Friday, April 26, 2024
Homeথ্রিলার গল্পভৌতিক গল্পগোপীবল্লভপুরের জমিদার বাড়ি - কৃষ্ণ গুপ্ত

গোপীবল্লভপুরের জমিদার বাড়ি – কৃষ্ণ গুপ্ত

vuture bari

দরকারের সময় কোন কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। বাড়িতে সকাল থেকে এখনও অবধি গোটা দশেক ডাইরী, ছোট পকেট নোট বুক, এমন কি একটা পুরানো চশমার খাপে থাকা মান্ধাতা আমলের কিছু টুকরো কাগজ ও খোঁজা হল। কিন্তু বসন্ত দার ল্যান্ড নাম্বার পাওয়া গেল না। অগত্যা আজ অফিসে এসে ধুলায় ঢাকা আলমারি ঘেঁটে ততোধিক ধুলোয় ঢাকা কুড়ি বছর আগের অ্যাড্রেস রেজিস্টার টা বার করে বাড়ির ফোন নাম্বার টা পাওয়া গেল।

–বসন্ত সমাদ্দার, গোপীবল্লভ পুর, নতুন বাজার, রানাঘাট। আমার সঙ্গে আলাপ চাকুরী জীবনের শুরুতে। আমার তখন বাইশ বছর বয়স। বসন্ত দা আমার জয়েনিং এর আর এক মাস পরই রিটায়ার্ড করেছিল। আমার প্রায় পিতৃসম ছিলেন উনি। ঐ একটা মাসেই বুঝেছিলাম, ষাট বছরের মানুষ টা কতটা আমুদে আর নিপাট ভাল মানুষ। আর হবে নাই বা কেন? জমিদার বংশের ছেলে। জীবনে অনেক কিছুর প্রাচুর্য দেখেছেন। অথচ নিজে সেই সরল সাদাসিধেই রয়ে গেছেন। বিয়ে থা পর্যন্ত করেন নি।

চেয়ারে স্তুপীকৃত ফাইলের পিছনে বসে বসে আজকের সকাল টা কেমন যেন বসন্ত ময়ই হয়ে গেল! তার সঙ্গে কাটানো ঐ স্বল্প সময় টুকু যেন অনেক স্মৃতি ই বহন করছে। এর মধ্যে আমার আরও বাইশ বছর চাকরীও হয়ে গেছে।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আজই কলকাতা তে আমার শেষ ডিউটি। পরশু সোম বার থেকে চলে যেতে হবে রানাঘাট। আমার বদলির অর্ডার এসেছে । আর সেটা রানাঘাটে হয়েছে বলেই বসন্ত দার কথা প্রথমেই মনে পড়ল। তবে শুধু যে বসন্ত দা ভাল মানুষ বলেই, তা নয়। আর একটা কারণ ও আছে, যেটা আমার মনের মধ্যে মার্ক হয়ে আছে, সেটা হল তার মুখে শোনা তার জমিদার বাড়ির ভৌতিক গল্প। তাই রানাঘাট নাম শোনার পর একবার তার জমিদার বাড়িতে গিয়ে এক রাত কাটানো আমি পাখির চোখ করে নিলাম।

কিন্তু মুশকিল হল, অফিস থেকে ঐ ল্যান্ড নাম্বারে দশ বার ফোন করলেও কেউ ধরে নি! ব্যাপার কি? উনি বেঁচে আছেন তো? কিন্তু পর মুহূর্তেই মনে হল, বেঁচে আছেন বলেই তো ফোন বাজছে। না হলে তো হয় ফোন বাজত না। না হলে ফোন অফিস থেকে বলত, এই নাম্বার টি সঠিক নয়। বা হয়তো অন্য কেউ ধরত। তো যাই হোক, নানা দুর্ভাবনার মধ্যে সন্ধ্যা বেলা মনের আশঙ্কা কমল। বসন্ত দা কে ফোনে পেলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় অনেক বছর পর অদেখা মানুষ টির প্রতি শ্রদ্ধা আর নানা উৎকণ্ঠা ঝড়ে পড়ল।

— আমি রজত ঘোষ বলছি, বসন্ত দা। মনে পড়ছে? অপর প্রান্ত থেকে একটা ভারিক্কি গলায় উত্তর এল। — কোন রজত? ঢ্যাঙা না মোটা? লাজুক মুখে বললাম, — আজ্ঞে ঢ্যাঙা রজত দাদা। কেমন আছেন?

— আর আছি…. কেটে যাচ্ছে ভায়া। তুমি কেমন আছ? এত দিনে তো নিশ্চয়ই বিয়ে, সাদি, ছেলে, পুলে করে পুরো ফ্যামিলি প্যাক রেডি? আমি লজ্জিত হয়ে বললাম, — না দাদা, ওটা আর এ যুগে হয়ে উঠল না। মা, বাবা সব পর পর চলে গেলেন। বোনের বিয়ে দিতে দিতে থাক ওসব। একটা দরকারে ফোন করলাম।– একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম।

আমি রানাঘাটে বদলী হয়ে সোম বার আসছি। খুব ইচ্ছা, একবার আপনার জমিদার বাড়ির ভৌতিক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করব। যদি অনুমতি দেন। আমার কথায় বেশ কিছুক্ষনের একটা নীরবতা। তারপর একটা হালকা কাশির মত আওয়াজ পেলাম। এটা কি ফোনের ঘ্যাষ ঘ্যাষ আওয়াজ না বসন্ত দার দীর্ঘশ্বাস, বুঝলাম না। আওয়াজ টা থামতেই বসন্ত দা বলল, — চলে এস। জমিয়ে আড্ডা দেব। আমি খুশি হয়ে বললাম, — ধন্যবাদ দাদা, আমি অফিসে জয়েন করে একটা ভাড়া বাড়ি খুঁজে ই তোমার ওখানে যাব।

— খুব ভাল। তবে ভায়া, দিনের বেলা তে তো আমি বিভিন্ন ক্লাব, সংগঠন, আশ্রম করে বেড়াই। তাই সন্ধ্যার পরই কিন্তু এস। না হলে ফোন ধরারও কেউ নেই। আমি উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ফোন রাখলাম।

রানাঘাট এসে সোম থেকে বুধ, অফিস আর ভাড়া বাড়ি খুঁজতে চলে গেল। তাই বৃহস্পতি বার অফিসের কাজ সেরে রিকশা ধরলাম। আধ ঘণ্টা ধরে প্যা পো করে যখন গোবিন্দ বল্লভ পুর এলাম, তখন ই শীতের সন্ধ্যা পার। এখান থেকে আবার সাইকেল ভ্যানে করে প্রায় কুড়ি মিনিটের জার্নি করে নতুন বাজার। তারপর পাকা রাস্তার বদলে মেঠো রাস্তা। তাই পায়ে হাঁটতে হবে। একে তাকে জিজ্ঞাসা করে মাথা খারাপ হতে লাগল। জমিদার বসন্ত সমাদ্দার?

না, কেউ দেখি নামই শোনে নি। এ যে মহা মুশকিল! কি যে করি…. আচ্ছা এখন তো সন্ধ্যা হয়েছে। ল্যান্ড লাইনে একটা ফোনই করা যাক। একমাত্র বসন্ত দাই বলতে পারবে নিজের বাড়ির অবস্থান। ভাগ্য ভাল, এক সুযোগেই পেলাম। সব শুনে বলল, — ওদের আবার দোষ কি? এরা তো সব বছর দশেক এসেছে। এত আগের কথা এরা কিভাবে জানবে? শালারা কিন্তু আমাদের জমি বিভিন্ন হাত ঘুরে কিনেই বাড়ি করেছে। যাই হোক, তুমি দাঁড়াও, আমি ভানু কে পাঠাচ্ছি।

অগত্যা একটা বন্ধ দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরে যিনি এলেন, তারও মনে হয় সত্তরের উপর বয়স। একটা ধুতি মালকোঁচা করে পরা। ঢ্যাঙা গায়ে ফতুয়া। এ গাঁয়ে এখনও ইলেকট্রিসিটি ঢোকে নি। তাই মোবাইলের টর্চই ভরসা। ভানু কোন কথা বিশেষ বলল না। শুধু ইশারা তে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। আমি মাঠ-ঘাট, বন-বাদার পেড়িয়ে চললাম। এখানে যে সভ্যতার এখনো বিকাশ হয় নি, দেখলেই বোঝা যায়। সত্যি, অনেকদিন পর মনের মতন কোন একটা গ্রামে এলাম। যদিও রাতের অন্ধকারে এর সৌন্দর্য বোঝা সম্ভব না।

খান কতক দিঘি, মেঠো পথ পেড়িয়ে অবশেষে হাজির হলাম এক বিশাল অন্ধকার প্রাসাদ পুরীর সামনে। ভানুই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে টিনের গেট টা খুলল। একটা সরু পথ পেড়িয়ে সোজা বৈঠকখানাতে উঠলাম। একটা আঙটা তে কম আঁচে হারিকেন ঝোলানো। তাতেই যা সামান্য আলোর দেখা পেলাম। না হলে চারদিকে নিকস কালো অন্ধকার। অনেকদিন পর দেখলাম এই হারিকেন। শহরে থাকতে থাকতে এই জিনিস গুলো তো এখন বিলুপ্তপ্রায়ই হয়ে গেছে।

— এসো এসো ভায়া। কত কত বছর পর দেখলাম তোমাকে। — বৈঠকখানা থেকে নেমে এসে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন বসন্ত দা। হাত তো না, যেন লোহার খুন্তি! কি শক্ত রে বাবা!

বৈঠকখানা তে তখন আরও তিন চার জন বসে। বোধহয় কোন মিটিং হচ্ছিল। অল্প আলোতে অবশ্য কারোরই মুখ দেখা যায় না। কারণ, একেতো গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। তার মধ্যে জানুয়ারি মাসের অজ গাঁয়ের সন্ধ্যা। ধুলো, কুয়াশা মাখা মায়াবী দৃশ্যপট তাই রেডি। করমর্দন শেষ করে প্রণাম করলাম একটা। বাইশ বছর আগের মানুষ টা কে গলার স্বর আর কথা বলার টান ছাড়া অন্ধকারে মেলাতে পারলাম না। প্রণাম সেরে একটা গদি আঁটা চেয়ারে বসলাম। সমবেত গুঞ্জন টা হঠাৎ থামল। নিশ্চয়ই খুব দরকারী আলোচনা চলছিল। তাই তাতে বিঘ্ন করায় নিজের বিব্রত বোধ হতে লাগল।

— আলাপ করিয়ে দেই, এ হল রজত ঘোষ। আমার এক সময়ের অফিস কলিগ। আর এরা হলেন আমার বন্ধু বান্ধব সব। এই ভানু, ওর জন্য একটু জল, মিষ্টি নিয়ে আয়।

বসন্ত দার নির্দেশে আমি ব্যস্ত হয়ে মানা করতে যাবার আগেই ভানু বেড়িয়ে গেল। আমি সবাই কে নমস্কার জানালাম হাত জোড় করে। বললাম, — অসময়ে এসে পড়ে আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তে বিঘ্ন করলাম। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।

–আরে না না, এরা সে রকম নয়, যেরকম তুমি ভাবছ। এরা সব এখানেই থাকে। সারা দিন রাতই গল্প গুজব করি আমরা। একটু আগেই তো তোমাকে নিয়ে ই কথা হচ্ছিল।

— আমাকে নিয়ে! লজ্জিত ভাব টা দ্রুত কাটাতে সোজা হয়ে বসে বসন্ত দার দিকে তাকালাম।
–হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার পাগলামি নিয়ে। তুমি নাকি ভূত খুব ভালবাস?

অন্ধকারে আমার বাম দিক থেকে একজন হেসে বলল। তার মুখ না দেখলে ও তার ক্ষয়াটে লম্বা লম্বা দাঁত গুলো চক চক করছিল। ততক্ষণে ভানু মিষ্টি আর জল নিয়ে হাজির। সত্যি বলতে কি, আমার তখন খিদেও পেয়েছিল। তাই মেকি প্রতিবাদ না বাড়িয়ে গপা গপ মুখে তুললাম। খেতে বেশ ভালই ছিল নলেন গুড়ের রসগোল্লা গুলো। চিবোতে চিবোতে বললাম, — তা ভূত একটু ভালবাসি বৈকি। তাদের সঙ্গে কথা বলা, দেখা করার বড়ই সখ আমার। আমার কথা শুনে বসন্ত দা আমার পিঠ চাপড়ে হো হো করে হেসে উঠল। সত্যিই বুড়ো হাড়ে বেশ জোড় আছে মাইরি!

— তা বেশ বলেছো খোকা। আমার বিপরীত দিকে বসা একজন খিল খিল করে হেসে উঠল। হাসি তো না, যেন কোন ডিজেল গাড়ির ইঞ্জিন চালু হল। চুয়াল্লিশ পেড়িয়ে যাবার পরও খোকা বলায়, মাথাটা একটু গরম হলেও চুপ করে থাকলাম।

— তা ভূত যে দেখতি চাও, তোমার ভয়, ডর কি লাই? আমার ডান পাশের বাঙাল ভদ্রলোক টি বলল এবার।
–ভয়? আরে সেটাই তো পরখ করতে আজ এখানে এসেছি।

আমার কথা তে সবাই একটু চুপ চাপ হয়ে গেল। । বসন্ত দা একটু কেশে নিয়ে বলল। –তা এসেই যখন পড়েছ। তখন উপরে যাও। ভানু তোমার স্পেশাল ঘর টা দেখিয়ে দিয়ে আসুক। ডিনার ও সময় মতন দিয়ে আসবে। ততক্ষণ আমরা আর একটু আড্ডা মেরে নিই। আর একটা কথা, যতটা তুমি হালকা ভাবছ, ততটা কিন্তু হালকা বিষয় না রজত। আমি এই বৈঠকখানার পাশের ঘরেই থাকব। তুমি সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখতে পার। তবে খুব সাবধান। বিপদ হলে আমাকে ডেকো।

আমি হেসে বললাম, — বিপদ কেন হবে? ওই ভূত দের ঠিক আমি সামলে নেব। আপনি ভাববেন না। আমার কথায় বসন্ত দা একটু গম্ভীর হল। বলল, — দেখ তেনারা সবাই আমার পরিবারের। কাজেই বার বার ভূত বললে কেমন যেন অপমানিত বোধ করি। যাই হোক, এই পরিবারে, এই বাড়ি তে ছোট থেকে বড় হয়েছি। তাই জানি, রাত টা কিন্তু ভাই খুব কঠিন যাবে তোমার। সাবধান! আমি বসন্ত দার কথায় শুকনো হাসলাম। তারপর আমার জন্য অপেক্ষা করা ভানুর পিছন পিছন দোতলাতে আমার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে চললাম।

বৈঠকখানা থেকে বেড়িয়েই উপরে ওঠার ভগ্নপ্রায় সিঁড়ি। হারিকেন টা ভানুর হাতে। আমি দু হাত তফাতে মোবাইলের টর্চ জ্বেলে চলেছি। দোতালায় পৌঁছে সিঁড়ির দু দিকেই পর পর ঘর। এই মহলের খাস ব্যাপার হল, সব ঘরের ই সামনে একটা করে নিজস্ব বারান্দা। আর পিছনে লম্বা করিডোর। যার এক পাশে সব ঘর গুলো। অন্য পাশে বড় বড় জানালা। যার বেশীর ভাগেরই কপাট ভেঙে ঝুলছে। তার ফাঁক দিয়েই মনে হল বাড়ির পিছনে যেন একটা দিঘি রয়েছে। যদিও অন্ধকার। কিন্তু জলে কিছু পড়ার আওয়াজ পেলাম। করিডোরের শেষ প্রান্তে এসে একটা ঘরের বহুদিনের বন্ধ কপাট খুলল ভানু। মর মর কট কট করে এক ভয়ঙ্কর আওয়াজ হল। যেন বহুদিন পর কোন দৈত্যের ঘুম ভাঙল।

— এই ঘর টা কি স্পেশাল? ভানুর দরজা খোলা হলে জিজ্ঞাসা করলাম।
— বছর পনেরো আগে এই ঘরে দাদাবাবুর এক মাত্র ছোট ভাই গলায় দড়ি দেয়। আপনার জন্য তাই এটাই বাছা হয়েছে।

— কথা টা শুনে বেশ লাগল আমার। এই তো, কেমন যেন একটা থ্রিল থ্রিল গন্ধ পাচ্ছি। ঘরে ঢুকে পিঠের বড় ব্যাগ টা ধুলোয় ধুসরিত একটা চেয়ারের উপর রেখে বিছানা তে বসলাম।
— খাবার কখন দেব? ভানুর প্রশ্নে এক মুহূর্ত চিন্তা করে বললাম, — তোমার কখন সুবিধা? তুমি কখন বাড়ি যাবে?
— আমি এখানেই থাকি। যদি বলেন, তবে রাত ন টা তে দেই।

রাত ন টা বড্ড আগে হয়। আমাদের দশ টা-এগারোটা করে অভ্যাস। তবু এখানে তো এক রাতের ব্যাপার। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার, অত গুলো মিষ্টি খেয়েও খিদে পেয়ে যাচ্ছে। তাই ন টা তেই হ্যাঁ বললাম। ভানু চলে গেল। করিডোর ধরে ওর পদ শব্দ মিলিয়ে যেতে হারিকেন টা বাড়াতে গেলাম। দেখলাম চাবি টা টাইট হয়ে রয়েছে। যাই হোক, বিছানা তে ধুলো আছে। এক রাতের বাস যোগ্য করতে একটু ঝেড়ে নেওয়া দরকার। ইতিমধ্যেই মোবাইলের চার্জ অনেক টাই শেষ। অফিসে চার্জার নিয়ে আসি নি। যার ফলে এমন একটা দিনে মোবাইল এর চার্জ চলে যাওয়ার আশঙ্কা তে রইলাম। যাইহোক সারা ঘরে আলো ফেললাম। বহুকাল যে এখানে মানুষ থাকে না, তা দেওয়াল আর মেঝে দেখলেই বোঝা যায়। ধুলো আর ঝুলের মোটা আস্তরণ জমেছে। যদিও দেওয়াল নিয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ বিছানা টা নিয়ে। যদিও ঘরময় চোখ রেখে কোন ঝ্যাটা চোখে পড়ল না। ব্যাগ থেকে অফিসের টেবিল মোছার ডাস্টার বার করে কিছুটা ঝাড়ার চেষ্টা করলাম।

মোবাইল বলছে এখন রাত পৌনে ন টা। নিচে বসন্ত দা দের অস্পষ্ট কথা বার্তার আওয়াজ আসছে। এই বয়সে ও বুড়ো গুলোর স্ফূর্তি দেখে ভাল লাগল। বারান্দার দরজা খুলে বাইরে একটু উঁকি মারলাম। হঠাৎ মনে হল, কে যেন সরে গেল বারান্দা থেকে। কিন্তু বারান্দার দরজা তো আমি এইমাত্র খুললাম। বাইরে থেকে তো আর কেউ চলে আসবে না। আমার চোখের ভুল ও হতে পারে অবশ্য। যত দূর চোখ যায়, শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার প্রান্তর। দু একটা জোনাকি অবশ্য ঘুরে ঘুরে আলো দিচ্ছে। হঠাৎ আবার মনে হল, আমার পাশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে! সেই সঙ্গে একটা কড়া সিগারেটের গন্ধ পেলাম। পাশ ঘুরলাম, কিন্তু কেউ নেই! ভারি অবাক লাগল। যারা নিচে আড্ডা দিচ্ছে, তারা সিগারেট খায় বলে মনে হয় না। বসন্ত দা তো নয়ই। তবে আরে ঐ তো একটা লোক, আমার পাশের ঘরের (সিঁড়ির দিকে) ব্যালকনি তে সিগারেট টানছে!

— কে ওখানে? ছোট করে একটা হাঁক পাড়লাম। কোন উত্তর দিল না কেউ। এমন সময় সদর দরজা তে ভানু কড়া নাড়ল। মানে ডিনার রেডি। ভানু ঢুকতেই জিজ্ঞাসা করলাম, — এ বাড়িতে সিগারেট কে খেত?

— আজ্ঞে ছোট বাবু, যিনি এই ঘরে গলায় দড়ি দিয়েছিল। আচ্ছা ভানু দা, আমার পাশের ঘরে কি কেউ থাকে? ভানু আমার প্রশ্নের উত্তরে হাসল। অন্ধকারে ওর হাসি যেন বিদ্রূপ মনে হল। বলল,–ঐ ঘর তো ছোট দাদা বাবুর পড়ার ঘর। কথা বলতে বলতে ভানু বেড়িয়ে গেল। আমার মনের মধ্যে তখন তোলপাড় হচ্ছে। মনটা খুশি তে ভরে উঠল। এই তো যা চাইছিলাম, পেতে শুরু করেছি। এবার ডিনার টা শেষ করে ডাইরী বার করে নিজস্ব অভিজ্ঞতা লিখতে বসব।

টেবিলের উপর ঢাকা দেওয়া প্লেট টা সরিয়ে দেখলাম, ভাতের সঙ্গে বেগুন ভাজা, মুড়োর ডাল, আর রুই মাছের বড় একটা রিং। কাঠের উনোনে রান্না করেছে সম্ভবত। দারুণ ঘ্রাণে পেট যেন এখনই ভরে গেল। হারিকেনের স্বল্প আলো তে ডিনার শেষ করলাম। এখন রাত সারে ন টা। খাবার প্লেট, বাটি, থালা রাখতে বাইরে এলাম। ইচ্ছা হল একটু বাইরে টা ঘুরি। তাই দরজা টা বাইরে দিয়ে হুড়কো টেনে করিডোর ধরে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। তারপর একটা বড় জানালার কাছে গিয়ে বাইরে টর্চের আলো ফেললাম। না, বেশী দূর দেখা গেল না। তবে জলের চিক চিকি দেখে মনে হল, দিঘি টা একদম কাছেই। আমার ঘরের কোনে করিডোরের শেষ প্রান্তেই বাথরুম। টর্চের আলো তে দেখলাম, এক বালতি জল তোলা আছে। চারদিকে শেওলা ধরা দেওয়াল। নোংরা মেঝে। অতি দুর্গন্ধ ময় আর অস্বাস্থ্যকর। কোন রকমে কাজ সেরে বাইরে এলাম।

আমার পাশের ঘরের বসন্ত দার ভাই এর পড়ার ঘরের দরজা টা সশব্দে বন্ধ হল। হাওয়া নেই, অথচ একটু চমকে উঠলেও সামলে নিয়ে দ্রুত গিয়ে দরজা টা খুলে ফেললাম। একটা জোড়ালো হাওয়া যেন আমাকে ধাক্কা মেরে বেড়িয়ে গেল। সেই সঙ্গে অদৃশ্য কেউ একটা জোরে চড় কষাল আমার গালে। কোন রকমে নিজেকে সামলালাম। গাল টা জ্বলে যাচ্ছে! কে চড় মারল আমাকে? ঘন অন্ধকারে টর্চ জ্বালতে বুঝলাম, টর্চের আলোও কমে আসছে। কারণ রিচার্জ আর বেশী নেই। ঘরের চারদিকে টর্চের আলো ফেললাম। চারদিকে অনেক বুক সেল্ফ। তাতে থরে থরে সব বই সাজানো। ঘরের মাঝে একটা টেবিল। সেখানে একটা বই যেন সদ্য খোলা হয়েছে, এমন ভাবে রাখা। বেশ একটা শিহরণ খেলে গেল শরীরে। টেবিলের উপর ধুলোর আস্তরণ। তার মধ্যে দুটি হাতের টাটকা স্পষ্ট ছাপ বিদ্যমান।

সারা ঘর জুড়ে কেমন একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ। কেন জানি না, বেশ গা ছম ছম করতে লাগল বলে বাইরে এলাম। পাশের কোন ঘর থেকে নূপুরের আর বাদ্য যন্ত্রের এক টানা আওয়াজ পাচ্ছি। মনে হয় কে যেন নাচছে। জমিদার বাড়ির পুরানো কোন নর্তকী? নাকি এ বাড়ির ই কোন মহিলা সদস্য? অবশ্য বসন্ত দার কাছে স্বল্প সময়ে ভৌতিক অভিজ্ঞতা ছাড়া বিশেষ কোন কাহিনী এ বাড়ি সম্পর্কে শুনি নি আমি। যাই হোক, একবার দেখার আশায় করিডোর ধরে চললাম। সিঁড়ির পরের ঘর থেকেই আসছে আওয়াজ। এই ঘর টা ভিতর থেকে বন্ধ। আর বন্ধ ঘর থেকে ই পরিষ্কার নাচ, গানের শব্দ পাচ্ছি। সত্যিই কি ভিতরে কেউ আছে? না কি মনের ভুল?

দরজা তে তিন বার নক করলাম। তার পর কেউ খুলছে না দেখে মৃদু ধাক্কা দিলাম। দেখলাম খুলে গেল! ভিতরে ঢুকে দেখলাম, ঘরটা বেশ বড়। একটা ঝাড়বাতি জ্বলছে আমাকে অবাক করে। তার উজ্জ্বল আলোয় দেখলাম একজন নাচ করছে। আর চারদিকে গোল হয়ে বসে আছে পাঁচ, ছয় জন। একজন তবলচি, একজন সানাই বাদক, আর যিনি গাইছেন, তার হাতে হারমোনিয়াম। এ যেন এক আস্ত মেহফিল! সঙ্গীতের মূর্ছনা তে আর নাচের ছন্দে কিছুক্ষনের মধ্যে যেন সব জীবন্ত হয়ে গেল। আমি যেন কেমন ঘোরের মধ্যে পড়ে হারিয়ে যেতে বসলাম। বোকার মতন কিছুক্ষন দাঁড়াতেই কোথা থেকে ভানু এসে একটা চেয়ার দিয়ে গেল। আমি ধপ করে বসে দেখলাম বসন্ত দাও এক পাশে বসে আছে। এবার তার চেহারা টা কিছুটা পরিষ্কার হল আমার কাছে। চক চকে টাক, টিকালো নাক, এখনও সেই সৌম্যদর্শনই আছেন, তবে শরীরে বয়সের ছাপ স্পষ্ট। তাও দেখে বড় জোর সত্তর মনে হতে পারে। অথচ ক্যালকুলেশান বলছে, ওনার বয়স এখন বিরাশি ।

বয়স হিসাব করতে গিয়ে আবার নানা রকম অন্য হিসাব নিকাশ ও মাথায় এল। আমার চোখ দুটো মেহফিলে, অথচ মনে অন্য দ্বন্ধ কাজ করছে। কতক্ষণ এভাবে ঘোরের মধ্যে ছিলাম, জানি না। হঠাৎ একটা চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেলাম। ঘোরের মধ্যে ই যেন দেখলাম বসন্ত দা প্রায় একই রকম দেখতে বয়সে অনেক ছোট কাউকে সবার সামনে তীব্র আক্রমণ করেছেন। চেঁচামেচি তে জলসা ভেঙে গেল। নর্তকী এক জায়গা তে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। এত হৈ হুল্লোড়ে ঝিমুনি ভাব টা কেটে গেল। ধড়ফড় করে ঘুম ভাঙতে দেখলাম, আমি একটা বড় ফাঁকা ঘরে পড়ে আছি। চার দিকে শুধু বিভিন্ন ভাঙাচোরা জিনিসপত্র ছড়ানো। সম্ভবত এটা ভাড়ার ঘর। ভাঙা চেয়ার, টেবিল, হারমোনিয়াম, তবলা থেকে শুরু করে ভাঙা দরজা, জানালা পর্যন্ত ডাই করা। মাকরসার জালে সারা হাত মুখ জড়িয়ে গেল।
মাথায় ঢুকল না, যা দেখলাম কিছুক্ষন আগে, তা কি মিথ্যে? না স্বপ্ন? এত গুলো লোক কে যে দেখলাম, সবই কি চোখের ভুল ছিল?

আর এটাও বুঝতে পারছি না, এত জোরে চড় টা তখন কে মারল? গালটা জ্বালা করছে। কানের পাশ টা ভো ভো করছে। মাথাটা ও ধরছে ক্রমশ। এবার বেশ একটু গা ছম ছম করতে লাগল। এখন রাত এগারোটা। বাড়ি তে তো বারোটার আগে শুই না। তাই ভাবলাম, একটু দিঘির হাওয়া খেয়ে আসি। সেই মতন সিঁড়ি বেয়ে নেমে বৈঠকখানার বিপরীত দিকের দরজা দিয়ে বাগানে প্রবেশ করলাম। বৈঠকখানা তে এখনো বসন্ত দা দের গল্প গুজব চলছে। কি রে বাবা, গাঁয়ের বয়স্ক মানুষ। ঘুমাবে কখন? বাগান পেড়িয়ে দিঘির পাড়ে এসে মন ভরে গেল। বাহ, কি সুন্দর গাছ, পালা এখানে। জল স্পষ্ট দেখা না গেলে ও অনুভব করা যাচ্ছে। তবে বড্ড ঠাণ্ডা। আমার মোবাইল দেখাচ্ছে, তাপমাত্রা মাত্র দশ ডিগ্রী।

মোবাইলের আলো তে জলে নামার বাঁধানো ঘাট টা দেখলাম। দু পাশে বসার জায়গা। তার এক পাশে বসে জমিদার বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যি অন্ধকারে ভূতুড়ে বাড়িই মনে হচ্ছে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ শুনলাম দোতলা তে আবার একটা চেঁচামেচি হচ্ছে । একজন অচেনা মহিলা কণ্ঠস্বরের সঙ্গে বসন্ত দার গলাও পেলাম। সেই সঙ্গে নূপুরের শব্দের ঘন ঘন আওয়াজ। মনে হচ্ছে ঐ নর্তকী যেন দৌড়ে নামছে। এবার আমাকে অবাক করে দিয়ে ঐ নর্তকী কাঁদতে কাঁদতে সত্যি দৌড়ে বেড়িয়ে এল। তার পর আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দিঘির জলে ঝাঁপ দিল। ও জলে ঝাঁপ দিতেই কনকনে ঠাণ্ডা জল আমার নাকে, মুখে এসে লাগল।
আরে, এ যে আত্মহত্যা করে বসল! কি করি এখন?

বসন্ত দা দের ডাকব? উনি তো উপরেই ছিলেন এই মাত্র। প্রথমে মোবাইল থেকে বসন্ত দার ল্যান্ড লাইনে ফোন করলাম। ফোন টা মনে হল দোতলার সেই জলসা ঘরে বেজে উঠল। কিন্তু কেউ ধরল না। বাধ্য হয়ে তাই অন্ধকারে সিঁড়ি ভেঙে দোতলা তে উঠতে থাকলাম। আমার পায়ের শব্দছক আর দ্রুত ধাবমান হওয়ায় পুরো মহল যেন কাঁপতে লাগল। মনে হল যে কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। সেই মুহূর্তে শুনলাম একটা ফায়ারিং এর শব্দও।

কোন ক্রমে উপরে উঠে ডাকতে লাগলাম, — বসন্ত দা, কোথায় গেলেন? সর্বনাশ হয়েছে! যিনি নাচ করছিলেন, তিনি না, বসন্ত দা কোথায়ও নেই। পর পর ঘর দেখে আমার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলাম। এই শীতে ও গাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। দরজার হুড়কো খুলে বিছানা তে বসতে গিয়ে দেখলাম, তেল শেষ হয়ে গিয়ে হারিকেন নিভে গেছে। মোবাইলের হাল্কা আলো টুকুই এখন ভরসা।

টেবিলের উপর ভানু একটি কুঁজো তে জল দিয়েছিল। এখন দেখছি সেটা আর নেই! যাঃ বাবা, এ ভোজবাজি নাকি?
অবশ্য দরজার হুড়কো খুলে তো যে কেউ ঘরে ঢুকতে পারে। তাই ওটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমার ব্যাগ থেকে জলের বোতল টা বার করে দু ঢোক খেলাম। এখন দেখছি খুব খিদে ও পেয়েছে। মনে মনে ভেবে অবাক হচ্ছি, আমি কি রাক্ষস নাকি? ঘণ্টা তিনেক আগেই তো খেলাম কত কিছু! যাই হোক, ব্যাগের ভিতর একটা কেক ছিল, সেটা খেয়ে দাঁড়াতে গিয়ে ঝুলন্ত কোন কিছুর সঙ্গে মাথা টা ঠুকে গেল। বেশ অবাক হয়ে মোবাইলের আলোটা সামনে ফেলতেই আমার শরীর বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। আমি যে জিনিসের সঙ্গে ধাক্কা খেলাম, তা আর কিছু না, একটা ঝুলন্ত শরীর! আমি বাক শক্তি হারালাম। নাকে সেই কড়া সিগারেটের গন্ধ এসে লাগল। তারপর ই ভানুর কথা মনে পড়ল, যে এ ঘরে পনেরো বছর আগে বসন্ত দার ছোট ভাই গলায় দড়ি দিয়েছিলেন।

এক অ্যাডভেঞ্চারের আশাতে এখানে এসে ছিলাম। কিন্তু মনে হল এই ভৌতিক ঘটনা গুলো কে উপভোগ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমার হাত, পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। লোক টার জীব ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়িয়ে আছে! চোখ দুটো কোঠর থেকে বেড়িয়ে ঝুলছে! আর কি আশ্চর্য, করিকাঠ থেকে যার সাহায্যে লোক টি ঝুলছে, সেটা তো আমার ই ফেলে রাখা গামছা টা! হায় ঈশ্বর, আমার যে সহন ক্ষমতা ক্রমশ শূন্য হয়ে আসছে। বসন্ত দা ঠিকই বলেছিল। আমার মতন দুর্বল চিত্তের মানুষের অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হওয়া টা কিন্তু ধৃষ্টতা।

আর কিছু ভাবার সময় আমার ছিল না। আমি নিচে যেতে চাইলাম দ্রুত। কারণ বসন্ত দা আর ভানু তো নিচে থাকবে শুনেছিলাম। তাই বিছানা থেকে কোন ক্রমে ব্যাগ টা নিয়ে করিডোর ধরে ছুটতে শুরু করলাম। ততক্ষণে মোবাইলেও রেড সিগনাল দিচ্ছে। আর হয়তো কয়েক মুহূর্ত। তারপর ই আমি পুরো অন্ধকার রাজত্বে ডুবে যাব। সিঁড়ি দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে নামতে লাগলাম। কিন্তু শেষ ধাপে এসে কিছু একটা তে পা বেঁধে পড়ে গেলাম। হাত, পায়ে চট চটে কিছু লাগল। কেমন একটা আঁশ টে গন্ধ। মোবাইলের ক্ষীণ আলোয় দেখলাম একটা ডেডবডি মুখ থুবড়ে পড়ে। কিছুক্ষন আগে একটা গুলি চলার শব্দ পেয়েছি। এটা কি তবে তার ফলেই হল? আরে ঐ তো লোকটার হাতে এখনো পিস্তল টা ধরা! কে লোকটা?

সাদা পাঞ্জাবী টা দেখে বুক টা ছ্যাত করে উঠল। মনে সাহস এনে মোবাইলের আলো তে লোকটাকে চিৎ করলাম। এ যে বসন্ত দা! স্থির চোখ দুটো যেন আমাকেই দেখছে। কপালের মাঝখানে একটা ফুটো। যেখান থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। এসব দেখে গা গুলিয়ে উঠল। শরীর যেন কেমন অবশ হয়ে আসতে লাগল। এবার টিনের গেট টা লক্ষ্য করে টলমল অবস্হায় দৌড়াতে লাগলাম। হঠাৎ পিছনে এক ভয়ঙ্কর শব্দ। সাহস করে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম, পুরো বাড়ি টা আমার দিকেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। প্রাণ বাঁচাতে দুটো হাত মাথায় দিয়ে লাফ দিলাম। চারদিকে ইট পাটকেল পড়তে লাগল। ধুলোর ঝড়ে আমি ঢাকা পড়ে গেলাম। চারদিকে আর কিছু দেখা যায় না। আমি ক্রমাগত হাঁচতে আর কাশ তে লাগলাম। দম যেন বন্ধ হয়ে যাবে।

মোবাইল টা আর নেই। বেশ কিছু কাটল ধুলোর মধ্যে। তার পর যখন একটু ফিকে হল। দেখলাম আমি ধ্বংস স্তুপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছি। গেটের দিক টা লক্ষ্য করে কোনরকমে শরীর বাঁচিয়ে এগতে লাগলাম। হঠাৎ একটা চাঙড়ের নিচে এক জোড়া পা বেড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ালাম। মালকোঁচা মারা ধুতি টা বেশ চেনা লাগছে। কিন্তু আমার আর শ্বাস চলছিল না। কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ছিলাম। তার পর আর কিছু মনে নেই। কতক্ষণ ওভাবে পড়েছিলাম জানি না, বেশ কিছু মানুষের কোলাহলে আর মুখে-চোখে জলের ঝাপটা পড়তেই চোখ মেলে তাকালাম। আরে, এ আমি কোথায় পড়ে আছি? এ যে ফাঁকা মাঠ প্রায়! সবে ভোরের আলো ফুটেছে। তার আলোয় দেখলাম, বেশ দূরে দূরে কিছু পুরানো ইটের স্তূপ। কিভাবে এলাম এখানে? মুখে, চোখে এক রাশ বিস্ময় নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। মাথা টা প্রচণ্ড ভার হয়ে আছে বুঝলাম।

আপনি এখানে কিভাবে এলেন? বাড়ি কোথায় আপনার? কি হয়েছিল গত কাল? ভিড়ের মধ্যে এক নাগাড়ে পর পর প্রশ্ন আসায়, কার প্রশ্নের কি জবাব দেব, বুঝে উঠতে পারলাম না। তবু নেতা গোছের একজন বয়স্ক কে দেখে বসন্ত দার সঙ্গে আমার পরিচয়ের কথা, গত কালকের সব ঘটনা গুছিয়ে বললাম। ইতিমধ্যে কেউ একজন আমার অবস্থা দেখে গরম দুধ নিয়ে এসেছে। তাই খেয়ে একটু সুস্থ হলাম। নেতা গোছের লোক টি ততক্ষণে ভিড় সরিয়ে আমাকে ধরে ধরে পাশের একটা কারখানার ভিতর এনে চেয়ারে বসাল। তারপর আমার মুখোমুখি বসে বলল, — দেখুন দাদা, বহু দিন ধরেই এখানে একটা প্রায় তিনশ বছরের পুরানো ভূতুড়ে বাড়ি ছিল। রাত, বিড়েতে মেয়ে দের কান্না, হৈ চৈ, হাসি, ঠাট্টা, হঠাৎ হঠাৎ ফোন বেজে ওঠা, নাচ, গান এমন কি গুলির ও শব্দ পাওয়া যেত। তাই সন্ধ্যার পর একান্ত দরকার না থাকলে কেউ আর এ পথে যেত না।

আপনি যে বসন্ত দার কথা বলছিলেন, তাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম, আলাপ ও ছিল। আমি কিন্তু এখান কার খুব পুরানো বাসিন্দা। বসন্ত দা আমার প্রায় বাবার বয়সী ছিলেন। বিয়ে থা করেন নি। রিটায়ার্ড লাইফের পর বন্ধু, বান্ধব আড্ডা, বাড়িতে নর্তকী নিয়ে এসে মেহফিল বসানো তে তার জুড়ি ছিল না। সে রকম ই একজন ছিলেন মিস কাবেরী। আসল পরিচয় কেউ ই জানত না। এখানে আসা, যাওয়া করতে করতে স্হায়ী ভাবে থাকতে শুরু করে। আর বসন্ত বাবুর বিলেত ফেরত ডাক্তার ভাই হেমন্তর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। হেমন্ত বয়সে বসন্ত বাবুর থেকে প্রায় কুড়ি বছরের ছোট। আর তিনি ও বিয়ে থা করে নি। এদিকে বসন্ত বাবুও বুড়ো বয়সে কাবেরী কে ভালবেসে ফেলেছেন। যার ফলে এক ত্রিকোণ প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হল। বসন্ত বাবু একদিন ছোট ভাই এর সব কথা জেনে গেলেন। আর জলসা চলা কালীন একমাত্র ছোট ভাইকে সবার সামনে খুবই তিরস্কার করেন। তারপর শুরু হল বিশাল ঝামেলা। বসন্ত দার ভাই নিরীহ টাইপের মানুষ ছিলেন। জনসমক্ষে দাদার এই আচরণ হজম করতে না পেরে গলায় দড়ি দেন। সেই শোকে দিঘির জলে ডুবে আত্মঘাতী হয় কাবেরী ও। পর পর দুটি নিজের কাছের লোকের মৃত্যু তে বসন্ত বাবুও ভেঙে পড়লেন। তারপর ঐ দিনই নিজের কপালে গুলি করে আত্মঘাতী হন নিজেও।

—একই দিনে তিন তিনটে আত্মহত্যা!– ধরা ধরা গলায় বললাম।
— হ্যাঁ দাদা, ঠিক তাই। ঐ পরিবারে দু ভাই এর কেউ ই বিয়ে থা না করায়, কোন উত্তরাধিকারী ছিল না।

এক মাত্র চাকর ভানুরও আর কোন কাজ থাকে না। কিন্তু তার দেশ বিহারে বলে শেষ বয়সে আর দেশে ফিরতে চান নি। আশেপাশের গ্রামে ভিক্ষাবৃত্তি করে ঐ বাড়ি তেই শেষ জীবন টা কাটিয়ে দেয়।

— কাটিয়ে দেয় মানে? এখন কি উনি নেই? প্রবল আতঙ্কে জিজ্ঞাসা করলাম। লোকটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, — না নেই। বছর পাঁচেক আগে ভূমিকম্পে পুরো বাড়ি ভেঙে পড়ে। ভানু দা ছাড়াও বসন্ত বাবুর যে বন্ধুরা তার মৃত্যুর পরও এখানে সন্ধ্যা বেলায় বিভিন্ন কারণে আসত, তারা সবাই ধ্বংস স্তূপে চাপা পড়ে মারা যায়। পরে প্রশাসন থেকে ধ্বংস স্তূপ তাদের বডি গুলো উদ্ধার করে। আর পুরো জমিদার বাড়ি টাই এলাকার ম্যাপ থেকে হারিয়ে যায়, শুধু পড়ে থাকে তার পনেরো বিঘা জুড়ে বিশাল এই ধ্বংস স্তূপ। এত দূর শুনে আমার মাথা ভন ভন করতে লাগল। তবে কি বসন্ত দার সঙ্গে ফোনে কথোপকথন, আমার এখানে আসা, এত গুলো ঘটনা, সবই ধোয়াশা? গাল টা কিন্তু এখনো জ্বলে যাচ্ছে!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments