Friday, March 29, 2024
Homeবাণী-কথাঅনুবাদ গল্পআজব পোশাক - সিলভিয়া প্লাথ

আজব পোশাক – সিলভিয়া প্লাথ

আজব পোশাক - সিলভিয়া প্লাথ

ম্যাক্স নামে ছোট্ট এক ছেলে বাস করতো ছোট্ট এক পাহাড়ি গ্রামে। গ্রামের নাম উইঙ্কেলবার্গ। একটা খাড়া পাহাড়ের অর্ধেক জুড়ে ছিলো উইঙ্কেলবার্গ। সে পাহাড়ে আছে তিনটা চূড়া। শীত-গ্রীষ্ম সারা বছরই ওই তিন চূড়ায় টুপির মতো করে বরফ জমে থাকে।

ম্যাক্সের পারিবারিক পদবি ‘নিক্স’। নিক্স পরিবারে আছে ম্যাক্সের বাবা-মা ও আরও ছয় ভাই। ম্যাক্সের বয়স সাত বছর এবং ভাইদের মধ্যে সে সবার ছোট। বড় ভাইয়ের নাম পল, সে ছিলো সবার চেয়ে লম্বা। তারপর ইমেইল। তারপর একে একে অটো, ওয়াল্টার, হুগো ও জোহান।

ম্যাক্সের পুরো নাম ম্যাক্সিমিলান। কিন্তু বয়সে সে ছোট বলে সবাই মনে করতো এতো বড় নাম তার দরকার নেই। তাই নামটাও ছোট করে সবাই ডাকতো ‘ম্যাক্স’।

একদিন সত্যি সত্যি এক ডাকপিয়ন এলো নিক্সদের বাড়িতে, একটা বাদামি রঙের বাক্স দিয়ে গেলো। কিন্তু বাক্সের গায়ে ঠিকানা গিয়েছিলো ভিজে, কেবল একটা শব্দ পড়া যাচ্ছিলো- ‘নিক্স’।

নিক্স পরিবারের সবারই আলাদা জামা ছিলো, কেবল ছিলো না ম্যাক্সের। এজন্য তার মনে অনেক দুঃখ। ম্যাক্সের খুব ইচ্ছে নতুন একটা জামা পরার। উইঙ্কেলবার্গের শিশুরা যেসব সুন্দর সুন্দর জামা-কাপড় পড়তো ম্যাক্স সেগুলোর দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতো, আর ভাবতো- আহা, আমারও যদি এমন একটা জামা থাকতো!

কিন্তু ম্যাক্স কোনো সাধারণ জামা চায় না। সে চায় এমন এক জামা যা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সারা বছরই পরা যাবে। গায়ে দিয়ে স্কুলে যাওয়া যাবে, খেলাধুলা থেকে শুরু করে সব কিছুই করা যাবে। শুধু তাই নয়, জামাটা হতে হবে অনেক সুন্দর ও আকর্ষণীয়।

কিন্তু তা কী করে সম্ভব? হ্যাঁ একভাবে সম্ভব, সেটা হলো স্বপ্ন দেখা। ম্যাক্স স্বপ্ন দেখা শুরু করলো, তাদের বাড়িতে এসে পৌঁছে গেছে এক রহস্যময় জামা। একদিন সত্যি সত্যি এক ডাকপিয়ন এলো নিক্সদের বাড়িতে, একটা বাদামি রঙের বাক্স দিয়ে গেলো। কিন্তু বাক্সের গায়ে ঠিকানা গিয়েছিলো ভিজে, কেবল একটা শব্দ পড়া যাচ্ছিলো- ‘নিক্স’। তাই বাক্সটা ঠিক কার জন্য পাঠানো হয়েছে বা কে কোথা থেকে পাঠিয়েছে কিছুই বুঝা যাচ্ছিলো না। কেউ বুঝতে পারছিলো না এর ভেতরই বা কী আছে! নিক্স পরিবারের সবার উৎসাহ এবার বাক্স ঘিরে, কী আছে এর ভেতর!

যখন বাক্সটা খোলা হলো ভেতরে পাওয়া গেলো আজব এক পোশাক। পশমি, পেছল আর চকচকা সরষে হলুদ রঙের এক জামা। সেই জামায় পিতলের তিনটা বোতাম আছে।

costume

জামা পেয়ে ম্যাক্সের বাবা মিস্টার নিক্স অনেক খুশি হলেন। তিনি আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন প্রায়, আর ভাবলেন আগামীকাল ব্যাংকে অফিস করতে তিনি এই জামা পরে যাবেন। কিন্তু এটা তিনি কীভাবে গায়ে দেবেন তাই ভাবছিলেন। কেননা এমন জামা তিনি তো নয়ই, উইঙ্কেলবার্গের কোনো বাসিন্দাই আগে দেখেনি। অনেক ভেবে মিস্টার নিক্স সিদ্ধান্ত নিলেন এমন চকচকা হলুদে জামা পরে অফিস যাওয়া ঠিক হবে না। ছেলেদের ডেকে তিনি বললেন, ‘এই জামাটা আমার জন্য নয়, এটা আসলে তোমাদের।’

তারপর বড় ছেলে পলকে দেওয়া হলো জামাটা পরতে। কিন্তু পলের গায়ে জামা আঁটছিলো না, পরতে গিয়ে বেশ কিছু জায়গায় কাঁচিকাটা করতে হলো আর জামাটা পরার পর পলকে দেখাচ্ছিলো বাংলা ‘ট’ এর মতো। কোনোরকম ঠেসেঠুসে জামা গায়ে গলিয়ে সে ভাবলো- আগামীকাল আমি এটা পরে স্কিইং করতে যাবো। কিন্তু উইঙ্কেলবার্গের কোনো বাসিন্দাই আগে দেখেনি এমন চকচকা জামা, পলের বন্ধুরাও আগে কেউ এমন হলদে জামা পরেনি। তাই পল তার অন্য ভাইদের ডেকে বললো, ‘এই জামাটা আমার জন্য নয়, এটা আসলে তোমাদের।’

তারপর জামা পরতে দেওয়া হলো ইমেইলকে। তার গায়েও জামা আঁটছিলো না। তারপর দেওয়া হলো অটোকে। অটো ইমেইলের মতো লম্বা ছিলো, কিন্তু তার কাঁধ খুব চওড়া ছিলো না। দেখা গেলো অটোর কাঁধের দুই দিকেই জামা ঝুলে আছে। কিন্তু মিসেস নিক্স ওই জায়গাগুলো তাপ্পি দিয়ে সেলাই করে দিলেন। যখন টেনেটুনে জামাটা গায়ে দেওয়া হলো, অটোকে দেখাচ্ছিলো বাংলা ‘ট’ এর মতো।

সেই যে একবার জামা গায়ে দিলো তারপর ওই জামা আর কখনও গা থেকে খোলেনি ম্যাক্স। সে জামা পরেই স্কুলে যায়, মাছ ধরতে যায়, সাইকেল চড়ে, খাড়া ঢাল থেকে নামে, গাভীর দুধ দোহন করে, শিকার করতে যায়, আরও কতো কী!

তারপর আরও দুই ভাই ওয়াল্টার ও হুগো জামা গায়ে দিতে চাইলো, কিন্তু হলো না। কারো হাতা ছোট হয়ে যায়, কারো গলায় আটকে যায়, কারো লম্বায় ছোট হয় ইত্যাদি। শেষে আজব এই পোশাক দেওয়া হলো জোহানকে। জোহান ছিলো নিক্স ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বেটে আর হুগোর চেয়ে আরেকটু গোলগাল। সে যখন জামা গায়ে দিলো মিসেস নিক্স জামার এইখানে একটু কাঁচি কেটে দেন তো ওইখানে একটু সেফটিপিন এঁটে দেন। তারপরও হচ্ছে না দেখে বোতামগুলো খুলে নিয়ে লাগিয়ে দিলেন জামার পেছনে। জোহান যখন টেনেটুনে জামাটা পরলো, তাকে দেখাচ্ছিলো বাংলা ‘ট’ এর মতো। সে বললো, ‘এই জামাটা আমার জন্য নয়, এটা আসলে কার জন্য বানানো হয়েছে জানি না।’

এভাবে মিসেস নিক্স জামাটা কাঁচি দিয়ে কেটে, সেলাই করে, পট্টি মেরে বা বোতামগুলো সরিয়ে নানাভাবে দেখলেন আসলে কার গায়ে আঁটে! কিন্তু কারও গায়েই হলো না। এখন নিক্স পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ম্যাক্সের পালা। সে ছিলো তার সব ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে পাতলা। দেখা গেলো ম্যাক্সের শরীরেই মাপ মতো হয়েছে আজব জামা। হুররে! মনে হচ্ছে এটা কোনো দর্জিবাড়ি থেকে ম্যাক্সের জন্যই ফরমায়েশ দিয়ে বানানো! ম্যাক্স বললো, আমি আজ এই জামাটা পরে থাকবো। আগামীকালও এই জামা পরবো। তার পরদিনও এই জামা পরে থাকবো।

সেই যে একবার জামা গায়ে দিলো তারপর ওই জামা আর কখনও গা থেকে খোলেনি ম্যাক্স। সে জামা পরেই স্কুলে যায়, মাছ ধরতে যায়, সাইকেলে চড়ে, খাড়া ঢাল থেকে নামে, গাভীর দুধ দোহন করে, শিকার করতে যায়, আরও কতো কী! আর সে যেখানেই যাচ্ছিলো সবাই তার প্রশংসা করছিলো। রাস্তার লোকজন যারা তাকে চেনে না, তারাও মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলছিলো, ‘বাহ, কি সুন্দর জামা!’

ম্যাক্স যখন আজব জামা পরে স্কুলে গেলো সব শিশু তাকে ঘিরে ধরলো। সবার একটাই ইচ্ছা- তারাও এমন একটা জামা গায়ে জড়াতে চায়। অন্য শিশুরা চারপাশ থেকে ম্যাক্সকে ঘিরে ধরলো।

আজব জামা পরে ম্যাক্স গেলো শেয়াল শিকার করতে। একটা শেয়াল গাছের আড়ালে লুকিয়ে দূর থেকে দেখছিলো, সে ভাবলো এটা নিশ্চয়ই কোনো মোটাসোটা হলদে মোরগ। ভাবতেই শেয়ালের জিভে জল এসে গেলো আর মোরগ ধরার জন্য দৌড়ে এলো। আর যেই না শেয়াল কাছে এলো এমনি তাকে খপ করে ধরে ফেললো ম্যাক্স। শেয়াল ধরতে গিয়ে জামার পিতলের একটা বোতাম খুলে হারিয়ে গেলো। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই আবার সেটাকে খুঁজে পাওয়া গেলো। কারণ অন্ধকার বনে জংলার মধ্যে বোতামটা তারার মতোই জ্বলজ্বল করছিলো।

তারপর আজব পোশাক পরে ম্যাক্স বাড়ি থেকে বের হলো। তাকে দেখে সরু অলিগলি থেকে ছুটে এলো বেড়ালের পাল, পাথর বাঁধানো বড়সড় রাস্তা থেকে দৌড়ে এলো কুকুরের দল।

তারপর আজব পোশাক পরে ম্যাক্স গেলো বরফে মাছ ধরতে। বরফের তলে শীতল জলের ভেতর থেকে মাছেরা ভেসে এলো এমন হলদে জামা দেখার জন্য, ওপরে কী চকচক করছে ওটা? আর যখনই মাছেরা ওপরে উঠে এলো অমনি তাদের ধরে রাতের খাবারের জন্য থলের মধ্যে ভরলো ম্যাক্স। কিছু কিছু মাছকে আজব জামা দিয়ে ঘিরে নিয়ে ওপরে তুলছিলো ম্যাক্স। কিন্তু মাছেদের সেদিকে খেয়াল ছিলো না, তারা ম্যাক্সের জামার প্রশংসায় ব্যস্ত।

আজব পোশাক পরে ম্যাক্স বাই-সাইকেল চালাতে গেলো। কিন্তু পথিমধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি। কিন্তু জামা অনেক পেছল ছিলো বলে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ঝরে পড়ে যাচ্ছিলো। হাঁসেদের পাখনা থেকে যেভাবে টুপটুপ করে পানি ঝরে অনেকটা সেরকম।

তারপর আজব পোশাক পরে ম্যাক্স বাড়ি থেকে বের হলো। তাকে দেখে সরু অলিগলি থেকে ছুটে এলো বেড়ালের পাল, পাথর বাঁধানো বড়সড় রাস্তা থেকে দৌড়ে এলো কুকুরের দল। বেড়ালগুলো মিউ মিউ করে আর কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে ম্যাক্সের জামার প্রশংসা করতে করতে পেছনে ছুটতে লাগলো।

ম্যাক্স ছুটে যাচ্ছে পাহাড়ি গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত, তার পেছনে বেড়াল-কুকুর- আর ছোট্ট শিশুর দল। তারা বলছিলো- চমৎকার জামা, পশমী জামা, চকচকে জামা, একেবারে নতুন জামা, সরষে রঙের জামা…। আসলে কি উইঙ্কেলবার্গের কেউই এমন পোশাক আগে দেখেনি বা পরেনি বলে এটাকে ‘আজব’ মনে হচ্ছিলো সবার, আসলেই এটা ছিলো সুন্দর জামা।

অনুবাদ: মাজহার সরকার

Anuprerona
Anupreronahttps://www.anuperona.com
Read your favourite literature free forever on our blogging platform.
RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments