Thursday, March 28, 2024
Homeবাণী-কথাদুজন - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

দুজন – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এক পলকের জন্য আমার মনে হল, ঘরের অন্য দেওয়ালের কাছে বসে থাকা একজন লোক আমার দিকে কটমট করে তাকিয়েছিল, আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মুখ ফিরিয়ে নিল।

লোকটির মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখে আরশোলা রঙের ফ্রেমের চশমা, বেশ শক্ত-পোক্ত চেহারার প্রৌঢ়, মাথার চুল চিনেবাদামের খোসার মতন। ঘরে আরও প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশ জন। নারী-পুরুষ, কারুকে আমি চিনি না। আমার দিকে কারুরই তো কটমট করে তাকাবার কোনও কারণ নেই!

বিয়ে বাড়িতে গিয়ে খাবার জন্য অপেক্ষা করাটা বড় বিদঘুটে। বর-কনে দেখা হয়ে গেছে, এখন শুধু বসে থাকা কখন খাবারের জায়গা খালি হবে। অনেক রেস্তোরাঁয় সব টেবিল ভরতি হয়ে গেলেও কিছু লোক দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে দৃষ্টিতে ঝরে পড়ে একটাই চিন্তা, ওদের খাওয়া শেষ হতে এত দেরি হচ্ছে কেন? এই দৃশ্যটা আমি সহ্য করতে পারি না।

বন্ধুর ছোট ভাইয়ের বিয়ে, নববধুকেও আমি আগে থেকে চিনি। এসে পড়েছি যখন, তখন না খেয়ে চলে যাওয়া যায় না। বেশি লোককে নেমন্তন্ন করে ফেলেছে, সেই তুলনায় বাড়িটা ছোট, ছাদে এর মধ্যে দু-ব্যাচ খাওয়া শেষ করেছে, এখনও অনেক লোক বাকি! যতদূর জানি, এ বিয়েতে দু-পক্ষেরই কোনও আপত্তি ছিল না। সুতরাং কোনও মন কষাকষির ব্যাপার নেই। তা। হলে ওই ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক আমার দিকে অমন ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দিল কেন? লোকটিকে আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে। আমি ভালো করে দেখিনি। এটা আমার একটা অনুভূতি মাত্র। যেন কারুর বিরাগ আমাকে ঝলসে দিচ্ছিল।

লোকটি এখন অন্যদিকে তাকিয়ে এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছে।

একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে বলে ঘরের সব জানলা বন্ধ। এখানে সিগারেট ধরালে ধোঁয়ায় চোখ। জ্বালা করবে। তাই আমি উঠে এলাম দরজার বাইরে। আজই দুজন পরিচিত লোকের হাস্যময় মুখ দেখলাম।

আমাদের কথাবার্তায় মাঝখানে এসে দাঁড়াল বেগুনি রঙের শাড়ি পরা এক রমণী। আমাদের তিনজনের ঠিক কার সঙ্গে যে সে আগে থেকে পরিচিত তা ঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু কথায় বেশ আপন-আপন সুর। খুব ভালো জাতের পারফিউমের গন্ধ আসছে তার শরীর থেকে। বিয়ে বাড়িতে এসে নতুন শাড়ি পরা কয়েকজন নারীর রূপ আর কিছু সুগন্ধ আমি উপভোগ করি। বাদবাকি সব কিছুই অকিঞ্চিৎকর।

সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা লোকটি এর মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে বেশ রাশভারী ভঙ্গিতে চলে গেল আমাদের পাশ দিয়ে। এবারও তার মুখখানা আমি পুরোপুরি দেখতে পেলাম না। সে আমার দিকে কোনও ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে গেল না বটে, কিন্তু আমাদের দিকে যে মোটেই চাইল না, সেটাই সন্দেহজনক নয়? আমাদের পাশে মোটামুটি একজন সুন্দরী মহিলা রয়েছে, তাকেই বা উপেক্ষা করার কী মানে হয়?

অবশ্য এটাও আমার ভুল হতে পারে। তাকাতেই যে হবে, তার কী মানে আছে?

ওপরের সিঁড়ি দিয়ে একজন দুদ্দাড় করে নেমে এসে বলল, নতুন ব্যাচ বসছে। আপনারা চলে যান, চলে যান। আগে-আগে বসে পড়ুন।

অর্থাৎ নিছক খাওয়ার জন্য অন্যদের চেয়ে আগে গিয়ে জায়গা দখল করতে হবে।

অগত্যা যেতেই হল। বেগুনি শাড়ি পরা মহিলাটি ক্ষণেকের জন্য হারিয়ে গেল বটে, কিন্তু ওপরে আমাদের ঠিক উলটো দিকের সারিতেই তাকে আবার দেখা গেল অন্য কয়েকটি মেয়ের পাশে। সেইখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল, আপনি এখনও শ্যামবাজারে থাকেন?

আমি দু-দিকে ঘাড় নেড়ে জানালাম, না।

তারপর পাশ ফিরে সুব্রতকে মৃদু গলায় জিগ্যেস করলাম, ওই মহিলাটি কে? কী নাম?

সুব্রত বলল, তা তো জানি না। আমি তো এতক্ষণ ভাবছি, তোমারই চেনা।

আমার হাসি পেয়ে গেল। এরকম প্রায়ই হয়। নামজানার দরকারই বা কী? যেটুকু সময়ের জন্য দেখা, হাসিঠাট্টা করে কাটিয়ে দিলেই হল।

খাওয়ার মধ্যে-মধ্যেও সুব্রতর সঙ্গে গল্প করতে-করতে আমার চোখ দুটো সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা লোকটিকে খুঁজছে। তাকে পাওয়া গেল, একেবারে কোণের দিকে, পেছন ফিরে বসা। লোকটি কি ইচ্ছে করেই আমার থেকে অতদূরে গিয়ে বসেছে?

কী মুশকিল, লোকটাকে নিয়ে আমার এত মাথাব্যথা কেন? আমি তাকে চিনি না। কিন্তু লোকটি কেন আমার ওপর রেগে আছে তা জানতে হবে না? রেগেই যে আছে, তারও কোনও প্রমাণ নেই। শুধু একটা অনুভূতি, আর কিছু না।

আমার বন্ধু রবি আর তার ছোট-ভাই অভিজিৎ ঘুরে-ঘুরে সবার সঙ্গে ভদ্রতা করছে। আমি লক্ষ্য করলাম, রবি সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে হেসে-হেসে কী যেন বলছে। রবির সঙ্গে ভালো পরিচয় আছে। লোকটি কেউকেটা গোছের?

রবির কাছে জিগ্যেস করলেই লোকটির পরিচয় জানা যায়। কিন্তু খামোখা জিগ্যেস করতে যাব কেন? একজন অচেনা লোক সম্পর্কে এমন কৌতূহল দেখানো আমার স্বভাব নয়।

খাওয়া শেষ করে ভিড় ঠেলে নীচে নামবার সময় সুব্রত বলল, সুনীলদা, তুমি একটু অপেক্ষা করো আমার জন্য, চলে যেও না। আমি একবার অভিজিতকে বলে আসছি!

বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরেও খুব গুমোট গরম। রাস্তায় নেমে আসবার পর তবু একটু আরাম হল। একটা সিগারেট ধরালাম।

বেগুনি শাড়ি পরা রমণীটির সঙ্গে আবার দেখা। সিল্কের শাড়ি শপশপিয়ে কাছে এসে জিগ্যেস করল, আপনি শ্যামবাজারে থাকেন না। এখন কোথায় থাকেন?

আমি বললাম, গড়িয়াহাটের দিকে।

মহিলাটি হেসে বলল, অনেকদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা। ভেবেছিলাম একসঙ্গে ফিরব। অনেক গল্প হবে। আমি শ্যামবাজারের দিকে যাওয়ার একজন সঙ্গী খুঁজছি। যাদের সঙ্গে এসেছি, তাদের ফিরতে অনেক রাত হবে।

আমি বললাম, আমি তো হেঁটেই চলে যাব, বেশিদূর নয়।

আমার সঙ্গে গাড়ি-টাড়ি কিছু নেই। আপনাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দেব?

মহিলাটি বলল, ওরে বাবা, এত রাতে আমি একা-একা ট্যাক্সিতে যেতে পারব না। দেখি আর কারুকে পাই কি না!

একটু পরেই এক দম্পতিকে দেখে এগিয়ে গেল সে।

সুব্রত এল আরও মিনিটপাঁচেক পরে। হাতে দু-খিলি পান। বলল, তুমি তো পান খাও না, তোমারটাও আমি নিয়ে এলাম। বেগুনি শাড়ি পরা যে মেয়েটি কথা বলছিল আমাদের সঙ্গে, তার নামটাও জেনে এসেছি। শ্রেয়া দাশগুপ্ত। ভদ্রমহিলা ডিভোর্সি। একটা বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে কাজ করেন। অভিজিৎ-এর সঙ্গে যার বিয়ে হচ্ছে, সেই মিলির মাসতুতো দিদি। তুমি চিনতে না?

শ্রেয়া নামটা শুনে একটা চেনা ঝিনঝিন শব্দ হচ্ছে বটে। আগে কোথাও শুনেছি, কিংবা কোনও উপন্যাসের নায়িকার নাম?

মেয়েটি গাড়িতে উঠে পড়েছে, আর কোনওদিন হয়তো দেখা হবে না। নামটা জেনেই কী লাভ? আমাকে চেনে এটুকু বুঝতে পারা গেল। সত্যিই আমি একসময় শ্যামবাজারে থাকতাম।

হঠাৎ রবি নেমে এসে বলল, এই তোরা তো গড়িয়াহাটের দিকে যাবি। দাঁড়া, দাঁড়া, একটা গাড়ির ব্যবস্থা করেছি।

আমি বললাম, গাড়ির কোনও দরকার নেই। বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। এরপর খানিকটা হাঁটাই ভালো।

রবি বলল, ইচ্ছে করলে গাড়িতেও যেতে পারিস। তাপসবাবু তোদের নামিয়ে দিতে পারেন। উনি যাদবপুর যাবেন।

তারপর পেছন ফিরে বলল, তাপসবাবুর সঙ্গে তোর আলাপ আছে তো? তাপস হালদার। নাট্যকার। অনেকগুলোনাটক লিখেছেন।

সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক।

তিনি শুকনো মুখে একটা নমস্কার জানিয়েই অন্যদিকে তাকালেন। আমাকে তাঁর গাড়িতে তোলার কোনওই ইচ্ছে নেই বোঝা গেল।

আমি প্রথমে খুবই চমকে গিয়েছিলাম। তারপর বুক ঠেলে হাসি বেরিয়ে আসতে চাইল। একটা রুমাল গুঁজে কাসি, সামলাবার ভান করলাম। তারপর হাত নেড়ে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। তাপস হালদার! চেহারা অনেক বদলে গেছে। নইলে নিশ্চয়ই চিনতে পারতাম আমি। এত বছর পরেও তিনি আমার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন!

মনে আছে সেই প্রথম দিনটার কথা।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে দুপুর থেকে। এইরকম বৃষ্টিতে রাস্তায় জল জমে না, আবার হাঁটাহাঁটি করতে গেলেও জামা ভিজে যায়। বিডন স্ট্রিট ধরে আমি হাঁটছি বন্যার সঙ্গে। ছাতা নেই। বন্যা ওর হাতের বইগুলো মুড়ে নিয়েছে আঁচলে। ময়ূরকণ্ঠি রঙের শাড়ি। আমি বারবার বলছি, বন্যা, আজ যেতে হবে না! আজ যেও না!

বন্যা শুনছেনা। আজই প্রথম দিন। সব কথাবার্তা ঠিকঠাক হয়ে আছে, ওকে যেতেই হবে!

আমি বললাম, ধরো, যদি খুব জোর বৃষ্টি পড়ত?

বন্যা বলল, নামাও না, খুব জোরে বৃষ্টি ডেকে আনন, তাহলে আমি যাব না। তখন সমস্ত রাস্তা খালি হয়ে যাবে। ঠিক মাঝখান দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে তুমি আর আমি ভিজব।

বন্যা পাগলের মতন বৃষ্টি ভালোবাসে।

ও ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভেজে, সম্পূর্ণ ভিজে কাপড়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে একটুও সঙ্কোচ বোধ করে না, রাস্তায় হাঁটু সমান জল জমলে আনন্দে হইহই করে জল ছেটাতে-ছেটাতে যায়। আজকের এই সামান্য ছিটছিটে বৃষ্টি ওর মোটেই পছন্দ নয়। কোন মন্ত্রে ওর জন্য ঝমঝমে বৃষ্টি আমি ডেকে আনব?

কেন সেই মন্ত্র আমি জানি না? আকাশের ওপরেই আমার রাগ হয়।

হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে উদয় হল সন্দীপ। আমি তাকে আসতে দেখিনি, কিন্তু সে একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

কোথায় যাচ্ছিস, বন্যা?

মানিকতলায়।

সেখানে কী? আমার মা তোকে একবার ডেকেছে।

অতি সাধারণ কথাবার্তা। আমি এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরলাম। সন্দীপকে যে আমি চিনি না তা নয়। কিন্তু তার সঙ্গে এখন আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কেন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না? কেন সন্দীপকে দেখেই আমার মেজাজ বিগড়ে গেল? মনে হচ্ছে যেন ওদের কথা আর শেষই হবে না। আমি রাস্তার গাড়ি গুনছি, ফিয়াট, অ্যাম্বাসেডার, স্ট্যান্ডার্ড…তেতাল্লিশটা, রিকশা দশটা, একটা ময়লা ফেলা গাড়ি…

সন্দীপ এক-একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু আমি কিছুতেই তার চোখে চোখ ফেলছিনা। বৃষ্টি একেবারেই থেমে গেছে। শেষ বিকেলের রোদ ঝিলিক দিল আকাশে।

একটা ফাঁকা ট্যাক্সি দেখে সন্দীপ দৌড়ে চলে গেল।

সঙ্গে-সঙ্গে আমি সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে রক্তচক্ষে বললাম, উঃ, এতক্ষণ ধরে কী কথা বলছিলে?

বন্যা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।

আমি অবার কর্কশ গলায় বললাম, এক ঘণ্টা ধরে এত আজেবাজে কথার কী ছিল?

বন্যা বলল, মোটেই অতক্ষণ কথা বলিনি। তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?

আমি বললাম, ওই সন্দীপটা, ওই সন্দীপটা…

বন্যা বলল, ও আবার কী করল? তোমার কী হয়েছে বলো তো?

আমি আর কথা খুঁজে পাচ্ছি না। সত্যিই তো এত রাগের কী হয়েছে। সিগারেট ধরাবার পর সেটা। শেষ হয়নি, অর্থাৎ পাঁচ মিনিটও কাটেনি, তবু এটা মনে হল কেন? রাগে আমার সারা শরীর জ্বালা করছে। যুক্তিহীন রাগ।

সন্দীপ বন্যার নিজের মামাতো ভাই। ছেলেবেলা থেকে একসঙ্গে মানুষ হয়েছে। সন্দীপ ছেলেটার ব্যবহারও খারাপ নয়, তবু ওকে আমি সহ্য করতে পারি না কেন?

একটা কথা কারুকে বলা যায় না। বন্যাকেও না।

বন্যার সঙ্গে যে-কোনও পুরুষ মানুষ কথা বললেই আমার রাগ হয়। শুধু রাগ নয়, সাংঘাতিক। ঈর্ষা। অন্য পুরুষের তো কথাই নেই, এমনকী বন্যার কাকা কিংবা ওর জামাইবাবু বন্যার সঙ্গে একটু হেসে কথা বললেই আমার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ইচ্ছে করে ওদের ঠেলে সরিয়ে দিই। বন্যার জামাইবাবু কথা বলার সময় মাঝে-মাঝে বন্যার পিঠে হাত রাখেন, আমি জানি, এটা সাধারণ ব্যাপার, বন্যার জামাইবাবু অতি রসিক, সুন্দর মানুষ, শ্যালিকার পিঠে একটু হাত রাখবেন, এতে দোষের কী আছে? জানি, সবই বুঝি, তবু ঈর্ষায় আমার বুক জ্বলে যায়। বন্যাকে

যদি আমি সর্বক্ষণ ঘিরে রাখি, সেটা বন্যাও পছন্দ করবে না।

কথা ঘোরানোর জন্য বললাম, তোমার ওখানে কতক্ষণ লাগবে?

বন্যা বলল প্রথম দিন তো। বড়জোর এক ঘণ্টা।

আমি বললাম, আমি উলটো দিকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকব।

বন্যা প্রবল আপত্তির সুরে বলল, না, না, না, না! তুমি আসবে না।

কেন?

তুমি কি পাগল নাকি, এক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে কেন?

অন্য কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসব।

না, প্লিজ, ওরকম কোরো না। তুমি কাল সকালে বাড়িতে চলে এসো। কেন, আমি এখান থেকে তোমার বাড়ি পর্যন্ত তোমার সঙ্গে যেতে পারি না?

কেন এরকম করবে? ফেরার সময় আমি বাসে চলে যাব। তোমাকেও তো টিউশনি করতে যেতে হবে!

একদিন নাই-বা গেলাম।

বলছি তো, কাল সকালে বাড়িতে চলে এসো।

আমরা পৌঁছে গেছি মানিকতলার মোড়ের কাছে। ডান দিকে একটা সরু গলি, তার মুখে প্রথম বাড়িটার দেওয়ালে মস্ত বড় সাইন বোর্ড। ইউনিক টিউটোরিয়াল।

বাজারে এখন টিউটোরিয়াল হোমগুলোর খুব নাম রমরমা। প্রাইভেট টিউটরদের ভাত মারা যেতে বসেছে। পাড়ায়-পাড়ায় গজিয়ে উঠেছে টিউটোরিয়াল হোম, সেখানে অল্প মাইনেতে কোচিং পাওয়া যায়। এরা শিওর সাজেশন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। সেটাই বড় টোপ।

ইউনিক টিউটোরিয়ালের খুব নাম হয়েছিল একসময়। আগেরবার এখান থেকে পাঁচজন ছাত্র ছাত্রী অঙ্কে খুব ভালো রেজাল্ট করেছে! পাঁচজনই ফার্স্ট ক্লাস। খবরের কাগজে ওরা বড়-বড় করে বিজ্ঞাপন দেয়। সেই পাঁচজন ছাত্র-ছাত্রীর ছবি ছাপিয়েছে, সন্দেহের কোনও কারণ নেই।

বন্যাকে সায়েন্স পড়ার মাথার দিব্যি কে দিয়েছিল? ও এত ভালো ছবি আঁকে, ওর উচিত ছিল। আর্ট কলেজে ভরতি হওয়া। ওর বড় কাকা বেঙ্গল কেমিক্যালের চিফ কেমিস্ট, তিনি বন্যাকেও কেমিস্ট বানাতে চান। তা ছাড়া, বন্যাকে কোনওদিনই লেবরেটরিতে অ্যাসিড-অ্যালকালি ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে না।

কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে পড়ছে বন্যা, কিন্তু টেস্টে অঙ্কে খুব খারাপ করেছে।

আমি নিজে টিউশনি করে জীবিকা অর্জন করি। সারাদিনে তিন জায়গায় ছেলেমেয়েদের ইংরিজি আর বাংলা পড়াই। কিন্তু ইস্কুলের অঙ্কতেই আমার গায়ে জ্বর আসত, বি. এস.সি.-র অঙ্কে আমার সাহায্য করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

বন্যা একটা টিউটোরিয়াল হোমে অঙ্কের কোচিং নেবে, এটা তো অস্বাভাবিক কিছু না। বাড়িতেও আলাদা টিউটর রাখতে পারত, ওদের অবস্থা বেশ ভালো। কিন্তু ইউনিক টিউটোরিয়ালে যিনি। অঙ্কা পড়ান। তাঁর সঙ্গে বন্যার দাদার চেনা থাকলেও তিনি কারুর বাড়িতে গিয়ে পড়ান না। তাঁর কাছে শিখতে হলে এখানেই আসতে হবে।

সেটাও অস্বাভাবিক কিছু না। আরও ছাত্র-ছাত্রীরা আসে, বন্যাও সপ্তাহে দুদিন এখানে পড়ে যাবে। কিন্তু আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা।

দরজাটা খোলা। বন্যা আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলল, যাই? ঠিক সেই সময় দরজার কাছে এক ব্যক্তি এসে দাঁড়াল। বেশ লম্বা ও স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ, তিরিশের কাছাকাছি বয়েস, মাথা ভরতি সুন্দর চুল, একটা বেশ দামি পাঞ্জাবি পরা।

বন্যার দিকে চেয়ে তিনি হাসলেন।

আমি চিনি এই ব্যক্তিটিকে, ইনিই সেই বিখ্যাত অঙ্কের অধ্যাপক।

তিনি বন্যার দিকে চেয়ে হেসে বললেন, এসো। বন্যা তাঁর সঙ্গে ভেতরে চলে গেল।

আমার মনে হল, আমি যেন বন্যাকে ওই লোকটির হাতে তুলে দিলাম। ওই টিউটোরিয়াল হোমে আর কেউ নেই। শুধু ওই লোকটি আর বন্যা, ওরা চলে গেল এক অন্ধকার গহ্বরে।

ওঃ, কী কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। হৃৎপিণ্ডটা যেন ফালাফালা হয়ে গিয়েছিল, অবিরাম রক্ত ঝরছিল সেখান থেকে। আমি ছটফট করছিলাম পাগলের মতন। যদিও যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করছিলাম নিজেকে যে, আমি এরকম অদ্ভুত ভাবছি কেন? এত নাম করা একটা টিউটোরিয়াল হোম বিকেলবেলা ফাঁকা থাকতে পারে না, আরও অনেক ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। ভেতরে। বন্যা সেখানে শিখতে গেছে নীরস অঙ্ক! কিন্তু মন তবু অবুঝের মতন মাথা ঝাঁকানি দিচ্ছে। ওই সুপুরুষ অঙ্কের মাস্টারটা ঠিক এই সময় এসে কেন দরজার কাছে দাঁড়াল। কেন। বন্যার দিকে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, এসো! ওর পিঠে একটা ছুরি বসিয়ে দেওয়া উচিত ছিল না আমার?

কোথায় হাঁটছি খেয়াল নেই, একসময় দেখি মানিকতলায় ব্রিজ পেরিয়ে গেছি!

আমার যাওয়ার কথা এখন নিউ আলিপুর। সেখানে দুটি মাত্র ছাত্রীকে ব্যাকরণ পড়াতে হবে।

আজ না গেলে হয় না? মাঝে-মাঝেই যাওয়া হয় না। এক-একদিন পকেটে ট্রাম ভাড়াও থাকে না। ছাত্র-ছাত্রীর মা খুব সদাশয়া, আমি কামাই করলেই আমার শরীর খারাপ কি না জিগ্যেস করেন। অথচ কিছুতেই আমার জ্বর-টর হয় না।

নিউ আলিপুর গেলে ফিরতে অন্তত আড়াই ঘণ্টা লেগে যাবে। বন্যা তার মধ্যেই বেরিয়ে আসবে। ও আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বারণ করেছে। কিন্তু আমার পক্ষে দূরে থাকা যেন কিছুতেই সম্ভব নয়, আমি মানিকতলা অঞ্চলেই ঘুরতে লাগলাম, এক-একটা দোকানের সামনে দাঁড়াই। কাগজের স্টলে দাঁড়িয়ে পত্রিকার পাতা ওলটাই।

একশো গ্রাম বাদাম কিনে ভাবলাম, বন্যার জন্য অর্ধেক রেখে দেব?

সময় আর কাটে না, একটা-একটা করে সব বাদামই খাওয়া হয়ে গেল।

টিউটোরিয়াল হোমটা থেকে বেশ খানিকটা দূরে, একটা বকুল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম। গাছটা বেশ পুরোনো। তবু ফুল ফুটেছে। দু-একটা পড়ে আছে মাটিতে। একটা ফুল কুড়িয়ে নিলাম। অবিকল বন্যার শরীরের ঘ্রাণ।

ঠিক এক ঘণ্টা পরেই বন্যা ছুটি পেল। কিন্তু আমি ওর সামনে গেলাম না, আমি টিউশানিতে যাইনি বুঝতে পারলে ও রেগে যাবে।

বন্যা কোনওদিকে না তাকিয়ে সোজা হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে। আমি ওকে অনুসরণ করছি। কেন? এ পৃথিবীতে যে আমার সবচেয়ে আপন, সমস্ত জাগ্রত মুহূর্তে যার কথা চিন্তা করি, একজন অচেনা মানুষের মতন আমি যাচ্ছি তার পেছনে-পেছনে। বন্যাকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরেছি, বন্যা অনায়াসে আমার চুলে হাত দেয়, অথচ আমি তার সঙ্গে কথা বলছি না। অন্য যে-কেউ দেখলে আমাকে পাগল ভাববে।

অনেকটা হেঁটে এসে বন্যা ট্রামে উঠল। আমি সেকেন্ড ক্লাসে। এত ভিড় যে এখান থেকে বন্যাকে দেখতে পাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবু তো আমরা একসঙ্গে যাচ্ছি। ফার্স্ট ক্লাসে উঠলেও আমি ওর পাশে বসার সুযোগ পেতাম না।

আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। জানি বন্যা এসময় অন্য কোথাও যাবে না। বাড়ির স্টপেই নামবে। তবু প্রতিটি স্টপ আমার দেখা চাই। লোকজন উঠছে নামছে, কেউ-কেউ আমার পা মাড়িয়ে দিচ্ছে, কেউ-কেউ ধমকাচ্ছে আমাকে, তবু আমার ভ্রূক্ষেপ নেই।

সন্ধে হয়ে গেছে। ফড়েপুকুরের মোড়ে দুজনে একসঙ্গে নামলেও বন্যা আমাকে দেখতে পেল না। ও কিছু একটা নেওয়ার জন্য ওষুধের দোকানে ঢুকল। এখানে বন্যাকে অনুসরণ করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। এ-পাড়ার অনেকেই আমাকে চেনে।

বন্যাদের বাড়িতে তো অনায়াসেই যেতে পারি। কোনও বাধাই নেই। তবু এখন যাওয়া যাবে না।

বকুল ফুলটা আমি পকেটে রেখেছিলাম। বার করে গন্ধ নিলাম একবার। এই তো, বন্যা এখন সারারাত আমার সঙ্গে থাকবে।

তাপস হালদার তখনও নাট্যকার হননি, একটি কলেজে পড়াতেন এবং দু-একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকায় ভারী-ভারী প্রবন্ধ লিখতেন। সে প্রবন্ধ বোঝা দুঃসাধ্য। দু-একটা মিটিং-এ আমি তাঁর বক্তৃতা শুনেছি।

দরিদ্র বুদ্ধিজীবীদের একরকম চেহারা থাকে, রোগা, লম্বা, নাকটা খাঁড়ার মতন, গেরুয়া পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। তাপস হালদারও দরিদ্র ছিলেন বটে, তবে যথেষ্ট সুপুরুষ। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারার জন্য তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে, বিশেষত ছাত্রীদের খুব প্রিয় ছিলেন। কিন্তু তিনি বিয়ে করে ফেলেছিলেন অনেক আগেই। তখন তিনি দুটি ছেলেমেয়ের বাবা, তা ছাড়া তাঁর নিজের বাবাও ছিলেন অসুস্থ, তাই সামান্য অধ্যাপনার চাকরিতে তাঁকে খুব টানাটানি করে চালাতে হত। ওইসব শক্ত-শক্ত প্রবন্ধ লেখার জন্য কোনও পারিশ্রমিক পাওয়ারও প্রশ্ন ছিল না। অবশ্য সম্মান। ছিল। শিয়ালদার কাছের এক কলেজে তিনি ছিলেন দুপুরবেলার অধ্যাপক, সকালে ব্যারাকপুরে পার্ট টাইমে কাজ করতে যেতেন। বিকেলবেলা টিউটোরিয়াল। হঠাৎ সেখানকার কয়েকটি ছাত্র ছাত্রী খুব ভালো রেজাল্ট করায় টিউটোরিয়ালটার নাম তো খুব ছড়াল বটেই, ফুলে ফেঁপে উঠল ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা। দু-বছরের মধ্যে তাপস হালদার সেই টিউটোরিয়ালের মালিক হয়ে গেলেন। তাঁর আর্থিক অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে গেল।

তখন থেকে তাঁর পোশাক ধপধপে আদ্দির পাঞ্জাবি। চটির বদলে পাম্প শু। হাতে দামি সিগারেট। চরম দারিদ্র্য থেকে আকস্মিক স্বচ্ছলতায় এসে তিনি কৃপণের মতন টাকা জমাতে লাগলেন না, খরচ করতে লাগলেন দু-হাতে।

আগে তিনি দারিদ্র্য নিয়ে গর্ব করতেন, অপরকে বঞ্চিত না করে কেউ ধনী হতে পারে না এ দেশে, এরকম মতামত ব্যক্ত করতেন, প্রায়ই। আসলে জীবনের ভালো-ভালো জিনিস উপভোগ করার জন্য তাঁর মনে একটা গুপ্ত বাসনা ছিল। ভালো খাওয়া-দাওয়া দামি পোশাক, সুন্দর বাসস্থান।

সম্ভবত তিনি তাঁর মনকে বুঝিয়ে দিলেন। তিনি মোটেই কোনও রকম শোষণ বঞ্চনা করে ধনী হননি। পণ্ডিত রবিশঙ্কর যদি সেতার বাজিয়ে এক লক্ষ টাকা, শিল্পী হুসেনের একখানা ছবি যদি পঞ্চাশ হাজার টাকায় বিক্রি হয়, তাহলে একজন ভালো অঙ্কের শিক্ষকই বা কেন ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়ে মাসে পাঁচ হাজার টাকা রোজগার করতে পারবে না? এসব তো গুণের স্বীকৃতি।

তবে টাকা রোজগার করার একটা নেশা আছে। আরও চারটে ছাত্রকে নিলে যদি আরও চারশো টাকা আসে, তাহলে নিতে আপত্তি কী?

তাপস হালদার হয়ে উঠলেন অঙ্ক শেখানোর যন্ত্র। সকাল থেকে ব্যাচ বাই ব্যাচ শুধু পড়িয়ে যাওয়া। ব্যারাকপুরের পার্ট টাইমটা ছেড়ে দিলেন, সেখানে পেতেনও খুব সামান্য। দুপুরের কলেজেও ছুটি নেন প্রায়ই। বিকেল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত তার নিশ্বাস ফেলায় অবকাশ নেই।

তাঁর প্রবন্ধ লেখা বন্ধ হয়ে গেল। সভা-সমিতিতে আর যান না। সাহিত্যিক ও অধ্যাপক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ারও সময় নেই। তিন বছরের মধ্যেই তিনি পাইকপাড়ায় একটা ছোট বাড়ি কিনে ফেললেন।

তাপস হালদারের অঙ্কের জ্ঞান সত্যিই অসাধারণ, সেই জ্ঞানটাকে তিনি কাজে লাগালেন ব্যবসায়। মাত্র দু-খানা ঘর নিয়ে শুরু হয়েছিল ইউনিক টিউটোরিয়াল, তাপস হালদার পুরো তিন তলা বাড়িটা ভাড়া নিয়ে সব ঘরে ক্লাস বসালেন, আরও অনেক নাম করা অধ্যাপকদের নিযুক্ত। করলেন সেখানে। যেন সেটাই একটা আলাদা কলেজ। বাড়িটার ছাদের একখানা ঘর তিনি রেখে দিলেন নিজের জন্য, দুপুরে বাড়ি ফেরার সুযোগ হয় না অনেক দিনই। ওই নিজস্ব ঘরটায় তিনি বিশ্রাম করেন।

কিন্তু টিউটোরিয়াল হোমগুলির ভাগ্য বেশ অনিশ্চিত।

ইউনিক টিউটোরিয়ালের যখন বেশ রমরমা অবস্থা, তখন হঠাৎ একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটল। এ টিউটোরিয়ালের ক্লাস সেরে বেরিয়ে আসছে একটি ছাত্র। এমনসময় দূর থেকে একটি যুবক ছুটে এসে তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে লাগল। তারপর সে ছাত্রটিকে ছুরি মেরে পালাল।

ছাত্রটি ছুরির গা খেয়ে রক্তাপ্লুত অবস্থায় ছটফট করছে। তক্ষুনি আর-একটা গুন্ডা মতন ছেলে এসে তার জামাটা টেনে ছিঁড়ে নিয়ে দৌড়োল। ততক্ষণে অন্য ছাত্ররাও বেরিয়ে এসেছে, জমা হয়েছে রাস্তার লোক, তারা ছুটে গিয়ে ধরে ফেলল দ্বিতীয় গুন্ডাটিকে।

সেই গুন্ডার হাতের ছেড়া জামাটার পকেটে ফিজিকস পার্ট টু পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। যে পরীক্ষা আর চারদিন পরে আরম্ভ!

পুলিশ কেস তো হলই, খবরের কাগজেও খুব চাঞ্চল্য চলল কয়েকদিন এই নিয়ে। টিউটোরিয়াল হোমের ছাত্রের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থাকে কী করে? এরা কি প্রেসের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে?

টিউটোরিয়াল হোমগুলো ছাত্রদের ক্ষতি করছে না উপকার করছে, এই নিয়েও তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল।

ইউনিক টিউটোরিয়ালের মধ্যে হানা দিল পুলিশ, বিজ্ঞানের পার্ট টু প্রত্যেকটি ছাত্র-ছাত্রীর বাড়ি সার্চ করা হল, ফিজিকসের এক অধ্যাপককে জেরা করা হল থানায় নিয়ে গিয়ে। সব মিলিয়ে কেলেংকারির এক শেষ।

তাপস হালদার অবশ্য দৃঢ়ভাবে বলতে লাগলেন বারবার যে ওই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে তাঁর। টিউটোরিয়াল হোমের কোনও সম্পর্ক নেই। ছাত্রটি কোথা থেকে সেই কোশ্চেন পেপার পেয়েছে পুলিশ তা খোঁজ করুক। ছাত্রটি ওটা টিউটোরিয়ালের কারুকে দেখায়নি, ও বিষয়ে কেউ বিন্দুবিসর্গও জানত না।

তাপস হালদারের বিবৃতি আমার কাছে সত্য মনে হয়েছিল। প্রশ্নপত্র আগে থেকে বার করে ছাত্রদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার মতন বোকামি তিনি করবেন কেন? যদি কোনওক্রমে একটা ছাপা প্রশ্নপত্র তাঁর হাতে এসে যায়, তাহলে তিনি সযত্নে সেটা গোপন রাখারই তো চেষ্টা। করবেন। তিনি আর দশটা প্রশ্নের সঙ্গে ওই প্রশ্নগুলো মিশিয়ে দিয়ে ছাত্রদের তৈরি করে দেবেন, সবাই বলবে কমন এসেছে। সেটা কিছু দোষের নয়।

তবু একটা দুর্নামের ধাক্কা ইউনিক টিউটোরিয়ালকে গ্রাহ্য করতেই হল।

ছুরিকাহত ছাত্রটি বেঁচে গেল এবং যথারীতি এই ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল কয়েকদিনের মধ্যেই।

কিন্তু সেবার রেজাল্ট বেরুবার পর দেখা গেল, ওই টিউটোরিয়ালের কোনও ছাত্র-ছাত্রীরই ওপরের দিকে নাম নেই। অর্ধেকের বেশি ফেল করেছে।

এই দ্বিতীয় ধাক্কা সহ্য করবার ক্ষমতা খুব কম টিউটোরিয়ালেরই থাকে। হুহু করে কমে গেল ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা। পাইয়োনিয়ার টিউটোরিয়াল খুব বড় বিজ্ঞাপন দিতে লাগল। সবাই ছুটল সেদিকে।

তাপস হালদার দমে গেলেও একেবারে ভেঙে পড়লেন না।

দু-মাস তিনি বন্ধ করলেন টিউটোরিয়াল। তারপর আবার নতুনভাবে সাজালেন। ফিজিকস-এর দুজন অধ্যাপককে তিনি আগেই ছাঁটাই করেছিলেন। এবার অন্য সবাইকেই চলে যেতে বললেন। অনেকে তখন মনে করেছিল, তাপস হালদার বুঝি টিউটোরিয়াল হোম একেবারে তুলে দিয়ে অন্য ব্যাবসা করবেন। কিন্তু তা নয়। ফিজিকস, কেমিস্ট্রি, বোটানি, বায়োলজি, ইংরিজি, বাংলা সব ক্লাস বন্ধ হয়ে গেল, রইল শুধু অঙ্ক।

যারা অঙ্কে কাঁচা, তাদের জন্য এবং যারা অঙ্কে খুব ভালো রেজাল্ট করতে চায়, তাদের জন্য এই টিউটোরিয়াল। এবারে সত্যিই এটা হল ইউনিক। একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ নিলেন তাপস হালদার। তিনি বিজ্ঞাপন দিলেন, এখানকার একটিও ছাত্র-ছাত্রী অঙ্কে ফেল করবেন না।

প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল ফিজিকস-এর। তাপস হালদার ফিজিকস পড়াতেন না, শুধু অঙ্কের ক্লাস নিতেন, তাই তাঁর গায়ে ব্যক্তিগতভাবে কালিমা লাগেনি। অসম্ভব তাঁর আত্মবিশ্বাস। আগের মতন আর শত-শত ছাত্র-ছাত্রী তিনি নিতে চাইলেন না। তিনি ভরতি করাতে লাগলেন বেছে বেছে। মাত্র দুটি শিফটে ক্লাস হবে, পঞ্চাশজন করে। পড়াবেন তিনি একলা। আর কয়েকজনকে তিনি আলাদা কোচিং দেবেন।

এবছর ইউনিক টিউটোরিয়ালের সব ছেলেমেয়ে অঙ্কে পাশ। কয়েকজন অন্য সাবজেক্টে ফেল করল বটে, কিন্তু অঙ্কে তাদের ভালো রেজাল্ট।

তাপস হালদার আবার খবরে ফিরে এলেন। টিউটোরিয়ালের জগতে তিনি একটি বিশিষ্ট নাম।

সব ঘরগুলো আর কাজে লাগে না। এ-বাড়ির কিছু-কিছু ঘর তিনি কয়েকটি অফিসকে ভাড়া দিলেন। অফিসের সুবিধে এই যে তারা কেউ সন্ধের পর থাকে না। ভাড়া বেশি পাওয়া যায়, কিন্তু জল-ইলেকট্রিসিটি কম খরচ হয়। কম সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে চালালেও তাপস হালদারের। উপার্জন বিশেষ কমল না।

এই সময় তাপস হালদারের জীবনে এল বন্যা নামে একটি মেয়ে। কিংবা বলা যায়, আমার জীবনে এল তাপস হালদার।

তাপস হালদার জনপ্রিয় অধ্যাপক এবং সুপুরুষ, সুতরাং মেয়েরা অনেকেই তাঁর ভক্ত হবে। এটা স্বাভাবিক। গত দশ বছরে তিনি অনেক ছাত্রীকে পড়িয়েছেন, তাদের মধ্যে কেউ-কেউ নিশ্চয়ই রূপসী ও রূপবতী ছিল। কিন্তু তাপস হালদারের নারীঘটিত দুর্বলতার কথা আগে শোনা যায়নি। তা ছাড়া তিনি টাকা রোজগারের নেশায় এমনই মেতে ছিলেন যে অন্য কিছুর জন্যই তাঁর সময় ছিল না। যে মানুষ সর্বক্ষণ অঙ্ক কষায়, সে কখনও কোনও মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে পারে?

কিন্তু বন্যার মতন মেয়েকে তো তাপস হালদার আগে দেখেনি!

বন্যা তেমন কিছু সুন্দরী নয়। আমাদের দেশে রূপের প্রধান মাপকাঠিই হল রং, বন্যাকে। কোনওক্রমেই ফরসা বলা যাবে না। তার শরীরের কোনও অঙ্গটাকেই বলা যাবে না অপরূপ। তবু সব মিলিয়ে এমন একটা কিছু আছে, যাতে তাকে অন্যসব মেয়ের চেয়ে আলাদা মনে হয়।

তার শরীরটা হিলহিলে, কোনও কিছুই যেন স্থির নয়। সবসময় খেলা করছে একটা চাঞ্চল্য। সে যখন কোনও কথা বলে না, তখনও তার চোখ ও ঠোঁটের চাপা হাসি যেন কিছু বলে।

তাপস হালদার আমার সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।

নিউ আলিপুর থেকে বাসে ফেরার সময় দারুণ ভিড় ছিল। গরমও প্রচণ্ড। কদিন ধরে খুব গুমোট চলছে, বৃষ্টির নামগন্ধও নেই। লোকজনের চাপে, ঘেমে-নেয়ে আমার একেবারে দম বন্ধ হয়ে। যাওয়ার মতন অবস্থা।

এসপ্ল্যানেডে নেমেই মনে হল, এক গেলাশ আখের রস খেতে হবে।

এই রস আমার প্রিয়। যে-কোনও বোতলের কোলড-ড্রিংকসের চেয়ে দামেও সস্তা। মিষ্টি রসে শরীরটাও চাঙ্গা হয়।

পরপর দু-গেলাস রস খেলাম আরাম করে।

তারপর দাম দেওয়ার জন্য পকেটে হাত দিতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।

আমার মানি ব্যাগ রাখার অভ্যেস নেই। দু-চার টাকা থাকলে বুক পকেটেই রাখি, একটু বেশি। হলে রাখি প্যান্টের পকেটে। আজই আমার ছাত্র-ছাত্রীর মা খামে করে আমাকে এ-মাসের মাইনে দিয়েছেন। ওঁরা খুব ভদ্র। কখনও এমনি টাকা দেন না, ভদ্রমহিলা নিজে আমার পড়ানো হয়ে। যাওয়ার পর আলাদাভাবে ডেকে কিছু একটা খাওয়ার জিনিস দেওয়ার পর বলেন, এই খামটা রাখুন।

খামটা নেই!

একশো পঁচিশ টাকা! মাইনে পাব জেনেই আমি আর কোনও টাকাপয়সা নিয়ে বেরুইনি। তেমন কিছু ছিল না বাড়িতে। শুধু কিছু খুচরো পয়সা রয়েছে।

এ-পকেট ও-পকেট চাপড়াতে লাগলাম। প্যান্টের তিনটে পকেট আর জামার বুক পকেট। নেই মানে নেই। কোথাও পড়ে উড়ে গেছে? অসম্ভব! একশো টাকার মূল্য আমার কাছে অনেক। বাসের ভিড়ের মধ্যেও আমি দু-তিনবার খামটা অনুভব করেছি।

পকেটমার? ভিড়ের বিরক্তি কাটাবার জন্য আমি কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক ছিলাম ঠিকই। যখন কোনও একটা পরিবেশ আমার একেবারে পছন্দ হয় না তখন আমি ইচ্ছে করে মনটাকে অন্যদিকে ফেরাই। সুন্দর কোনও জায়গার কথা ভাবি। চলন্ত বাসে বসে আমি চিন্তা করছিলাম কাঁকড়াঝোড় জঙ্গলের কথা।

আমার হাতে দু-খানা বই। সেগুলোরও পাতা ফরফর করে দেখলাম।

পকেটমাররা জানল কী করে যে আজই আমার পকেটে একটা টাকাওয়ালা খাম আছে? অন্যদিন আমার পকেটে পাঁচ-সাত টাকার বেশি থাকেই না!

বাঁ-হাত থেকে হাতঘড়িটা খুললাম। এটা আমার বাবার। বেশ পুরোনো।

ঘড়িটা এগিয়ে দিলাম রসওয়ালার দিকে।

সে চমকে উঠে বলল, ইয়ে কেয়া?

সত্যি কথা বলতেও আমার বুক কাঁপছে। আমার পকেটে যে টাকা ছিল, সেই জন্যেই আমি রস খেতে এসেছি, সেকথা কি ও বিশ্বাস করবে?

বললাম, রুপিয়া খো গ্যয়া। পাকিটমার। আপ এ-ঘড়ি রাখ দিজিয়ে।

লোকটি আঁতকে উঠে বলল, নেহি, নেহি! ঘড়ি নেহি লেঙ্গে, আপ পয়সা দিজিয়ে।

জানতাম বিশ্বাস করবে না। ও ভাবছে আমি ওর সঙ্গে কৌতুক করছি। কিংবা ঠকাতে চাইছি।

বারবার পীড়াপীড়ি করাতে রসওয়ালা একসময় গোমড়া মুখে জানাল যে, ঠিক আছে আমাকে পয়সা দিতে হবে না। ঘড়িও সে রাখবে না।

তখন আমি ঘড়িটা জোর করে তার হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম, তুমি রাখো। কাল আমি পয়সা এনে ঘড়িটা ছাড়িয়ে নিয়ে যাব। সে ঘড়িটা নাড়াচাড়া করে দেখল। কানের কাছে নিয়ে আওয়াজ শুনল। খেলনা ঘড়ি নয়। চলবে। যতই কম দাম হোক, দু-গেলাস সরবতের চেয়ে নিশ্চয়ই বেশি।

লোকটিকে ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থায় রেখে আমি হনহন করে এগিয়ে গেলাম ট্রাম গুমটির দিকে।

বাড়িতে র‍্যাশান তোলার টাকাটা আমি দিই। এই টাকা থেকে দেওয়ার কথা। কালই সেই দিন। টাকাটা যে-কোনও ভাবে জোগাড় করতে হবে। ঘড়ির ব্যাপারটা গোপন রাখতে হবে সাবধানে। কাল এখানে এসে যদি দেখি রসওয়ালা নেই, তাতেও কিছু যায় আসে না। দু-চারদিন পর বাড়িতে জানিয়ে দেব যে ঘড়িটা হারিয়ে গেছে। হারাতে তো পারেই।

ছোটখাটো অপমান আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না। তিন-চারদিন ধরে সেটাই শুধু মাথার মধ্যে ঘোরে, অন্য কিছু ভাবতে পারি না। লিখতে পারি না।

রসওয়ালাকে যদি শুধু বলতাম টাকা হারিয়ে গেছে, দাম দিতে পারছি না। তাহলে সে আমাকে মনে করত ঠক-জোচ্চোর। যদি কোনও খারাপ কথা বলত, আগুন জ্বলত আমার মাথার মধ্যে। তার চেয়ে ঘড়িটা যাওয়া অনেক ভালো।

পকেটে যা খুচরো আছে, তাতে কোনও রকমে ট্রাম ভাড়াটা হয়ে যাবে।

একটা ট্রাম এসে থামবার পর সবেমাত্র হাতলটা ধরেছি, সেই রসওয়ালা ছুটতে-ছুটতে এসে। বলল, আপ ঘড়ি লে যাইয়ে। কই ফিকির নেহি। আবার যেদিন রস খেতে আসবেন, সেদিন দাম দিয়ে দেবেন। তাড়াতাড়ির কিছু নেই।

আমি তবু বললাম, কেন তুমি ঘড়িটা রাখো না!

লোকটি কাতরভাবে বলল, না।

এরপর আর জোর করা যায় না। আমি লোকটিকে ঘড়িটা একেবারে মেরে দেওয়ারও সুযোগ দিয়েছিলাম। কাল থেকে সে যদি এখান থেকে সরে গিয়ে অন্য জায়গায় বসত, তাকে আমি খুঁজে পেতাম না আর। দুদিন পরে ভুলে যেতাম তার মুখ।

ট্রামে উঠে পড়ে তার দিকে আমি একটা কৃতজ্ঞতার হাসি দিলাম।

লোকটির এই অদ্ভুত সততার কথাটা সবাইকে জানাবার মতন না?

অন্তত বন্যাকে এক্ষুনি বলতে হবে!

আজ সকালেই বন্যার সঙ্গে দেখা হয়েছে। সন্ধের সময় আবার যাওয়া যায় না। কিন্তু এখন মনে হল, যেতেই হবে। বন্যাকে এই ঘটনাটা না বললে আজ রাত্তিরে আমার ঘুমই আসবে না।

ফড়েপুকুরের মোড়ে ট্রাম থেকে নেমে আমি ছুটতে লাগলাম। যেন একটা মুহূর্তও নষ্ট করলে মহাবিপদ হয়ে যাবে।

বন্যাদের বাড়ির একতলার বাঁ-দিকের ঘরে বসে আছেন বন্যার কাকা আর তাপস হালদার। বন্যা দাঁড়িয়ে আছে একটা বইয়ের র‍্যাকের পাশে। কিছু একটা বেশ জমাট গল্প হচ্ছে।

এটা বন্যাদের লাইব্রেরি ঘর। বন্যার ঠাকুরদার খুব বইয়ের শখ ছিল, তিনি প্রচুর বই কিনতেন। সবই সাহিত্যের বই। ইংরিজি-বাংলা ক্লাসিক। বন্যার বাবা-কাকারা কেউ সাহিত্যের ভক্ত নন, এখন বিজ্ঞানের হাওয়া বইছে। ঠাকুরদার আমলের বইগুলো অনেকদিন অযত্নে পড়েছিল। এখন বন্যা সেগুলোকে আবার ধুলোটুলো ঝেড়ে ভদ্রস্থ করেছে।

আমি মাঝে-মাঝে এখান থেকে বই পড়তে নিই। কেউ আপত্তি করে না।

কোনও প্রয়োজন ছিল না, তবু আমি ঘরের মধ্যে ওই দুজনকে দেখে প্রথমেই বলে ফেললাম, এই বই দুটো ফেরত দিতে এসেছি!

বন্যার দাদার সহপাঠী আমি। দীপেন এখন চাকরি নিয়ে চলে গেছে রাঁচি। সবাই জানে, আমি বন্যারও বন্ধু। এ-বাড়িতে যখন খুশি আসতে পারি। তবু কেন আমার মুখ দিয়ে একটা কৈফিয়ৎ বেরিয়ে আসে?

বন্যা বলল, এর মধ্যে পড়া হয়ে গেল?

আমি বললাম, হ্যাঁ, আর-একখানা নেব!

বন্যার কাকা বললেন, এখনও চা-টা দিল না কেন? বসো, বসো, তোমরা একটু বসো। আমি দেখছি। আমাকে একটু বেরুতে হবে।

তাপস হালদার এখানে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে আসেননি। এসেছেন স্পেশ্যাল ভিজিটে। বন্যা পড়াশুনো করে অন্য একটা ঘরে।

তাপস হালদারের সঙ্গে সেই আমার মুখোমুখি দেখা।

বন্যা আমাদের আলাপ করিয়ে দিল। তাপস হালদার আমার সঙ্গে শুকনো ভদ্রতা করলেন, বিশেষ পাত্তা দিলেন না। তিনি একটা বইয়ের পাতা ওলটাতে লাগলেন।

বন্যা আবার বলল, সুনীলদা একজন কবি। কবিতা পত্রিকা, চতুরঙ্গ, দেশ পত্রিকায় অনেকগুলো কবিতা বেরিয়েছে।

এবার তাপস হালদার মুখ তুলে খানিক কৌতূহলের চোখে তাকালেন।

আমি বিনীতভাবে বললাম, আমি আপনার বেশ কয়েকটা প্রবন্ধ পড়েছি। আপনি অনেকদিন আর তো কিছু লেখেন না!

তিনি উদাসীনভাবে বললেন, এখন আর সময় পাই না।

তিনি যে অতি ব্যস্ত তা সবাই জানে। কিন্তু আজ এক ছাত্রীর বাড়িতে বেড়াতে আসার সময় পেলেন কী করে, সেটাই খুব আশ্চর্যের ব্যাপার।

হয়তো আমার চোখের মধ্যে এই প্রশ্ন ছিল। তাই তিনি আবার বললেন, আমাদের কোচিং কলেজের ঠিক সামনেই আজ একটা পুজো হচ্ছে। ইতু পুজো না ষষ্ঠী পুজো কী যেন! এত জোরে মাইক আর ঢাক বাজাচ্ছে যে ওখানে আর বসে থাকা যায় না। তাই আজ বেরিয়ে পড়েছি!

তাপস হালদারের চেহারা ও ব্যক্তিত্বের কাছে এমনিতেই আমি কাঁচুমাচু হয়ে গেছি। এরপর আবার তিনি প্রশ্ন করলেন, আপনি কী করেন ভাই!

এই একটি প্রশ্নই যে-কোনও বেকার যুবককে কাত করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

আমি ঢোঁক গিলতে গিলতে বললাম, বিশেষ কিছু না। চেষ্টা করছি কিছু একটা জোগাড় করার।

তাপস হালদার একটা সিগারেট ধরালেন।

বন্যা একটা বই এনে বলল, আপনি ওর কবিতা পড়েছেন। এটা ওর প্রথম বই।

আমি ভুরু নাচিয়ে-নাচিয়ে বন্যাকে বারণ করার অনেক চেষ্টা করেও পারলাম না। বন্যা বইটা তাপস হালদারের হাতে তুলে দিল।

তাপস হালদার খুব অবহেলার সঙ্গে পাতা ওলটাতে লাগলেন। এক জায়গায় তাঁর চোখ থেমে গেল। একটা গোটা কবিতা পড়লেন মনে হল। তিন-চার পাতা পরে আর-একটা।

আমি ব্যগ্র চোখে চেয়ে আছি। বুকটা দুরুদুরু করছে। আমার সামনে বসে কেউ আমার লেখা পড়লে যেমন লজ্জা করে, তেমনি কৌতূহলও দমন করতে পারি না।

বইখানা পাশের টেবিলে রেখে দিয়ে তাপস হালদার বললেন বাঃ, বেশ ভালোই তো। কয়েকটা লাইন বেশ ইন্টারেস্টিং।

তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে, চোখ নাচিয়ে, খানিকটা হেসে বললেন, কয়েকটা ছন্দ ভুল আছে!

সঙ্গে-সঙ্গে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে গেল!

সাহস কী লোকটার! বুদ্ধদেব বসু পর্যন্ত আমার ছন্দের ভুল ধরতে পারেননি কখনও। আর হঠাৎ এই কথা বলল একজন অঙ্কের মাস্টার।

আমার মুখচোখ লাল হয়ে গেছে। কোনওরকমে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে যতদূর সম্ভব বিনীতভাবে জিগ্যেস করলাম, কোথায়-কোথায় ভুল আছে, একটু দেখিয়ে দেবেন?

তাপস হালদার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, নাঃ! এখন আর মাস্টারি করতে ইচ্ছে করছে না। তারপর বন্যার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, তোমাদের বাড়িতে চা দিতে খুব দেরি করে তো? তোমার কাকা কোথায় গেলেন?

বন্যা বলল, দেখছি। আপনি একটু বসুন!

বন্যা এক ছুটে বেরিয়ে গেল।

ও কেন শুধু বলল, আপনি একটু বসুন? কেন বলল না, আপনারা? ও চায় না, আমি এখানে বসে থাকি? ধ্যাৎ, তা হতেই পারে না। আমার সঙ্গে কি বন্যার ভদ্রতার সম্পর্ক?

তাপস হালদার আমার সঙ্গে আর একটিও কথা না বলে অন্য একটা বইয়ের পাতা ওলটাতে লাগলেন। আমিও বসে রইলাম চুপ করে। দেওয়ালে একটা বড় ঘড়ি, তার পেন্ডুলামের শব্দও শোনা যাচ্ছে।

তাপস হালদার গোড়া থেকেই আমাকে পছন্দ করেননি। উনি কি আমার নিশ্বাসে হিংস্রতার গন্ধ পেয়েছিলেন?

একসময় আমিও উঠে গিয়ে বইয়ের রাকের পাশে দাঁড়ালাম। বন্যা ফিরে এল দু-কাপ চা নিয়ে। জিগ্যেস করল, স্যার, আপনি চিনি খান তো? তাপস হালদার বেশ অবাকভাবে বললেন, কেন, চিনি খাব না কেন?

বন্যা এক কাপ চা তাপস হালদারের হাতে তুলে দিল, কিন্তু আর-এক কাপ টেবিলের ওপর রেখে বলল, এই-ই, তোমার চা!

বন্যা আমাকেও কাপটা হাতে তুলে দিল না কেন?

বন্যা বলল, কাকা ওপরে টেলিফোনের কাছে বসে আছেন। বিদেশ থেকে একটা কল আসবার কথা আছে।

তাপস হালদার বললেন, আমারও বাড়িতেও একটা টেলিফোন নেওয়ার অনেক চেষ্টা করছি। কিছুতেই দিচ্ছে না।

বন্যা বলল, পেয়ে যাবেন, সামনের মাসের মধ্যেই!

সামনের মাসে পাব? সত্যি? তোমার কেউ চেনা আছে?

না কেউ চেনা নেই।

তাহলে? তুমি কী করে জানলে।

আমি বলছি, দেখুন মেলে কি না। ঠিক এক মাসের মধ্যে।

বন্যা, তুমি মাঝে-মাঝে এমনভাবে কথা বলো, যেন মনে হয়, তুমি হাত গুণতে জানো!

আপনি ওসবে বিশ্বাস করেন বুঝি?

না। বিশ্বাস করি না। তবে মজা পাই। একসময় হাত-দেখার চর্চা করেছি।

আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ালাম। ওদের সংলাপে আমার কোনও ভূমিকা নেই। যেন ঘরে আর কেউ নেই।

তাপস হালদার যদি বন্যার হাত দেখার চেষ্টা করে, তাহলে আমি একটা মোটা বই ওর মাথায় ছুড়ে মারব। হাত দেখা? পুরোনো টেকনিক!

বন্যাও ইঙ্গিতটা নিল না। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। ও আমার মনোভাব ঠিক বুঝেছে। এই জন্যই বন্যা অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা।

তাপস হালদার চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বললেন, তুমি সারাদিনে অন্তত দু-ঘণ্টা সময় দিতে পারবে অঙ্কের জন্য? তা হলেই আমি তোমাকে ফার্স্ট ক্লাস পাইয়ে দেব।

পড়াশুনোর কথাবার্তা। তাপস হালদার ভাবছেন, আমি একজন অপ্রয়োজনীয় মানুষ। বই নিতে এসেছি, এখন আমার চলে যাওয়া উচিত!

বন্যাকে এই লোকটার কাছে একা রেখে আমি চলে যাব?

শুরু হল একটা স্নায়ুযুদ্ধ। কে আগে যাবে? আমার আগে যাওয়ার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। এসপ্ল্যানেডের আখের রসওয়ালার গল্পটা বলতে হবে না বন্যাকে? তাপস হালদারের সামনেও সেকথা বলা চলে না।

বন্যা আমাকে জিগ্যেস করল, তোমার বই বাছা হয়নি?

কেউ যেন আচমকা আমাকে একটা চড় মেরেছে! বন্যার এই কথা বলার মানে কী? বন্যা আমাকে চলে যেতে বলছে?

এরপর আমার সামনে দুটি মাত্র পথ।

এই মুহূর্তে বন্যাকে খুব করে আমার বলা উচিত, আর কোনওদিন অন্য লোকের সামনে আমার সঙ্গে এভাবে কথা বোলোনা! অথবা, এক্ষুনি এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাব, আর আসব না। কোনওদিন, আর কোনওদিন মুখ দেখব না বন্যার।

দু-এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আমাকে পথটা বেছে নিতে হল।

তারপর বললাম, থাক, আজ আর কোনও বই নেব না। এমনকি তাপস হালদারের দিকেও চেয়ে বললাম, আসি! নমস্কার!

বন্যার দিকে না তাকিয়ে আমি বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে। কেউ কি আমাকে কিছু বলল? কেউ আমার নাম ধরে ডাকল?

আমি শুনতে পেলাম না কিছু।

রাস্তায় বেরিয়ে হলুদ রঙের বাড়িটার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললাম, বিদায়!

হুহু করে আমার শরীরের ওজন কমে যাচ্ছে। আমি এত হালকা হয়ে গেছি যে যেন হাওয়ার উড়ে যেতে পারি। ঝড়ের মুখেএকটা শুকনো পাতার মতন আমি একটা ট্রামের ভেতর ঢুকে পড়লাম।

বন্যাকে আমি এত বেশি আঁকড়ে ধরেছিলাম, সে আমার বুক এতটাই জুড়ে ছিল যে তাকে পরিত্যাগ করা মাত্র আমি একেবারে শূন্য হয়ে গেলাম। আমার অস্তিত্বটাই টলমলে হয়ে গেল।

এইরকম সময়ে কেউ-কেউ আত্মহত্যা কিংবা খুন করে। আমি কলম ছাড়া আর কোনও অস্ত্র কখনও হাতে নিইনি। অনেক সময়েই কোনও-কোনও লোককে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে বটে, কিন্তু আমি জানি, সেরকম ইচ্ছে আমি কোনওদিনই কাজে পরিণত করতে পারব না। তার চেয়ে নিজে সরে যাওয়া অনেক সহজ।

আহিরীটোলার একটা বাড়িতে একতলার আড়াইখানা ঘর আমাদের। এ-বাড়িতে পাঁচ ঘর ভাড়াটে, অনরবত লোকজন আসে যায়, সর্বক্ষণ যেন একটা হট্টমেলা চলছে। রাত্তিরে কে সদর দরজা বন্ধ করবে। ভোরবেলা কে এসে খুলে দেবে তার কোনও ঠিক নেই।

দরজার পাশেই ছোট্ট ঘরখানা আমার আর ছোট কাকার। ছোট কাকা খুব ঘুম কাতুরে আর আমার রাত জাগার অভ্যেস। দোতলার বিপিনবাবুর খুব চোর-ডাকাতের ভয়, তিনি রাত দশটা বাজলেই ওপর থেকে চিৎকার করেন, সদর বন্ধ হয়েছে? সদর বন্ধ হয়েছে? অন্ধকারে কেউ সিঁড়ির নীচে ঢুকে বসে থাকবে!

তিনি নিজে নামবেন না, আমাকেই দরজা বন্ধ করে দিতে হয়।

কিন্তু তার পরেও এগারোটা, সাড়ে এগারোটায় কেউ-কেউ ফেরে, তারা খটাখট করে দরজায় কড়া নাড়ে। আমাকেই খুলে দিতে হয়, এবং আমার ওপরেই চোখ রাঙিয়ে তারা বলে, এত তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করতে কে বলেছে?

রাস্তার দিকে একটি মাত্র জানলা। সেটা খুলে রাখারও বিপদ আছে। রাত বারোটার পর যখন সব দিক নিঝুম হয়ে যায় তখন আমি লেখাপড়া করতে বসি। তারপর শুরু হয় উপদ্রব।

আমাদের পাড়ার মোড়ে একটা ছোট্ট স্যাকরার দোকান আছে। বেশিরভাগ দিনই দিনের বেলা সেটার ঝাঁপ বন্ধ থাকে, সন্ধের পর খোলে। আসলে সেটা একটা চোলাই মদের আড্ডাখানা।

এ-পাড়ার দুই মাতাল মান্তুদা আর সানুদা প্রায়ই মাঝরাত্তিরে এসে দাঁড়ায় আমার জানলার কাছে। দুজনেই কিন্তু ভালো লোক, আমাকে পছন্দ করে বেশ। তবে, রাত্তিরে নেশা করার পর আমার জন্য তাদের দরদ উথলে ওঠে।

আমি হয়তো তখন একটা কবিতা লিখছি। দুটো লাইন লেখার পর তৃতীয় লাইনটা কিছুতেই মনে আসছে না। ঠিক মতন শব্দ খোঁজার জন্য কলম কামড়াচ্ছি। তখন মান্তুদা আর সানুদা জানলার। কাছে এসে দাঁড়িয়ে গভীর দুশ্চিন্তার সঙ্গে বলবে, ইঃ, তুই এখনও লেখাপড়া করছিস? তোর কি সারাবছর ধরেই পরীক্ষা থাকে? আগের বারে পাস করিসনি? এত পড়া আর পড়া, তোর যে চোখ নষ্ট হয়ে যাবে রে! ব্রেনের ওপর এত টর্চার, ভালো করে মাখন খাস তো? আহা রে, ছেলেটার কী কষ্ট!

এইরকম কথা অনেকক্ষণ ধরে। কখনও তারা আমার কাছ থেকে সিগারেট চায়, আবার তাদের হাতের বোতল থেকে আমাকে দু-এক ঢোঁক খাওয়াবারও চেষ্টা করে। এইজন্য, গরমের মধ্যেও আমাকে জানলা বন্ধ রাখতে হয়।

তবে গ্রীষ্মকালটায় আমার মুক্তির একটা জায়গা আছে। ছাদ। রাত্তিরবেলা ছাদে মাদুর পেতে শুতে আমার দারুণ ভালো লাগে। ভাড়াটেদের আরও কেউ-কেউ শোয়, তবে আমি একটা কোণ বেছে নিই, অন্যদের সঙ্গে বিশেষ কথা হয় না।

একটু মেঘলা-মেঘলা থাকলে আরও ভাবনা। সেদিন আর অন্য কেউ যায় না।

আজ এদিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। সেইজন্য ছাদে আর কেউ মাদুর পাতেনি। আকাশ এখন লাল হয়ে আছে।

সারাদিন এত গরম ছিল যে ওই এক পশলা বৃষ্টিতে ছাদ একটুও ভেজেনি। বরং ধুলো সরে গেছে। আজ পুরো ছাদটা আমার, তবু কোণের দিকটায় আমার নিজস্ব জায়গাতেই মাদুর পাতলাম। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়লেও আমি উঠি না। ঝমঝমিয়ে নামলে সিঁড়ির মুখে ছোট্ট জায়গাটাতেই শুয়ে থাকি।

চিৎ হয়ে শুয়ে বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনটাও যেন উন্মুক্ত হয়ে যায়। আকাশে প্রত্যেকদিন নতুন ছবি। যেদিন মেঘ থাকে না, সেদিন চলে যাই নক্ষত্রলোকে। দেখতে পাই উল্কার ছোটাছুটি। মেঘরাও কতরকম ভাস্কর্য ও স্থাপত্য তৈরি করে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে মনে হল, বন্যা আমার জীবনে আর নেই। আজ বিকেলেও কি আমি ভাবতে পারতাম, বন্যাকে বাদ দিয়ে আমি বেঁচে থাকতে পারব? এত বেশি ভালোবাসা আমার চোখ অন্ধ করে দিয়েছিল। আমি ভালোবাসলেই বন্যা পুরোপুরি তার প্রতিদান দেবে, এটা ধরেই নিয়েছিলাম? আর কোনও দিকে তাকাইনি। আর কোনও মেয়ের সঙ্গে আমার। ভাব নেই। সবসময় শুধু বন্যা আর বন্যা! কিন্তু ও আমাকে ভালোবাসতে যাবে কেন? আমি একটা অতি সাধারণ পরিবারের বেকার ছেলে, দুটো-চারটে কবিতা লিখেছি মাত্র, ভবিষ্যতের কোনও আশা নেই।

বন্যা আমাকে হয়তো খানিকটা পছন্দ করে। খানিকটা প্রশ্রয়ও দেয়। কিন্তু সেটা ভালোবাসা নয়। সেটাই আমি এতদিন বুঝতে পারিনি।

বুকটায় একটা বড় ক্ষত হয়ে আছে, তার ওপর লাগছে ঠান্ডা হাওয়া। আঘাতটা এত বেশি যে সম্পূর্ণ ব্যথাটা এখনও টের পাচ্ছি না। হাওয়াটাই খুব ভালো লাগছে। সত্যিকারের মিষ্টি হাওয়া। যারা আজ ঘরের মধ্যে শুয়ে আছে, তারা আজ ফুল স্পিডে পাখা চালিয়েও এ আরাম পাবে না।

ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসবেই একসময়। তবু আবার জেগে উঠলাম।

বন্যা আমার পাশে এসে বসেছে। ওর নরম হাত রেখেছে আমার কপালে।

এটা স্বপ্ন। না, বন্যা, আমি তোমাকে আর স্বপ্নেও দেখতে চাই না।

বন্যা হেসে বলল, কেন, এত রাগ?

আমি বললাম, নাঃ, রাগ নয় তো! দ্যাখো আমি কত শান্ত। আমি সব বুঝে গেছি।

বন্যা বলল, তুমি পাগলের মতন দৌড়ে আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে? একবার আমার দিকে তাকালে না?

আমি বললাম, মোটে দৌড়ে বেরোইনি। তোমার কাছ থেকে, তোমার অঙ্কের মাস্টারের কাছ থেকে ভদ্রতা করে বিদায় নিয়ে এসেছি। তুমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলে।

বন্যা বলল, মোটেই না। আমি সোজা তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তুমি মুখ তোলাইনি।

আমি বললাম, আঃ! এটা তো স্বপ্ন। স্বপ্নের মধ্যে তর্ক করে কী লাভ? তুমি যাও, বন্যা, আমার স্বপ্ন থেকে চলে যাও। আমি কোনও স্বপ্ন দেখতে চাই না, চাই না, তুমি যাও!

বন্যা জেদির মতন বলল, না, আমি যাব না!

হঠাৎ ধড়মড় করে জেগে উঠলাম। স্বপ্ন ভেঙে দেওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় জেগে ওঠা।

এ কী। রীতিমতন রোদ উঠে গেছে। এবং আমার পাশে সত্যিই বন্যা বসে আছে। মুখে তার মিটিমিটি হাসি। একটা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরা।

আমি গভীর দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। সত্যিই কি বন্যা? আমাদের বাড়ির ছাদে! বন্যা আমাদের বাড়িতেই কখনও আসেনি, আমার বাড়ি সে চেনে না।

বন্যা আমার পাশে বসে আমার চুল নিয়ে খেলা করছে। আমি একটা হাত তুলে রাখলাম তার ঊরুতে।

বন্যা আমার হাতটা ধরে বলল, অনেক ঘুমিয়েছ, এবার ওঠো!

আর কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। সত্যিই রক্ত-মাংসের নারী। কাল রাত্রে কী ঘটেছে, আমি সমস্ত ভুলে গেলাম। আমার মনে একটাই প্রশ্ন, বন্যা এখানে এল কী করে?

বন্যা দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বলল, আকাশ দিয়ে উড়তে-উড়তে।

অধিকাংশ নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারই খুব রক্ষণশীল। এ-বাড়ির অন্য ভাড়াটেরাও পরচর্চার সামান্য সুযোগ পেলেই জিভে শান দেয়। ভোরবেলা একটি যুবতী মেয়ে ছাদে আমার পাশে বসে গল্প করছে। এ দৃশ্য কেউ সহ্য করবে না। হয়তো ওরা ভাববে, বন্যা সারারাতই আমার সঙ্গে এখানে ছিল।

বন্যা আমার ঠিকানা জানে। ঠিকানা খুঁজে এসেছে। ফড়েপুকুর থেকে এতদূর এই ভোরে এল কী করে, ট্যাক্সিতে? সদর দরজা কে খুলে দিল? বন্যা কী করেই বা জানল যে আমি ছাদে শুয়ে থাকব!

বন্যা সেসব প্রশ্নের কোনও উত্তরই দেবে না।

বালিশের তলা থেকে ঘড়িটা বার করলাম। খুব ভোর নয়, সাতটা বাজে। এতক্ষণে কলকাতা অনেকটাই জেগে উঠেছে, আমাদের বাড়িতেও একতলায় বাথরুমে কাজের মেয়েদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।

বন্যা বলল, তোমাদের এখান থেকে তোগা কাছেই। চলো, গঙ্গার ধারে কোনও দোকানে গিয়ে চা খাই!

আমি বললাম, জানো, এই ঘড়িটা, কাল সন্ধেবেলা এসপ্লানেডে একটা আখের রসওয়ালার কাছে বাঁধা রাখতে চেয়েছিলাম। সে কিছুতেই নিল না। আমি জোর করলাম, তবু নিল না। এত ভালোমানুষ এখনও হয়?

বন্যা বলল, ঘড়ি বাঁধা দিয়েছিলে? কাল টিউশনির মাইনের টাকা হারিয়ে ফেলেছ বুঝি?

বন্যাকে সব বলতে হয় না, ও অনেক কিছুই আগে থেকে বুঝে নেয়। আমি কেন বুঝতে পারি না?

বন্যা বলল, চলো, চলো, এরপর বেশি রোদ উঠে যাবে!

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মনে-মনে জপ করছি, কেউ যেন দেখতে না পায়। মা-বাবার সামনে যেন পড়ে না যাই।

আমি যে বাবা-মাকে খুব ভয় পাই, তা নয়। তবু লজ্জা, সমীহ মেশানো একটা কিছু তো থাকেই। তা ছাড়া অনেক দিনের সংস্কার। একটি তরুণী মেয়ের সঙ্গে পা টিপেটিপে ছাদ থেকে নামা, এটা দেখলে ওঁরা আঁতকে উঠবেন। অন্য কেউ বুঝবে না যে প্রায় সারারাত ধরে স্বপ্নে ওর সঙ্গে তর্কাতর্কি করেছি বলেই সকালবেলা বন্যা এখানে এসেছে।

বিপিনবাবু গামছা পরে ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে বন্যাকে দেখতে পেয়ে নিজেই লজ্জায় ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন। ছোটকাকা বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে-মাজতে দেখল, আমার বদলে বন্যাকেই বেশি করে দেখল। কিন্তু অবাক হল না। হয়তো ভাবল, বন্যা এ-বাড়ির অন্য কোনও ভাড়াটেদের অতিথি। আমার সঙ্গে যোগাযোগটা কল্পনাই করেনি। সেইটাই সুবিধে। একতলায় কেউ ভাববে না। বন্যা আর আমি একসঙ্গে ছাদ থেকে নামছি।

ময়লা, চটকান, পাজামা, তার ওপর একটা গেঞ্জি। সদর দরজার কাছে এসে বললাম, তুমি বাইরে দাঁড়াও, আমি একটা জামা পরে আসছি।

বন্যা বলল, কোনও দরকার নেই।

বন্যা আমার হাত ধরে টানতে যাচ্ছিল, আমি নিজেই বেরিয়ে এলাম। কোনওদিন আমি গেঞ্জি পরে রাস্তায় বেরোই না, আর আজ একটি মেয়ের সঙ্গে…

কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বন্যা বলল, ছেলেদের কত সুবিধে, তবু তারা গরমের মধ্যে সবসময় জামা পরে থাকে কেন? ইস, আমরা যদি এরকম পারতুম! সকালবেলা শুধু একটা শায়া আর গেঞ্জি পরে বেরুলে সবাই ভাবত খারাপ মেয়ে, তাই না?

আমি কথা খুঁজে পাচ্ছিনা।

বন্যা বলল, একদিন কোনও একটা নির্জন সমুদ্রের ধারে আমি তোমার সঙ্গে ঠিক এইরকম ভাবে হাঁটব।

মোড়ের মাথায় একটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। বন্যা তাকে পয়সা দিয়ে ছেড়ে দিল।

তারপর আমাকে জিগ্যেস করল, তোমাদের বাড়ি থেকে গঙ্গা এত কাছে। তুমি গঙ্গায় সাঁতার কাটতে যাও না?

ছেলেবেলায় যেতাম।

তুমি আমাকে সাঁতার শিখিয়ে দেবে? কলকাতায় না, বাইরে কোথাও গিয়ে। আমার পরীক্ষাটা হয়ে যাক! ঘাটশিলায় তোমার এক বন্ধু থাকে না? ওখানে নদীটার কী যেন নাম?

বন্যা, তুমি কী করে জানলে যে আমি ছাদে শুয়ে থাকব?

ওসব থাক। নদীটার নাম বলো না!

সুবর্ণরেখা।

খুব গভীর?

না, বেশি জল থাকে না। তুমি ওখানে সাঁতার শিখতে পারো!

তাহলে যদি এই সেপ্টেম্বরে। কথা রইল।

তুমি এত সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে। কেউ তোমার খোঁজ করবে না?

তুমি এত আজেবাজে জিনিস নিয়ে চিন্তা করো কেন? এগুলো কি দরকারি কথা? আমি সকালবেলা দেশবন্ধু পার্কে বাস্কেটবল খেলতে যাই, জানো না? তোমাদের এখানে এখন জিলিপি। পাওয়া যাবে?

হ্যাঁ, খুব ভালো জিলিপি! চলো, কাছেই।

কাল কগেলাস আখের রস খেয়েছিলে?

দু-গেলাস।

কত দাম?

আড়াই টাকা।

সেই টাকাও তোমার কাছে ছিল না। তুমি ঘড়িটা দিতে গিয়েছিলে? আমি ওই লোকটার কাছে গিয়ে আখের রস খাব। আজই বিকেলে।

বিকেলে তুমি টিউটোরিয়ালে যাবে না?

আবার বাজে কথা! আখের রস খেতে চেয়েছি, তুমি খাওয়াবে কি না বলো! আমরা দুজনে মিলে চার গেলাস খাব। তারপর লোকটাকে আমার একটা সোনার চুড়ি বাঁধা দিতে চাইব। দেখতে হবে, সেটাও ও ফেরত দিতে চায় কি না!

বন্যা এমনভাবে এ কথাটা বলে হাসতে লাগল যে আমারও না হেসে উপায় রইল না। সোনার চুড়ি হাতে সেই রসওয়ালা লোকটার ভ্যাবাচ্যাকা মুখখানা যেন দুজনেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

গঙ্গার ধারে প্রচুর স্নানযাত্রীর ভিড়। এখানকার অনেক দোকানই খুব ভোরে জেগে ওঠে। কাছেই

শ্মশান বলে কোনও-কোনও দোকান জেগে থাকে সারারাত।

জিলিপি সিঙারা ভাজার গন্ধে ম-ম করছে জায়গাটা।

একটা দোকানের সামনের বেঞ্চে বসলাম দুজনে। বন্যাকে বললাম, আমি জামা পরে আসিনি, পয়সা না থাকলেও ক্ষতি নেই। এরা আমাকে ধার দেয়।

বন্যা চোখ বড়-বড় করে বলল, কেন, ধার কেন? তোমার হাতে তো ঘড়িটা রয়েছে!

আবার সেই হাসি!

হাসতে-হাসতে আমার মনে হল, একদিন কোথাও বন্যা আর আমি এরকম পাশাপাশি বসে জিলিপি খাব আর মজার গল্প করব। তাপস হালদার হেঁটে যাবে আমাদের সামনে দিয়ে, আমরা ফিরেও তাকাব না।

তাপস হালদার যেন প্রায় পাগল হয়ে গেলেন।

অত ব্যস্ত মানুষ, কিন্তু তিনি প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলা আসতে লাগলেন বন্যাদের বাড়িতে। বন্যাকে তিনি আলাদা পড়াবেন। বন্যা অঙ্কে এবছর রেকর্ড নম্বর পাবে, এই তাঁর প্রতিজ্ঞা।

এতখানি সময় তিনি ব্যয় করবেন, কিন্তু তাঁর জন্য বেশি টাকাও তিনি চান না। বন্যার কাকাকে তিনি বুঝিয়েছেন যে বছরের-পর-বছর মাস্টারি করতে-করতে তাঁর একঘেয়েমি এসে গেছে। পয়সার জন্য টিউটোরিয়াল হোম তাঁকে চালাতে হবেই। কিন্তু প্রতি বছর অন্তত একজন কোনও ছাত্র বা ছাত্রীকে আলাদা করে বেছে নিয়ে তিনি মনপ্রাণ দিয়ে অঙ্ক শেখাতে চান। এটা তাঁর

আনন্দের ব্যাপার। এজন্য তাঁর টাকা চাই না। বন্যার মতন বুদ্ধিমতী মেয়ে তিনি আগে দেখেননি।

বন্যা যদি অঙ্কে ফার্স্ট হয়, তাহলে তিনি ওর কাকার কাছ থেকে নিজেই কিছু চেয়ে নেবেন।

প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলা দু-ঘণ্টা, আড়াই ঘণ্টা ধরে অঙ্ক! লোকটা তো পাগল হয়েছেই। মেয়েটাকেও পাগল করে দেবে নাকি? এত অঙ্ক কারুর সহ্য হতে পারে?

এখন প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলা সাড়ে ছটা থেকে নটা পর্যন্ত বন্যাদের বাড়িতে যাওয়া আমার নিষেধ। কেউ নিষেধ করেনি। আমরা নিজেরাই ঠিক করেছি। ভালো রেজাল্ট করার সম্ভাবনায় বন্যা তাপস হালদারের আগ্রহের আতিশয্য মেনে নিয়েছে। উনি যে সত্যিই ভালো পড়ান, তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই।

উনি আমাকে একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। এর মধ্যে আর দু-তিনবার দেখা হয়েছে। আমাকে দেখলেই উনি উকটভাবে গম্ভীর হয়ে যান। এখন আর আমার রাগ হয় না, ওকে রাগিয়ে আমি মজা পাই!

ঠিক নটা বাজতে পাঁচ মিনিট আগে আমি ফড়েপুকুরের মোড়ে এসে দাঁড়াই! অপেক্ষা করি। দূর থেকে তাপস হালদারকে আসতে দেখলে আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে শুরু করি।

ঠিক ওঁর সামনে এসে, ইচ্ছে করে মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলি, ভালো আছেন?

উনি এতই অবাক হয়ে যান যে কোনও কথাই বলতে পারেন না। রাত নটার পর আমি বন্যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, এটা উনি যেন বিশ্বাসই করতে পারেন না। আমারই মতন নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছেন তাপস হালদার, ওঁর মধ্যেও নানান সংস্কার কাজ করছে।

কিন্তু বন্যা যদি ভোরবেলা আমাদের বাড়ির ছাদে গিয়ে দেখা করতে পারে, তাহলে আমিই বা রাত নটার সময় ওর বাড়িতে আসতে পারব না কেন? বন্যাদের বাড়িতে এ ব্যাপার নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

দ্বিতীয় দিন আমাকে ওভাবে দেখার পর তাপস হালদার আবার ফিরে এলেন।

বন্যা তখন দরজার দিকে পেছন ফিরে বসে বইপত্র গোছাচ্ছে, আমি চুপিচুপি এসে ওর চোখ টিপে ধরলাম।

আমার স্পর্শ চেনে বন্যা, তবু কৃত্রিম ভয়ে বলে উঠল, এই, এই, কে? কে?

আমি গলার স্বর গম্ভীর করে বললাম, যথেষ্ট অঙ্ক হয়েছে, এখন কবিতা পড়ার সময়! সারাদিন যারা শুধু কেমিস্ট্রি, ফিজিকস আর অঙ্ক কষে, একটাও কবিতা পড়ে না, তাদের ভবিষ্যৎ। একেবারে ঝরঝরে! বন্যা বলল, আমি রাত্তিরে শুয়ে-শুয়ে কবিতার বই পড়ি! রোজ! দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন তাপস হালদার। বন্যাকে শোনাবার জন্য নয়, তাঁকে শোনাবার জন্য আমি আবার বললাম, শুধু কাজ, কেরিয়ার আর টাকা রোজগারের চিন্তা করলেই চলে না, মানুষকে। মাঝে-মাঝে স্বপ্ন দেখতে হয়। যে স্বপ্ন দেখে না, সে ভালোভাবে বাঁচতেও জানে না!

তাপস হালদার এবার গলা খাঁকারি দিলেন।

বন্যা সঙ্গে-সঙ্গে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে তাকাল।

তাপস হালদার খানিকটা নার্ভাস গলায় বললেন, একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, বন্যা। কেমিস্ট্রির কয়েকটা ফর্মুলার অঙ্ক…কথা বলতে-বলতে তিনি চেয়ারে এসে বসলেন। অর্থাৎ তাঁর কথাটা দু-এক মিনিটে ফুরোবে না।

বন্যার সঙ্গে আমার শর্ত আছে, ওঁর সামনে আমি পারতপক্ষে থাকব না। তাই হাতের একটা বই টেবিলের ওপর রেখে বললাম, আমি চলি!

পরদিন দুপুরে বন্যা আমাকে হাসতে-হাসতে জানাল, স্যার তোমার সম্পর্ক কী বলছিলেন। জানো? কাল বেশ রেগে গিয়েছিলেন। এর আগে সরাসরি তোমার সম্পর্কে কিছু বলেননি। কিন্তু কাল বললেন, ওই ছেলেটি তোমাকে এত বিরক্ত করতে আসে কেন? বারণ করে দিতে পারো না? এতে তোমার কনসেনট্রেশন নষ্ট হয়ে যাবে!

তুমি কী বললে?

আমি নিরীহভাবে বললুম, বারণ করব কী করে? আমার দাদার বন্ধু, অনেকদিন ধরে এ-বাড়িতে আসছেন?

তারপর?

তখন উনি বললেন, বাড়িতে এলেও তোমাকে জ্বালাতন করবে কেন? না, না, এখন পরীক্ষার আগে এভাবে সময় নষ্ট করা ঠিক নয়! জানোনা। যাদের আর কিছু হয় না, চাকরি-বাকরি পায় না, তারাই কবিতা লেখে!

শোনো বন্যা, তোমার ওই অঙ্কের মাস্টারটিকে কবিতা সম্পর্কে আলোচনা করতে বারণ করো! সেটা আমি টলারেট করব না।

এই মাথা গরম করবে না, প্লিজ! আর তো মাত্র কয়েকটা মাস। তারপর আমরা সুবর্ণরেখা নদীর ধারে যাব।

কয়েকদিনের মধ্যেই দুটি মিরাকল ঘটল। আমি একটা চাকরি পেয়ে গেলাম মধ্যশিক্ষা পর্ষদ-এ। কয়েক মাস আগেই ইন্টারভিউ দেওয়া ছিল, তখন শুনেছিলাম কোনও আশা নেই। দুটি ছেলের অ্যাপয়েন্টমেন্টও হয়ে গেল। হঠাৎ নাকি সেই দুজনই ভালো সুযোগ পেয়ে এই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। তাই আমার ভাগ্যে শিকে ছিড়ল। অতি সাধারণ চাকরি, তাই বা এ-বাজারে কজন পায়?

তাহলে এতদিন বাদে আমার বেকার দুর্নামটা ঘুচল। মধ্যশিক্ষা পর্ষদে কাজ করি, কী পোস্ট তা আর কজন জানছে? এবার আরও বেশি করে কবিতা লিখতে হবে!

আমার চাকরি পাওয়ার মতনই আর-একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা, তাপস হালদার একটা টেলিফোন পেয়ে গেলেন!

বন্যা বলেছিল বটে, উনি এক মাসের মধ্যে টেলিফোন পেয়ে যাবেন। সেটা একটা কথার কথা। লোককে চমকে দেওয়ার জন্য বন্যা এই ধরনের কথা বলে। সেটা মিলে গেল! এক মাস না। হোক, আড়াই মাসের মধ্যে। অনেকে বহু সাধ্যসাধনা করে দশ বছরের মধ্যেও পায় না!

নতুন ফোন পেলে কেউ-কেউ খানিকটা আদিখ্যেতা করেই। অকারণে যখন-তখন ডায়াল ঘোরায়। তাপস হালদার দিনের মধ্যে অন্তত পাঁচবার বন্যাকে টেলিফোন করতে লাগলেন। প্রথমেই জিগ্যেস করেন, কী করছিলে? যেন উনি জানতে চান, বন্যা আমার সঙ্গে সময় নষ্ট করছে কি না!

বন্যার কাকার সঙ্গে তাপস হালদারের আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তিনি আর বাড়ির অন্যান্য লোকও বুঝতে পারলেন যে তাপস হালাদার বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন। কিন্তু সকলেই এই কথাও ভাবছেন, আর তো মাত্র কয়েকটি মাস। পরীক্ষা হয়ে গেলে তো অঙ্কের মাস্টারের সঙ্গে তাঁর ছাত্রীর আর বিশেষ কোনও সম্পর্ক থাকার কথা নয়। এই কয়েকটা মাস তাঁর বাতিকগুলো মেনে নিতেই হবে।

রাত নটার পর ফড়েপুকুরের মোড়ে আমি মাঝে-মাঝেই তাপস হালদারের মুখোমুখি এসে ওঁকে চমকে দিই!

আমার অফিস পার্ক স্ট্রিটে। নিউ আলিপুরের টিউশনিটা এখনও ছাড়িনি। বছরের মাঝখানে ছাড়া যায় না। সেখানে থাকতে হয় সাড়ে ছটা থেকে আটটা পর্যন্ত। অফিস ছুটির পর আমি আর বাড়ি ফিরি না, মাঝখানের সময়টা ওই অঞ্চলেই ঘোরাঘুরি করে কাটিয়ে দিই। বন্যা মাঝে-মাঝে চলে আসে। দাঁড়িয়ে থাকে পার্কের কোণে। এ-পাড়ার কোনও রেস্তোরাঁয় ঢোকার সাধ্য আমার নেই। প্রথম মাসের মাইনে পেলে একবার বন্যাকে খুব বড় কোনও জায়গায় খাওয়াব ঠিক করে রেখেছি। তা ছাড়া, ঘাটশিলায় যাওয়ার জন্য পয়সা জমাতে হবে।

আমরা দুজনে চিনেবাদাম খেতে-খেতে হাঁটি। কখনও চলে যাই পুরোনো কবরখানায়। কখনও ময়দানে। ঘোর বর্ষা এসে গেছে। বন্যার প্রিয় ঋতু। বৃষ্টির মধ্যে বন্যা ইচ্ছে করে ভেজে।

পুরোপুরি ভিজলেও আমাদের অসুখ করে না। কয়েকবার হাঁচি হয়। হয়তো জ্বর হয়। কিন্তু এগুলোকে মোটেই অসুখ বলা যায় না।

পার্ক স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে, চৌরঙ্গি পার হয়ে আমরা সবে ময়দানের দিকে যাচ্ছি, এমনসময় ঘ্যাঁচ করে একটা ট্যাক্সি আমাদের থেকে একটু দূরে থামল। তারপর পিছিয়ে এল।

সেই ট্যাক্সি থেকে নেমে এলেন তাপস হালদার। রাগে তাঁর মুখখানা গনগন করছে। এই প্রথম। বন্যার বদলে তিনি সরাসরি আমার দিকে তাকালেন।

ধমকের সুরে বললেন, এসব কী হচ্ছে? তুমি মেয়েটাকে বৃষ্টিতে ভেজাচ্ছ? আর দু-মাস বাদে ওর পরীক্ষা!

আজ বৃষ্টি পড়ছে টিপিটিপি। একে ঠিক বৃষ্টি ভেজা বলে না। মাথাও ভেজেনি। আমাদের কারুর কাছেই অবশ্য ছাতা নেই।

আমি বললাম, দু-মাস তো অনেক দেরি!

তাপস হালদার রীতিমতন চেঁচিয়ে বললেন, অনেক দেরি মানে?

একটা দিন নষ্ট হওয়া মানেই অনেক ক্ষতি। যদি শক্ত কোনও অসুখ হয় পরীক্ষা দিতেই পারবে না!

বন্যা বলল, না, স্যার, আমার সহজে অসুখ হয় না।

বন্যার কথা গ্রাহ্য না করে তিনি আমাকে আবার বললেন, একটা ব্রিলিয়ান্ট মেয়ের কেরিয়ার তুমি নষ্ট করে দিতে চাইছ? এটা আমি কিছুতেই টলারেট করব না। আমি একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। ওকে এখন খুব সাবধানে থাকতে হবে।

বন্যা বলল, আমি একটু বাদেই বাড়ি ফিরে যেতাম, স্যার।

তাপস হালদার বললেন, এক্ষুনি চলো। এই ট্যাক্সিতে। আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।

আমি বাসেই চলে যাব স্যার। আপনি কেন…

কোনও কথা শুনতে চাই না। তুমি চলো আমার সঙ্গে।

বন্যা আমার দিকে তাকিয়ে ভুরুর সামান্য ইঙ্গিত করল। এটা আমাদের একটা নিজস্ব কোড। এখন আপত্তি করা চলবে না। আমিও একটু ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানালাম।

তাপস হালদার বন্যার হাত ধরতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই বন্যা এগিয়ে গেল ট্যাক্সিটার দিকে। ভেতরে গিয়ে বসল।

তাপস হালদার আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, রাস্কেল!

তাপস হালদার, সুপুরুষ, সুপ্রতিষ্ঠিত। বন্যাকে তিনি নিজের মতো গড়তে চাইছেন। মাঝখান থেকে আমার মতন একটা চ্যাংড়া ছেলে বন্যার অনেকটা সময় হরণ করে নিচ্ছে, এটা তিনি। কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না। তিনি সর্বক্ষণ বন্যাকে চান।

তাপস হালদার বিবাহিত, দুটি ছেলেমেয়ে আছে, সেসব কথা তিনি গোপন করেননি। কিন্তু তাতে কি হয়েছে! বউ থাকে বাড়িতে, সংসার সামলায়। বউয়ের কথা মনে রাখবার তো দরকার নেই। তিনি বন্যাকে চান, এটাই বড় কথা।

বন্যা এক কথায় তাঁর সঙ্গে ট্যাক্সিতে যেতে রাজি হওয়ায় তাঁর আহত অহংকারে খানিকটা প্রলেপ পড়ল। আমাকে তিনি একটা গালাগালিও দিয়ে ফেললেন। ওঁর ধারণা, ওঁর বিরুদ্ধে আমার কিছুই করার ক্ষমতা নেই।

কিন্তু তাপস হালদারকে আমি এতটা সন্তুষ্ট হতে দেব কেন? বন্যাকে আমি কথা দিয়েছি, এই কমাসের মধ্যে কোনওক্রমেই আমি ওঁর সঙ্গে ঝগড়া করব না। তবে, বন্যার গায়ে উনি হাত ছোঁয়াতে পারবেন না। যদি কখনও বন্যাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করেন, তাহলে আমি তুলকালাম কাণ্ড বাধাব।

উনি বন্যার গায়ে হাত দেননি, আমাকে একটা গালাগাল দিয়েছেন। সামান্য একটু শোধ নিতেই হবে।

ট্যাক্সিটা ছাড়বার আগে আমি দৌড়ে উলটোদিকের জানলার কাছে গিয়ে বন্যাকে বললাম, কাল আবার এসো! ঠিক সোওয়া পাঁচটায়।

তাপস হালদার ক্রুদ্ধ কণ্ঠে ড্রাইভারকে বললেন, চলো, চলো, জলদি!

কলকাতার নানা মহলে রটতে শুরু করেছে যে তাপস হালদার বন্যা নামে একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছেন, প্রায় সর্বক্ষণ তার সঙ্গে থাকেন।

কফি হাউসে প্রায়ই কেউ-কেউ আমার সামনে এই ইঙ্গিত করে।

কেউ স্পষ্ট বলে ফেলে। আমি গায় মাখি না। বন্যার সঙ্গে আমার গোপন বোঝাপড়ার কথা তো জানে না এরা কেউ!

কেউ-কেউ নানান রসসিক্ত কাহিনি বানায়। জানি, সেসব মিথ্যে। বন্যা কখনও আমার কাছে মিথ্যে কথা বলবে না। প্রেম শব্দটা শুনলেই অধিকাংশ মানুষের মনে আদিরস উথলে ওঠে।

তাপস হালদার আমার নামে নালিশ জানালেন বন্যার কাকার কাছে।

তাতে কোনও ক্ষতি হল না। নরেকশকাকা একদিন ডেকে পাঠালেন আমাকে। খুব ভালো ব্যবহার করলেন।

তারপর বললেন, জানো, সুনীল, তোমাদের বয়েসি ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্বটা এখনও অনেকে মেনে নিতে পারে না। কিন্তু আমি মনে করি, এটা স্বাস্থ্যকর ব্যাপার। মিশবে না কেন, নিশ্চয়ই মিশবে। ছেলেরা মেয়েরা দূরে থাকলেই বরং তাদের মনে নানারকম খারাপ চিন্তা জাগে। বন্যাকে তুমি এতদিন ধরে চেনো, হঠাৎ মেলামেশা বন্ধ করবে কেন? না, না, আমি এসব সাপোর্ট করি না। তবে, পরীক্ষার আগে পর্যন্ত কয়েকটা মাস একটু আড়ালে থেকো। তাপস বন্যাকে ফার্স্ট। করাবার জন্য একেবারে খেপে গেছে। একটুও সময় নষ্ট করতে দিতে চায় না। দেখা যাক না, ও কতটা করতে পারে। বন্যা ফার্স্ট হলে তো তুমিও খুশি হবে। তাই না?

আমি জিগ্যেস করলাম, নরেশকাকা, আমিরাত নটার পর এসে একবার বন্যার সঙ্গে একটু গল্প করে যেতে পারি? সারাক্ষণ পড়াশুনো করা কি ভালো?

নরেশকাকা বললেন, মোটেই ভালো নয়। হ্যাঁ, এসো, তুমি একবার এসে আধ ঘণ্টা, পঁয়তাল্লিশ মিনিট গল্প করে যেও। তাতে বন্যার ভালোই হবে। হ্যাঁ, এসো, নিশ্চয়ই এসো! তারপর নতুন কী কবিতা লিখলে বলো!

পরীক্ষার দেড় মাস আগে তাপস হালদার একটু অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। ভদ্দরলোক আর মাথার ঠিক রাখতে পারছেন না।

সেদিন ইউনিক টিউটোরিয়াল হোমের প্রতিষ্ঠা দিবস। ওই দিনটায় ওখানে খাওয়াদাওয়া হয়। বন্যা এখন সেখানে পড়তে যায় না অবশ্য, তবু তারও নেমন্তন্ন।

সেখানেই প্রথম তাপস হালদারের স্ত্রীর সঙ্গে বন্যার আলাপ হল। তিনিও লেখাপড়া জানা মহিলা। এম.এ. পড়ার সময় তাপস হালদারের সঙ্গে প্রেম, প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে বিয়ে। দুটি ছেলেমেয়েকে। মানুষ করবার জন্য তাঁকে বাড়িতেই থাকতে হয়। ইউনিক টিউটোরিয়ালের খাওয়াদাওয়ার দিনে তাঁকে তো আসতেই হবে।

একটা খালি ঘরে বন্যাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে তিনি বললেন, ও, তুমিই তাহলে সেই বন্যা? তোমার নাম আমার ছেলেমেয়েরাও এখন জানে। যেখানে থাকি, সেই পাড়ার লোকেরা ডেকে-ডেকে আমাকে বলে যায়, বন্যা নামে একটি সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে আমার স্বামীকে কাল গঙ্গার ধারে, আজ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দেখা গেছে। বন্যাবিবর্ণ মুখে বলল, না, না, এসব মিথ্যে কথা!

সেই মহিলা বললেন, কিছুটা তো মিথ্যে হবেই, তা কি আমি বুঝি না? তোমাকে উনি বাড়িতে গিয়ে পড়ান?

বন্যা মাথা হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ, উনি আমাকে…

এই সময় তাপস হালদার সেই ঘরে ঢুকে পড়লেন।

তাঁর স্ত্রী তীক্ষ্ণভাবে হেসে বললেন, উনি শুধু মেয়েদের মধ্যেই প্রতিভার সন্ধান পান। কোনও ছেলেকে আজ অবধি আলাদা পড়াননি।

তোমাকে নিয়ে এই তৃতীয়। তোমাকে আমি কিন্তু সাবধান করে দিচ্ছি ভাই, এর আগে একটি মেয়ে…

তাপস হালদার হুঙ্কার দিয়ে বললেন, চুপ!

ভদ্রমহিলা বললেন, কেন চুপ করব! এ একটা সরল, ভালো মেয়ে, তাকে আমি সাহায্য করব না?

তাপস হালদার ছুটে এসে স্ত্রীকে সজোরে এক থাপ্পড় কষালেন!

বন্যার মুখে এই ঘটনা শোনার পর আমি জিগ্যেস করলাম, এর পরেও তুমি ওঁর কাছে পড়তে চাও?

বন্যার মুখখানা ম্লান। সে এক গভীর সঙ্কটে পড়েছে।

সে বলল, আমার এত খারাপ লেগেছিল, কান্না পেয়ে গেল, আমি ছুটে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। স্যারের এরকম চেহারা আমি কখনও আগে দেখিনি!

এত রাগ যে বউকে ধরে মারবে? ওর বউ কোনও গোপন কথা ফাঁস করে দিচ্ছিল!

উনি এরপর আমার কাকাকে এসে কী বলেছেন জানো? ওঁর বউয়ের পাগলামির অসুখ আছে। ভদ্রমহিলা বানিয়ে বানিয়ে উদ্ভট কথা বলেন।

বউ পাগল, না স্বামীটাই পাগল হয়ে গেছে?

কাকাকে উনি কাগজপত্র দেখিয়েছেন, ওঁর স্ত্রীর পাগলামির চিকিৎসা হয়েছে। সত্যিই। আর উনি নাকি আগে কখনও কোনও মেয়েকে আলাদা করে পড়াননি।

সেটা খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে।

কাকা খোঁজ নেবেন বলেছেন। তার আগে, কাকা বলছেন, এই স্টেজে আমার অঙ্কের পড়া বাদ দেওয়া ঠিক হবে না। তাতে আমার খুব ক্ষতি হবে। সব গুলিয়ে যাবে।

কাকা ওঁর কাছেই পড়তে বলছেন?

হ্যাঁ, মাত্র তো দেড় মাস। আমিও ভয় পাচ্ছি।

তোমাকে কি অঙ্কে ফার্স্ট হতেই হবে, বন্যা? না হলে কী হয়? আমিও যেন চ্যালেঞ্জটা বিশ্বাস করে ফেলেছি। ফার্স্ট হতে কেমন লাগে, সেটা একবার দেখতে ইচ্ছে করছে।

এর দুদিন বাদেই জানা গেল যে তাপস হালদার তাঁর স্ত্রীকে ডিভোর্সের নোটিশ দিয়েছেন। বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন তিনি। টিউটোরিয়ালের তিনতলার ঘরে একা থাকবেন।

অর্থাৎ তাঁর আর পিছুটান রইল না। বিবাহিত মাস্টার ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম করলে লোকে তাকে অপবাদ দেয়। কিন্তু অচিরেই তিনি মুক্ত হচ্ছেন সম্পূর্ণভাবে। আর বাধা থাকবে না।

যে-কোনও উপায়ে তিনি বন্যাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চান।

এরপর কেটে গেছে উনিশ বছর।

তাপস হালদার এখনও আমার ওপর রাগ আর ঘৃণা পুষে রেখেছেন? অথচ ওর কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।

এতগুলো বছরের মধ্যে কয়েকবার ওঁর কথা শুনেছি অবশ্য।

একসময় প্রবন্ধ লিখতেন, পরে নাটক লিখতে শুরু করেন। খুব একটা উচ্চাঙ্গের কিছু লেখেননি অবশ্য। কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, তার থেকে দুটো সিনেমাতেও জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু সাহিত্যের মূল স্রোতে তিনি স্থান পাননি। এখন যাত্রার জন্য লিখছেন।

অর্থাৎ টাকা বানানোর নেশাটা তাঁর আজও রয়েছে। টিউটোরিয়ালটা একেবারে উঠে যায়নি, টিমটিম করে চলে। টিউটোরিয়ালের ব্যাবসা এমনিতেই এখন মন্দা। উনি বিয়ে করেছেন আবার।

এই দীর্ঘ সময় আমাদের দুজনকেই সম্পূর্ণ দুদিকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। এর মধ্যে ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কখনও।

বিয়ে বাড়িতে সেদিন যোগাযোগটা সত্যি অদ্ভুত। শ্রেয়া দাশগুপ্ত নামে যে মহিলাটিকে দেখেছিলাম, তিনিই তাপস হালদারের প্রথম স্ত্রী। আমি আগে ওঁকে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অথচ উনি আমার বিষয়ে অনেক খবর রাখেন। ওঁর চেহারা সম্পর্কে আমার অন্যরকম ধারণা ছিল, কিন্তু এখন চুল-ছাঁটা, ভুরু কামানো এক অতি আধুনিক মহিলা তিনি। আর বিয়ে করেননি, বিয়ের আগের পদবিটা ব্যবহার করেন।

তাপস হালদারের অমন মেজাজ খারাপ, গোমড়া মুখো অবস্থাটার কারণ বোঝা যায়। একই জায়গায় তিনি শ্রেয়াকে আর আমাকে দেখেছেন। শ্রেয়া তাঁর স্ত্রী ছিলেন, এখন স্ত্রী নন। আর আমি তাঁর প্রেমের প্রতিপক্ষ, তাঁর এককালের প্রেমিকার বন্ধু, কিন্তু আমিও তো আসলে তা নই!

তাপস হালদারের সঙ্গে একবার দেখা করা খুবই দরকার।

ভেবেছিলাম রবির কাছ থেকে ঠিকানা জেনে নেব, তারপর মনে হল টেলিফোন গাইডেই নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। অন্য কারুকে জানাবার দরকার নেই।

সকাল আটটার সময় হাজির হলাম তাপস হালদারের বাড়ির সামনে। এই বয়েসেও আমার বুকটা একটা দুরুদুরু করছে। উনি কি প্রথমেই আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। একটা কিছু কাজের ছুতো দেখাতে হবে।

দরজা খুলে দিল একজন কাজের লোক। ভেতরে নিয়ে বসাল।

একতলার বসবার ঘরটা বেশ পরিচ্ছন্ন। সচ্ছলতার চিহ্নও বেশ স্পষ্ট।

পাজামা ও পাঞ্জাবি পরে, চটি ফটফটিয়ে তাপস হালদার ঘরে ঢুকেই আমাকে দেখে থমকে গেলেন। মুখখানা আড়ষ্ট হয়ে গেল।

আগে তাঁর মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি ছিল না, এত মোটা ফ্রেমের চশমা পরতেন না। মাথার চুলও খুব পাতলা হয়ে গেছে, তাই ওঁকে দেখে আমি চিনতে পারিনি। কিন্তু আমার চেহারারও অনেক বদল হয়েছে, তবু উনি আমাকে চিনতে ভুল করেননি।

এক সময়ে উনি আমার চেয়ে বয়েসে বেশ বড় ছিলেন। অনায়াসে তুমি বলতেন। কিন্তু এখন আমরা যে বয়েসে পৌঁছেছি, তাতে দশ-বারো বছরের তফাতে বিশেষ কিছু আসে যায় না।

আমি নিজের নাম জানিয়ে বললাম, নমস্কার। আপনার কাছে একটা বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি।

তাপস হালদার দাঁড়িয়ে থেকেই ভুরু কুঁচকে বললেন, বলুন!

আমি বললাম, আমার এক বন্ধু ফিলম পরিচালক। সে আপনার একটা নাটক নিয়ে ছবি করতে চায়। তাই একটা খবর নিতে এসেছি।

একথা শুনে নরম হয় না, এরকম লেখক বিরল।

আমার কথাটা একেবারে মিথ্যেও নয়। সত্যিই আমার এক বন্ধু একজন মোটামুটি পরিচিত। চলচ্চিত্র পরিচালক। কমার্শিয়াল ছবি তোলে। সে একটা নতুন কাহিনির খোঁজ করছিল। তাপস হালদারের কাহিনি আমার পরামর্শ শুনে সে অনায়াসে নিতে পারে। ভালোই চলতে পারে।

আমি বললাম, আমি শুধু জানতে এসেছি, আপনার ওই কাহিনিটা এখনও ফ্রি আছে কি না। কারুকে কি দিয়ে দিয়েছেন?

তাপস হালদার বললেন, না। এখনও ফ্রি আছে।

আমি বললাম, ঠিক আছে। তাহলে বাকি কথাবার্তা সেই-ই বলবে। কবে তাকে আসতে বলব। বলুন তো?

রবিবার সকালে। এগারোটার মধ্যে।

এবার আমার ওঠা উচিত। আমার আর কোনও ভূমিকা থাকার কথা নয়। তবু আমি উসখুস করতে লাগলাম কয়েক মুহূর্ত।

তারপর হঠাৎ জিগ্যেস করলাম, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন?

উনি শুকনোভাবে বললেন, হ্যাঁ।

আমি আপনাকে আর একটা কথাও জানাতে এসেছিলাম। বন্যা আমাকে শেষ যে চিঠি লিখেছিল, তাতে আপনার কথা ছিল।

বন্যা?

তাপস হালদার তীব্র চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। তাঁর মুখের রেখা বদলে যাচ্ছে। তীব্রতা কমে যাচ্ছে দৃষ্টির।

খানিকটা অভিমানী কণ্ঠে তিনি জিগ্যেস করলেন, বন্যা? সে আমার কথা লিখেছিল?

আমি বললাম, হ্যাঁ। চিঠিটা আমি নিয়ে এসেছি।

হঠাৎ উঠে গিয়ে ভেতরের দরজার কাছে গিয়ে একবার উঁকি মারলেন। তারপর আবার ফিরে এসে বললেন, সকালবেলা আমার কাছে অনেক লোক আসে। এক্ষুনি সব আসতে শুরু করবে। তিনতলায় আমার একটা ঘর আছে, সেখানে চলুন!

ভেতরের সিঁড়ির কাছে একগাদা ময়লা জামাকাপড় পড়ে আছে। ধোপা বাড়ি যাবে মনে হয়। একটি মেয়ে গলা সাধছে হারমোনিয়ামে।

একজন মহিলা নেমে এলেন ওপর থেকে খুব সম্ভবত তাপস হালদারের দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি আমার দিকে কিছুটা কৌতূহলের চোখে তাকালেও তাপস হালদার তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলেন না।

তিনতলার ঘরটি খুবই সুন্দর। আমি আগেও লক্ষ্য করেছি, যারা সঠিক অর্থে লেখক নয়, তাদের অনেকেরই ঘর ঠিক লেখকের ঘরের মতন সাজানো থাকে। তিন দিকের রাক ভরতি বই। একটা জানলার ধারে টেবিল। পাশে একটা দারুণ টেবিল ল্যাম্প।

অনেকগুলি দামি-দামি কলম। সুদৃশ্য আশট্রে, পাশে চার-পাঁচ প্যাকেট সিগারেট।

একটা গদিওয়ালা চেয়ার দেখিয়ে তিনি বললেন, বসুন, আমার সকালের চা খাওয়া হয়নি। চা নিয়ে আসছি।

দরজাটা ভেজিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

বন্যার চিঠির কথা বললে একটা কিছু প্রতিক্রিয়া হবে আমি আশা করেছিলাম, কিন্তু এতটা হবে আমি বুঝিনি।

চা বোধহয় তৈরিই হচ্ছিল, তাপস হালদার একটু বাদেই ফিরে এলেন। নিজে একটা ট্রে নিয়ে এসেছেন, তাতে এক পট চা ও দুটো কাপ। কিছু বিস্কুট।

কাপে চা ঢালতে-ঢালতে তিনি বললেন, আপনাকে দেখে অনেকদিন পর বন্যার কথা মনে। পড়ল। তারপর আপনি নিজেই বন্যার কথা বললেন। সত্যি সে চিঠিতে আমার কথা লিখেছিল?

আমি বুক পকেট থেকে চিঠিটা বার করলাম। সাড়ে সতেরো বছর আগেকার। মলিন হয়ে গেছে কাগজ। এমনভাবে চার ভাঁজ পড়েছে যে সেখানকার কথাগুলো পড়া যায় না।

আমি চিঠিটা উলটে শুধু তলার দিকটা দেখালাম। আঙ্গুল দিয়ে নির্দেশ করে দিলাম জায়গাটা।

অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। উনি আমার দারুণ উপকার করেছেন। দেশে ফিরলে ওঁর সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা করব।

তিনটি মাত্র বাক্য। তাপস হালদার তাই-ই যেন পড়লেন বেশ কয়েকবার। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমি ওর উপকার করিনি তো! আসলে ওর ক্ষতি করেছি!

আমি চুপ করে রইলাম।

উনি আবার বললেন, আমি অত জেদ ধরে বন্যাকে না পড়ালে ও অঙ্কে অত ভালো রেজাল্ট করতে পারত না। তাহলে কি বিদেশে পড়াশুনো করতে যেতে পারত? বরং এদেশে থাকলে…

বন্যার কাকা আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্র বন্যাকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনে। সেখানে ওঁর শালা বিরাট চাকরি করেন। তিনি বন্যাকে স্পনশর করেছিলেন।

বিলেত যাওয়ার প্রস্তাবটা তখন এমনই লোভনীয় ছিল যে প্রত্যাখ্যান করা যায় না। বন্যা তবু আমাকে জিগ্যেস করেছিল, আমি কী করব বলো তো? যাব? আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।

আমি কী করে বলব যে, না, যেও না!

আমি নিজে এরকম একটা সুযোগ পেলে লাফিয়ে উঠতাম না।

প্রস্তাবটা এমনই আকস্মিক যে বেশি বিবেচনারও সময় পেলাম না। আমি ঘাটশিলায় যাওয়ার পরিকল্পনা সব করে ফেলেছিলাম। বন্যা যাবে তার মাকে নিয়ে। আমি তখন সুবর্ণরেখায় বন্যাকে সাঁতার শেখাবার কল্পনায় মশগুল।

কিন্তু লন্ডন যেতে হবে না, সুবর্ণরেখার তীরে চলো, একথা কোনও বাঙালির ছেলেই বোধহয় বলতে পারে না। আমি বললাম, কেন যাবে না, নিশ্চয়ই যাবে। এরকম সুযোগ কেউ ছাড়ে।

তাপস হালদার এই খবর শুনে খেপে উঠেছিলেন। তিনি প্রতিবাদ জানালেন বন্যার কাছে। তিনি বলেছিলেন, বন্যা, খুব ভালো রেজাল্ট করবেই। এখানেই এম এস সি পড়া উচিত তার। তারপর সে বিলেতে পি এইচ ডি করতে যদি যেতে চায় তো যাবে, এখনই যাওয়ার কী দরকার!

শেষপর্যন্ত মরিয়া হয়ে তিনি বন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব জানালেন। বন্যার কাকা এটা আগেই অনুমান করেছিলেন, তিনি পাত্তা দিলেন না। বন্যা লন্ডনে উড়ে চলে গেল।

প্রথম-প্রথম সপ্তাহেদু-খানা করে চিঠি লিখতাম আমরা। ডাকটিকিটের জন্য যাতে আমি কার্পণ্য না করি, সেইজন্য বন্যা মাঝে-মাঝে খামের মধ্যে পাঁচ পাউন্ড, দশ পাউন্ডের নোট ভরে পাঠিয়ে দিত।

তাপস হালদারকে সে কোনও চিঠি লেখেনি বোধহয় একটাও। তাপস হালদার আহত বাঘের মতন গজরাতে লাগলেন। রেজাল্ট বেরুবার পর দেখা গেল, বন্যা সত্যিই অঙ্কে ফার্স্ট হয়েছে, রেকর্ড নম্বর পেয়ে। তবু তাপস হালদার কোনও কৃতিত্ব পেলেন না। বন্যাকে বিয়ে করতে চেয়ে নিজেকে যেন অনেকটা ছোট করে ফেললেন। তাপস হালদারের নাম কেউ উল্লেখও করল না।

তাপস হালদার একদিন বন্যার কাকার বাড়িতে গিয়ে ঝগড়া করে এলেন চেঁচিয়ে-মেচিয়ে। অনেকের ধারণা হল, সত্যি লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

আবার শোনা গেল, তাপস হালদার নিজেই ইংল্যান্ডে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। পাসপোর্ট অফিসেও হইচই করে এলেন একদিন। তারপর তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন, মৃদু ধরনের সেরিব্রাল অ্যাটাক। সুস্থ হয়ে উঠলেন মাসচারেক পরে। তারপর থেকে তিনি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত মানুষ। একেবারে শান্ত। আর বন্যা সম্পর্কে কোনও আগ্রহ প্রকাশ করেননি কখনও।

চিঠিটা আমাকে ফেরত দেওয়ার পর তাপস হালদার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ওর কী হয়েছিল ঠিক করে বলুন তো? আপনি নিশ্চয়ই জানেন। কী হয়েছিল? আত্মহত্যা?

আমি বললাম, না। একটা অত্যন্ত সাধারণ দুর্ঘটনা।

জলে ডুবে গিয়েছিল, এটা সত্যি?

হ্যাঁ। একটা সুইমিং পুলে সাঁতার শিখতে গিয়েছিল।

এই কথাটা উচ্চারণ করতে গেলেই একতাল পরেও আমার গলার কাছে বাষ্প আটকে যায়। সুবর্ণরেখা নদীতে বন্যাকে সাঁতার শেখাবার কথা ছিল আমার। সত্যি যদি সাঁতারটা শিখিয়ে দিতাম, তাহলে এমন অকারণে ওর প্রাণ যেত না। জল এত ভালোবাসত বন্যা, সেইজন্যই ওকে। টেনে নিল!

তাপস হালদার চাপা গলায় বললেন, আমি কি ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী? আমি ওকে অনেক বিরক্ত করেছি, আমি লন্ডনে গিয়েও ওকে জ্বালাতন করব ঠিক করেছিলাম।

আমি বললাম, না, না, নিশ্চয়ই তা নয়। ও শেষ চিঠিতে আপনার কথা লিখেছে, খুব শ্রদ্ধার সঙ্গেই তো লিখেছে।

চিঠিটা আবার পড়লেন তাপস হালদার। বড় শ্বাস ফেলে বললেন, তা ঠিক। ও কখনও আমাকে চিঠি লেখেনি। আপনার চিঠিতে আমার সম্বন্ধে লিখেছে। আচ্ছা, আপনি এতদিন পর আমাকে

এই চিঠিটা দেখাতে এলেন কেন?

আমি কোনও উত্তর দিলাম না। মুখে বলা যায় না। সেদিন বিয়ে বাড়িতে আমার প্রতি ওঁর তীব্র রাগের ভাব দেখেই আমার মনে হয়েছিল, বন্যার প্রতি ওঁর এখনও দারুণ ভালোবাসা রয়ে। গেছে। সেই ভালোবাসার মূল্য আর কারুর কাছে না থাকুক, আমার কাছে থাকবেই।

এতগুলো বছর কেটে গেছে, কে আর মনে রেখেছে বন্যাকে? এখন আর কেউ তার কথা বলে না। তাপস হালদারের রাগ, ক্ষোভ, অভিমানের মধ্যে বন্যা এখনও বেঁচে আছে। তাপস হালদারকে এখন আমার খুব আপনজন মনে হচ্ছে। তাপস হালদার আমার দু-হাত জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে রইলেন অনেকক্ষণ।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments