Thursday, April 25, 2024
Homeবাণী-কথাঅনুবাদ গল্পঅনুবাদ গল্প: জাদুকরের নিমন্ত্রণ

অনুবাদ গল্প: জাদুকরের নিমন্ত্রণ

অনুবাদ গল্প: জাদুকরের নিমন্ত্রণ

এই জীবনে আমি অনেক উদ্ভট দাওয়াতে গিয়েছি। তোমাদের হাতে যথেষ্ট সময় থাকলে বলতে পারি, সোনার খনিতে খাওয়া সেই দুপুরের খাবার কিংবা এক কোটিপতির বাসায় দাওয়াতের কথা। তবে আমার ধারণা, এক জাদুকরের বাসায় দাওয়াতের গল্প শুনতেই তোমরা বেশি পছন্দ করবে। কারণ, এ রকম আজব অভিজ্ঞতা খুব কম মানুষেরই আছে। অবশ্য খুব কম মানুষই সত্যিকারের জাদুকর চেনে। কারণ, ইংল্যান্ডে জাদুকর খুব একটা নেই। কিছু কিছু বাজিকর আছে, যারা নিজেদের জাদুকর বলে দাবি করে। তারা শিয়ালের মতো চতুর।

কিন্তু সত্যিকারের জাদুকরের মতো জাদু দেখাতে পারে না তারা। আমি বলতে চাইছি, বাজিকরেরা তোমার সামনে একটা গোল্ডফিশের অ্যাকুয়ারিয়ামকে হঠাৎ একটা ধবধবে সাদা নাদুসনুদুস খরগোশ বানাতে পারে। কিন্তু এটা আড়ালে আড়ালে হাতসাফাই ছাড়া কিছুই না। তোমাকে স্রেফ বোকা বানাবে। কিন্তু সত্যিকারের জাদুকর একটা গরুকে চাইলে ঘড়ি বানিয়ে দিতে পারেন, যেটা ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজায়। আর তিনি এই কাজটা করতে পারবেন কোনো আড়াল ছাড়াই। এমন কাজ অনেক কঠিন। অবশ্যই যে-সে করতে পারে না, মানে যেভাবে সপ্তাহে ছয় দিন মঞ্চের ওপর বাজিকরেরা টুপি থেকে সহজে খরগোশ তুলে আনে।

মিস্টার লিকির সঙ্গে যেদিন আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, আমি বুঝতেই পারিনি তিনি সত্যিকারের জাদুকর। ঘটনার দিন হে মার্কেটের দিকে যাচ্ছিলাম। বিকেল পাঁচটার দিকে। আমি যখন রাস্তা পার হচ্ছিলাম তখন ঢাল বেয়ে একটা বাস আসছিল। তাই দ্রুত ল্যাম্পপোস্টের নিচে আশ্রয় নিলাম। কিন্তু এক ভদ্রলোক রাস্তার মাঝেই ছিলেন তখনো। বাস আসতে দেখে পেছনের দিকে লাফ দিয়ে এক মোটরগাড়ির সামনে পড়ছিলেন আরেকটু হলেই। সেই মুহূর্তে আমি তাঁর কোটের কলারে টান দিয়ে নিরাপদ জায়গায় না নিয়ে এলে তিনি চাপাই পড়তেন। সেদিন আবহাওয়া আর্দ্র ছিল, রাস্তাও ছিল পিচ্ছিল। মোটরগাড়ির ড্রাইভার ব্রেক কষেও গাড়ি থামাতে পারেনি পুরোপুরি।

তাই দেখতে ছোটখাটো সেই ভদ্রলোক অনেক কৃতজ্ঞ হলেন আমার প্রতি। একই সঙ্গে ভয়ে জবুথবু। তাঁকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করে বাসায় পৌঁছে দিলাম। তাঁর বাসাটা কাছেই। কিন্তু ভুলেও তাঁর ঠিকানা জিজ্ঞেস কোরো না। আমি বলে দিলে হয়তো কোনো একদিন তুমিও তাঁর বাসায় যাবে। তাতে বিরক্ত হয়ে তিনি তোমার এক কান বাঁধাকপি পাতার মতো করে দিলেন কিংবা তোমার চুলগুলো সবুজ বা ডান পা-বাঁ পা অদলবদল করে দিলেন অথবা আরও ভয়াবহ কিছু। তারপর সবাই তোমাকে দেখে হেসে হেসে বলবে, ‘এই যে জনাব কান-ঝুলো’ বা ‘গিরগিটি বালিকা’।

সেদিন বাসায় গিয়ে তিনি বললেন, ‘এই আধুনিক গাড়িঘোড়া আমার ভালো লাগে না। এদের যমের মতো ভয় পাই। লন্ডনে আমার কাজকর্ম না থাকলে আমি চিরতরে গাড়িঘোড়াহীন এক ছোট্ট দ্বীপে চলে যেতাম কিংবা পাহাড়চূড়ায়।’ তিনি নিশ্চিত ছিলেন, আমি তাঁর জীবন বাঁচিয়েছি। তাই আমাকে ডিনারে যোগ দিতে বললেন। বললাম, বুধবারে তাঁর দাওয়াত রক্ষা করব। সেদিন তাঁর ব্যাপারে বিশেষ কিছু খেয়াল করিনি। শুধু মনে আছে, তাঁর কান কিছুটা বড় ছিল। আর কানের ওপর এক গোছা করে চুল ছিল। অনেকটা চিড়িয়াখানার বনবিড়ালের মতো। ভাবলাম, আমার কানে চুল থাকলে আমি প্রতিদিনই সেগুলো শেভ করে ফেলে দিতাম। তিনি তাঁর পরিচয় দিলেন ‘লিকি’ নামে। ওই বাড়ির দোতলায় থাকেন তিনি।

সেই হপ্তার বুধবার তাঁর বাসায় গেলাম ডিনারের জন্য। কয়েকটা ফ্ল্যাট পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দরজায় টোকা দিলাম। খুবই সাদামাটা এক দরজা, ঠিক ফ্ল্যাটটার হলঘরের মতোই। কিন্তু যখন ভেতরে গেলাম, আমার জীবনের সবচেয়ে আজব ঘরটা দেখলাম আমি। দেয়ালে ওয়ালপেপারের বদলে চারদিক ঘিরে পর্দা ঝুলছিল আর সেটার ওপর মানুষ-পশুপাখির নানা ছবি এমব্রয়ডারি করা। এক ছবিতে দুটো মানুষ ঘর বানাচ্ছিল। আরেক ছবিতে এক লোক তার কুকুর নিয়ে বুনো খরগোশ শিকার করছিল ক্রস-বো নিয়ে। বুঝতে পেরেছিলাম, ওগুলো স্রেফ সেলাই ছিল, তবু আমি ওগুলো ছুঁয়ে দেখলাম। ছবিগুলো বায়োস্কোপের মতো নড়ে যাচ্ছিল, যার যার কাজ করে যাচ্ছিল। চোখ সরিয়ে আবার তাকালে বদলেও যাচ্ছিল। ডিনার শুরু হতে না-হতেই ওই দুটো মিস্ত্রি একতলা বাড়ি বানিয়ে ফেলল, শিকারি একটা পাখি ধরে ফেলল আর তার কুকুরটা পেল দুটো খরগোশ।

আসবাবগুলো পর্যন্ত অদ্ভুত ছিল। বইয়ের তাক ছিল কাচের। তাতে রাখা ছিল আমার দেখা সবচেয়ে বিশাল সাইজের বই। চামড়ায় বাঁধানো বইগুলোর একটাও এক ফুটের কম হবে না উচ্চতায়। চেয়ারগুলো সুন্দরভাবে খোদাই করা। আর ছিল দুটো টেবিল। একটা কাঠের, অন্যটা তামার। তার ওপর বিশাল এক ক্রিস্টালের গোলক। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না, ঘরটাতে আলো আসছে কী করে। ছাদ থেকে অনেক উদ্ভট জিনিস ঝুলছিল। পরে বুঝতে পারলাম আলোর উৎস। টবে জন্মানো বিভিন্ন গাছের ফলগুলো লাল, হলুদ আর নীল আলো ছড়াচ্ছিল। এমন আজব ফল সে পেল কোথায়! এগুলো লুকানো ইলেকট্রিক ল্যাম্পও ছিল না। আমি স্পর্শ করে দেখলাম ওগুলো ঠান্ডা আর ফলের মতোই নরম।

‘বলুন, ডিনারে কী খেতে আপনি পছন্দ করবেন?’ মিস্টার লিকি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।

‘ওহ্, আপনার বাসায় যা কিছু হবে।’

‘আপনার যা মনে আসে আপনাকে পরিবেশন করা হবে। অনুগ্রহ করে আপনি কোন স্যুপ খেতে চান, বলুন’, তিনি জানতে চাইলেন।

ভাবলাম, তিনি হয়তো কোনো এক রেস্টুরেন্ট থেকে আনিয়ে নেবেন। তাই বললাম, ‘আমি বোরৎশ নিবো’। এটা ক্রিম মেশানো লালচে রাশিয়ান স্যুপ।

‘ঠিক আছে’, তিনি বললেন। ‘ব্যবস্থা করছি। দেখুন, আপনি কি কিছু মনে করবেন, যদি আপনাকে সেভাবে ডিনার পরিবেশন করি, যেভাবে আমারটা সব সময় হয়? আপনি আবার সহজে ভয় পান না তো?’

‘খুব সহজে ভয় পাই না’, আমি জবাব দিলাম।

‘তাহলে আমার পাচককে ডাকি। আগে থেকেই সাবধান করে দিচ্ছি, সে কিন্তু বেশ আলাদা।’

এটা বলতে বলতেই মিস্টার লিকি তাঁর কানের লতিগুলো দোলালেন, সেগুলো মাথার সঙ্গে বাড়ি খেতে লাগলে নিচু লয়ে হাততালির মতো শব্দ হলো। এরপর ঘরটার এক কোণে রাখা কাপড় ধোয়ার গামলার মতো বিশাল তামার পাত্র থেকে কিছু একটা উঠে এল। প্রথমে ভেবেছিলাম, সেটা হয়তো বিশাল ভেজা সাপ। একটু খেয়াল করে দেখা গেল, এটার একপাশে কিছু চোষক লাগানো। এটা তাহলে অক্টোপাসের একটা পা! সেটা ক্যাবিনেটের দেরাজ খুলে একটা তোয়ালে বের করে নিজেকে খুব ভালো করে মুছে নিল। এরপর টিকটিকির মতো দেয়াল বেয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। এত বড় অক্টোপাস আমি কখনো দেখিনি। এর প্রতিটা পা আট ফুটের মতো লম্বা আর দেহটা একটা বস্তার মতো। দেয়াল বেয়ে, ছাদ বেয়ে সে টেবিল পর্যন্ত পৌঁছাতেই বাকি সাতটা পা দিয়ে কাপ-পিরিচ-চামচ নামিয়ে সাজিয়ে দিল বুকশেলফের ওপরকার ক্যাবিনেট থেকে।

‘ও হচ্ছে অলিভার। আমার বাসার কাজ করে দেয়। মানুষের চেয়ে সে কাজকর্মে বেশি পারদর্শী। কারণ, তার ছয়টা অতিরিক্ত কাজের হাত আছে। আর চোষকগুলো দিয়ে কাচের প্লেট কখনো পড়ে যায় না।’

অলিভার নামের অক্টোপাসটি যখন টেবিল সাজাচ্ছিল সে তার সাত হাতে ধরা বোতল থেকে একে একে পানি, লেমনেড, বিয়ার আর চার প্রকার ওয়াইন সাধল। আমি একটু পানি আর বার্গেন্ডি থেকে আসা চমৎকার রেড ওয়াইন বেছে নিলাম।

আট-পেয়ে অলিভারের মাথায় টপ হ্যাট দেখে অবাক হইনি। কিন্তু অবাক হলাম যখন সে হ্যাট খুলে সেখান থেকে দুই বাটি স্যুপ ঢেলে দিল।

‘আহ্, আমাদের কিছু ক্রিমও দরকার’, মিস্টার লিকি শুধালেন। ‘এদিকে আসো ফিলিস।’ এটা শুনে একটা ছোট্ট সবুজ গরু এল, খরগোশ আকারের। ফিলিসের কাছ থেকে একটা রুপোর জগে ক্রিম নেওয়া হলো। সেটা স্বাদে চমৎকার। স্যুপটা খেয়ে আমি তৃপ্ত।

‘এরপরে আপনি কী খেতে চান?’ তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন।

‘আপনার ওপরই ছেড়ে দিলাম’, সবিনয়ে বললাম।

‘তাহলে আমরা গ্রিল করা টার্বট মাছ আর টার্কি নিচ্ছি। ওহে অলিভার, দয়া করে একটা টার্বট ধরে দাও। আর পম্পেই ওগুলোকে গ্রিল করার প্রস্তুতি নাও।’

হুকুম মেনে অলিভার একটা বড়শি নিয়ে সুতায় বেঁধে তার এক হাতের প্রান্ত থেকে ঝুলিয়ে দিল। পাকা জেলের মতো বাতাসে তা ভাসিয়ে বড়শি ফেলল। এ সময় ফায়ারপ্লেস থেকে হট্টগোল শুনতে পেলাম এবং পম্পেই বেরিয়ে এল। সে একটা ছোট্ট ড্রাগন, এক ফুটের মতো উঁচু। তার লেজ দৈর্ঘ্যে এক ফুট। গনগনে কয়লার ওপর শুয়ে পম্পেই উত্তাপে লাল হয়ে আছে। তাকে এক জোড়া অ্যাসবেস্টসের বুট পরে নিতে দেখে স্বস্তি পেলাম।

‘লেজখানা ভালো করে তুলে ধরে রাখো, পম্পেই’, মিস্টার লিকি কড়া কণ্ঠে বললেন। ‘যদি তুমি আবারও কার্পেট পুড়িয়ে ফেলো, আমি তোমার ওপর এক বালতি ঠান্ডা পানি ঢেলে দেব।’ (আমি অবশ্য কখনোই এমন করব না। ড্রাগনের গায়ে পানি ঢেলে দেওয়া অনেক নিষ্ঠুর কাজ। বিশেষ করে এমন পাতলা চামড়ার শিশু ড্রাগনের ওপর)। শেষ কথাগুলো তিনি অনেক আস্তে বললেন, স্রেফ আমি শুনলাম। বেচারা পম্পেই হুমকিটা গুরুত্বসহকারে নিল। ফুঁপিয়ে ওঠায় ওর নাক থেকে হলুদ আগুনের শিখা বের হলো। অপটুভাবে পেছনের পায়ের ওপর ভর দিয়ে লেজটা ধরে হেঁটে এল। ভারী পাথুরে বুট জুতার কারণে বেচারা হাঁটতে পারছিল না। কারণ, ড্রাগনেরা সাধারণত চার পায়ে হাঁটে আর কদাচিত্ জুতা পরে। কিন্তু মেঝের কার্পেট আগুনের হাত থেকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় নেই।

পম্পেইকে দেখতে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে আমি অলিভারের মাছ ধরা দেখতে পারলাম না। যখন সেদিকে চোখ গেল, অলিভার মাছটা পরিষ্কার করে ফেলে পম্পেইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। পম্পেই তার একটু ঠান্ডা হয়ে যাওয়া সামনের দুহাত নিয়ে মাছটা ধরল। ওর হাতের তাপমাত্রা গ্রিল করার জন্য জুতসই এখন। কাজ হয়ে গেলে সে অলিভারের কাছে মাছটা দিল একটা প্লেটের ওপর। পম্পেই ঠান্ডায় কাঁপছিল, দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছিল। তাই সে আবারও ফায়ারপ্লেসে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

‘হ্যাঁ, আমি জানি কিছু লোকে বলে একটা পিচ্চি ড্রাগনকে এভাবে ঠান্ডা হতে দেওয়াটা নিষ্ঠুর’, মিস্টার লিকি বললেন। ‘কিন্তু আমি বলি, ড্রাগনরা এটা বুঝতে সময় নেয় যে জীবন স্রেফ আগুনের কুণ্ডু আর উত্তাপ নয়। পৃথিবী তার পছন্দের চেয়ে অনেক বেশি ঠান্ডা। আর ঠান্ডা লাগলে ওকে কিছু সালফার খেতে দিই। ঠান্ডা লাগা ড্রাগনের চেয়ে জঘন্য কৌতুক আর কী হতে পারে? কিন্তু আমি জানি, এদের হাঁচি থেকে ছুটে আসা আগুন শত মাইল যেতে পারে। এভাবে চীনের এক সম্রাটের রাজপ্রাসাদ পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া স্রেফ শখের বশে ড্রাগন পোষার মতো সচ্ছল আমি নই। তাই ওকে দিয়ে কিছু কাজ করাই। যেমন ধরুন, এই গত সপ্তাহেই ওকে দিয়ে দরজার পুরোনো রং পুড়িয়ে ওঠালাম। এ ছাড়া চোর-ডাকাতের হাত থেকে ঘর নিরাপদ রাখতে ও কুকুরের চেয়ে বেশি ভালো। চোর-ডাকাত মাঝে মাঝে পাহারাদার কুকুরকে গুলি করে। কিন্তু সিসার বুলেট পম্পেইকে স্পর্শ করলেই গলে যাবে। আমার ধারণা ড্রাগনেরা শোপিস নয়, কাজের জিনিস।’

‘আচ্ছা, আপনি জানেন কি, আমার বলতে লজ্জা লাগছে যে পম্পেই আমার দেখা প্রথম ড্রাগন।’ আমি উত্তর দিলাম।

‘অবশ্যই’, মিস্টার লিকি বললেন। ‘আমিও বা কতটা বোকা দেখুন, আমার অতিথিরা সবাই আমার পেশারই হয়। ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি সাধারণ পেশার মানুষ।’ টুপি থেকে মাছটার ওপর সস ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘জানি না আপনি আজব কিছু লক্ষ করছেন কিনা। কিছু লোকের পর্যবেক্ষণক্ষমতা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি।’

‘সত্যি বলতে, এর আগে আমার এমন অভিজ্ঞতা হয়নি।’

যেমন সেই মুহূর্তে খেয়াল করছিলাম রংধনু রঙের গুবরেপোকা আমার প্লেটের দিকে আসছিল। সেটার পিঠে লবণদানি বাঁধা ছিল।

‘তাহলে আপনি তো বুঝে ফেলেছেন যে আমি একজন জাদুকর’, তিনি বললেন। ‘পম্পেই অবশ্যই একটা আসল ড্রাগন। কিন্তু এখানকার অধিকাংশ প্রাণীই একসময় মানুষ ছিল। আমি তাদের জাদু করে বর্তমানের রূপ দিয়েছি। যেমন ধরুন অলিভার যখন মানুষ ছিল তার পা দুটো ট্রেনের নিচে কাটা পড়েছিল। আমি সেগুলো জোড়া লাগাতে পারিনি। কারণ, আমার জাদু যন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে না। রক্তপাত হয়ে অসহায় অলিভার মরেই যাচ্ছিল। তার জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায় ছিল তাকে এমন কোনো প্রাণীতে পরিণত করা, যার কোনো পা নেই। তখন তার আর কেটে ফেলার যোগ্য কোনো পা থাকবে না। আমি তাকে একটা শামুক বানিয়ে বাসায় নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু যতবারই তাকে আরও ভালো কিছু বানানোর চেষ্টা করছিলাম, যেমন ধরুন কুকুর, দেখা গেল তার পেছনের পা দুটো নেই। অক্টোপাসের কিন্তু কোনো পা-ই নেই। ওই আটখানা টেন্টাকল মাথা থেকেই বের হয়। তাই তাকে অক্টোপাসে রূপান্তরিত করার পর আর কোনো অসুবিধাই থাকল না। যখন সে মানুষ ছিল, সে ওয়েটারেরই কাজ করত, তাই সে তাড়াতাড়ি কাজ শিখে গেল। তুমি বাকি মাছটুকু খেয়ে নিয়ো, অলিভার। সঙ্গে কিছু বিয়ার। আমি জানি, এসব তোমার পছন্দ।’

অলিভার খাবারটা এক শুঁড়ে পেঁচিয়ে টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো মুখ দিয়ে গিলে নিল। বিয়ারের বোতলের মুখ খুলে ঢকঢক করে বোতল খালি করার সময় সে বিশাল বিশাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আচমকা চোখ টিপল। এই আচরণে নিশ্চিত হলাম সে আসলেই এককালে মানুষ ছিল। আমি কখনো সত্যিকারের অক্টোপাসকে এভাবে চোখ টিপতে দেখিনি।

টার্কির রোস্ট এল সাদামাটাভাবেই। অলিভার একটা বিশাল প্লেটকে একটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখল। মিস্টার লিকি উঠে ছাতা রাখার জায়গা থেকে একটা ওয়ান্ড বের করে সেটা ঢাকনাটার দিকে তাক করে বিড়বিড় করে কিছু বললেন। এরপর অলিভার ঢাকনাখানা সরাতেই দেখি ধোঁয়া-ওঠা গরম গরম টার্কি।

‘এটা করা কোনো ব্যাপারই না’, স্মিত হাসিমুখে মিস্টার লিকি বললেন। ‘যেকোনো দক্ষ বাজিকরই এটা পারবে কিন্তু সে নিশ্চয়তা দিতে পারবে না যে খাবারটা টাটকা। সে জন্যই আমার সদ্য ধরা মাছের স্বাদ দারুণ লাগে। যদিও কিছুদিনের পুরোনো পাখির মাংসে স্বাদ বেশি। আর কিছু সসেজ হলেও বেশ হয়।’

তিনি একটা ছোট্ট মাটির নল তাঁর পকেট থেকে বের করে ফুঁ দিলেন। একটা বিশাল বাদামি বুদ্বুদ বের হয়ে সসেজের রূপ নিল। অলিভার এক শুঁড় দিয়ে সেটা তুলে নিয়ে প্লেটে পরিবেশন করল। এটা সসেজই ছিল। কারণ, আমি সেটা খেতে পারছিলাম। এভাবে তিনি ছয়খানা সসেজ বানালেন। আমি যখন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁকে দেখছিলাম, অলিভার সবজির সালাদ পাতে তুলে দিল। টেরও পেলাম না সেগুলো কোত্থেকে এল। বরাবরের মতো মিস্টার লিকি সেগুলোর ওপর গ্রেভি ঢেলে দিলেন তাঁর টুপি থেকে।

এরপরেই এই সন্ধ্যার প্রথম দুর্ঘটনা ঘটল। যেই গুবরেপোকাটা লবণদানি বয়ে এনেছিল, তার লবণদানি থেকে ভুলবশত কিছু লবণ উপচে পড়ল টেবিল ক্লথের ওপর, একেবারে মিস্টার লিকির সামনেই।

‘তুমি সৌভাগ্যবান বটে, লিওপোল্ড, যে আমি সচেতন মানুষ’, মিস্টার লিকি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন। ‘আমি কুসংস্কারমনা নই। যদি তাই হতাম তাহলে ভাবতাম, এই লবণের কারণে আমার কপালে খারাপ কিছু আছে। যদি কারও কপালে খারাবি থাকে, সেটা তোমারই। তোমাকে আবারও মানুষে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা আমার আছে। যদি আমি সেই ইচ্ছা পূরণ করি, সোজা তোমাকে কাছে-পিঠে এক থানায় নিয়ে যাব। আর পুলিশ যখন তোমাকে জিজ্ঞেস করবে এত দিন তুমি কোথায় লুকিয়ে ছিলে, তারা কি তোমার কথা বিশ্বাস করবে যে তুমি এই এক বছর গুবরেপোকা হয়ে ছিলে? তোমার কি আফসোস হচ্ছে না?’

লিওপোল্ড অনেক কষ্টে পিঠের বাঁধন থেকে বের হয়ে এল। এরপর উল্টে গিয়ে তার কিলবিলে ছয় পা নাড়াতে লাগল প্রভুভক্ত কুকুরের মতো।

‘যখন লিওপোল্ড মানুষ ছিল, সে লোকজনকে ঠকিয়ে টাকা আয় করত। পুলিশ তার কারিকুরি জেনে গিয়ে অ্যারেস্ট করতে চাইলে, সে এসে আমার কাছে সাহায্য ভিক্ষা করল। ভাবলাম, এটা তার জন্য ভালো শাস্তি হবে। তাই তাকে সুযোগ দিয়ে বললাম, তুমি ধরা পড়লে তোমার সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হবে। আর আমার এখানে আশ্রয় নিলে পাঁচ বছর গুবরেপোকা হয়ে থাকতে হবে। যদি তুমি ভালো আচরণ করো, পাঁচ বছর পর আমি তোমাকে ভিন্ন চেহারার মানুষ বানিয়ে দেব, যাতে পুলিশ আর তোমাকে চিনতে না পারে। তাই লিওপোল্ড এখন গুবরেপোকা’, মিস্টার লিকি আমাকে ব্যাখ্যা দিলেন। ‘যেহেতু তুমি লবণ ফেলে দেওয়া নিয়ে আফসোস করছ, লিওপোল্ড, এখনই প্রতিটা লবণের দানা তুলে ফেলবে।’

উপচে যাওয়া লবণের প্রতিটি দানা তুলতে লিওপোল্ডের মোট এক ঘণ্টা লাগল। প্রথমে সে তার মুখ দিয়ে প্রতিটা দানা তুলছিল। এরপর পাখা দিয়ে। অনেক পরিশ্রমের পর তার মাথায় বুদ্ধির উদয় হলো। সে এক টুকরো কাগজ সামনের পা দুটো দিয়ে বেলচার মতো ধরে বাকি লবণ তুলে ফেলল।

‘একটা গুবরেপোকার বুদ্ধিকে ছাড়িয়ে গেলে’, জাদুকর বললেন। ‘যখন সে তার মনুষ্য রূপ ফিরে পাবে, আশা করি সে শুধরে যাবে আর সৎ উপায়ে রোজগার করবে।’

টার্কিটা প্রায় শেষ হওয়ার পথে, তখন মিস্টার লিকি চিন্তিতভাবে বারবার ঘড়ি দেখছিলেন।

‘আশা করি আবদুল মক্কর স্ট্রবেরি নিয়ে পৌঁছাতে দেরি করবে না।’ তিনি বললেন।

‘স্ট্রবেরি!’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। এই জানুয়ারির বরফ-ঢাকা সময়ে স্ট্রবেরি পাওয়া যায় নাকি!

‘ও, হ্যাঁ। আমি আবদুল মক্করকে সে জন্য নিউজিল্যান্ড পাঠিয়েছি। অবশ্যই সেখানে ভরপুর গ্রীষ্ম। তার বেশি দেরি হওয়ার কথা নয়, যদি সে ভালোমতো চলে। কিন্তু জানেনই তো জিনরা কেমন হয়। মানুষের মতোই তাদের কিছু বদভ্যাস থাকে। কৌতূহল বিশেষ করে। যখন তাদের এমন কোনো কাজে পাঠানো হয়, তারা অনেক বেশি উচ্চতায় উড়ে উড়ে যায়, যাতে স্বর্গে দেবদূতদের কথোপকথন শুনতে পায়। তাদের এই কানপাতার চেষ্টায় দেবদূতেরা রেগে গিয়ে ওদের দিকে ঝরে পড়া নক্ষত্র ছুড়ে দেয়। তখন তারা তাদের পার্সেল ফেলে অর্ধেক দগ্ধ হয়ে বাড়ি ফেরে। তার তো চলে আসার কথা। এক ঘণ্টা তো পেরিয়ে গেল। এরই মাঝে আমরা অন্য কোনো ফল খাই যদি তার দেরি হয়।

তিনি উঠে পড়ে তাঁর ওয়ান্ড দিয়ে টেবিলের চার কোনায় টোকা দিলেন। প্রতিটি কোনা ফুঁড়ে গাছের কাষ্ঠল কাণ্ড বের হলো এবং সেগুলোর শাখা-প্রশাখা গজাল। সেই শাখায় এল পাতার মুকুল এবং তারা বাড়তে থাকল। এক মিনিটের মাথায় তারা কয়েক ফুট লম্বা গাছ হয়ে গেল। আমি চেয়ারে বসেই দেখতে পাচ্ছিলাম তাদের একটা চেরি, একটা নাশপাতি, একটা পিচ। কিন্তু চতুর্থটি চিনতে পারলাম না।

অলিভার তখন টার্কির অবশিষ্টগুলো চার হাতে পরিষ্কার করে নিয়ে যাচ্ছিল। আর পঞ্চম হাতে একখানা সসেজ মুখে চালান করছিল। এমন সময় আবদুল মক্কর এল। সে আবির্ভূত হলো ছাদ ভেদ করে, যেভাবে চিড়িয়াখানার পেঙ্গুইনরা জলাশয়ে ডুব দেয়। সে একটুর জন্য অলিভারের এক পায়ে পাড়া দেওয়া থেকে বাঁচল, তবু নিরাপদে মেঝেতে অবতরণ করল হাঁটু গেড়ে, জাদুকরের সামনে মাথা নত করে উপবিষ্ট হয়ে। তার বাদামি মুখে ছিল লম্বা একটা নাক, চেহারা কিছুটা মানুষের মতোই। যদিও তার চামড়ার ডানা ছিল বাদুড়ের মতো, গুটিয়ে রাখা। আর তার নখ সোনার তৈরি, মাথায় পাগড়ি আর গায়ে সবুজ সিল্কের জামা।

‘হে বিশ্বের রাজাধিরাজ এবং অন্যায়ের পরিত্রাতা’, আবদুল মক্কর বেশ নাটকীয়ভাবে বলে গেল, ‘আপনার অযোগ্য ভৃত্য দুর্লভ ফলাহার লইয়া আপনার দরবারে উপস্থিতি ঘোষণা করিতেছে।’

‘তোমার উপস্থিতি আমাকে প্রীত করিয়াছে’, জাদুকর হাজিরা নিলেন যেন।

‘এই হীন ভৃত্যের আনন্দ রাজা সলোমন, ডেভিডের সন্তান (তাহার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক)-এর রানি বিলকিস, শেবার রানির প্রথম দর্শন পাওয়ার সমান। সব আনন্দের বিরুদ্ধকর্তা এই আবাস থেকে দূরে থাকুক।’

‘যেন কখনো তোমার মতিভ্রম না হয়।’

‘হে দৈত্যবশকারী জাহাঁপনা, গবলিনদের অধিকর্তা, আপনার এই ভৃত্য কী অপরাধ করিয়াছে?’

‘তাহা তোমার বোধবুদ্ধি দিয়া বুঝিয়া লও।’

‘যারপরনাই ক্ষমা করিবেন, হুজুর।’

‘তোমাকে প্রস্থানের অনুমতি দেওয়া হইল। প্রত্যুষে আমাকে শয্যা হইতে জাগ্রত করিবে। আমার সেফটি রেজরের ব্লেড শেষ হইয়া গিয়াছে এবং লন্ডনের দোকানাদি বন্ধ রইয়াছে। যত শিগগির সম্ভব মন্ট্রিয়লের উদ্দেশে যাত্রা করিয়া মধ্য দুপুরের মাঝে ফিরিবে এবং আমার লাগিয়া এক প্যাকেট খরিদ করিবে।’

‘আপনার আদেশ সভয়ে যথার্থভাবে পালন করিব।’

‘ভয় করিবে কেন ইফ্রিতগণের মাঝে সর্বনির্ভীক?’

‘হে জাহাঁপনা, নিম্ন বায়ুস্তর জাদুর গালিচা অপেক্ষা দ্রুতগামী উড়োজাহাজে ভরপুর এবং উচ্চ বায়ুস্তর উল্কাপিণ্ডের রাজপথ।’

‘ভূমি হইতে পাঁচ ক্রোশ ওপর অবধি উড্ডয়ন করিবে, তবেই তুমি উভয় প্রকার মুসিবত হইতে মুক্ত থাকিবে। হে সকল আদেশ পালনকারী ও ইচ্ছাপূরণকারী, এখন তবে বিদায় লইতে পারো।’

‘হে জাহাঁপনা, প্লেটোর বুদ্ধিমত্তা, শিখের আয়ু, সলোমনের ঐশ্বর্য এবং আলেকজান্ডারের সাফল্য যেন আপনার পূত পদযুগলে লুটিয়া পড়ে।’

বলিয়া জিন মশাই অদৃশ্য হইলেন। থুক্কু, এসব বলে আবদুল মক্কর গায়েব হলো মেঝে ভেদ করে। যতক্ষণ আমি তাদের ভাবগম্ভীর কথোপকথন শুনছিলাম, গাছগুলো চার ফুট লম্বা হয়ে গেছে এবং তাতে ফুল ফুটেছে। ফুলের পাপড়িগুলো ঝরে গিয়ে সবুজ ফলের উদয় হচ্ছিল।

‘এভাবে জিনদের সঙ্গে কথা না বললে তারা আপনাকে সম্মান করে না। আশা করি তার সঙ্গে আপনাকে পরিচয় না করিয়ে দেওয়ায় আপনি আহত হননি। কিন্তু জিনরা অপরিচিতদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অনেক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।’ জাদুকর আমার কাছে ভদ্রতাবশত ক্ষমা চাইলেন। ‘আবদুল মক্কর ভালো জিন কিন্তু সে অনেক বেশি কথা বলে। আর সাধারণ মানুষ হিসেবে জিনদের নিয়ন্ত্রণ করার ভাষা আপনার জানা নেই। যেমন ধরুন আপনি ক্রিকেট খেলছেন, ব্যাটিং করছেন এক ফাস্ট বোলারের বিরুদ্ধে, আবদুল মক্কর বলবে, ‘জাহাঁপনা, আমি কি শত্রুকে বধ করিব? হে স্ট্যাম্পরক্ষক, তাহাকে কি রোগাক্রান্ত পাঁঠায় পরিণত করিব?’ আপনি জানেন আমি ক্রিকেট খেলার অনেক ভক্ত ছিলাম, কিন্তু এখন আর দেখতে পারি না। কারণ, একটুখানি জাদু ম্যাচের ফলাফল ওলটপালট করার জন্য যথেষ্ট। গত বছর আমি অস্ট্রেলিয়া বনাম গ্লচেস্টারশায়ারের ম্যাচ দেখতে গেলাম। গ্লচেস্টারশায়ারের ওপর আমার একটু সহানুভূতি ছিল বলে অস্ট্রেলিয়ার উইকেট গণহারে পড়তে লাগল। আমি ওই দিন চলে না এলে অস্ট্রেলিয়া হেরেই যেত। এরপর আর কখনো টেস্ট ম্যাচ দেখতে যাইনি। কারণ, আমি চাই সর্বশ্রেষ্ঠই জিতুক।’

আমরা নিউজিল্যান্ড থেকে আনা স্ট্রবেরি খেলাম। ফিলিস ক্রিমের সঙ্গে এদের খেতে অপূর্ব লাগল। এ সময় পম্পেই হেঁটে চলা চুল্লির মতো পনির গলিয়ে দিচ্ছিল। সেটা থেকে ওয়েলশ রেয়ারবিট বানানো হলো। এরপর আমরা ডেজার্ট খেতে শুরু করলাম। চতুর্থ গাছে অ্যাপ্রিকটের মতো এক ডজন সোনালি ফল ঝুলছিল। কিন্তু আকারে অনেক বড়। জাদুকর জানালেন, এরা হচ্ছে আম, যেটা ভারতীয় উপমহাদেশে জন্মে। এমনকি জাদু ছাড়া এদের ইংল্যান্ডে উৎপাদন করা সম্ভব না। তাই আমি আম বেছে নিলাম চেখে দেখার জন্য।

‘আহা!’, জাদুকরকে অনেক সন্তুষ্ট মনে হলো। ‘এখানেই আমি লর্ড ম্যালেশেট অথবা ওয়েস্টমিনস্টারের ডিউকের মতো ধনবান ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি সুবিধা পাই। তারা চাইলে অ্যারোপ্লেনে করে আম আনাতে পারে কিন্তু একটা ফিটফাট ডিনার পার্টিতে তা ডেজার্ট হিসেবে খেতে পারে না।’

‘কেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘এর মানে আপনি আগে কখনো আম খাননি বোধ হয়। আম খাওয়ার একমাত্র ভালো জায়গা হচ্ছে গোসলখানা। আপনি দেখছেন না এটার বাইরের চামড়া শক্ত কিন্তু ভেতরটা নরম আর রসাল। চামড়া ছিলে খেতে গেলেই ভেতরের রস উপচে পড়ে আর সাদা শার্টে চটচটে দাগ বানায়। আপনি কি বুকে পাটাতন দেওয়া শার্ট পরেন?’

‘সাধারণত না।’

‘ভালোই। জানি না লোকজন কেন এমন উদ্ভট জামা পরে।’

এরপর তিনি তেমন শার্ট পরার প্রচলনের পেছনে বিশাল ইতিহাস বললেন, যেখানে মেক্সিকান জাদুকর হুইজতো পাকোতালের ইংল্যান্ড ভ্রমণকালে জাদুকর বেনেডিক্ট বার্নাকলের দুই মাথাওয়ালা টিয়ে পাখি (কিন্তু এরা আমেরিকা অথবা রাশিয়ার জাতীয় পতাকার ইগলের মতোই বিশাল) ধার নেওয়ার দরকার পড়েছিল। দুটো মন্ত্র একত্রে বলার জন্য। পাকোতাল একেবারেই ধনী মানুষদের যত্রতত্র অর্থের অপচয় সহ্য করতে পারছিলেন না বলে তাঁদের সবাইকে জাদু করে কচ্ছপ বানাতে চেয়েছিলেন। বার্নাকল তাঁর পাখিদের অপেক্ষাকৃত কম কার্যকরী মন্ত্র শেখালেন সহানুভূতির কারণে। এরপরের এক শ বছর সব অকর্মা ধনী লোকজন কচ্ছপের খোলসের মতো শক্ত জামা পরিধান করাকে ফ্যাশন হিসেবে বেছে নেয়। ওই শার্টগুলো তাই কচ্ছপের খোলের মতো শক্ত আর আঁটসাঁট।

‘আপনি নিশ্চিন্তে আম খেতে পারেন। আমি জাদু করে দিয়েছি যাতে এর রস গড়িয়ে না পড়ে।’

তাঁর ছোট্ট একটা মন্ত্র আর জাদুর কাঠির পরশই যথেষ্ট ছিল এবং আমি জীবনে প্রথমবারের মতো আম খেলাম। এর স্বাদ অসাধারণ। এমনকি স্ট্রবেরির চেয়েও। আমি বর্ণনা দিয়ে বোঝাতে পারব না স্বাদটা, সবকিছুর মিশ্রণ যেন, কিছুটা কিশমিশের স্বাদ, গ্রীষ্মের পাইন বনের ঘ্রাণ। ভেতরে শক্ত একটা আঁটি, মুখে নেওয়ার জন্য অনেক বিশাল। আর এটাকে ঘিরে নরম রসাল হলুদ শাঁস। মন্ত্রটা পরীক্ষা করতে আমি খুবই চেষ্টা করলাম কাপড়ে দাগ ফেলার এবং ব্যর্থ হলাম। মিস্টার লিকি একটা নাশপাতি খেলেন আর আমাকে পাঁচখানা আম দিলেন বাসায় গিয়ে খাওয়ার জন্য। ওগুলো গোসলের সময়ই খেতে হবে। কারণ, ওগুলো জাদু করা ছিল না।

ডিনারের পর আমরা কফি খাচ্ছিলাম তাঁর হ্যাট থেকে ঢেলে। ফিলিস নামের সেই ছোট্ট সবুজ গরু দুধ দিয়ে গেল তাঁর কুঁড়েঘর থেকে বের হয়ে। আমরা কিছুক্ষণ কথা বললাম জাদু, উদ্ভট ব্রিডের কুকুর যেমন বেডলিংটন টেরিয়ার আর বড় লোমের ডাশাউন্ড নিয়ে। এরপর আমি জাদুকরকে বাসায় ফেরার কথা জানালাম।

‘আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি’, মিস্টার লিকি প্রস্তাব দিলেন। ‘আপনার সময় হলে, এখানে এসে দিন কাটাতে পারেন। আমরা জাভা অথবা ভারতীয় উপমহাদেশ ঘুরে আসতে পারি। এখন আমরা জাদুর গালিচায় চড়ব। প্রথম কয়েক যাত্রায় একটু মাথা ঘোরায়।’

আমরা গালিচায় উঠলাম। আমি শেষবারের মতো টেবিলটার দিকে তাকালাম, যেখানে লবণের দানাগুলো তুলে ফেলে ক্লান্ত লিওপোল্ড বিশ্রাম নিচ্ছে। ফিলিস চেয়ারের কভার চিবোচ্ছিল। এরপর আমি আমার চোখ বন্ধ করলাম। জাদুকর আমার বাসার ঠিকানা আওড়ালেন আর তাঁর কানের লতি দোলালেন। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা আমার গালে এসে লাগল, মাথা বন বন করতে শুরু করল। এরপর বাতাস আবারও উষ্ণ। জাদুকর আমাকে চোখ খুলতে বললেন। আমি নিজেকে সেই পাঁচ মাইল দূরে আমার নিজের বসার ঘরে আবিষ্কার করলাম। কার্পেট নামতে গিয়ে দুই চারটা বই মেঝেতে ফেলে দিয়েছে বুকশেলফ থেকে। আমি গালিচা থেকে নেমে লাইট জ্বালাতে সুইচে হাত দিলাম।

‘শুভরাত্রি’, হাত মেলাতে মেলাতে আমরা পরস্পরকে বললাম। এরপর তিনি তাঁর ল্যাগব্যাগে কান আবার দোলাতেই গালিচাসমেত অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমার রুমে আমি থেকে গেলাম ভরা পরিতৃপ্ত পেটে আর কল্পনাতীত এক ঝুড়ি আম নিয়ে।

লেখা: জে বি এস হ্যালডেন
অনুবাদ: তাইশা তাশরীন

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments