Friday, April 19, 2024
Homeবাণী-কথামৃত্যুদণ্ড - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মৃত্যুদণ্ড – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

অনেকের কাছে মনে হবে, লোকটির অপরাধ অতি সামান্য। কিন্তু রাগে আমার গা জ্বলে গিয়েছিল!

ট্রেনে যাচ্ছিলাম হাজারিবাগ। রাত্তিরের ট্রেন, তেমন কিছু ভিড় নেই। কামরাটি মোটামুটি পরিচ্ছন্ন, আলোর জোর আছে। বই পড়া যাবে, সুতরাং যাত্রাটা বেশ আরামদায়কই হওয়ার কথা।

ট্রেন ছাড়ার আগে একটা ব্যাপার নিয়ে গোলমাল চলেছিল খানিকক্ষণ, ওপরের মালপত্র রাখবার জায়গায় একজন যাত্রী এক গাদা কাপড়ের গাঁঠরি রেখে সব জায়গাটা ভরে ফেলেছে। অন্য যাত্রীরা মালপত্র রাখার একটুও জায়গা পাচ্ছে না। একজন লোক এত বেশি মালপত্র এনে এতখানি জায়গা দখল করবে কেন? এই নিয়ে কয়েকজন রাগারাগি করতে লাগল।

সেই যাত্রীটি ধুতি ও সাদা শার্ট পরা। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, সে একগুঁয়ের মতন একটা মালও নামাল না, বারবার হিন্দিতে বলতে লাগল, আমি আগে এসেছি, মালপত্র রাখার জায়গায় কি রিজার্ভেশন থাকে?

কেউ-কেউ পালটা যুক্তি দিয়ে বললে বেশি মালপত্র থাকলে লাগেজ ভ্যানে বুক করা নিয়ম। কিন্তু লোকটি এসব কথায় কানইদিল না।

লোকটিকে দেখলে মনে হয়, ছোটখাটো কাপড় ব্যবসায়ী, গাঁঠরিগুলোতে সে ধুতি শাড়ি নিয়ে চলেছে। আমি একা, সঙ্গে ছোট একটা ব্যাগ, সেটা সিটের নীচেই রাখা যায়, আমার কোনও অসুবিধে হয়নি।

সুতরাং আমি ওই ঝগড়ার মধ্যে মাথা না গলিয়ে চুপচাপ শুনে চললাম।

ট্রেন চলতে শুরু করতেই অবশ্য আস্তে-আস্তে সব থেমে গেল। অন্যদের সুটকেস বেডিং কোনওরকমে অন্য জায়গায় ঠেসে ঠুসে দেওয়া হল। দু-একজন একটুক্ষণ রাগে গরগর করে কয়েকটা বাঁকা-বাঁকা কথা বলল। কিন্তু সেসব ওই গাঁঠারিওয়ালার গায়ে বিধছে বলে মনে হল না।

বেশ ঝলমলে রঙের ছাপা শাড়ি পরা এক মহিলা জানলার ধারে বসে আগাগোড়া তাকিয়েছিল বাইরের দিকে, ঝগড়ার সময় একবারও মুখ ফেরায়নি। তার উলটো দিকের জানলার পাশেই রয়েছে কাপড়ের ব্যবসায়ীটি। কিছুক্ষণ বাদে ঝুঁকে পড়ে সে মহিলাটির সঙ্গে কিছু একটা কথা বলতেই বোঝা গেল, ওরা স্বামী-স্ত্রী।

আগেভাগে স্টেশনে এসে ওরা শুধু ওপরের তাক মালপত্র বোঝাই করেনি, ভালো-ভালো দুটি বসবার জায়গাও দখল করেছে।

যখনকার কথা বলছি, তখন সেকেন্ড ক্লাসকে বলা হতো থার্ড ক্লাস। সেই থার্ড ক্লাসের বেশ কিছু কামরায় সিট রিজার্ভেশনের কোনও বালাই ছিল না। যার যেমন খুশি বসে পড়ত। কেউ-কেউ বিছানা পেতে ফেলে অনেকটা জায়গা নিয়ে নিত।

মহিলাটির মাথায় ঘোমটা দেওয়া। সর্বাঙ্গে ঢাকাঢুকি দেওয়া থাকলেও বোঝা যায় শরীরের গড়নটি বেশ ভালো।

আমি বসেছি তার ঠিক পাশেই। মহিলাটির মুখ দেখার জন্য যে-কোনও পুরুষেরই কৌতূহল হবে।

দেখাও গেল। ঘি-এর মতন রং, টানাটানা চোখ, নাকটিও চোখা। সুন্দরীই বলা যায়। খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা কাপড়ের ব্যবসায়ীটির স্ত্রী একেবারেই মানায় না।

তবে, মহিলাটির নাকে একটা বড় নোলক, চুল তেল জবজবে, মুখ থেকে গ্রাম্যতার ছাপ একটুও মোছেনি। হয়তো বিহারের কোনও প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে, কিংবা উত্তর প্রদেশের। এইসব গ্রামের কোনও মেয়ে যদি হঠাৎ খুব সুন্দরী হয়ে যায়, তাহলে শহরের কেউ-না-কেউ টাকার জোর দেখিয়ে তাকে বিয়ে করে নিয়ে যাবেই।

কোনও ভালো জিনিসই গ্রামের জন্য নয়। গ্রামের ভালো-ভালো তরি-তরকারি মাছ মুরগি যেমন শহরে চালান হয়ে যায়, তেমনি সুন্দরী মেয়েরাও চালান হয়ে যাবে, এতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?

কাপড়ের ব্যবসায়ীটি অত কাপড় সঙ্গে নিয়ে চলেছে, কিন্তু নিজের পোশাক বেশমলিন। বউটির শাড়িটি খুব দামি না হলেও তার রঙের উজ্জ্বলতা চোখটানে। তার গায়ের রঙের সঙ্গে বেশ মানিয়েছে।

কিছুক্ষণ বাদে স্বামীর নির্দেশে বউটি তার পাশ থেকে একটা পুঁটুলি বার করে সেটা খুলল।

আমি যদিও একটা বই খুলে পড়ছি, কিন্তু মাঝে-মাঝে পাশের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। বইটি বেশ কঠিন, জেমস জয়েসের ইউলিসিস। আগে যতবার পড়তে শুরু করেছি, শেষ করতে পারিনি। তাই সেবারে ঠিক করেছিলাম, সঙ্গে আর কোনও বই রাখব না। যাওয়া আসার ট্রেন যাত্রায় বইটি শেষ করতেই হবে। কোনও একটা বই, ভালো জেনেও অর্ধসমাপ্ত রাখা তো কাপুরুষতা।

তখন আমার বয়েস সাতাশ। পাশে একজন সুন্দরী রমণী বসে থাকলে নীরস ছাপার অক্ষরের দিকে বেশিক্ষণ মনসংযোগ রক্ষা করা সম্ভব নয়।

পুঁটুলির মধ্যে একটা বড় সাইজের টিফিন কৌটো। তাতে রয়েছে দিস্তেখানেক পরোটা, কালো কালো রঙের কী একটা তরকারি, অনেকখানি আচার আর গোটা কয়েক লাড়ু।

মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে, এর মধ্যেই খাওয়া শুরু করেছে।

আমার ও কামরার অনেকের কাছ থেকে রেলের কেটারার খাবারের অর্ডার নিয়ে গেছে। আমাদের খাবার দেবে আসানসোলে। সওয়া নটায়। তার আগে রাত্তিরের খাওয়া আমার অভ্যেস নেই।

ওরা স্বামী-স্ত্রী দিব্যি তৃপ্তি করে খাচ্ছে। মাঝে-মাঝে ফিসফিস করে অতি দুর্বোধ্য হিন্দিতে কী সব বলছে, তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।

বউটি দু-একবার তাকাল আমার দিকে।

আমার মনে হল, ওরা বোধহয় ওদের খাবার থেকে আমাকে কিছুটা দিতে চায়। সহযাত্রীদের প্রতি অনেকেই এরকম ভদ্রতা করে।

আমি জোর করে বইয়ে চোখ সেঁটে রইলাম। অন্যের খাবারের দিকে তাকানো মোটেই ভদ্রতাসম্মত নয়। ওরা আমাকে কিছু দিতে চাইলেই আমি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করব। অন্যের খাবারে ভাগ বসাতে যাব কেন? তাছাড়া ঠান্ডা পরোটা কিংবা লাড়ু আমার একেবারেই পছন্দ নয়।

কিন্তু ওই খাবারের দিকে তাকায়েই আমার জিভে জল এসে গেছে। গ্রামের লোকদের আমের ঝাল-ঝাল আচার অতি চমৎকার যে। আচার দেখলে আমি কিছুতেই লোভ সামলাতে পারি না। ওরা যদি খুব পীড়াপীড়ি করে তা হলে খানিকটা খাবারের সঙ্গে এক টুকরো পরোটা আমি চেখে দেখতে পারি। কিংবা শুধু খাবার।

শেষপর্যন্ত ওরা অনুরোধ করলই না। সব খাবার চেটেপুটে খেয়ে শেষ করলেন দুজনে।

বউটি বর্তন দেওয়ার জন্য চলে গেল বাথরুমের দিকে।

এতে আমার মনে একটা ক্ষোভ জন্মানো স্বাভাবিক। আমাকে পরোটা লাড়ু প্রত্যাখানের সুযোগও দিল না! কিংবা, ওদের আচার চেখে দেখে কত প্রশংসা করতাম, তা থেকে ওরা বঞ্চিত হল!

অন্য কোনও লোকের সঙ্গে ভাব জমাবার ওদের কোনও ইচ্ছেই নেই।

তার জন্য ওদের দোষ দেওয়া যায় না। প্রথমেই কামরার কিছু লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে এখন ওরা কোণঠাসার মতন আচরণ করতেই পারে। কিংবা হয়তো ওদের নতুন বিয়ে হয়েছে, নিজেদের নিয়ে মত্ত থাকতে চায়।

বউটির সঙ্গে স্বামীটির বয়সের অনেক তফাত, স্বামীটির বয়েস অন্তত ডবল। প্রৌঢ়স্য তরুণী ভার্যা। কাপড়ের ব্যবসায়ীটি নির্ঘাত টাকার জোরেই তরুণীটিকে বিয়ে করেছে। গ্রামে তো এরকম হয়ই।

কিছুক্ষণ বাদে আমাদের কামরায় উঠল একজন ভিখিরি গায়ক।

রাত্তিরের দিকে সাধারণত ভিখিরির উৎপাত কম থাকে। অনেকে ট্রেনে ওঠার পর থেকেই ঘুমের উদ্যোগ করে। এসময় ভিখিরিরা পাত্তা পায় না।

কিন্তু এই ভিখিরিটির বয়েস কুড়ি-একুশ, খালি-গা, মালকোচা মেরে ধুতি পরা। হাতে একটা বাঁশি। ঠিক যেন রাখাল-বেশি কেষ্টঠাকুর।

উঠেই ছেলেটি একটি গান ধরল। পরিষ্কার চাঁছাছোলা গান। গলায় তেজ আর সুর দুটোই আছে। ছেলেটি যেন জানে, ওর গান শুনলে কেউ আপত্তি জানাতে পারবে না। তখন আর ছেলেটি ভিখিরি রইল না।

সে একজন গায়ক। রেডিও বা রেকর্ড কোম্পানি তাকে চেনে না। পাড়ার জলসায় সে ডাক পাবে না। সেইজন্য সে ট্রেন যাত্রীদের গান শোনাচ্ছে। গান গাওয়াটাই তার জীবিকা। গানের পরে সে যখন লোকের কাছে পয়সা চাইবে, সেটা ভিক্ষে নয়, সেটা তার পারিশ্রমিক।

পরপর তিনটে গান শোনাল ছেলেটি।

সত্যিই সে ভালো গায়। চলন্ত ট্রেনে খুব চেঁচিয়ে গাইতে হয় বলে অনেকেরই গলা ভেঙে যায়। এর এখনও ভাঙেনি। অল্প বয়েস।

তিনখানা গান গেয়ে সে যখন থামল, তখন কেউ-কেউ তাকে আরও দু-একটা গানের ফরমায়েস করল।

ছেলেটির কোনও আপত্তি নেই। যে- বলে, সে গেয়ে দেয়।

কাপড় ব্যবসায়ীটিও একটা বিশেষ হিন্দি গান গাইবার জন্যে অনুরোধ করে বসল।

কাপড়ের ব্যবসায়ীটি যে গান-বাজনার সমঝদার তা তো তার চেহারা দেখে বোঝা যায়নি!

দিব্যি তাল দিতে লাগল মাথা নেড়ে। একটা গান শেষ হওয়ার পর অনুরোধ জানালো আর একটার জন্য। সেটা শুনতে-শুনতে যেন আবেশে বুজে গেল তার চোখ।

এতগুলো গান গাইবার পর ছেলেটি হাত পাতলো অন্যদের সামনে।

অনেকেই কিছু কিছু দিল। আমি তখন কাঠ-বেকার, আমি সাধ্যের অতিরিক্ত দুটি টাকা দিলাম তাকে। ছেলেটি সত্যিই ভালো গেয়েছে।

কাপড়ের ব্যবসায়ীটি যে চোখ বুজেছে, চোখ আর খোলেই না।

ছেলেটি তার সামনে হাতের পয়সা ঝনঝন করল, দু-তিনবার দাদা, দাদা বলে ডাকল, তাতে কোনও সাড়া নেই। লোকটি এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে, এটা অসম্ভব। মটকা মেরে আছে। একটাও পয়সা দেবে না।

ছেলেটি কিছু না পেয়েই চলে গেল!

আমি স্তম্ভিত!

গান শুনেও অনেকে পয়সা দেয় না, তা ঠিক। কেউ-কেউ ভিখিরি বা কোনও কারুকেই পয়সা। দেয় না, সেটাও তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপার। কিন্তু এই লোকটা গান শোনার জন্য অনুরোধ জানালো কেন? তাও কিছু দক্ষিণা দেবে না গায়ককে? লোকটা মহা ফেরেববাজ তো।

এরকম লোক আমি দেখিনি। কেমন যেন গা ঘিনঘিন করতে লাগল আমার। মানুষ এমন হীন হয় কেন? কাপড়ের ব্যাবসা করছে, ওই ছেলেটিকে কি অন্তত একটা আধুলিও দিতে পারত না?

আমার খুব রাগ হচ্ছে বটে কিন্তু তা নিষ্ফলা রাগ। কেউ যদি ভিখিরিকে ভিক্ষে না দেয় কিংবা কারুর গান শুনেও পয়সা দিতে না চায়, তার জন্য কোনও অভিযোগ জানানো যায় না। জোর করে ওকে দিয়ে পয়সা দেওয়ানোও যায় না।

গুম মেরে বইতে চোখ ফেরালাম।

কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। অনেকেই ঘুমে মন দিয়েছে। নিস্তব্ধ হয়ে এসেছে কামরা। আমার চোখে ঘুম নেই।

হঠাৎ আমার কাঁধে কেউ রূঢ়ভাবে একটা ধাক্কা দিল।

সেই কাপড় ব্যবসায়ী। সে বেশ অভদ্রভাবে বলল, আপ জেরা হট যাইয়ে!

লোকটির স্ত্রী ঘুমের ঘোরে আমার কাঁধে দু-একবার মাথা ছুঁইয়েছে। আমি একটু-একটু সরে সরে বসলেও এ পাশে আর জায়গা নেই। ওকে ঘুম থেকে জাগিয়েও দেওয়া যায় না। ঘোমটাপরা একটা মাথাদু-একবার আমার কাঁধে লাগালেও মহাভারত এমন কিছু অশুদ্ধ হয়ে যায় না।

আমি কটমট করে লোকটার দিকে তাকালাম।

লোকটি এর পরেও বলল, আপ ইধার উঠকে আইয়ে!

ইচ্ছে হল ঠাস করে ওর গালে একটা চড় কষিয়ে দিই।

কিন্তু কিছু একটা গোলমাল করলে আমারও বিপদ হবে, যদি লোকটা দুম করে বলে বসে যে আমি ওর যুবতী বউয়ের গায়ে ইচ্ছে করে হাত দিয়েছি?

আমার প্রতিবাদ কেউ বিশ্বাস করবে না। মেয়েদের দিকেই সকলের সহানুভূতি থাকে। আমার বয়সটাই দায়ী হবে।

লোকটি আবার ওই কথা বলতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম, অন্য কেউ যেন কিছু শুনতে না পায়। জায়গা বদলাবদলি করলাম লোকটার সঙ্গে।

অপমানে আমার গা শিরশির করছে। কোনও দোষ করিনি, তবু লোকটা আমার সম্বন্ধে বিশ্রী সন্দেহ করেছে।

লোকটা এখনও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ও শুধু একটা স্বার্থপর, কৃপণ চশমখোরই নয়, অতিশয় সন্দেহপ্রবণ, অভদ্র, অনেক কিছু।

আমি বললাম, হারামজাদা! যদি আমার একটা রিভলভার থাকত, তোকে গুলি করে মেরে ফেলতাম। তোর মতন নরকের কীটের বেঁচে থাকার দরকার কী?

মনে-মনে! মনে-মনে ছাড়া আর কী? কোনওদিনই আমার কাছে রিভলভার থাকবে না। দৈবাৎ কখনও হাতে নিলেও গুলি করতে পারব না। যারা অনায়াসে মানুষ মারতে পারে, তাদের মনের গঠনটাই অন্যরকম হয়।

আমি শুধু মনে-মনেই এরকম গজরাতে-গজরাতে বহু লোককে শাস্তি দিই।

কিছুতেই জেমস জয়েসে আর মন বসল না। এক সময় ঘুম এসে গেল। বই খসে পড়ে গেল হাত থেকে।

শেষরাতের দিকে ঘুম ভাঙল আবার। ট্রেন থেমে আছে কোনও একটা বড় স্টেশনে, বোধহয় ধানবাদ।

সেই কাপড়ের ব্যবসায়ী ও তার স্ত্রী নেমে যাচ্ছে এখানে। কুলি এসে নামাচ্ছে কাপড়ের গাঁঠরিগুলো। আমি ভাবলাম, যাক, আপদ বিদায় হল।

ঘোমটা দেওয়া বউটি যাওয়ার আগে এক ঝলক তাকাল আমার দিকে। সেই দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল। হয়তো সে তার স্বামীর দুর্ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইছে। কিন্তু মুখে কিছু বলল না, কী করে

এসব কথা বলতে হয়, তা জানে না।

ওই দৃষ্টিটার জন্যই মেয়েটির মুখ আমার মনে গেঁথে গেল।

দিনতিনেক বাদে ফিরলাম হাজারিবাগ থেকে। ওই একই ট্রেনে।

ট্রেন ধানবাদ স্টেশনে অনেকক্ষণ দাঁড়ায়।

প্ল্যাটফর্মে এক জায়গায় ছোটখাটো একটা ভিড়। সেখানে কেউ চিৎকার করছে, অন্যরাও গলা মিলিয়েছে তার সঙ্গে। প্রথমেই মনে হয়, কারুর কোনও জিনিস চুরি গেছে। এরকম তো প্রায়ই হয়।

নেমে উঁকি মেরে দেখি, কান্নাকাটি করছে একজন মহিলা। সাদা শাড়ি পরা। মাথায় ঘোমটা নেই, সব চুল খোলা।

ভিড়ের একজনের দিকে তাকাতেই সে বলল, ও বেচারার স্বামী কাল হঠাৎ মরে গেছে। হার্ট ফেল। বেচারার আর কেউ নেই এখানে!

আমার বুকের মধ্যে যেন একটা গুলি লাগল।

এখন মুখখানা অন্যরকম দেখালেও এ যে সেই কাপড়ের ব্যবসায়ীর স্ত্রী, তাতে কোনও সন্দেহ নেই!

বউটি একবার চোখ তুলে আমাকে দেখেই যেন থেমে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য।

ধরা পড়া চোরের মতন ভয়ে কেঁপে উঠলাম আমি। আমাকে চিনতে পেরেছে? ও কী বুঝতে পেরেছে যে আমিই ওর স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলাম!

ওর স্বামীটি ছিল নিতান্তই চুনোপুঁটি। ওর অপরাধ এমন কিছু গুরুতর নয়। আমি কি সত্যি-সত্যি ওকে মারতে চেয়েছিলাম? আরও কত বড়-বড় রাঘব বোয়াল কতরকম জঘন্য অন্যায় করে দাপটে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কত সময় আমি মনে-মনে তাদের কঠোর শাস্তি দিই, কিন্তু তাদের তো কিছু হয় না!

দ্রুত পালিয়ে গেলাম সেখান থেকে। যেন আমারই একটা কঠিন শাস্তি প্রাপ্য।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments