Friday, November 14, 2025
Homeবাণী ও কথাআম্র-তত্ব - প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

আম্র-তত্ব – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

আম্র-তত্ব – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

দানাপুর স্টেশনের অনতিদূরে, ইংরাজ টোলায়, লাল টালি আচ্ছাদিত লম্বা ধরনের একখানি একতলা পাকা বাড়ী ইহা রেলওয়ে গার্ডগণের জন্য নির্মিত ‘রেস্ট হাউস’ বা বিশ্রামগৃহ। সারি সারি অনেকগুলি প্রকোষ্ঠ—সমুখে ও পশ্চাতে লম্বা টানা বারান্দা। বাড়ীটির পশ্চাদ্ভাগে, দেশী খোলার ছাপ্পরযুক্ত কয়েকখানি ঘর—তাহার মধ্যে একটি বাবুর্চিখানা, অপর কয়েকখানি ভৃত্যগণের অবস্থানের জন্য সম্মুখভাবে খানিকটা খোলা জমির উপর ফুলের বাগান দুইটি বড় বড় কৃষ্ণচূড়ার গাছ সর্বাঙ্গে ফুল ফুটাইয়া বাতাসে দুলিতেছে বাকিগুলির অধিকাংশই বিলাতী ফুলের ছোট গাছ, দুই একটি দেশী ফুলও আছে।

আষাঢ় মাস। আকাশে মেঘ করিয়া রহিয়াছে। সমুখের বারান্দায় লোহার খাটে নেটের মশারির মধ্যে গার্ড ডিসুজা সাহেব নিদ্রিতা মাঝে মাঝে ফুরফুরে হাওয়ায় সে মশারি কাঁপিয়া উঠিতেছে। রাত্রি দুইটার সময় মোগলসরাই হইতে ২৬নং মালগাড়ী লইয়া ডিসুজা সাহেব দানাপুরে আসিয়াছিলেন। অদ্য বেলা ১০টায় আবার ১৫ নং লোকাল প্যাসেঞ্জার লইয়া তাঁহাকে মোগলসরাই ফিরিতে হইবে।

বেলা ৮টা বাজিল। রৌদ্র নাই, তাই বেলা বুঝা যাইতেছে না। বাঙ্গালার খানসামা নগ্নপদে ধীরে ধীরে আসিয়া সাহেবের শয্যার নিকট দাঁড়াইল। লাল ডোরাকাটা কানপুর টুইলের পায়জামা-সুট পরিয়া সাহেব গভীর নিদ্রায় মগ্না কোটের বুকের অধিকাংশ বোতামই খোলা। খানসামা ডাকিল, “হুজুর।”

হুজুরের সাড়া নাই।

খানসামা আবার ডাকিল, “আঠ বাজ গিয়া সাহেব—জাগিয়ে।”

অবশেষে খানসামা মশারির ভিতর হস্ত প্রবেশ করাইয়া দিয়া, সাহেবের হাঁটু ধরিয়া নাড়া দিয়া বলিল, “জাগিয়ে হুজুর। আঠ বাজ গিয়া।”

সাহেব তখন উঃ করিয়া চক্ষু খুলিলেন। একটি হাই তুলিয়া, বালিসের নীচে হইতে নিজ বৃহদাকার সরকারী ওয়াচটি বাহির করিয়া দেখিলেন, আটটা বাজিয়া বারো মিনিট।

সাহেব বিছানায় উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, “গোসল ঠিক করো।”

“ঠিক হায় হুজুর”—বলিয়া খানসামা চলিয়া গেল।

সাহেব শয্যা হইতে নামিয়া, কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া হুক হইতে ঝুলানো নিজ কোটের পকেট হইতে পাইপ, দেশলাই ও তামাকের পাউচ বাহির করিয়া লইলেন। ভিতরের বুক পকেটে একখানি চিঠি ছিল, তাহাও বাহির করিলেন।

একখানি ঈজি চেয়ারে বসিয়া, পাইপ ধরাইয়া, পত্রখানি খুলিয়া সাহেব পড়িত লাগিলেনা পত্রখানি মজঃফরপুর স্টেশন মাস্টারের কন্যা, কুমারী বার্থা ক্যাম্বেল কর্তৃক লিখিত। বার্থার সহিত ডিসুজা সাহেব বিগত এপ্রিল মাস হইতে বিবাহপণে আবদ্ধ। অক্টোবর মাসে ডিসুজা সাহেবের একমাস ছুটি ‘ডিউ’ হইবে—ছুটি হইলেই বিবাহ, ও সিমলা শৈলে গিয়া মধুচন্দ্র-যাপন স্থির হইয়া আছে।

পত্রখানি আজ তিনদিন হইতে সাহেবের পকেটে পকেটে ঘুরিতেছে। ফেরৎ ডাকে উত্তর দিবার জন্য অনুরোধ ছিল, তাহা হইয়া উঠে নাই—আজ উত্তর দিয়া পত্রখানি ডাকে ফেলিতেই হইবে।

পাইপ শেষ করিয়া, ক্ষৌরকার্য ও স্নানাদি অন্তে সাহেব যখন বাহির হইলেন তখন ৯টা বাজিয়া গিয়াছে। মোকামা-মোগলসরাই লোক্যালখানি ঠিক সাড়ে নয়টার সময় দানাপুরে পৌঁছিবে। সেই সময় স্টেশনে উপস্থিত হইয়া, ট্রেনের চার্জ বুঝিয়া লইতে হইবে—সুতরাং পত্র লেখার বাসনা পরিত্যাগ করিয়া সাহেব “হাজারি” আনিবার হুকুম করিলেন পত্ৰলেখার সময় হইল না বলিয়া সাহেবের মনটা কিছু অপ্রসন্ন, তাঁহার মুখভাব হইতে স্পষ্টই ইহা বুঝা যাইতেছিল।

খাদ্যদ্রব্যের প্রথম কিস্তি টেবিলে আসিলা দুইখানি টোস্ট, মাখন ও চা। দুইটি “আণ্ডা বইল’ ছিল—সাহেব প্রথম ডিম্বটি ভাঙ্গিয়া দেখিলেন—পচা তাহা সরাইয়া রাখিয়া, দ্বিতীয়টি ভাঙ্গিয়া, মাখন ও টোস্ট সহযোগে ভক্ষণ করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঔর ক্যা হায়?”

খানসামা উত্তর করিল, “মটন চাঁপ হায়, ঠানটা রোস হায়, কারি-ভাত হায়।” বলিতে বলিতে খানসামার সহকারী একটি ঢাকা পাত্রে মটন চাঁপ আনিয়া টেবিলে রাখিল।

সাহেব ৩/৪ খানি চপ প্লেটে তুলিয়া লইয়া, ছুরি দিয়া কাটিয়া মুখে তুলিলেন। খানিক চর্বণ করিয়া বলিলেন, বহুৎ কড়া হায়, মটন নেহি হায়।”

খানসামা বলিল, “গোট-মটন হায় হুজুর—আসল মটন ত আজ মিলা নেহি।”

সাহেব দ্বিতীয় একখানি চপ কাটিয়া, চর্বণ করিবার বৃথা চেষ্টার পর রাগিয়া বলিলেন, “লে যাও। ফেঁক দেওা কুত্তাকো মৎ দেও—উস্কা দাঁত টুট যায়েগা।”

খানসামা প্লেট উঠাইয়া লইয়া সহকারীকে বলিল, “রোস লাও—কারি ভাত লাও—জলদি।”

গত রাত্রে রোস্ট করা লেগ-অব-মটনের কিয়দংশ ছিল, তাহা হইতে টুকরা দুই কাটিয়া সাহেব ভক্ষণ করিলেন—ভাল লাগিল না।

সাহেব তখন কারি-ভাত-চাহিলেন। মুর্গীর কারি—পাত্র হইতে হু-হু করিয়া ধোঁয়া উঠিতেছে। প্লেটে লইয়া মুখে দিয়া দেখিলেন, চর্বণ করা তাঁহার কর্ম নয়।

সাহেব গর্জন করিয়া উঠিলেন, “ক্যা হুয়া? ইয়ে ক্যা হায়? ইউ ড্যাম উল্লুকা বাচ্চা, হাম তুমারা উপর রিপোট কর দেঙ্গে—সী ইফ আই ডোন্ট”—বলিয়া কাঁটা চামচ ফেলিয়া সাহেব উঠিয়া পড়িলেন। ঘড়ি দেখিলেন নয়টা বাজিয়া সাতাশ মিনিটা হ্যাট লইয়া বাহির হইয়া দ্রুতপদে স্টেশন অভিমুখে অগ্রসর হইলেন।

যথাসময়ে ট্রেন দানাপুর ছাড়িল। খান পাঁচ ছয় আরোহীগাড়ী, বাকি সমস্তই মাল বোঝাই ওয়াগনা প্রত্যেক স্টেশনে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া, সন্ধ্যা নাগাদ গাড়ী মোগলসরাই পৌঁছিবো।

গোটা দুইতিন স্টেশন পার হইলে, ডিসুজা ক্ষুধার তাড়নায় ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিল। ট্রেনের চার্জ লইবার সময় সে দেখিয়াছিল, ব্রেকভ্যানে মেঝে হইতে গাড়ীর ছাদ পর্যন্ত আমের ঝুড়ি বোঝাই করা আছে। এ সময় দ্বারভাঙ্গা অঞ্চল হইতে বিস্তর আম চারিদিকে চালান যাইয়া থাকে। সাহেব ভাবিল, গোটাকতক আম বাহির করিয়া ততক্ষণ খাওয়া যাউক।

এই ভাবিয়া সাহেব ব্রেকভ্যানের দ্বার খুলিল। প ফলের লোভনীয় সুমিষ্ট গন্ধ ক্ষুধার্তের নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করিল।

সামনেই একটা বৃহৎ ঝুড়ি মুখটার উপর আচ্ছাদনখণ্ড দড়ি দিয়া সেলাই করা, সেলাইয়ের ফাঁক দিয়া কালো কালো আমপাতা উঁকি দিতেছে। ডিসুজা পকেট হইতে ছুরি বাহির করিয়া, সেলাই কাটিয়া, ভিতরে হাত ভরিয়া দিল। প্রথমটা কেবল পাতা, আরও নিম্নে হাত ঢুকাইয়া ডিসুজা একটি আম বাহির করিল। দেখিল, বৃহদাকার উৎকৃষ্ট ল্যাংড়া আরও একটা আম বাহির করিয়া, ব্রেকভ্যানের দ্বার বন্ধ করিয়া স্বস্থানে আসিয়া বাক্স হইতে একখানি প্লেট বাহির করিল। সাহেব আম দুইটিকে সোরাইয়ের জলে উত্তমরূপে ধৌত করিল। তাহার পর সে দুইটি কাটিয়া, পরম পরিতৃপ্তির সহিত ভোজন আরম্ভ করিল।

ভোজন অর্ধ শেষ হইতেই, গাড়ী আসিয়া কৈলোয়ার স্টেশনে দাঁড়াইল। স্টেশন মাস্টার রামতারণ মিত্র ধুতির উপর হেঁড়া চাপকান পরিয়া গাড়ী পাস’ করিতে আসিয়াছেন। ব্রেকভ্যানে আসিয়া বলিলেন, “গুড মর্নিং মিস্টার ডিসুজা কিছু পার্শেল-টার্শেল নামবে নাকি?”

সাহেব আম খাইতে খাইতে বলিল, “কুছু না।”

“বাঃ—বেশ আম ত! খাসা গন্ধ বেরিয়েছে—পার্শেলের আম বুঝি?”

সাহেব শিরশ্চালনা করিয়া বলিল, “খাইবে?”

“দাও না সাহেব।”—বলিতে বলিতে রামতারণ বাবু ব্রেকভ্যানে উঠিলেন।

সাহেব বলিল, “দরজা খোলা ঐ—ঐ সামনের বাস্কেট হইতে দুইটা লও।”

রামতারণ বাবু ঝুড়ির আবরণ চাড়া দিয়া তুলিয়া ধরিয়া, এ-পকেটে দুইটা ও-পকেটে দুইটা এবং হাতে দুইটা আম লইয়া বাহির হইলেনা

সাহেব বলিল, “পান আছে?”

“আছে বৈ কি”—বলিয়া বাবু পকেট হইতে ডিবা বাহির করিয়া, দুইটি পান সাহেবের “ভ্যানবুক” নামক বহিখানির উপর রাখিয়া দিলেন। নামিয়া, ঘণ্টা দিতে বলিলেন—গাড়ী ছাড়িল।

সাহেব হাত ধুইয়া, ড্রাইভারকে সবুজ ঝাণ্ডী দেখাইয়া পান দুটি খাইতে যাইতেছিল, এমন সময় তাহার মনে হইল, ক্ষুধা এখনও ভাঙ্গে নাই, আর গোটা দুই আম খাইলে মন্দ হইত না। যেমন ভাবনা কার্যও সেইরূপ আহারান্তে মুখ হাত ধুইয়া পান খাইতে খাইতে, গাড়ী আরা স্টেশনে আসিয়া দাঁড়াইলা

আরা অপেক্ষাকৃত বড় স্টেশন স্টেশন মাস্টার গাড়ী পাস করিতে আসেন নাই— আসিয়াছেন জেনারেল এসিস্ট্যান্টা বাবুটির বয়স হইয়াছে, চোখে রূপার ফ্রেমযুক্ত চশমা। ব্রেকভ্যানে উঠিয়া বলিলেন, “হ্যালো মিস্টার ডিসুজা—ম্যাঙ্গো স্মেলিং—বিউটিফুল।”

সাহেব হাসিয়া বলিল, “ফাইন ল্যাংড়াজা খাইবে?”

“দাও না সাহেব গোটা কতক।”

ডিসুজা সেই ঝুড়ি হইতে গোটা চারি আম বাহির করিয়া বাবুটিকে দিল। ব্রেকভ্যান বন্ধ করিয়া স্টেশনের আপিসে গেল—এখানে কয়েকখানা মালগাড়ী কাটিতেছে—দেরি হইবো স্টেশন মাস্টার তখন বাড়ীতে, আহারান্তে নিদ্রাগত। তাঁহার পুত্র চারু ও কন্যা কমলা সেখানে খেলা করিতেছিল। জেনারেল বাবুর হাতে আম দেখিয়া এবং তাহা ডিসুজা সাহেব দিয়াছে শুনিয়া, চারু ও কমলা বাহানা ধরিয়া বসিল, ‘সাহেব, আমরাও আম খাবা”—বলিয়া তাহারা সাহেবের হাঁটু ধরিয়া লাফাইতে লাগিল।

সাহেব বলিল, “আচ্ছা, তুমিরা হামার জন্যে পান লইয়া আসে। হামি আম দিবে।”

চারু ও কমলা ডিসুজা সাহেবের জন্য পান আনিতে ছুটিল। তাহারা ইহাকে “পানখেকো সাহেব” বলিতা পূর্বেও কতবার সাহেবের পান আনিয়া দিয়াছে।

পান লইয়া, সাহেব ইহাদিগকে ব্রেকভ্যানে লইয়া গিয়া, স্বহস্তে ঝুড়ি হইতে বাহির করিয়া আম দিল। ইহারাও “আরও দাও—আরও দাও” করিয়া, কোঁচড় ও অঞ্চল ভরিয়া আম লইয়া, আনন্দে নৃত্য করিতে করিতে গৃহে ফিরিয়া গেলা

এইরূপে প্রতি স্টেশনে “দাতব্য” করিতে করিতে এবং মাঝে মাঝে খাইতে খাইতে, বেলা ৫টা নাগাইদ ঝুড়িটি প্রায় খালি হইয়া গেলা সকলডিহার স্টেশন মাস্টারকে ঝুড়ির ইতিহাস বলিতে বলিতে দুইটি আম দিবার সময় ডিসুজা দেখিল, বড় জোর আর গুটি ১৫/১৬ আম নিম্নে পড়িয়া আছে। স্টেশন মাস্টার বাবু বলিলেন, “তা সাহেব, দিলে দিলে, একটা ঝুড়ি থেকেই সব দিলে কেন? এত ঝুড়ি ত রয়েছে! ভাগাভাগি করে নিলেই ত হ’ত!”।

সাহেব বলিল, “এ আমগুলি খুব চমৎকার যে! অন্য ঝুড়ির আম কেমন হইত তাহার ঠিক কি?”

বাবু হাসিয়া বলিলেন, “তা বটে। আর, পাঁচজনের অভিশাপ কুড়ানোর চেয়ে, একজনের অভিশাপই ভালা”

সাহেব বলিল, “ঝুড়িটি একেবারেই খালি হইয়া গেল। এই খালাসী-লাইন সে থোড়া পাত্থল উঠাও ত।”

খালাসী পাথর উঠাইয়া ব্রেকভ্যানের উপর রাখিতে লাগিল। অনেকগুলা জমিলে, সাহেবের আদেশ অনুসারে খালাসী উঠিয়া, আমের ঝুড়ি হইতে আমগুলা বাহির করিয়া, পাথর ভরিয়া, তাহার উপর আম, তাহার উপর আমপাতা চাপাইয়া দিলা গাড়ী ছাড়িলে সাহেব স্বহস্তে ঝুড়ির মুখ আবার সেলাই করিয়া দিল। গুনছুঁচ, দড়ি প্রভৃতি এইরূপ কুকার্যের জন্য গার্ডসাহেবদের বক্সেই মজুত থাকে।

সন্ধ্যার পূর্বেই ট্রেন মোগলসরাই পৌঁছিল।

কাজকর্ম সারিয়া, বাড়ী যাইবার পূর্বে ডিসুজা কেলনারের হোটেলে গিয়া এক পেয়ালা চা হুকুম করিয়া, রুটিতে মাখন মাখাইয়া খাইতে আরম্ভ করিয়া দিল।

চা পানান্তে বাহির হইয়া বাড়ী যাইতেছিল, পথে রেলওয়ে ইনস্টিটুটের কাছে দুইজন বন্ধু তাহাকে গ্রেপ্তার করিল। বলিল, “চল, এক হাত পোকরা খেলা যাউক।”

ইনস্টিট্যুটে “পানীয়” মিলে, তাহার নগদ দামও দিতে হয় না। ডিসুজা সহজেই সম্মত হইল।

দুই বাজি পোকর খেলিতে ও কয়েক পাত্র হুইস্কি পান করিতে রাত্রি সাড়ে আটটা বাজিয়া গেলা ডিসুজা তখন বলিল, “বাড়ী যাই—আমার ক্ষুধা পাইয়াছে।”বাড়ীতে কেবল ডিসুজার বৃদ্ধ মাতা আছেন

বাঙ্গালায় পৌঁছিয়া ডিসুজা দেখিল, তাহার মাতা রাগিয়া আগুন হইয়া বসিয়া আছেন। মেঝের উপর আমের একটি ঝুড়ি, আশে পাশে আম পাতা ছড়ান, একস্থানে গুটি ১৫/১৬ আম, এবং এক বোঝা পাথরের টুকরা।

মত্ততার অবস্থায় ডিসুজা ব্যাপারটা ঠিক বুঝিতে পারিল না।

মিসেস ডিসুজা বলিলেন, “এই যে জন কোন ট্রেনে ফিরলে?”

ডিসুজা সে কথার উত্তর না দিয়া বলিল, “এ–বাস্কেট—কোথা হইতে আসিল?”

“মজঃফরপুর হইতে আজ দ্বিপ্রহরে তোমার হবুশ্বশুরের পত্র পাইলাম, ১৫০টা ভাল ল্যাংড়া আম পাঠাইতেছেন, খুব সম্ভব ১৫ নম্বরে তাহা এখানে আসিয়া পৌঁছিবে। লিখিয়াছিলেন, রসিদ ডাকে আসিতে বিলম্ব হইতে পারে, ১৫ নম্বর আসিলে স্টেশনে লোক পাঠাইয়া যেন ঝুড়িটা আনাইয়া লই। ট্রেন পৌঁছিবার আধ ঘণ্টা পরেই আমি স্টেশনে গিয়া বাস্কেট আনিলাম। আনিয়া খুলিয়া দেখি—আম সব চুরি গিয়াছে, আমের স্থানে পাথর বোঝাই করিয়া দিয়াছে। দেখ দেখি কাণ্ড! কি ভয়ানক কথা! ফিফটিন আপ-এ গার্ড কে ছিল খবর নাও ত!” ডিসুজা বলিল, “ফিফটিন আপ—আমিই ত লইয়া আসিয়াছি।” “তুমি?—তুমি তবে এতক্ষণ ছিলে কোথা?—তুমি?—তবে আম কে লইল? বোধ হয় দীঘায়— অথবা বাঁকীপুরে

ডিসুজা বলিল—“না—না— ও—ও—আম—আ-আ-আমিই খাইয়াছি।”

বৃদ্ধা ইতিপূর্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন, পুত্র প্রকৃতিস্থ নাই। বলিলেন, “তুমি খাইয়াছ—এই এক ঝুড়ি আম? অসম্ভব!”

ডিসুজা নিকটস্থ চেয়ারে বসিয়া বলিল, “বড়ই ক্ষুধা পাইয়াছিল—তাই খা—খা—খাইয়া ফেলিয়াছি।”

মাতা বলিলেন, “ননসেন্স। একথা এখন তোমাকে বলিয়া কোনও ফল নাই। কল্য প্রাতে এসম্বন্ধে রীতিমত তদন্ত করিয়া, ব্যাপারটা উপরিওয়ালাদের জানাইতে হইবো সহজে আমি ছাড়িতেছি না। এতগুলা আম! রেলের কর্মচারীরা কি চোর! কি পাষণ্ড! ছি ছি ছি!”

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here


Most Popular

Recent Comments