Friday, April 26, 2024
Homeবাণী-কথাদেখা হবে - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

দেখা হবে – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

নকশি কাঁথার মতো বিচিত্র এক পৃথিবী ছিল আমাদের শৈশবে। এখনও পায়ের তলায় পৃথিবীর মাটি, চারিদিকে গাছপালা, মাথার ওপর আকাশ। বুক ভরে শ্বাস টেনে দেখি। না, শীতের সকালে কুয়াশায় ভেজা বাগান থেকে যে রহস্যময় বন্য গন্ধটি পাওয়া যেত তা আর পাওয়া যায় না। আমাদের সাঁওতাল মালি বিকেলের দিকে পাতা পুড়িয়ে আগুন জ্বালত।

সেই গন্ধ কতবার আমাকে ভিন্ন এক জন্মের স্মৃতির দিকে টেনে নিয়ে গেছে। আর মনে আছে মায়ের গায়ের ঘ্রাণ। সে গন্ধে ঘুমের ভেতরেও টের পেতাম, মা অনেক রাতে বিছানায় এল। মা’র দিকে পাশ ফিরে শুতাম ঠিক। তখন নতুন ক্লাসে উঠে নতুন বই পেতাম ফি বছর। কী সুঘ্রাণ ছিল সেই নতুন বইয়ের পাতায়। মনে পড়ে বর্ষার কদম ফুল কুড়িয়ে এনে বল খেলা। হাতে পায়ে কদমের রেণু লেগে থাকত বুঝি। কী ছিল! কী থাকে মানুষের শৈশবে! বিকেলের আলো মরে এল যেই অমনি পৃথিবীটা চলে যেত ভূতেদের হাতে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়া ছিল ভারী শক্ত। বিশাল বাড়িতে কয়েকটি প্রাণী আমরা গায়ে-গায়ে ঘেঁষে থাকতাম।

ভোরের আলোটি ফুটতে–না-ফুটতে ঘুম ভেঙে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ছুটতাম বাইরে। বাইরেটাই ছিল বিস্ময়ের। সূর্য উঠছে, আকাশটা নীল, গাছপালা সবুজ। সব ঠিক আগের দিনের মতোই। তবু অবাক হয়ে দেখতাম, মনে হত, গতকাল ঠিক এরকম দেখিনি তো! সেই আনন্দিত ছেলেবেলায় একটা দুঃখের ঘটনা ঘটে গেল। আমার ছোটকাকা মৃত্যুশয্যায়। মাত্র দেড় বছর আগে কাকিমা এসেছেন ঘরে। একটি ফুটফুটে মেয়েও হয়েছে। সে তখন হাত পা নেড়ে উপুড় হয়, কত আহ্লাদের শব্দ করে। তবু বউ মেয়ে রেখে ছোটকাকার মরণ ঘনিয়ে এল। বিকেলে শ্বাস উঠে গেছে। দাদু তখন বাইরের বারান্দায় বসে আছেন। বাঁ-হাতে ধরা তামাকের নল, কল্কেতে আগুন নিবে গেছে কখন। সন্ধের পর জ্যোৎস্না উঠেছে সেদিন। দাদু সেই জ্যোৎস্নায় পা মেলে বসে আছেন। ভিতর বাড়িতে কান্নার। শব্দ উঠেছে। বাবা আর জ্যাঠামশাইরা এসে দাদুকে ডাকলেন।

–আসুন, প্রিয়নাথকে একবার দেখবেন না?

দাদু খড়মের শব্দ তুলে ভিতর বাড়িতে এলেন। তার মুখখানা একটু ভার দেখাচ্ছিল, আর কিছু নয়। ছোটকাকা তখন বড়-বড় চোখে চারিদিকে তাকাচ্ছেন। কাকে যেন খুঁজছেন। কী যেন খুঁজে পাচ্ছেন না। বারবার বলছেন–তোমরা সব চুপ করে আছ কেন? কিছু বলল , আমাকে কিছু বলো।

জ্যাঠামশাই নীচু হয়ে বললেন–কী শুনতে চাও প্রিয়নাথ?

ছোটকাকা ক্লান্ত, বিরক্ত হয়ে বললেন–আমি কী জানি। একটা ভালো কথা, একটা সুন্দর কথা কিছু আমাকে বলল , আমার কষ্ট ভুলিয়ে দাও। আমি কেন এই বয়সে সবাইকে ছেড়ে যাচ্ছি –আমার মেয়ে রইল, বউ রইল–আমার এই কষ্টের সময় কেউ কোনও সুখের কথা বলতে পারো না!

বড় কঠিন সেই পরীক্ষা। কেউ কিছু বলতে পারে না। সবাই কেবল মরণোন্মুখ মানুষটার মুখের দিকে চেয়ে থাকে, কথা খুঁজে পায় না। কিন্তু প্রত্যেকেরই ঠোঁট কাঁপে।

একজন অতি কষ্টে বলল –তুমি ভালো হয়ে যাবে প্রিয়নাথ।

শুনে ছোটকাকা ধমকে বললেন–যাও যাও-।

আর একজন বলল তোমার মেয়ে বউকে আমরা দেখব, ভয় নেই।

শুনে ছোটকাকা মুখ বিকৃত করে বললেন–আঃ, তা তো জানিই, অন্যকিছু বলো।

কেউ কথা খুঁজে পাচ্ছিল না।

সেই সময়ে দাদু ঘরে এলেন। স্বাভাবিক ধীর পায়ে এসে বসলেন ছোটকাকার বিছানার। পাশে। ছোটকাকা মুখ ফিরিয়ে তাঁকে দেখে বললেন বাবা, সারাজীবন আপনি কোনও ভালো কথা বলেননি, কেবল শাসন করেছেন। এবার বলুন।

সবাই নিস্তব্ধ। সেই নিস্তব্ধতায় একটা পাহাড়প্রমাণ ঢেউ অদৃশ্য থেকে এগিয়ে আসছে। ছোটকাকাকে জীবনের তীরভূমি থেকে অথই অন্ধকারের এক সমুদ্রের দিকে নিয়ে যাবে বলে ঢেউটা আসছে, আসছে। আর সময় নেই। ছোটকাকার জিভটা এলিয়ে পড়েছে, বারবার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, মুখ প্রবল ব্যথায় বিকৃত!

দাদু একটু ঝুঁকে শান্তস্বরে বললেন–প্রিয়নাথ, আবার দেখা হবে।

কী ছিল সেই কথায়! কিছুই না। অতিথি অভ্যাগত বিদায় দেওয়ার সময় মানুষ যেমন বলে, তেমনি সাধারণভাবে বলা। তবু সেই কথা শুনে মৃত্যুপথযাত্রী ছোটকাকার মুখ হঠাৎ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে গেল। তিনি শান্তভাবে চোখ বুজলেন। ঘুমিয়ে পড়লেন।

এসব অনেকদিন আগের কথা। নকশিকাঁথার মতো বিচিত্র সুন্দর শৈশবের পৃথিবী কোথায় হারিয়ে গেছে। সেই সুন্দর গন্ধগুলো আর পাই না, তেমন ভোর আর আসে না। মায়ের গায়ের

সুঘ্রাণের জন্য প্রাণ আনচান করে! পৃথিবী বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে ক্রমে! বুড়ো গাছের মতো শুকিয়ে যাচ্ছে আমার ডালপালা। খসে যাচ্ছে পাতা। মহাকালের অন্তঃস্থলে তৈরি হচ্ছে একটি ঢেউ। একদিন সে এই পৃথিবীর তীরভূমি থেকে আমাকে নিয়ে যাবে। বুকের মধ্যে শৈশবের একটি কথা তীরের মতো বিঁধে থরথর করে কাঁপছে আজও। সেই অমোঘ ঢেউটিকে যখনই প্রত্যক্ষ করি, মনে-মনে তখনই ওই কথাটি বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে। শৈশবের সব ঘ্রাণ, শব্দ ও স্পর্শ ফিরিয়ে আনে। মায়ের গায়ের ঘ্রাণ পেয়ে যেমন ছেলেবেলায় পাশ ফিরতাম তেমনি আবার পৃথিবীর দিকে পাশ ফিরে শুই। মনে হয়, দেখা হবে। আবার আমাদের দেখা হবে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments