Saturday, April 20, 2024
Homeবাণী-কথাঅলৌকিক - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

অলৌকিক – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

একদিন দিব্য স্নান শেষ করার আগেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে পড়েছিল দরজা খুলে। নিজের শোওয়ার ঘরে না গিয়ে সে টানা বারান্দা পেরিয়ে নামতে শুরু করে দিল সিঁড়ি দিয়ে। তারপর সদর দরজা পার হয়ে চলে এসেছিল রাস্তায়। তখনও তার কিছু খেয়াল হয়নি।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ছোট রাস্তা, একটু পরে বাঁ-দিকে বেঁকে আর-একটা রাস্তা, তারপর এক মিনিট গেলে ট্রাম লাইন। দিব্য ছোট রাস্তাটা পেরিয়ে দ্বিতীয় রাস্তা পর্যন্ত চলে এসেছে, তখন তার চোখ পড়ল চন্দনের দিকে। চন্দনকে যেন ভূতে থাপ্পড় মেরেছে, তার মুখখানা এমনই বিহ্বল। চন্দন চোখের পাতা ফেলতে পারছে না।

চন্দনের চোখে দিয়েই যেন দিব্য নিজেকে দেখতে পেল। সে সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তার গায়ে সাবানের ফেনা।

জামা-কাপড় না থাকলে বোধহয় মানুষ নিজের শরীরটাকে খুব ছোট্ট মনে করে। নইলে দিব্য কেন ভাবল আড়াআড়িভাবে দুটো হাত চাপা দিলেই সে তার নগ্নতা লুকোতে পারবে?

চন্দন কিছু বলবার আগেই দিব্য পেছন ফিরে ছুটল! বাড়িতে গিয়ে সিঁড়ির প্রথম ধাপে আছাড় খেয়ে তার থুতনি ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল! এই সব কিছুই পাগলের মতন।

দিব্যকে যদি কেউ-কেউ পাগল ভাবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ওই অবস্থায় শুধু তো চন্দন তাকে একা দেখেনি, অনেকেই দেখেছে। এ-বাড়ি ও-বাড়ির বারান্দায়, মোড়ের। দোকানপাট থেকে। মানুষ তার গৌরবের সময় প্রায়ই নিঃসঙ্গ থাকে। কিন্তু অপমানের মুহূর্তে সাক্ষীর অভাব হয় না।

চন্দন অবশ্য পরে এ বিষয়ে একটা কথাও উচ্চারণ করেনি। পাড়ার কেউই কিছু বলেনি। দিব্যর বয়েস আটত্রিশ, সে প্যান্টের ভেতর সার্ট গুঁজে, মোজা ও শু পরে অফিস যায়। পাড়ার সবাই তাকে একই সঙ্গে উদার ও বুদ্ধিমান বলে জানে, তাই কিঞ্চিৎ সমীহ করে।

দিব্য নিজেই পরে অনেক ভেবেও বুঝতে পারেনি যে সেদিন সে কেন ওই অবস্থায় বাথরুম থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে গিয়েছিল। হঠাৎ কি তার মনে পড়ে গিয়েছিল কোনও জরুরি কাজের কথা? কী সেই জরুরি কাজ?

বাথরুমে মানুষ নগ্ন থাকে, অন্যমনস্ক থাকে, নিজের চরিত্রটা বদলে ফেলে, বয়েসের খেয়াল। থাকে না এই সবই ঠিক, কিন্তু কোমরের নীচে কিছু না জড়িয়ে কেউ তো বাইরে বেরোয় না। ভুল মনা অধ্যাপকদের সম্পর্কে অনেক গল্প শোনা যায়, কিন্তু দিব্য তো সেরকমও নয়। দিব্য বেশ মেপে-টেপে কথা বলে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে।

অনেকদিন আগে অবশ্য আর একবার এরকম হয়েছিল, সেটা কাশীতে। দিব্যর বয়েস তখন এখনকার অর্ধেক। কী কারণে যেন সেবার কাশীতে দেড়-দু-মাস থাকা হয়েছিল, মাসি-পিসিদের সঙ্গে সাময়িক যৌথ পরিবারের অছিলায়। টুনু ও পিনাকীর সঙ্গে দিব্য গঙ্গায় সাঁতার কাটতে নেমেছিল।

দিব্য সাঁতার জানে, পিনাকীই ছিল খানিকটা দুর্বল, তাকে সামলাচ্ছিল অন্য দুজন। হঠাৎ এক সময় দিব্য ওপরে উঠে এল। সুইমিংট্রাঙ্ক নয়, জাঙ্গিয়া পরে নেমেছিল, সেটা যে শুধু পরা নেই তা নয়, সে সম্পর্কে তার কোনও সই নেই। জাঙ্গিয়া আপনা আপনি খুলে যাওয়া খুব স্বাভাবিক নয়, দিব্য কি ইচ্ছে করে খুলে ফেলেছিল? তার মনে নেই।

কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে সবসময় হাজার লোকের ভিড়। পাগল ভিখিরি ও সন্ন্যাসীর সংখ্যাও যথেষ্ট। দিব্যকে ওই অবস্থায় উঠে আসতে দেখে কেউ হইহই করে ওঠেনি, কেউ কোনও মন্তব্য করেনি।

ওদের স্নেহ মাসি আর রথীন মেসো বসে ছিলেন একটু দূরে জামা-কাপড় সামলাবার জন্য। আর ছিল দু-তিনটে কাচ্চা-বাচ্চা পিসতুতো-মাসতুতো ভাই বোন। রথীন মেসো হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন, কাচ্চা-বাচ্চারা হাততালি দিয়েছিল আর স্নেহ মাসিও হাসতে-হাসতে একটা তোয়ালে ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, এই পাগল, তুই সোজা উঠে এলি, অ্যাঁ?

রথীন মেসোর হাসির চেয়েও স্নেহ মাসির অত হালকা সুরে কথা বলাটাই দিব্যর স্মৃতিতে গেঁথে। আছে। তখন দিব্যর উনিশ-কুড়ি বছর বয়েস, সে একটি পূর্ণাঙ্গ যুবক, তাকে ওই অবস্থায় দেখেও স্নেহ মাসি দিব্যকে একটি শিশুর মতন গ্রহণ করেছিলেন কী করে? পরে অনেকবার স্নেহমাসি হাসতে-হাসতে পারিবারিক মজলিসে ওই গল্প বলেছেন, জানো সেজদি, দিব্যটা এমন পাগল, ওই রকমভাবে যে উঠে এসেছে, তা খেয়ালই নেই। আমি তোয়ালেটা ছুঁড়ে দিলুম, তা দিয়ে প্রথমে মাথা মুছতে লাগল!

দিব্যর মা অবশ্য বরাবরই এ গল্পটা অবিশ্বাস করেছেন। একমাত্র মেয়েরাই বোধহয় প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের নগ্নতা মেনে নিতে পারেন না।

কেন কাশীর গঙ্গা থেকে দিব্য ওইরকমভাবে হঠাৎ উঠে এসেছিল তা সে আজও মনে করতে পারে না। সে তার চৈতন্যের গভীরতম দেশ পর্যন্ত খুঁজে দেখতে রাজি আছে এর উত্তর পাওয়ার জন্য। কিন্তু খানিকটা ডুব দিয়েই সে অন্য চিন্তায় হারিয়ে যায়।

আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল, সেটা অবশ্য নগ্নতার কিছু নয়। মাত্র দেড় বছর আগেকার কথা। সেদিন দিব্য খানিকটা মদ্য পান করেছিল, আড়াই-তিন পেগের মতন। দিব্য অত্যন্ত সেয়ানা মাতাল। যাদের মধ্যে ভদ্রতাবোধ অতি প্রবল তারা সহজে মাতাল হয় না। অফিসের পার্টিতে কিংবা বন্ধুমহলে দিব্যর এইরকম একটা বিভ্রান্তিকর খ্যাতি আছে যে ছ-সাত পেগ হুইস্কি খেলেও দিব্যর পা টলে না, জিভ জড়ায় না। এমন কি একবার বোম্বাই গিয়ে হোটেলে পার্টির হই-চই তে সাত পেগ মদ খাওয়ার পর জেনারেল ম্যানেজারের অনুরোধে দিব্য একটা জরুরি চিঠি ড্রাফট করেছিল, তার হাতের লেখা একটুও বদলায়নি, ভাবের প্রেসেন্টটেন্স থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বারে সে একবারও এস দিতে ভুল করেনি। অফিসে দিব্যর এই চিঠি লেখার গল্প কিংবদন্তি হয়ে আছে।

সেই দিব্য এয়ারপোর্ট হোটেলের অফিসের পার্টিতে থেকে মাত্র আড়াই তিন পেগ হুইস্কি খেয়ে হঠাৎ কারুকে কিছু না বলে বাইরে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরেছিল। সোজা যোধপুর পার্ক। কম দূর তো নয়। এর মধ্যে দিব্য একটুও ঘুমিয়ে পড়েনি, ট্যাক্সি ড্রাইভারকেও নির্দেশ দিতে একবারও ভুল করেনি। যোধপুর পার্কের রাস্তাগুলো খুব গোলমেলে, বিশেষত গভীর রাত্রে। দিব্য তবু ঠিক বাড়ির সামনেই এসে উপস্থিত হয়েছিল।

দোতলা বাড়ি সামনে খুবই সামান্য, ক্ষমাপ্রার্থীর মতন এক চিলতে বাগান। হাফ গেট অনায়াসেই খোলা যায়, এইসব বাড়িতে হিংস্র কুকুর থাকা খুব স্বাভাবিক। দিব্য সেসব গ্রাহ্যই করেনি। একতলার দরজা কেন খোলা ছিল কে জানে, দিব্য সটান উঠে গিয়েছিল দোতলায়। তারপর বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কলিংবেলের বোতামে ডান হাতের তর্জনী চেপে ধরেছিল।

এ-বাড়িতে দিব্য আগে কখনও আসেনি, দূর থেকে দু-একবার দেখেছে মাত্র। দিব্য কি জানতো ডঃ খান্ডেলকর সে রাত্রে বাড়িতে থাকবেন না? দিব্য পরে বহুবার এ তথ্য অস্বীকার করেছে। ডঃ খান্ডেলকর কখন কোথায় যান তা দিব্যর জানবার কথা নয়। দিব্য আর ডঃ খান্ডেলকরের গ্রহ আলাদা।

একটানা কলিং বেল বাজার পর দরজা খুললেন মিসেস খান্ডেলকর। গলা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঝোলা একটা সাদা রঙের রাত-পোষাক পরা। মাথার সব চুল খোলা, ক্রিম মাখা মুখখানা। চকচকে। এমন পোষাকে, এমন প্রসাধনে দিব্য ওই মিসেস খান্ডেলকর নাম্নী রমণীকে আগে। কখনও দেখেনি। আসলে সে ওঁকে এর আগে দেখেছেই মাত্র তিনবার, নিছক সৌজন্য—আলাপ, বাংলায় কথাবার্তা হলেও আপনি ছেড়ে তুমিতে নামেনি। দরজা খোলার পর সেই শ্বেতবসনা রমণীকে দেখে দিব্য বলেছিল, কেমন আছ, মহাশ্বেতা?

মিসেস খান্ডেলকর বাঙালি হলেও তাঁর নাম মহাশ্বেতা নয়। কুমারী জীবনে তাঁর নাম ছিল অনসূয়া রায়।

প্রগাঢ় বিস্ময়ে তিনি কিছুক্ষণ কোনও কথাই বলতে পারলেন না।

দিব্য ফট করে দশটা জানালা খোলার মতন অনেকখানি হেসে বলেছিল, তুমি ভালো আছো তো, সেই খবরটা নিতে এলাম?

শ্ৰীমতী খান্ডেলকর বললেন, হোয়াট হ্যাপন্ড টুইউ? আর ইউ…অর আই…ইন…ইজ সাম ট্রাবল? আর ইউ লস্ট?

দিব্য বলল, নো, নো, নো, নাথিং হ্যাপন্ড টু মি, আই ওয়াজ জাস্ট পাসিং গ্রু। ভাবলুম, তোমার খবরটা একবার নিয়ে যাই।

শ্ৰীমতী খান্ডেলকর এবার বাংলায় বললেন, কিন্তু, এত রাত্তিরে আপনি এদিকে কোথায় যাচ্ছিলেন, আপনার বাড়ি তো মানিকতলায়!

মানিকতলা যেন একটা দুর্বোধ্য শব্দ, এই ভাবে দিব্য একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল শ্রীমতী খান্ডেলকরের দিকে। কোনও উত্তর দিল না।

আপনার সঙ্গে গাড়ি আছে?

মহাশ্বেতা, তুমি ভালো আছ?

আপনি মহাশ্বেতা কাকে বলছেন? আপনার নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে। ভুল জায়গায় এসেছেন।

কিছু ভুল হয়নি। তুমি নিজেকে চেনো না? তুমি কাদম্বরীর একটা চরিত্র, মনে নেই? তুমি কেমন আছো আজ?

আপনি বাড়ি যান!

না, আমি আজ এখানেই থাকব, তোমার সঙ্গে সারারাত গল্প করব।

প্লিজ, একথা বলবেন না। আপনার সঙ্গে যদি গাড়ি না থাকে, আমার চিন্তা হচ্ছে আপনি কী করে। ফিরবেন, কিন্তু…এখানে থাকা সম্ভব নয়, আপনি একটু বুঝবার চেষ্টা করুন…

শ্ৰীমতী খান্ডেলকর যদি তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতেন তাহলে দিব্য নিশ্চয়ই সেই দরজায় আবার দুমদুম করে ধাক্কা দিত। উনি যদি রূঢ় ব্যবহার করতেন, দিব্য চেষ্টা করত জোর করে ভেতরে ঢুকে পড়তে। কিন্তু উনি দরজা খোলা রেখে মুখে এমন একটা বেদনার্ত দাবির ভাষা ফোঁটালেন যে দিব্য তখুনি মরমে মরে গেল। কোনওরকম বিদায় না জানিয়েই সে ছুট দিয়েছিল নীচের দিকে।

ট্যাক্সিটা দিব্যর জন্য অপেক্ষা করে ছিল না, সে থাকতেও বলেনি। দিব্য সে ব্যাপারে চিন্তাই করল না, সে আঁকাবাঁকা পায়ে হাঁটতে লাগল।

একটা কথাই শুধু ঘুরছিল তার মাথায়। খান্ডেলকরের বাড়িতে অন্তত দু-তিনজন দাস-দাসী থাকবেই। এত রাত্রে বেল দেওয়ার পর অনসূয়া, না, না, মহাশ্বেতা নিজেই কেন দরজা খুলে দিল? সে কি কারুর জন্য প্রতীক্ষা করছিল উঁহু, এরকম হতেই পারে না। তবে?

রাত একেবারে নিঝঝুম। এখন লোডশেডিং আছে কি নেই তা বোঝবারও উপায় নেই। দিব্য কোনদিকে হাঁটছে সে জানে না।

খানিক পরে তিন-চারটে ভুতুড়ে চরিত্র তাকে ঘিরে ফেলল। তাদের দাবি অনুযায়ী সে খুলে দিল হাতঘড়ি, পকেট থেকে পার্স। দিব্যর ঠোঁটে ফুরফুরে হাসি, সে যেন এসব ব্যাপারে বেশ মজা পাচ্ছে। ছায়ামূর্তির দিব্যর পার্সটা খুলে অসুখী ভাবে গজরাতে শুরু করতেই দিব্য বলেছিল, ওতে কিছু হল না? আমার হাওয়াই শার্টটা নেবে? প্যান্ট নেবে? খুলে দিচ্ছি!

একজন নিশাচর এগিয়ে এসে দিব্যর গালে জোরে এক থাপ্পড় কষিয়ে বলল, হারামির বাচ্চা, মাল খেয়ে আমাদের সঙ্গে মজাক করতে এসেছিস? যা, বাড়ি যা!

ওরা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরেও দিব্য একা ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফিক-ফিক করে হাসতে লাগল।

এসব কোনও কিছুই দিব্যর চরিত্রের সঙ্গে মানায় না। তার ঘনিষ্ঠ মানুষজনেরা বলবে, অসম্ভব, অবিশ্বাস্য!

দুই

নামের পরিচয়ে মহারাষ্ট্রের মানুষ হলেও দু-পুরুষ ধরে খান্ডেলকরেরা কলকাতায় প্রবাসী। অজয় খান্ডেলকরের দুই দাদাই উচ্চ পদস্থ ব্যাঙ্ক কর্মচারী, অজয় নিজে একজন অর্থনীতির পণ্ডিত। ওঁর। বোন একটি বাংলা সংবাদপত্র সম্পাদকের স্ত্রী।

অজয় খান্ডেলকর দক্ষিণ কলকাতার একটি স্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারিতে ফার্স্ট হয়েছিলেন, ইংরেজি ও বাংলায় সেবারে পেয়েছিলেন সর্বোচ্চ নম্বর।

তারপর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাপগুলো অবহেলায় মেডেল তুলতে-তুলতে পেরিয়ে গিয়ে তিনি চলে গেলেন আমেরিকা। সেখান থেকে তিন বছর বাদে দেশে বেড়াতে এসে তিনি বম্বে-পুনে ঘুরে ট্রেনে এলেন হাওড়ায়। তারপর কলকাতা শহরে না ঢুকে পরবর্তী ট্রেনে চলে গেলেন শান্তিনিকেতনে।

অনসূয়ার সঙ্গে এর আগে কলকাতায় তাঁর দুবার মাত্র দেখা হয়েছিল। সৌজন্য মূলক আলাপ পরিচয় হয়েছিল, তার বেশি কিছু নয়। অজয় খান্ডেলকরের আশঙ্কা ছিল অনসূয়া তাঁকে চিনতে পারবে কি না।

অজয় খান্ডেলকরের চেহারায় বৈশিষ্ট্য আছে, একবার দেখলে ভুলে যাওয়ার কথা নয়। প্রায় সাহেবদের মতন ফরসা রং, মেদহীন লম্বা শরীর, লম্বাটে মুখ, তীক্ষ্ণনাক, অত্যন্ত গাঢ় ভুরু। সম্ভবত ওই ভুরুর জন্যই তার চোখ দুটি বেশি উজ্জ্বল দেখায়। তাঁর বাংলা উচ্চারণে সামান্যতম আড়ষ্টতা নেই।

পূর্বপল্লীর গেস্টহাউসের প্রায় উলটোদিকেই অনসূয়াদের বাড়ি। হঠাৎ দেখা হওয়ায় অনসূয়া বেশ খুশি হয়ে উঠেছিল!

আপনি? আমেরিকা চলে গিয়েছিলে কেন? কবে ফিরলেন?

ফিরিনি এখনও।

শান্তিনিকেতনে আপনার কোনও লেকচার আছে বুঝি?

একটুও দ্বিধা না করে সহাস্য মুখে অজয় খান্ডেলকর বলেছিলেন, না, আমি শুধু আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্য এসেছি।

এরকম কথা অনেকেই বলে। অনসূয়া এটাকে হালকা রসিকতা হিসাবেই নিয়েছিল। তাদের বাড়িতে ডেকে এনে অজয় খান্ডেলকরকে সে চা খাওয়াল পরিচয় করিয়ে দিল বাবা-মায়ের সঙ্গে।

অজয় খান্ডেলকর স্কুলে পড়বার সময় একবার শান্তিনিকেতন এসেছিলেন বটে কিন্তু ভালো করে তাঁর দেখা হয়নি সেবার। অনসূয়াই হল তাঁর গাইড। এক সাইকেলরিক্সায় ঘুরতে লাগল দুজনে।

অনসূয়ার ডাক-নাম হাসি, শান্তিনিকেতনে ডাক-নামটাই বেশি চলে। রবীন্দ্রনাথের আমলে এখানে যে আন্তর্জাতিক আবহাওয়া ছিল তা এখনও মুছে যায়নি। রবীন্দ্রভবনের সামনে একজন বৃদ্ধ সুইডিস অনসূয়াকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বললেন, হাসি, শোনো, তোমার সঙ্গে আমার প্রয়োজনীয় কথা আছে।

সাইকেলরিক্সা থেকে নেমে অনসূয়া গেল সেই বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলতে, অজয় খান্ডেলকর চুপ করে বসে রইলেন। মনে হল যেন তিনি তখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। এই সময়টুকু পেয়েই তিনি একটা জটিল অঙ্কের সমাধান খুঁজছেন।

মিনিট পাঁচেক পর অনসূয়া ফিরে আসতেই তিনি হালকা গলায় বললেন, এখানে সবাই আপনাকে হাসি বলে ডাকছে, আমিও সেই নামে ডাকতে পারি!

স্বচ্ছন্দে! আমার আসল নামটা আমার নিজেরই তেমন পছন্দ নয়।

কে রেখেছিল ওই নাম?

আমার জ্যাঠামশাই, তিনি এখানে সংস্কৃত পড়াতেন। জ্যাঠতুতো দিদির নাম শকুন্তলা।

এখন বাঙালি মেয়েদের তিন অক্ষরে নামটাই ফ্যাসান তাই না?

না দু-অক্ষরের।

তারপর কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি, শ্রীনিকেতন ঘুরে আসবার পথে হঠাৎ অজয় খান্ডেলকর এক জায়গায় সাইকেলরিক্সা থামাতে বললেন।

একটা জলাশয়ের পাশে বড় আমগাছতলায় দাঁড়ালেন দুজনে। একটুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর অজয় খান্ডেলকর বললেন, আমি চোদ্দ হাজার মাইল দূর থেকে আপনাকে একটা কথা বলার জন্যই এখানে এসেছি। ওখানে বসে আমি আপনার কথা অনেক চিন্তা করেছি। কথাটা ঠিক। কীভাবে বলতে হয় আমি জানি না, যদি কিছু ভুল হয় আপনি অপমানিত বোধ করবেন না। হাসি, আপনাকে আমি আমার স্ত্রী হিসেবে পেতে চাই।

পুরুষদের প্রণয় নিবেদন শোনার পূর্বী-অভিজ্ঞতা ছিল অনসূয়ার, তবু তার কানের ডগায় উষ্ণতা এসেছিল, মুখ রক্তিম হয়েছিল।

যাঃ, এসব কী কথা বলছেন।

না, না, না, আপনাকে এক্ষুণি কিছু উত্তর দিতে হবে না। আপনি ভালো করে চিন্তা করে দেখুন।

আপনার সঙ্গে আমার মাত্র কয়েকদিনের আলাপ।

তাতে কিছু যায় আসে না! এলগিন রোডে ডঃ মৈত্রর বাড়িতে আপনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল মনে আছে? আপনি গান গেয়েছিলেন দুটো, সে গানের লাইনও আমি বলে দিতে পারি। শুনুন, আমি মিথ্যে কথা বলছি না, আমেরিকায় বসে আমি আপনার কথা অনেক ভেবেছি, তারপর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আপনি সময় নিন। আমি দু-সপ্তাহ। কলকাতায় থাকব, তারপর আর এক সপ্তাহ পুনেতে। তার মধ্যে আপনি জানাবেন। যদি রাজি না হন তাও জানাবেন। কিংবা যদি এক বছর, দুবছর অপেক্ষা করতে হয়, তাতে আমি রাজি।

আপনি কেন এইসব কথা বলছেন? আমি একটা অতি সাধারণ মেয়ে।

আমার চোখে আপনি অপ্রতিম!

এরপর ফেরার পথে দুজনে আর একটাও কথা হল না।

এক রিক্সায় দুজনে বসায় অঙ্গস্পর্শ হয়েছিল বটে কিন্তু অজয় খান্ডেলকর একবারও হাসির হাত ধরার চেষ্টা করেননি। তাঁর সমবোধ ও শিষ্টাচার নিখুঁত।

পরদিন হাসিকে কলকাতা ও পুনের দুটি ঠিকানা দিয়ে অজয় খান্ডেলকর ফিরে গেলেন।

তারপর কয়েকটি দিন হাসির মানসিক জগতে একটা প্রবল আলোড়ন চলল। একটা ঝড়ের মধ্যে সে যেন দিশেহারা, অথচ তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবীদের কাছেও সে এ ব্যাপারে সাহায্য চাইতে পারে না।

হাসি তখন সঙ্গীত ভবনের নাম করা ছাত্রী। রেডিওতে একবার অডিশান দিয়েই পাশ করেছে। কলকাতায় এক বড় অনুষ্ঠানে শ্যামা নৃত্যনাট্যে শেষ মুহূর্তে প্রধানা গায়িকা এসে পৌঁছতে না পারায় হাসিই শ্যামার চরিত্রের সবকটি গান গেয়ে খুব সুখ্যাতি পেয়েছিল কাগজে-কাগজে। অনেকের আশা হয়েছিল শান্তিনিকেতন থেকে অনেকদিন পর আর একজন প্রতিভাবান রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা উঠে আসছে।

শুধু গান গাইতে জানলে, ছবি আঁকা শিখলে বা লেখার ক্ষমতা থাকলেই হয় না, শিল্পী হওয়ার জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা দরকার। হাসির তা ছিল। হালকা আনন্দের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মতন মেয়ে সে নয়। নিশ্চিন্ত সুখী জীবনের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল না, সে চেয়েছিল নিজের যোগ্যতার দাবি অর্জন করতে।

কিন্তু অজয় খান্ডেলকর সব গোলমাল করে দিল।

হাসি মনে-মনে হাজার বার বলতে লাগল, না, না, না, আমি এখন বিয়ে করব না, কিছুতেই বিয়ে করব না।

কিন্তু হাসিকে এই কথা বারবার বলতে হচ্ছেই বা কেন? অজয় খান্ডেলকর তো জোর করেননি, এমনকি হাসির বাবা-মাকেও কিছু জানাননি। মাঠের মধ্যে আমগাছ তলায় দাঁড়িয়ে অতি সংক্ষেপে একটি প্রস্তাব দিয়ে গেছেন মাত্র। তারপর দূরে সরে গেছেন। এখন হাসি তো তাঁকে কোনও উত্তর না দিলেই পারে। এসব ক্ষেত্রে নীরবতাই প্রত্যাখ্যান।

অজয় খান্ডেলকরের কলকাতা বাসের দুটি সপ্তাহ কেটে গেল। হাসি চিঠি লেখেনি বটে, কিন্তু প্রতিটি দিন সে গুনেছে। এবারে অজয় যাচ্ছেন পুনেতে। সেখানে আর মাত্র সাতদিন।

শুধু সুপুরুষ আর গুণবানই নয়, অজয়ের চরিত্র ও ব্যবহারে এমন একটা কিছু ছিল যা হাসিকে চুম্বকের মতন টেনেছে। এরই নাম কি প্রেম? কেন সর্বক্ষণ হাসি ওই মানুষটির কথাই ভাবছে? চোদ্দ হাজার মাইল দূর থেকে একজন মানুষ এখানে এসেছিল শুধু হাসির সঙ্গে দেখার করার জন্য!

পুনে থেকে একটা টেলিগ্রাম এল হাসির নামে। হাসি তখন বাড়ি ছিল না, তার বাবা সেটি সই করে নিয়েছিলেন, কিন্তু খোলেননি।

হাসি বাড়ি ফেরার পর তিনি জিগ্যেস করলেন, পুনেতে তোর কোন বন্ধু আছে রে?

হাসির সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল। হাসি তার মুখের ভাব লুকোতে পারে না। তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে কেন? বাবার সামনেই টেলিগ্রামটা সে খুলল।

অজয় জানিয়েছে, আমার ফ্লাইট পরশুদিন রাত্রে! আমি কি কিছুই না জেনে ফিরে যাব?

বাবা জিগ্যেস করলেন, কে?

হাসি কিছুই উত্তর না দিয়ে ছুটে গেল বাড়ি থেকে। এবারে একবার তাকে তপনের কাছে যেতেই হবে। বাবা-মাও বন্ধুর মতন, কিন্তু এক্ষুনি সে বাবা-মাকে কিছু খুলে বলতে পারবে না।

সব পুরুষ মানুষই প্রেমিক হওয়ার যোগ্য হয় না। তপন সেইরকম একজন। সে হাসির যত না। বন্ধু, তার চেয়ে বেশি ভক্ত। হাসি যে মাটি দিয়ে হেঁটে যায়, কেউ যদি বলে তপন ওই মাটি জিভ দিয়ে চাটো তো, তপন তা পারবে। কিন্তু তপন কোনওদিন বলতে পারবে না, হাসি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার হও।

লাইব্রেরি থেকে তপনকে হাসি টেনে আনল। দুজনে চলে গেল রেল লাইনের ধারে। তারপর তপনকে সব খুলে বলল।

তপনের একমাত্র চিন্তা হাসি যেন কিছুতেই কষ্ট না পায়। হাসির মুখ ম্লান হলে তপনেরও মুখ ম্লান হয়ে যায়।

কী হয়েছে হাসি?

হাসি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। সে একটা কথাও বলতে পারছে না।

তপন চুপ করে চেয়ে রইল হাসির মুখের দিকে। তার বুকটা মুচড়ে উঠছে। কীসের যেন একটা সম্ভাবনা হঠাৎ কাঁপিয়ে দিচ্ছে তাকে।

একটু পরে, নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে হাসি বলল, তপন, আমি জানতুম না রে আমার মনটা এত দুর্বল! আমি কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছি না।

আমাকে তুই সব খুলে বল!

আমাকে একজন ডাকছে, আমি যেতে চাই না, তবু আমাকে যেতেই হবে!

কে ডাকছে?

কদিন আগে একটি মারাঠি ছেলে এসেছিল, তুই দেখেছিলি? যাকে নিয়ে আমি সাইকেল রিক্সায় ঘুরছিলাম।

হ্যাঁ দেখেছি। ভালো নাচেন বোধহয় তাই নয়? চেহারা দেখে তাই মনে হয়।

ধুৎ! নাচ-গান কিছু জানেনা। অঙ্কের পণ্ডিত! আমেরিকায় থাকে, বুঝলি? আমার সঙ্গে কলকাতায় সামান্য একটু আলাপ হয়েছিল, আমার গান শুনেছিল। কোনওদিন আমাকে চিঠি লেখেনি, কিছু না! আমেরিকাতে বসে নাকি শুধু আমার কথাই ভেবেছে, সেখান থেকে এই যে সেদিন এল, আমার সঙ্গেই দেখা করার জন্য! তুই এটা বিশ্বাস করতে পারিস?

না।

কেন তুই তাকে অবিশ্বাস করবি। তুই তার সঙ্গে একটু কথা বললেই বুঝতে পারতিস সে মিথ্যে কথা বলার মানুষ নয়।

সে তোকে নিয়ে যেতে চায়?

হ্যাঁ।

কোথায়? বোম্বেতে?

কী জানি কোথায়?

তুই কি পাগল হয়ে গেছিস হাসি? ওরকম চোখের ভালোলাগা তো অনেকেরই লাগে। এখানে কতজন তোকে–।

তপন আমি সত্যি পাগল হয়ে গেছি রে! ও সেই যে শান্তিনিকেতন থেকে চলে গেল, তারপর প্রত্যেকদিন, জেগে থাকার সবটা সময় আমি শুধু ওর কথাই ভাবছি। এ যেন একটা চুম্বক, আমাকে অনবরত টানছে! আমি কিছুতেই নিজের মনটা ফেরাতে পারছি না অন্যদিকে।

তুই আমাদের ছেড়ে চলে যাবি?

না-না-না, আমি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কিছুতেই যাব না। আমি গান ছাড়তে পারব না, আমি তোকে ছাড়তে পারব না! আমি শুধু ওকে আর একবার দেখতে চাই! এরপর তপনের হাত দিয়েই একটা টেলিগ্রাম পাঠাল হাসি। অজয়কে লিখল, বিদেশে ফেরার আগে আপনি আর একবার শান্তিনিকেতনে আসতে পারেন?

দু-দিন পরে আবার একটি সাইকেল রিকশা এসে থামল হাসিদের বাড়ির সামনে। হাসি তখন ক্লাস করতে গেছে। হাসির বাবা অজয়ের সঙ্গে এমনভাবে গল্প করতে লাগলেন যেন তিনি কিছুই জানেন না। যদিও তপনের কাছ থেকে তিনি সব শুনেছেন।

তিনি শুধু একবার জিগ্যেস করলেন, শান্তিনিকেতন জায়গাটা আপনার খুব পছন্দ হয়েছে বুঝি? পরপর দুবার এলেন?

অজয় পরিষ্কার উত্তর দিলেন, আমি হাসির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। হাসি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

হাসিকে খবর দেওয়া হল। সে এসে অজয়কে দেখেই যেন রাগে জ্বলে উঠল। যেন অজয় একজন অনভিপ্রেত অতিথি। সে বেশ কঠোর ভাবে জিগ্যেস করল, আপনি এখানে ফিরে এলেন? আপনার আজই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল না?

অজয় হেসে বললেন, তাহলে কি অন্য কেউ মজা করার জন্য আপনার নামে আমার কাছে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল?

হাসির বাবা অল্প বয়েসিদের এইসব গোলমালের মধ্যে থাকতে চাইলেন না। তিনি ঘর থেকে। বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, হাসি তাঁকে ডেকে বলল, বাবা, শোনো, এই লোকটা আমাকে বিরক্ত করছে! জ্বালিয়ে মারছে। এর জন্য আমি রাত্তিরে ঘুমোতে পর্যন্ত পারছি না।

অজয় তৎক্ষণাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বললেন, আপনার মেয়েকে যদি আমি বিরক্ত করে থাকি, সে জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। অনুগ্রহ করে এবারের মতন আমাকে মার্জনা করুন। আমি শপথ করছি, আমি জীবনে আর কোনওদিন এই শান্তিনিকেতনে পা দেব না।

অজয়ের নম্র, বিষণ্ণস্বর শুনে বাবা পর্যন্ত বিচলিত হয়ে বললেন, না, না, না আপনি কিছু মনে করবেন না। আমার মেয়েটা একবারে পাগল, কখন যে কী করে মাথার ঠিক নেই। আপনি বসুন, চা-টা শেষ করুন।

কিন্তু অজয় আর দাঁড়ালেন না। হাসির দিকে একবারও না তাকিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

বিকেলের আগে ট্রেন নেই। দুপুরটা অজয়কে ট্যুরিস্ট লজে কাটাতে হবে। দরজা বন্ধ করে তিনি ঘুম দিলেন। একটুপরেই দরজায় দুমদুম শব্দ হল।

দরজা খুলতেই হাসি ঝড়ের বেগে ঢুকে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলল, আপনি…আপনি অতি নিষ্ঠুর! কেন বললেন যে জীবনে আর কোনওদিন শান্তিনিকেতনে পা দেবেন না? শান্তিনিকেতন কি আমার একলার? গুরুদেবের জায়গায় যে-কেউ আসতে পারে।

অজয় কিছু না বলে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন হাসির মুখের দিকে।

হাসি আবার বলল, আপনি…তুমি…শান্তিনিকেতন ছেড়ে যেয়ো না, তুমি এখানেই থাক। বিদেশে যাওয়ার কী দরকার? আমি শান্তিনিকেতন ছেড়ে যে যেতে পারব না।

সেই প্রথম অজয় এগিয়ে এসে হাসির হাত ধরে টেনে তুলে তাকে বুকের ওপর এনে বললেন, তুমি চল, কয়েক বছর মাত্র আমরা বিদেশে থাকব। তারপর আবার আমরা ফিরে আসব। তোমার গান বন্ধ হবে না!

অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বিবাহ-উৎসবের পরই অজয় ফিরে গেলেন আমেরিকায়। হাসিকে থেকে যেতে হল পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষার আর তিনমাস বাকি, কিন্তু সেই সময়টাই হাসির মনে হল বিরাট লম্বা। যে শান্তিনিকেতনকে এত ভালোবাসত হাসি, সেই শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাওয়ার জন্য সে ছটফট করতে লাগল। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিনই হাসি দমদম ছেড়ে প্লেন ধরল।

অজয় খান্ডেলকরকে বিদেশে থাকতে হল সাত বছর। মাঝখানে হাসি একবার কয়েক সপ্তাহের জন্য মা-বাবার কাছে ঘুরে গিয়েছিল। বিদেশে হাসির স্বাস্থ্য অনেক ভালো হয়েছে, চোখে-মুখে এসেছে অন্যরকম দীপ্তি, সবসময় সে আনন্দ-উচ্ছল, বিয়েটা তার খুবই সার্থক হয়েছে।

সাত বছর বাদে যখন বিদেশে পাকাঁপাকি বসবাস কিংবা সবকিছু গুটিয়ে দেশে ফেরার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এল তখন হাসির দেশ সম্পর্কে টান অনেকটা কমে গেছে। ওখানে থেকে যাওয়াই তার ইচ্ছে। কিন্তু অজয়ই ফিরতে চাইলেন। দেশ তাঁকে টানে। হাসিকে তিনি ফিরিয়ে আনবেন এই কথা দেওয়া ছিল।

দু-তিন জায়গা থেকে চাকরির অফার পেয়েছিলেন অজয়, তার মধ্যে দিল্লিরটাই সবচেয়ে ভালো ছিল, তবু অজয় কলকাতার চাকরিটাই নিলেন।

সাত বছর পর হাসি তার ফুটফুটে শিশুপুত্রের হাত ধরে ফিরে এল শান্তিনিকেতনে। কলকাতায়। পছন্দমতন বাড়ি পাওয়া যায়নি, অজয় থাকছেন কোম্পানির গেস্টহাউসে, হাসি কিছুদিন বাবা মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে যাবে।

কিন্তু এই কবছরেই শান্তিনিকেতন যেন অনেক বদলে গেছে। হাসির বন্ধু বান্ধবীরাও প্রায় কেউই নেই। শান্তিনিকেতনের গাছপালাও হাসিকে চিনতে পারল না। তপন থাকে দুর্গাপুরে, সেখানে গানের স্কুল খুলেছে, মাঝে-মাঝে বাংলা সিনেমায় উপ-নায়কের পার্ট করে। বয়স্ক নারী-পুরুষরা ছাড়া আর কেউ হাসির সঙ্গে যেচে কথা বলে না। গানের জন্য এক সময় হাসির কত নাম ছিল, সেকথা কেউ মনে রাখেনি। এমন কি মোহরদিও তার নামটা ভুলে গিয়েছিলেন।

হাসিও অবশ্য গানের চর্চা টিকিয়ে রাখতে পারেনি। অজয় ব্যবস্থা করেছিলেন সবরকম, দেশ থেকে হারমোনিয়াম আর তানপুরা আনিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের আধুনিকতম রেকর্ড ক্যাসেট কিছুই বাদ ছিল না। তবু হাসির উৎসাহ চলে গেছে আস্তে-আস্তে। শান্তিনিকেতনে সবাই মিলে রিহার্সালের সময় কতরকম মজা, মাঝে-মাঝে কলকাতায় ফাংশান করতে যাওয়া, অন্য গায়ক-গায়িকাদের সঙ্গে সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা, তার নেশাই ছিল অন্যরকম। বিদেশে সারাক্ষণ কাজ করতে হয়, তারপর সন্তান জন্মের পর হাসি আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে মাঝে-মাঝে আপন। মনে দু-চার লাইন গেয়ে ওঠে বটে, কিন্তু সে আর গানের জগতে নেই।

হাসি গায়িকা হয়নি বটে কিন্তু সে সুখী জীবন পেয়েছে। কিংবা খুব সহজেই সুখটাকে মেনে নিয়েছে বলে সে শিল্পী হতে পারল না।

তিন

সেদিন এমন কিছু নেশা হয়নি দিব্যর যে পরেরদিন সে কথা মনে থাকবে না।

লজ্জিত হওয়ার চেয়েও সে বিস্মিত হয়েছিল অনেক বেশি। কেন সে অমনভাবে অনসূয়া খান্ডেলকরের কাছে ছুটে গিয়েছিল অত রাতে? এটা তো নিছক অন্যমনস্কতা নয়! এ তো পাগলামি। অনসূয়ার সঙ্গে তার অতি সামান্য আলাপ, ভদ্রমহিলার চেহারা সুন্দর, ব্যবহারও বেশ ভালো, সকলেই তাকে পছন্দ করে। দিব্যর ক্ষেত্রেও তার বেশি কিছু নয়, সে অনসূয়ার প্রেমে পড়েনি, তাকে নিয়ে সে কোনও স্বপ্নও দেখে না। তাহলে?

দিব্য বেশ ভয় পেয়ে গেল। তার মেজমামা এমনই হিংস্র উন্মাদ যে তাঁকে বছরের পর বছর একটা নার্সিং হোমে রাখতে হয়। দিব্যর মধ্যেও সেই পাগলামির বীজ ঢুকেছে নাকি?

দিব্য দু-তিনদিন খুব মনমরা হয়ে রইল। অফিসে গেল না। কোনও ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার কথা চিন্তা করেও যেতে সাহস হল না। সে চুপচাপ বাড়িতে শুয়ে কাটাল।

ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীকে কি বলে দিয়েছেন সেই রাত্রির ঘটনা? বলাটাই স্বাভাবিক।

দিব্য অজয় খান্ডেলকরের অধীনে কাজ করে না, তার অফিস আলাদা, কিন্তু তার অফিসের স্বার্থে তাকে প্রায়ই ওঁর সঙ্গে দেখা করতে হয়। তার অফিস থেকে মাঝে-মাঝেই পাটি দেওয়া হয়, অনসূয়া খান্ডেলকর সেখানে আসেন।

দিব্য বিষণ্ণভাবে ভাবল, হয়তো এই চাকরিটা ছেড়ে দিতে হবে। অজয় খান্ডেলকর তার নামে অভিযোগ করলে দিব্যদের অফিসের জি. এম. আর দিব্যকে রাখবেন না। কারণ, অজয় খান্ডেলকরের মূল্য অনেক বেশি। যদিও দিব্যর নামে দুশ্চরিত্রতার অভিযোগ শুনলে জেনারেল ম্যানেজার প্রথমবার একেবারে হাঁ হয়ে যাবেন।

চেষ্টা করলে দিব্য একটা অন্য চাকরি পেয়ে যাবে। তার যোগ্যতা আছে। কিন্তু এই অফিসটা তার বেশ পছন্দ ছিল। চাকরি জীবনে মাইনে ছাড়াও পছন্দ মতন সহকর্মী পাওয়া অনেক বড় ব্যাপার।

চারদিন পরে দিব্য আবার অফিসে গেল এবং কারুর মুখে কোনও ব্যাঁকা কথা শুনল না। কেউ কিছু জানে না। সবই আগের মতন স্বাভাবিক।

কিন্তু দিব্যর ব্যবহার অনেক আড়ষ্ট হয়ে গেছে। সে মেপে-মেপে কথা বলে। যে কোনও জায়গায় যাওয়ার আগে সে ভেবে নেয় ঠিক জায়গায় যাচ্ছে তো? বাথরুম থেকে বেরুবার আগে অন্তত। তিনবার দেখে নেয় জামা-প্যান্ট ঠিক মতন পরা হয়েছে কি না!

শনিবার তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী অশোক বাজপেয়ীর বিবাহবার্ষিকীর নেমন্তন্ন ছিল, দিব্য কায়দা করে এড়িয়ে গেল। অশোকের বাড়িতে গেলেই খুব মদ্যপান হয়, অশোক খুব জোর করে। দিব্য এখন বেশ কিছুদিন মদ ছুঁতে চায় না। যথেষ্ট মদ খেলেও তার নেশা হয় না এই গর্ব ছিল, এক। সন্ধেবেলা সব উলটে গেল। এয়ারপোর্ট হোটল থেকে সে ছুটে গেল যোধপুর পার্ক, এটা মাতলামি পাগলামি?

মহাশ্বেতা! নামটা একেবারে কাল্পনিক নয়। কিন্তু কতদিন আগে হারিয়ে গেছে সেই মহাশ্বেতা। তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঘাটশিলায়, তখন দিব্যর বয়েস একুশ-বাইশ হবে। তার গায়ে তখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের গন্ধ।

মহাশ্বেতারাও বেড়াতে এসেছিল। মহাশ্বেতাদের খুব বড় পরিবার! এক দঙ্গল লোক! মহাশ্বেতার বয়েস সতেরা-আঠারো হবে। তার বয়েসী আরও দুটি মেয়ে ছিল ওদের দলে। তাদের নাম মনে নেই। পাশাপাশি বাড়িতে থাকা তাই আলাপ পরিচয় হবেই। তারপর কিছু হাসি-ঠাট্টা, একসঙ্গে বেড়ানো, কোনও লোকজনের দিকে গাঢ় চোখে তাকান, এর বেশি আর কিছু না।

দিব্য তখন খুব লাজুক ছিল। অন্য অনেক ছেলে যেমন কথার পিঠে চালাক-চালাক কথা বলে, সে ক্ষমতা তার একেবারেই ছিল না। মহাশ্বেতার সঙ্গের অন্য দুটি মেয়ে বরং বেশ স্মার্ট। মহাশ্বেতা একটু চুপচাপ ধরনের।

ওই তিনজনের কোনও একজনের সঙ্গেই দিব্যর প্রেম হয়নি, মনে রাখবার মতন কিছু ঘটেনি।

শুধু একটা বিকেলে, সেদিন বোধহয় ধারাগিরির দিকে সবাই মিলে বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল। একসঙ্গে, মহাশ্বেতা তাকে বলেছিল, আমার মাঝে-মাঝে ভীষণ মন খারাপ হয়! কোনও কারণ নেই, এমনি-এমনি, কেন যে হয় বুঝতে পারি না। কী করে মন খারাপ ভালো করা যায় বলতে পারেন?

অতিরিক্ত লাজুক লোকরা অনেক সময় রূঢ় হয়। সেই রকমভাবেই দিব্য বলেছিল, আমি কী করে জানব, আমি কী ডাক্তার?

মহাশ্বেতার মুখখানা ডিমের মতন। তার মুখের রঙ চাপা জ্যোৎস্নার মতন। ভুরু দুটি খুব গভীর। তখনও তার ভুরু প্লাক করার বয়েস হয়নি। খুব একটা সাজগোজের দিকেও মনোযোগ ছিল না।

গভীর ভুরু দুটি তুলে আহত বিস্ময়ের সঙ্গে সে বলেছিল, বাঃ শুধু ডাক্তাররাই বুঝি মন খারাপের কথা বোঝে? আর কেউ বোঝে না? এই যে বিকেলের আলো কমে আসছে, একটা দিন চলে যাচ্ছে, আকাশটা কী রকম হারিয়ে যাচ্ছে, এই সময়টায় আমার বেশি মন খারাপ হয়। আপনার হয় না?

দিব্য বলেছিল, না।

মহাশ্বেতা বলেছিল, আপনি বুঝি খুব গোঁয়ার? শুনেছি গোঁয়ার লোকদের মন খারাপ হয় না। আপনার সত্যিই কখনও হয় না?

দিব্য আবার বোকার মতন বলেছিল, না!

মহাশ্বেতা বেশ কয়েক মুহূর্ত দিব্যর চোখের দিকে চেয়ে থেকে খুব নরম ভাবে বলেছিল, ও এই সব মানুষদের আমার ভয় করে।

তারপর সে আস্তে-আস্তে একা হেঁটে গিয়েছিল জঙ্গলের দিকে।

লাজুক দিব্য তখন এইটুকু শুধু বুঝেছিল যে মহাশ্বেতাকে সে ভুল কথা বলেছে। মহাশ্বেতা মনে একটু আঘাত পেয়েছে। কিন্তু ঠিক কী কথা তাকে বলা উচিত ছিল তা দিব্যর মনে পড়েনি।

মহাশ্বেতা যখন একলা চলে গেল তখনও সে একটা পাথরের ওপরেই বসে রইল, ওর সঙ্গে গেল না। মহাশ্বেতার সঙ্গে ঠিক কোন কথা বলতে হবে, সেটাই যে সে জানে না।

মহাশ্বেতার সঙ্গে দিব্যর আর কোনওদিন দেখা হয়নি। দিব্য যদি চালু ছেলে হত, তাহলে মহাশ্বেতাকে কলকাতায় ঠিকই খুঁজে বার করত, যোগাযোগ রাখত। কিন্তু দিব্য তখন ফাইনাল পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মাঝে-মাঝে ধারাগিরির কাছে সেই বিকেলটার কথা মনে পড়ত। মহাশ্বেতাকে কী উত্তর দেওয়া উচিত ছিল?

বছর দেড়েক বাদে দিব্যর ছোট বোন একদিন বলল, দাদা, ঘাটশিয়াল সেই যে মহাশ্বেতা বলে একটা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মনে আছে! ইস কী কাণ্ড!

মহাশ্বেতার লম্বাটে মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল দিব্যর। হ্যাঁ তাকে মনে আছে, অন্য কোনও কারণে নয়, একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি বলে।

দিব্য জিগ্যেস করল, কী হয়েছে তার?

রিনি বলল, আজ কাগজে দ্যাখোনি? সে আত্মহত্যা করেছে। কাগজে লিখেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মহাশ্বেতা সেনগুপ্ত শ্লিপিং পিল খেয়েছে, তার আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি।

তৎক্ষণাৎ দিব্যর মনে পড়ে গিয়েছিল মহাশ্বেতার প্রশ্নের সঠিক উত্তরটা। দিব্যর বলা উচিত ছিল, আমাকে তোমার মন খারাপের খানিকটা ভাগ দাও। গোঁয়ার লোকদের শিখিয়ে দাও, কী করে মন খারাপের ভাগ নিতে হয়!

সেইদিন ধারাগিরির কাছে বিকেলে ঠিকঠিকভাবে মহাশ্বেতাকে এই কথাটা বলতে পারলে হয়তো সে আত্মহত্যা করত না। হয়তো এই প্রশ্ন সে আরও কারু-কারুর কাছে করেছে, কেউ সঠিক উত্তর দেয়নি!

তারপর কতদিন কেটে গেছে, একেবারে হারিয়ে গেছে মহাশ্বেতা। দিব্য তার বুকের মধ্যে কোনও অপরাধবোধ পুষে রাখেনি, কেনই বা রাখবে?

অনসূয়ার সঙ্গে তো মহাশ্বেতার কোনও মিল নেই! যতদূর সে জানে, অনসূয়া খান্ডেলকরের জীবন খুব সুখী আর পরিতৃপ্ত। দিব্য তার কাছে কেন গিয়ে বলবে…। না, দিব্য কিছুতেই তার নিজের ব্যবহারের যুক্তি খুঁজে পায় না।

সোমবার দিব্য অফিসে গিয়েই শুনল যে অজয় খান্ডেলকর তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

জেনারেল ম্যানেজার বললেন, শোনো দিব্য মিঃ খান্ডেলকর তোমায় বেশ পছন্দ করেন, আমি আগেও লক্ষ্য করেছি। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। মিঃ খান্ডেলকরকে আমরা উইথ। ফ্যামিলি কাশ্মীরে একটা গুড ট্রিটমেন্ট দিতে চাই। ওখানে আমরা একটা সেমিনারের আয়োজন করব। সেটা হবে প্রধানত ওঁরই জন্য। তোমাকে খুব কায়দা করে কথাটা পাড়তে হবে। উনি যেন বুঝতে না পারেন যে ওঁর জন্য স্পেশাল কিছু করা হচ্ছে। তুমি ওঁর কাছ থেকে একটা ডেট নিয়ে এসো। তুমি এটা পারবে, আমি জানি।

দিব্য মৃদু হেসে বলল, আচ্ছা আমি চেষ্টা করব।

দিব্য অবশ্য মনে-মনে ঠিকই বুঝেছে, শুধু তাকে আলাদা করে ডাকার মানেটা কী! অজয় খান্ডেলকর খুব কড়া ধরনের নীতিবাগিশ মানুষ। বাইরে অত্যন্ত ভদ্র, কিন্তু নিজের বিশ্বাসে সব সময় স্থির থাকেন। এইবারে তিনি দিব্যকে নিজের চেম্বারে বসিয়ে গায়ের ঝাল ঝাড়বেন।

দিব্যকে হয়তো আজই চাকরিটা ছাড়তে হবে, তবু সে ঠিক করল তার যাওয়া উচিত। নইলে ছিচকে অপরাধীর মতন মনে হবে নিজেকে। অজয় খান্ডেলকর যা খুশি বলার পর সে ক্ষমা চাইবে।

অজয় খান্ডেলকর বসেন চৌরঙ্গি অঞ্চলের উঁচু বাড়ির ষোলতলায়। তাঁর ঘর থেকে সম্পূর্ণ ময়দান ও তার একপ্রান্তে গঙ্গার বাঁক দেখতে পাওয়া যায়। খিদিরপুরের জাহাজগুলো দেখা যায় স্পষ্ট।

অজয় চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে দিব্যর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, আসুন-আসুন। ওঃ, আজ রোদ বড় চড়া, আসতে আপনার কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়ই। একটা খুব জরুরি পয়েন্ট ক্লিয়ার করার কথা, সেই জন্যই আপনাকে ডেকেছি।

সত্যিই অফিস সংক্রান্ত একটা জরুরি ব্যাপার। অজয় কোনওরকম ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তুললেন না। একটা ইমপোর্ট লাইসেন্সের ব্যাপারে দিল্লি থেকে আপত্তি জানিয়েছে, তবু তাড়াতাড়ি তার উত্তর পাঠাতে হবে। প্রায় সওয়া ঘণ্টা ধরে দুজনে গভীর মনোযোগ দিয়ে বিষয়টি আলোচনা করল।

তখনও কাজ বাকি থেকে গেল খানিকটা। কিন্তু অজয়কে বেরুতে হবে, তাঁর একটা জরুরি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে অজয় বললেন, আমি দুঃখিত, দিব্যবাবু, কাজটা শেষ করা গেল না। অথচ কালই উত্তর পাঠানো দরকার।

দিব্য বলল, আমি কাল সকাল ঠিক সাড়ে নটায় আবার আসতে পারি।

অজয় হুঁ, বলে চোখ বুজে চিন্তা করতে লাগলেন।

দিব্য এই সুযোগে কাশ্মীরের প্রস্তাবটা পেড়ে ফেলল। অজয় সে সম্পর্কে বেশি আগ্রহ প্রকাশনা করে বললেন, ওসব পরে ভেবে দেখা যাবে। আপনি আজ সন্ধেবেলা বিশেষ কিছু করবেন? ফ্রি আছেন?

দিব্য একটু অবাক হয়ে বলল, না তেমন কিছু নেই। কেন বলুন তো!

অজয় হেসে বললেন, আমি ভাবছিলুম, আপনি যদি আজ সন্ধেবেলা আমার বাড়িতে আসতে পারেন। কাজটাও শেষ করা যায়, খানিকটা গল্পগুজবও করা যায়। অফিসের সময়টা তো আমরা সবাই যন্ত্রের মতন, তাই না? যেন আমাদের কোনও সামাজিক পরিচয় নেই।

দিব্য চুপ করে চেয়ে রইল।

কোনও অসুবিধে আছে?

না।

তাহলে চলে আসুন। আমার বাড়ি চেনেন তো! এই সাড়ে সাতটা নাগাদ! হ্যাঁ, আমাদের ওখানেই খেয়ে নেবেন! তা হলে ওই কথা রইল?

দিব্য একবার জানলা দিয়ে ময়দানের দিকে তাকাল। এত উঁচু থেকে সব কিছুই সুন্দর দেখায়। এখান থেকে আত্মহত্যা করা কত সোজা। একটুও ভয় করবে না।

বাইরে বেরিয়ে এসে দিব্যর মনে হল, অজয় খান্ডেলকর কি একটা ফাঁদ পেতে তার মধ্যে। দিব্যকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন? কিন্তু তাঁর ব্যবহারে কোনওরকম ধূর্ততার চিহ্ন নেই। তাঁর এই যে ভালোমানুষী ব্যবহার, এর সবটাই অভিনয় হতে পারে? কিন্তু অজয় খান্ডেলকর অফিসের কাজে কোনওদিন কারুকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছেন, এরকম শোনাই যায় না।

তবে কি সমস্ত ব্যাপারটাই স্বপ্ন? সেদিন রাতে দিব্য যায়নি যোধপুর পার্কে। কিন্তু তার মানি ব্যাগ, ঘড়ি খোয়া গিয়েছিল…

অফিস একটু ছুঁয়েই বাড়ি চলে এল দিব্য। তারপর বেশ খানিকক্ষণ ঘুমলো। ঘুম থেকে উঠে খুব ভালোভাবে স্নান করল। ঘুম আর স্নান, এই দুটোতেই মন বেশ স্নিগ্ধ থাকে অনেকক্ষণ। মনের

এইরকম অবস্থায় নিজে বেশি কথা না বলে অন্যের কথা শুনতে ইচ্ছে হয়। সাদা ট্রাউজার্স আর সাদা শার্ট পরল। সাদা পোষাকেও বেশ উৎফুল্ল লাগে তার। ঠিক সাড়ে সাতটায় সে এসে পৌঁছল যোধপুর পার্কে। আশ্চর্য, আজ তাকে বাড়িটা খুঁজে পেতে ট্যাক্সি নিয়ে বেশ ঘুরতে হল খানিকক্ষণ।

পাজামা ও পাঞ্জাবি পরে অজয় খান্ডেলকর বসবার ঘরেই অপেক্ষা করছিলেন। দিব্য ঢুকতেই তিনি সহাস্যে বললেন, একটা ভালো খবর আছে। ইমপোর্ট লাইসেন্সের সেই প্রবলেমটা সলভ করে ফেলেছি এর মধ্যেই। ফাইলটা আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি, কাল সকালেই পাঠিয়ে দেবেন, কেমন?

দিব্য তখনও বসেনি, ফাইলটা হাতে নিয়ে সে ভাবল, তা হলে আর এখানে থাকার তো কোনও প্রয়োজন নেই, এখন চলে গেলেই তো হয়।

সে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। আমি আসি তাহলে?

অজয় ব্যস্ত হয়ে বললেন, না না, সে কী, বসুন! আমি তো আপনাকে সোস্যালি ইনভাইট করেছি। ভালোই হল, অফিসের কথাবার্তা আর বলতে হবে না, তাই না?

দিব্যর মনে হচ্ছে, সত্যিই সে একটা ফাঁদে এসে পড়েছে। অজয় খান্ডেলকরের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সঙ্গে সে পাল্লা দিতে পারছে না। কী চান ইনি?

অজয় জিগ্যেস করলেন, আপনাকে কী ড্রিঙ্কস দেব?

অনেক অনুরোধেও দিব্য কোনওরকম মদ নিতে রাজি হল না। সে একটা নরম পানীয় নিয়ে অল্প-অল্প চুমুক দিতে লাগল।

অজয় জিগ্যেস করলেন, একটা কিছু গান দেওয়া যাক। আপনি গান ভালোবাসেন নিশ্চয়ই? কোন ধরনের গান? রবীন্দ্রসঙ্গীত?

দিব্য মাথা নাড়ল।

অজয় একটা ক্যাসেট রেকর্ডার কাছে নিয়ে এসে বললেন, আপনি কি জানেন আমার স্ত্রী এক সময় ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন?

দিব্য মাথা নেড়ে জানাল যে সে তা জানে না।

আমি ছেলেবেলা থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত। আমার স্ত্রী, যখন তিনি আমার স্ত্রী ছিলেন না, তাঁর গান শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছিলুম। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে তিনি গান একেবারে ছেড়ে দিয়েছিলেন।

কিছু তো একটা বলতে হবে, তাই দিব্য বলল, আপনারা তো অনেকদিন বাইরে ছিলেন।

হ্যাঁ সাত বছর। খুব দীর্ঘ সময় তাই না? কিন্তু বিদেশেও তো অনেকে গান-বাজনার চর্চা রাখে। বনানী ঘোষ রবীন্দ্রসংগীতের স্কুল চালান। আমরা যেখানে ছিলাম, তার কাছেই আলি আকবরের মিউজিক স্কুল। আমার স্ত্রী তবু গেল না।

দিব্য ক্রমশ আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অজয় খান্ডেলকর শুধু স্ত্রীর প্রসঙ্গে কথা বলছেন। এই জন্যই তিনি দিব্যকে ডেকে এনেছেন।

অজয় ক্যাসেট রেকর্ডারটা চালিয়ে দিলেন। নারী কণ্ঠের একটা গান শুরু হল। দিন যায়, যায় রে! টানা সুরের গান, গভীর বিষাদে ভরা। কণ্ঠস্বর খুব গভীর। গানটা যেন ওই গায়িকার একেবারে বুকের ভেতর থেকে উঠে আসছে। দিব্যর কাছে এই কণ্ঠস্বর অচেনা।

দুজনে নিঃশব্দে গানটি শুনল। ওই একটা গান শেষ হওয়ার পরই অজয় যন্ত্রটা বন্ধ করে দিলেন।

দিব্য জিগ্যেস করল, এটা কার গান?

হাসি রায়ের। আপনি নাম শুনেছেন?

না।

হাসি রায়ের ভালো নাম ছিল অনসূয়া। এখন তিনি আমার স্ত্রী। এই গানটা উনি গেয়েছেন চারদিন আগে। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর আমি ওঁর গলায় একটা পুরো গান শুনলাম। রাত্তিরবেলা, অনেক রাত্রি তখন, দুটো-আড়াইটে হবে ঘুম ভেঙে গেল, আমি দেখি, আমার স্ত্রী জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন, এই গানটা গাইতে-গাইতে তাঁর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। আমাদের বিবাহিত জীবনে তাঁকে কোনওদিন কষ্ট পেতে দেখিনি, আমি তাঁকে সবরকম সুখে রাখতে চেয়েছি। বরং আমারই মনে একটা দুঃখ ছিল উনি গান ছেড়ে দিয়েছেন বলে!

কেন গান ছেড়ে দিয়েছিলেন?

জানি না। কোনওদিন তো বলেননি। সেদিন মাঝরাতে ওঁকে এই গানটা গাইতে শুনেই আমি ক্যাসেটটা চালিয়ে দিই। তারপর গান শেষ হল, উনি তবু জানলার ধারে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। দিন যায়, যায় রে। গানের কথাগুলো লক্ষ করেছেন? তা হলে কি ওঁর দিনগুলো এইরকম দুঃখেই কাটছে, যা আমি খবর রাখি না? আমি তখন হাসির কাছে গিয়ে আস্তে জিগ্যেস। করলাম, তোমার কীসের এত দুঃখ? আমি কি কিছু ভুল করেছি? উনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে আমার বুকে মাথা রাখলেন। আমি তাঁর চুলে হাত বুলোত লাগলাম। তারপর একটু সামলে নিয়ে উনি বললেন, সত্যি আমার কোনও অভাব নেই, দুঃখ নেই। কিন্তু কদিন আগে একজন লোক এসে আমার মন খারাপ করে দিয়ে গেছে!

দিব্য সামনে ঝুঁকে পড়ে ব্যাকুলভাবে বললেন, মিঃ খান্ডেলকর, আমি…

অজয় তাকে বাধা দিয়ে বললেন, দাঁড়ান আমি আগে শেষ করে নিই! হাসির মুখে ওই কথা শুনে আমি স্বাভাবিকভাবেই অবাক হলুম। জিগ্যেস করলুম, রাত্তিরবেলা একজন লোক এসেছিল? কে? হাসি বললেন, ঘটনাটা তোমাকে জানাতে চাইনি, ড্রিংক করে কেউ-কেউ মাঝে-মাঝে এরকম পাগলামি করে, পরেরদিন সেজন্য খুব লজ্জা পায়। এ নিয়ে বেশি রাগারাগি বা কোনওরকম অ্যাকশন নেওয়া উচিত নয়। দিব্য ছেলেটিকে দু-একদিন যা দেখেছি, এমনিতে খুব ভদ্র। সে রাত্তিরে এসে আমার সঙ্গে কোনওরকম অসভ্যতা করেনি, শুধু বারবার বলছিল, তোমার নাম মহাশ্বেতা! কেন ওরকম বলছিল? তারপর থেকেই আমার ভীষণ মন খারাপ লাগছে। আমি কিছুতেই মনটা ঠিক করতে পারছি না। আমার কান্না এসে যাচ্ছে।

দিব্য মাথা নীচু করে বসে রইল।

অজয় একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি কেন এসেছিলেন আমি জানি না। জানতে চাই না। কিন্তু আপনি আমার উপকারই করেছেন। আপনি হাসির গলা থেকে আবার গান বার করে এনেছেন। দাঁড়ান, হাসিকে ডাকি।

অজয় চট করে চলে গেলেন ভেতরে। দিব্য একলা বসে থেকে মরমে মরে যেতে লাগল। এখন কী করা উচিত, কী বলা উচিত, কিছুই সে বুঝতে পারছে না।

প্রায় পাঁচ মিনিট বাদেশ্ৰীমতী অনসূয়া খান্ডেলকর ঘরে ঢুকলেন একা। মুখখানা দেখে মনে হয় বিষাদ প্রতিমা। দিব্যর সামনে এসে বসলেন।

দিব্যর হাত-পা কাঁপছে। জীবনে সে কখনও এত নার্ভাস বোধ করেনি। কেন সে এখানে এল?

পরদিনই তার চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতার বাইরে চলে যাওয়া উচিত ছিল। মুখ তুলে দিব্য গভীর আবেগের সঙ্গে বলল, আমি দুঃখিত। সেদিনের ব্যবহার যদিও অমার্জনীয়, তবু আমি আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চাইছি।

হাসি অস্ফুট স্বরে জিগ্যেস করল, আপনি কেন এসেছিলেন?

আমি জানি না। বিশ্বাস করুন, আমি কোনওদিন কারুর সঙ্গে এরকম…আমি নিজেই আমার ব্যবহারের মানে বুঝতে পারছি না! কেউ যেন আমাকে জোর করে টেনে এনেছিল।

মহাশ্বেতা কে? আপনি কেন বলেছিলেন, আমার নাম মহাশ্বেতা?

তাও আমি ঠিক জানি না। আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে, আমি ভেবেচিন্তে কিছু করিনি। কেন যে আপনাকে মহাশ্বেতা বললুম।

ওই নামে কেউ ছিল?

ছিল, অনেকদিন আগে হারিয়ে গেছে!

ওকে নিয়ে আপনার নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট ছিল বুকের মধ্যে? সেই কষ্টটা আপনি আমাকে দিয়ে গেলেন। আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না ওই নাম। কেন আমাকে মহাশ্বেতা বলেছিলেন, ভাবতে গেলেই কান্না পেয়ে যায়। সেই কান্না হঠাৎ একদিন গান হয়ে বেরিয়ে এল। আমি যেন একটা, কী বলব, যেন একটা সুখের ফানুসের মধ্যে ছিলুম, হঠাৎ কী করে ঢুকে পড়ল দুঃখ।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অজয় বললেন, এজন্য দিব্যবাবুকে আমাদের দুজনেরই ধন্যবাদ জানানো উচিত। তাই না? হাসি, তুমি এবারে আমাদের একটা গান উপহার দাও! তানপুরাটা আনি?

হাসি আর একটা গান শুরু করল। চির সখা হে, ছেড়োনা! এ গানেও দুঃখের সুর। গান শুনতে-শুনতে দিব্যর চোখে জল এসে যাচ্ছে। কবে, কোথায় হারিয়ে গেছে মহাশ্বেতা! এখন তার মুখটাও আর দিব্যর মনে নেই। তবু সেই মহাশ্বেতার মন খারাপ কী করে যেন সুর হয়ে ঝরে-ঝরে পড়ছে হাসির কণ্ঠ দিয়ে। হাসি এখন সত্যিই মহাশ্বেতা!

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments