Saturday, April 20, 2024
Homeবাণী-কথাবন্ধু - বাণী বসু

বন্ধু – বাণী বসু

পিসিমা - বাণী বসু

হাওড়ার ফ্যাক্‌টরি থেকে সোজা গেছি আমহার্স্ট স্ট্রীটে। সেখান থেকে ভবানীপুর। রবিন আজ ছুটিতে। আমিই ড্রাইভ করেছি সবটা। দোতলার দালান পর্যন্ত পৌঁছতে আজ আমার দম বেরিয়ে গেল। পায়ে যেন জোর নেই। দালান অবধি পৌঁছতেই কালোমাণিক গুড়গুড় গুড়গুড় করতে করতে এগিয়ে এলো। পায়ের কাছটায় ফোঁস ফোঁস করছে, যেন প্রণাম করছে। আজ মন-মেজাজ এতোই খারাপ যে পাটা ছুঁড়তে গিয়েছিলাম। সামলে নিলাম। ড্যাসুনটার কী দোষ! ও তো আমায় ছেড়ে যায়নি, যাবেও না ওর আয়ুষ্কাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত। জানোয়ার মানুষের চেয়ে অনেক বিশ্বস্ত, অনেক বৎসল। উঃ, টুকটুক যে কোথায় গেল! ওর বোঝা উচিত গাড়ির শব্দ পাওয়া গেছে, অতএব আমি এসেছি। কোথায় কি এমন রাজকর্মটা করছে! ঠিক আছে। করো তুমি তোমার রাজকর্ম। আমিও কিচ্ছুটি বলব না। জুতো খুললাম না। জামা-কাপড়, ধড়াচুড়ো যা পরা ছিল, রইল। দালানের সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। পাখাটা চলছে ফুল স্পীডে। তবু ঘামছি।

অমিতের ব্যবহার বরাবরই বড় শীতল। একেক সময় মনে হত ওর বোধশক্তি হয় নেই, নয় ভোঁতা। অথচ ও যে আমাকে কী টানে টেনেছিল! চিরকালই আমার অনুভূতি তীক্ষ্ণ, তীব্র। অমির পেট ব্যথা করলে, মাসিমা অনেক সময়ে কাকে ওষুধ খাওয়াবেন ঠিক করতে পারতেন না। হয়ত এতো অনুভূতিপ্রবণ বলেই আমি মানুষটা লোকের চোখে মেয়েলি বলে প্রতিভাত হই। অনুভূতি-টুতি সব নারীজাতির একচেটিয়া কি না! যারা এসব মনে করে তারা অবশ্য ইচ্ছে হলে টুকটুককে দেখে যেতে পারে। যাই হোক, মেয়েলি বলুক, বাড়াবাড়ি বলুক, আদিখ্যেতা বলুক, সব সহ্য করতে রাজি আছি, কিন্তু ‘ন্যাকামি’ বললে মেনে নিতে পারব না। ‘ন্যাকা’ শব্দটার মধ্যে একটা হিপক্রিসির ব্যাপার আছে। আমার আর অমির সম্পর্কের মধ্যে কোনও খাদ নেই। অমির আদ্যন্ত নির্লিপ্ততা সত্ত্বেও এই দুর্লভ বন্ধুত্ব টিকে আছে, আমি সে কথা হাজার মুখে বলব, অমি অবশ্য বলবে না, হাসবে। গাধা পিটিয়ে ঘোড়া যদি করাও যায়, অমিকে পিটিয়ে তার মুখ থেকে কথা বার করা সহজ নয়। প্রচণ্ড মুখচোরা। ওই হাসিটাই ওর জবাব। ওর মতামত।

পাখা চলছে। তবু ঘামছি অস্বাভাবিক। দোষ নেই। যত জীবন এগোচ্ছে ততই বুঝতে পারছি প্রয়াত সেই কবির কথাই ঠিক, চতুর্দিকে মুখোশ, শুধু মুখোশ। তুমি কথা বলো, অপরপক্ষের ঠোঁট নড়বে হৃদয় নড়বে না, তুমি কিছু শোনালে কানগুলো শুনবে, কিন্তু মর্মে পৌঁছবে না। হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব—এ একেবারে কাব্যকথা। কবি-বাক্যে বিশ্বাস করে সারাটা জীবন একটার পর একটা ভুল জায়গায় নিজেকে সমর্পণ করে এসেছি।

পেছনে একটা শব্দ হল। নিশ্চয় টুকটুক। পনের মিনিট কেটে গেল, এতক্ষণে বাবুর আসবার সময় হয়েছে। পেছন থেকে সামনে এলো। একটা সবুজ সিল্কের রাজস্থানী পোশাক পরেছে। ভারী সিল্কের ওপর দিয়ে হাওয়া কাটলে একটা অদ্ভুত আকর্ষক শব্দ হয়। সেই শব্দটাই আমি শুনতে পেয়েছিলুম। টুকটুকের জামা-কাপড়ের শখ ভীষণ, কত রকমের যে পোশাক করায়। পরে, বাড়িতেও পরে থাকে!

—‘কতক্ষণ এসেছো?’ একেবারে অলস টু-দা পাওয়ার ইনফিনিটি। হাতটা পড়ে রয়েছে সোফার হাতলে। নখগুলো লাল, হাতের পাতায় কোথাও কোনও শিরা জেগে নেই। যেন নেতিয়ে পড়া কেয়াফুলের স্তবক। বাপের বাড়ির হতদরিদ্র ঘরে টুকটুক এমন হাত টিকিয়ে রেখেছিল কি করে—এটা একটা লাখ টাকার প্রশ্ন। আমি যে জবাব দিলাম না, আমার মেজাজটা যে একটু অন্যরকম, ভঙ্গিতে বিষাদসিন্ধু এসব টুকটুক লক্ষই করল না। আপন মনে নিজের আঙুল দেখছে। হাতের কাঁকন দেখছে। পা তুলে একবার সোনালি চটি নাকি তার অভ্যন্তরে নিজের সাদা মসৃণ পায়ের পাতা দেখল। নার্সিসাস!

—‘খাবে? নাকি বাইরে খেয়েছো?’—আমার খাওয়া না-খাওয়া ওর কাছে সমান। এবারেও উত্তর না পেয়ে বোধ হয় মেমসাহেবের বোধোদয় হল। বললো—‘কি ব্যাপার? কথা বলছো না যে! কিছু হয়েছে?’

জবাব দিলাম না। টুকটুক এবার উঠে পড়ল। আমার কাছে চলে এলো। নিচু হয়ে সোফার পেছনে দু হাত রাখল, আবারও বলল—‘কিছু হয়েছে?’

—‘অমিত অস্ট্রেলিয়া চলল ফর গুড’—আমি অনেক কষ্টে শব্দগুলো উচ্চারণ করতে পারলাম।

—‘তো কি?’ বুকের ওপর দু হাত আড়াআড়ি রেখে চূড়ান্ত নির্বেদের সঙ্গে টুকটুক বলল।

আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। প্রায় কাঁপছি এত উত্তেজনা। বলছি—“টুকটুক তুমি বলছ কি? অমিত অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে বরাবরের মতো আমাকে ছেড়ে। আর তুমি বলছ,—‘তো কি?’ তো তুমি কি?”

টুকটুক আড়াআড়ি হাতদুটো নামাল। ঝট করে পেছন ফিরল, ওদিকের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ ঘাড়টা ফেরাল, তারপর মুখটা সামান্য বেঁকিয়ে আমাকে আমূল কাঁপিয়ে দিয়ে বলল, —‘ন্যাকা’।

এই অসহ্য রকমের ঘৃণ্য শব্দটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিল আমার স্ত্রী যাকে আমি কাদা থেকে তুলে এনে রাজসিংহাসনে বসিয়েছি, প্রতিদিন যার সাংস্কৃতিক শিক্ষা-দীক্ষা এবং বিলাসের খাতে আমার আয়ের অঙ্কে রীতিমত একটা বিয়োগ হয়। যার বাবা-মা, দুটি ছোট ভাইবোনের দায়ও আমি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছি। কোনরকম প্রার্থনা, অনুরোধ, উপরোধ বা প্রত্যাশার দায় মেটাতে নয়। এটাই আমার পক্ষে সবচেয়ে স্বাভাবিক, এটাই সবচেয়ে মানবিক বলে। আমাদের নিজেদের মানুষ বলে পরিচয় দিতে হবে তো!

এই মনুষ্যত্ব রক্ষার তাগিদেই না অমির কাঁধে হাত রেখেছিলাম! তখন বাল্য পেরিয়ে কাঁচা কৈশোর। বই আনেনি এই অপরাধে ভূগোলের ক্লাসে সেবারের সেকেন্ড বয় সাঙ্ঘাতিক মার খেল। ভূগোলের মাস্টারমশাই প্রফুল্লবাবু বড় নিষ্ঠুর স্বভাবের ছিলেন। মেরে-ধরে ছেলেটিকে আধমরা করে উগ্রচণ্ডা দুর্বাসার মতো বেরিয়ে গেলেন প্রফুল্লবাবু, আমি বললাম—‘চল, আমরা হেড সারের কাছে কমপ্লেন করতে যাই।’ কয়েকজন ছেলে সঙ্গে সঙ্গে তৈরি। অমিত অর্থাৎ মার-খাওয়া ছেলেটি বলল—‘না।’

—‘যাবো না? সে কি? কেন?’

—‘সত্যিই তো, গতকাল উনি বারবার করে আনতে বলেছিলেন টেক্সট্‌টা।’

—‘ঠিক আছে, কিন্তু এই সামান্য ভুলের জন্য ওই রকম মার? অমিত তোমার যে পিঠ লাল হয়ে গেছে। কানের পাশ দিয়ে রক্ত পড়ছে।’

—‘ও কিছু না। ওঁর বাড়ি থেকে চলে গেলেই উনি আর মারবেন না।’

আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসার পর জিজ্ঞাসায় জানলাম—অমিত এবং তার মা প্রফুল্লবাবুর বাড়ির নিচের তলায় ভাড়া থাকেন। —ওর বাবা বছরখানেক হল হঠাৎ মারা যাওয়ায় ওরা একেবারে অকূলে পড়েছে। ভাড়া দিতে পারছে না মাসছয়েক হল। প্রফুল্লবাবুর মারের পেছনের আসল ইতিহাস এই।

অত সহজে, অন্যান্য ছেলেদের সামনে অবশ্য অমি এত কথা বলেনি। আস্তে আস্তে টিফিন পিরিয়ডে মাঠে বেড়াতে বেড়াতে গাছতলায় বসে মুড়ি চিবোতে চিবোতে অনেক জেরার পর একটু একটু করে বেরিয়েছে কথাগুলো অমির পেট থেকে।

আমি বললাম—‘আজ ছুটির পর অমিত আমাদের বাড়ি চলে প্লীজ।’

—‘আজ নয়।’

—‘তবে কাল।’

—‘ঠিক আছে দেখা যাক।’

—‘দেখা যাক নয়, কাল আসছই।’

বাড়ি গিয়ে বাবাকে সব কথা বললাম। আমার মা নেই। বাবা অত্যন্ত উদার-চরিত্রের মানুষ। বললেন—‘আমাদের একতলার দক্ষিণ দিকে দুখানা ঘর তো এমনিই পড়ে রয়েছে, ওঁদের আসতে বলে দাও। —আমি বারান্দাটা ঘেরার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’

পরের দিন অমিকে বাড়িতে আনলাম, বাবা কারখানা থেকে ফিরে ওকে দেখলেন, আদর করে বললেন,—‘বাঃ, বেশ ব্রাইট ছেলে মনে হচ্ছে!’

কিন্তু আমাদের বাড়ির একতলায় থাকার কথায় অমিত ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়ল। খালি গোঁয়ারের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে থাকে। শেষে ওদের বাড়িতে গিয়ে ওর মার কাছে কথাটা পাড়লাম। উনি বললেন,—‘প্রফুল্লবাবুর ছ’মাসের বাকি ভাড়া না দিয়ে কি ভাবে যাই বলো! তা ছাড়া তোমাদের বাড়ির ভাড়াও তো অনেক হওয়ার কথা।’

আমি ছেলেমানুষ। মায়ের মতো এক মহিলার মুখের ওপর আর কি বলব। বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি ভাড়ার পরিমাণ পাঁচ শ চল্লিশ টাকা। আমার হাত খরচের টাকা জমেছিল হাজারের সামান্য ওপরে। তার থেকে পাঁচ শ চল্লিশ প্রফুল্লবাবুর হাতে দিয়ে রসিদ নিয়ে অমির মার কাছে গেলাম। হাত ধরে বললাম—‘চলুন না মাসিমা, আমার মা নেই। কেউ আমাকে দেখে না।’

এই শেষের তীরটাই বোধ হয় অব্যর্থ হয়ে থাকবে। তাই ওদের বাড়িতে আনতে পারলাম। অমির মা আমার নিজের মায়ের মতো হলেন। ওঁদের একতলার ঘরই হল বলতে গেলে আমার আসল বাসস্থান। রাজশয্যা ছেড়ে ধূলিশয্যা, অনেকেই বলল।

—মাসিমার সেলাই-মেশিন এবং অমির কাগজ বিক্রি চলতে লাগল আড়ালে আমাদের বাড়ির ভাড়া এবং আমার পাঁচ শ চল্লিশ টাকার ঋণ মেটাবার জন্যে। এবং কোনক্রমেই আমি অমিকে আমার খাবার টেবিল বা শয্যার ভাগ দিতে পারলাম না, একমাত্র কোনও জন্মদিন-টিনের মতো বিশেষ উৎসবের দিন ছাড়া। এবং মাসিমাও কোনও দিন তাঁর ভাড়া-করা দুখানা ঘর-বারান্দার সীমা অতিক্রম করলেন না।

টুকটুক এসে বলল—‘যদি খেয়ে এসে না থাকো, তো চলো খাবার দিতে বলেছি। আমি নিজে রেঁধেছি আজ।’

এটা নতুন। রান্না করতে টুকটুক খুব ভালোই পারে। কিন্তু একদম ভালোবাসে না কাজটা করতে। বললে বলে—‘ভালো রাঁধতে পারি, তো কি? তুমি কি রান্নার জন্যে আমায় বিয়ে করেছিলে? তা হলে আমার মাকে বিয়ে করলেই পারতে, মা আরও অনেক অনেক ভালো রাঁধে।’

—‘টুকটুক! কি অসভ্যতা। কি বিশ্রী!’

—‘আমার যদি দিনরাত শুয়ে থাকতে, কি গল্পের বই পড়তে, কি টি ভি দেখতে ভালো লাগে আমি তা করতে পাবো না! এরকম তো কথা ছিল না!’

কথা কি ছিল তা অবশ্য আমি আদৌ জানি না। কিন্তু টুকটুক যখন পরম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এই প্রশ্নটা উচ্চারণ করে আমি প্রাণ ধরে পাল্টা বলতে পারি না—“কী কথা ছিল?” আমার খারাপ লাগে। আমি বুঝতে পারি টুকটুক রান্না করতে করতে, রান্না করতে করতে হাঁপিয়ে গেছে। এখন ওর তাই রাঁধতে আর ভালো লাগে না। জীবনে কোনদিন লাগবেও না। আর আমি এতো হ্যাংলা নই যে রান্নায় বীতস্পৃহ স্ত্রীকে দিবারাত্র ‘এটা করো’ ‘ওটা করো’ বলে নাজেহাল করে তুলব। এমন কি আমাদের আদ্যিকালের বামুনঠাকুরের রান্না খেয়ে টুকটুক যখন নাক কুঁচকে বলে—‘তোমরা ঘটিরা সব তাতে এতো মিষ্টি খাও। তোমাদের বামুনঠাকুর কি মাছের ঝোলেও চিনি দেয়?’ তখনও আমি বলি না—‘নিজে রাঁধলেই তো পারো, কিংবা নিজের পছন্দটা দেখিয়ে দিলেও তো পারো।’ কোনও কথা ছিল অথবা ছিল না বলে যে একথা আমি বলতে পারি না তা নয়। আসলে এ ভাবে বলা আমার স্বভাবে নেই। বিশেষত যখন টুকটুকের ব্যাপারটা আমি আগাগোড়াই বুঝতে পারি।

তো সেই টুকটুক আজ রান্না করেছে। জামা-কাপড় বদলে, হাত-মুখ ধুয়ে নিতে হল। অমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছে, সেই খবর বুকের ভেতর নিয়ে আজ আমি টুকটুকের রান্না পোলাও, চিতল মাছের কোপ্তা খাচ্ছি, ঠিক সেই দিনেই, এ কেমন নিষ্করুণ কাকতালীয়? আমাকে অন্যমনস্ক দেখে টুকটুক দু আঙুল জিভ দিয়ে চেটেচুটে নিয়ে বলল—‘কেমন, ভালো হয়নি বুঝি?’

আমি বললাম—‘ভালো হয়নি মানে? দারুণ হয়েছে, সাঙ্ঘাতিক হয়েছে। শুধু তোমার এই একটি গুণের জন্যও আমি পত্নীগর্বে গর্বিত হতে পারি।’

—‘থাক’—টুকটুক বলল—‘তো বন্ধুকে একদিন ডাকো, খাইয়ে দাও।’ টুকটুক কি অমিকে ডাকবার প্রসঙ্গ তুলতেই আজ নিজে হাতে রান্না করেছে। ও কি জানে না, অমিকে নিয়ে আমি প্রায়ই বাইরে খাই, কিন্তু বাড়িতে না। বাড়িতে ডেকে অমিকে কোনও কষ্ট বা অপ্রিয় পরিস্থিতির মধ্যে ফেলবার নিষ্ঠুরতা আমি কেমন করে করব?

—‘কি প্রস্তাবটা পছন্দ হল না বুঝি?’—টুকটুকের কাটা কাটা কথা। অমিকে যেমন বাঁচিয়ে চলি, টুকটুককেও তেমনি সত্যি কথাটা বলতে পারি না। আজকে বলে ফেললাম—‘তুমি তো জানো অমি আজকাল আর আমার বাড়ি একেবারে আসতে চায় না। তা ছাড়া ও তো কালই চলে যাচ্ছে।’

উত্তরে টুকটুক একটা অদ্ভুত মুখভঙ্গি করল। এই বিচিত্র মুখভঙ্গির মানে কি বোঝবার চেষ্টা করতে করতে আমি খাওয়া শেষ করলাম। হাত মুখ ধুয়ে, সিগারেট ধরিয়ে জানলার পাশে দোলনা চেয়ারে বসলাম। এক হতে পারে—বয়েই গেল। অমি যদি আসতে না চায় ওর জন্যেই নিশ্চয় চাইছে না, সেটা ওর পক্ষে যথেষ্ট অপমানকর। তাই সেটাকে ও উড়িয়ে দিতে চাইছে। আসবে না তো বয়েই গেল। দ্বিতীয় হতে পারে আমার কথা ও বিশ্বাস করেনি। অর্থাৎ অমিকে আমি আসতে বলেছি অথচ সে আসতে চাইছে না। এটা আমার রচনা। টুকটুকের মধ্যে অবিশ্বাসের শেকড় খুব গভীর। আমার এখনও পর্যন্ত সাধ্যে কুলোয়নি যে তাকে উপড়োই। আস্তে আস্তে হবে। আমি অপেক্ষা করতে পারি। তাড়াহুড়োয় কি লাভ?

অমির জন্যেও তো আমায় অপেক্ষা করতে হয়েছে। কত দিন, কত মাস, কত বছর। তবু ওর মনের তল পেয়েছি কি কোনদিন? বড্ড চাপা স্বভাব। একমাত্র যখন আমার বসন্ত হল, তখন, সেই ভয়ঙ্কর সময়টায় অমি আমার ঘরে শুয়েছিল। এক মশারিতে আমি, আরেক মশারিতে ও। কষ্টে ছটফট করছি, ঘুম আসছে না। অমি উঠে এসেছে, নীল আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, মশারি সামান্য তুলে অমির সেই মৃদু গলার প্রশ্ন এখনও আমার কানে বাজে—‘বড্ড কষ্ট হচ্ছে না রে গোপাল? শোন, একদম চুলকোবি না। আমি আস্তে আস্তে ফুঁ দিয়ে দিচ্ছি।’ এইভাবে ফুঁ দিয়ে দিয়ে, মৃদু গলায় গল্প করে, গান করে আমায় অন্যমনস্ক রাখত, ঘুম পাড়াত অমি। সে বছর ঠিক তিন নম্বরের তফাতে আমি সেকেন্ড হয়ে গেলাম। মাস্টারমশাইরা প্রকাশ্যেই বললেন—‘প্রশংসনীয় প্রতিযোগিতা। তবে কিছুতেই অমিতকে এর চেয়ে কম মার্কস দেওয়া গেল না। গোপাল তুমি ইচ্ছে করলে খাতাগুলো দেখতে পারো।’ খাতা দেখেছিলাম। সেই বয়সেই মনে হয়েছিল অসাধারণ। সেদিনটা আমার রাস্তায় রাস্তায় কেটে গেল একা, ভাবটি অমিটা কি সাঙ্ঘাতিক মেধা লুকিয়ে রেখেছিল। ওর জন্য অনেক বড় কিছু অপেক্ষা করছে। আমাদের স্কুল কলকাতার গর্ব। আমিও অহঙ্কার করছি না, যা-তা ছেলে নই। সেই আমার এতদিনের রেকর্ড ভেঙে যে বেরিয়ে যেতে পারে তাকে তো শাবাশ জানাতেই হয়।

সে রাত্রে আর মাসিমার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারিনি, পরদিন স্কুল যাবার আগে গিয়ে প্রণাম করতে মাসিমা কেঁদে ফেললেন, বললেন,—‘কাল আসিসনি কেন রে গোপাল, দুঃখ হয়েছিল খুব, না রে?’

আমি বললাম—‘সে কি? দুঃখ হতে যাবে কেন? আমার আসলে ভীষণ…’

—‘না, না, আমি ঠিক জানি এতো দিনের ফার্স্টবয় তুই, মন দিয়ে লেখাপড়া করিস, ফাঁকি তো দিস না, তোর দুঃখ হয়েছে কি না তুই না বুঝলেও আমি বুঝি রে! মাত্র তো তিনটে নম্বর, পার হতে পারবি না!’ এতো ভালোবাসতেন আমাকে মাসিমা।

মাসিমার প্রেরণাতেই আর কোনদিন আমার সেকেন্ড হতে হয়নি। কিন্তু আমি তাতে খুশি হতে পারিনি। অমি ঠিক আমার পেছন-পেছন এসেছে। বরাবর। নয় কি দশ নম্বর পেছনে, যেন পা টিপে টিপে। এই ধরে ফেলল, এই ধরে ফেলল। কিন্তু ধরতে পারছে না। তাতে ওর কোনও বিকারও নেই। যতই বলি না কেন—‘অমি, বাক আপ ম্যান, কেন পারছিস না? এরকম কমপিটিশন আমার ভালো লাগে না। আমার মাস্টারমশাইদের কাছে পড়।’

অমি নরম করে হাসে—‘না পারলে কি করব বল গোপাল! আর কি-ই বা এসে যায় এতে।’ সত্যিই ওর মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের কথা।

অনেকক্ষণ বসে আছি। উঠলাম। জল খেলাম। পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে গেছে—‘টুকটুক, টুকটুক!’

শিবুদা এসে ধরল। এইসা ঝিঁঝিঁ ধরেছে যে নড়তে পারছি না। শিবুদা বলল—‘বাঁ পা দিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল এমনি করে চেপে ধরো।’

—‘দু পা-ই ধরে গেছে যে!’

—শিবুদা তখন নিচু হয়ে আস্তে আস্তে পা মালিশ করে দিতে লাগল। একটু পরে ঝিনঝিনে হাসি শুনে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি টুকটুক। হেসে গড়িয়ে পড়ছে একেবারে।

বললাম—‘কি হল?’

—‘শিবুদা তোমার পায়ে ধরে অত সাধছে কেন?’

—‘পায়ে ধরতে যাবে কেন? আচ্ছা তো! ওই জন্যেই তো তোমাকে ডাকছিলাম, তা তোমার পাত্তা পেলে তো!’

—‘কেন ডাকছিলে! পায়ে ধরে সাধতে? এরপর কি সকালবেলা বুড়ো আঙুল ধোয়া জল খেতেও ডাকবে?’ টুকটুকের হাসি বেড়েই যাচ্ছে।

বিরক্ত হয়ে বললাম—‘ঝিঁঝিঁ ধরেছে প্রচণ্ড। কী যে বাজে কথা বলো।’

—‘উঃ। কত ন্যাকামিই যে জানো!’ টুকটুকের প্রস্থান। ওকে সাবধান করে দিতে হবে এই কথাটা ও যেন আর ব্যবহার না করে। আমার অ্যালার্জি হয়ে যাচ্ছে কথাটায়। টুকটুক যেন মনে না করে ওকে যে আমি বিয়ে করেছি এটা একটা ফেরানো-যায় না গোছের ব্যাপার। আজকালকার দিনে হতে পারে না। এটা ওর জানা উচিত। অমিকেও কয়েকদিন আগেই বলছিলাম—‘টুকটুকের বাইরের রূপ-গুণ দেখে আকৃষ্ট হওয়াটা বোকামি কি বল! ভেতরের মানুষটা ঠিক।…’

অমিত চুপ করে রইল। আমি হেসে বললাম—‘তুই আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। অলটার ইগো বলতে গেলে। তুই এ বিষয়ে মতামত দিলে আমি কিছু মনে করব না।’

অমিত বলল—‘না…মানে..ঠিক…।’

—‘না…মানে…ঠিক…? তুই ইয়ার্কি পেয়েছিস! তুই নিজে ওর মধ্যে কি দেখেছিলি?’

অমিত বলল—‘দূর, তুইও যেমন! ছাড় তো!’

ব্যাস। বিষয় পরিবর্তন। আর একটি কথাও ওকে দিয়ে বলাতে পারিনি।

অমি আমাদের বাড়ির একতলা ছাড়ল মাসিমার মৃত্যুর পর। সে এক মর্মান্তিক ব্যাপার। মনে করলে এখনও আমার গা শিউরে ওঠে। মানুষকে ক্ষমা করতে পারি না। মাসিমা কোনদিন নিজেদের ঘরের সীমানার বাইরে পা বাড়াতেন না, কিন্তু আমার বাবা নানা প্রয়োজনে মাঝে-মধ্যেই যেতেন। এই নিয়ে আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী মহলে একটা চাপা গুজগুজ আরম্ভ হল। আমাদের তখন ফাইনাল ইয়ার। রটনা শুনে রাগে আগুন হয়ে গেলাম। আমারই মাথায় আগুন জ্বলছে, তা হলে ওদের না জানি কি হচ্ছে! ঘরে গিয়ে দেখি মাসিমা যেমন অবিশ্রান্ত সেলাই করে যান তেমনি করছেন, অমিত ছাত্র পড়াবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। অমিকে ঝাঁকিয়ে বললাম—‘তোর কি দেহে মাছের রক্ত, এইসব রটনা শুনেও তুই নির্বিবাদে ছাত্র পড়াতে যাচ্ছিস?’

মাসিমার মুখটা লাল হয়ে গেল। অমির মুখটা একেবারে নীলবর্ণ। আমি টেবিলে চাপড় মেরে বললাম। ‘এইসব জঘন্য শয়তানির উচিত জবাব কি জানিস?—বাবার সঙ্গে মাসিমার বিয়ে দিয়ে দেওয়া।’

—মাসিমার সেলাই-কল দুম করে বন্ধ হয়ে গেল। তিনি যেন একটা উদগত চিৎকার চাপলেন। অমিত উঠে দাঁড়িয়ে বলল—‘গোপাল তুমি বলছো কি, ছিঃ। এসব কথা চিন্তা করলেও ওদের নোংরা ধারণাকে মেনে নেওয়া হয়। বোঝো না?’

আমি বললাম—‘ভুল। ভুল। সমাজ চিরকাল একভাবে চলবে না অমিত চলতে দেবো না, সমাজের মুখে থাবড়া দেব, এ আমি করেই ছাড়ব। আজই বাবাকে বলছি।’

অমিত বলল—‘হঠকারীর মতো কথা বলো না, হঠকারীর মতো কাজ কোরো না। যাও তো এখন এখান থেকে, যাও।’

একরকম ঠেলে আমাকে নিজেরই বাড়ির ঘর থেকে বার করে দিল অমিত। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। মা-ছেলের মধ্যে কি কথা হয়েছিল জানি না। পরদিন এক বীভৎস দৃশ্য দেখা গেল। আমাদের পরমপূজ্য মাসিমার কুসুমকোমল শরীরটা সিলিং থেকে…।

অমিত ঘরের কোণে বসেছিল। আছড়ে পড়ে বললাম—‘এ কি করলেন মাসিমা, এ করলি অমি? কী বলেছিলি মাসিমাকে?…’

অমিত ঘর ছেড়ে চলে গেল।

মাসিমার শেষ কাজ হয়ে যাবার পর আমাকে বা বাবাকে একটা কথাও না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে গেল অমিত। একদিন ভোররাতে উঠে শুধু দেখলাম, দালানে শ্বেতপাথরের টেবিলে সে মাসের ভাড়ার টাকাটা, ঘরের চাবির তলায় চাপা দেওয়া রয়েছে। একটা চিঠি না, কিচ্ছু না।

টুকটুক বলল, ‘শুতে চলো। অনেক রাত হয়েছে।’

সত্যিই রাত হয়ে গেছে। শুয়ে পড়লাম। কিন্তু সত্যিই ঘুম আসছে না। সামনের জানলার পর্দা সরানো দু পাশে। চাঁদটা একেবারে ঠিক চোখের ওপর। টুকটুক বলল—‘একটা জিনিস করেছি, দেখবে?’

—‘এখন? এই এত রাতে?’

—‘ঘুমোচ্ছ না বলে বলছি।’

টুকটুক উঠল, আলো জ্বালল, আলমারি খুলল। ভেতর থেকে দুটো প্যাকেট টেনে বের করল। একটা প্যাকেটে হাত-কাটা খুব সুন্দর একটা স্লিপোভার, ধবধবে সাদা। আর একটা প্যাকেটে ঠিক ওইরকম আরেকটা স্লিপোভার, কুচকুচে কালো।

টুকটুক বলল—‘তুমি ফর্সা, তোমাকে কালোটা মানাবে, আর তোমার বন্ধু কালো, ওকে সাদাটা…।’

হেসে বললাম—‘তোমার কালার-ম্যাচিং সম্পর্কে ধারণা খুব পুরনো টুকটুক। এখন সবাই জানে ফর্সা রঙে সাদা পরতে হয়। যাই হোক ওটা একটা ব্যাপারই না। বেশ সুন্দর হয়েছে।’

টুকটুক বলল—‘অস্ট্রেলিয়া যাবার আগে এটা তোমার বন্ধুকে দিয়ে দিও।’

—‘বাঃ, তুমি উপহার দিচ্ছো, তুমিই দেবে, আমি দিতে যাবো কেন?’ আমি পাশ ফিরে শুলাম। টুকটুক তা হলে এখনও অমির জন্য ভাবে। আশ্চর্য!

অমিকে সেবার খুঁজে বার করলাম ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে। পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠল। বললাম—‘ভূত দেখলি নাকি?’

ফিকে হাসল। বললাম—‘ও বাড়িতে থাকতে আর না-ই যাস। আমাকে তোর ঠিকানাটা অন্তত দে। আমি যে তোকে ছেড়ে খেতে শুতে পারি না, একথাটা তো এতদিনে জানিসই।’

ঠিকানাটা খসখস করে লিখে দিল। আমহার্স্ট স্ট্রীটের একটা মেসের ঠিকানা। এরপর আমাদের জীবন, আলাপ, অন্তরঙ্গতা সব একেবারেই লেখাপড়া-কেন্দ্রিক হয়ে উঠল। মাস্টারমশাইরা অর্থাৎ সায়েন্স কলেজের মাস্টারমশাইরা নিত্য আসতেন বাড়িতে। ওঁরা বলতেন কে যে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবে আর কে যে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হবে বোঝা যাচ্ছে না। আমি বলতাম—‘অমিত হবে,’ অমি বলত—‘গোপাল হবে।’ পাঁচ নম্বর, মাত্র পাঁচ নম্বরের জন্য সেকেন্ড হয়ে গেল অমিত।

সেইজন্যেই মনোদুঃখে কি না জানি না অমি একটা চাকরি নিয়ে বসল। ভালো চাকরি, কিন্তু গবেষণার সুযোগ নেই। শুধু সেলস। অনেক বোঝালাম, শেষে ইনস্টিট্যুটে যোগ দিতে ও রাজি হল। তারপর আমাদের যুগ্ম গবেষক-জীবনের শুরু। কি পরিশ্রম করছে অমি, আমি বুঝতে পারছি ও এবার কিছু করবে। করবেই। প্রাণপণে ওকে সাহায্য করে যাচ্ছি। ওর নির্দেশমতো চলছি। পেপার বার হচ্ছে আমাদের উভয়ের নামে। তারপর? তারপর ভাগ্যের সেই অদ্ভুত খেলা। জেনেটিক এঞ্জিনিয়ারিং-এর সেই আবিষ্কার যা অদ্ভুতভাবে শেষ পর্যন্ত আমার হাত দিয়েই হল। নেশায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। রাতে সবাই চলে যাবার পর আবার গেলাম ল্যাবে। দারোয়ানকে দিয়ে চাবি খুলিয়ে, সারারাত কাজ করছি, খুঁজছি, তারপর হঠাৎ আলোর ঝলক। পর দিন সকালে চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেল খবর। প্রেস কনফারেন্স ডাকলেন ডক্টর বর্মা, আমি জোর করেছিলাম আমাদের দুজনের নামই থাক। অমি রাজি হল না। রিসার্চ ছাড়ল অমি। অবশ্য ছাড়ল বলা ঠিক না। চাকরি তো রিসার্চেরই। কিন্তু ওর সেইসব মূল্যবান গবেষণা ত আর ওর ব্যক্তিগত থাকবে না। অনেক বারণ করেছিলাম। কিছুতেই শুনল না। ওর নাকি টাকার দরকার। আমারও আর ভালো লাগল না। ছেড়ে দিলাম ইনস্‌টিটিউট। সেই সময়ে বাবা মারা গেলেন, আমাকে হাল ধরতে হল বাবার ব্যবসার। মনে অশান্তি নিজের পছন্দমতো কাজ পাচ্ছি না। বাবার ইলেকট্রিক্যাল পার্টস-এর ব্যবসা, বাঁধা খদ্দের সরকার, কাজের মধ্যে রস পাই না। একদিন এসপ্লানেডে গাড়ি থেমে আছে ট্রাফিক সিগন্যালে, দেখলাম ওদের দুজনকে। অমি তখনও পুরনো মেস ছাড়েনি, বলে—‘বেশ তো আছি, নিজস্ব বাড়ি মানেই নানান ঝামেলা।’ মনে মনে হাসলাম, ও এইজন্য তোমার টাকার দরকার। এইবার তুমি বাড়ির ঝামেলায় যাবে। গাড়ি ঘুরিয়ে তুলে নিলাম। পরিচয় হল। হেসে বললাম—‘রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবি কেন? আমার বাড়িটা কি তোর নয়?’

পরের রবিবারই ডাকলাম ওদের দুজনকে। আলোয় ফুলে ভরে দিলাম বাড়ি। ইনটিরিয়র ডেকোরেটর ডেকে ঘর সাজালাম। ওরা এলো। সারাটা মুগ্ধ সম্মোহিত সন্ধ্যা খালি গান আর গল্প, গল্প আর ছবি, যেখানে যা ভালো খাদ্য আছে, অমি যা ভালোবাসে, যা ওর পক্ষে ভালোবাসা সম্ভব—সবই জড়ো করেছিলাম।

চিকমিকে সব জরির ঝালর। টুংটাং ঘণ্টার মধ্যে দিয়ে বড় বড় চোখ কপালে তুলে টুকটুক বলছিল—‘এতো বড়, এতো সুন্দর বাড়ি, এই বিশাল গাড়ি, এতো সম্পদ সব আপনার একার?—কোনও দ্বিতীয় ভাগীদার নেই?’

আমি হেসে বলছিলাম—‘আর এই সব রোশনি, এই খুশবু, এই সমস্ত আপ্যায়ন আয়োজন আপনার। আপনার একার। কোনও ভাগীদার নেই।’

স্বপ্নালু চোখে টুকটুক বলছিল—‘কথা বলাও কি আপনি মাস্টারমশাই রেখে শিখেছিলেন?’

আমি বলছিলাম—‘চলতে ফিরতে হাসতে যদি আপনি মাস্টারমশাই রেখে শিখে না থাকেন, তা হলে কথা বলতে শিখতেও আমার মাস্টারের দরকার হয়নি।’

আমার বাড়ি ওদের জন্যে খোলা রইল। চাবি দিয়ে দিলাম একটা—অমির হাতে। অমি সেটা টুকটুকের হাতে চালান করে দিল।

দু-তিন দিন পর টুকটুক এলো একা একা। অমি নাকি কাজে ব্যস্ত। আরও কয়েক দিন পর টুকটুক আবার এলো একা, অমি ট্যুরে গেছে। আরও কয়েকদিন পর টুকটুক আমার দেওয়া চাবিটা ব্যবহার করল। অর্থাৎ আমি বাড়ি এসে দেখলাম টুকটুক—দালান আলো করে সোফায় এলিয়ে আছে। তারপর একদিন টুকটুক এসে কান্নায় ভেঙে পড়ল। অমি নাকি বিয়ে করতে চাইছে না।—‘প্রায় দু বছর এতো মেলামেশার পর…আমি মুখ দেখাতে পারব না বাড়িতে’, টুকটুক দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছিল। অমির অফিসে গেলাম। খুব উত্তপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। ওর ঘরে আরও দুজন কর্মী বসে। গ্রাহ্য করলাম না। যা বলার বললাম। আমি বলল—‘আমি ওর সঙ্গে বন্ধুর মতো মেলামেশা করেছি, বিয়ে করব কথা দিইনি তো!’

—‘বাঃ চমৎকার। তুই যে এত বড় স্কাউন্ড্রেল তা আমার জানা ছিল না। কথা দিসনি তো ও ভাবল কি করে?’ এই সময়ে সহকর্মী দুটি উঠে বাইরে চলে গেল।

অমিত মৃদু হেসে বলল—‘তাই তো? ভাবল কেন? আমার বাঁধা পড়বার ইচ্ছে নেই, কাজ অনেক কাজ, আচ্ছা গোপাল, দ্যাখ না ও যদি তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়!’

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম—‘ওকে যখন এভাবে পরিত্যাগ করেছ, তখন ও এরপর কাকে বিয়ে করতে রাজি হবে সে কথা ভেবে আর নাই মাথা ঘামালে!’

যাক গে, সে সব দিনও গত হয়ে গেছে। গত মাস কয়েক ধরেই আমার নতুন পরিকল্পনা নিয়ে দুজনের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। আমার এই লোহা-লক্কড় আর ভালো লাগছে না, ওটা আছে থাক। ওষুধের ফ্যাকটরি করব। অমি অনেক প্ল্যান-ট্যান ছকে দিল, এসবে ওর মাথা তো পরিষ্কার! আমি বললাম, ‘তোকে কিন্তু আসতে হবে আমার সঙ্গে।’

—‘কিভাবে?’

—‘কেন? তুই ওয়ার্কিং পার্টনার, ল্যাবরেটরির ভার তোর ওপর।’

অমিত যেন কি ভাবছে। অনেকক্ষণ পরে বলল—‘দেখা যাক।’

তারপর কালকে ওই ঘোষণা। আগে থেকে কোনও খবর না, কিছু না। দুম করে—‘কাল আমি মেলবোর্ন যাচ্ছি। হ্যাঁ ওখানেই চাকরি নিয়েছি। কবে ফিরব ঠিক নেই। খুব সম্ভব কোনদিন না।’

ভোর হয়ে গেছে। সারা রাত এক ফোঁটাও ঘুমোতে পারিনি।

বলেছিলাম—‘আমার ওষুধের কারখানার কি হবে?’

—‘তুই একটা ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ডি এস সি বায়োকেমিস্ট গোপাল, তোর ভাবনা হওয়া উচিত নয়।’ অমিত আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।

বোধহয় আধ ঘণ্টার মতো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। টুকটুক জাগিয়ে দিল। —‘রেডি হবে না? প্লেন তো ন’টায়।’

—‘ঠিক। তা তুমিও যাচ্ছো নাকি?’

—‘বাঃ, তুমিই তো বললে উপহার নাকি আমার নিজে গিয়ে দিতে হবে।’

—‘এই ফ্যান্সি ড্রেসটা পরেই?’

—টুকটুক গোঁয়ারের মতো বলল, ‘হ্যাঁ।’

কালকের সেই রাজস্থানী পোশাকটা পরেছে ও, এটা পরলে ওকে রাণা প্রতাপ সিংহর যুগের রাজপুতানী সুন্দরীদের মতো দেখায়। দারুণ সেজেছে টুকটুক। আপাদমস্তক রঙিন। ম্যাচিং গয়না ঝকমক করছে। পারফ্যুমের গন্ধে ঘর ভরে যাচ্ছে।

আমি উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। ইচ্ছে ছিল, অমির সঙ্গে দিল্লি পর্যন্ত গিয়ে সী-অফ করবার। কিন্তু এত দেরিতে খবরটা জানায় সেটা সম্ভব হল না। টুকটুকের হাতে মস্ত ব্যাগের মধ্যে প্যাকেট। আমি মনে করিয়ে দিয়েছিলাম একবার। কিন্তু টুকটুকের ভুল হয়নি। খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল ও কোনটা দিচ্ছে অমিকে। সাদাটা না কালোটা। ব্যাগ ফাঁক করে দেখাল টুকটুক। গোঁয়ারের মতো মুখ। সাদাটাই। ওই সাদাটার সুতোয় সুতোয় ও বোধকরি অমি সংক্রান্ত ভাবনাগুলো বুনে রেখেছে।

অমিটা স্টেট্‌স থেকে ঘুরে আসতে পারত। জার্মানি। ফ্রান্স কিংবা ইউ কে হলেও কিছু বলার ছিল না। ওর কোম্পানি না পাঠাক, আমি পাঠাতাম। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া! ওকি চীজ-রুটি, আর ভেড়ার মাংস, কিংবা ক্রিকেট-ট্রিকেটের লোভে অস্ট্রেলিয়া চলল নাকি? কথাটা মনে করে হাসি পেল আমার। কিন্তু এয়ারপোর্ট যতই এগিয়ে আসছে, হাসি মুছে যাচ্ছে, আমার মন থেকে। মুখ থেকে। অমি চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে, আমি কেমন করে বাঁচব? আর দুজনে পাশাপাশি কাজ করতে পাবো না। আর হবে না সেইসব আড্ডা, তর্ক, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা যেগুলো আমার জীবনে অপরিহার্য ছিল, আমার ধারণা অমিতের জীবনেও ছিল। এখন সে ধারণা আমি পরম অভিমানে পাল্টে নিতে বাধ্য হচ্ছি। একা একা অমি মেলবোর্ন চলল। এখনও ভীষণ মুখচোরা। প্রয়োজনের কথা কাউকে বলতে পারে না। বিদেশি শহরে ওর একাকিত্ব যেন আমার।

ওই তো অমি। লাউঞ্জে ঢুকেই দেখতে পেলাম অমি একটা দলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছে। সব ওর সহকর্মী সহকর্মিণী। আমাদের দেখতে পেয়ে হাসল। টুকটুক বলল—‘পালিয়ে যাচ্ছেন বেশ! বাঃ!’

অমি হেসে বলল—‘যঃ পলায়তি স জীবতি মিসেস সেন।’ ওর অফিসের কলীগরা দেখলাম খুব বিচলিত, একটি অল্পবয়সী উৎসাহী ছেলে বলল—‘এখনও ভেবে দেখুন অমিতদা। আপনি না থাকলে আমাদের পুরো টিমটাই কানা হয়ে যাবে।’

অমি তার পিঠে হাত রেখে বলল—‘কথাটা ঠিক বললে না অরূপ। কারো জন্য কিছু পড়ে থাকে না। নেচার অ্যাভর্স আ ভ্যাকুয়াম, জানো না!’

—‘যতই প্রবাদ প্রবচন বলুন, আমাদের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা হল যে স্থান একবার শূন্য হয় তা আর কখনও পোরে না।’

—‘বিশ্বাস করো এ ছাড়া আমার উপায় ছিল না।’ এই অবিশ্বাস্য কথাটা আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে অমি হঠাৎ একটি সহকর্মিণীর দিকে এগিয়ে গেল; চলতে চলতে হঠাৎ পেছন ফিরে বলল—‘গোপাল, মিসেস সেন আলাপ করানো হয়নি। এই আমার স্ত্রী অর্পিতা।’ মেয়েটি দু’হাত জড়ো করে ফিরে দাঁড়াল। অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ করছিলাম—এখন ভালো করে দেখলাম স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ বুদ্ধির শ্রী মেয়েটির মুখে। ঝকঝকে দাঁতে নির্মল হাসি। ধবধবে সাদা একটা দেশী সিল্ক পরেছে, ছোট চুল পেছনে গোছা করে বাঁধা। তার পাশে কটকটে দিনের আলোয় টুকটুক যেন যাত্রাদলের রঙ মাখা সঙ।

আমাদের বিমূঢ় রেখে ওরা দুজন এগিয়ে গেল। এরোড্রোমের টারম্যাকের উপর দিয়ে ওরা হাঁটছে। প্লেনের সিঁড়ি থেকে একবার হাত তুলে বিদায় জানাল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। সিঁড়ি ফিরে আসছে। প্লেন গতি নিল বলে।

পেছন ফিরে দেখি টুকটুক দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। অমি কবে বিয়ে করল? অস্ট্রেলিয়া যাবার ব্যবস্থার মতো বিয়ের ব্যাপারটাও চুপিচুপি সেরেছে। কেন? আমাকে জানায়নি কেন? কয়েকটা বিদ্যুৎ নির্মমভাবে ঝলকাচ্ছে। আমি অমিকে মেঘের মধ্যে একবার দেখতে পাচ্ছি, একবার পাচ্ছি না। ও কি আমাকে ভয় পেয়েছে? কেন? ও কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেনি? কত কাল? ও কি আমাকে কোন দিনই…!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments