Friday, March 29, 2024
Homeবাণী-কথাদুই বন্ধু - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

দুই বন্ধু – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

দুই বন্ধু - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নমাসে ছমাসে সত্যচরণ একবার করে আসেন বন্ধু সদাশিবের সঙ্গে দেখা করতে। দুজনেরই বয়েস এখন আশি ছুঁই-ছুঁই। সদাশিবের তুলনায় সত্যচরণ এখনও বেশ শক্তসমর্থ আছেন, দিব্যি একাই হেঁটে চলে আসেন নারকেলডাঙা থেকে ভবানীপুর। ভিড়ের ট্রামে বাসে চড়তে-নামতেই বরং তার অসুবিধে হয়। হাঁটার অভ্যেসটা তাঁর বরাবরের।

সদাশিব নিজস্ব গাড়ি চালিয়েছেন যৌবন বয়েসে থেকেই। একসময় তাঁর স্টুডি-বেকার গাড়ি ছিল। হাঁটা দুরের কথা, তিনি ট্রাম-বাসেও চেপেছেন জীবনে খুবই কম। হয়তো সেই কারণেই তাঁর দুটো হাঁটুই গেছে, এখন সিঁড়ি দিয়ে একটুখানি উঠতেই প্রবল কষ্ট হয়। সেইজন্য তিনি তিনতলাতেই বসে থাকেন প্রায় সর্বক্ষণ।

সত্যচরণের রোগা, লম্বা চেহারা। হাতে সবসময় একটা ছাতা থাকে, সেই ছাতাটাই লাঠির কাজ করে। তিনি অবশ্য ধুতির বদলে প্যান্ট-শার্ট পছন্দ করেন, বরাবর একটা বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করেছেন বলেই। এখন অবশ্য তাঁর বড় ছেলেরই প্রায় রিটায়ার করার বয়স হয়ে গেল!

সন্ধের সময় তিনি ভবানীপুরে এসে বন্ধুর বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাঁক দেন, সদাশিব! সদাশিব!

এ বাড়ির গেটে কলিং বেল আছে, কিন্তু সেকথা মনে থাকে না সত্যচরণের। বরাবর এই রকম চেঁচিয়ে ডাকাই অভ্যেস।

সদাশিবের বাড়িটা বেশ বড়। নাতি-নাতনি, ভাগ্নে-ভাগ্নি নিয়ে প্রায় কুড়ি-বাইশজনের সংসার। প্রেসের ব্যাবসা করে সদাশিব প্রচুর সম্পত্তি করেছেন। সে ব্যাবসা এখনও ভালোই চলছে। দুই ছেলে সেই ব্যাবসা দেখে, কিন্তু এই বয়েসেও সদাশিব সব কিছুর কর্তৃত্ব ছেড়ে দেননি। নিজে আর প্রেসে যেতে পারেন না, তবু ঘরে বসেই টেলিফোনে সব খবর নেন, নির্দেশ পাঠান। এখনও পাঁচ হাজার টাকার বেশি অঙ্কের সই করার অধিকার শুধু তাঁর একার।

সত্যচরণকে এ-বাড়ির সবাই চেনে, সবাই খাতির করে। তিনি এ-বাড়ির কর্তাবাবুর বন্ধু। একমাত্র প্রাণের বন্ধু বলা যেতে পারে। সদাশিবের সঙ্গে সত্যচরণের কোনও স্বার্থের সম্পর্ক নেই। ব্যাবসার সম্পর্ক নেই। কোনওদিন তিনি সদাশিবের প্রেস থেকে বিনা পয়সায় নিজের নামে একটা প্যাডও ছাপাননি। বরং যেদিনই তিনি এ-বাড়িতে আসেন, কুড়ি-পঁচিশ টাকার একটা মিষ্টির হাঁড়ি আনেন বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্য।

সন্ধের পর সদাশিব বেশ কিছুক্ষণ পুজো-আচ্চায় কাটান। তিনতলাতেই ঠাকুরের ঘর। উদাত্ত কণ্ঠে স্তোত্রপাঠ করেন সদাশিব। এক-এক সময় তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়ায়। তাঁদের পরিবার আগে ছিল শাক্ত, কিন্তু সদাশিব বৈষ্ণব হয়েছেন অনেকটা। তিনি মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর শোওয়ার ঘরে মস্ত বড় একটা কৃষ্ণের ছবি।

এই বয়েসেও অবশ্য সত্যচরণের ধর্মে মতি হয়নি! তাঁর পুজো আচ্চার বালাই নেই। বাড়ি থেকে না বেরোলে তিনি সন্ধের সময় থেকে একমনে টি ভি দেখেন, একেবারে শেষ পর্যন্ত!

দুই বন্ধুর স্বভাবে কিংবা জীবনযাত্রায় প্রায় কোনও মিলই নেই। তাঁদের আর্থিক অবস্থাও একরকম নয়। তবুপ্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে দুজনের বন্ধুত্ব টিকে আছে, কখনও বড় রকমের মনোমালিন্য হয়নি। বেশ কিছুদিন পরস্পরকে না দেখলে দুজনেই ছটফট করেন।

তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতেও সত্যচরণ ডাকেন, সদাশিব! সদাশিব!

বন্ধুর ডাক শুনলেই সদাশিব পুজোর ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। পুজো শেষ হোক বা না হোক। খুশিতে ঝলমল করে তাঁর মুখ। তিনি হাত বাড়িয়ে বলে ওঠেন, এসো সতু, এসো! এবার অনেকদিন পর এলে!

তারপর তিনি বন্ধুকে নিয়ে শোওয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন!

দুই বৃদ্ধের এমন কী গোপন কথা থাকতে পারে, যা দরজা বন্ধ করে বলতে হবে? সদাশিবের ছেলেমেয়েদের ধারণা, ওঁরা দুজনেই ওইসময় মদ খান!

তা এই বয়েসে এত ঢাক-ঢাক গুড়গুড়েরই বা দরকার কী? সদাশিব এ-বাড়ির বড় কত্তা, তিনি মদ খেলেই বা কে আপত্তি করবে? তাঁর স্ত্রীও বেঁচে নেই। দুই ছেলেই নিয়মিত মদ্যপান করে। আজকাল বড়-বড় কোম্পানির অর্ডার আদায় করতে গেলে পার্টি দিতে হয়। আর পার্টিতে কি মদ ছাড়া চলে?

সদাশিবের ঘরের আলমারিতে সত্যিই থাকে রকমারি মদের বোতল। কিন্তু তিনি মাসের-পর-মাস মদ ছুঁয়েও দেখেন না। একমাত্র সত্যচরণ এলেই দুটি গেলাস নিয়ে বসেন। সে সময় তাঁর ঘরে অন্য কারুর ঢোকা নিষেধ।

সত্যচরণ জীবনে কখনও দু-পেগের বেশি মদ্যপান করেননি এক বৈঠকে। নেশা করার প্রশ্নই ওঠেনা। তিনি আবার তো হেঁটেই ফেরেন নারকেলডাঙায়। কোনওদিন তাঁকে কেউ বেচাল হতে দেখেনি।

এতদূর থেকে আসেন তিনি, সদাশিবও তাঁকে দেখলে যথার্থ খুশি হন, তবু দুই বন্ধুর গল্প করার ধরনটা অদ্ভুত! প্রথমে পারিবারিক কুশল প্রশ্ন, তারপর দুজনের শারীরিক খবরাখবর তো বিনিময় হবেই। তাও বেশ সংক্ষেপে ও মৃদু গলায় তারপর দুজনেই চুপ। এই বয়েসে বোধহয় সামনাসামনি বসলেই অনেক কিছু বোঝাবুঝি হয়ে যায়, মুখে আর কিছু বলার দরকার হয় না।

অনেকক্ষণ পর, দ্বিতীয় পেগ প্রায় অর্ধেক শেষ করার পর সদাশিব হঠাৎ বলে ওঠেন, তাহলে ওটা কুকুরই ছিল, কী বলো, সতু?

সত্যচরণ মাথা দোলাতে-দোলাতে উত্তর দিলেন, না হে, অত ছোট প্রাণী তো নয়! কুকুর হবে কী করে?

সদাশিব আরও জোর দিয়ে বলেন, অনেক বড় সাইজের কুকুরও হয়। মনে করো, ওটা অ্যালসেশিয়ান!

সত্যচরণ বলেন, ওই ধাদ্ধারা গোবিন্দপুরে কে অ্যালসেশিয়ান পুষবে? অত রাতে লোকের পোষা দামি কুকুর রাস্তায় ছাড়া থাকবেই বা কেন?

সদাশিব ব্যগ্রভাবে বললেন, তবে কি গাধা? হ্যাঁ, গাধাই হবে নিশ্চয়। ওদিকে ধোপাটোপারা থাকে।

সত্যচরণ আর কিছু না বলে মুকচি-মুচকি হাসেন। এবার তাঁর ওঠবার সময় হয়েছে। বছরের পর-বছর ধরে দুই বন্ধুর প্রায় এই একই ধরনের আড্ডা চলে আসছে। শেষের দিকে উত্তেজিতভাবে সদাশিব বন্ধুর হাত চেপে ধরে বলতে থাকেন, আমি বলছি, ওটা গরু ছিল না। গাধা কিংবা কুকুর? এমনকী ছাগলও হতে পারে…

সদাশিব ব্যাকুলভাবে বলেন, বিশ্বাস করো, সতু, আমি গোহত্যা করিনি! আমি নিজের চোখে দেখেছি…

প্রায় পঁচিশ বছর আগেকার একটা ঘটনা। তখন সদাশিবের একটা বাগানবাড়ি ছিল মধ্যমগ্রামে। সেই বাড়িটা এখনও তাঁর আছে, তবে বাগান আর নেই, ভাড়া দেওয়া হয়ে গেছে।

মাঝে-মাঝে শনিবার সন্ধেতে সদাশিব বন্ধুবান্ধব নিয়ে সেই বাগান বাড়িতে যেতেন ফুর্তি করতে। মেয়েঘটিত দোষ তাঁর ছিল না, গান-বাজনার খুব শখ ছিল। ওইখানে মদ্যপানের সঙ্গে গান বাজনারই চর্চা হত।

একবার বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। তা প্রায় সাড়ে এগারোটা হবে। সত্যচরণকে পাশে বসিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে ফিরছিলেন সদাশিব। ঈষৎ নেশা হলেও তাঁর হাতে স্টিয়ারিং ঠিক ছিল। কথা বলছিলেন একটু বেশি, সিগারেট টানছিলেন ঘনঘন। গঙ্গানগরের মোড়টার কাছে গাড়ি ঘোরাতে যাবেন, এমনসময় আচম্বিতে সাদা-সাদা মতন কী যেন একটা দৌড়ে এল রাস্তার মাঝখানে। সদাশিব ব্রেক কষতে একটু দেরি করে ফেললেন, অত ভারী গাড়িতে মড়মড় করে হাড় ভাঙার শব্দ হল।

সদাশিব হতবুদ্ধি হয়ে গিয়ে বলেছিলেন, কী হল, সতু, কী হল, কী চাপা দিলাম?

একটু দুরেই মাঠের মধ্যে যাত্রাপালা হচ্ছে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে মঞ্চটা, নাকি-নাকি গলায় পুরুষেরা ফিমেল পার্ট করছে, তখনও যাত্রায় আসল মেয়েদের নেওয়াটা চল হয়নি। কয়েক হাজার লোক মুগ্ধ হয়ে শুনছে সেই যাত্রা, তারা ব্রেক কষার কর্কশ শব্দটা শুনতে পেয়েছে।

এই বুঝি তেড়ে-তেড়ে আসবে দলে-দলে মানুষ!

সামান্য একটা ছাগল চাপা দিলেও এখন লোকে একশো-দুশো টাকা দাবি করে। পাড়ার কুকুর মরলেও তাদের শোক উথলে ওঠে।

সত্যচরণ বন্ধুকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছিলেন, থেমে রইলি কেন? লোকের হাতে মার খেয়ে মরবি যে! শিগগির স্টার্ট দে!

সদাশিব তবু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলেছিলেন, কী চাপা দিলাম?

সত্যচরণ ব্যস্ত হয়ে বললেন, ওটা একটু গরু! শিগগির চল!

যাত্রার শ্রোতারা রাস্তায় এসে পৌঁছবার আগেই সদাশিব গাড়ি স্টার্ট দিলেন আবার, হুশ করে। বেরিয়ে গেলেন। কয়েকজন লোক ইট ছুঁড়ে মেরেছিল, তাও গাড়িতে লাগেনি। বিপদ হল না আর কিছু। কেউ কিছু জানতেও পারল না।

তারপর থেকেই সদাশিব নিজে গাড়ি চালানো ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়িতে এখন দুজন ড্রাইভার। মধ্যমগ্রামের সেই বাড়িতেও আর কখনও ফুর্তি করতে যাওয়া হয়নি। সদাশিব বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি একটা গরুকে চাপা দিয়েছিলেন। এমন কিছু নয়।

বছরকয়েক পরে তাঁর মনে খটকা লাগল। গো-হত্যা তো মহাপাপ। তাঁর প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। কিন্তু সত্যই কি সেটা গরু ছিল। সত্যচরণের মুখের কথা ছাড়া আর কী প্রমাণ আছে? গরু চাপা দিলেও পাবলিক রেগে যায়, গাড়িতে তাড়া করে। সেইজন্যই কি সত্যচরণ বলেছিলেন গরুর কথা? কিন্তু একটা ধোপার গাধাকে যদি চাপা দেওয়া হয়, সে রাগ করে তেড়ে আসবে না? কিংবা যদি কারও বাড়ির পোষা কুকুর হয়? অনেক সময় পাড়ার একটা নেড়ি কুত্তাও কিছু মানুষের বড় ন্যাওটা হয়ে যায়, সেই কুকুরটা অপঘাতে মরলেও তারা দুঃখ পায়!

সেই দুর্ঘটনার কথা সদাশিব এ পর্যন্ত আর কারুকে ঘুণাক্ষরেও বলেননি। শুধু সত্যচরণ ছাড়া আর কেউ জানে না। সত্যচরণও নিজে থেকে কখনও তোলেন না সেই প্রসঙ্গ।

গরু চাপা দেওয়ার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করলে তো স্বীকার করা হয়েই গেল যে তিনি গো-হত্যা করেছেন। সারাজীবন সেজন্য কি একটা অনুশোচনা থেকে যাবে না?

কিন্তু কুকুর কিংবা গাধা হলে প্রায়শ্চিত্তও করার প্রশ্ন নেই, অনুশোচনাও হবে না। একমাত্র সত্যাচরণই পারে সেইটা ঠিক করে দিতে!

কিন্তু সত্যচরণ সেই যে একবার গরু বলেছে, আর কিছুতেই ফেরাবে না সেকথা!

সত্যচরণের ছেলের বিয়ের সময় সদাশিব তাঁর বরানগরের একটা ছোট বাড়ি তাঁকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন। সত্যচরণ হেসে বলেছিলেন, পাগল নাকি! তোর বাড়ি নিতে যাব কেন, সদু? ছেলের যদি যোগ্যতা থাকে, সে নিজেই একদিন বাড়ি করবে!

সত্যচরণ চাকুরিজীবী ছিলেন, চিরকাল ভাড়া বাড়িতে কাটিয়ে গেলেন! তাঁর ছেলেও আজও বাড়ি করতে পারেনি।

সত্যচরণের ছোটমেয়ের সঙ্গে সদাশিব নিজের মেজোছেলের বিয়ে দেওয়ার জন্য খুব উঠে পড়ে লেগেছিলেন। দুই পরিবারে জাতেরও অমিল নেই, থাকলেও সদাশিব বোধহয় গ্রাহ্য করতেন না। বন্ধুর চেয়ে বড় জাত আর হতে পারে নাকি? সে বিয়ের ব্যাপারে সত্যচরণ উৎসাহও। দেখাননি, আপত্তিও করেননি। পরে জানা গেল, সেই মেয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধুকে পছন্দ করে বসে আছে। সত্যচরণ মেয়েকে শাসন করে, সেই সম্পর্ক ভেঙে, বন্ধুর ঘরে কন্যা দেওয়ার জন্য কোনও উদ্যোগ নিলেন না, মেয়ে সেই সহপাঠীকে বিয়ে করেই দিল্লি চলে গেল। সত্যচরণের মতিগতি বোঝা বড় শক্ত।

মাঝে-মাঝে সদাশিবের সন্দেহ হয়, তিনি গোহত্যাকারী এই ভেবেই কি সত্যচরণ তাঁর মেয়ের বিয়ে দিতে চাইল না এ-বাড়িতে? তাঁর বন্ধু কি তাঁকে মনে-মনে ঘৃণা করে? কিন্তু সত্যচরণ নিজে থেকেই তো আসেন এই বাড়িতে বন্ধুর খোঁজ নিতে।

এক শীতকালে সন্ধেবেলা সত্যচরণ আবার নারকেলডাঙা থেকে হাঁটতে-হাঁটতে এলেন ভবানীপুরে। এসে দেখলেন সদাশিবের বাড়িতে যেন কীসের হুলুস্থুল। বাড়ির সামনে দু-খানা। অন্য লোকের গাড়ি। কিছু লোক ব্যস্ত হয়ে বাড়ির মধ্যে আসছে-যাচ্ছে। বেঠকখানায় বসে আছে একদঙ্গল লোক।

সত্যচরণ রাস্তা থেকে বন্ধুর নাম ধরে ডাকবার আগেই সদাশিবের মেজো ছেলে আদিত্য হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বলল, এই যে সত্যকাকা, আপনি এসে গেছেন? আপনার বাড়িতে টেলিফোন করেও লাইন পাইনি, একজন লোক পাঠাচ্ছিলুম।

সত্যচরণ বিপদের গন্ধ পেলেন। তবে কি এরই মধ্যে সব শেষ?

আদিত্য বলল, আজ বেলা এগারোটায় বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। কলকাতার সবচেয়ে বড় দুজন স্পেশালিস্টকে ডেকে এনেছি, কিন্তু কী মুশকিল বলুন তো, একজন বলছেন, এই অবস্থায় রিমুভ করাটা খুব রিস্কি। আর-একজন বলছেন, নার্সিং হোমে নিয়ে না গেলে ঠিক চিকিৎসা হবে না। এখন কী করি বলুন তো! এদিকে বাড়ির সবাই আর আত্মীয়জনরাও দু-রকম বলছেন। বড়দা এখানে নেই, সব দায়িত্ব আমার। এখন যাচ্ছি, একজন থার্ড ডাক্তারের ওপিনিয়ান নিতে।

সত্যচরণ জোর করে নিজের মতামত জাহির করেন না। তা ছাড়া, এইসব ব্যাপারে ডাক্তারই। ভালো বুঝবে। তিনি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে জিগ্যেস করলেন, তোমার বাবার সঙ্গে কি দেখা করা যাবে? দেখা করা ঠিক হবে?

আদিত্য বলল, এখন ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আপনি চলে যাবেন না। বুকে ব্যথার সময় বাবা বারবার আপনার কথা বলছিলেন। আপনি বরং বাবার কাছে গিয়ে একটু বসুন। সত্যচরণ সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন ধীরে-ধীরে। তিনি ভাবলেন, যথেষ্ট বয়েস হয়েছে সদাশিবের, নার্সিংহোমে হাসপাতালে যাওয়ার আর কী দরকার। বাড়িতে আপনজনদের মুখ দেখতে-দেখতে শান্তিতে চলে যাওয়াই তো ভালো!

তাঁর মনে হল, এবার বোধহয় তাঁরও দিন ঘনিয়ে এসেছে!

গরম নেই আর তেমন, একটু বরং ঠান্ডা-ঠান্ডা ভাবই পড়েছে, তবু সদাশিবের শিয়রের কাছে বসে পুরোনো আমলের ঝালর দেওয়া পাখা দিয়ে বাতাস করছে তাঁর এক পুত্রবধূ। অন্য এক পুত্রবধূ সদাশিবের পায়ের পাতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এর কোনওটাই দরকার নেই, তবু এসব সেবার চিহ্ন। সদাশিব উইল করে রেখেছেন কি না, তাই-ই বা কে জানে!

সত্যচরণ একটা চেয়ার টেনে বসলেন, সদাশিবের দুই পুত্রবধূ তাঁকে দেখে মাথায় ঘোমটা টানার একটা ভঙ্গি করল। এ-বাড়িতে এখনও এসব প্রথার চল আছে। সদাশিব চলে গেলে আর থাকবে না।

চিত হয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছেন সদাশিব। মুখে স্পষ্ট আসন্ন মৃত্যুর রং। তবে আজকালকার কড়া ওষুধে এই অবস্থা থেকেও অনেকে বেঁচে উঠে আরও দু-চার বছর হেসে-কেঁদে কাটিয়ে যায়।

প্রায় আধঘণ্টার মধ্যেই সদাশিবের জ্ঞান ফিরে এল কিংবা ঘুম ভাঙল। চোখ মেলেই সত্যচরণকে দেখে তিনি স্পষ্টত খুশি হয়ে উঠলেন। দুই পুত্রবধূকে তিনি বললেন ঘরের বাইরে যেতে। তারা কিছুটা আপত্তি জানিয়েও চলে যেতে বাধ্য হল। সত্যচরণকে আরও কাছে আসার ইঙ্গিত করে সদাশিব ফিসফিস করে বললেন, তোকে কেউ খবর দিয়েছে?

সত্যচরণ চেয়ারটা টেনে এনে বললেন, না, আমি আগে খবর পাইনি। এমনিই চলে এলাম।

সদাশিব বললেন, আমি আজ সারাদিন তোকে মনে-মনে ডেকেছি, তাই তুই আসতে বাধ্য হয়েছিল, সতু! তুই না এলে মরেও শান্তি হত না। দরজাটা বন্ধ করে দে। ওই আলমারিতে দ্যাখ হুইস্কি আছে, গেলাস আছে।

বন্ধু এতখানি অসুস্থ, সেই অবস্থায় তাঁর পাশে বসে সত্যচরণ মদ্যপান করবেন, এ কী অদ্ভুত প্রস্তাব!

সত্যচরণ মাথা নেড়ে বললেন, না, আজ আর ওসবের দরকার নেই।

সদাশিব কাতরভাবে বললেন, তুই একটু খা, সতু! তাতে আমার তৃপ্তি হবে। এতকাল আমরা একসঙ্গে…আজ তুই শুধু-শুধু বসে থাকবি তা কি হয়?

সত্যচরণ দৃঢ়ভাবে বললেন, সে প্রশ্নই ওঠেনা। তুই ভালো হয়ে ওঠ, তারপর আবার আমরা একসঙ্গে বসে খাব।

সদাশিব বললেন, ভালো হয়ে উঠব! হ্যাঁ, কিন্তু যদি এ-যাত্রা না উঠি? মাথায় একটা পাপের বোঝা নিয়ে চলে যাব? সতু, এখন অন্তত সত্যি করে বল ওটা কি গরুই ছিল, না অন্য কোনও জানোয়ার?

সত্যচরণ চুপ করে রইলেন।

সদাশিব মাথাটা একটু উঁচু করে বললেন, সতু, একবার সেদিনের ঘটনাটা ভালো করে ভেবে বল।

সত্যচরণ তবু চুপ করে রইলেন। মধ্যমগ্রাম থেকে সেই রাতে ফেরার ঘটনাটা তিনি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন।

সদাশিব দুর্বল হাতখানি তুলে বন্ধুর গায়ে রেখে বললেন, আর কেউ না জানুক, তুই তো জানবি, আমি গো-হত্যার পাপ মাথায় নিয়ে পৃথিবীর থেকে চলে যাচ্ছি! কিন্তু তোর তো ভুল হতেও পারে, সেদিন অন্ধকার রাত ছিল, অমাবস্যার ঠিক পরের দিন…

সত্যচরণ এক দৃষ্টিতে বন্ধুর মুখের দিতে চাইলেন। মৃত্যুপথযাত্রীকে যে-কোনও কথা বলে সান্ত্বনা দিতে দোষ নেই। তিনি মৃদু হেসে বললেন, তোর সঙ্গে আমি এতকাল ঠাট্টা করতুম রে। সেটা ছিল আসলে একটা গাধা! কুকুর-টুকুর না, গাধা! স্পষ্ট দেখেছি! তুই গো-হত্যা করিসনি! গাধারা তো এরকম মরেই!

একটি তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললেন সদাশিব। দু-চোখ দিয়ে গড়িয়ে এল জল। একটুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তিনি তোশকের তলা থেকে টেনে বের করলেন একটা খাম। তার মধ্যে অনেককালের পুরোনো একটি মলিন খবরের কাগজের কাটিং। সেটা সদাশিব ছিঁড়ে ফেললেন টুকরো-টুকরো করে। তিনি যে গো-হত্যা করেননি, তার অকাট্য প্রমাণ এতদিন তাঁর কাছে জমা ছিল।

ওই কাগজের কাটিংটা সত্যচরণের চেনা। তাঁর কাছেও একটা আছে। ওই কাগজে ছাপা হয়েছিল গঙ্গানগরের মোড়ে সেই নিহত যুবকটির ছবি।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments