Friday, March 29, 2024
Homeবাণী-কথাআজীবন দিন-রাত্রি – জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

আজীবন দিন-রাত্রি – জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

আজীবন দিন-রাত্রি – জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

রবিকে বাসায় নিয়ে আসার জন্যে আমি স্টেশনে যাচ্ছিলাম।

রীণা বললো, আর একবার ভেবে দেখলে হতো না?

.

তার স্বর এতে নিরুত্তাপ, নির্লিপ্ত যে জবাব দিতে সময় নিতে হলো। আর মুখেও কোনো রেখা নেই। আমি বললাম, ভেবে দেখার সময় নেই রীণা। ট্রেন আসবে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে। আমার স্টেশনে যাওয়া উচিত। আর—। কথা শেষ করার আগে আবার ভেবে নিলাম, আর দেখো, রীণা, আরও অনেক দিন কাটাতে হবে, এমনি করে কেউ বাঁচে না।

ঘর ছেড়ে বেরুনোর মুখে বললাম, স্ব কিছু সহজ করে নাও।

আগের মতো গাঢ় আলিঙ্গনে আর তাকে ধরা যাবে না জানতাম। তবু প্রফু মুখে তার হাতে ঝাকুনী দিয়ে বললাম, কি রবি, কেমন আছো? গাড়ীতে ঘুম হয়েছিলো তো?

রবি অবাক হবার ভাণ করছিলো, আরে মনি, তুমি কি দারুণ ভদ্র হয়ে গেছে।

আমি চাইছিলাম, এই কষ্টকর ব্যাপারটা যাতে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। জোর দিয়ে বললাম, বিয়ে করলে বাই কিছুটা পালটায়। তুমিও তো কিছু কম পালটে যাওনি।

যদি সে আমার ইচ্ছা বুঝতো, যদি সে প্রশ্ন করতো, রীণা কেমন আছে, আমাকে ভালোবাসে কি না, তার কথা মনে রেখেছে কি না তাহলে কি হতো বলা যায় না, হয়তো সহজে বেড়াগুলো পার হয়ে আসা যেত। কিন্তু আমরা কেউ তা করি না। আমরা অনেককাল বাঁচতে চাই।

রবি আমার ইচ্ছেয় সাড়া দিলো না। খানিক ইতস্তত করে বললো, আমার চিঠি পেয়েছিলে তো। কোন হোটেলে।

তার দিকে তাকিয়ে বললাম, হোটেল এখনো কিছু ঠিক করিনি। এখন বাসায় চলো। আগে এলেও তো আমার বাসায়ই উঠতে। তার ঠোঁট একবার দু’বার নড়তে চাইলো দেখে আমি আর স্কুটার নিলাম না। শব্দে কারো কোনো কথা শোনা যাবে না।

রিক্সায় উঠে আমার চাকরির কথা, পুরনো বন্ধু, যারা এখানে আছে, তাদের কথা জিজ্ঞাসা করলো রবি।

বাড়ী তখনো কিছুদূরে। রবি আমার দিকে চাইলো, মনি, আমি তোমার মতো নই, তুমি জানো, কিছু ভেবো না, আমাকে নিয়ে যাবে, রীণার আপত্তি হবে না তো?

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, প্রথমেই জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিলো। আমরা তিনজন লোক। আমি, তুমি, রীণা। কিছু কিছু জায়গা ছেড়ে দিলে বোধ হয় সকলেরই চলে যাবে। রীণা জানে তুমি আসছো, তোমাকে বাসায় নিয়ে যাবো তাকে বলেছি। তবু, রীণা স্ত্রীলোক, তুমি কিছু মনে করো না।

রবি হেসে বললো, পাগল।

.

হাত-মুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে বসলে চাকরের হাতে চা-খাবার পাঠিয়ে দিলো রীণা। আমি জানতাম, সে সামনে আসবে না। সত্যকে হৃদয়ে ধারণ করার ক্ষমতা আদৌ তাৎক্ষণিক নয়। ব্যক্তিবিশেষে তার পার্থক্যও স্বীকৃত।

আমি পারতাম আরো দ্রুত সব কিছু সহজ করার চেষ্টা করতে। কিন্তু সে সব ফিল্মী কায়দা স্থায়ী হয় না। আমি রীণার হাত ধরে টেনে এই ঘরে এনে বলতে পারতাম, রবি, এই যে রীণা, এতোকাল যাকে চিনেছো সেই রীণা নয়, আমার স্ত্রী রীণা, বলতে পারতাম, অনর্থক তোমরা অপরিচিতের ভাণ করো না। স্মৃতি যে মানুষের কি সম্পদ আমরা সবাই জানি।

অথবা রবিকেই সঙ্গে করে নিয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে যেতে পারতাম, রীণা রবিকে দেখাও তুমি কি কি রান্না শিখেছে।

কিন্তু এই সবই ফিল্মী কায়দা। স্থায়ী হয় না।

তাহলে সহজ পথটা কি? আমি কি চাই যে আমার অন্যান্য বন্ধুর মতোই রবিকেও রীণা সৌজন্যে, আপ্যায়নে প্রীত করবে?

আমি ভেতরে গিয়ে রীণাকে বললাম, একটা নিঃশ্বাস চেপে রীণাকে বললাম, রবির সঙ্গে তোমার বোধ হয় একবার দেখা করা উচিত ছিলো।

মুখ না ফিরিয়ে মৃদু গলায় রীণা বললো, দেখা তো হবেই এক সময়। তাড়াতাড়ির কি আছে।

.

চাকরটাকে নিয়ে বাজারে বেরুবার মুখে রবি এসে দাঁড়ালো, চলো আমিও বাজারে যাই।

না, না, রাত জেগে এসেছে। তুমি বিশ্রাম করো।

আসলে আমার ভয় ছিলো, একসঙ্গে বাজারে বেরুলে পথে এতোক্ষণ কি কথা বলা যাবে। সে আসার আগে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা যেভাবে ভেবে রেখেছিলাম, সে ভাবে কিছুই ঘটছে না। এতো সহজে যে ঘটবে না, জানতাম। তবু যার সাথে কথা কোনো কালে শেষ হবে না বলে ভাবতাম, তাকে নিয়ে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়াও তো যায় না।

পথে প্রচুর ঘুম হয়েছে, বলে পায়ে জুতো গলিয়ে রবি তৈরী হয়ে দাঁড়ালো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো, তোমার মতো মনের জোর তো সবার না-ও থাকতে পারে, এ কথা ভুলে যেও না মনি। আস্তে আস্তে সইয়ে নিতে দাও।

পথে নেমে বললাম, মনের জোর-টোর কিছু নয়। বাইকে বেঁচে থাকতে হবে। গৃহধর্ম সন্তান পালন যাই বলো, সবই এর অঙ্গ। কিছু বাড়তি ডালপালা ঘেঁটে এই জীবনবৃক্ষটিকে একটু সোজা করে নিতে আপত্তি কি?

রবি বললো, ও সব কথা থাক মনি। আপত্তি থাকলে আমিই কি আর তোমার কাছে আসতাম?

.

দুপুরে খাওয়ার সময়ে অন্তত রীণা কাছে থাকবে ভেবেছিলাম। সে রকম কোনো আভাস পেলাম না। ফলে, ক্রমেই শংকিত হয়ে উঠছিলাম। শংকা এই জন্যে যে, রবিকে যদি এমন অবস্থার মধ্যে পুরো দিন কাটাতে হয়, সে সত্যিই হোটেলে গিয়ে উঠবে। আর আমি যে জন্যে তাকে ডেকে এনেছি, সহজ মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেবো বলে আমার যে উদ্যম, তারই বা কি হবে?

অথবা আমি যেভাবে মানুষের অনুভবগুলিকে ওজন করতে চাই, কেউ তা করে না। হয়তো আমি নিজেই যা করছি তার সাফল্যে বিশ্বাসী নই।

তবু এ-ভাবে ছেড়ে দেয়া যায় না। পৃথিবী বিশাল হয়তো। কিন্তু আমাদের এই চারপাশ বন্ধ, ছোটো দম-আটকানো দেশ, খোলা হাওয়া তার কোনো জানালা দিয়েই ঢুকতে চায় না। অতএব ছোটো ফাঁকগুলো বন্ধ করে লাভ কি?

আমি আরও ভেবেছিলাম, সবই এমন কিছু দু’য়ে দু’য়ে চার হয়ে যায় না। অংকের বাইরেও কিছু রয়ে গেছে সন্দেহ কি?

আরও ভেবেছিলাম, রবি এবং রীণা যদি তাদের অবস্থান মেনে নেয়, তাতে আমারই সুখ। পুরনো প্রথা, সংস্কার এমনকি পুরনো ধরনের অনুভূতিগুলোও কি কিছু পালটে দেয়া যায় না?

তারও চেয়ে বড়ো কথা, রবির সঙ্গে আমার হৃদ্যতা শেষ হয়ে যাক, আমি চাইনি। এমন ক্ষেত্রে যা হয় তেমন করে দূরে সরে যাওয়া এবং কদাচিৎ মুখোমুখি হলে না-দেখার ভাণ করা, অথবা কষ্টে মুখে হাসি ফোঁটানো, এর কোনোটাই আমি চাইনি।

রীণাকে এ কথাই বোঝাতে চেষ্টা করেছি। অতীতকে ভুলে যাও বলবো এত বড়ো মুখ নই, বু মানুষ তো পরিবর্তিত অবস্থার দাস।

সব বুঝেও রীণা বলেছে, কি জানি, বুঝি না, মানুষের দূর্বলতার ওপরে তুমি কি করে যাবে।

খাওয়ার টেবিলে বসার আগে রীণাকে বললাম, তুমি কি এখনও ওর সামনে। যাবে না ভাবছো?

রীণা স্থির চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইলো, তুমি খুব স্পষ্টতা পছন্দ করো মনি, তোমার কাছে এসে আমিও করতে শিখছি। আচ্ছা ধরো রবিকে দেখে, তার কথা শুনে তোমরা যাকে সেলফ বলো, সেই পুরনো সেল যদি আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়। বিবর্ণ আমি হেসে বললাম, তাকে বাধা দেবো না— সেই শক্তি কারো থাকে না।

রীণা আমার মুখ থেকে চোখ নামালো না, তার দরকারও হবে না, তবু তোমার মতো অতে তাড়াতাড়ি এগুতে আমি পারি না।

রীণা কি ইচ্ছা করে আমায় ধুলোয় টেনে নামাতে চাইছে? আর শোনো, এখন আমাদের ব্যক্তিগত কথাবার্তা কিছু কমালে ভালো হতো।

আমি মলিন মুখে বললাম, আমিও তোমায় তাই বলবো ভাবছিলাম।

.

বিকেলে, বাইরে বেরুনোর আগে রবি বললো, মনি, হোটেলে একটা জায়গা করে নিলে হতো না?

আমি ভেবে বললাম, এত অল্পে ছেড়ে দেবো না রবি, আরও দেখা যাক। তুমি কি খুবই বিব্রত হচ্ছো?

রবি আগের দিনের মতো হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, পাগল। চিয়ার আপ ওল্ড বয়। উইশ ইউ সাসেস।

সারাদিনে একবার হাসতে পেরে আমি বেঁচে গেলাম।

.

পুরনো দু’একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে রবি শহরের অন্য মাথায় চলে গেলে আমি একবার বাসায় ফেরার কথা ভেবেছিলাম। রীণার কথা ভেবে অন্য পথে নেমে গেলাম। অথচ হাতে কোন জরুরী কাজ ছিলো না, কারো সঙ্গে দেখা করার কথা ছিলো না। অন্যদিন এমন অবস্থায় হয়তো বাসায়ই ফিরে যেতাম। হয়তো রীণাকে নিয়ে বাইরে বেরুতাম।

লক্ষ্যহীন, একা একা সেই সব পথে ঘুরে বেড়ালাম যে পথে আমি, রবি, রীণা সকলেই পায়ের দাগ রেখে গেছি।

রীণার কথা ভাবছিলাম সে আমাকে কেননা ধূলোয় টেনে নামাতে চাইবে? যা স্বাভাবিক, যা ঘটে যায়, যা ঘটবে, যা আমরা সবাই জানি তাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে লাভ কি?

রবির ফিরতে রাত হবে, সে বলে গেছিলো। আমি আর কাঁহাতক একা একা পথে ঘুরবো?

রাস্তায় সেদিন আলো ছিল না। কেবল দু’পাশের বাড়ীর জানালায় পরদা দেখা যায়।

বাগানের দরজা খোলা ছিল, নিঃশব্দে ঢুকে গেলাম। দেখলাম রবির ঘরে আলো। সে তাহলে আমার আগেই পৌঁছে গেছে।

বাগানের ঠাণ্ডা হাওয়া অকস্মাৎ কয়েকটা ঝাঁপটা দিয়ে গেলো। সমস্ত শরীর ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে আসতে চায়। অথচ বিকেলে বেরুনোর সময় শীত লাগছিলো না বলে গরম কাপড় বেশী নিইনি।

ওরা আসলে আমার অনুপস্থিতিই চাইছিলো। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নেবার প্রয়োজন তো আমিও অস্বীকার করিনি, তাহলে আমার অনুপস্থিতি এতো কাম্য কেননা?

খোলা দরজা দিয়ে রীণার পেছন দিক দেখা যাচ্ছিলো কেবল। একবার ভাবলাম, ফিরে যাই। না, ফিরবো কেননা—যা ঘটে, যা ঘটবে, তাকে তুমি রোধ করতে পারো না, ঘুরে যাওয়া চাকাকে থামাবে কে? দরজার গোড়ায় শব্দ করে ঘরে ঢুকে গেলাম। রীণা চমকে ফিরে দাঁড়ালো। তার হাতের জিনিসপত্র দেখে বুঝলাম সে বিছানা গোছাতে এসেছে। ঘরে রবি নেই। সে তখনো ফেরেনি।

কপালে অল্প ঘাম ছিলো বোধ হয়। রীণা দ্রুত কাছে এসে, বুকের কাছে এসে, কপালে হাত রাখলো, এ রকম দেখাচ্ছে, শরীর খারাপ করলো না তো?

খাটের ওপরে বসলাম। বসে অনেকক্ষণ বসে, থেকে বললাম, না, রীণা, দুর্বলতা সহজে যায় না তো।

নিশ্চিন্ত হয়ে রীণা কি একটু ভাবলো, বললো, দেখো, ভাবছি, রবি যে ক’দিন আছে তোমরা দুজন এ ঘরেই শোবে।

আমি কৃতজ্ঞতায় তার হাত চেপে ধরে বললাম, আমিও তাই ভেবেছি।

রাতে খাওয়ার সময় রীণা আমাদের সঙ্গে ছিলো। শিষ্টাচার, কিছু হাল্কা কথা দিয়ে দ্রুতধাবী চাকাকে থামাতে চাইলাম আমরা। সু কিছুই সহজ হলো না সে-ও বোঝা গেলো।

শোয়ার সময় লেপ হাতে নিয়ে পাশের খাটে এলে রবি আদৌ বিস্মিত হয় না।

তার মুখে হাসির আভাস ছিলো।

বাতি নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। বললাম, রবি, আজ আর বেশী কথা নয়, ঘুমিয়ে পড়ো। রাতে তোমার ভালো ঘুম হওয়া দরকার। আমারও কাল ভোরে আপিসে ছুটতে হবে।

দেয়াল থেকে ঘড়ির আওয়াজ ভেসে আসছিলো।

অনেক পরে হঠাৎ রবি শব্দ করে হেসে উঠলো।

বিস্মিত আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আরে, কি ব্যাপার!

অন্ধকারে রবির গলা ভেসে এলো, আচ্ছা, আমরা আর কতোদিন বাঁচবো, মনি?

ভালো করে লেপ গায়ে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলাম। বললাম, আরো অনেক দিন রবি। এমনি সব দিন রাত্রি পা করে আরও অনেক দিন আমাদের বাঁচতে হবে।

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments