ভাইকে জেরা করা হয়েছে প্রথমে পৃথক-পৃথকভাবে। পরে দুজনকে একসঙ্গে পাশাপাশি বসিয়ে জেরা করা হয়েছে। এতটুকু সন্দেহজনক কথার আভাস মেলেনি। দ্বিতীয় দফায় ওঁদের কাজের নোক গোবিন্দ ও হরিপদকে সরাসরি অ্যারেস্ট করেছিলাম। কিন্তু তাদের কাছেও কোনো সন্দেহজনক সূত্র পাইনি। অগত্যা আপাতত জামিনে ছেড়ে দিয়েছি। তবে একটা ক্ষীণ সূত্র ওঁদের কাজের মেয়ে শৈলবালার কাছে পেয়েছিলুম। বছর তিনেক আগের কথা। সন্ধ্যা থেকেই লোডশেডিং ছিল। সুদর্শনবাবুর ঘরের তালা সেই সুযোগে কেউ ভাঙছিল। শৈলবালা নাকি চাপা শব্দটা শুনেই উঠোন পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে চুপি-চুপি উঠে যাচ্ছিল। সিঁড়িতে কেউ তাকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়।

–কিন্তু তারপরও তো মহালক্ষ্মীর জুয়েলস চুরি যায়নি।

–যায়নি। তবে শৈলবালার সন্দেহ, সে-ই পরে জুয়েলস চুরি করেছে।

–লোকটাকে কি শৈলবালা চিনতে পেরেছিল?

–আবছা আঁধারে লোকটাকে চেনা মনে হয়েছিল তার। কিন্তু সাহস করে কাউকে বলতে পারেনি। যদি সত্যিই সেই লোকটা না হয়?

মিঃ ভাদুড়ি হেসে উঠলেন। কর্নেল বললেন, আপনাদের কি সে বলেছে, কোন লোকটার কথা সে ভেবেছিল?

মিঃ ভাদুড়ি আরও হাসলেন। তারপর বললেন,–শৈলবালা ভেবেছিল সুদর্শনবাবুই তাকে সিঁড়িতে ধাক্কা মেরে পালিয়ে গিয়েছিলেন। বিদ্যুৎ আসার পর তিনিই নাকি বাড়ি ফিরে এসে হইচই বাধান!

কর্নেলও হাসলেন। –নিজেই নিজের ঘরের তালা কেন ভেঙেছিলেন সুদর্শনবাবু, এ বিষয়ে শৈলবালার কী ধারণা?

-আপনাকে বলেছি, শৈলবালার সন্দেহ অনুসারে সুদর্শনবাবুই চোর। জেরার পর শৈলবালা বলেছে, আগে থেকে নিজেকে–শৈলবালার ভাষায় ‘নিদুষি’–অর্থাৎ নির্দোষ সাব্যস্ত করে রাখার মতলবে কাজটা তাদের ছোটবাবু করে থাকতে পারেন।

-ছোটবাবু, মানে সুদর্শনবাবু?

-হ্যাঁ। শৈলবালার কথার অর্থ দাঁড়ায় : এভাবে একটা ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করে রেখেছিলেন ছোটবাবু! পয়েন্টটা অবশ্য উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

হুঁ৷ যায় না।–কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন।–এর সঙ্গে কাঞ্চন সেনের সম্প্রতি কনকপুরে আসার ব্যাপারটা জুড়ে দিলে একটা কেস দাঁড় করানো যায়!

মিঃ ভাদুড়ি আস্তে বললেন, আপনি কাঞ্চন সেনের ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে এসেছেন বলে আমার ধারণা। ভদ্রলোক কলকাতার এক বিখ্যাত জুয়েলারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন।

–চন্দ্র জুয়েলার্স কোম্পানির এজেন্ট ছিলেন। চোরাই জুয়েলস কেনা-বেচার যোগসূত্র এই এজেন্টরা। মিঃ ভাদুড়ি! কাঞ্চন সেন এখানে এসে রায়বাড়িতে ওঠেননি, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

–আপনি সিওর?

–হ্যাঁ, আমার হাতে তথ্য আছে, কাঞ্চন সেন গত শুক্রবার এসে সেদিনই কলকাতা ফিরে যান। তারপর আবার শনিবার এখানে আসেন এবং সেদিনই কলকাতা ফিরে যান। রবিবার সন্ধ্যায় তাকে মার্ডার করা হয়। আগেই বলেছি, তার চেনা লোক তাঁকে মার্ডার করেছে।

–খুনিকে আজ রাত্রেই ধরে ফেলব।

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,–অবশ্য যদি সে কনকপুরে থাকে!

–দেখা যাক।

–কাঞ্চন সেনের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আমার একটা অতিরিক্ত দায়িত্ব আছে। আমি অনুশোচনায় ভুগছি মিঃ ভাদুড়ি! সেই কারণে তার খুনি শিগগির ধরা পড়ুক, এটা আমি চাই। হাতের কার্ড আমি নাকি পুলিশকে দেখাই না বলে পুলিশমহলে একটা ধারণা আছে। আমি আপনাকে অন্তত এ ব্যাপারে আমার হাতের কার্ড দেখাতে চাই।

মিঃ ভাদুড়িকে বিস্মিত লক্ষ করছিলুম। আমিও বিস্মিত। কারণ কর্নেলের মধ্যে এমন ভাবাবেগ আমি কখনও দেখিনি। মিঃ ভাদুড়ি বললেন,–বলুন স্যার! আমার পক্ষ থেকে যতটা করা সম্ভব আমি করব।

কর্নেল জ্যাকেটের ভিতর থেকে কাঞ্চন সেনের সেই কার্ডটা মিঃ ভাদুড়িকে দেখতে দিলেন। তারপর তিনি কার্ডটা ফেরত নিয়ে গত রবিবার বিকেলে তার অ্যাপার্টমেন্টে কাঞ্চন সেনের কার্ড ফেরত নিতে আসার ঘটনা সবটাই বললেন। কিন্তু কার্ডটা কীভাবে তার হাতে এসেছিল, সেই অংশটা চেপে গেলেন। মিঃ ভাদুড়ি! কাঞ্চন সেন আমাকে যে নাম-ঠিকানা লিখে দিয়েছিলেন, তা এখনই আপনাকে জানাচ্ছি না। আমার বিশ্বাস, এই নাম-ঠিকানা আপনারা নিজেরাই পেয়ে যাবেন। কাঞ্চন সেনের খুনি নিশ্চয় আমার বাড়ি পর্যন্ত গোপনে তাঁকে ফলো করে গিয়েছিল। তারপর সে কাঞ্চন সেনের ঘরে তার সঙ্গে দেখা করার ছলে যায়। আমার পরিচয় খুনি তার মালিকের কাছে আগেই পেয়েছিল।

–আপনি সিওর হলেন কী করে?

যথাসময়ে জানতে পারবেন। এরপর খুনি কাঞ্চন সেনের কাছে যায়। কার্ড হারিয়ে চাকরি যাওয়ার আশঙ্কায় কাঞ্চন সেনের মানসিক অবস্থা সুস্থ থাকার কথা নয়। আমার ধারণা, খুনির সঙ্গে তার বন্ধুতার সম্পর্ক ছিল। কারণ কনকপুর হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন কাঞ্চনবাবু। এমন হতেই পারে, কথায়-কথায় তিনি খুনিকে জানিয়েছিলেন, কার্ড আমার কাছে আছে। তা ফেরত পাওয়ার শর্তও মুখ ফসকে তিনি বলে ফেলেছিলেন। কাজেই মালিকের নির্দেশমতো খুনি চিরকালের জন্য তার মুখ বন্ধ করে দেয়। তারপর–

মিঃ ভাদুড়ি কর্নেলের কথার ওপর বললেন,–তারপর সে চিরকালের জন্য আপনার মুখও বন্ধ করার জন্য ওয়াটারড্যামের কাছে জঙ্গলে ওত পেতে বসে ছিল।

ঠিক তা-ই।–বলে কর্নেল ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়ালেন। একটা কথা। রায়বাড়ির দুই ভাই কে কোথায় চাবি লুকিয়ে রেখেছিলেন, তা জিজ্ঞেস করেছিলেন কি?

ও. সি. মিঃ ভাদুড়িও উঠে দাঁড়ালেন। একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ। তবে ওঁরা একে অন্যকে লুকিয়ে গোপনে আমাকে জানিয়েছেন। দেখিয়েছেনও।

কর্নেল হাসলেন। বড়বাবু পুরোনো শাস্ত্রীয় বৃহৎ পঞ্জিকার ভিতরে গর্ত কেটে আর ছোটবাবু তাঁর ছড়ির ভিতরে চাবি লুকিয়ে রাখতেন।

–আমি আপনার কথায়.অবাক হচ্ছি না স্যার! শুনেছি, পিছনেও আপনার একটা চোখ আছে।

–নাঃ। প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদার আমার সোর্স, মিঃ ভাদুড়ি!

মিঃ ভাদুড়ি চেয়ার থেকে উঠে এলেন। আপনারা এখন কি সেচ-বাংলোয় ফিরে যাবেন?

–হ্যাঁ। দেখি, কোনো রিকশোওয়ালাকে রাজি করাতে পারি নাকি!

–ওদের তো একটা জিপগাড়ি আছে! আপনি বললেই নিশ্চয় পেতেন।

–ইঞ্জিনিয়ার মিঃ গোস্বামী গাড়িটা দিতে চেয়েছিলেন। আমি নিইনি।

–ঠিক আছে। রমেনবাবুকে বলছি, আমাদের গাড়িতে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবেন। শীতের রাত্রে ইরিগেশন বাংলোতে যেতে কোনো রিকশোওয়ালাই রাজি হবে বলে মনে হয় না।

পা বাড়িয়ে হঠাৎ কর্নেল ঘুরে দাঁড়ালেন। আস্তে বললেন,–কাল সকাল দশটা থেকে তৈরি থাকবেন। যে-কোনো সময় আপনার সদলবলে রায়বাড়ি যাওয়ার দরকার হতে পারে।

মিঃ ভাদুড়ি হাসলেন। আবার বলছি, অবাক হচ্ছি না স্যার! পুলিশ সুপার মিঃ রাজেশ কুমার আমাকে প্রায় হুমকি দিয়ে রেখেছেন, আপনার কাছে যা-কিছুই শুনি, যেন মাথা ঠিক রাখি। মাই গুডনেস! এক মিনিট স্যার! আপনাকে একটা ডায়রি করতে বলেছিলুম। ভুলে গেছি। স্বার্থটা আমারই। একটা আইনগত ভিত্তি থাকা দরকার।

তিনি টেবিলের কাছে গিয়ে একটা প্যাড টেনে নিলেন। আপনি সংক্ষেপে চিঠির মতো করে ঘটনাটা লিখে দিয়ে সই করুন। আমাকে অ্যাড্রেস করে লিখবেন। ততক্ষণে আমি রমেনবাবুকে জিপের ব্যবস্থা করতে বলি।…

সেচবাংলোয় ফিরে গিয়ে দেখি, হালদারমশাই নীচের ঘরে সোফায় বসে আছেন। পাশে একটা মাঝারি সাইজের ব্যাগ। আমাদের দেখে তিনি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন–ওপরে চলেন কর্নেলস্যার। সব কইতাছি।

দোতলায় আমাদের ঘরে ঢুকে তিনি শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বললেন, সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎ দুই ভাইয়ে কী লইয়া ঝগড়া বাধছিল। আমি থামাইতে গেছলাম। দুইজনেই আমারে কইলেন, ওনাগো ডিটেকটিভের দরকার নাই। আমিই নাকি ওনাগোর মইধ্যে গণ্ডগোল বাধাইতে আইছি। কর্নেলস্যার! আমারে অকারণে দুইজনে ইনসাল্ট করল। হেভি মিস্ত্রি!…

হালদারমশাইয়ের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল আমাদের পাশের ঘরে। সকাল আটটায় বাসুদেব ঠাকুর বেড-টি এনে আমার ঘুম ভাঙিয়েছিলেন। তিনি বললেন,–বড়সায়েব আর হালদারসায়েব ভোরবেলা বেড়াতে বেরিয়েছেন। ভোঁদাকে সঙ্গে নেননি বলে বেচারা মনমরা হয়ে বসে আছে।

ঠাকমশাই হাসতে-হাসতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। বেড-টি খেতে-খেতে মনে পড়েছিল গত রাত্রে কর্নেল ও. সি. মিঃ ভাদুড়িকে আজ সকাল দশটা থেকে তৈরি থাকতে বলেছেন। যে-কোনো সময়ে তাকে সদলবলে রায়বাড়ি যেতে হতে পারে। তা হলে কি আজ হালদারমশাই-কথিত ‘হেভি মিস্ট্রি’-র পর্দা তুলবেন কর্নেল?

উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে উঠেছিলুম। বাথরুম সেরে সেজেগুজে বারান্দায় গিয়ে বসেছিলুম। কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ও গোয়েন্দাপ্রবরকে গেটে ঢুকতে দেখলুম। ওপরে এসে কর্নেল অভ্যাসমতো সম্ভাষণ করলেন, মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।

বললুম,–মর্নিং কর্নেল! হাড়কাঁপানো শীতের ভোরে হালদারমশাইকে ওয়াটারড্যামের হিম খাইয়ে জব্দ করেছেন। তাই না হালদারমশাই?

হালদারমশাই সহাস্যে বললেন,–আমাদের জব্দ করে কেডা? পঁয়তিরিশ বৎসরের পুলিশ-লাইফে অনেক ড্যাঞ্জারাস হিম খাইছি।

তিনি আমার পাশের চেয়ারে বসলেন। কর্নেল ঘরে ঢুকে গেলেন। বললুম,–প্রাতঃকৃত্য করবেন না?

–প্রাতঃকৃত্য কইরাই বাইরাইছিলাম।

চুপি-চুপি বললুম,–কর্নেল বলেননি, আজ দশটায় রায় বাড়ি যাবেন?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ হাসিমুখে বললেন,–ওয়েট অ্যান্ড সি।

একটু পরে ভোঁদা কফি আর স্ন্যাক্সের ট্রে এনে টেবিলে রাখল। তার মুখটা বেজায় গম্ভীর। সে চলে যাচ্ছিল। কর্নেল বেরিয়ে এসে ডাকলেন,–ভোঁদা! তুমি খেয়েদেয়ে তৈরি থেকো। আমরা সাড়ে ন’টা নাগাদ বেরুব। আর শোনো! আমাকে যে জিনিসগুলো দেখিয়েছিলে, সেগুলো একটা চটের ব্যাগে ঢুকিয়ে নেবে। রাত্রে সুখরঞ্জনবাবুকে বলে রেখেছি। তার কাছে চটের থলে পেয়ে যাবে।

ভোঁদার মুখে হাসি ফুটল। সে বলল,–সুকুবাবু কঁকপুরে পাঁজা কঁত্তে না? ছাঁইকেঁলে না?

–বুঝেছি। নটার মধ্যে উনি এসে যাবেন।

ভোঁদা থপথপ করে চলে গেল। বললুম,–কী ব্যাপার? ভোঁদা চটের ব্যাগে কী নেবে?

কর্নেল চেয়ারে বসে কফির পেয়ালা তুলে চুমুক দিলেন। তারপর বললেন,–হেভি মিস্ট্রি! কী বলেন হালদারমশাই?

গোয়েন্দাপ্রবর শুধু বললেন,–হঃ!….

বেলা ন’টায় কর্নেলের নির্দেশমতো তৈরি হয়ে নীচে ডাইনিংরুমে গেলুম। আমাদের ব্রেকফাস্টের সময় সুখরঞ্জনবাবু সাইকেলে থলে ভর্তি বাজার করে ফিরলেন। তিনি হাসিমুখে ঘোষণা করলেন,–ঠাকমশাই! আজ সায়েবদের পাতে তাবড় তাবড় পাবদা মাছ সার্ভ করতে পারবেন। ভাগ্যিস, কেতো-জেলেকে বাজারে ঢোকার মুখেই ধরে ফেলেছিলুম।

ভোঁদা বলল,–সুকুবাবু! হুঁ-হঁ-হঁটের ব্যা–

সুখরঞ্জনবাবু কপট চোখ রাঙিয়ে বললেন,–এই ভোঁদড়টাকে নিয়ে পারা যায় না!

ব্রেকফাস্টের পর আমরা বেরিয়ে পড়লুম। ভোঁদার হাতে চটের থলেতে কী আছে কে জানে! সে যে কর্নেলের কাছ ঘেঁষে ভালুকের মতো হেঁটে চলল। আমরা প্রায় অর্ধেক রাস্তায় পৌঁছেছি, একটা জিপগাড়ি আসতে দেখলুম। কাছাকাছি এসে গাড়িটা দাঁড়াল। সাব-ইন্সপেক্টর রমেনবাবু নেমে ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে নির্দেশ দিলেন। তারপর কর্নেলকে নমস্কার করে বললেন,–ও. সি. সায়েব আপনাকে খবর দিতে বলেছেন, যে লোকটার কথা আপনি বলেছিলেন, তাকে গত রাত্রে তিনটে নাগাদ অ্যারেস্ট করা হয়েছে।

–কোথায়?

–কৃষ্ণগঞ্জে। আমাদের সোর্স তাকে পরশু বিকেলে বাসস্ট্যান্ডে কৃষ্ণগঞ্জের বাসে চাপতে দেখেছিল। সেখানে ওর একটা ডেরা আছে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–হালদারমশাই! আপনি খুশি হতে পারেন।

গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, আমি যার কথা কইছিলাম, সে ধরা পড়ছে?

–হ্যাঁ। ঠিক আছে রমেনবাবু! আমরা পায়ে হেঁটেই যাব। আপনি মিঃ ভাদুড়িকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন।

রমেনবাবু বললেন,–গাড়ি থাকতে হাঁটবেন কেন স্যার?

–একটু সতর্কতা দরকার।

–বেশ তো! পাওয়ার সাবস্টেশনের কাছে আপনাদের নামিয়ে দিয়ে যাব। বলে রমেনবাবু ভোঁদার দিকে তাকালেন। এ কোথায় যাবে? মনে হচ্ছে, ইরিগেশন বাংলোতে একে দেখেছি।

–রমেনবাবু! এর নাম ভোঁদা। আমার ভাগ্য! একজন বিশ্বস্ত সহযোগী পেয়ে গেছি।

রমেনবাবু হাসতে-হাসতে বললেন,–আমরা পিছনে বসছি! জয়ন্তবাবু! মিঃ হালদার! আমাদের পিছনে বসতে হবে। ভোঁদা! তোর হাতে ওটা কী?

কর্নেল বললেন,–অ্যাটম বোমা রমেনবাবু! ওটা ছোঁবেন না প্লিজ!

কর্নেল সামনে বসলেন। আমরা পিছনে। এই জিপগাড়িটা গত রাতেরটা নয়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমরা বিদ্যুৎ সাবস্টেশনের কাছে পৌঁছে গেলুম। আমাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা বাঁদিকে বাঁক নিয়ে উধাও হয়ে গেল। কর্নেল বললেন,–হালদারমশাই আমাদের গাইড।

হালদারমশাই বললেন,–আপনারে যা কইছি কর্নেলস্যার! একটু দূরের থেইক্যা বাড়িখান দেখাইয়া দিমু। আমারে দেখলে ওনারা হয়তো আবার ইনসাল্ট করবেন!

–ঠিক আছে। তবে আপনাকে যেতে হবে ও-বাড়ি। আপনি লক্ষ রাখবেন। জয়ন্ত একসময়ে বেরিয়ে একটুখানি দাঁড়াবে। আপনি ঠিক তখনই সোজা গিয়ে ঢুকবেন।

খেলার মাঠের ডানদিক ঘুরে ছোট রাস্তা, তারপর বড় রাস্তা দিয়ে মিনিট দশেক হাঁটার পর হালদারমশাইয়ের নির্দেশমতো বাঁদিকে ঘুরে কিছুটা এগিয়ে গেলুম। এদিকটা কনকপুরের শেষপ্রান্ত মনে হচ্ছিল। একটা বিশাল বটগাছের তলায় শিবমন্দির। সেখানে দাঁড়িয়ে হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন,–ডাইনে রাস্তায় আউগাইয়া কারেও জিগাইবেন। গেট আছে। পুরানো দোতলা বাড়ি। উঁচা বাউন্ডারিওয়াল আছে। দ্যাখলেই বোঝবেন। গেটে ‘রায়ভবন’ লেখা আছে। আর কী কমু?

ডাইনে রাস্তাটা একসময় পিচে মোড়া ছিল। এখন খানা-খন্দে শ্রীহীন অবস্থা। পশ্চিমে এগিয়ে বাড়িটা চোখে পড়ল। দক্ষিণমুখী পুরোনো দোতলা বাড়ি। মাঝামাঝি গেট। ফাটলধরা গেটের মার্বেলফলকে ‘রায়ভবন’ লেখা। ওপরে বুগেনভেলিয়ার ঝাপি। গেটের মরচে ধরা গরাদের সামনে কর্নেল দাঁড়াতেই একটা লোক এসে বলল,–সায়েবদের কোথা থেকে আসা হচ্ছে আজ্ঞে?

কর্নেল বললেন, কলকাতা থেকে। সুদর্শনবাবুকে খবর দাও!

–ছোটবাবু ওদিকে পুকুরের মাছ ধরাচ্ছেন সার! বড়বাবুকে ডাকব?

–তাই ডাকো। ওপর থেকে কেউ বলল,–কে রে হরিপদ?

–বড়বাবু! এনারা কলকাতা থেকে এসেছেন।

বুগেনভেলিয়ার ঘন ঝাপির জন্য গেট থেকে দোতলা দেখা যাচ্ছিল না। কর্নেল বললেন,–এই কার্ডটা নিয়ে গিয়ে বড়বাবুকে দেখাও হরিপদ।

হরিপদ গেট খুলল না। গরাদের ফাঁক দিয়ে সে কর্নেলের হাত থেকে তাঁর নেমকার্ড নিয়ে চলে গেল। বললুম,–অদ্ভুত তো!

কর্নেল হাসলেন।–অদ্ভুত কিছু নয়। মুখ বুজে থাকবে।

প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এবং গায়ে শালজড়ানো একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোককে দেখা গেল। তিনি করজোড়ে নমস্কার করে বললেন,–নমস্কার! নমস্কার! তা হলে সত্যিই কর্নেলসায়েবের পায়ের ধুলো পড়ল রায়বাড়িতে? ও হরিপদ! গেট খুলিসনি কেন হতভাগা! সায়েবকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস?

হরিপদ গেট খুলল। আমরা ভিতরে ঢুকলুম। কর্নেল বললেন, আপনি সুরঞ্জনবাবু?

–হ্যাঁ কর্নেলসায়েব! ইনি বুঝি সেই সাংবাদিক ভদ্রলোক? গত রাত্রে কলকাতা থেকে ঝন্টু ট্রাঙ্ককল করেছিল। আপনি পৌঁছেছেন কি না জিজ্ঞেস করছিল। আরে! এটা আবার কে?

কর্নেল বললেন, আমি ইরিগেশন বাংলোয় উঠেছি। ছেলেটি সেখানে কাজ করে। আমাদের রায়ভবন চিনিয়ে দেবে বলে একে নিয়ে এলুম। এর নাম ভোঁদা!

সুরঞ্জনবাবু বললেন,–অ্যাই ভোঁদা! বাড়ি চিনিয়ে দিয়েছিস, বেশ করেছিস! তা সায়েবদের সঙ্গে তুই ঢুকলি কেন? বেরো বলছি!

কর্নেল একটু হেসে বললেন,–ভোঁদা আমার সারাক্ষণের সঙ্গী। আসবার পথে কিছু কেনাকাটা করেছি। ওর চটের ব্যাগে রাখা আছে।

সুরঞ্জনবাবু ঘুরে বললেন,–হরিপদ! হাঁ করে কী দেখছিস! বসবার ঘরের দরজা খুলে দে শিগগির! আসুন কর্নেলসায়েব! আর আপনার নামটা কী যেন?

আমি পকেট থেকে আমার একটা নেমকার্ড বের করে দিলুম। উনি পড়ে দেখে বললেন, হ্যাঁ, জয়ন্ত চৌধুরি। ঝন্টুই বলেছিল। আসুন! দেখতেই পাচ্ছেন, কী অবস্থায় বেঁচে আছি। স্কুল থেকে রিটায়ার করেছি দুবছর আগে। এখনও পেন্ডিং-এর ফাইল আটকে আছে। ভাগ্যিস কিছু জমিজমা, বাগান-পুকুর বাবা রেখে গিয়েছিলেন।

গাড়িবারান্দা দেখে বোঝা গেল, একসময় রায় পরিবারের গাড়ি ছিল। গাড়িবারান্দার তলা দিয়ে কয়েকধাপ সিঁড়ি বেয়ে গোলাকার ছোট্ট বারান্দায় উঠলুম। হরিপদ দরজা খুলে দিয়েছিল ততক্ষণে। ভিতরে ঢুকে দেখি প্রশস্ত একটা ঘর। একপাশে পুরোনো সোফাসেট। দেওয়ালে টাঙানো; পূর্বপুরুষদের অয়েলপেন্টিং অস্পষ্ট হয়ে গেছে। তারপর চোখে পড়ল দুদিকের দেওয়াল ঘেঁষে কয়েকটা আলমারি। তাতে বাঁধানো প্রকাণ্ড সব বই ঠাসা আছে। কর্নেল সোফায় বসে বললেন–আপনার কাকা ওকালতি করতেন শুনেছি। আইনের বইগুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছেন।

সুরঞ্জনবাবু বললেন, হ্যাঁ। কাকাবাবু কৃষ্ণনগর জনকোর্টে অ্যাডভোকেট ছিলেন। তাঁর গাড়ি ছিল। এখান থেকে গাড়িতে যাতায়াত করতেন। বাইশ কিলোমিটার দূরত্ব। বাবা নিষেধ করতেন। কৃষ্ণনগরে একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে পরামর্শ দিতেন। কিন্তু কাকা একটু জেদি মানুষ ছিলেন। আমাদের বংশের এই রোগটা আছে। তো শেষ অব্দি গাড়িই তাঁকে খেল।

–অ্যাকসিডেন্ট?

–হ্যাঁ। হরিপদ! বললুম না নান্টুকে খবর দে! আর মোনাঠাকুরকে বলে যা, সায়েবদের জন্য চা-টা শিগগির নিয়ে আসে যেন।

–আপনি বসুন!

–বসব। তা যা বলছিলুম। কাকাবাবু আসলে ভাবতেন, কনকপুর ছেড়ে দূরে থাকলে বাবা একা সব সম্পত্তি ভোগ করবেন।

–আপনার কাকাবাবুর ফ্যামিলি?

–সেটাই বলতে যাচ্ছিলুম। খুব ট্র্যাজিক ঘটনা। অ্যাকসিডেন্টের সময় তার গাড়িতেই কাকিমা আর তার ছেলে ছিল। বছর তিনেক বয়স। কাকিমার বাপের বাড়ি চণ্ডীতলায় পৌঁছে দিয়ে কাকাবাবুর কৃষ্ণনগর যাওয়ার কথা ছিল। আর কী বলব?

সুরঞ্জনবাবু জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, আপনারা বসুন! আমি আসছি।

তিনি ভিতরের দরজা দিয়ে চলে গেলেন। দেখলুম, ভোঁদা দরজার পাশে হাঁটুমুড়ে বসে আছে। কর্নেল ঘরের ভিতরটা দেখছিলেন। আস্তে বললেন, এই আইনের বইগুলোর দাম অন্তত সে-আমলেই লক্ষাধিক টাকা। এত বই! অথচ ভদ্রলোক এখানে বসেই ওকালতি করতেন!

বললুম,–এই এরিয়ার সব মক্কেল নিশ্চয় ওঁর হাতে ছিল।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে চাপাস্বরে বললেন, নাকি পূর্বপুরুষের মহালক্ষ্মীর জুয়েলস ওঁর এখানে থাকার কারণ? জয়ন্ত! সম্ভবত সুদর্শনবাবু জানেন না, দু-জোড়া চাবি ওঁর ঠাকুরদাই তার দুই ছেলের জন্য তৈরি করিয়েছিলেন।

বলে তিনি ছবিগুলো দেখতে গেলেন। ডাইনে ও বাঁয়ে আলমারির ওপরে উঁচুতে ছবিগুলো টাঙানো আছে। আর আলমারিগুলোর জন্য দুপাশের দেওয়াল ঢাকা পড়েছে। ওদিকে সম্ভবত কোনো জানলা নেই। কর্নেল ছবিগুলো দেখার পর সোফায় এসে বসলেন।

সেইসময় হন্তদন্ত হয়ে সুদর্শনবাবু ঘরে ঢুকলেন। কী আশ্চর্য! নমস্কার কর্নেলসায়েব! আপনি আসছেন না! এদিকে আপনার প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোক কাল একটা ঝামেলা বাধিয়ে এক কাণ্ড করে বসেছিলেন।

–কী কাণ্ড বলুন তো?

–এ বাড়ির কে নাকি ওঁকে গোপনে বলেছে, তিনবছর আগে আমার ঘরের তালা আমি নাকি নিজেই ভেঙেছিলুম। কিন্তু তার চেয়ে সাংঘাতিক কথা–গত মহালয়ার আগের দিন শৈলবালা পাঁচিলের কাছে একটা সাপ দেখে চ্যাঁচামেচি করছিল। তখন আমি নীচে নেমে গিয়েছিলুম। সেইসময় দাদা নাকি আমার ঘর থেকে আমার ছড়িটা নিয়ে সাপ মারতে আসছিল। হালদারবাবুকে কে এসব কথা বলেছে, জানি না। আমার মেজাজ তো জানেন! আপনাকে অলরেডি বলেছি সে কথা!

–আপনি আপনার দাদাকে চার্জ করে বসলেন?

-হ্যাঁ। তারপর দু-ভায়ে প্রায় হাতাহাতির উপক্রম। সেই সময় বাঞ্ছুদা নামে এক ভদ্রলোক–দাদার বন্ধু উনি এসে পড়ে মিটিয়ে দিলেন। ডিটেকটিভদ্রলোকের পরিচয় দিতুম না। কিন্তু রাগের বশে–বুঝতেই পারছেন!

-বাঞ্ছুবাবুই কি মিঃ হালদারকে চলে যেতে বললেন?

-উনি কী করে বলবেন? উনি দাদাকে যত, আমাকে তত বকাবকি করে চলে গেলেন। পুলিশ যা পারল না, একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ তা পারে? বাঞ্ছুদা ঠিকই বলেছেন মনে হল। সাপ মারবার জন্য দাদা আমার ঘর থেকে মোটা বেতের ছড়িটা আনতে যেতেও পারেন, এই ভেবে আমি দাদাকে খামোকা চার্জ করেছিলাম। কারণ সাপটা হরিপদ মারার পর আমার ঘরে গিয়ে ছড়িটা ব্র্যাকেটে একই অবস্থায় ঝোলানো দেখেছিলুম।

–আর সেই চাবির চাপা শব্দ শুনতে পেতেন তো!

–হ্যাঁ। বিকেলে ক্লাবে যাওয়ার সময় অভ্যাসমতো শব্দটা টের পেয়েছি।

–বাড়ির লোকেদের আপনারা জিজ্ঞেস করেননি, কে মিঃ হালদারকে এসব কথা বলেছে।

–করব না আবার? প্রত্যেকে মহালক্ষ্মীর দিব্যি কেটে বলেছে, সে বলেনি।

এইসময় শীর্ণকায় যে লোকটি চা-টা নিয়ে এলেন, তিনিই মোনাঠাকুর। সুদর্শনবাবু তাকে বললেন,–চা না কফি?

ঠাকুরমশাই বললেন,–বড়বাবু চা পাঠাতে বলেছিলেন! বলে তিনি চলে গেলেন।

সুদর্শনবাবু বললেন,–সরি কর্নেলসায়েব! আমার ঘরে আপনার জন্য কফি এনে রেখেছি।

–ঠিক আছে। চা-ই খাওয়া যাক। আপনার পুকুরে মাছ ধরার কাজ শেষ হয়েছে?

–দাদাকে যেতে বললুম। মাছের ব্যাপারীকে ওজন করে দিতে হবে। এদিকে আপনারা এসেছেন। এ বেলা দু-মুঠো–

বলে তার চোখ পড়ল ভোঁদার দিকে।–এই! কে রে তুই?

কর্নেল বললেন,–ইরিগেশন বাংলোয় কাজ করে ছেলেটা। আমি সঙ্গে এনেছি। কিছু কেনাকাটার ব্যাপার ছিল। তো আপনার কি মাছের ব্যাপারীর কাছে যাওয়া দরকার?

–একটুখানি দরকার বইকি। আপনারা চা খান। আমি শিগগির আসছি।

বলে সুদর্শনবাবু আবার হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন। চায়ের কাপ হাতে কর্নেল উঠে গিয়ে আবার সেই ছবিগুলো দেখতে-দেখতে কখনও একটু থেমে, কখনও কয়েক-পা এগিয়ে আবার পিছিয়ে এসে একটু থেমে, ডাইনে থেকে বাঁদিকে ঘোরাঘুরির পরে সোফায় এসে বসলেন। আমি বললুম,–ছবিগুলো আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কেন বলুন তো?

কর্নেল সে-প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, তুমি বেরিয়ে গিয়ে গেটের ওখানে একটু দাঁড়িয়ে চলে এসো। গেট খুলে রাখবে। হালদারমশাই না এসে পড়লে নাটক জমবে না।

একটু দ্বিধার সঙ্গে তার নির্দেশ পালন করতে গেলুম।…

.

গোয়েন্দাপ্রবর ঘরে ঢুকে সোফার এককোণে বসলেন। তারপর কর্নেলকে দেওয়ালে টাঙানো একটা বিশাল ছবি দেখিয়ে বললেন,–রায়বাহাদুর!

কর্নেল বললেন,–বাঁ-দিকে তিননম্বর বলেছিলেন আপনি!

হালদারমশাই বললেন,–ঘরে আলো জ্বালে নাই ক্যান? ওনারা কই গেলেন?

–পুকুরের ধারে মাছ ধরিয়ে বিক্রি করছেন।

হালদারমশাই অমনই উঠে ছবিটার কাছে গেলেন। তখনই ফিরে এসে বললেন,–ভুল করছিলাম। চাইর নম্বর। রাত্রে এটুখানি দেখা। হঃ! রায়বাহাদুর। সুদর্শনবাবু আগের দিন কইছিলেন, ওনার ঠাকুরদার ঠাকুরদা রায়বাহাদুর ছিলেন।

ওঁদের এসব কথা বুঝতে পারছিলুম না। একটু পরে মোনাঠাকুর চায়ের সরঞ্জাম নিতে এসে হালদারমশাইকে দেখে কেন কে জানে মুচকি হেসে চলে গেলেন। তারপর এল হরিপদ। সে হালদারমশাইকে দেখে গম্ভীর মুখে বলল,আপনি আবার এসেছেন বাবুমশাই! আবার ঝামেলা বাধবে।

বলে সে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল। কর্নেল বলবেন,–তোমার কর্তাবাবুদের কাজ শেষ হয়নি হরিপদ?

–হয়েছে আজ্ঞে! ছোটবাবু আমাকে ঘরে আলো জ্বেলে দিতে বললেন। ওনারা এক্ষুনি এসে যাবেন।

সে চলে যাওয়ার একটু পরে দুই ভাই ঘরে ঢুকলেন। তারপর গোয়েন্দাপ্রবরকে দেখে দুজনেই থমকে দাঁড়ালেন। সুরঞ্জনবাবু গম্ভীরমুখে বললেন, আপনি আবার এসেছেন? কর্নেলসায়েব! ওঁকে চলে যেতে বলুন!

সুদর্শনবাবু দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন,–কেলেংকারি হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি! কর্নেলসায়েবের খাতিরে গায়ে হাত তুলছি না। বেরিয়ে যান বলছি। নইলে গোবিন্দকে ডাকব।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনারা মিঃ হালদারের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করেছিলেন। কিন্তু লিখিতভাবে কন্ট্রাক্ট বাতিল করেননি। প্রাইভেট ডিটেকটিভদের ব্যাপারে একটা সরকারি আইন আছে। আমাকে মিঃ হালদার বলছিলেন, কারণ দেখিয়ে কন্ট্রাক্ট বাতিল করতে হয়। তা না হলে উনি ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন।

সুরঞ্জনবাবু বাঁকা হেসে বললেন, ঠিক আছে। আপনি যখন বলছেন, তা-ই করছি। নান্টু! একটা কাগজ এনে দাও।

সুদর্শনবাবু বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল এবার গম্ভীরমুখে বললেন, একজন স্থানীয় বিশিষ্ট লোককে ডাকতে হবে। তিনি কন্ট্রাক্ট বাতিলের কাগজে সাক্ষী হিসেবে সই করবেন। আপনার বন্ধুদের মধ্যে তেমন কেউ নিশ্চয় আছেন?

সুরঞ্জনবাবু বললেন,–এমন আইন আছে নাকি?

-আছে। আপনি পুলিশকে ফোন করে জেনে নিতে পারেন।

সুদর্শনবাবু এক্সারসাইজ খাতার একটা পাতা ছিঁড়ে এনে সুরঞ্জনবাবুকে দিলেন। সুরঞ্জনবাবু বললেন–নান্টু! কর্নেলসায়েব বলছেন, কন্ট্রাক্ট বাতিলের কাগজে কোনো বিশিষ্ট লোককে সাক্ষী রাখতে হবে। এই নাকি আইন।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ সুদর্শনবাবু! বরং আমার কথা যাচাই করতে থানায় টেলিফোন করুন। পুলিশকে বলুন আমি এখানে আছি। না-না! নিঃসন্দেহ হওয়া উচিত। আপনি ফোন করে আসুন।

লক্ষ করলুম, কর্নেল সুদর্শনবাবুর দিকে তাকিয়ে কথা বলার সময় চোখের ভঙ্গিতে যেন কী ইশারা করলেন। সুদর্শনবাবু ফোন করতে যাচ্ছেন দেখে সুরঞ্জনবাবু বললেন,–নান্টু! বাঙ্কুবাবুকেও একটা ফোন করে এখনই আসতে বলো! ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকছে। বাঙুরও আসা দরকার।

একপ্রান্তে সুরঞ্জনবাবুর অ্যাডভোকেট কাকার সেক্রেটারিয়েট টেবিল আছে। উল্টোদিকের চেয়ারে বসে তিনি বললেন,–বলুন কর্নেলসায়েব! কী লিখতে হবে।

কর্নেল বললেন,–বেশি কিছু না। বাংলায় লিখলেও চলবে। স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লিখুন : প্রাইভেট ডিটেকটিভ শ্রী কে. কে. হালদার মহাশয়ের সহিত আমাদের গৃহদেবী মহালক্ষ্মীর গহনা উদ্ধারের জন্য যে চুক্তি করিয়াছিলাম, তাহা এতদ্বারা বাতিল করিলাম। কারণ তিনি এই কার্য করিতে গিয়া আমাদের পরিবারে অহেতুক মনোমালিন্য ও বিরোধ বাধাইয়া সমস্যার সৃষ্টি করিয়াছেন।

কর্নেলের এইসব কথা লিখতে সুরঞ্জনবাবুর মাত্র মিনিট পাঁচেক সময় লাগল। কাগজটা তিনি কর্নেলকে দিয়ে বললেন,–বাইশ বছর স্কুলমাস্টারি করেছি কর্নেলসায়েব! আশা করি বানান ভুল নেই!

কর্নেল কাগজটা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন,–এর তলায় তারিখ দিয়ে আপনি ও সুদর্শনবাবু সই করবেন। বাঁদিকে সাক্ষী সই করবেন।

সুদর্শনবাবু একটু পরে ফিরে এলেন। বললেন,–ও. সি. থানায় ছিলেন। তিনি বললেন, আইনে এইরকম ব্যবস্থা আছে!

সুরঞ্জনবাবু বললেন–বাঙ্কুবাবুকে পেলে?

-হ্যাঁ। উনি এক্ষুনি আসছেন।

–এসো। আমি সই করেছি। তুমি তলায় সই করো। তারিখ লিখে দিয়ে।

দুজনে সই করার পর কর্নেল একটু হেসে বললেন,–মিঃ হালদার পূর্ববঙ্গের লোক। ওঁর সামনেই বলছি। একসময় পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন। ওঁর দাপটে চোর-ডাকাতরা এলাকা ছেড়ে পালাত। আইনকানুন ওঁর মুখস্থ। উনি হঠাৎ এসে পড়বেন জানতুম না। এসেই আমাকে বলছিলেন, ক্ষতিপূরণের কে করবেন আপনাদের বিরুদ্ধে। আমি ওঁকে বুঝিয়ে শান্ত করেছি।

সুরঞ্জনবাবু বললেন,–কাল রাত্রে ঝন্টু ট্রাঙ্ককলে বলছিল, আপনাকে যেন এই কেসের দায়িত্ব দিই। আপনার সঙ্গে কি কন্ট্রাক্ট করতে হবে?

-নাঃ! সুদর্শনবাবু! আপনি বসুন। মিঃ হালদারের সঙ্গে নিষ্পত্তি হয়ে গেলে আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলব। তো বাঙ্কুবাবুর বাড়ি কতদূরে?

সুরঞ্জনবাবু বললেন,–তত কিছু দূরে নয়। ওই মোটরসাইকেলের শব্দ শুনছি। হরিপদ! ও হরিপদ!

হরিপদ দরজায় উঁকি মেরে বলল,–আজ্ঞে বড়বাবু!

-–গেট খুলে দে। বাঙ্কুবাবু আসছেন মনে হচ্ছে।

একটু পরে বাইরে মোটরসাইকেলের শব্দ থেমে গেল। সুরঞ্জনবাবু উঠে গিয়ে বললেন, –এসো বাঞ্ছু! বড্ড ঝামেলায় পড়ে গেছি।

তার সঙ্গে বেঁটে স্থূলকায় একজন ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। কর্নেলকে দেখেই উনি থমকে দাঁড়ালেন।–এঁরা কারা?

–কলকাতা থেকে ঝন্টু এঁদের পাঠিয়েছেন। উনি কর্নেলসায়েব! পরে বলছি।

–ডিটেকটিভদ্রলোক আবার এসে ঝামেলা পাকিয়েছেন?

সুরঞ্জনবাবু কাগজটা তাঁকে দেখিয়ে বললেন, এখানে তুমি উইটনেস হিসেবে একটা সই দাও বাঞ্ছু! নান্টু থানায় ফোন করেছিল। ও. সি. সায়েব বলেছেন এটাই নাকি আইন।

বাঞ্জুবাবু একটা চেয়ারে বসে সই করে দিলেন। সুরঞ্জনবাবু কাগজটা হালদারমশাইকে দিয়ে বললেন,–এবার দয়া করে কেটে পড়ুন মশাই।

হালদারমশাই কাগজটা কর্নেলকে দিয়ে বললেন,–আর-একবার দেইখ্যা দিন কর্নেলস্যার!

কর্নেল কাগজটা হাতে নিয়েছেন, এমনসময় ও. সি. মিঃ ভাদুড়ি, এস. আই. রমেনবাবু এবং আরও একজন অফিসার ঘরে ঢুকলেন। বারান্দায় একদঙ্গল কনস্টেবলও এসে দাঁড়াল।

বাঙ্কুবাবু আড়ষ্টভাবে হেসে বললেন,–কী ব্যাপার স্যার? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না?

ও. সি. মিঃ ভাদুড়ি বললেন,–আপনার বাড়ি হয়েই আসছি দত্তবাবু! আপনাকে আমাদের দরকার।

বাঞ্ছারাম দত্ত করজোড়ে বললেন,–বলুন স্যার!

–কর্নেলসায়েব! আপনি এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আগে কথা বলে নিন।

কর্নেল জ্যাকেটের ভিতর থেকে কাঞ্চন সেনের কার্ডটা বের করে বললেন,–দেখুন তো দত্তবাবু। এই কার্ডটা চিনতে পারেন কি না।

দত্তবাবু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন,–ওটা কীসের কার্ড স্যার?

কলকাতার বিখ্যাত চন্দ্র জুয়েলারি কোম্পানির এজেন্ট কাঞ্চন সেনের কার্ড। তাকে আপনি কয়েক লক্ষ টাকার জুয়েলারি বিক্রির খবর দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। গত সপ্তাহে শুক্রবার কাঞ্চনবাবু আপনার বাড়ি এসেছিলেন। কিন্তু জুয়েলারি তাকে সেদিন দেখানোর অসুবিধে ছিল বলেই আমার ধারণা। কারণ ওগুলো তখনও আপনার কাছে পৌঁছয়নি। তা ছাড়া, চোরাই জুয়েলারি। একটা ঝুঁকি ছিল, আপনি তা জানতেন। তাই জুয়েলারি চুরির দায় অন্যের কাঁধে চাপানোর জন্য আপনি কাঞ্চনবাবুর পকেট থেকে কোনো সুযোগে তার কার্ডটা চুরি করেছিলেন। কাঞ্চনবাবু কলকাতা ফিরে গিয়ে টের পান তার এজেন্ট-কার্ড চুরি গেছে। পরদিন শনিবার তিনি ২৯৭ আপনার কাছে এসেছিলেন। কিন্তু কার্ডের হদিস পাননি। রবিবার সুদর্শনবাবু তার মাসতুতো ভাই ঝন্টুবাবুর নির্দেশে কলকাতায় আমার কাছে গিয়েছিলেন। বাসে কিংবা ট্রেনে আপনার লোক তার ব্যাগে কার্ডটা গোপনে ভিড়ের মধ্যে গুঁজে দেয়। হা-সুরঞ্জনবাবু আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সুরঞ্জনবাবুই আপনাকে জানিয়েছিলেন, তার ছোটভাই কোথায় যাচ্ছেন। আপনি সুরঞ্জনবাবুর কাছেই জেনে নিয়েছিলেন, সুদর্শনবাবু ব্যাগে মহালক্ষ্মীর ছবি আমাকে দেখাতে নিয়ে যাবেন। সুদর্শনবাবু ছবি বের করলেই চন্দ্র জুয়েলারি কোম্পানির এই বিশেষ কার্ড বেরিয়ে পড়বে। সুদর্শনবাবু কার্ড দেখে চমকে উঠবেন। আমিও কার্ডটা দেখব। এই কার্ড দেখার পর সুদর্শনবাবু আমার সন্দেহভাজন হবেন। কিন্তু ছবি বের করার সময় কার্ডটা ছিটকে পড়েছিল সুদর্শনবাবুর পায়ের নীচে। তিনি তা লক্ষ করেননি। তিনি চলে যাওয়ার পর কার্ডটি আমি দেখতে পেয়েছিলুম। আর-একটা কথা। কাঞ্চনবাবু কার্ড হারানোর পর আমার কাছে গিয়েছিলেন। তিনি নিজের হাতে আপনার নাম-ঠিকানা লিখে দিয়েছিলেন।

ও. সি. মিঃ ভাদুড়ি বললেন,–দত্তবাবুর সেই লোককে আমরা অ্যারেস্ট করেছি। সে জেরার মুখে সব স্বীকার করেছে। কাঞ্চনবাবু আপনাকে শনিবার এসে কার্ড না পেয়ে হুমকি দিয়ে গিয়েছিলেন, কার্ড না পেলে তিনি আপনাকে চোরাই জুয়েলারির কেসে ফাসাবেন। তাই রবিবার আপনার লোক, অর্থাৎ কুখ্যাত বাবু ঘোষকে আপনি কলকাতা পাঠিয়েছিলেন। সে কাঞ্চনবাবুর একসময় ক্লাসফ্রেন্ড ছিল। অনেক চোরাই জুয়েলারি সে কাঞ্চনবার সাহায্যে বিক্রি করেছে। আপনার হুকুম ছিল, বেগতিক দেখলেই তাকে যেন বাবু ঘোষ খতম করে। শেষপর্যন্ত বাবু ঘোষ তা করেছে। তাকে আমরা খুনের দায়ে ধরেছি। এবার আপনার পালা! রমেনবাবু! বাঞ্ছারাম দত্তকে অ্যারেস্ট করুন।

রমেনবাবু বাঞ্ছারাম দত্তের কাছে এসে সহাস্যে বললেন,–আপনাকে গ্রেফতার করা হল। আপনি মানী লোক। চলুন! আমাদের গেস্টহাউসে থাকবেন। একটু কষ্ট হবে। কিন্তু উপায় কী?

বলে তিনি কনস্টেবলদের ডাকলেন, রামভকত! সুরেন্দ্র! এঁকে প্রিজনভ্যানে নিয়ে যাও। একমিনিট। কই দত্তবাবু! শালের ভেতর থেকে হাতদুটো বের করুন।

দত্তবাবুর দুটো হাতে তিনি হ্যান্ডকাফ এঁটে দিলেন। কনস্টেবলরা দত্তবাবুকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ও. সি. মিঃ ভাদুড়ি বললেন,–রামভকত! দত্তবাবুকে একটু পরে নিয়ে যাবে। কর্নেলসায়েব! বলুন!

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন,–দত্তবাবু! আপনি পাঁচখালি এলাকার কালুখালিতে দশরথের কাছে অর্ডার দিয়ে একটা বেতের ছড়ি তৈরি করেছিলেন! অবিকল সুদর্শনবাবুর মতো ছড়ি।

দত্তবাবু বলার ভিতরে বললেন,–তাতে কী হয়েছে?

কর্নেল সবাইকে অবাক করে ভোঁদাকে বললেন,–ভোঁদা! তোমার থলে দাও!

ভোঁদা চটের থলেটা নিয়ে এল। কর্নেল থলেতে হাত ভরে যে জিনিসগুলো বের করলেন, তা একটা বেতের ছড়ির ভাঙাচোরা খানিকটা অংশ। শুধু ঘোরানো কালো রঙের বাঁটটা আস্ত আছে। কিছু অংশে মাটি লেগে আছে। বোঝা যায়, শুকনো কাদা।

কর্নেল হাসলেন। –এগুলো শ্রীমান ভেঁদার আবিষ্কার। দুর্গাপুজোর কিছুদিন আগে ভোঁদা সন্ধ্যার একটু আগে কনকপুর থেকে সেচবাংলোতে ফেরার সময় দুর থেকে দেখেছিল, দত্তবাবু জঙ্গল থেকে বেরিয়ে তার মোটরসাইকেলে চেপে তার পাশ দিয়ে চলে গেলেন। এই ছেলেটা স্বভাবে খুব কৌতূহলী! ছোটবেলা থেকে সে সর্বচর। মঙ্গলবার ভোরে মর্নিংওয়াকে আমার সঙ্গে বেরিয়ে সে এই গোপন ঘটনাটা বলেছিল। তার সঙ্গে গিয়ে এগুলো একটা ঝোঁপের ভিতরে দেখতে পেলুম। তার ঢোলা প্যান্টের দুই পকেটে ভরে এগুলো তাকে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখতে বললুম। আমার মাথায় একটা থিয়োরি এসেছিল। তার সত্যতা যাচাই করতেই কালুখালিতে দশরথের কাছে গিয়েছিলুম। তার পর সিওর হয়েছিলুম।

সুদর্শনবাবু নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি ফুঁসে উঠলেন। তা হলে কিছুদিন ধরে আমার ছড়ির বদলে বাঞ্ছুদার ছড়িটা আমার ঘরের ব্র্যাকেটে ঝোলানো ছিল! ডিটেকটিভদ্রলোক ঠিক বলেছিলেন। সাপ মারার দিন কে দেখেছিল, দাদা আমার ঘর থেকে আমার ছড়িটা বের করে আনছিল! দাদা! এখনও বলছি, খুলে বলো! তুমিই ছড়ি বদল করেছিলে! হ্যাঁ-তুমি! তুমি! তুমি!

সুদর্শনবাবু দাপাদাপি জুড়ে দিলেন। ও. সি. মিঃ ভাদুড়ি তাকে জোর করে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললেন,–চুপচাপ বসে থাকুন। চ্যাঁচামেচি পরে করবেন।

কর্নেল বললেন,–হালদারমশাই! আপনার ব্যাগ থেকে এবার আপনার আবিষ্কৃত জিনিসগুলো বের করুন।

গোয়েন্দাপ্রবর তার ব্যাগের চেন খুলে খবরের কাগজের মোড়ক বের করলেন। তারপর তিনি মোড়ক খুললেন। দেখলুম, একগাদা আধপোড়া কাগজ। তিনি বললেন,–এগুলি আমি পাইছিলাম রায়বাবুগো পুকুরের পাড়ে। ঝোঁপের মইধ্যে লুকানো ছিল।

মিঃ ভাদুড়ি পরীক্ষা করে বললেন,–ছাপানো বইয়ের পাতা মনে হচ্ছে।

কর্নেল উঠে গিয়ে সেই রায়বাহাদুরের ছবির তলায় একটা আলমারির কাঁচের কপাট হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেললেন। তারপর বললেন,–হালদারমশাইয়ের কুড়িয়ে পাওয়া কাগজগুলো পরীক্ষা করে বুঝতে পেয়েছিলুম, আইনের বইয়ের পাতা। এ ঘরে ঢুকে দেখে নিয়েছি, এই দুটো প্রকাণ্ড বই লাইন থেকে একটু এগিয়ে ও পিছিয়ে আছে। অনেকদিন আগে রাখা বই আলমারির র‍্যাকে রাখলে ময়লার রেখা পড়বে। এই দুটো বই সেই রেখা মুখে দিয়েছে।

দুটো বই বগলদাবা করে তিনি টেবিলে রাখলেন। একটা বইয়ের ভিতরে চৌকো করে কাটা গভীর একটা অর্ধবৃত্তাকার অংশ বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু সেখানে কিছু নেই। কর্নেলকে চঞ্চল ও উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। তিনি দ্বিতীয় বইটা খুললেন। চৌকো গভীর গর্ত দেখা গেল। কিন্তু এটাতেও কিছু নেই।

মিঃ ভাদুড়ি বললেন,–টেলড দিয়ে অনেক পরিশ্রম করে কাটা গুপ্তস্থান। কিন্তু শূন্য কেন?

কর্নেল বললেন,–এই বইটার মধ্যে মহালক্ষ্মীর হীরকখচিত সোনার মুকুট লুকানো ছিল। তাই এই বইয়ের গর্তটা অর্ধবৃত্তাকার। আর দ্বিতীয় বইটার মধ্যে মহালক্ষ্মীর জড়োয়া নেকলেস ছিল। এর গর্তটা চৌকো।

বলে কর্নেল ডাকলেন,–সুরঞ্জনবাবু!

সুরঞ্জনবাবু মুখ নামিয়ে বললেন,–বলুন!

–আপনি পুরোনো প্রকাণ্ড শাস্ত্রীয় পঞ্জিকার ভিতরের পাতা কেটে গর্ত করে নিজের চাবিদুটো লুকিয়ে রেখেছিলেন। ও. সি. মিঃ ভাদুড়িকে তা দেখিয়েছিলেন।

গোয়েন্দাপ্রবর বললেন,–আমারেও তা দ্যাখাইছেন উনি!

কর্নেল বললেন,–এ কাজে আপনার দক্ষতা আছে। কিন্তু আপনার কাকাবাবুর দুটি আইনের বইয়ের ভিতর লুকিয়ে রাখা দুটি জুয়েলস কোথায় গেল?

সুরঞ্জনবাবু ভাঙা গলায় বললেন,–আমি বুঝতে পারছি না। বিশ্বাস করুন! এ কী অদ্ভুত কাণ্ড।

সুদর্শনবাবু গর্জন করলেন,–নিজেরই চুরি করে লুকিয়ে রাখা জিনিস কোথায় গেল বুঝতে পারছ না? ন্যাকা? ও. সি. সায়েব! কর্নেলসায়েব! বাঞ্ছারাম দত্তের বাড়ি সার্চ করলেই মাল বেরিয়ে পড়বে। কাল বিকেলে ক্লাবে যাওয়ার সময় আমি দেখেছি, আমার মহাপুরুষ দাদা দত্ত-বাড়িতে চুপিচুপি ঢুকে গেল।

সুরঞ্জনবাবু মিনমিনে গলায় বললেন,–না-না! আমারও অবাক লাগছে, এ কাজ কে করল? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না।

ও. সি. মিঃ ভাদুড়ি বললেন,–তার মানে আপনি স্বীকার করছেন বইদুটোর মধ্যে মহালক্ষ্মীর মুকুট আর জড়োয়া নেকলেস লুকিয়ে রেখেছিলেন?

সুরঞ্জনবাবু এবার দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলেন।–আমি পাপী। আমি মহাপাপী। ওই বাঞ্ছুর প্ররোচনায় আমি ফাঁদে পা দিয়েছিলুম।

এই সময় ভিতর থেকে এক ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর ঘরের ভিতরে চোখ বুলিয়ে সবাইকে দেখে নিয়ে বললেন, কী হয়েছে? এত কান্নাকাটি কীসের?

সুদর্শনবাবুও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন,বউদি! আমি কল্পনাও করিনি, আমার দাদা–

তাকে ভদ্রমহিলা ধমক দিলেন।–চুপ করো! দাদা-অন্তপ্রাণ একেবারে! তোমাকে সাবধান করে দিইনি, দত্তবাবু কেন দুবেলা রায়বাড়ি আসছে, খোঁজখবর নাও?

বুঝলুম, এই মহিলাই সুরঞ্জনবাবুর স্ত্রী শোভারানি। তিনি দত্তবাবুর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললেন,–বাঃ! বেশ মানিয়েছে এতদিনে। কত লোককে ফাঁদে ফেলে সর্বনাশ করে এবার নিজেই ফাঁদে পড়েছে বাঙুরাম। কই? কর্নেলসায়েব কোথায়?

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বললেন,–শোভাদেবী! আমি সব বুঝতে পেরেছি। চলুন। রায়বাড়ির গৃহদেবী মহালক্ষ্মীকে এবার আমরা গিয়ে দর্শন করি। হীরকখচিত সোনার মুকুট আর জড়োয়া নেকলেস পরা ছবি আমি দেখেছি। এবার সেই প্রতিমাকে একই বেশে দেখতে পাব। মিঃ ভাদুড়ি! দত্তবাবুকে লক-আপে পাঠিয়ে দিন।

এই সময় হালদারমশাই খুব চাপাস্বরে কর্নেলকে বললেন,–আমারে হুমকি দেওয়া চিঠির হাতের লেখার সঙ্গে সুরঞ্জনবাবুর হাতের লেখার মিল দেখলাম।

কর্নেল হাসলেন।–হ্যাঁ, সেইজন্য এত কাণ্ড করতে হল।

ও. সি. মিঃ ভাদুড়ি এস. আই. রমেনবাবুকে নির্দেশ দিয়ে বললেন,–তপনবাবু! আমেদসায়েব! আপনারা এখানে থাকুন। আমরা আসছি। চলুন সুরঞ্জনবাবু! আপনার সম্পর্কে কী করা যায়, পরে ভেবে দেখা যাবে। সুদর্শনবাবু! আমার মনে হচ্ছে, এখনই আপনার ঘরে গিয়ে আপনার ছড়িটি পরীক্ষা করে দেখা দরকার।

সুদর্শনবাবু সবার আগে হন্তদন্ত বেরিয়ে গেলেন।…

দোতলায় উঠে দেখি, সুদর্শনবাবু একহাতে তাঁর বেতের ছড়ি অন্য হাতে ছড়ির কালো বাঁট নিয়ে তেমনই হন্তদন্ত এগিয়ে আসছেন। তিনি হাঁপাতে-হাঁপাতে বললেন–আমার চাবি নেই! আমার চাবিদুটো চুরি গেছে।

শোভাদেবী ধমক দিলেন।–চুপ করো নান্টু! আর চাবি-চাবি কোরো না। তোমরা দুভাই জানো না। কিন্তু শৈলবালা সাক্ষী! মৃত্যুর আগের দিন শ্বশুরমশাই আমাকে দু-জোড়া চাবিই গোপনে দিতে চেয়েছিলেন। তখন আমার বয়স কম। সাহস করে চাবি রাখতে পারিনি। এবার থেকে আমার কাছে চাবি থাকবে।

সুরঞ্জনবাবু মিনমিনে গলায় বললেন,–আমার চাবিজোড়াও নিয়েছ তুমি?

চুপ! একটি কথাও নয়।–বলে তিনি কোমরের কাছ থেকে দুজোড়া চাবি বের করে সিঁড়ির পূর্বের ঘরের দরজা খুললেন। তারপর ভিতরে ঢুকে আলো জ্বেলে দিলেন। এঘরের কোনো জানলা নেই। দ্বিতীয় কোনো দরজাও নেই।

কনেমিঃ ভাদুড়ি এস. আহ.মর আসছি। চলুন সুরঞ্জনবাবু শুনার ঘরে গিয়ে দেখলুম আমাদের পিছনে ভোঁদাও উঠে এসেছে। চোখে চোখ পড়লে সে নিঃশব্দে হাসল।

শোভাদেবী দেওয়ালের মধ্যে বসানো আয়রনচেস্ট দুটো চাবির সাহায্যে খুললেন। তারপর মেঝেয় মাথা লুটিয়ে প্রণাম করে দুহাতে রুপোর চৌকো থালায় বসানো দেবী মহালক্ষ্মীকে বের করলেন। কষ্টিপাথরে তৈরি ছোট্ট প্রতিমার মাথায় রত্নখচিত মুকুট আর গলা থেকে হাঁটু অব্দি ঝোলানো জড়োয়া নেকলেস আলোয় ঝলমল করে উঠল।

সুরঞ্জনবাবু আর সুদর্শনবাবু মাথা লুটিয়ে প্রণাম করলেন। শোভাদেবী বললেন,–ও. সি. সায়েব, কর্নেলসায়েব। এবার আপনারা কী বলবেন, বলুন!

ও. সি. মিঃ ভাদুড়ি একটু হেসে বললেন, আপনার স্বামী রাজসাক্ষী হবেন! আর কী বলব? আপনার গোয়েন্দাগিরির কাছে হার না মেনে উপায় নেই। কী বলেন কর্নেলসায়েব? মিঃ হালদার?

কর্নেল চুপ করে থাকলেন। হালদারমশাই বললেন,–ঠিক কইছেন মিঃ ভাদুড়ি! এতদিনে বুঝলাম, ওনাগো ক্যান গৃহলক্ষ্মী কয়!

মিঃ ভাদুড়ি আমার দিকে ঘুরে বললেন-জয়ন্তবাবু! আপনি তো সাংবাদিক! আমার ধারণা, পুরো ঘটনাটি আপনি আপনাদের পত্রিকায় লিখবেন। তাই না?

কর্নেল সহাস্যে বললেন,–জয়ন্ত রোমহর্ষক গপ্পো লিখে ফেলবে। ওকে একটু সতর্ক করে দেওয়া উচিত।

বলে তিনি পিছনে ঘুরলেন। অ্যাই ভোঁদারাম! উঠে পড়ো বাবা! রায়বাড়ির মহালক্ষ্মী দেবী দর্শন করতে চেয়েছিলে। দর্শন হয়ে গেছে। আর কী?

ভোঁদা এতক্ষণ ধরে উপুড় হয়ে মেঝেয় মাথা ঠেকিয়ে ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে সে তেমনই নিঃশব্দে হাসল। সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, প্রতিমার মূল্যবান রত্নরাজির চেয়ে একটি অনাথ, সরল ও নিষ্পাপ তরুণের এই হাসি অনেক বেশি উজ্জ্বল। অনেক বেশি মূল্যবান।…

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments